গুপ্তিপাড়ার দক্ষিণের গ্রাম বেহুলা।
জ্যৈষ্ঠের তাপদগ্ধ গাছপালায় জল লেগেছে। যৌবনের জল। রং লেগেছে গাছে গাছে, পাতায় পাতায়। কাজলের রং। এত দিনের দগ্ধ বিবর্ণ ধূলিভরা বনানী কাজল পরা চোখে চেয়ে হাসছে। হাসছে, দুলছে। শিরায় শিরায় বইছে তার নতুন প্রবাহ। রাঢ়ের তৃষ্ণার্ত শক্ত মাটি সিক্ত হয়েছে। এত দিনের ধূলাচ্ছন্ন সাদাটে মাটি কালো হয়ে উঠেছে। বেড়েছে পাখির জটলা। বৃষ্টিঝরা মাটির বুকে উপচে পড়া প্রচুর খাবারের সন্ধান মিলছে এখন, তাই ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকির আর শেষ নেই।
চতুষ্পঠীর দাওয়ায় বসে শিবনাথ এই রূপই দেখছিল। পৃথিবীর এই রূপ৷ তারও চোখে নতুন কাজলের ঝিকিমিকি। দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত। অপরারে সুদীর্ঘ ছায়া পড়েছে। কমে এসেছে রোদের তেজ। তার দীপ্ত কাঁসার চোখ ধাঁধানো আলো এখন সোনালি রং ধরছে। চতুষ্পঠীর গোময় লেপা আঙ্গিনায় একরাশ পায়রা কী যেন খাচ্ছে খুঁটে খুঁটে। গাঢ় সবুজ বর্ণের ঋজু দেবদারু গাছটায় লেগেছে সোনালি রং। সেখানেও নাম-না-জানা কতগুলি পাখির ভিড়।
শিবনাথ দেখছিল। না সে দেখছিল না, সে ডুবে ছিল নিজের মনে। সে দেখছিল তার নিজের রূপ। আত্মভোলা শিশুর মতো সেই রূপের স্বাদ দেখছিল চেখে চেখে। চতুষ্পঠী খালি করে পোডোরা গেছে অনেকে বাপ মায়ের কাছে। কেউ কেউ গেছে বেড়াতে গঙ্গার ধারে, বৃন্দাবনের মন্দিরে। কৃষ্ণপক্ষ যাচ্ছে, সামনেই শুক্লপক্ষ। অম্বুবাচীর পর দ্বিতীয়াতে রথযাত্রা। আর গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা,কত দেশ দেশান্তরের লোক আসবে। ছুটির হাওয়া লেগেছে এর মধ্যেই। ছাত্রদের ছুটি ছুটি মন। নতুন বর্ষণের পালা লেগেছে। রথ-উৎসব পর্যন্ত চতুষ্পঠীর অধ্যয়ন এমনি চলবে। চলুক। অধ্যক্ষ শিবনাথ বাচস্পতির মনটাও ছুটি ছুটি করছে। অন্য অধ্যাপক, শিবনাথের বন্ধু নারায়ণ, নারায়ণ চূড়ামণি তো কাজের মধ্যেও ছুটির আনন্দ উপভোগ করে। পয়লা আষাঢ় থেকে সে সন্তপ্ততাং তমসি শরণং তৎ পয়োদ প্রিয়ায়া শুরু করেছে তার মিষ্টি গম্ভীর গলায়। সে যখন বাংলা ভাষায় অজ্ঞ ছাত্রদের সামনে বলে, হে জলধর। তুমি সমুদিত হইলে, আমার ন্যায় পরাধীন ভিন্ন আর কোন ব্যক্তি বিরহিণী পত্নীকে উপেক্ষা করে? তখন ছাত্রদের নিশ্বাস দ্রুত হয়। কপালে ঘাম দেখা দেয়। উত্তরীয় দিয়ে বার বার মুছেও তা দূর হয় না। তাদের চোখের দৃষ্টি নেমে যায়, পরস্পরকে দেখে আড়ে আড়ে। শিবনাথের অবস্থাও ছাত্রদের মতো হয়ে ওঠে।
আজ চতুষ্পঠী খালি। নারায়ণও অনুপস্থিত। শুধু একটি ছেলে কোথাও যায়নি। সে ঘোরাঘুরি করছে আশেপাশে। চুঁচুড়ার অবিনাশ মুখোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল বংশধর অবনীমোহন। মেধাবী ছাত্র। চতুম্পাঠীতে তার বিরুদ্ধবাদী বলে খুব নাম ডাক। অদ্বৈতবাদের সমর্থনে তার যুক্তি বড় তীব্র। খণ্ডন তর্কে বাচস্পতি নিজেও এক এক সময় বড় দুর্বল বোধ করে। অন্যান্য ছাত্ররা তো তার কাছে তর্কযুদ্ধে তুচ্ছ। অবনী ঘোরাফেরা করছে আশেপাশে। হয়তো শিবনাথের সঙ্গে কোনও বিষয়ে আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে।
থাকুক। শিবনাথের মন আজ এখানে নেই। এখানে ওখানে সেখানে, কোথাও নেই। সে যে কোথায় আছে, কোন যক্ষপুরীতে, কোন অলিন্দের কোন বাতায়নে, তা সে নিজেই জানে না।
শিবনাথ বাচস্পতি। বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। কিন্তু এর মধ্যেই প্রদেশ জুড়ে নাম কিনেছে। বেউলের শিবুপণ্ডিত বলতে সাধারণের শ্রদ্ধা উপচে পড়ে। এই বয়সের মধ্যেই বার তিনেক নবদ্বীপ বিজয় করে এসেছে। অদ্বিতীয় না হোক, গুপ্তিপাড়া বেহুলার কয়েকজন শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িকদের মধ্যে শিবনাথ অন্যতম। চব্বিশ পরগনার ভাটপাড়াতেও শিবনাথের বিলক্ষণ পরিচয় আছে।
কিন্তু এত অধ্যয়ন, এত অধ্যবসায় আজ সবই যাই যাই করছে। পদ্মপাতায় টলমল করছে জলবিন্দু। শিবনাথ বলে, কচুপাতায় ভেকউদগীরিত তরল বিষ-বিন্দুর মতো সংস্কৃত শিক্ষা কাঁপছে। বড় দুঃখে বলে। বড় যন্ত্রণায় এ কথা বলে শিবনাথ। যে শিক্ষা, যে গৌরব তার হাড় মাংস ও রক্ত, আজ তা-ই বহু
পণ্ডিতের অনাচারে কচুপাতার বিষ হয়েছে। নতুন শিক্ষার আগুন এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে সব। সে আগুন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃত শিক্ষিত কামানের মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে।
কিন্তু সে ভাবনা এখন নেই। সে দুশ্চিন্তায় তার বিশাল কপালের রেখা সর্পিল হয়ে ওঠেনি। তার রক্ত রেখায়িত ঠোঁটে চমকাচ্ছে হাসি। হাসিতে এক অভূতপূর্ব রং লেগেছে।
অবনীমোহন তাই লক্ষ করছে অবাক হয়। বাচস্পতি মহাশয়ের ঠোঁটে এক বিচিত্র হাসির লীলা! একী আত্মভোলা রূপ!
