ষড়যন্ত্র – গোবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
যেন একটা সাপের ছোবল খেলেন আচমকা রাউন্ড অফিসার। চমকে উঠলেন সেই মুহূর্তে। বন্ধ করা লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিটা ঘরের মধ্যে সঞ্চালিত করলেন। পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠলেন অসংযত জ্বালা নিয়ে ; ওয়ার্ডার! —
জমাদার রামলোচন সিং পাহারায় ছিল, পায়চারি করছিল বারান্দার একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত—চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে এল ওঁর সামনে।
ওকে আমল না দিয়েই রাউন্ড-অফিসার আবার চিৎকার করে ডাকলেন : ওয়ার্ডার! —
প্রথম চিৎকার-ধ্বনিটা ওয়ার্ডারের কানে গিয়েছিল, দ্বিতীয় আওয়াজটা উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ার্ডার ওঁর সামনে এসে থমকে দাঁড়াল—বোকা বোকা চোখে তাকাল।
—সেলের দরজাটা খোলো শিগগির। নির্দেশ বেরিয়ে এল রাউন্ড অফিসারের অস্বাভাবিক কণ্ঠ থেকে।
কম্পিত হাতে চাবির গোছাটা পকেট থেকে বের করল ওয়ার্ডার, তালার মুখবিবরে একটা চাবি প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সেলের মধ্যে দৃষ্টি ছেড়ে দিল। কেঁপে উঠল ও, ঝড়-বৃষ্টির শীর্ণ পত্রদলের মতো।
চল্লিশ নম্বর সেলের আসামীর গলায় দড়ির ফাঁস-বাঁধা, ঝুলছে।
দরজা খোলা হলে দ্রুত-অস্থির পায়ে সেলের মধ্যে প্রবেশ করল তিনজনে।
সেলের কড়িকাঠের সঙ্গে দড়ির একটা প্রান্ত যুক্ত করে অন্য প্রান্তটায় লাগানো ফাঁস দিয়ে আসামীর নিজের গলায় বাঁধা। মেঝে থেকে এক হাত উঁচুতে ওর পা-দুটো ঝুলছিল।
ওয়ার্ডার তৎক্ষণাৎ জমাদারের কাঁধের ওপর উঠে কড়িকাঠে যুক্ত করা দড়ির অপর প্রান্ত ছুরির সাহায্যে কেটে দিল।
ধপ করে শব্দ তুলে মেঝেয় পড়ে গেল আসামী।
কিন্তু তখনো ওর প্রাণের দীপ-শিখাটিকে উতলা বাতাস পরম পরিহাসে নিভিয়ে দিতে পারেনি।
ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল তার। বুকটা হাপরের মত ওঠা-নামা করছিল।
রাউন্ড অফিসার ওয়ার্ডারকে বললেন, ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনো।
ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে ওয়ার্ডার সেল থেকে বেরিয়ে গেল। জমাদার তার আগেই সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবকে খবর দিতে ছুটেছিল।
আসামীর মাথার কাছ ঘেঁষে হাঁটু গেড়ে বসলেন রাউন্ড অফিসার, ওর মুখের ওপরে দৃষ্টিটা কেন্দ্রীভূত করলেন।
সেলের ঠিক পেছনেই সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর কোয়ার্টার থেকে রেডিওতে গান হচ্ছিল। গানের কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল এখান থেকে :
ওরে ও ভোলা মন
তুই লোভ মোহ আর লালসাতে
হারালিরে আসল রতন⋯·
হঠাৎ চোখদুটো আস্তে আস্তে খুলে গেল আসামীর, ঠোঁটদুটো প্রাণপণে প্রসারিত করতে চাইল।
রাউন্ড অফিসার বলে উঠলেন, কেমন বুঝছো?
বিয়োগান্ত নাটকের করুণ নায়কের মত বিষাদের হাসি হাসল আসামী। তারপর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা সজোরে কামড়ে ধরে বলল, ছিঁড়ল না!
অদ্ভুত একটা চাপা গলায় রাউন্ড অফিসার বলল, ছিঁড়ল না?
