শ্রেণিপ্রক্রিয়াকে কেন্দ্রে রেখে একটি নতুন রাজনৈতিক ভাষ্যের সন্ধানে
অচিন চক্রবর্তী
ভূমিকা
কিছুদিন আগেও, যখন এদেশের মার্কসবাদীদের কথাবার্তা এখানে ওখানে শোনা যেত, শুনতাম তাঁরা ‘শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে’। শ্রমিকশ্রেণির বিপরীতে পুঁজিপতি। শ্রেণিসংগ্রাম মানেই পুঁজিপতিশ্রেণি আর শ্রমিকশ্রেণির দ্বন্দ্ব। অথচ বিংশ শতাব্দী জুড়ে আর্থনীতিক সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা যেভাবে বদলাতে থাকল, এই দ্বৈত শ্রেণি-বিভাজন আর প্রাসঙ্গিক থাকল না। আধুনিক করপোরেট সংস্থায় পুঁজির মালিক আর বিবিধ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা এক নয়। মালিক সেখানে অনেক— প্রত্যেক শেয়ার মালিকই কোম্পানির মালিক, আংশিক যদিও। কিন্তু কোম্পানির দৈনন্দিন কাজকম্মে তাঁদের মাথা গলানোর কথা নয়। সেটা শীর্ষস্থানীয় ম্যানেজারের কাজ। আমাদের দেশে অধিকাংশ কোম্পানির ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা নিয়ন্ত্রণ করছে কোনও পরিবার বা গোষ্ঠী, আক্ষরিক অর্থে পুঁজির পুরো মালিক না হয়েও প্রায় সব সিদ্ধান্ত তাঁরাই নিচ্ছেন। অর্থাৎ, শুধু উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ঘিরে বিভিন্ন গোষ্ঠীস্বার্থের দিকে তাকালেই দেখতে পাচ্ছি দ্বৈত শ্রেণি-বিভাজনের গুরুত্ব ফিকে হয়ে যাচ্ছে যেন। শেয়ার-মালিকের স্বার্থ, বোর্ড সদস্যের স্বার্থ, ম্যানেজারের স্বার্থ, শ্রমিকের স্বার্থ— এর প্রত্যেকটি অন্যটির থেকে স্বতন্ত্র। উৎপাদন প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে সামগ্রিকভাবে সমাজব্যবস্থার দিকে দেখলে তো দেখি নানান স্বার্থের ভিড়ে সেটা আরও ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, নানা ধরনের সংগ্রাম ও আন্দোলন হতে দেখা যায় যেখানে মানুষ শামিল হয়ে থাকেন কিছু সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে। যেমন, জনজাতিদের আন্দোলন কিংবা লিঙ্গ-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। এসব ক্ষেত্রে আন্দোলনকারী মূল গোষ্ঠীকে কোনওভাবেই পুঁজি-শ্রম-ভিত্তিক এই দ্বৈত শ্রেণি-বিভাজনের আদলে ফেলা যায় না। এমনকী মানুষ যখন ‘আমরা নিরানব্বই শতাংশ’ বলে রাস্তায় নামেন তাঁদের সবাইকেই ঠিক ধ্রুপদি অর্থে প্রোলেতারিয়েত বলা যায় না। এইসব থেকে মনে হয়, মার্কস যে শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা বলেছেন, যেখানে শ্রেণি বলতে মূলত দু’টি পরস্পরবিরোধী শ্রেণি বোঝায়, আজকের দিনে তা কতটা প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ের মূল দ্বন্দ্বগুলিই-বা চিহ্নিত হবে কীভাবে? শ্রেণির আতসকাচ দিয়ে বর্তমান সময়টা দেখার চেষ্টা আদৌ কোনও বিকল্প রাজনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে পারে কি? এইসব প্রশ্ন নিয়ে এই প্রবন্ধ। প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গিয়ে মার্কস-উত্তর বিশেষ কিছু আলোচকের সাহায্য নিয়েছি।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল, যদি বলি ভূমণ্ডলের যাবতীয় প্রশ্নই আদতে শ্রেণি-বিষয়ক, তাহলে শ্রেণি কথাটির আর ধার থাকে না। তাই গোড়াতেই কোনগুলি শ্রেণি-বিষয়ক এবং কোনগুলি নয় সেটা বুঝে নিতে হবে। এবং তারপর এদের মধ্যে সম্পর্কগুলি বুঝতে হবে। বলা বাহুল্য, দু’জন ব্যক্তির প্রেমের সম্পর্ককে কোনওভাবেই শ্রেণি-বিষয়ক বলা যায় না। অথচ যুবা বয়সে কোথায় যেন পড়েছিলাম ‘শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রেমও কলুষিত হতে বাধ্য’। এই ‘বাধ্য’ কথাটিতে খুবই বিচলিত হয়েছিলাম। ‘বাধ্য’ কিংবা ‘অবশ্যম্ভাবী’— এই শব্দগুলিকে তখন বামপন্থী লেখাপত্রে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে দেখা যেত, যেহেতু মার্কসবাদকে ‘বিজ্ঞান’ বলা হত।
পুঁজি-শ্রম দ্বন্দ্ব থেকে দুটি শ্রেণি
সত্যের খাতিরে অবশ্য বলতে হয়, পুঁজি-শ্রম-ভিত্তিক দুই প্রধান শ্রেণি ছাড়া অন্য ‘শ্রেণি’দের অস্তিত্ব বরাবরই ছিল। এমনকী রোজা লুক্সেমবুর্গও সেই কবে লিখে গেছেন—
এই দু’টি শ্রেণি (অর্থাৎ পুঁজিপতি ও শ্রমিক) ছাড়াও নানান মানুষজন আছেন: জমিদার, বেতনভুক কর্মচারী, স্বাধীন পেশায় থাকা ডাক্তার, আইনজীবী, শিল্পী এবং বিজ্ঞানী। তদুপরি চার্চ এবং তার সেবকরা আছেন, পুরোহিত, এবং পরিশেষে রাষ্ট্রের আধিকারিক ও সেনাবাহিনী। এইসমস্ত বিভিন্ন স্তরের মানুষদের পুঁজিপতি বা শ্রমিক কোনও শ্রেণিতেই ফেলা যায় না। অথচ যেকোনও সমাজকেই এঁদের ভরণপোষণ করতে হবে।১
কিন্তু মার্কস পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে এই দু’টি শ্রেণিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে করা হয়। এই মনে করার পেছনে প্রধান কারণ সম্ভবত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-র এই স্পষ্ট বাক্য: ‘সমাজ সামগ্রিকভাবে দু’টি প্রধান বিরোধী শিবিরে বিভাজিত, দু’টি প্রধান শ্রেণিতে, যারা সরাসরি পরস্পরের মুখোমুখি— বুর্জোয়া এবং সর্বহারা’।২ মার্কস যখন সামাজিক গঠন ও উৎপাদন ব্যবস্থার পৃথক ধারণা দু’টি আনছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে অন্য ব্যবস্থাগুলির পার্থক্য বোঝাতে, তখনও দু’টি প্রধান শ্রেণির দ্বন্দ্বের কথাই আসছে— যেকোনও সামাজিক গঠনে একটি বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থা অন্যগুলির উপর ছাপিয়ে উঠছে এবং প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থা চিহ্নিত হচ্ছে দু’টি প্রধান শ্রেণির দ্বন্দ্বের দ্বারা। পুঁজিবাদে যেমন পুঁজিপতি-শ্রমিক, সামন্ততন্ত্রে তেমন প্রভু-ভৃত্য, দাসব্যবস্থায় দাস ও তার মালিক। আবার অন্যত্র মার্কস কিন্তু শ্রেণির ধারণা বিষয়ে তেমন সোজাসাপটা নন। নানান ইঙ্গিত তিনি রেখে গেছেন যা থেকে অন্য ভাষ্য তৈরির সম্ভাবনা থেকে যায়।