বয়স পঞ্চাশ বটে, কিন্তু বয়সের চেয়ে শিবনাথ নবীন। দাড়ি গোঁফ কামানো ধবধবে ফরসা মুখ। চিকন শ্যামলের আভাস গালে ও চিবুকে। তীক্ষ্ণ নাক, টানা চোখ। উন্মুক্ত শক্ত বলিষ্ঠ বুকে শুভ্র উপবীত হাওয়ায় নড়ছে মৃদু মৃদু। মাথার সামনের দিকে প্রায় অর্ধেক মুণ্ডিত। পেছনে দোলনচাঁপা বাঁধা সুদীর্ঘ শিখা। কিন্তু এ সব শিবনাথের মূর্তিকে উগ্র করে তোলেনি। তার হৃদয় ও মস্তিষ্ক যোগাযোগের পূর্ণ রূপ ধরেছে।
শিবনাথ স্বপ্ন দেখছিল। এমন সময় এল বিলোচন। বিলোচন চাষি। দূর থেকে গড় করে বিলোচন বলল, গড় করি দেবতা। কী করছেন গো বসে বসে?
শিবনাথ মাটিতে পা দিল। চমকে হেসে বলল, কে? বিলোচন? কিছু করছি না। বসে আছি।
চূড়ামণি ঠাউর আসেন নাই বুঝি?
না, এ বেলা তো তার দেখা পাইনি। বোধ হয় গুপ্তিপাড়া গেছে।
কাপড়ের খুঁট থেকে খুলে বিলোচন একটি শুকনো নরম পাতার ছোট্ট পুঁটলি ধরে দিল শিবনাথের পায়ের কাছে। একগাল হেসে চোখ ভরা কৌতুক নিয়ে তাকাল বাচস্পতির সপ্রশ্ন চোখের দিকে।
শিবনাথ বলল, ওটা কী এনেছ গো বিলোচন?
গলায় তার ভারী স্নেহ। হাত দিয়ে পুঁটলিটি তুলেই আনন্দে উঠে দাঁড়াল শিবনাথ। বলল, আঃ, গন্ধেই যে প্রাণ ভরে উঠল।
বিলোচন বলল, হু হু, যেখেন সেখেনের লয় দেবতা। একেবারে কুষ্টের খাঁটি পাতা দিয়া তোয়ের করে এনেছি। পাড়াসুদ্ধ লোক হেঁচে হেঁচে মরেছে।
সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে আগে পুঁটলি খুলল শিবনাথ। তিন আঙুলে বেশ বড় একখানি নস্যির টিপ নিয়ে পুরে দিল নাকে। আরক্ত মুখে, চোখ বুজে, রুদ্ধ নিশ্বাসে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ।
শিবনাথ ধরা গলায় বলল, আঃ! সত্যি, এ নদের তামাক পাতাই বটে। খুব খেটে তৈরি করেছ দেখছি, কিন্তু এমন মিঠে গন্ধটি কী দিয়ে করেছ হে?