না, ছিঁড়ল না। ক্লান্ত আর নির্জীব কণ্ঠে কথাটা বেরিয়ে এল আসামীর মুখ থেকে। চোখদুটো বুজে গেল, মাথাটা ঢলে পড়ল একদিকে।
চোয়ালটা হঠাৎ ঝুলে পড়ে রাউন্ড অফিসারের, শাণিত শিকারীর দৃষ্টি মুহূর্তে ঘোলাটে হয়ে যায়।
পেছন থেকে গান ভেসে আসে :
ফাঁসির দড়ি নিয়ে গলায়
দিলি রে তুই আপন বিলায়
হৃদয়-বীণার তার ছিঁড়িল।
ছিঁড়িল রে তোর মনের বাঁধন।
রাউন্ড অফিসারের বিধ্বস্ত মনে পঙ্গপালের মত এসে ভিড় করে এলোমেলো চিন্তা। কয়েক মুহূর্ত পরে সেখানে এসে হাজির হন সুপারিন্টেন্ডেন্ট, চীফ ওয়ার্ডার, সেল-ব্লকের মেট এবং জেলের ডাক্তার মন্মথ পাইন।
আসামীকে পরীক্ষা করেন মন্মথ পাইন। শেষে বেদনায় গলার স্বর ভারী করে জানান, দুঃখিত, মারা গেছে।
গানটা কিন্তু তখনো শেষ হয়ে যায়নি! সুরের সুষমাধারা উছলে পড়ছিল নিস্তব্ধ পরিবেশে। একটা বেদনার অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছিল সুরের মধ্যে এক উদার-করুণ স্নিগ্ধতায়।।
খবর পেয়ে রামেশ্বর চৌধুরী যখন এলেন, তখন জায়গাটায় কয়েকজন জেলের কর্মচারীর আগমন হয়েছিল।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর্থার জোন্স একখানা হাত প্রসারিত করে দিলেন মৃতের দিকে। পর্যবেক্ষণের ভঙ্গিতে রামেশ্বর চৌধুরী নির্বাক চোখে মৃত ব্যক্তির আপাদমস্তক দেখলেন।
মৃতের মুখখানায় একটা শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব, জ্বালা-যন্ত্রণার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। দীর্ঘ-শ্যাম, সুশ্রী চেহারা। কালো চুলের ঢেউ মসৃণ কপাল থেকে ঘাড়ের ঢালু পর্যন্ত প্রসারিত।
সেদিকে তাকিয়ে রইলেন রামেশ্বর চৌধুরী। ওঁর সমস্ত শিরা-স্নায়ুতে একটা অসহায়তার রেশ ছড়িয়ে পড়ল, মস্তিষ্কটা মনে হল যেন পাথরের পিণ্ড।
আর্থার জোন্সের অফিস-ঘরে এসে রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, আমার মক্কেল নীহার ঘোষ এভাবে আত্মঘাতী হবে, ভাবতেই পারিনি।
আর্থার জোন্স চেয়ারের পেছনে পিঠটা সামান্য ছেড়ে দিয়ে বললেন, ঘটনাটা আমাদেরও বেশ খানিকটা অবাক করেছে। আপনার মক্কেলকে আজ খুব খুশী খুশী দেখছি। ক’দিন থেকে নীহার ঘোষ রাত্রের খাবার খাচ্ছিল না। আজ কিন্তু খেয়েছিল। অথচ কী এমন ঘটল—
কথাটা ইচ্ছে করেই উনি শেষ করলেন না।
মৃদু কণ্ঠে রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, গতকাল সন্ধ্যাবেলায় ফোনে আপনাদের যা জানিয়েছিলাম, নীহাররঞ্জনকে বলেছিলেন?
আর্থার জোন্স বললেন, হাইকোর্ট থেকে ওঁর পুনর্বিচারের আদেশ হয়েছে শুনে উনি খুব খুশি হন। আমি নিজে গিয়ে ওঁকে সংবাদটা জানিয়ে এসেছি। নেভার স এ ম্যান সো হ্যাপি ইন মাই লাইফ।
ডাঃ মন্মথ পাইন এতক্ষণ ওঁদের একপাশে বসেছিলেন নীরবে—এবারে মুখ খুললেন : আসলে কিন্তু নীহাররঞ্জনের মনের অবস্থাটা স্থির ছিল না। আপনার বোধ হয় মনে আছে মিঃ জোন্স, দিনকয়েক আগে ওকে জেল-হাসপাতালে পাঠাবার জন্যে আমি আপনার কাছে সুপারিশ করেছিলাম। নেহাৎ জেল-হাসপাতাল থেকে দুজন কয়েদী কিছুদিন আগে পালায়, তাই আমার সুপারিশে আপনারা সেদিন কান দেননি। গত রাত্রে যখন আমি ওকে দেখে যাই তখন ওকে আমার কেমন যেন মনে হল। আজ সকালে ওর সমগ্র মুখখানায় যেন বিষাদের ভাব ছিল। তবে মস্তিষ্ক বিকৃতির কোন লক্ষণ দেখতে পাইনি। আই অনলি মেন্ট হি ওয়াজ সাবজেক্ট টু মুডস।
ওঁর পানে তাকিয়ে রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, আপনি ওর সেলে দিনে অনেকবার যেতেন?
—আপনি হয়ত জানেন না নীহার ঘোষ সাংঘাতিকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় ভুগছিল। এখানকার ডাক্তার হিসেবে ওকে দেখাটা আমার কর্তব্যের মধ্যে ছিল। কিন্তু পুনর্বিচারের আদেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে ও আত্মহত্যা করল, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ভালো কথা, কানাঘুষোয় শুনছি আপনার ভাইঝি করবী পাইনের সঙ্গে ওর বিয়ের কথাবার্তা একরকম ঠিক হয়ে আছে। ঠিক বলছি?
ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানালেন মন্মথ পাইন।
—একটা কথা মিস্টার জোন্স।—রামেশ্বর চৌধুরী আর্থার জোন্সের মুখের ওপরে চোখ রেখে বললেন, নীহাররঞ্জন ফাঁসির আসামী ; ধরে নিলাম না হয় এক সময়ে উত্তেজিত অবস্থায় দড়ির ফাঁস গলায় লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এখন আমার বক্তব্য হল, দড়িটা ও গেল কোথা থেকে?
ভুরু কুটিল করে আর্থার জোন্স বললেন, আমারও সেই এক কথা। আমিও ওই কথাই ভাবছি। গতকাল সন্ধ্যাবেলায় যে লোকটা নীহাররঞ্জনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসে, সে-ই হয়তো দড়ি দিয়ে গেছে।
—ভদ্রলোকের পরিচয়?
—রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীর সেক্রেটারী তমোনাশ কোলে।
ঠোঁট চেপে যায় রামেশ্বর চৌধুরীর—কঠিন মুখে বলেন, কোন্ রামেন্দ্র চক্রবর্তী! ম্যাক্সিম হোটেলের মালিক রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী?
