পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

শ্ৰী কামড় বাবা

শ্ৰী কামড় বাবা

আমাদের হোঁৎকা ওরফে মিহির কুমার সরখেল এবারও পরীক্ষায় লাট খেয়েছে। অবশ্য আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের শ্রীমান হোঁৎকা দু একটা সাবজেক্টে বিশেষ করে অঙ্কে একটু কাঁচা আর ইংরাজিতেও একটু নড়বড়ে। তবে অন্য বার নাম্বার কিছু কম থাকলেও টেনেটুনে উৎরে যায়। কারণ স্কুল টিমের সে-ই ক্যাপ্টেন। খেলাধুলায় সুনামের মূলেও হোঁৎকা। তাই স্যাররাও ওকে একটু নেক নজরেই দেখেন।

কিন্তু এবার হোঁৎকা একেবারে ভোঁ কাট্টা ঘুড়ির মতো জব্বর ভাবে ফেল করেছে তিনটে সাবজেক্টে। অঙ্ক, ইংরাজি আবার বিজ্ঞান। হেডস্যার বলেছেন—“এবার নো চান্স মিহির কুমার।”

হোঁৎকা মাঠের ক্লাবে একাই বসে আছে। তার রাগটা এবার ফেল করার জন্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি ওই নবীন পাল লেনের হাঁকডাকওয়ালা শ্রী কামড় বাবার উপর। ব্যাপারটা আমরাও জানতাম না। তবে শ্রী কামড় বাবার নাম আমরা কেন এই চত্বরের সবাই জানে। প্রত্যেক শনি-মঙ্গলবার নাকি তাঁর উপর বাবা মহাদেব ভর করেন। বেশ ক’বছর হল ওখানে কামড় বাবার আবির্ভাব হয়েছে।

ওদিকে এখনও শহরের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। এখনও ওই অঞ্চলে বাঁশবন, কিছু গাছপালা আর পুরানো বাসিন্দাদের টালির ঘরও রয়েছে। একটা বটগাছের নীচে বেশ খানিকটা জায়গাতে কামড় বাবার আশ্রম, মন্দির। এখন সেই মন্দিরের বেশ রমরমা। শ্ৰী কামড় বাবা বলেন—বাবা মহাদেব শ্মশানে ঘুরে বেড়ান। তিনি পাকা মন্দির চান না।

তাই তাঁর মন্দির এখনও মাটির চালাই রয়েছে। ওদিকে গড়ে উঠেছে কামড় বাবার পাকা দালান ঘর। ভক্তদের অনেকেই টাকা পয়সা দিয়ে বাবার জন্য ঘর, আসবাবপত্র, কার্পেট, চেয়ার সব এনে দিয়েছে। শনি, মঙ্গলবার বাবার নাকি ভর হয় আর কৈলাস থেকে বাবা মহাদেব এসে কামড় বাবার ঘাড়ে চাপেন। আর সিল্কের গেরুয়া পাঞ্জাবী পরা কামড় বাবা তখন মহাদেব হয়ে সবার ভূত ভবিষ্যৎ বলে দেন। বহু দুরারোগ্য রোগীকে যা যা বলেন তা নাকি বর্ণে বর্ণে ফলে যায়। ওঁর বাতলানো ওষুধ খেয়ে নাকি মৃত্যুপ্রায় রোগী, ডাক্তার যাদের আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তারা নাকি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অবশ্য এসব ভবিষ্যৎবাণী শোনার জন্য আগে থেকে ভক্তদের গিয়ে ভালো টাকা দিয়ে নাম লেখাতে হয়। বাবা ভরের সময় নামের তালিকা ধরে তাকে দক্ষিণার পরিমাণ দেখে নির্দেশ দেন জনে জনে। আর যদি বাবা পাতাল ভৈরবের মুখের কথা শুনতে হয় তাহলে আরও বেশি প্রণামী দিলে বাবার নির্দেশ আসে তাঁর ঘর থেকে। কামড় বাবা ঘটে ফুল চাপিয়ে বাবার পূজা করেন প্রার্থীর নামে। ভক্তরাও একদৃষ্টে ঘটের দিকে তাকিয়ে থাকে। কামড় বাবাও হুঙ্কার দেন—-জয় বাবা পাতাল ভৈরব, দয়া করো বাবা। জয় বাবা-

পাতাল ভৈরবের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে। আর কামড় বাবার হুঙ্কারে যেন স্বয়ং মহাদেব ঘট থেকে আশ্চর্যজনকভাবে ফুল ফেলে দেয়। ভক্তের প্রার্থনা নাকি নির্ঘাৎ পূরণ হবে, হয়ও। বাবা পাতাল ভৈরবের জয়ধ্বনি ওঠে। জয়ধ্বনি ওঠে—জয় শ্রী কামড় বাবা-

আর বাবা যদি একবার কাউকে কামড়ান তাহলে তার সব বিপদই নাকি কেটে যায়। তার থেকেই ওর নাম হয়েছে শ্রী কামড় বাবা। তবে সেটা নাকি খুব কঠিন সাধনার কাজ। ব্যয়সাধ্যও। তাই কামড়টা কমই হয়। তবে নামটা বহাল রয়ে গেছে।

হোঁৎকা এমনিতে বিশেষ দেবদেবী মানে না। তবে দেখেছে এত লোক আসে। শতশত ভক্ত। বাবার দয়ায় তাদের অনেক কাজই হয়েছে। সব বিপদই কেটেছে। তাই হোঁৎকার হঠাৎ মনে হয় পরীক্ষার ব্যাপারে যদি বাবার শরণ নিতে পারে, হয়তো কামড় বাবার দয়ায় আর পাতাল ফোঁড় শিবের দয়ায় নির্ঘাৎ পাস হয়ে যাবে। অবশ্য হোঁৎকা আমাদের এসব কথা জানায়নি ।

