ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ – ফৌজদারী-বালাখানা
বেলা দ্বিতীয় প্রহরের সময়ে জামাতা সমভিব্যাহারে বৃদ্ধ হলধর ঘোষ কলিকাতা ফৌজদারী- বালাখানার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সিংহদ্বারে একজন বরকন্দাজ বন্দুকে সঙ্গিন চড়াইয়া, বুক ফুলাইয়া ও গোঁফে চাড়া দিয়া পাঁওতারা করিতেছিল ও অপর একজন হিন্দুস্থানী বরত মাজিতেছিল। দেওয়ান জিজ্ঞাসিলেন, “ফৌজদার কাঁহা? “
বরকন্দাজ। ফৌজদার দো-মহালাপর, আপ্ যাইয়ে, উপর চলা যাইয়ে
দেওয়ান শ্বশুর সহ সুখারোহ সোপানশ্রেণী অতিক্রম করিয়া বালাখানার দ্বিতলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
সেখানে অপর দুইজন সিপাহী পাহারা দিতেছিল, একজন জিজ্ঞাসিল, “কাঁহা যাওগে?”
দেওয়ান। ফৌজদার কাঁহা?
বরকন্দাজ অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা ফৌজদারী এলাস্ দেখাইয়া দিল। প্রকাণ্ড প্রশস্ত গৃহ, গৃহের একধারে কতকগুলি মুহুরী ও কারকুন একাগ্রমনে লেখা-পড়া করিতেছে ও অপর দিকে কতকগুলি পিয়াদা ও চাপরাসী বসিয়া আছে। মধ্যস্থানে সুচারু গালিচা, তদুপরি সুকোমল মস্লন্দে তাকিয়া নির্ভর করিয়া ফৌজদার বিশ্বনাথ ঘোষ প্রলম্বিত নল বিশিষ্ট আলবোলায় ধূমপান করিতেছেন। এখন তাঁহার বিশ্রামের সময়, দ্বিতীয় প্রহর হইতে আড়াই প্রহর পর্য্যন্ত তিনি কোন কার্য্য করিতেন না। জামাতা সহ হলধর ঘোষকে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিবামাত্র তিনি দণ্ডায়মান হইয়া “একি! দাদা মহাশয় যে! আসতে আজ্ঞা হয়,” বলিয়া তাঁহার হস্ত ধারণপূর্ব্বক নিজ আসনে বসাইয়া পুনর্ব্বার উপবিষ্ট হইলেন; দেওয়ান তাঁহাদিগের নিকটে গালিচার উপর উপবেশন করিলেন। ফৌজদার তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “ইনি কে?”
হলধর। ইনি আমার জামাতা।
ফৌজদার। ইনিই দেওয়ান গোবিন্দরাম নিয়োগী? খুব অল্প বয়স ত।
হলধর। আশীর্ব্বাদ কর, বেঁচে থাকুন; ভাই, এঁরি কল্যাণে সম্প্রতি আমার প্রাণরক্ষা হইয়াছে, সে বিপদের কথা মনে হইলে এখনও আমার হৃদকম্প উপস্থিত হয়।
ফৌজদার। অ্যাঁ সেকি! ব্যাপারখানা কি বলুন?
তখন হলধর ঘোষ তাঁহার ও দেওয়ানের সমস্ত বিপদ বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলেন। তৎপরে বলিলেন, “ভাই, নিত্য এ প্রকার অত্যাচারে দেশ ত ছারখার হইল, ইহার কি কোন প্রতীকার হইবে না?
ফৌজদার। রাজ্য-বিপ্লবের পর, কিছুদিন অরাজকতা অবশ্যম্ভাবী।
হলধর। ইংরাজ ত বহুদিন হইল পলাসীর যুদ্ধে জয়ী হইয়াছে, এখনও অরাজকতা কেন থাকে?
ফৌজদার। ইংরাজ, মিরজাফরের মৃত্যুর পর, স্বকরে রাজ্যভার গ্রহণ করিয়াছেন।
দেওয়ান। সেও ত আজি প্রায় পঁচিশ বৎসর হইল।
ফৌজদার। এত অল্প সময়ের মধ্যে কি এতবড় একটা প্রকাণ্ড রাজ্যের সুশাসন ব্যবস্থা হইতে পারে?