—আপনার অনুমান যথার্থ।
—রামেন্দ্রনারায়ণ তো একজন নামকরা জুয়াড়ী। কথাটা আচমকা বেরিয়ে আসে রামেশ্বর চৌধুরীর মুখ থেকে।
গম্ভীর গলায় আর্থার জোন্স বলেন, তাতেই তো তমোনাশ কোলের ওপরে আমার যত সন্দেহ। তদন্ত শুরু হলে সব কিছুই তখন জানা যাবে।
—নীহাররঞ্জনের মৃত্যুর আগে ‘ছিঁড়ল না’—ওর এই কথাটার তাৎপর্য আপনারা ধরতে পেরেছেন?
—এক মিনিট। আর্থার জোন্স বেল টিপলেন।
একজন জমাদার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। রাউন্ড অফিসার চিত্তরঞ্জন সরকারকে ডেকে আনবার জন্য উনি ওকে নির্দেশ দিলেন।
জমাদার প্রস্থান করল।
নামল নীরবতা। কতকগুলো মুহূর্ত কেটে গেল।
একসময়ে সুইং ডোর ঠেলে চিত্তরঞ্জন সরকার ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সুন্দর সরল লম্বা চেহারা। উন্নত নাসা। দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বুদ্ধির পরিচয় পরিস্ফুট।
এখানকার রাউন্ড অফিসার উনি। উনিই সর্বপ্রথমে নীহাররঞ্জনের অস্বাভাবিক দেহ আবিষ্কার করেন।
আর্থার জোন্সের প্রশ্নে ভদ্রলোক জানালেন, রোজকারের মত আজ উনি সেল পরিদর্শনে গিয়ে চল্লিশ নম্বর সেলের ভেতরের দিকে তাকাতেই নীহাররঞ্জনবাবুকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন এবং চিৎকার করে ওয়ার্ডারকে ডাকেন।
—নীহাররঞ্জনবাবুর শেষ কথাটা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়েছিল?—আর্থার জোন্স প্রশ্নের তীর ছুঁড়লেন।
—‘ছিঁড়ল না’ সম্পর্কে?
—হ্যাঁ।
—একটা গান····।
—গান? উৎকণ্ঠ আবেগে বলে ফেললেন আর্থার জোন্স।
শান্ত গলায় চিত্তরঞ্জন সরকার বললেন, একটা বাংলা গান। গানটা আপনার কোয়ার্টারে রেডিওতে হচ্ছিল। সেল-ইয়ার্ডে আমার যাবার আগে থেকেই গানটা হচ্ছিল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রামেশ্বর চৌধুরী বলে উঠলেন : গানের কথাগুলো আপনার মনে আছে?
—সব ঠিক মনে করতে পারব না। তবে দুটো পঙ্ক্তি আমার মনে আছে।
—কি রকম?
চিত্তরঞ্জন সরকার বললেন, পঙ্ক্তিদুটো এই রকমের :
ওরে ও ভোলা মন
তুই লোভ মোহ আর লালসাতে
হারালিরে আসল রতন।
ফাঁসির দড়ি নিয়ে গলায়
দিলি রে তুই আপন বিলায়
হৃদয়-বীণার তার ছিঁড়িল
ছিঁড়িল রে তোর মনের বাঁধন।
রামেশ্বর চৌধুরী আপন মনে বললেন, এই গানের কোন কথার সঙ্গে নীহাররঞ্জনের শেষ কথাটার যোগাযোগ আছে? এবারে আর্থার জোন্সের দিকে তাকিয়ে রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, কিছু মনে করবেন না মিস্টার জোন্স, আপনার কোয়ার্টারে বাংলা গান—?
একটু হাসলেন আর্থার জোন্স : আমার স্ত্রী বাঙালী।
—ওঃ। রামেশ্বর চৌধুরী ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। তারপর উনি যাবার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
—মিস্টার চৌধুরী!
রামেশ্বর চৌধুরী কয়েক পা এগিয়েছিলেন, আর্থার জোন্সের ডাকে ঘুরে দাঁড়ালেন। অর্থহীন শূন্য দৃষ্টি ফেললেন বিহ্বলের মত।
আর্থার জোন্স বললেন, নীহাররঞ্জনবাবুর মৃতদেহটা নিয়ে যাবার পরে আমরা ওই সেলের ভদ্রলোকের বিছানার নিচে থেকে একটা এনভেলাপ পেয়েছি। এনভেলাপের মধ্যে একটা চিঠি ছিল। চিঠিসমেত এনভেলাপ আর দড়িটা আমার ধারণায় গতকাল কেউ নীহাররঞ্জনবাবুকে দিয়ে যেতে পারে না। কেননা, ওঁর কম্বলটা গতরাত্রে বদলে দেওয়া হয়। গতরাত্রে ও-দুটো জিনিস চল্লিশ নম্বর সেলে দিয়ে গেলে ওয়ার্ডারের নজরে পড়ত নিশ্চয়। তাছাড়া ওই সেলে কোন কিছু লুকিয়ে রাখবার মত তেমন জায়গাও নেই।
—চিঠিটা আমাকে একবার দেখাতে পারেন?