আমাদের পাড়ার নেত্যদা কামড় বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত। বাবার দয়াতেই নাকি তার চিটেগুড়ের ব্যবসা রমরম করে চলছে। হোঁৎকা সেই নেত্যদার সাথে বাবার কাছে আছে। বাবার চ্যালা হোঁৎকাকে বলে,

—বাবার প্রণামী একশো এক টাকা। তবে বাবার দয়া হলে তোমার সব বিপদ কেটে যাবে । বাবা তো দেবদেবীদের সাথে কথা বলেন, মা সরস্বতীর সাথে কথা বলে তুমি যাতে পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করো সে ব্যবস্থা করে দেবেন। চাই কি ফার্স্টও করে দিতে পারেন কামড় বাবা। হোঁৎকা বিপদে পড়ে। বলে,

—একশো এক টাকা! কিছু কম হইব না?

ভক্ত তার খেরো খাতা দেখিয়ে বলে–দ্যাখো বাবার রেট, পাঁচশো এক টাকা। তোমাকে কনসেশন করছি নিত্যদার জন্য। ভেবো না, বাবার দয়ায় লোকে ভরা নদী পার হয়ে যায়, আর পরীক্ষা তো তুচ্ছ! হোঁৎকা এতদিন ধরে কিছু সঞ্চয় করেছিল টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে। বাজার থেকে ম্যানেজ করে। সব নিঃশেষ করে বাবার চরণে দিয়ে এল। ভক্ত বলে,

—বাবা তোমার হয়ে বাবা পাতাল ভৈরবকে ফুল চড়াবেন। যদি ফুল পড়ে জানবে কেল্লা ফতে। ফার্স্ট-সেকেন্ডই হয়ে যাবে।

হোঁৎকা স্বপ্ন দেখে যে পটলা তাকে টপকে ফার্স্ট হয়েছে। তাই পরদিনই কিছু না খেয়ে শীতের সকালে স্নান সেরে বের হয়। মা জিজ্ঞাসা করে,

—ব্যাপার কি রে? এত ভোরে চান্ করস্ ক্যান্?

হোঁৎকা বলে—কাম আছে গিয়া। পরে কমু।

হোঁৎকার সকাল বেলাতেই খাওয়া অভ্যেস। আজ উপোস দিয়েই বাবার আশ্রমে এসেছে। রয়েছে ভক্তের ভিড়। তার মাঝে তার নাম করেও ডাক আসে। বাবার ডাক। কামড় বাবা তখন ভরে শিরনম্র হয়ে পাতাল ফোঁড় শিবের ঘটের সামনে উপবিষ্ট। বাবা পাতাল ভৈরব নাকি স্বয়ং মাটির তল থেকে এখানে উঠেছেন নিজেই। কামড় বাবার আহ্বানে তিনি ধরাধামে এসেছেন। ঘটের উপর ফুল চাপানো। হোঁৎকার ভাগ্য তাতে নির্ধারিত হতে চলেছে। ফুল যদি পড়ে যায়, দয়া হয়েছে জানতে হবে। না পড়লেই সর্বনাশ। হোঁৎকাও কামড় বাবার মত হাঁক পাড়ে, “জয় বাবা পাতাল ভৈরব, জয় শ্রী কামড় বাবা!

ভক্তদের ডাকে দেখা যায় ঘটে আম্রপল্লব নড়ে ওঠে আর ফুল পড়ে যায় বাবার শ্রীচরণে। হোঁৎকাও নিশ্চিন্ত হয়। কামড় বাবা বলেন, – যা তোর প্রার্থনা বাবা শুনেছেন রে! আর ভয় নেই। বাবার চরণামৃত নিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি যা। আর সেই ফুল মাদুলি করে লাল সুতোয় বেঁধে ডান হাতে ধারণ করবি। জয় বাবা পাতাল ভৈরব।

তারপর বাড়ি ফিরে রোজ মাদুলি ধোয়া জল খেয়েছে। পরীক্ষার দিন একশো আটবার কামড় বাবার নাম করেছে। তারপরও তিনটে সাবজেক্টে ফেল। পাসের নামগন্ধ নেই। টাকা জলে গেল। আর ভক্তিও যেন তার উবে গেছে।

সেই খবরটা আমরাও জেনে গেছি। হোঁৎকা গর্জে ওঠে—সব ফক্কিবাজী! ব্যাটা নাম্বার ওয়ান ভণ্ড। লোককে ঠকাইত্যাছে—আমারেও ঠকাইছে—

পটলা বলে-জ্ঞান হয়েছে তাহলে? পড়বি না—আর কামড় বাবা কেন স্বয়ং মহাদেব ও তোকে পাস করাতে পারবে না।

গোবরা বলে—তুই গেলি ওই ঠকবাজদের কাছে! গেল তো টাকাটা? হোঁৎকা বলে, —ওই কামড় বাবার সব জারিজুরি খতমই করুম। ওর ধর্মের নামে লোক ঠকানো বন্ধই করুম। আমার মত আর কেউ যেন না ঠকে।

কথাটা অবশ্য এখানের অনেকেই বলে। তবে বাবার চ্যালাদের দাপটও কম নয়। আমাদেরও জেদ চাপে। বেশ কিছু মানুষও চান বাবার এসব খেলা বন্ধ হোক। কিন্তু তারা তাদের ভয়ে জোর গলায় কথা বলতে পারে না। থানা পুলিশও কোনো অভিযোগ পায়নি। তাই সব দেখেও তারা না দেখার ভান করে।