দেওয়ান। কিন্তু এ বড় পরিতাপের বিষয় যে, রাজধানীর সন্নিহিত জনপদ সমূহেও অদ্যাপি অরাজকতা নিবারিত হইল না।
দেওয়ানের এইকথায় ফৌজদার ঈষদ্ধাস্য সহকারে উত্তর করিলেন, “বাবাজী, ‘নগর পুড়িলে, দেবালয় কি এড়ায়?’ যখন সুব্যবস্থা ও সুশাসন সংস্থাপিত হইবে, তখন সমস্ত রাজ্য ব্যাপিয়াই হইবে এবং তাহারও আর অধিক বিলম্ব নাই। বর্ত্তমান বড় সাহেব কত বড় বিচক্ষণ ও সুদক্ষ লোক, তাহা ৰাবাজীকে বলা বাহুল্য, তিনি যে প্রকার শাসন-প্রণালী প্রবর্ত্তিত করিতে মনস্থ করিয়াছেন, আশা করা যায় যে, তাহাতে দেশে সুনীতি ও শান্তি শীঘ্রই সংস্থাপিত হইবে।
হলধর। সে এখন দূরের কথা, তুমি ও হুগলীর ফৌজদার উভয়ে যদি একটু বিশেষ চেষ্টা কর, তা হলে কি রাঘব সেনের দস্যুদলকে দমন করিতে পার না?
ফৌজদার। আপনি এখনও রাঘব সেনকে চিনিতে পারেন নাই—তাহার অতুল প্রতাপ, বিপুল বিভব, অসাধারণ শক্তি, অসাধারণ বুদ্ধি কৌশল এবং প্রবল সহায়; কাহার সাধ্য, তাহার নামে অভিযোগ উপস্থিত করে? কাহার সাধ্য, তাহার অপরাধ সপ্রমাণ করে?
দেওয়ান। আপনি যদি এরূপ বলিলেন, তবে আর কাহার শরণাগত হইব? বুঝিলাম, আমাদের আর নিস্তার নাই!
এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে দারোগা ফতেউল্লা, জমাদার ও চারিজন অস্ত্রধারী চৌকীদার এক্লাসে আসিয়া উপস্থিত হইল।
ফৌজদার দারোগার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “কি খবর, দারোগা সাহেব?”
দারোগা সেলাম করিয়া দেওয়ানের দিকে অঙ্গুলি নিৰ্দ্দেশ পূৰ্ব্বক বলিল, ‘ঐ লোকটির নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা আছে।”
দেওয়ান হাস্য করিয়া বলিলেন, “উল্টা দাবী নাকি?”
ফৌজদার। দেওয়ানের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা?
দারোগা। আজ্ঞা হাঁ, উনি রাঘব সেনের কিস্তি লুঠ করিয়াছেন, খুন করিয়াছেন।
ফৌজদার। বামাল পাইয়াছ?
দারোগা। ওঁর গোলাবাড়ী হতেই সমস্ত বামাল বার হয়েছে।
ফৌজদার। বামাল ধরা পড়িয়াছে কবে?
দারোগা। আজ প্রাতে।
ফৌজদার এই সময়ে তাকিয়ার নিম্নতল হইতে একখানি কাগজ (জুলিয়ার এজেহার) বাহির করিয়া দেখিলেন; দেখিয়া বলিলেন, “আমি আশ্চৰ্য্য হইলাম যে, এতবড় একজন সম্ভ্রান্ত লোক এমন কার্য্য করিয়াছেন। আচ্ছা, আমি স্বয়ং ইঁহাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেছি, তুমি একটু অপেক্ষা কর।”
বলিয়া তিনি একজন চাপরাসী দ্বারা চারিজন বরকন্দাজকে সসজ্জ হইয়া নিম্নতলে প্রস্তুত থাকিতে আদেশ করিয়া গৃহান্তরে গমন করিলেন এবং অচিরকালমধ্যে পরিচ্ছদ পরিবর্ত্তন করিয়া পুনর্ব্বার এলাসে আসিয়া দারোগাকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “ইঁহাকে এখন কোথায় লইয়া যাইতে হইবে?”
দারোগা। সম্প্রতি গঙ্গাপুরে যাইব, তথায় হুগলীর ফৌজদার আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।
হলধর ঘোষ ও গোবিন্দরামকে অনুসরণ করিতে আদেশ করিয়া ফৌজদার অগ্রসর হইলেন। নিম্নতলে চারিজন সিপাহী, দেওয়ান গোবিন্দরাম, হলধর ঘোষ, দারোগা, জমাদার ও চৌকীদারগণ এবং ফৌজদারের দুইজন চাপরাসী ও দুই জন খানসামা বিবিধ প্রয়োজনীয় দ্রব্যজাত লইয়া, ফৌজদারের সহিত সম্মিলিত হইল এবং সকলে বালাখানা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।