—তেমন অসুবিধা আছে বলে মনে করি না।
আর্থার জোন্স পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করে রামেশ্বর চৌধুরীর হাতে তুলে দিলেন।
এনভেলাপের ওপরে ‘নীহাররঞ্জন ঘোষ’ এই কথাটা ইংরাজীতে লেখা ছিল। রামেশ্বর চৌধুরী এনভেলাপের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করলেন। লেখা ছিল :
প্রিয় নীহার, বিশেষ বিপদে পড়েছি, তাই চিঠিটা আমাকে এভাবে পাঠাতে হল। তোমাকে আমার প্রয়োজন। এ বিপদে তুমি ছাড়া আমাকে আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তোমার পুনর্বিচারের আদেশ হয়েছে, আমি জানি। তবে এক সপ্তাহ পরে হলে ভয়ানক দেরি হয়ে যাবে। কোনভাবে তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পার না?—
একান্ত তোমারই
করবী পাইন।
রামেশ্বর চৌধুরী চিন্তার অক্টোপাসে আবিষ্ট মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। বিছানায় শুয়েও চোখে ঘুম নামে না। একটা মৌন বেদনা ওঁর পাঁজরগুলো ঠেলে উঠতে চায়। ফাঁসীর আসামী নীহাররঞ্জন শেষে আত্মহত্যা করল? কিন্তু দড়িটা ও পেল কোথায়? তবে কি করবী পাইন যে লোকটিকে চিঠি দিয়ে নীহাররঞ্জনের সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিল, সে-ই ওকে দড়ি দিয়ে যায়? সত্যিই যদি কেউ নীহাররঞ্জনকে দড়ি দিয়ে গিয়ে থাকে, তবে কী কারণে ও আত্মহত্যা করল? ওর তো পুনর্বিচারের আদেশ হয়েছিল। খবরটা তো ও জেনেছিলও। ওর এত অর্থ এখন কি হবে? মাত্র মাসকয়েক আগে ওর কাকার মৃত্যুর পরে ও বিরাট অর্থের মালিক হয়েছে।
নীহাররঞ্জন বি-এ পাশ করেছিল কৃতিত্বের সঙ্গে। শিকারী মহলে ওর খুব সুনামও হয়েছিল। কাকা রাখহরি ঘোষ নিজের বন্দুকটার লাইসেন্স ওর নামে করে দেন।
এক পিকনিকে ওর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল করবী পাইনের। তিনটি মাসের নিবিড় যোগাযোগে ওদের দুজনের মধ্যে গাঢ় অন্তরঙ্গতা হল। ভালবাসল একে অন্যকে। প্রেমের পথ কোন বাধা না পেয়ে থেমে যায়নি, সহজ সরল ধারায় এগিয়ে চলল।
করবী পাইন এক গালর্স স্কুলে মাস্টারি করত। থাকত মেয়েদের একটা মেসে। আত্মীয় বলতে একমাত্র মন্মথ পাইন ছাড়া ওর আর কেউ ছিল না। মাস্টারি করে যা ও রোজগার করত, তাতে আড়ম্বরে থাকার চেষ্টা করত। ফলে বান্ধবীদের কাছে ওকে হাত পাততে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এক সময়ে নীহাররঞ্জন ওকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
নীহাররঞ্জনের জীবনে শুধুমাত্র করবী পাইন এক এবং অদ্বিতীয়া ছিল না। শহরের এক বিশিষ্ট হোটেলের নর্তকীকেও ও ভালবেসেছিল। সাধারণ সুন্দরী সেই নর্তকী। নাম প্রণতি মিত্র। নীহাররঞ্জন সন্ধ্যার পরে প্রায়ই সেই হোটেলে যেত। নাচ দেখত প্রণতি মিত্রের। প্রণতি মিত্রের সঙ্গে গল্প-গুজব করে ট্যাক্সিতে করে বাড়িতে ফিরে আসত। নীহাররঞ্জনকে করবী পাইনের মত কোনদিন কারো কাছে হাত পাততে হয়নি—রাখহরি ঘোষের সঙ্গে ঝগড়া করে মাসে বারো শ’ টাকা হাত-খরচের জন্য আদায় করত। রাখহরি ঘোষ ওর স্বভাব-চরিত্র জেনেও কোনদিন ওকে বাড়ি থেকে চিরদিনের মত চলে যাবার কথা বলেননি।
প্রায়-সন্ধ্যার মত সেদিনও নীহাররঞ্জন সেই হোটেলে গেল। প্রণতি মিত্রকে বলল, বুড়োর দিন এবার ফুরিয়ে এসেছে, প্রণতি। বুকের বেদনাটা যেরকম বেড়েছে, তাতে শিগগির ওকে হয়ত এ জগৎ ছাড়তে হবে। তখন তোমাকে টাকার পাহাড়ে বসাব। তখন তুমি আর আমি—।
পরদিন সকালেই আবিষ্কৃত হল রাখহরি ঘোষের মৃতদেহ। ওঁর বুকে বন্দুকের গুলি বিদ্ধ হয়েছিল।
মৃতদেহ আবিষ্কার করল পাচক দীনদয়াল। আগের রাত্রে পাড়ায় যাত্রা ছিল, বাড়ির অন্য একটি প্রবেশদ্বারে তালা লাগিয়ে দীনদয়াল যাত্রা দেখতে যায়। শেষ রাত্রে বাড়িতে ফিরে আসে। সকালে রাখহরি ঘোষের ঘরে চা এবং প্রাতরাশ দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল ওঁর মৃতদেহ।
অনুসন্ধানে জানা গেল, যে গুলি রাখহরি ঘোষের বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, সেটা নীহাররঞ্জনের বন্দুক থেকেই এসেছে।
হত্যাকারী সন্দেহে পুলিশ নীহাররঞ্জনকে গ্রেপ্তার করল।
নীহার বলল, আগের রাত্রে অত্যধিক হুইস্কি পান করে আসে, তাই দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। ও ওর কাকাকে হত্যা করেনি। কিন্তু দায়রা বিচারে ওর ফাঁসির আদেশ হয়ে গেল। ওর পক্ষ সমর্থন করেও রামেশ্বর চৌধুরী তখন বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেননি। রামেশ্বর চৌধুরী আপীল করলেন। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে পুনর্বিচারের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রাত্রে রামেশ্বর চৌধুরী শুয়ে শুয়েই স্থির করলেন, সকালে প্রথমেই করবী পাইনের সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর যাবেন প্রণতি মিত্র আর রামেন্দ্রনারায়ণের কাছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশ সেরেই ম্যাক্সিম হোটেলে ছুটলেন ; রামেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গেই প্রথমে দেখা করলেন।
রামেন্দ্রনারায়ণ আপ্যায়নে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করলেন। উঁচু লম্বা দোহারা চেহারা। পরনে দামী মফ-রঙা স্যুট। রামেশ্বর চৌধুরীর প্রশ্নে জানালেন, গত পরশুদিন সন্ধ্যায় ওঁর সেক্রেটারি তমোনাশ কোলেকে জেলে পাঠান নীহাররঞ্জনকে একখানা চিঠি দেবার জন্য। চিঠিটা নীহাররঞ্জনের কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্য এক ভদ্রমহিলা ওঁকে অনুরোধ জানান। যেহেতু সেই ভদ্রমহিলার কাছে উনি কৃতজ্ঞ, তাই অনুরোধটা প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। চিঠিতে কী লেখা ছিল, উনি জানেন না। পরের চিঠি পড়া ওঁর অভ্যাস নয়!