সেদিন আশ্রমে কিসের উৎসব। বহু লোকসমাগম হয়েছে। কামড় বাবা বেশ সেজেগুজে পূজায় বসেছেন। শিবলিঙ্গ বলতে পাথরের একটা চাঁই। কালো সিঁদুর মাখা। তার সামনে একটা ঘটি। উপরে আম্রপল্লব, তার উপর ফুলের স্তূপ। সেই ঘট থেকে ফুল ফেলার জন্য বাবা তারস্বরে চিৎকার করছে।

—জয় বাবা পাতাল ভৈরব।

হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে সেই মাটির কলসিতে এসে লাগে গুলতি দিয়ে ছোড়া কাচের গুলি। আর তার আঘাতে মাটির ঘটি দু’ আধখানা হয়ে যায় আর জল সব বেরিয়ে যায়। দেখা যায় তার ভিতর থেকে বের হচ্ছে দু’তিনটে কাঁকড়া। ওই কাঁকড়াগুলোই ঘটির মধ্যে নড়াচড়া করলে আম্রপল্লবের ডগায় নড়া লাগে আর ফুল পড়ে যায়।

ঘটনাটা দেখে সকলেই হতবাক। এইভাবে পুরো ব্যাপারটা যে সাজানো, কামড় বাবার ভণ্ডামি তা ধরা পড়ে গেছে। বাবা গর্জে ওঠে—এসব কি?

হোঁৎকাই আজ গুলতি মেরে হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে। কামড় বাবাও এবার মরিয়া হয়ে ওঠে। ত্রিশূল নিয়ে সে লাফ দিয়ে ওঠে। হোঁৎকাকে সে নিধন করবেই। অবশ্য পুলিশে বলা ছিল আগে থেকেই। পুলিশ তাই ছদ্মবেশে ছিল ওই উৎসবে। তারাও কামড় বাবাকে হাতে নাতে ধরে ফেলে। বন্দি কামড় বাবা শুধু গর্জনই করে। বাবার সব জারিজুরি আজ হোঁৎকাই ধরে ফেলেছে।

 কেঁচো খুঁড়তে কেউটে

শত্রু যে কত রকমের হয় তার সম্বন্ধে কোনো বই-এ বিশদ ভাবে লেখা না থাকলেও তারা যে নানা প্রকারের, নানা রূপের হয় এটা এবার আমরা, অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের সভ্যবৃন্দ বেশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

আর ওই শত্রুদের কাজকর্মের নমুনা যত টের পাচ্ছি, মনে মনে ততই শিউরে উঠছি। এক এক সময়ে ক্লাবের ময়দানে সন্ধ্যার পর ঘাসের উপর বসে ঘোষণা করি,—পটলা, ক্লাব তুলে দে। এত শত্রু! উঃ !

হোঁৎকা গর্জে ওঠে,—ওগোর সব প্ল্যান, শত্রুতা বানচাল কইরা দিমু। চুপ মাইরা দ্যাখ।

ফটিক বলে,—আর কত দেখবো র‍্যা? ওই কুলেপাড়ার ইলেভেন বুলেটস্ আমাদের গুলি করে ফুটিয়ে দেবে! সেদিন দেখলি আমাদের ক্লাবের জমাটি বসন্তোৎসবটাকে ক্যামন করে ফাঁসিয়ে দিল! বাজারের দু’তিনটে ধর্মের ষাঁড়কে খাবারের লোভ দেখিয়ে এনে কিভাবে ক্লাবের মাঠে ঢুকিয়ে দিল !

সে এক কাণ্ড। ফটিক তখন সবে তার কালোয়াতি গানের মুখটা ধরেছে, চোখ বুজে শূন্যে হাত তুলে। ঠিক তখনই, একটা ষাঁড় উত্তেজিত হয়ে প্যাণ্ডেলে ঢুকে শিং দিয়ে, খান তিনেক চেয়ার এদিক ওদিক ছুঁড়তেই, দর্শকরা উঠে পড়ে প্রাণভয়ে কে যে কোনদিকে যাবে ঠিক করতে পারে না। ফটিকের তবলচিও কাট মেরেছে। তানপুরাওয়ালাও গদা ঘাড়ে করে সটকেছে। ফটিক চোখ খুলতেই দেখে সামনে ওই বিশাল বপু ষণ্ড মহারাজকে। অজান্তেই তখন গান ছেড়ে একেবারে তারস্বরে চেল্লাতে শুরু করে,—বাঁচাও -ও—! —বাঁচাও—ও—!

আমরা অবশ্য তখন লাঠি বাঁশ হাতে যণ্ড মহারাজদের যুদ্ধ থামাবার চেষ্টা করছি। পটলা দৌড়েছে ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করতে।

কোনোমতে ফটিককে তুলে আনি দুই যণ্ডের মাঝখান থেকে।

পরে জানা গিয়েছিল, এ ওই ইলেভেন বুলেটস্-এর নেতা গুপিনাথ বাঘ-এর কীর্তি। ওরা আমাদের ক্লাবের পিছনে আদানুন খেয়ে লেগেছে।

অবশ্য তার কারণ আছে। আমরা, পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব এলাকার মানুষদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা আদায় করি না। পটলার বাবা-কাকারাই ক্লাবের জমি দিয়েছেন। আর পটলাই তার হাতখরচা থেকে মাসে শ’তিনেক টাকা দেয় ক্লাবকে। আর আছেন পটলার ঠাকুমা।

আমরা পটলার দিনরাতের সঙ্গী। ওর পাশে থাকি। বহুবার ওই ওলি বংশধরকে বাঁচাবার জন্য ঠাকুমা আমাদের ক্লাবের উপর খুবই খুশি। তাই দায়ে-অদায়ে ঠাকুমা ক্লাবকে দু’পাঁচ হাজার টাকা দেন ।