দু’টি পরস্পরবিরোধী শ্রেণির ধারণাকে তত্ত্বের একমাত্র ধারণা বলে অনেকেই মানতে চাননি। কেউ কেউ প্রধান দু’টি শ্রেণির ধারণাকেই মূল ধারণা মেনে নিয়েও বলার চেষ্টা করেন দু’টির কোনওটিই সমসত্ত্ব পদার্থ নয়। যেমন পুঁজিপতি বলে সব পুঁজির মালিককেই এক করে দেখলে চলবে না। কেউ অতি বৃহৎ, কেউ অতি ক্ষুদ্র, কারোর একচেটিয়া বাজারের ক্ষমতা, কেউ-বা বৈদেশিক বাজারের সুবিধা নিতে পারে, কাউকে আবার রাজনৈতিক যোগাযোগ সুযোগ করে দেয়, ইত্যাদি। শ্রমিকদের মধ্যেও সেরকম অনেক বিভাজন রয়েছে— ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন। এইসব বিভাজন থেকেই রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির ব্যাখ্যা খোঁজা হয় যখন শ্রেণিস্বার্থের নিরিখে শ্রেণিদ্বন্দ্বের ধ্রুপদি চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবের রাজনীতিতে নানাবিধ জটিল গাঁটছড়া বন্ধন দেখা যায় যা ধ্রুপদি মার্কসবাদ অনুসরণ করে দ্বৈত শ্রেণিবিভাজন দিয়ে বোঝা যায় না। কিন্তু এই মার্কসবাদীরা শেষমেশ দু’টি শ্রেণির মূল কাঠামোকে কিন্তু পরিত্যাগ করছেন না।
অন্য দিকে অন্যরকম ভাষ্যের তাগিদে কেউ যুক্ত করেছেন অন্য শ্রেণিগুলিকে, যাদের সরাসরি পুঁজিপতি বা শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ফেলা যায় না, যেমন কৃষক,৩ অথবা হস্তশিল্প কারিগরের মতো যেকোনও স্বনিযুক্ত ব্যক্তি। তবে ধ্রুপদি মার্কসবাদী আলোচনায় এই বর্গগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কারণ ধরে নেওয়া হয় পুঁজিবাদী বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শেষমেশ দুই প্রধান শ্রেণিতে মেরুভবন হবে, ফলে এই শ্রেণিগুলি আর থাকবে না। লেনিনের ডেভেলপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজ়ম ইন রাশিয়া-র (১৮৯৯) সারবস্তু ছিল এটাই। আর একে অনুসরণ করে সমাজতান্ত্রিক দল, অর্থাৎ, রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (আর.এস.ডি.এল.পি.) জোর ধাক্কাও খেয়েছিল। সংক্ষেপে সেই ইতিহাসটুকু এখানে বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। অ-পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থা মার্কস খুব গভীরে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয় না। মার্কস তথা অন্যান্য ধ্রুপদি রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের কেউই কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত ছিলেন না। পুঁজিবাদের উদ্ভবের সেই কালে শিল্পে পরিবর্তনগুলো এতটাই চোখে পড়ার মতো ছিল যে, সে যুগের যাবতীয় তত্ত্বায়ন প্রচেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই একে ঘিরে হয়েছে। কৃষক প্রসঙ্গ এলেই তাকে ‘একরকম রহস্যময়, অদ্ভুত, খাপছাড়া জীব’ বলে বর্ণনা করেছেন মার্কস। ‘আলুর বস্তা’, ‘নির্বোধ গ্রামীণ জীবন’ এমন আপত্তিকর বিশেষণেরও জন্ম দিয়েছেন। কৃষি হোক বা শিল্প, ধ্রুপদি মার্কসবাদে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি বোঝা হয়েছিল মোটামুটি একভাবে। উৎপাদন শক্তির বিকাশের ফলে উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে তার সামঞ্জস্যের অভাব ঘটবে, আর তার ফলে সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়ায় পুঁজির কেন্দ্রাভিগ প্রবণতা এবং ফলত প্রোলেতারিয়ানাইজ়েশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। সেই ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে পার্টির মতটা ছিল কৃষিতে কেন্দ্রীভবন আর মেরুভবন যেহেতু ঘটবেই, সমাজবাদীদের কাজ হবে একে ত্বরান্বিত করা। এই ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব নিয়ে মাঠে নেমে পড়তেই গোলমাল লেগে গেল। তৎকালীন রুশ কৃষকদের থেকে কেই-বা বেশি জানে যে লেনিনের কেন্দ্রীভবনের গল্পটা বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না? অনেক জায়গায় বরং উলটোটাই ঘটেছে— অল্পসংখ্যক বিশাল এস্টেটের পরিবর্তে ছোট ছোট জোতের মালিক সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। বিপ্লবের প্রয়োজনে এবং প্রগতির নিয়মে তাদের সর্বহারা হয়ে যেতে হবে এমন উদ্ভট সম্ভাবনায় কৃষকরা বেঁকে বসল। সমাজতান্ত্রিক দল সর্বত্রই জোর ধাক্কা খেতে থাকল কৃষকদের থেকে। এই টানাপড়েনের মধ্যে থেকেই উঠে এল ‘কৃষিপ্রশ্ন’। ফ্রাঙ্কফুর্ট (১৮৯৪) ও ব্রেসলাউ (১৮৯৫) কংগ্রেসে এই প্রশ্ন পার্টিকে প্রায় ছিন্নভিন্ন করতে চলেছিল। তখনকার মতো যদিও সামাল দেওয়া গেল, পরবর্তীকালে এটাই প্রধান প্রশ্ন হয়ে থাকল বেশ কিছুকাল। মার্কসও তাঁর শেষজীবনে কৃষিপ্রশ্ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে চেয়েছিলেন। তেওডোর শানিন সম্পাদিত লেট মার্কস অ্যান্ড দ্য রাশিয়ান রোড৪ পুস্তকে এর আভাস আছে। মার্কসের মৃত্যুর পর ‘কৃষিপ্রশ্ন’কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা পার্টি করে গেছে। লেনিন নানান প্যাঁচালো যুক্তি দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করে যেতে থাকলেন রাশিয়ায় সত্যিই কৃষিতে উৎপাদন শক্তির কেন্দ্রীভবন ঘটেছে, কৃষকরা যা-ই বলুন।
কৃষিপ্রশ্ন আবার খানিকটা অন্যভাবে এল বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ায় তথাকথিত ‘নতুন আর্থনীতিক নীতি’র সময় থেকে। সদ্যোজাত রাষ্ট্রের তখন প্রয়োজন পুঞ্জীভবন ও আর্থনীতিক বৃদ্ধির হার যথাসম্ভব বাড়ানো। এবং তার জন্যে প্রয়োজন কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত সরিয়ে শিল্পে বিনিয়োগ করা। বিপ্লব হয়ে গেলেও সোভিয়েত রাশিয়ায় তখনও কৃষিতে বড় ও মাঝারি কৃষকের প্রাধান্য। বেশি জোরজার করে রসদ সংগ্রহ করতে গেলে এঁরা বিদ্রোহ করতে পারেন, এমনকী যাঁরা ছোট কৃষক, যাঁদের বেশিরভাগই বিপ্লবে সমর্থনও করেছিলেন, তাঁরাও বেঁকে বসতে পারেন। বিপ্লবোত্তর প্রথম এক দশকে এ নিয়ে অত্যন্ত টানাপড়েন চলেছিল। তারপর স্তালিন মঞ্চে এসে গেলে আর ওসবের দরকার হল না। এক দিকে কুলাকদের ওপর প্রবল দমনমূলক নীতি এল, আর সমাজতন্ত্রের ‘শত্রুরা’ যেভাবে একে একে হারিয়ে যেত সে আমলে, ‘কৃষিপ্রশ্ন’ও সেভাবেই নিরুদ্দেশ হল।