—আপনার সেক্রেটারি চিঠির সঙ্গে নীহাররঞ্জনকে একগাছা দড়ি দিয়ে আসেননি তো?
রামেশ্বর চৌধুরীর কণ্ঠের অস্বাভাবিকতায় চমকে উঠলেন রামেন্দ্রনারায়ণ : না-না, তা হতে যাবে কেন! এ কি বলছেন?
ঠোঁট থেকে রাশি রাশি অবজ্ঞা ছড়িয়ে রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, হতেও তো পারে! টাকার বিনিময়ে সব কিছুই তো পারেন ; নয় কী?
মেসে নিজের ঘরের চেয়ারে বসে ছাত্রীদের খাতা দেখছিল করবী পাইন।
ঝি লীলাবতী রামেশ্বর চৌধুরীকে সেখানে নিয়ে গেল। মৃদুকণ্ঠে ডাকল, দিদিমণি!
ঘাড় বেঁকিয়ে তেরছা তাকাল করবী পাইন। রামেশ্বর চৌধুরীর সঙ্গে চোখাচোখি হল। তমাল দীঘির সন্ধ্যাজলের মত দুটি স্নিগ্ধ চোখ করবী পাইনের। কচি আমপাতার মত শ্যামাশ্রী। পরনে শ্যাম্পেন-রঙা শাড়ি। রামেশ্বর চৌধুরী আগমনের কারণ বর্ণনা করলেন। ওঁকে একটা খালি চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে করবী পাইন লীলাবতীকে যেতে বলল। চলে গেল লীলাবতী। রামেশ্বর চৌধুরী কথা পাড়লেন : কী ধরণের বিপদে পড়েছেন মিস পাইন?
করবী পাইনের ভ্রূ-দুটো ধনুক-বাঁকা হয়ে গেল মুহূর্তে : কী বলতে চান?
—শুনলাম একটা চিঠি রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীর সেক্রেটারি তমোনাশ কোলের মারফৎ নীহাররঞ্জনের কাছে পাঠান?
—চিঠিটা ও ছিঁড়ে ফেলেনি?
—নীহাররঞ্জনবাবুর সেলে পাওয়া গিয়েছে। এখন ওখানকার জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর হেফাজতে।
—তার সঙ্গে তো ওর মৃত্যুর কোন যোগাযোগই নেই।
—ওই সঙ্গে আপনি কি কোন দড়ি পাঠিয়েছিলেন?
—কী বলছেন? আমি পাঠাতে যাব কেন! প্রণতি মিত্রই হয়ত পাঠিয়ে থাকবে। ও-ই তো ওর সব কিছু গ্রাস করবার মতলবে আছে।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নামল।
রামেশ্বর চৌধুরী আবার মুখ খুললেন : কী ধরণের বিশেষ বিপদে পড়েছেন, বললেন না তো মিস পাইন?
যেন একটা স্বপ্নাচ্ছন্নতার আবেশে করবী পাইন এতক্ষণ ডুবেছিল, রামেশ্বর চৌধুরীর প্রশ্নে ওর সম্বিৎ ফিরে এল : বলবার মত মনের অবস্থাও এখন আমার নেই। এ কথা সত্যি, আজ আমি অনেক টাকার মালিক। খানিক আগে ওর অ্যাটর্নি হরিমোহনবাবু এসে আমাকে জানিয়ে গেলেন, গত সাতদিন আগে ও যে উইল করেছিল, তাতে আমি ওর সমস্ত কিছুর মালিক। দুঃখের কথা কী জানেন, যার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া দরকার ছিল, তাকে যখন এখন আর পাওয়া যাবে না, কার কাছেই বা আর সাহায্য চাইব! করবী পাইনের কণ্ঠস্বরে আশ্চর্য কোমলতা।
রঙ আর পাউডার দিয়ে স্বাস্থ্য উজ্জ্বল করবার মুখোস লাগানো প্রণতি মিত্রের স্বাস্থ্যহীন চেহারায়। রাঙা তপ্ত ইস্পাতের মত গোলাপী ঠোঁটে একটু হাসি ফুটিয়ে রামেশ্বর চৌধুরীকে ও অভ্যর্থনা করল।
একটু পরেই ওর কথার মাধ্যমে রামেশ্বর স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে, নীহাররঞ্জনের উইল সম্পর্কীয় ব্যাপারে ও আদৌ সন্তুষ্ট নয়। এছাড়া করবী পাইন বর্তমানে একরাশ অর্থের অধিকারিণী হওয়াতে ও মনে মনে খানিকটা ক্ষুব্ধ।
রামেশ্বর চৌধুরী বললেন, একটা প্রশ্ন করছি। একটা দড়ির টুকরো কী কারো সাহায্যে নীহাররঞ্জনবাবুর সেলে পাঠান?