ফলে আমরা ক্লাবের, ফুটবল টিম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—এগুলো অনায়াসেই করে থাকি এলাকার কাউকে চাপ না দিয়ে। সকলেই আসে আমাদের অনুষ্ঠানে।

নিজস্ব খেলার মাঠ—অনুষ্ঠানের জায়গাও আছে আমাদের। অন্য ক্লাবের তা নেই। আর ওদের কোনো অনুষ্ঠান করতে হলে টাকা চাই। তাই পাড়ার লোকের কাছে হাত পাততে হয়। তাছাড়া মোটা টাকা চাঁদা আদায় করে দোকানদারদের কাছ থেকে, বাজারের ফড়েদেরও নিস্তার নেই। সোজা কথায় না দিলে চমকায়। কারো দোকানের সাইনবোর্ডই খুলে ফেলে।

ফলে লোকে চাঁদা দেয় ওদের, কিন্তু বলে,—ক্লাব তো ওই পঞ্চপাণ্ডব। ভদ্দরলোকের ছেলেদের ক্লাব। ওদের খানদানই আলাদা। তোদের মত ছ্যাঁচড়ামি করে না।

এতে ওই ইলেভেন বুলেটস্-এর সভ্যরা হাড়ে হাড়ে চটে ওঠে। কিন্তু কিছুই করার নেই । তাই ওরা আমাদের ক্লাবের পিছনে লেগেছে। নানা ভাবে আমাদের ক্লাবের সুনাম তারা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায় ।

ফুটবল খেলায় ওরাই গোলমাল করে, খেলা পণ্ড করে দেয়। ওরাই রেফারি—এখানকার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার গজেনবাবুকে শাসায়,—পাড়ায় প্র্যাকটিস করতে দেব না।

ওদের ক্লাবের নন্টে বলে,—ওই লবেনচুষ মার্কা ওষুধ সব গিলে খেয়ে ডাক্তারি লাটে তুলে দেব। ইলেভেন বুলেটকে জিতিয়ে দিতে হবে।

গজেন ডাক্তার নিরীহ ছাপোষা গৃহস্থ মানুষ। খেলাধুলো ভালোবাসে। তাই কেউ ডাকলে গলায় বাঁশি নিয়ে হাফপ্যান্ট কেইডস্ পরে মাঠে নেমে রেফারিগিরি করে। কিন্তু এমন বিপদে পড়তে হবে সে ভাবেনি। গজেন ডাক্তার ইলেভেন বুলেটস্-এর বুলেটদের চেনে। নন্টে কথায় বলে,—তা কি করে হয়? ওদের টিম তো খেলা ভণ্ডুল করেনি। করেছ তোমরা ।

নন্টে বলে,—ওসব বুঝি না, ভালো কথায়, যা বললাম তাই করুন ডাক্তারবাবু, না হলে কাল থেকে বাজারে আপনার ডাক্তারখানার ঝাঁপ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

গজেন ভয়ে ভয়েই তাই পঞ্চপাণ্ডবকে হারিয়ে দিল। ব্যবসাপত্র বজায় রাখতে হবে তো ? পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব এবার শিল্ড পেল না। শিল্ড জিতলো ওই ইলেভেন বুলেটস্। ওরা বিজয়ী হয়ে বিরাট শোভাযাত্রা করে শিল্ড নিয়ে গেল আমাদের ক্লাবের সামনে দিয়ে।

প্রতিবার এই বিজয় উৎসব করি আমরাই, এবার হতাশ হয়ে দেখলাম ওদের নৃত্য। — পটলা বলে বিমর্ষ কণ্ঠে!

–এর পরেও বাঁ…ব…বাঁচতে বলিস ?

পটলার ওই এক দোষ। উত্তেজিত হলে তার জিবটা আলটাকরায় সেঁটে যায়। যাবারই কথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে। এতদিনের জেতা শিল্ড থেকে জোর করে ছিকে আউট করে দিল আমাদের। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের আর কত সর্বনাশ করবে ওরা জানি না !

এবার সত্যিই আমরাই বিপদে পড়েছি।

খবরটা আনে আমাদের ক্লাবের গোবরা নিজে। ওর মামার বিরাট হোলসেল কুমড়ো, চালকুমড়োর ব্যবসা। খালের ধারে বিরাট গুদামে টাল করে রকমারি সাইজের কুমড়ো সাজানো। দেড় দু’কেজি থেকে উৎকৃষ্ট তারকেশ্বরের আট-দশ কেজি সাইজের কুমড়োও মেলে। আর ওদিকে গাদা করা চালকুমড়ো।

কচি, বুড়ো, ছোকরা সব কিসিমের চালকুমড়োই আছে। ট্রাকে মাল আসে, গুদাম ভরে যায়। আবার কলকাতার বিভিন্ন বাজারে ওসব মাল বিলি হয়ে যায়। এসটক্ ক্লিয়ার। আবার মাল আসে দূর দূরান্তের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাক বোঝাই হয়ে।

গোবরা ওইসব কাজ দেখাশোনা করে। ইলেভেন বুলেটস্ ক্লাবের ওই গুপিনাথের বাজারে কুমড়োর দোকান। চালকুমড়োর মোরব্বার কারখানা। মামার এখান থেকে ছাতা পচা দুনম্বরী চালকুমড়োগুলো কিনে দোকানে লোক দিয়ে পিস্ পিস্ করে কাটায়। সেই চালকুমড়োর পিগুলোকে কাঠি দিয়ে ফুটো ফুটো করিয়ে কড়াই-এ রাত ভোর সেদ্ধ করে। তারপর সেই সেদ্ধ চালকুমড়োর পিসগুলোকে শুকিয়ে তারপর চিনির রসে সেদ্ধ করে চালকুমড়োর মিঠাই বা মোরব্বা বানানো হয়।