বিলোচন বলল, সন্নোচাঁপা ফুলের সঙ্গে ভিজিয়ে রেখে দিয়েছিলুম পাতা, তারই গন্ধ।
শিবনাথ বলল, আহা-হা-হা। আজ শুধু ধামার চাল নয়, দিদিকে ডাকি, কিছু খেয়ে যাও। কিন্তু, এ জিনিস তো একলা মানুষে মজে না। নারায়ণ এলেই সদগতি হত।
আশা অপূর্ণ রইল না। নারায়ণ চূড়ামণিও এল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দীর্ঘ পুরুষ। আয়ত চোখ। তারও দাড়ি গোঁফ কামানো। কিন্তু মাথার সামনের দিক মুণ্ডিত নয়। বরং ঘন কুঞ্চিত কালো চুল কিছু দীর্ঘ। একটু রুক্ষ। সিংহের কেশরের মতো অবিন্যস্ত। বেশবাস একটু বিস্ত। কোঁচা লুটোচ্ছে, লুটোচ্ছে গায়ের উত্তরীয়। বিদগ্ধ পণ্ডিত সদৃশ সন্দেহ নেই। শিবনাথের সঙ্গে একটি সুস্পষ্ট তফাত আছে নারায়ণের। নারায়ণের আয়ত চোখ ঢুলু ঢুলু। হাসিতে যেন নিজেকে সঁপে দেওয়ার চাপা ব্যাকুলতা। এমনকী চতুষ্পঠীর অধ্যাপক হিসাবেও যেন কিঞ্চিৎ বেমানান।
চতুম্পাঠী-প্রাঙ্গণে ঢুকেই বলল, কীসের সদগতি করবে শিবু, তোমার সর্বভুক উপস্থিত।
শিবনাথ স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখতে দেখতে জুটল এমনি সুগন্ধি তীব্র তাজা নস্য। তার উপরে নারায়ণের আবির্ভাব। সে নস্যের পাত্র বাড়িয়ে ধরে বলল, কথা পরে, বিলোচনের অমৃত নাও আগে।
নারায়ণ নাসারন্ধ্র ফুলিয়ে হাসল। হাতের চেটোয় তুলে নিলে অনেকখানি নস্য। নিয়ে একটু একটু করে নাকে নিয়ে বলল, বড় ভাল। আজ সারাটি দুপুর সতীশের চণ্ডীমণ্ডপে অম্বুরি চলেছে। তারপরে এমন বস্তু। এসো শিবু, আজ একটু ভাল করে বসা যাক!
বিলোচন বলল হাত-জোড় করে, দেবতা, বর্ধমানের বড় সায়েব তো এসল না। শুনেছিলুম, কোলকাতা থেকে কোন বাবুরা এসবে কুটিয়ালদের কীর্তি দেখতে। তানারাও এসলেননি। বর্ষা হয়ে গেল৷ লেঠেলরা নিজেরাই নীল বুননের উয্যোগ করছে।
শিবনাথ বিমর্ষ হয়ে উঠল। আজ থাক। আজ থাক, কাল থাক, কিছুদিন থাক ও সব কথা। যাক নীল চাষ, থাক সাহেব সুবো, থাক কোর্টকাঁচারি আইন। থাক না লাট বেলাট, অভাব-অনটন। সত্যি, এ বিষয়ে শিবনাথের উৎসাহ কম ছিল না। তারও অনেকখানি জমি কুটিয়াল গ্রাস করেছে। অপমানের ভয়ে তাকে গ্রহণ করতে হয়েছে দাদন। যে মাটিতে কোনওদিন পা দেবে না বলে স্থির ছিল, সেই গুপ্তিপাড়ার নীলকুঠির প্রাঙ্গণে যেতে হয়েছে তাকে, অসম্মানের আশঙ্কায়। বড় সাহেব বলেছে তাকে, ঠাকুরবাবা, আমি ভালমানুষ, দাদন না নিলে ছোট সাহেব তোমার টোল উপড়ে গঙ্গায় ফেলে দেবে। সেদিন নন্দরাজার উন্মুক্ত-শিখা কৌটিল্যের কথা মনে পড়েছিল শিবনাথের। সবই সত্য, কিন্তু আজ নয়। মন আজ অবশ। সে যে কোথায়, কোন দুর আসমানে পাখা মেলে দিয়েছে, তা ভাল করে জানে না শিবনাথ। স্ববশে আনবে কী করে। প্রতিশোধ চায় সে। কলকাতার আন্দোলনের প্রতিটি কথাই শুনতে চায়। কিন্তু আজ নয়।
তাকে নীরব দেখে বিলোচন তাকাল। নারায়ণ তাকাল অন্যমনস্ক শিবনাথের দিকে। নারায়ণ বিস্মিত হল। না ভয় নেই। শিবনাথের মুখে তো কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। বরং তার ঘোর নৈয়ায়িক বন্ধুর হাবভাবে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু বিলোচনের মুখ খুলবার জায়গা এটাই ছিল। কুটিয়ালদের বিষয়ে প্রাণ খুলে কথা বলবে এই দুটি মাত্র মানুষ। আর আছেন গুপ্তিপাড়ার মিত্তিরমশাই। কিন্তু আজ শিবনাথ এ কথার পর বলল, চলো বিলোচন, দিদিকে বলে আসি। বসো নারায়ণ।
নারায়ণ বসল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল শিবনাথ। হেসে বলল নারায়ণকে, তোমাকে আজ খুশি খুশি দেখছি যে খুব।
এমন অনাবশ্যক কথা কখনও শোনেনি নারায়ণ শিবনাথের মুখে। বিশেষ সে নিজেই যখন কী এক গুঢ় গুপ্ত খুশিতে ছটফট করছে। নারায়ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার বলো তো?
নারায়ণের এ কথাতেই বাচস্পতি ঝিমিয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কিছুনয় তো।
নারায়ণ বলল, হালিশহরের সর্বেশ্বর ঘটক এসেছিল বুঝি?
শিবনাথ বলল, হ্যাঁ।
বিদ্রুপে বেঁকে উঠল নারায়ণের ঠোঁট। বলল, ব্যবস্থা হল?
শিবনাথ বলল, হ্যাঁ।
তেমনিভাবে তীব্র শ্লেষভরে আবার বলল নারায়ণ, নিশ্চয়ই কোনও বংশজের অষ্টমবর্ষীয়া গৌরী প্রতিমার ব্যবস্থা হয়েছে?
শিবনাথ ভ্রু কুঁচকে বলল, অষ্টমবর্ষীয়া না হোক, সে দ্বাদশী। কেন তোমার মনে কোনও সন্দেহ আছে?
থাকলেই বা তোমার কী? তোমার তো কোনও সন্দেহ নেই?