—না। তীব্র কটাক্ষপাত করে ঠোঁট বেঁকাল প্রণতি মিত্র।
—নীহাররঞ্জনকে আপনি ভালবাসতেন?
—পছন্দ করতাম। আশা ছিল একদিন ও রাখহরি ঘোষের টাকার মালিক হবে। ওকে পছন্দ করতাম ঠিক সেই কারণেই।
—মিস মিত্র, আপনার কী মনে হয় রাখহরি ঘোষকে ও-ই খুন করেছিল?
—নীহার কখনই ওর কাকাকে খুন করেনি। এ কাজ অন্য কারোর। সেদিন নিজে ট্যাক্সি করে ওকে ওর বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছি।
—কই, একথা তো আগে বলেননি!
ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি বিছিয়ে দিয়ে প্রণতি মিত্র বলল, বললে সন্দেহের ভাগী হতাম। তাই বলিনি। নীহারকে ওর বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়েই আমি সেদিন ক্ষান্ত হইনি। রাখহরি ঘোষকে আমার তখন দেখবার বিশেষ সাধ হল। কোনদিন ওঁকে, দেখিনি। নীহার একসময়ে বলেছিল, ওর কাকা তেতলায় একেবারে শেষের ঘরে থাকেন। তখন চোরের মত চুপি চুপি সেই ঘরের জানলার ধারে গিয়ে ঘরের ভেতরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম, ভদ্রলোক বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। ওঁর বুকে গভীর একটা ক্ষতচিহ্ন। বিছানাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। নীহারকে সেদিন আমি কিছু না জানিয়েই ওদের বাড়ি থেকে চলে আসি। পরে এ সম্পর্কে কারো কাছে কোন উচ্চবাচ্য করিনি।
—হুম! নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত করে গম্ভীর শব্দ করেন রামেশ্বর চৌধুরী।
আবার করবী পাইনের মেসের উদ্দেশে ট্যাক্সি হাঁকান রামেশ্বর। করবী পাইন তখন খাওয়াদাওয়া সেরে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। রামেশ্বর চৌধুরীকে ও আশা করেনি। রামেশ্বর চৌধুরী সরাসরি প্রশ্ন করলেন, রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী কোন দিক দিয়ে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, মিস পাইন?
—কৃতজ্ঞ! করবী পাইনের সারা মুখে অবিশ্বাস্যের ছায়া মেঘের ফাঁকে রোদের আলোছায়ার মত খেলে যায় কী বলছেন, মিস্টার চৌধুরী? আমি ওঁকে জীবনে কোনদিন দেখিইনি। ওঁর সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত আমার নেই।
—বলতে চান চিঠিটা আপনার হাতের লেখা নয়?
—অস্বীকার করি না।
—চিঠিটা রামেন্দ্রনারায়ণের কাছে গেল কী করে?
ধকধক করে জ্বলে ওঠে করবী পাইনের চোখ—অদ্ভুত উত্তেজনার সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে : আপনার কোন কথার উত্তর দিতে বাধ্য নই—দয়া করে এখান থেকে চলে গিয়ে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
রাস্তায় নেমে এলেন রামেশ্বর চৌধুরী। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দিলীপ সান্যালের বাড়ির উদ্দেশে পা চালালেন। শেষ পর্যন্ত রহস্যান্বেষী দিলীপ সান্যালের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে ওর উপদেশ নেওয়াটাই সাব্যস্ত করেছেন। সব শুনে দিলীপ বলল, বেশ বোঝা যাচ্ছে রাখহরি ঘোষের হত্যাকাণ্ডে খানিকটা ঘোরপ্যাঁচ আছে।
রামেশ্বর চৌধুরী বিহ্বলভাবে তাকিয়ে বললেন, আপনি বিশ্বাস করেন নীহাররঞ্জন ওর কাকাকে হত্যা করেননি?
দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে দিলীপ বলল, কোন সন্দেহ নেই। রাখহরি ঘোষের হত্যাকারী সমস্ত অপরাধ নীহাররঞ্জনবাবুর ওপরে চাপিয়ে দিয়েছে নির্বিবাদে।
—কে এই কাজটা করেছে মনে করেন?
—সন্ধ্যের পরে আমার এখানে আসুন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর্থার জোন্সকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন। তখন আপনাদের কাছে সব কিছু গুছিয়ে বলব’খন। একটা কথা—
—বলুন।
—রাখহরি ঘোষের বাড়িতে দীনদয়াল নামে যে লোকটা থাকে, সে তো রাখহরি ঘোষের হত্যার রাত্রে যাত্রা শুনতে গিয়েছিল, তাই না?
—হ্যাঁ। নীহাররঞ্জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেই দীনদয়াল রাখহরি ঘোষের ঘরের টেবিলে রাতের খাবার রেখে দিয়ে, বাড়ির পেছনকার দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
—বাড়ির সামনের দরজাটা তখন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?