গুপিনাথ তাই বিরুদ্ধ ক্লাবের হলেও গোবরাকে কিছুটা বিশ্বাস করে। অবশ্য ওই মাল কেনাবেচায় গোবর্ধনেরও কিঞ্চিৎ অবদান থাকে, তাই গুপিনাথ গোবরাকে আড়ালে কিঞ্চিৎ কমিশনও দেয়।

এহেন গোবর্ধনকে ওই ইলেভেন বুলেটস্-এর গুপিনাথ গোপনে কথাটা জানায়। এবার তারা নাকি পটলার পিতৃদেবকেই ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করবে। আর পটলার বাবার সামনে ইলেভেন বুলেটস্ প্রমাণ করবে যে তারাই আসল কাজের লোক, ওই পঞ্চপাণ্ডবদের তুলনায় । ফলে খেলার মাঠটা তাদের ক্লাবকে দিলে তারাই এই অঞ্চলে খেলাধুলোর বিকাশ ঘটিয়ে এই ঊষর প্লেয়ারহীন মাটিতে প্লেয়ারের ফুল ফুটিয়ে দেবে।

পটলার বাবাও নাকি নিমরাজি হয়েছেন ।

এবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে আমাদের।

পটলা বলে, আর কিছু বাকি থাকল ই-ই-ন্ সাল্টের? মাঠ চলে গেলে ক্লাবও গন্ ফট ! হোঁৎকা বলে,—ঠামারে ক’, একটা ব্যবস্থা করণের লাগবো।

গোবর্ধন বলে,–না হলে ওরা এই সিজিনেই মাঠের দখল নেবে বলল ।

ফটিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহাকার ভরা কণ্ঠে বলে,–একে একে নিভিছে দেউটি।

জবাব কি দেব জানি না। তাই চুপ করেই থাকি। হোঁৎকা বলে, ওগোর ব্যবস্থা করনের লাগবোই।

এর মধ্যে বর্ষা নেমেছে। বর্ষা নামলে এদিকের চেহারা একেবারে বদলে যায়। এককালে এই এলাকা ছিল কলকাতার পূর্ব সীমান্ত। তারপরই খাল–ওপারে ছিল ভেড়ি, নলখাগড়ার বন, মাঝে মাঝে দু-চার ঘর বসতি তারপরই ভেড়ি।

এখন সেসব অঞ্চলই সল্টলেক, বাইপাস রোডে পরিণত হয়েছে। তখন এসবের চিহ্ন ছিল না। কুলেপাড়া বলতে নিচু জলা জমি, বাঁশ, আশশ্যাওড়া আর ঘেঁটুবন।

গ্রীষ্মে ছায়াময়, আর বর্ষায় জলে ডুবে যেত ওই অঞ্চল। ঘরবাড়ি যাদের ওদিকে ছিল, তারা এসে ঠাঁই নিত স্কুলবাড়িতে। আর ওই অঞ্চল তখন জলে থৈ থৈ করছে।

ওই জলবন্দী মানুষদের উদ্ধারের কাজে আমরাও নামতাম। বেশ কিছু লোককে এনে তুললাম পাড়ার মাতঙ্গিনী বিদ্যামন্দিরে। আমরাই চাল ডাল সংগ্রহ করে ওদের খিচুড়ি বিতরণ করতাম।

এবার ইলেভেন বুলেটস্ যেন জনসেবায় আত্মোৎসর্গ করেছে একাগ্রভাবে। বৃষ্টি নামার পরদিন থেকেই ওসব অঞ্চলে জল জমতে শুরু হবার মুখেই তারা কুলেপাড়া, শীলপাড়া, খালধার বস্তি থেকে লোকজনদের আগাম তুলে এনে ওদের পাড়ার চারুশীলা বালিকা বিদ্যালয়-এর বিল্ডিং ভরে তুলেছে।

পরের দিন সকালে আমরা জলবন্দী মানুষদের উদ্ধারের কাজে বের হবার মুখে গোবরাই খবর দেয়,আর যেতে হবে না।

ক্যান? একরাতেই সব ডুইবা গেছে গিয়া?—হোঁৎকা বলে।

গোবর্ধন বলে, – না, না ওই ইলেভেন বুলেটস্ কাল থেকেই ওসব অঞ্চলের লোকদের তুলে এনে চারুশীলা বিদ্যালয়ে গ্যারেজ করেছে। কাল রাতেই মামার গুদাম থেকে দুশো মণ কুমড়ো, কয়েক বস্তা পিঁয়াজ, আলুও এনেছে, জোর লঙ্গরখানা চালু করেছে দেখলাম, বড় বড় ডেকে খিচুড়ি চেপেছে ।

অবাক হই,—সেকি! তাহলে আমাদের রিলিফ ওয়ার্কের কি হবে?

হোঁৎকা বলে,—তাই দেখছি। সৎকাজও করতি দিবে না ওই গুপিনাথের দল।

পটলা বলে,—ক্-ক্লাব এবার তুলেই দিতে হবে।

ফটিক বলে,—এবার মাঠই না কেড়ে নেয়। এই ঘরও! তাহলে কি করে এলাকায় মুখ দেখাবি হোঁৎকা?