ইতিহাসের এই অধ্যায়টুকুর অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণীটি এখানে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য বাস্তব রাজনীতিতে শ্রেণিপ্রক্রিয়ার যথাযথ বিশ্লেষণ ও শ্রেণিগুলিকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তা কতখানি তার আভাস দেওয়া। সেইসঙ্গে এও দেখানো, রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতাবলে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন, আহরণ ও বণ্টনে কেমন চরম অবস্থান নিতে পারে।
দ্বৈততা থেকে বেরিয়ে এসে
কেউ আবার অর্থনীতি-ভিত্তিক শ্রেণিসংঘাতের ধ্রুপদি ধারণা থেকেই সরে আসতে চান। সমাজের যাবতীয় দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা শেষমেশ অর্থনীতিতেই নিহিত রয়েছে— এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আর্থনীতিক নির্ধারণবাদ (economic determinism) বলা হয়ে থাকে। মার্কসের তত্ত্বকে আদিতে যেভাবে বোঝা হত তাকে আর্থনীতিক নির্ধারণবাদ দোষে দুষ্ট হিসেবে সমালোচনা করেছেন পরবর্তী আলোচকরা। আর্থনীতিক নির্ধারণবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে এঁরা ‘ক্ষমতা’ ও ‘দমন’-এর ধারণাকে কেন্দ্রস্থলে নিয়ে এসেছেন। যেমন রালফ মিলিব্যান্ড (Ralph Miliband)। এই ধারণা অনুসারে ক্ষমতার নিরিখে দমনকারী ও দমিতের বিভাজন মাথায় রাখলে দেখা যাবে তা শুধু পুঁজি-শ্রম ঘিরে যে আর্থনীতিক কাঠামো সেখানেই দেখা যাচ্ছে তা নয়— রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত ক্ষেত্রেও ক্ষমতার বৈষম্য থাকছে, দমনকারী ও দমিত থাকছে। এই ভাবনায় দমন চলে আসছে কেন্দ্রস্থলে আর শ্রেণি ধারণাটি আসছে দমনের অনেকগুলি উৎসের একটি হিসেবে যা আর্থনীতিক। এখানে ক্ষমতা বা দমন শুধুমাত্র আর্থনীতিক উৎস থেকেই যে উদ্ভূত হচ্ছে তা নয়। এই ভাবনার সঙ্গে অনেকে সহমত হলেও মার্কসীয় শ্রেণির ধারণাটিকে সরিয়ে দমনকারী-দমিত বিভাজনটিকে কেন্দ্রে রাখায় প্রশ্নের অবকাশ আছে। এ যেন এক ধরনের নির্ধারণবাদের সীমাবদ্ধতা দূর করতে আর-এক ধরনের নির্ধারণবাদ বা মর্মবস্তুবাদ (essentialism) এনে ফেলা হচ্ছে। এখানে দ্বন্দ্বের মর্মবস্তুটি চিহ্নিত করা হচ্ছে কেবল রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে নয়।
অন্য দিকে নিকোস পৌলান্ত্জ়া (Nicos Poulantzas) কিংবা এরিক ওলিন রাইট (Erik Olin Wright)— এঁরা নানাভাবে ধ্রুপদি ভাষ্যে মার্কসের দ্বৈত শ্রেণি-বিভাজনের যে ধারণাটি চলে আসছে তাকে সমালোচনা করে অন্যতর ভাষ্যের সন্ধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন রাইট নিয়েছেন তিনটি মূল শ্রেণি— বুর্জোয়া, সর্বহারা আর পাতি বুর্জোয়া। এর সঙ্গে আবার তিনটি শ্রেণি যোগ করেন তাদের ‘দ্বন্দ্বমূলক শ্রেণি অবস্থান’-এর জন্যে। এর উপর আরও তিনটি, যেমন গৃহবধূ, ছাত্র এবং অন্যরা।
শ্রেণি শব্দটি মার্কসের লেখাপত্রে যেভাবে এসেছে তা থেকে অন্তত দু’রকম অর্থ করা যেতে পারে। শ্রমিকশ্রেণি বা পুঁজিপতিশ্রেণি বললে বোঝা যায় এখানে সংজ্ঞা নিরূপিত হচ্ছে সম্পত্তি-মালিকানার ভিত্তিতে। পুঁজির মালিকরা এক শ্রেণি আর শ্রম-ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনও কিছুর মালিক নন যাঁরা তাঁরা শ্রমিকশ্রেণি। আবার তাঁর ইতিহাস-ভিত্তিক লেখাপত্রে— যেমন দি এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অফ লুই বোনাপার্ত (১৮৫২) অথবা দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স (১৮৭১), এমনকী কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (১৮৪৮)-তেও শ্রেণি শব্দটি ব্যবহার করেছেন কিছুটা ভিন্ন অর্থে। এখানে শ্রেণির মর্মবস্তুটি অতটা বস্তুমুখী নয়। যখন ব্যক্তিবর্গ তাঁদের স্বার্থের অভিন্নতা অনুভব করে একজোট হচ্ছেন ও পদক্ষেপ করছেন সেই ব্যক্তিবর্গকে মোটামুটিভাবে শ্রেণি বলছেন মার্কস। বলাই বাহুল্য, এই সংজ্ঞা সম্পত্তির অধিকার ঘিরে যে সংজ্ঞা তার মতো সুস্পষ্ট নয়। আর তা নয় বলেই এর সম্ভাবনা প্রবল। শ্রেণি নিয়ে এই দু’রকম অর্থের আভাস থেকেই ‘ক্লাস-ইন-ইটসেলফ’ আর ‘ক্লাস-ফর-ইটসেলফ’ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল পণ্ডিতদের মধ্যে। বিতর্কটি শ্রেণির দুটি ভিন্ন দিক নিয়ে। এক দিকে শ্রেণিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে পুঁজির মালিকানার ভিত্তিতে আর অন্য দিকে স্থির করা হচ্ছে সামাজিক/রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে কে কোন অবস্থান নিচ্ছে। একটি বিশেষ শ্রেণির সংজ্ঞা যখন সরাসরি সম্পত্তির অধিকার দ্বারা চিহ্নিত হচ্ছে, সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে সেই শ্রেণিকে কি আবশ্যিকভাবেই একটি নির্দিষ্ট চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে পাব? একটি শ্রেণিকে নির্দিষ্ট চেতনার বাহক হিসেবে দেখা আর সম্পত্তির অধিকারের ক্রমে নির্দিষ্ট অবস্থানে দেখা— এই দু’রকম দেখার একটি থেকে আর-একটিতে সোজাসুজি উপনীত হওয়া যায়? অর্থাৎ, পুঁজির মালিক নয় এবং মূলত শ্রম-বিক্রেতা এমন যাবতীয় ব্যক্তিবর্গ কি চেতনায় শ্রমিকশ্রেণির অংশ হিসেবে নিজেদের দেখবেই? উদাহরণস্বরূপ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের কথা বলা যায়। এই শিল্পে যুক্ত কর্মীরা নিজেদের সাধারণভাবে শ্রমিকশ্রেণির অংশ বলে মনে করেন না। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে কথা বললেই এ বিষয়ে জানা যায়। আর যেসব শিল্পে কর্মীরা নিজেদের কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারেন সেখানে তো বিষয়টা আরও জটিল। তাঁরা একইসঙ্গে শ্রমিক এবং আংশিক মালিক। ফলে যেসব আলোচক মার্কসকে অনুসরণ করে শ্রেণিকে নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হিসেবে দেখাটাকেই সঠিক বলে মনে করেন তাঁরা এ বাবদে বেশি দূর যেতে পারেন না।