—ভেজান ছিল। নীহাররঞ্জন প্রায়ই রাত্রে বাড়ি ফিরে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরে যেত।
—ধন্যবাদ। ওই কথাই রইল।
—বেশ, মিস্টার জোন্সকে নিয়ে সন্ধ্যের পরেই আসব’খন। শুকনো হাসি হাসবার চেষ্টা করে রামেশ্বর চৌধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
এক সময়ে সূর্য অস্ত গেল। ক্রমে অন্ধকারটা ঘন হয়ে চাপ বেঁধে বসল মহানগরীর বুকে।
সাড়ে সাতটায় আর্থার জোন্সকে সঙ্গে নিয়ে রামেশ্বর চৌধুরী দিলীপের বাড়িতে এলেন। ড্রয়িংরুমের দুখানা চেয়ার দুজনে অধিকার করলেন। চাকর দোতলায় গিয়ে সংবাদ দিল দিলীপকে।
একটু পরেই দিলীপ ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। আর্থার জোন্সকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে ওঁদের মুখোমুখি একখানা চেয়ারে বসল—তারপর ওঁদের দুজনকে দুটো সিগারেট দিয়ে নিজে একটা ধরাল, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করল : রাখহরি ঘোষ নিহত হয়েছেন নিঃসন্দেহে। হত্যাকারী নীহাররঞ্জনবাবু নন। তান্য কেউ। দিস মার্ডারার মেড ওয়ান ট্রাই—মার্ডার বাই ফ্রেম আপ। রাখহরি ঘোষকে সে হত্যা করেছে মাত্র দুটি কারণে। প্রথমটা হল, নীহাররঞ্জনবাবুর ওপরে সমস্ত দোষটা চাপিয়ে দিয়ে ওঁকে এ জগৎ থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়টা হল, রাখহরি ঘোষের যে অর্থ নীহাররঞ্জনবাবু রাখহরি ঘোষের মৃত্যুর পরে পেলেন, তা হস্তগত করা। রাখহরি ঘোষের বাড়ির সদর দরজাটা নীহাররঞ্জনবাবু রাত্রে ফিরে এসে বন্ধ করতেন। ওঁর ফিরে আসার আগেই হত্যাকারী ভেজানো দরজাটা ঠেলে সেদিন বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। বাড়িতে তখন রাখহরি ঘোষ ছাড়া আর কেউ ছিল না। নীহাররঞ্জনবাবু পাকা শিকারী এবং ওঁর বন্দুকটা কোথায় থাকে হত্যাকারী জানত। সেদিন বাড়িতে নিঃশব্দে প্রবেশ করে নীহাররঞ্জনবাবুর ঘর থেকে বন্দুক এবং গুলি নিয়ে রাখহরির ঘরে গিয়ে ওঁকে হত্যা করল। কাজ শেষ করে বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে প্রস্থান করল।
এবার নীহাররঞ্জনবাবুর প্রসঙ্গে আসা যাক। দিলীপ বলে চলল : সকালে আমি মিস্টার চৌধুরীকে জানিয়েছি যে, নীহাররঞ্জনবাবুকে ওঁর কাকার মতই হত্যা করা হয়েছে।
কী করে, নিশ্চয় আপনারা এখন জানতে চান। ধরে নিলাম নীহাররঞ্জনবাবু আত্মহত্যা করবার জন্যে কারো কাছ থেকে দড়ি চেয়েছিলেন। সেইমত কোন একজন ওঁকে খানিকটা দড়িও দিয়েছিল। কিন্তু তাই যদি হবে, মৃত্যুর আগে ‘ছিঁড়ল না’ এই কথাটা কেন বলে গেলেন। মিঃ জোন্সের কোয়ার্টারের রেডিওতে সেই সময়ে যে গান হচ্ছিল, তার সঙ্গে নীহাররঞ্জনবাবুর শেষ কথাটার কোন যোগাযোগ আছে?
আছে। বলে রাখি, সেটা খুব উল্লেখযোগ্য নয়। কাকতালীয়। ‘হৃদয় বীণার তার ছিঁড়িল, ছিঁড়িল রে তোর মনের বাঁধন’—গানের এই অংশ ওঁকে মৃত্যুর আগে শেষ কথাটা বলতে অনুপ্রাণিত করেছিল মাত্র।
এবারে প্রশ্ন আসে, নীহাররঞ্জনবাবু কিভাবে নিহত হলেন?
নীহাররঞ্জনবাবুকে হত্যাকারী নিজের হাতে হত্যা করেনি। দড়ির টুকরোটা পাঠিয়েছিল এবং ওঁকে পালাবার মতলব দিয়েছিল। ওঁর পুনর্বিচারের আদেশ হবে, হত্যাকারী আগে থেকেই আন্দাজ করে নেয়। তাই ওকে কিভাবে জগৎ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তার পরিকল্পনাও ছকে নেয় অনেক আগে থেকেই। ওঁকে দড়ি দিয়ে বলা হল, উনি গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার অভিনয় করবেন। দড়িটা দিয়ে ওঁকে ওঁর গলায় ফাঁস লাগাবার নির্দেশ দেওয়া হল—বলা হল, ওঁর শরীরের ভার কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। দড়িটা ছিঁড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উনি মেঝেয় পড়ে গেলেই কাতরাবেন। ফলে ওয়ার্ডার এবং সেল ব্লকের মেট ইত্যাদি সেই সেলে ছুটে যাবে এবং ওঁকে হাসপাতালে পাঠানো হবে। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে উনি পালাবেন। কিন্তু কার্যত তা ঘটেনি। পরিকল্পনাটা হত্যাকারীর একটা চাল ছিল মাত্র।
এখন প্রশ্ন আসে, কে ওঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল?
এ ব্যাপারে তমোনাশ কোলেকেই একমাত্র সন্দেহ করা চলে। কিন্তু দড়িটা ভদ্রলোক সেদিন নীহারবাবুকে দিয়ে যাননি। উনি যদি দড়িটা দিয়ে যেতেন, চল্লিশ নম্বর সেলের কম্বল বদলে দেবার সময়ে সেটা আবিষ্কৃত হত। তাহলে দড়িটা নীহাররঞ্জনবাবুকে কে দিয়ে গেল?