পটলা বলে,—ওই গুপিনাথকে দেখি বাবার কাছেও যায় টায়।

হোঁৎকা বলে,—এই জমি ওর বাবার নয়, এ জমির মালিক সুভাষিণী দেব্যা—তর ঠাকুমা। ঠাকুমারেই গিয়া কই চল। যেন জমি না দেয়।

আমি বলি, ইলেভেন বুলেটকে ঘা না দিলে সর্বনাশ হবে। এখন কি করে মোক্ষম ঘা-টা ওদের দেওয়া যায় তাই ভাব।

ইলেভেন বুলেটস্-এর কর্ণধার গুপিনাথ খুব ঘোড়েল ব্যক্তি। বাজারে একটা মুদিখানার দোকান চালায়—আর কর্তাদের ধরে করে সেই সঙ্গে রেশন শপ্-ও চালু করেছে। এখন সেই দোকান রমরমিয়ে চলছে। খালধারে একটা গুদামও ভাড়া নিয়ে সবরকম মালপত্র রাখছে। ক’মাসের মধ্যেই গুপিনাথ বেশ ফেঁপে উঠেছে। একটা মোটর বাইক হাঁকিয়ে তার আদি নিবাস বনগাঁ থেকে সীমান্তের দিকে কোনো অজ পাড়াগাঁয়েও যাতায়াত করে।

আর ক্লাব করে এখানকার এম.এল.এ সুধীরবাবুরও খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে। ফলে থানার বড়বাবু, মেজবাবু, মায়বিটের কনস্টেবলরাও ওকে ভালো করে চেনে। দেখা হলে সেলাম জানিয়ে কুশল সংবাদ নেয়।

সুধীরবাবুও জানে সামনে ইলেকশন আসছে। ভোটে জিততে হলে ওই ক্লাবকে হাতে রাখতেই হবে। ওরাই এদিকের সব বস্তির ভোট নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সুধীরবাবুও গুপিনাথকে তার গাড়িতে নিয়ে ঘোরে যখন তখন। সারা এলাকার মানুষও জানে এম.এল.এ-কে দিয়ে কোনো কাজ করাতে হলে গুপিনাথবাবুকেই ধরতে হবে। তাই পারমিট্, লোনের জন্য আসে তারা গুপিনাথের কাছেই। গুপিনাথও ক্রমশ বুঝেছে এই লাইনের ব্যাপারটা।

কিছু পেতে গেলে কিঞ্চিৎ দিতে হবে। গুপিনাথ সেই থেকে আমদানিও শুরু করে। আর সেই টাকা ব্যবসাতে ঢালে। ক্রমশ গুপিনাথ পটলার কাকার সঙ্গেও পরিচিত হয়ে ওঠে। পটলার কাকার কারখানায় রকমারি সাবান, সুগন্ধি কেশতৈল, আয়ুর্বেদিক মলম—এসব তৈরি হয়। আর গুপিনাথ ওসবের এজেন্সি নিয়ে বেআইনি পথে সেইসব মাল বাংলাদেশে পাচার করে বিরাট মুনাফা গড়ে তুলেছে।

ফটে পটলার কাকা এখন ব্যবসা করছে ভালোই, আর সেই সুবাদে গুপিনাথও উপরে উঠছে। এবার পটলার বাবা অর্থাৎ ও বাড়ির বড়বাবুর বিশ্বাসভাজন হতে পারলে ওই বিঘে তিনেক খেলার মাঠটাও নিশ্চিত দখলে এসে যাবে।

ওই মাঠ হাতে এলে বছর কয়েক খেলার নামে কিছু খরচ করে তারপর রাতারাতি ওখানে ফ্ল্যাটবাড়ি তুললে কোটি টাকা আমদানি হবে। বাকিটা সামলে দেবে নেতা—ওই সুধীরবাবুই। সেই মতলবটা অবশ্য এখন প্রকাশ করে না গুপিনাথ। এ বাড়িতে আসে যায় ৷

ঠাকুমা গুপিনাথকে চেনে। আগে গুপিনাথ লাড়ে সাইকেল চেপে ঘুরত। এখন জিপ নিয়ে ঘোরে।

ঠাকুমা বলে পটলার বাবা গোবিন্দবাবুকে,—ওই লগার মত লোকটা তোর কাছে আসে কেন? মদনও দেখি ওর সঙ্গে ঘোরে।

মদন পটলার কাকা। গোবিন্দবাবু বলে,—ও এলাকার সেবামূলক কাজ করে। দেশপ্রেমিক গুপিনাথ ।

ঠাকুমা বলে,—ওই কাকতাড়ুয়ে হল দেশপ্রেমিক! রেশনের মাল দেয় না, সব ব্ল্যাক করে। ওর সঙ্গে মিশবি না, ও বাজে লোক।

মায়ের উপর কথা বলার সাহস নেই গোবিন্দবাবুর। চুপ করে থেকে বলে,—এখানে খেলার জন্যে সরকারি টাকা এনে স্টেডিয়াম করবে, তাই বলছিল ওই মাঠটা যদি ওদের দেওয়া যায়—!

ঠাকুমা অবশ্য আগেই শুনেছে কথাটা। হোঁৎকার দল সবই বলেছে তাকে। ঠাকুমা বলে, —সরকার ইস্‌টেডিয়াম করবে—নিজেরা মাঠ দেখে নিক। আমার জমি আমি দেব না। পটলারা খেলছে—খেলবে ওখানে।

গোবিন্দবাবু আপাতত চুপ করে যান। কিন্তু খবরটা হোঁৎকাদের কাছে ঠিক পৌঁছে যায়। এবার আমরাও জরুরি মিটিং ডাকি। বেশ বুঝেছি যে ওই গুপিনাথ এবার আমাদের হঠিয়ে এই মাঠের দখল নিতে চায় ৷

এদিকে আমরাও গোপনে ক’জন মিলে ওই গুপিনাথের হাল হকিকত-এর খবর নিতে শুরু করেছি। ফটিকের মামার বাড়ি বনগাঁয়ের ওদিকে। গুপিনাথের গ্রামটা ফটিক চেনে। সেও তার মামার বাড়িতে চারপাঁচ দিন থেকে গুপিনাথের সম্বন্ধে যা সব খবর এনেছে তা একেবারে চমকপ্রদ।

আমরা অবাক হই। শুধোই ফটিককে,—ঠিক খবর তো রে ফটিক?