মার্কসীয় পরম্পরায় এই সরল বিশ্বাসটি আগে দেখা যেত— যদি প্রতিটি শ্রমিক ব্যক্তি হিসেবে একই স্বার্থ অনুভব করছে তাহলে সব শ্রমিকই একসঙ্গে তাদের সেই স্বার্থরক্ষার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে না কেন? অথচ মার্কস নিজে কিন্তু লিখে গেছেন, শ্রমিক হিসেবে ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের প্রতিযোগিতা থাকবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শুধু টিকে থাকার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনমতো মজুরি নয়, ন্যূনতম মজুরির হার হোক তার দ্বিগুণ। এই দাবিকে শ্রমিকদের অভিন্ন দলগত স্বার্থ হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু একজন কর্মহীন ব্যক্তি তেমন মজুরির থেকে একটু কমেও কাজ করতে রাজি হয়ে যেতে পারেন। তাই দেখা যায় শ্রমিকরা একসঙ্গে কোনও দাবি নিয়ে পদক্ষেপ করছেন তখনই যখন তাঁরা সংঘবদ্ধ হতে পেরেছেন। শ্রমিক সংগঠনের ক্ষমতার এটি একটি মূল বৈশিষ্ট্য।
তাহলে শ্রেণিকে কীভাবে দেখব?
আমরা এখানে প্রস্তাব রাখছি শ্রেণিকে ব্যক্তিবর্গ হিসেবে না দেখে প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার। এইভাবে দেখাও যে মার্কস অনুসরণ করেই হতে পারে, তার সন্ধান দিয়েছেন দুই রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ— স্টিফেন রেজ়নিক আর রিচার্ড উল্ফ্। এভাবে দেখার বাস্তব সুবিধা কতটা তা-ই এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে। বাস্তবের রাজনৈতিক পরিসরে মার্কসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আজ যেকোনও আলোচনায় এই বিষয়টি উঠে আসা উচিত বলে মনে হয়। ক্যাপিটাল-এর প্রথম থেকে দ্বিতীয় ও বিশেষত তৃতীয় খণ্ডে প্রবেশ করলে এই পথের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
ধরা যাক দু’জন মাছ ধরতে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে একটা সামাজিক সম্পর্ক থাকবেই। এই সামাজিক সম্পর্কতে শ্রেণিপ্রক্রিয়া থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। সেটা নির্ভর করছে কোন কোন প্রক্রিয়া সম্পর্কটি নির্ধারণ করছে। এই নির্ধারণ কথাটি অবশ্য বিশেষ অর্থে ধরতে হবে। ‘ক’ নির্ধারিত হচ্ছে ‘খ’ দ্বারা— এরকম সোজাসুজি কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ধারণ মার্কসের পদ্ধতি বলে মনে হয় না। ‘ক’ এবং ‘খ’ ছাড়াও ‘গ’, ‘ঘ’, ইত্যাদি— এরা একে অপরকে গঠন করছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হবে। ওই মাছ ধরতে যাওয়া দু’জনের একজন যদি অন্য জনের উদ্বৃত্ত শ্রম গ্রহণ করেন, অর্থাৎ একজন আরেক জনের শ্রমক্ষমতা কিনেছেন, তাহলে তাদের সম্পর্কটি কয়েকটি প্রক্রিয়ার সমষ্টি যার মধ্যে শ্রেণিপ্রক্রিয়াও রয়েছে। কিন্তু তাঁরা যদি দুই বন্ধু হন যাঁরা তাঁদের অবসর বিনোদনের জন্যে মাছ ধরতে চলেছেন, সেখানে সম্পর্কটির মধ্যে কোনও শ্রেণিপ্রক্রিয়া নেই। আবার ভাষা কিংবা কথোপকথনকেও প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়, যা দু’টি ক্ষেত্রেই রয়েছে। মার্কসীয় তত্ত্বকে তাহলে এইভাবে দেখা যেতে পারে। এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য হল বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও সামাজিক সম্পর্ককে চিহ্নিত করা, যাদের সামগ্রিক পরিণতি একটি সামাজিক গঠন, এবং সেই সামাজিক গঠনে শ্রেণিপ্রক্রিয়ার ভুমিকার দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা।
ক্যাপিটাল, থিয়োরিস অফ সারপ্লাস ভ্যালু, গ্রুনড্রিসে— এইসব তাত্ত্বিক লেখাপত্রে মার্কস যে শ্রেণির ধারণাটি গড়ে তোলেন তা কিন্তু একটি প্রক্রিয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে— উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন ও আহরণের প্রক্রিয়া। উদ্বৃত্তের ধারণা ধ্রুপদি রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মার্কসের আগেও এসেছে। তবে মার্কস-ই প্রথম ‘শোষণ’-এর ধারণাটি আনলেন যেটি প্রয়োজনীয় শ্রম ও উদ্বৃত্ত শ্রমের পার্থক্যের ভিত্তিতে নির্মিত। উৎপাদকদের (অর্থাৎ শ্রমিকদের) কর্মক্ষম থাকতে গেলে যেসব প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লাগে— যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি— তা উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শ্রমের প্রয়োজন হয় তাকে মার্কস বলছেন ‘প্রয়োজনীয়’ শ্রম। মনে রাখতে হবে, এখানে ‘প্রয়োজন’ বলতে শুধু শারীরিক বা জৈবিক প্রয়োজনের কথা বলছেন না তিনি। এই ‘প্রয়োজনীয়’ শ্রমের পরিমাণটি সামাজিকভাবে নির্ধারিত। আর সারাদিনে উৎপাদক যে পরিমাণ শ্রম দিয়ে থাকে তার থেকে প্রয়োজনীয় শ্রমটুকু বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তাকেই মার্কস বলছেন উদ্বৃত্ত শ্রম। এই উদ্বৃত্ত শ্রম উদ্বৃত্ত মূল্য রূপে আহরিত হয়। শোষণের সম্পর্কটি তখনই তৈরি হচ্ছে যখন ওই উদ্বৃত্ত শ্রম, যার বিনিময়ে উৎপাদক কিছু পাচ্ছেন না, মূল্যের রূপে করায়ত্ত করছে উৎপাদক নয় এমন কেউ। এখানে মনে রাখতে হবে উদ্বৃত্ত শ্রম আর প্রয়োজনীয় শ্রমের এই ভাগাভাগিটা কোনও ন্যূনতম প্রয়োজনের ধারণা থেকে আসছে না। তা ছাড়া ন্যূনতম প্রয়োজনের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা চিহ্নিত করাও কঠিন। প্রয়োজনীয় শ্রমের পরিমাণটি, মতানুসারে, নির্ধারিত হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। অতএব মার্কসীয় তাত্ত্বিক পদ্ধতি বলতে আমরা বুঝব শ্রেণির বিমূর্ত ধারণার (যা আদতে কতকগুলি প্রক্রিয়া) সঙ্গে বাস্তবের সামাজিক সম্পর্কগুলির, সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির, সামাজিক পরিবর্তনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা।