—কার কীর্তি, এখন আমি বুঝতে পারছি, মিস্টার সান্যাল। পাথরের মত শক্তস্বরে বলে উঠলেন আর্থার জোন্স।
অকৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রেখে দিলীপ বলল, খুবই স্বাভাবিক। তবে করবী পাইন হত্যাকারীর হাতিয়ার ছিল মাত্র। যে চিঠি তমোনাশ কোলে নীহাররঞ্জনবাবুকে দিয়ে আসেন, সেটা করবী পাইনেরই হাতের লেখা। চিঠিটা ওঁর কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়ে হত্যাকারী তখন রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে দিয়েছিল। রামেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী চিঠিটা তমোনাশ কোলের মারফৎ নীহাররঞ্জনবাবুকে পাঠান। নীহাররঞ্জনবাবুর ওপরে করবী পাইনের ভালবাসাটা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে তখন আক্রোশে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রণতি মিত্র নামে একজন নর্তকী ওঁর ভাবী স্বামী নীহাররঞ্জনকে ওঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং সেই নর্তকী নীহাররঞ্জনবাবুর কাছ থেকে বেশ কিছু পরিমাণ অর্থও হস্তগত করবার মতলবে ছিল।
হত্যাকারী করবী পাইনের এই মানসিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ওঁকে পরামর্শ দিয়ে বলে, ওঁকে নীহাররঞ্জনবাবু কোনদিনই বিয়ে করবে না। সেক্ষেত্রে নীহাররঞ্জনবাবুর কাছ থেকে ফন্দি করে ওর সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা প্রয়োজন। হত্যাকারীর পরামর্শে তখন করবী পাইন সায় দিল। কেননা, ওঁর আর্থিক অবস্থাটা ভাল ছিল না। অবিশ্যি ভদ্রমহিলা যদি আগে থেকেই জানতে পারতেন যে, নীহাররঞ্জনবাবু উইল করে ওর সমুদয় অর্থ ওঁকে দিয়ে গেছেন, তাহলে হত্যাকারীর পরামর্শ উনি কখনই গ্রহণ করতেন না। অথচ হত্যাকারী ডাক্তার পাইন—করবী পাইনের কাকা ডাঃ মন্মথ পাইন সব জানতেন।
মুহূর্তে রক্ত সরে গিয়ে শাদা হয়ে যায় রামেশ্বর চৌধুরীর মুখখানা—অস্ফুট কণ্ঠে বলেন, এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য!
দিলীপ মৃদু হেসে বলে, একটিমাত্র ভুলে ভদ্রলোক আমার চোখে অপরাধী। ভুলটা হল, নীহাররঞ্জনবাবুকে আত্মহত্যার অভিনয় করবার জন্য একগাছা দড়ি দেওয়া। গোড়া থেকেই নীহাররঞ্জনবাবুর কাছে ভদ্রলোক নিজেকে বিশ্বাসের পাত্র করে তুলছিলেন। উনিই মিস্টার জোন্সের কাছে নীহাররঞ্জনবাবুকে জেল হাসপাতালে পাঠাবার জন্য সুপারিশ করেন। অথচ নিজেই জানতেন যে, ওঁর সুপারিশ অগ্রাহ্য করা হবে। কেননা, দুজন কয়েদী কিছুদিন আগে পালিয়ে যায়। নীহাররঞ্জনবাবুর মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায় তমোনাশ কোলে ডাক্তার পাইনের নির্দেশমত করবী পাইনের চিঠিটা নীহাররঞ্জনবাবুকে দিয়ে গেলেন। এ সম্পর্কে ডাঃ পাইন নিশ্চিত ছিলেন যে, ওকে পুলিশ সন্দেহ করতে পারবে না। অবিশ্যি পুলিশ যদি পরে তমোনাশ কোলে আর করবী পাইনকে সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করে এবং ওরা দুজনে যদি ওঁর প্রসঙ্গে কিছু বলেও, তখন উনি সরাসরি অস্বীকার করবেন। ওদের দুজনের ওপরে নীহাররঞ্জনবাবুর হত্যাপরাধটা চাপাবার উদ্দেশ্যও ওঁর ছিল।
তমোনাশ কোলের কাছ থেকে নীহাররঞ্জনবাবু চিঠিটা পেয়ে একটা অজানা আশংকায় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ডাক্তার পাইন চিঠি মারফৎ যা আশা করেছিলেন, সেটাই ঘটল। নীহাররঞ্জনবাবু জেল থেকে পালাবার জন্য ডাক্তার পাইনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন এবং সেই প্রার্থনায় উনি সাড়া দিয়ে বললেন যে, দড়ির কৌশলের মাধ্যমে পালাবার ব্যবস্থা উনি করে দেবেন। তারপরের কথা তো আপনাদের আগেই বলেছি।
দিলীপ থামল। পুড়ে যাওয়া সিগারেটটা অ্যাস্ট্রেতে ফেলে দিয়ে আর একটায় অগ্নিসংযোগ করল।
—সাংঘাতিক লোক, ডাক্তার পাইন! গম্ভীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল রামেশ্বর চৌধুরীর।
কিন্তু কথাটা দিলীপের কানে গিয়ে পৌঁছোয় না। ও তখন চেয়ারের পেছনে পিঠটা ছেড়ে দিয়েছে, চিন্তা মুছে ডুব দিয়েছে সিগারেটের ধোঁয়ার ফুলঝুরিতে।