এবারে ফটিক যেন গুপিনাথকে বধ করার মত ব্রহ্মাস্ত্র হাতে পেয়েছে। বলে সে—ঠিক মানে? একেবারে ঠিক। ওরা রাতের অন্ধকারে মোটা টাকা দিয়ে, লাইন করে ওদিক থেকে লাখলাখ টাকার বিদেশি মালপত্র আনে, আর এদিক থেকে ট্রাকে চাল, ডাল, চিনি, টিনটিন সরষের তেল, আলু—এদেশের লোকের মুখের গ্রাস টাকার জন্যে ওদেশে পাচার করে। আর মালপত্র কখন আসে, কোথায় আসে—তাও খবর এনেছি।

পটলা বলে,—চুপ করে থাক। কালই তোকে নন্দ মেসোর কাছে নিয়ে যাব।

নন্দদুলালবাবু পটলার আপন মেসোমশাই। লালবাজারের বিরাট পুলিশ অফিসার। ফটিক ঢোক গিলে বলে,–কোনো গোলমাল হবে না তো রে?

হোঁৎকা বলে,–না-না। কাল যা ওরে লই’ সব রিপোর্ট কইরা আয়। এদিকে আমরাও দেখছি, ওই দ্যাশসেবক গুপিনাথেরে এবার শিক্ষাই দিমু একখান।

হোঁৎকা তার পরিকল্পনাটা আমাদের বলেছে।

ফটিক বলে,এদিককার সঠিক খবর আমি এনে দেবো, সেইমত অ্যাকশন করতে হবে।

ব্যাপারটা খুবই গোপনে ঘটিয়ে চলেছি আমরা। পটলার সেই পুলিশের কর্তা মেসোমশাইও পটলাকে দিয়ে ফটিককে ডাকিয়ে এনে নিজে থেকে কি সব জেরা করে সীমান্তের ধারে ওই গ্রামটার সম্বন্ধেও সব খবর নিয়ে বলেন,–এবার নজর রাখো ফটিক। খবর যা শুনবে বা পাবে আমাকে জানাবে ।

এদিকে গুপিনাথও থেমে নেই। সারা এলাকায় একজন দরদি সমাজসেবক বলে পরিচিত হয়ে উঠেছে সে। এবার বর্ষায় ওই বানডুবি অঞ্চলের মানুষদের জন্য একেবারে পার্মানেন্ট ক্যাম্পই বানিয়েছে ওই চারুশীলা বালিকা বিদ্যালয়ের দুখানা তিনতলা বিল্ডিং-এ ।

আর এম.এল.এ মন্ত্রীরাও যখন ওর হাতের লোক, সুতরাং ফুড ডিপার্টমেন্ট থেকে ওই ক্যাম্পের চাল, ডাল এসবের পার্মানেন্ট কোটাও বের করেছে। প্রায় হাজার বস্তা চাল, দুশো বস্তা ডাল এসবও আসছে রিলিফের জন্য।

আমরাও এবার ওদের দলে ভিড়েছি। অর্থাৎ ইঁদুর যেমন ডুবন্ত নৌকা ছেড়ে নদীতে লাফ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে, আমরাও তেমনি কৌশল করে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব ছেড়ে ওই ভাসমান তরী ইলেভেন বুলেটস্-এ সভ্যপদ পাবার জন্য দরখাস্ত করেছি।

গুপিদাই বলে,—কিছুদিন ট্রায়ালে থাকতে হবে তোদের, তারপর কমিটি মিটিং-এ তোদের মেম্বার করে নেবো। তবে তোদের ক্লাবঘর তুলে দিতে হবেই হবে।

অর্থাৎ তাহলেই ওরা পটলার বাবাকে এনে দখল নেবে মাঠের। হোঁৎকা বলে, – আমরা তো ছাইড়াই দিছি ক্লাব। অন্য মেম্বারদের কন তো প্যাঁদাইয়া দিমু। বাপ্ বাপ্ কইতি কইতি মাঠ ক্যান হেই কুলেপাড়া ছাইড়া পলাইব।

গুপিনাথ বলে,—দেখি ভালো কথায় যদি কাজ না হয় তাহলে আঙুল বাঁকাতে হবে। মোট কথা, আমার মাঠের দখল চাই।

আমরা এখন পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের বিপক্ষ ইলেভেন বুলেট্সে। গুপিদাই আমাদের আপনজন। তাই বলি,–অর্ডার করবেন অ্যাকশন ঠিক হয়ে যাবে। মাঠও আসবে আমাদের কব্জায়। ওরা আর কজন? কি করে ক্লাবকে বাঁচাবে?