না। তোমার মতো নতুন আদর্শবাদীর মনে সন্দেহ আছে।
নারায়ণ দৃঢ় গলায় বলল, আছে। জানিনে। কে সে ভাবী বাচস্পতি-গৃহিণী। জাত কুল মান জানা না থাকলেও এক শিশুকে তুমি বিয়ে করতে পারো না।
ঠিক যে বিদ্যাসাগরের মতো কথা বলছ?
বিদ্যেসাগর কি রামমোহন কিংবা নারায়ণ চূড়ামণি তা জানিনে। এ অবৈধ।
দুজনে নীরব। কিন্তু দুজনেরই মুখে উত্তেজনার রক্তাভা উথলে উঠেছে। নারায়ণ চূড়ামণি আর শিবনাথ বাচস্পতি। পরম বন্ধু দুজনে। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব কিন্তু বিশ্বাস ও আদর্শ বাদ দিয়ে নয়। যা ছিল তর্কের বিষয় তাই কাজে হতে যাচ্ছে। তাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিরোধ। যে তর্ক হয়েছে গাছতলায়, ঘরে, গঙ্গার ধারে, বন্ধুজনের মাঝে, যে তর্ককে শিবনাথ ভয়ে আতঙ্কে ঘেঁষতে দেয়নি চতুষ্পঠীর ত্রিসীমানায়, সে তর্ক আজ দুই বন্ধুর মাঝখানে ভিন্ন চেহারায় দেখা দিয়েছে। চতুষ্পঠীর মধ্যে ভয় অবনীমোহনকেই বেশি। সে ইংরেজি পড়ে। রামমোহনের ব্রহ্ম উপাসনা, বিদ্যাসাগরের কৌলীন্য বিরোধিতা ও বহু বিবাহ সম্পর্কে পড়েছে, জানে।
নব্যন্যায়ের মৈথিলি মতের মধ্যে গৌড়ীয় মতও নাকি উঁকি মারে অবনীর মনে। শিবনাথের তো সেখানে ঘোরতর আপত্তি। গৌড়ের অর্থাৎ বাংলার আবার নব্যন্যায় কীসের? ইতিহাসকেও বিকৃত করতে চায় অবনীমোহন? বিনীত জবাবের মধ্যে ক্ষুরধার যুক্তিজাল বিস্তার করে বলে অবনীমোহন, বাংলার কোনও ইতিহাস নেই। যা আছে তা ভুল এবং মনগড়া। গঙ্গার প্রবাহ বদলায়, জনপদও তাই পরিবর্তিত হয়। আমাদের ইতিহাস গঙ্গার জলের তলায় চাপা পড়ে থাকে, লোকে তাকে ভুলে যায়। গৌড়ের নব্যন্যায় নতুন নয়, তার অস্তিত্ব একদিন প্রকাশ পাবেই।
মতনিরপেক্ষ নয় অবনী। আর তার মতামত ভীতিজনক। ছাত্রদের উপরও অখণ্ড প্রতাপ। নারায়ণের সঙ্গে মতের মিল আছে।
কিন্তু আজকের বিষয় নব্যন্যায়, বেদান্তের অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের চেয়ে অনেক কঠিন, আরও তীব্র। আজ তো শুধু তর্ক নয়, দৈনন্দিন জীবনের বিশ্বাস ও ভালবাসার প্রশ্ন। এখানে আজ রক্তে জেগেছে উন্মাদনা, হৃদয়ে উঠেছে হাহাকার। চতুম্পাঠীর আঙিনা পেরিয়ে তার প্রবেশ ঘটেছে মনের রাজ্যে। এখানে যে আসল পরিচয়। মানুষ হিসেবেই, দুজন কত কাছাকাছি, কতখানি দূরে, সেই জানাজানির দিন সমাগত।
দুই বন্ধু, কিন্তু কেউ মাথা নোয়াতে চায় না। শিবনাথের দৃঢ়তাই আজ বিরোধ বাধিয়ে দিল। সে প্রাচীন মতে বিশ্বাসী। সেবংশজ তবু বিশ্বাস। বংশজ নারায়ণ নিজেও। তবুও সে কৌলীন্য কিংবা বংশজ নীতির বিরোধী। যুগ চলে গেছে, অনেক যুগান্তর ঘটে গেছে। তবু সেই বিগত যুগেরই ধারা কাজ করে চলেছে আজও। লক্ষ্মণসেনের আমলের কৌলীন্য প্রথা। আদিশূর আনীত ব্রাহ্মণ বংশধরদের যারা নিরক্ষর, অনাচারী তাদের বাদ দিয়ে কুলীন গোষ্ঠী গড়া হয়েছিল সদাচারী, বিনয়ী, বিদ্বান ও ধার্মিকদের নিয়ে।
আর এই বেহুলারই পণ্ডিত দেবীবর। ঘটকেরা সেই প্রথাকে করেছেন আরও জটিল। তখন গ্রামের নাম বেহুলা নয়, নাম ছিল আয়দা। আয়দার শোভাকর পণ্ডিতের বাড়িতেই সেই মেলবন্ধনের কুটিল সভা বসেছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। অঙ্কের মতো, ছক কেটে, চুলচেরা হিসেব করে বেঁধে দিয়েছেন তাঁরা মেলবন্ধন, যার সঙ্গে যার মেলে। দোষান্ মেলয়তীতি মেলঃ। যে ব্রাহ্মণের মেয়ে কোনওদিন যবন-লাঞ্ছিত হয়েছে সেই বংশের যে কোনও লোকের বিয়ে হতে পারবে আর এক যবনস্পাঞ্ছিত ব্রাহ্মণ পরিবারে অন্যত্র না। দোষমালায় লেখা আছে,
অনুঢ়া শ্রীনাথসূতা ধন্দঘাটস্থলে গতা।
হাঁসাইথানদারেণ যবনেন বলাৎকৃতা ॥
ধন্দস্থানগতা কন্যা শ্রীনাথচট্টজাত্মিজা।
যবনেন চ সংসৃষ্ঠা সোঢ়া কংসসূতেন বৈ ॥
যার মানে দাঁড়ায়, শ্রীনাথ চাটুজ্যের দুই মেয়েকে, ধন্দ নামে জায়গায়, মুসলমান থানাদার হাঁসাই মিয়া বলাৎকার করেছিল। শ্লোকে লেখা আছে, সেই দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিল কংসারির ছেলে পতিতুণ্ড আর গঙ্গাধর বাঁড়ুজ্জে। অর্থাৎ গঙ্গাধর বাঁড়ুজ্জেদের ঘরেও অন্য কোনও হাঁসাই মিয়া জুটেছিল, সুতরাং দোষে দোষে মিল হয়ে গেছে।
এ শুধু কুলীনের মেলবন্ধন। অকুলীন ছিলেন যাঁরা আগে থেকেই, সেই সব পণ্ডিতেরা এ নিয়মকে মানতে পারেনি। তাই অমান্যকারীরা পেয়েছেন বংশজ আখ্যা। কিন্তু বিরোধী এত কম ছিল যে, বংশজের সংখ্যা নগণ্য। আজ বংশজের ছেলের কপালে একটি বউ জোটে না। দেবীবরের বিরুদ্ধবাদীর বংশধর হয়েও সেই প্রাচীন শাস্তিকে মাথা পেতে নিতে চায় শিবনাথ। সে আজ ক্রীত মেয়ে বিয়ে করতে চাইছে।
না করেই বা কী উপায়! প্রাচীন মতে যদি সে বিশ্বাসী নাও হয়, মাথা পেতে যদি না-ই নিতে চায় বংশজের অভিশাপ, রাজধানী কলকাতার সংবাদপত্র যদি গলা ফাটিয়েও ফেলে, বিদ্যাসাগর এক আইন ছেড়ে আরও শতখানি আইনও যদি রচনা করেন, তাতেই বা কী এসে যায় এ দেশের। আইন করা যায়, কাগজে লেখা যায়, তাতে সতীদাহ বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু শিবনাথ বাচস্পতিকে মেয়ে দেবে কে? সেখানে তো আইন চলে না। বিদ্যাসাগর বলেন, এ দেশের সাত হাত স্তর মাটি কেটে সমুদ্রে ফেলে না দিলে, এর উন্নতি হবে না। কিন্তু সেই ন মন ঘি কবে পুড়বে, রাধা কবে নাচবে, শিবনাথ জানে না। জানতে চায় না। ক্রীতকন্যা বিবাহ ছাড়া বংশ রক্ষার কোনও উপায় নেই।
নারায়ণ ভ্রূ বাঁকিয়ে বলল, তোমার পণ্ডিত দেবীবরের নীতির কি কোনও পরিবর্তন হয় না?
শিবনাথ বলল, হয়। কিন্তু এখনও সে পরিবর্তনের পথ কেউ দেখাননি।
নারায়ণ দৃঢ় গলায় বলল, দেখিয়েছেন। বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন।
শিবনাথ বলল, দেখিয়েছেন, বহু-বিয়ে সম্পর্কে।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের নাম শুনলেই শিবনাথ বড় দুর্বল বোধ করে। তাই বোধ হয় ক্রুদ্ধ, রূঢ় হয়ে ওঠে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সে, তবু তাঁর মত আজও গ্রাহ্য নয়। কুলীনের স্ত্রীরা তো উপপত্নী নন।
আগুন জ্বলে উঠল নারায়ণের চোখে। বলল, না উপপত্নী নন, তার চেয়েও খারাপ। উপপত্নীকে তার কর্তা টাকা, পয়সা, কাপড়, খাবার, বাড়ি খাট, গহনা সবই দেন। কুলীন-পত্নীরা সুতো বেচা কড়ি দিয়ে, বিয়ের চোদ্দো বছরে এক দিন স্বামীর মুখ দেখেন। তাঁরা যেন আঁস্তাকুড়ের জঞ্জাল।
শিবনাথ বলল, তাও গৌরবের। এখনকার কালচারওয়ালা নব্যদের রক্ষিতার মতো তো নন।
নারায়ণ হাসল। বলল, জানিনে, তুমি কাদের কালচারওয়ালা বলছ। বোধ হয় একদল উজ্জ্বল যুবককে তুমি জ্ঞানী গুণী ভেবে নিয়েছ। ধর, দেবীবরের নীতির যদি পরিবর্তন হয়?
শিবনাথ উত্তর দিল, সকলে মানলে, মানব।
নারায়ণ বলল, মানবে। যেদিন রাজা লক্ষ্মণসেনের মতো ইংরেজ রাজা হুকুম দেবে, সেদিন মানবে।
শিবনাথ বলতে যাচ্ছিল, দেবীবরের যুগে রাজা লক্ষ্মণসেন ছিলেন না। যবন রাজত্ব ছিল। তবুও দেবীবরকে মেনে আসতেই হয়েছে এত দিন।
ইংরেজ রাজাও তা পারবে না। নারায়ণ তর্কের জন্য প্রস্তুত ছিল। আজ তার নৈয়ায়িক বন্ধুর সঙ্গে সে তর্কে পেছুতে চায় না। কিন্তু শিবনাথ কলহের পথ ধরল। সে জানে, যুক্তি তীব্র হলেও নারায়ণ কালাচারী। কাল দিয়ে তার বিশ্লেষণ। কিন্তু বিশ্বাস নিয়েও কালের কাছে কালের মতোটি হতে সে নারাজ। অখণ্ডতা সে বিশ্বাস করে। কালজয়ী ধর্মে তার বিশ্বাস। সেখানে দেবীবর তার কাছে কালজয়ী হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যৎ সমাজে কী পরিবর্তনের বীজ নিহিত আছে, সে জানে না, দেখতে পায় না। তাই শিবনাথের মতে বিদ্যাসাগর খণ্ডবাদী। কুলীনের বহু-বিবাহে বেদনা আছে, সেই বহু পত্নীর চোখে শিবনাথ সিক্ত। সে কুলীনের হৃদয় পরিবর্তন কামনা করে।
নারায়ণ বলে, কুলীন বাঘের রক্তপিপাসার্ত হৃদয়ের পরিবর্তন হবে না।
তবে ইংরেজের ধর্মে ও শাসনে হবে? যে পরের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে, যে পরের রাজ্য কেড়ে নেয়, যে মিথ্যাবাদী পাপাশ্রয়ী, তার আইনে হবে? আগামীকাল যদি দুর্গম অরণ্যের উলঙ্গ গুহাবাসী তোমার দেশ শাসন করে? তবে তুমি তার ধারাকে বয়ে চলবে?
না, গুহাবাসীর কোনও প্রশ্ন নেই। ইংরেজদের ধারাকেও বয়ে চলতে চাইনে। কিন্তু ধর্ম যেখানে নরকের কিছু সুবিধাভোগীদের লালসার অস্ত্র হয়ে উঠেছে, কুসংস্কারের অভ্যাসের স্পর্ধা যেখানে মানুষকেই তার বলি করেছে, ধর্মের সেই খেলাকে বন্ধ করতে হবে। রাজশক্তির জোরে যে দুর্নীতি শিকড় গেড়েছে, রাজশক্তি দিয়েই যদি তা উপড়ে ফেলা যায়, তাই করতে হবে। দেবীবরদের পুথির আর নীতির জঞ্জাল ভেসে যাক, ধ্বংস হোক।
নারায়ণ দেবীবরের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে তর্ক করে না। সে ইংরেজি শিক্ষিতদের কষ্টিপাথরে সব যাচাই করে। বিধর্মীর শিক্ষা ভাবাবেশ সৃষ্টি করতেই বা ছাড়বে কেন। সেখানেই তো শিবনাথের প্রতিবাদ, সংগ্রাম, বোধ হয় দারুণ ঘৃণাও আছে। সেইজন্যই তার এত উত্তেজনা। এত বিদ্বেষ। তা ছাড়া হৃদয়, এই অশান্ত হৃদয়! না, ক্রীতকন্যাই সে বিয়ে করবে। দেশের যে উচ্ছঙ্খলতার জন্য দেবীবর মেলবন্ধন করেছেন, শৃঙ্খলা ফিরে এলে নবীন দেবীবর শাস্ত্র পরিবর্তনের অধিকার নিয়ে ফিরে আসবে। সেই দিন হবে শাপমোচন। কিন্তু এই ইংরেজ রানির অনাচারী রাজত্বে তা সম্ভব নয়। অনাচার দিয়ে শাস্তিকে উপেক্ষা করা যায় না। সেই অভিশাপকেই বহন করবে শিবনাথ। সে নীলের দাদন নিতে নারাজ। সে তার কু অথবা সু কোনও রীতির উপরই পরের রীতি চাপাতে নারাজ। সে অভিশপ্ত, ক্রীতকন্যা বিবাহ তার অদৃষ্ট। সে কন্যা ব্রাহ্মণের কন্যা তো বটে!
তাই নারায়ণের মুখে ইংরেজ রাজার কথা শুনে সে বলল, আজ বোধহয় ইংরেজি শাস্ত্র ঘাঁটা হয়েছে। সারাদিন?
সত্যি নারায়ণ ইংরেজি শেখে, পড়ে। বলল, না। বলেছি তো সতীশ বাঁড়ুজ্জের চণ্ডীমণ্ডপে সারা দুপুর অম্বুরি টেনেছি।
শিবনাথ বলল, তবে বোধহয় বিদ্যেসাগরে ডুব দিয়েছিলে?
নারায়ণ উত্তর দিল, না।
তবে রামমোহনের খ্রিস্ট-দর্শন?
না। তোমাদের মতো অন্ধ বিশ্বাসীদের নিয়ে কথা হচ্ছিল।
সতীশ বাঁড়ুজ্জের চণ্ডীমণ্ডপে তাকে নিয়ে আলোচনা! বিস্ময়ে ও ক্রোধে ধৈর্য হারাল শিবনাথ। বলল, নারায়ণ, কোনও বিদ্যেসাগরের চেলার মতো আমি কুমারী মেয়ের সঙ্গে পিরিত করতে পারব না।
চকিতে নারায়ণের মুখ কাচির ধুতির মতো সাদা হয়ে গেল। নিষ্প্রভ, বিবর্ণ, যন্ত্রণাবিকৃত মুখ নারায়ণের। মুহূর্তে সহস্রাধারে বিনবিন করে ঘাম ফুটতে লাগল মুখে ও দেহে। নিদারুণ বেদনার ও আনন্দের, অসহ্য সুখের ও দুঃখের গোপনস্থানে আঘাত করেছে শিবনাথ। শিবনাথ বন্ধু। সে তার সব গোপন খবরই জানে। বেহুলার নীলরতন চক্রবর্তীর মেয়ে স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতা, ছাব্বিশ বছর বয়সের কুমারী কুলীন মেয়ে। পাত্ৰাভাবে আজও অনূঢ়া। স্বর্ণলতা! জীবনে কত বার দেখাদেখি হয়েছিল। জন্ম থেকে সে দেখেছে স্বর্ণলতাকে। কিন্তু সেই দেখাদেখি একদিন অন্যরকমের দেখাদেখি হয়েছিল। সহসা, বিচিত্র সেই দেখা হয়েছিল বছর চারেক আগে। সেদিন আকাশে কোনও নতুন রং দেখে বেরোয়নি নারায়ণ, কোনও নতুন মন নিয়ে বেরোয়নি। বাতাসে কোনও সুর ছিল না। যে সুর প্রাণ ভোলায়। সে প্রত্যহের মতোই বেরিয়েছিল তার চল্লিশ বছর বয়সের তীব্র বেদনা নিয়ে। বংশজের অভিশাপ, নারীহীন সংসার। ক্রীতকন্যা বিবাহে তার চিরদিনের বিদ্বেষ।
সেদিন স্বর্ণলতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। নিঝুম দুপুর। খাঁ খাঁ করছিল গ্রামের পথ। নারায়ণ গুপ্তিপাড়ার পথে। স্বর্ণলতার গন্তব্য অন্যপাড়ার পথে। পথেই দেখা। দেখা হয়েছিল, কিন্তু কেন যে তারা হঠাৎ দাঁড়িয়েছিল! কেন যে তারা পরস্পরের দিকে বারবার তাকিয়েছিল আর চোখ নামিয়েছিল, তারা জানত না। তারা জানত না, কী সুর বেজেছিল সেই দুপুরের নির্জনতায়। কী সুর তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। কী বিচিত্র রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল দুপুরের আকাশ বাতাস৷
মুহূর্তপরেই তীব্র ভয়ে, বিস্ময়ে, যন্ত্রণায় নারায়ণ ফিরে পেয়েছিল সংবিৎ। একী করছে সে! হতাশা ও ক্ষোভ মোহমুক্ত করেছিল। তবু রীতিভঙ্গ করে নারায়ণ জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যাচ্ছ স্বর্ণলতা?
বাইশ বছরের স্বর্ণলতা। বলেছিল হেসে, বাঁড়ুজ্জে জ্যাঠার বাড়ি। তুমি?
আনত চোখে জিজ্ঞেস করেছিল স্বর্ণ। কিন্তু কী সাহস! শুধু সাহস? এই বংশজ রিক্ত বুকে আর কিছু এনে দেয়নি সেই প্রশ্ন? স্বর্ণলতা তার গন্তব্য জানতে চায়? সে বলেছিল, গুপ্তিপাড়া।
তবু তারা দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর একবার বুঝি কেঁপে উঠেছিল স্বর্ণলতা। এক বার বুঝি মুখের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হয়ে আবার দ্বিগুণ ধারায় এসেছিল ফিরে। সেই দ্বিগুণ ধারাপ্রবাহ বেগে বেরিয়ে এসেছিল তার মুখ থেকে, কিছু বলবে শিরোমণি ঠাকুর?
কী বলবে নারায়ণ! কী কথা শুনতে চায় আজ স্বর্ণলতা? শুধু দুইজনেই তারা চোখে চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, কোন অতীতকাল থেকে যেন তাদের অনেক কথা জমা হয়ে ছিল। অনেক কথা বলার আছে দুজনের।
বংশজের রক্তধারায় প্রচণ্ড আলোড়ন। বলেছিল, বলতে ইচ্ছে করে স্বর্ণলতা।
আরক্ত নত মুখে বলেছিল স্বর্ণ, বলো।
নারায়ণ বলেছিল, কথায় যে সে কথা ফোটে না।
দুজনেই তাকিয়েছিল চোখে চোখে। দুর্জয় সাহসিনী স্বর্ণলতা বলেছিল, আবার দেখা হবে?
হ্যাঁ, অসহ্য ভয়ে ও সুখে কেঁপে উঠেছিল নারায়ণের বুকের মধ্যে! নারায়ণ চূড়ামণি, পণ্ডিত। সেই দুর্জয় সাহসিনীর কাছে নিজেকে দুর্বল মনে হয়েছিল। কোনওরকমে বলেছিল, হবে।
সেই দেখা হওয়া আজও শেষ হয়নি। পশ্চিমের বনঝাড়ে চণ্ডিকার ভাঙা মন্দিরের পাশে সেই দেখা সমানে চলে আসছে। অতি গোপনে। সাক্ষী শুধু বন আর পাখি। আর চণ্ডিকা-দেবীর মূর্তির মধ্যে যদি প্রাণ থেকে থাকে, তবে জানেন তিনি। সেই থেকে শিক্ষা ও আদর্শের মোড় দ্রুত ফিরেছে নারায়ণের। সে কলকাতায় আশ্রয় চায়। সে নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকুরিজীবী হতে চায় কলকাতায়। স্বর্ণলতার জন্য সে বিদ্যাসাগরের পক্ষচ্ছায়া চায়।
তার এই গোপন কথা জানে একমাত্র বন্ধু শিবনাথ। শিবনাথ সেইখানেই আঘাত করেছে তাকে। লেগেছে নারায়ণের। কিন্তু সেই লাগাকে আয়ত্ত করে নিল সে একটু পরেই। বলল ম্লান হেসে, শিবু, পিরিত করে না, পিরিত হয়।
শিবনাথ বলল, সেটা অধর্ম, পাপ।
আর তোমার ক্রীত কিশোরীর সঙ্গে পিরিত করা পাপ হবে না?
শিবনাথ উত্তর দিল, না। ওটা আমার শাস্ত্রধর্ম। বিবাহিতা পত্নীর সঙ্গে প্রেম পাপ নয়৷
নারায়ণ জিজ্ঞাসা করল, সে বিয়ে যেমনই হোক? সে বিয়ে শাস্ত্রোক্ত।
নারায়ণ বলল, তবে আমার শাস্ত্র নেই, বর্ণ নেই, জাত নেই। আমার কোনও কুল নেই, কোনও প্রথা নেই। আমার কি সমাজে ঠাঁই হওয়া উচিত নয়?
শিবনাথ উত্তর দিল, না।
নারায়ণের ক্রোধ ও ক্ষোভ বিষাদের রূপ নিয়েছে। শান্ত বিষাদ। অবনীমোহন অবাক হয়ে তার গুরুদেবের কথা শুনছিল আর বিস্মিত শ্রদ্ধাভরে দেখছিল নারায়ণকে।
পায়রাগুলি উধাও হয়েছে। আকাশ নির্মেঘ, যেন শরতের মতো ধোয়া। দেবদারুর বুক থেকে সোনালি রোদ একেবারে মাথায় গিয়ে ঠেকেছে। যেন সোনালি টোপর মাথায় পরেছে দেবদারু। ঘরমুখো পাখিরা ডাকছে বারমুখো পাখিদের! পূজার সময় হয়ে এল। দেরি হয়েছে। আবার গঙ্গায় গিয়ে ডুব দিয়ে আসতে হবে শিবনাথকে। ওটা তার নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়া।
নারায়ণ বলল, শিবনাথ, তুমি মনে করো না তুমি আমাকে মুখের মতো কথা বলে চুপ করিয়ে দিলে। তোমাকে সত্যি বলি, অভিশাপ আমি জানিনে। তাতে যদি আমাকে চণ্ডালের অন্ন গ্রহণ করতে হয়, পেছ পা হব না। তুমি যে কথা বলে আমাকে আঘাত করতে চাইলে সেই পিরিতই আমার অক্ষয় হয়ে থাকুক। এ যদি পাপ, তবে পাপই আমার জীবন-ধন।
শিবনাথ বললে, তা জানতুম।
কথা শেষ না হতেই নারায়ণ বিদায় হল। শিবনাথ দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে। তার রংভরা আকাশটায় কে ছড়িয়ে দিয়ে গেল রাশি রাশি মেঘ। একটু পরেই কোথায় এক পাখির তীব্র চিৎকারে চমকে উঠল শিবনাথ।
নারায়ণ নেই। হাতে বিলোচনের সুগন্ধিপূর্ণ নস্য, এতক্ষণের কথায় আর কারও এ বস্তুর কথা মনেও ছিল না। নারায়ণ এক টিপ নস্য না নিয়েই চলে গেল? একি শুধু শিবনাথের একার জন্য?
চতুম্পাঠী থেকে নীরবে বাড়ির মধ্যে গেল শিবনাথ। অবনী চোখভরা কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে রইল শিবনাথের পথের দিকে। আঠারো বছর বয়স অবনীর। সুগঠিত সুন্দর স্বাস্থ্য। এখনও কিশোরীর মতো লোমবিহীন মুখ। মুণ্ডিত মস্তক। ফরাসভাঙার পাড়হীন থান কোমরে সেঁটে পরেছে। এতক্ষণের সমস্ত কথা তার কাছে একটু একটু করে এক জটিল ঘটনার জাল খুলে দিতে লাগল। এ জটিলতা সামান্য। আগামী আশ্বিন মাসে অবনী নবদ্বীপে যাবে নৈয়ায়িকদের বিতর্কসভায়।
নিঃশব্দে শিবনাথ গঙ্গার পথ ধরল। স্নান করল, কমণ্ডলু ভরল জলে। জল থেকে পাড়ে উঠে এসে মন্ত্রোচ্চারণ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
ওপারে শান্তিপুরের কোল থেকে সপ্তমীর চাঁদ উঠেছে। আধো অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ঝিঁঝি ডাকছে ঝোপে ঝাড়ে। মাঝে চরার কোল ঘেঁষে যাচ্ছে পালতোলা নৌকা। অকস্মাৎ শিবনাথের সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। নারায়ণ ভুল বুঝল, ভুল বুঝল তাকে? সে শাস্ত্র ধর্মের বাইরে যেতে পারবে না। সে যে তার রক্তের মধ্যে। তার যে কোনও স্বর্ণলতা নেই। যদি কোনও স্বর্ণলতার সঙ্গে কোনওদিন দেখা হত, তবুও শিবনাথ তার সঙ্গে কথা বলতে পারত না। নারায়ণ সব ছেড়ে একজন স্বর্ণলতার কাছে যায়। কিন্তু শিবনাথের যে কেউ নেই। স্বর্ণলতার সোহাগ-আশ্রিত নারায়ণ বন্ধুর সে বেদনাটুকুও ভুলে গেছে। কী বলেছে, কী বলেছে সর্বেশ্বর ঘটক? সে সুগৌরী রূপবহ্নি। গৃহকর্ম-নিপুণা এক দরিদ্র পিতৃমাতৃহীন ভট্টাচার্য ঘরের মেয়ে। কী বলেছে সর্বেশ্বর ঠাট্টা করে বলেছে, বাচস্পতি মশাই, আপনাদের গুপ্তিপাড়ার চোপার খুব নাম বটে। কিন্তু আপনাকে যে চোপা দেব তার তুলনা হয় না। আবার স্বপ্ন নেমে এল শিবনাথের চোখে। কোনও কথা শুনল না নারায়ণ। শিবনাথের কোনও কথাই শুনল না। সে ফিরে এসে দেখল, চতুম্পাঠীতে প্রদীপ জ্বলছে। ছাত্ররা ফিরে এসেছে। গায়ত্রী জপে বসেছে সকলে। আনন্দে ভরে উঠল শিবনাথের বুক। এরপর থেকে ছাত্রদের গুরু-মা তাদের দেখাশোনা করবে। এই মাতৃহারা চতুষ্পঠীতে ছেলেগুলি এবার মা পাবে।