উদ্বৃত্ত শ্রম উৎপাদন ও আহরণের যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে শোষণের উদ্ভব, মার্কসীয় তত্ত্বে তাকে শ্রেণিপ্রক্রিয়া বলা যায়। আর এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদক এবং উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণকারী দু’টি পৃথক শ্রেণি-অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু মার্কস যে কেবল এই দু’টি শ্রেণি-অবস্থানই চিহ্নিত করে গেছেন তা নয়। ক্যাপিটাল-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে আর-এক ধরনের পার্থক্য পাওয়া যায়, যা উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ ও বণ্টনের মধ্যে। অতএব উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন, আহরণ ও বণ্টনের প্রক্রিয়াগুলির সঙ্গে এসে পড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-অবস্থান। এই শ্রেণিপ্রক্রিয়া এবং তার অস্তিত্বের শর্তগুলি উন্মোচন করাই সেখানে মার্কসের প্রধান উদ্দেশ্য। সেখানে ব্যক্তি বা জনসমষ্টির প্রসঙ্গটি আংশিকভাবে আসছে মাত্র, প্রক্রিয়ার ব্যক্তিভবনের (personification) মধ্যে দিয়ে। তাঁরা যেমন শ্রেণিপ্রক্রিয়ায় অংশ নেন, আবার অন্য প্রক্রিয়াতেও অংশ নিতে পারেন। ব্যক্তিকে এভাবে প্রক্রিয়ার ব্যক্তিভবন হিসেবে দেখলে শ্রেণিকে আর নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হিসেবে ভাবা যায় না। অন্য দিকে একজন ব্যক্তিকে একাধিক প্রক্রিয়ার ব্যক্তিভবন হিসেবেও দেখা যায়; সেখানে শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির সঙ্গে অ-শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির মিথস্ক্রিয়ায় পরিণতিটি কী দাঁড়াতে পারে তা বিশ্লেষণসাপেক্ষ। তাই শুধুমাত্র তথাকথিত শ্রেণিস্বার্থের নিরিখে জনসমষ্টিকে স্বাভাবিকভাবে জোটবদ্ধ দেখতে চাইলে ভুল হবে। বাস্তবে যখন এটা হয় না তখন মার্কসবাদীদের বিচলিত হতে দেখা যায়। কিন্তু এখান থেকে একটু এগিয়ে শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির সঙ্গে অ-শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা তেমন দেখা যায় না।
মানুষজন আদতে শ্রেণিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী, সেখান থেকে নির্ণয় করা যাবে তাদের শ্রেণি-অবস্থান। কিছু মানুষ প্রয়োজনীয় ও উদ্বৃত্ত শ্রম দেন— মার্কসের ভাষায় যাঁরা ‘প্রত্যক্ষ উৎপাদক’। অন্যরা উদ্বৃত্ত শ্রম আহরণ ও গ্রহণ করেন। এঁরা যে সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি দল হতেই হবে তা নয়। একজন ব্যক্তি যেমন একইসঙ্গে একাধিক শ্রেণি অবস্থানে থাকতে পারেন, আবার দু’টি মৌলিক বা প্রধান শ্রেণি ছাড়া আরও অনেক শ্রেণি-অবস্থান থাকতে পারে। প্রত্যক্ষ উৎপাদক ও উদ্বৃত্ত শ্রম-আহরক এই দু’টিকে যদি বলা হয় ‘মৌলিক’ শ্রেণি তাহলে অন্য শ্রেণি অবস্থানগুলিকে বলা যায় ‘অন্তর্ভূত’ শ্রেণি, যা উঠে আসছে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলি থেকে। মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়ায় যেখানে উদ্বৃত্ত শ্রমের উৎপাদন ও আহরণ নির্ধারিত হচ্ছে, অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া নির্ধারণ করছে ইতিমধ্যেই উৎপাদিত ও আহৃত হয়েছে যে উদ্বৃত্ত তার বণ্টন। অতএব মুলত দু’টি অন্তর্ভূত শ্রেণি অবস্থান ভাবা যায়— বণ্টনকারী ও গ্রহীতা। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্কস বলছেন না কি যে গুরুত্বের বিচারে মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়াকে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়ার ওপরে স্থান দিতে হবে? বণ্টন তো আসে উৎপাদনের পরে, তাই না? ক্যাপিটাল দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড দু’টি ভাল করে পড়লে কিন্তু এ ধারণা হয় না। মৌলিক বা অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়ার আগে-পরের কোনও ব্যাপার নেই— দু’টিই একে অপরকে প্রভাবিত করছে, আকার দিচ্ছে। একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব থাকে না। ধরা যাক জমি রয়েছে ব্যক্তিমালিকানায়। পুঁজিপতি যদি সে জমিতে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয় তাহলে তা ব্যবহারের অধিকার পেতে হবে আগে, এবং এই ব্যবহারের অধিকারের বিনিময়ে জমি মালিককে দিতে হবে খাজনা— মার্কস যাকে বলছেন ‘ক্যাপিটালিস্ট গ্রাউন্ড রেন্ট’। আবার ভিন্ন কোনও সামাজিক অবস্থায় হয়তো জমিতে ব্যক্তিমালিকানা নেই। ধরা যাক রাষ্ট্র সেখানে কোনও বিশেষ পদ্ধতিতে তার ব্যবহারের অধিকার দিয়ে থাকে। এখানে তাহলে জমি ব্যবহারের অধিকার ঘিরে আগের বারের মতো কোনও অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া তৈরি হল না। দেখা যাচ্ছে জমির মালিকানার ধরন থেকে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়াটি নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি ভেবে নিই এটি এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে তাহলে ভুল হবে। মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়াটি দু’টি ক্ষেত্রে আপাতভাবে একইরকম মনে হলেও তা এক নয়। অর্থাৎ অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া ও মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়া একে অপরকে প্রভাবিত করছে বলা যায়।
অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়াকে মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়ার অস্তিত্বের শর্ত হিসেবে দেখা যায়। ধরা যাক লগ্নি পুঁজির কথা। শিল্পে বিনিয়োগকারীকে লগ্নি পুঁজি অর্থ জোগায়। অতএব উদ্বৃত্ত মূল্যের একটা অংশ এই পুঁজির জোগানদারের প্রাপ্য সুদ হিসেবে। জমির জন্যে খাজনা কিংবা লগ্নি পুঁজির জন্যে সুদ উদ্বৃত্ত থেকেই আসতে হবে। অর্থাৎ খাজনা কিংবা সুদ হিসেবে উদ্বৃত্ত মূল্যের বণ্টন যে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া নির্দেশ করে তা মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়ার অস্তিত্বের আবশ্যিক শর্ত। একইভাবে সরকারও আইনের পরিকাঠামো রক্ষা করে এই শর্ত পালন করে যে, পরিকাঠামো বিভিন্ন চুক্তিকে সুরক্ষা দেয়। উৎপাদন ব্যবস্থা আসলে নানান চুক্তির জাল, আর আইনি সুরক্ষা ছাড়া চুক্তি মূল্যহীন। অতএব উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি অংশ কর রূপে চলে যাচ্ছে সরকারি কোষাগারে, সেখান থেকে সরকারি ব্যয় হিসেবে সরকারি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের কাছে। উদ্বৃত্ত মূল্যের এই বণ্টন একইভাবে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া নির্দেশ করছে।
বাজার, রাষ্ট্র ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠান : অন্য আলোয় দেখা
মৌলিক ও অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়ার পার্থক্যকে কেন্দ্র করে আরেক অন্যরকম ভাষ্যের সন্ধান পেতে পারি। মার্কসের লেখাপত্র থেকেই বোঝা যায় শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে যেমন তাঁর বিস্তৃত বিশ্লেষণ রয়েছে, বাজার নিয়েও আছে। তদুপরি, বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সময়ে বাজার ও শ্রেণিকাঠামোর আন্তঃসম্পর্ক নিয়েও তাঁর বিশ্লেষণ রয়েছে। সম্পর্কটি, বলাই বাহুল্য, সোজাসাপটা নয়। মার্কসবাদের নিবিড় পাঠে এ-রকমই পাওয়া যায়। অথচ সোভিয়েত-উত্তর পূর্ব ইউরোপের আলোচনায় এ দু’টিকে প্রায়শই এক করে দেখা হয়। এক দিকে সোভিয়েত ধরনের সমাজতন্ত্রের সমালোচকরা, যাঁরা বাজার- ও ব্যক্তিমালিকানা-ভিত্তিক ব্যবস্থাকেই আদর্শ মনে করেন, তাঁরা ধরে নেন সমস্যার মূলে ছিল এদের অনুপস্থিতি। অতএব এদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই সমাধান। অন্য দিকে বাজার- ও ব্যক্তিমালিকানা-ভিত্তিক ব্যবস্থার বিরোধীরা (অর্থাৎ বামপন্থীরা) চান কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা এবং উৎপাদন উপকরণের যৌথ মালিকানা। তাঁদের কাছে সমাজতন্ত্র মানে সেটাই। আর উৎপাদন উপকরণ ব্যক্তিমালিকানায় না থেকে রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকলেই যে সমাজতন্ত্র হল তাও বলা যায় না। আমরা দেখানোর চেষ্টা করব উৎপাদন উপকরণের মালিকানা আর বাজার, এ দু’টিকে আলাদাভাবে দেখলে— যা শ্রেণিপ্রক্রিয়ার দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সেভাবেই প্রতিভাত হবে— নতুন রাজনৈতিক ভাষ্যের সম্ভাবনা খুলে যায়।
বাজারকে দেখতে হবে উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের বণ্টনের ব্যবস্থাপনা হিসেবে। অনেকগুলি বিকল্প ব্যবস্থাপনার মধ্যে বাজারব্যবস্থা একটি মাত্র। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানার সঙ্গে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনামাফিক বণ্টন— এই দুইয়ে মিলে আর একটি বিকল্প হতে পারে। অন্য দিকে পুঁজিবাদী শ্রেণিবিন্যাসকে দেখা যেতে পারে উদ্বৃত্তমূল্যের উৎপাদন ও অধিকার-গ্রহণের নির্ধারক হিসেবে। পুঁজিবাদী শ্রেণিব্যবস্থায় শ্রমিকরা উদ্বৃত্ত শ্রম দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন করলেও উদ্বৃত্ত হস্তগত করার অধিকার তাঁদের নেই। সেজন্যে মার্কসীয় পরিভাষায় এঁরা ‘শোষিত’। উদ্বৃত্তটি কীভাবে বণ্টিত হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পুঁজিপতির। সাম্যবাদী সমাজে যে-শ্রমিকরা উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন করছেন তাঁরাই যৌথভাবে সেটির অধিকার নিচ্ছেন এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কীভাবে কাদের মধ্যে তা বণ্টিত হবে। অর্থাৎ, পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের সংজ্ঞার মূলে রয়েছে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন, গ্রহণ ও বণ্টন, যা আবার নির্ধারিত হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাসের প্রকৃতি দ্বারা।
অতএব, মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, পুঁজিবাদী কিংবা সাম্যবাদী উভয় সমাজেই বাজার থাকতেও পারে, নাও পারে। এমনকী যখন উপাদান ও উৎপন্ন দ্রব্য উভয়েই পরিকল্পিত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বণ্টিত হচ্ছে সেখানেও পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া থাকতেও পারে, নাও পারে। সংক্ষেপে বললে, বাজার এক বিষয়, পুঁজিবাদ আর এক। শ্রেণিপ্রক্রিয়াই পুঁজিবাদের চরিত্র নির্ধারণ করে, বাজার থাকা, না-থাকা নয়।
এইভাবে যদি ভাবা যায় তাহলে তথাকথিত ‘বণ্টনের সমস্যা’কে যেমন অন্যভাবে দেখা যায়, সেখান থেকে রাষ্ট্রের ভুমিকাকে কিংবা বিকল্প উৎপাদন ব্যবস্থাগুলিকেও অন্যভাবে দেখা যায়। প্রথমে আসি বণ্টনের সমস্যায়। আর্থনীতিক বৈষম্যের বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরে গোটা বিশ্বে যে-রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে তা অভূতপূর্ব। বিশেষভাবে ২০০৭-০৮-এর আর্থিক সংকটের পর থেকেই বৈষম্যের প্রশ্নটি রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব পাচ্ছে। ‘উই আর নাইনটি নাইন পারসেন্ট’ স্লোগানও এই সময়েরই ফসল। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর গ্লোবাল অ্যাটিট্যুড প্রজেক্ট’-এর অংশ হিসেবে এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, পৃথিবীর কাছে এখন সবচেয়ে বড় বিপদটি কী? ইউরোপ ও আমেরিকার অধিকাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন ‘বৈষম্য’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাণ্টনি অ্যাটকিনসন বছর চারেক আগে ইনইকুয়ালিটি : হোয়াট ক্যান বি ডান (২০১৫)৫ শিরোনামে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক প্রকাশ করেছেন। অ্যাটকিনসন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে অসাম্যের বাড়া-কমার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে এর কারণগুলিও খুঁজে বার করেছেন। যেমন, ইউরোপ ও আমেরিকায় অসাম্য কমতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে প্রায় সত্তর দশক পর্যন্ত। আশির দশক থেকে তা উলটো দিকে ঘুরতে থাকে। অসাম্য বাড়তেই থাকে এই দশক পর্যন্ত। আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি— এমন অনেক দেশেই নব্বই-এর দশক থেকে এই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত অসাম্য বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। এই দেশগুলিতে অসাম্যের কমা এবং বাড়ার সময়কালটি দেখলে মনে হবে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালটি যেন অসাম্যের কেবলই বেড়ে চলার ইতিহাস। তা কিন্তু নয়। লাতিন আমেরিকার ছবিটি যেমন অন্যরকম। আশি এবং নব্বই-এর দশকে বাড়ার পর গত দশকে অসাম্য স্পষ্টতই কমেছে চিলি, ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, এল সালভাদোরে। অ্যাটকিনসনের ব্যাখ্যায় দেখা যাচ্ছে, যে-কারণগুলির জন্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় অসাম্য কমল তাদেরই বিপরীতমুখীনতায় সে-দেশগুলিতে অসাম্য বাড়ল। আবার কতকটা সেইসব কারণেই লাতিন আমেরিকাতেও অসাম্য কমল এই সাম্প্রতিকতম দশকে। কী সেগুলি? সংক্ষেপে বলতে গেলে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যা যা করা উচিত তার প্রসারণ ও সংকোচন। সামাজিক সুরক্ষা এবং আয়ের পুনর্বণ্টনের লক্ষ্যে নানান নীতি থেকে যখনই সরে আসছে রাষ্ট্রগুলি, অসাম্য বাড়ছে। মার্কস-অনুপ্রাণিত এক ধরনের রাজনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে যাঁরা বেশি পরিচিত তাঁরা হয়তো এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবেন না। তাঁরা আরও গভীর ‘স্ট্রাকচারাল’ ব্যাখ্যায় যাবেন। রাষ্ট্রের হাত গুটোনোর সঙ্গে বিশ্বায়নের অবধারিত সম্পর্ক খুঁজবেন। পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়ে এমনই যেন হওয়ার কথা। অথচ অ্যাটকিনসন আঁটোসাঁটো পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিচ্ছেন রাষ্ট্রের হাত খোলা বা গোটানোর মধ্যে তেমন কোনও অবশ্যম্ভাব্যতা নেই।
মৌলিক ও অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়ার ধারণা দিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকাটি বোঝা যেতে পারে। রাষ্ট্রকে দেখা যেতে পারে একটি সামাজিক ‘ক্ষেত্র’ (site) হিসেবে, যা বিভিন্ন শ্রেণি- ও অ-শ্রেণি- প্রক্রিয়ার সমষ্টি। এই প্রক্রিয়াগুলি কিছু প্রাকৃতিক, কিছু রাজনৈতিক, কিছু আর্থনীতিক বা সাংস্কৃতিক। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বা সংস্থার সামাজিক আচরণের জন্যে নিয়মকানুন ঠিক করে, আইন কিংবা জননীতির মধ্যে দিয়ে। বিচারব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখে। এগুলিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলা যায়। রাষ্ট্র কর চাপিয়ে, করের টাকা ব্যবহার করে পরিসেবা দিয়ে অথবা সরাসরি পুনর্বণ্টন করে বিশেষ জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নতিতে সাহায্য করে, বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে আর্থনীতিক কাজকর্মে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করে। এগুলিকে আর্থনীতিক প্রক্রিয়া বলা যায়। সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়টি ফেলা যায়। রাষ্ট্র পরিচালিত বেতার বা দূরদর্শনও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সাধারণত বিশেষ কিছু প্রক্রিয়া সংসাধন করে থাকে, যাদের পুঁজিবাদী মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়ার অস্তিত্বের শর্ত হিসেবে দেখা যায়। সেই প্রক্রিয়াগুলি সংসাধনের জন্যে রাষ্ট্র উদ্বৃত্ত মূল্যের ভাগ নেয়, উৎপাদক সংস্থার ওপর করের মাধ্যমে। অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়া এবং অ-শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলি কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্যের অস্তিত্বের শর্ত হিসেবে কাজ করছে তা বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই রাজনৈতিক দিশা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয়। যেমন, প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত, ফিনান্সের বাজারের ফুলেফেঁপে ওঠা, বেতন কাঠামোর ওপর দিকে অস্বাভাবিক স্ফীতি, ট্রেড ইউনিয়নের ক্রমহ্রাসমান গুরুত্ব— এদের সঙ্গে শ্রেণি- ও অ-শ্রেণি- প্রক্রিয়াগুলির যোগাযোগ চিহ্নিত করাটাই হবে মূল লক্ষ্য। কোম্পানি সি.ই.ও.-দের আকাশছোঁয়া বেতন ও বোনাস কোন কোন প্রক্রিয়ার পরিণতি তার বিশ্লেষণ করা যায়। অর্থাৎ, মৌলিক শ্রেণিপ্রক্রিয়া-কেন্দ্রিক ধ্রুপদি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির সঙ্গে একে মিলিয়ে দেখলে উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরণ ও বণ্টনের রাজনীতিটা বোঝার সুবিধা হয়।
এবার আসি উৎপাদন সংগঠনের কথায়। মৌলিক ও অন্তর্ভূত শ্রেণিপ্রক্রিয়ার ধারণাটি মাথায় রাখলে বোঝা যায় উৎপাদন উপকরণের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে থাকলেও একটি রাষ্ট্রীয় উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া থাকতে পারে, যদি সেই প্রতিষ্ঠানে উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশন ও বণ্টনে প্রত্যক্ষ উৎপাদকের কোনও ভূমিকা না থাকে। যেমন অতীতের সোভিয়েত রাশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি সম্পর্কে বলা যায়। আবার ধরা যাক উৎপাদন সমবায়ের কথা। খাতায়-কলমে সমবায় হলেও তা প্রকৃত অর্থে অ-পুঁজিবাদী সম্পর্ক নির্দেশ করছে কি না বুঝতে গেলে অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াটির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। উদ্বৃত্ত মূল্যের বণ্টনের সিদ্ধান্তটি যদি প্রকৃত উৎপাদকের বদলে অন্য কেউ নিয়ে থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াটি পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া থেকে খুব আলাদা নয়, যদিও আপাতদৃষ্টিতে এখানে উৎপাদন ব্যবস্থাটি পুঁজিবাদী নয়। অতএব প্রকৃত অ-পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া যদি একটি সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য বলে মেনে নিই, তাহলে সমবায়ের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র একটি প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টি দিতে পারলে খানিকটা নতুন ধরনের রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হতে পারে।
এইভাবে যদি ভাবা যায় তাহলে তথাকথিত ‘বণ্টনের সমস্যা’কে যেমন অন্যভাবে দেখা যায়, অন্য দিকে বিকল্প উৎপাদন ব্যবস্থাগুলিকেও অন্যভাবে দেখা যায়। ধরা যাক উৎপাদন সমবায়ের কথা। খাতায়-কলমে সমবায় হলেও তা প্রকৃত অর্থে অ-পুঁজিবাদী সম্পর্ক নির্দেশ করছে কি না বুঝতে গেলে অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াটির দিকে নজর দিতে হবে। উদ্বৃত্ত মূল্যের বণ্টনের সিদ্ধান্তটি যদি প্রকৃত উৎপাদকের বদলে অন্য কেউ নিয়ে থাকে তাহলে অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াটি পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া থেকে খুব আলাদা নয়, যদিও আপাতদৃষ্টিতে এখানে উৎপাদন ব্যবস্থাটি পুঁজিবাদী নয়। অতএব প্রকৃত অ-পুঁজিবাদী শ্রেণিপ্রক্রিয়া যদি একটি সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য বলে মেনে নিই, তাহলে সমবায়ের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র একটি প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী শ্রেণিপ্রক্রিয়াগুলির দিকে দৃষ্টি দিতে পারলে খানিকটা নতুন ধরনের রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি হতে পারে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যাঁরা সমালোচক তাঁরা সাধারণত এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই কোনও বিকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন এইসব বিকল্প শেষমেশ পুঁজির দাপটের কাছে হেরে যাবেই। এ-রকম ভাবনার সূত্র মার্কসের রচনা থেকেই পাওয়া যায়। তবে সেইসঙ্গে বলা উচিত তাঁর রচনায় সমবায় নিয়ে স্পষ্ট কোনও অবস্থান দেখা যায় না। যেমন ক্যাপিটাল তৃতীয় খণ্ডে তিনি লিখছেন—
শ্রমিক সমবায় চালিত কারখানাগুলি নতুন ব্যবস্থার অঙ্কুরোদগমের মতো, পুরনো ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই। যদিও এরা স্বাভাবিকভাবেই পুরনো ব্যবস্থার যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকেই নিজ সংগঠনের সর্বত্র পুনরুৎপাদন করে, করবেই। কিন্তু তারই মধ্যে পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বটা অতিক্রান্ত হচ্ছে। অন্তত প্রথমেই সংযুক্ত শ্রমিকরা পুঁজির মালিক হয়ে উঠে, উৎপাদনের উপকরণ আয়ত্ত করে, নিজেদেরই নিয়োগকর্তা হয়ে উঠছে। সমবায়গুলি দেখাচ্ছে কীভাবে একটি নতুন উৎপাদনব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই একটি পুরনো ব্যবস্থা থেকে উঠে আসতে পারে, যখন উৎপাদনের উপকরণগুলি এবং সামাজিক উৎপাদনব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট স্তরে উন্নীত হয়।৬
অর্থাৎ, পুঁজির রথের চাকায় পিষে যাওয়াই যে সমবায়গুলির ভবিতব্য অতটা যেমন বলছেন না, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে একটা উচ্চতর সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তা নিয়ে গিয়ে ফেলবে এমন আশাও মার্কস করছেন না। যা দেখছেন তা একটা নতুন ব্যবস্থার ‘অঙ্কুরোদগম’ মাত্র। অঙ্কুর থেকে তা কীভাবে মহিরুহ হয়ে উঠতে পারে মার্কস তার দিশা দিয়ে যাননি যদিও, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে সমবায়-চালিত উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলির সাফল্য-ব্যর্থতা থেকে বিকল্পের দিক্নির্দেশ সন্ধান করা যেতেই পারে। ১৮৭১-এ পারি কমিউন ঘিরে যে স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল মার্কস উৎসাহের সঙ্গে সেদিকে নজর রেখেছিলেন। সেই সময়ে তিনি সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স বইটি লিখছেন। কমিউন টিকে ছিল মাত্র দু’মাস— ১৮৭১-এর মার্চ থেকে মে। এরই মধ্যে মার্কস দেখেছিলেন ভবিষ্যতের শ্রমিক-চালিত রাষ্ট্রকে।
পরবর্তীকালে রোজা লুক্সেমবুর্গ থেকে শুরু করে অনেক মার্কসবাদীই পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে সমবায়ের সম্ভাব্যতা প্রায় উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্পেনের মন্দ্রাগন (Mondragon) সমবায়ের মতো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু জানা যায় তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের গ্লোবাল সেন্সাস অফ কোঅপারেটিভস থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৩-১৪ সালে সারা বিশ্বে সমবায়ের সংখ্যা ২৫ লক্ষ, এবং মোট সদস্যসংখ্যা ১০০ কোটি (একই ব্যক্তি অবশ্য একাধিক সমবায়ের সদস্য হতে পারেন, সেক্ষেত্রে সংখ্যাটি কিছু কম হবে)। কেরালার উরালুঙ্গল লেবার কন্ট্রাক্ট কোঅপারেটিভ সোসাইটি (ULCCS) শতবর্ষ অতিক্রম করবে আর কয়েক বছর পর। এই সমবায় সমিতিটির ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি একটি চমৎকার বই লিখেছেন টমাস আইসাক এবং মিশেল উইলিয়ামস। মিশেল দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান আর আইসাক স্বনামধন্য সমাজবিজ্ঞানী, বর্তমানে কেরলের অর্থমন্ত্রী। বিল্ডিং অল্টারনেটিভস (২০১৭)৭— বইটির এই শিরোনামেই রয়েছে বিকল্প ভাবনার সাহস।
ঋণ স্বীকার
Stephen A. Resnick and Richard D. Wolff, Knowledge and Class : A Marxian Critique of Political Economy (University of Chicago Press : Chicago, 1987).
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. Rosa Luxemburg, The Accumulation of Capital (Routledge and Kegan Paul : London, 1963), pp. 134-35.
২. Karl Marx and Frederick Engels, ‘Manifesto of the Communist Party’ in Collected Works, Vol. 6 (Progress Publishers : Moscow), 1976, p. 485.
৩. এখানে peasant অর্থে বলা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতিতে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না কৃষক কোনও অর্থেই নির্দিষ্ট শ্রেণি হতে পারে না। ভূমিহীন ‘কৃষক’-এর আর যিনি মধ্য কৃষক খেতমজুর নিয়োগ করে চাষ করেন তাঁর শ্রেণিস্বার্থ এক হতে পারে না।
৪. Teodor Shanin, Late Marx and the Russian Road. Marx and ‘The Peripheries of Capitalism’ (Monthly Review Press : New York, 1983).
৫. Anthony B. Atkinson, Inequality. What can be done? (Harvard University Press : Cambridge, Massachusetts, 2015).
৬. Karl Marx, Capital, vol. III (Progress Publishers : Moscow, 1959). p. 440.
৭. T.M. Thomas Isaac and Michelle Williams, Building Alternatives. The Story of India’s Oldest Construction Workers’ Cooperative (LeftWord Books : New Delhi, 2017).