হোঁৎকা বলে,—আমরা রেজিনেশন দিছি পঞ্চপাণ্ডব খনে।

তাই গুপিদা আমাদের উপর এখন ভরসা করে এগোচ্ছে। আমরাও এখানকার রিলিফ ক্যাম্পের বিশ্বস্ত কর্মী। হিসাবপত্র রাখি। ওই গুদামে অবশ্য আমাদের যেতে দেয় না গুপিনাথ । সেখানে তার একান্ত বিশ্বস্ত কিছু ছেলে কাজ করে।

গুপিনাথ মাঝে মাঝে রাতে উধাও হয়ে যায়। সারারাত কোথায় থাকে, কি করে কেউ জানে না। ফেরে পরদিন, আর কর্মব্যস্ততাও বেড়ে যায় তখন। গুদামে মাল আসা যাওয়া করে রাতের অন্ধকারে।

এদিকে নেতা মন্ত্রীরাও আসছে। এখানে খেলার স্টেডিয়াম হবে। সুধীরবাবুদের নিয়ে গুপিনাথ এবার পটলার বাবাকেই ধরে,—ওই মাঠটা দেন। পটলাদের ক্লাব উঠেই যাবে। ওখানে পাকা স্টেডিয়াম হবে।

অবশ্য এর আগে নশুবাবু নেতা থাকাকালীন একটা মাঠে কোনো মন্ত্রীকে দিয়ে একটা পাথরের ফলক লাগিয়ে ছিলেন। সেটা এখন ঝোপজঙ্গলে ঢাকা পড়ে আছে।

পটলার ঠাকমাকে খবরটা আমরাই দিয়েছি। ঠাকুমা সব শুনে বলে,–গোবিন্দ তোর ওই ন্যাতাদের বল মাসির মাঠে যে শীল পুঁতেছিল মন্ত্রী, ওই মাঠেই কাজ হোক। এখানে কেন? গুপিনাথ বলে,—ওখানে জলা। এই মাঠটা হলে দারুণ হত—আপনার স্বামীর নামে পাকা মাঠ হবে।

এর মধ্যেই হঠাৎ খবর আসে, ক্যাম্পে নাকি আন্ত্রিক না হয় ফুড পয়জন হয়েছে কয়েকজনের। কাতরাচ্ছে তারা। আমরা অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে ক্যাম্পের সাতজনকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠিয়েছি।

আরও অনেকে অসুস্থ। গোবরার মামার কুমড়ো বওয়া গাড়িকেই অ্যাম্বুলেন্স বানিয়ে রোগীদের পাচার করছি।

সারা এলাকার মানুষ ক্ষেপে উঠেছে। খারাপ খাবার খাইয়ে ক্যাম্পের লোকদের মারতে চায় এই ইলেভেন বুলেটস্। ভাগ্যিস পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব ছিল তাই ওদের হাসপাতালে পাঠিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে।

পুলিশেও খবর যায়।

গুপিনাথ সেদিন তার বিশেষ কাজে ব্যস্ত। সে তখন সীমান্তের গ্রামে। সে জানে না তার দুর্গে এবার আক্রমণ শুরু হয়েছে। পচা ভেজাল চাল ডাল, ভোজ্য তেল-এর অভিযোগ উঠতে পুলিশ ও জনতা ওই গুদামেই হানা দেয়। এর মধ্যে ফটিকও গিয়ে হাজির হয়েছে পটলের সঙ্গে তার পুলিশ মেসোমশায়ের কাছে। সব জেনে তিনিও ফোর্স নিয়ে এসে গুদামে হানা দেন ৷ আর দেখেন রাশি রাশি ভালো চাল, ডাল, তেল ট্রাকে উঠে চলেছে সীমান্তের দিকে। আর এদিকে ক্যাম্পের লোকেদের খাওয়ানো হচ্ছে ধানকল থেকে সংগৃহীত বাতিল খুদ্, পচা চাল ডাল ৷

গুদাম থেকে বের হয় হরেকরকমের দামি বিদেশি মালপত্র। কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস। এদিকে তখন গুপিনাথ নতুন চালানের মাল নিয়ে বিজয়ীর মত ঢুকছে। এক একটা চালানের মাল ঠিকমত আনতে পারলে দিয়ে-থুয়েও লাখখানেক টাকা থাকে। প্রতি মাসে এরকম দুতিনটে চালান তার হাতে আসে।

—হল্ট।

চমকে ওঠে গুপিনাথ ।

পথের মাঝে অন্ধকারে চারিদিক থেকে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে তাকে। তিন চার লরি মালসমেত। বের হবার পথ নেই। পুলিশের ইমার্জেন্সি আলো—ওদিকে দুচারটে সার্চলাইট রাতকে দিন করে তুলেছে।

হাতে-নাতে ধরে ফেলে পুলিশ, গুপিনাথ আর ওই এলাকার নেতাকে। এতদিন ওরা দেশসেবক, সমাজ সেবকের মুখোশ পরে ছিল, আজ সেই মুখোশ তাদের খুলে পড়েছে। সকালে সারা কুলেপাড়ার মানুষ ভেঙে পড়ে। তারা দেখছে গুদামে পুলিশ ভর্তি। কয়েকশো বস্তা ভালো চাল ডাল ও ক্যাম্পের মাল পাচার করছিল গুপিনাথের দলবল।

এবার ইলেভেন বুলেটস্-এর বেলুন চুপসে গেছে। নেতা ও তাদের দলবলকে পুলিশ এবার জুলুম করে টাকা তোলা, লোকের ক্ষতি করা ইত্যাদি নানা চার্জে ধরেছে।

আর গুপিনাথও দেখেছে পুলিশ সাহেব পটলা, ফটিকদের স্টেটমেন্ট রেকর্ড করছে। হোঁৎকাই ওই ক্যাম্পের আন্ত্রিকের ব্যাপারটা ঘটিয়েছিল তার চেনাজানা কজনকে দিয়ে। তারপরই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়।

এবার আমাদের মাঠ আবার জমে ওঠে। ইলেভেন বুলেটস্ দু’দিন মাথা তুলেই একেবারে ঠান্ডা! আবার নব উদ্যমে লেগে পড়েছি আমরা। ক্লাবকে বিপদে ফেলার মত আর কেউ নেই ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *