3 of 3

শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক

শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোক

কত হলো?

আজ্ঞে, ছয়ের ঘরে ঢুকে গেছি।

কি করলে? কিভাবে খরচ করলে দিন?

ঠাকুর! জীবনটা শুধুই ভুলে ভরা। ভুলের পর ভুল। এক ভুল থেকে আরেক ভুল।

কিরকম?

এই যেমন, জন্ম! আচ্ছা, জন্ম আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমার বড় হওয়া! সে তো প্রকৃতির কাজ। বিজ্ঞান বলছে, ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর’। শিক্ষা! সে হলো পরিবারের পরিকল্পনা।

তাহলে? এর কোনটাই তো তোমার হাতে ছিল না।

ঠাকুর! এর পরের সবচেয়ে বড় ভুলটা আমার—সেটা হলো সংসারে প্রবেশ। বলেই মনে হলো, কথাটা ঠিক বলা হলো না। সংসারেই তো মানুষ আসে। এই জগৎটাই তো মানুষের সংসার। শতরকম বৈচিত্র্যের মাঝে মানুষের বিচরণ। পৃথিবীতে প্রবেশ মানেই মানুষের সংসারে প্রবেশ। তাহলে? ভুলটা কোথায়!

বুঝেছি ঠাকুর! ভুল হলো সেইটাই। আসক্তি। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরার অধিকার দেওয়া। আপনি বলেছিলেন, মুক্ত মনে করলেই মুক্ত, বদ্ধ মনে করলেই বদ্ধ। একের পর এক, একের পর এক শৃঙ্খল, সে তো মনেরই রচনা। রচয়িতা কে? অহঙ্কার। অহঙ্কারের নাম ‘আমি’। এই ‘আমি’-র আসক্তি, ‘আমি’-র প্রত্যাশা। ‘আশা’। সে একরকম ভাল। মেঘের আশায় আকাশ। চাষার আশা বৃষ্টি। চাতকের আশা স্বাতি নক্ষত্রের জল। মানুষ আশা করে অদৃশ্য কোন শক্তির কাছে। কেউ বলেন ‘ঈশ্বর’, কেউ বলেন ‘ভাগ্য’! প্রত্যাশাই যত হতাশার উৎস। মানুষের প্রত্যাশা ব্যক্তি-মানুষের কাছে, সমাজের কাছে, প্রতিষ্ঠানের কাছে, সরকারের কাছে।

সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক—এক ‘আমি’র কাছে আরেক ‘আমি’র পারস্পরিক প্রত্যাশা। আমাকে কেউ কিছু দেবে না। আমি কিছু চাই না। চাওয়াটা কমাতে কমাতে শূন্য করে ফেলতে হবে। সে কি সম্ভব? ঠাকুর বলছেন, অবশ্যই সম্ভব। সেই পথটি হলো সমর্পণের পথ। আন্তরিক সমর্পণ। এর জন্যে আলাদা ধরনের একটা সাহস চাই। অথবা শিশুর মতো সরল হতে হবে। বলতে হবে- মা, আমি তোমার সন্তান। আমি কাঁদতে পারি, চাইতে পারি না। আমার প্রয়োজন তুমি জান।

এর মানে কি এই হলো, বেকার ছেলে বাপের হোটেলে?

না। এ তো তামস সমর্পণ নয়! জ্ঞানীর সমর্পণ। উজ্জ্বল আধ্যাত্মিকতা। আমার প্রয়াস থাকবে, আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। আমার মায়ের কাজে আমি সাহায্য করব। তাঁর আদেশ, নির্দেশ আমি পালন করব। মা আমাকে বলে বলে দেবেন—এখন এইটা কর, এখন এটা কর। কান পেতে মায়ের আদেশ শোনার চেষ্টা কর। পৃথিবীর কলকোলাহলে কান খাড়া রাখ। শুনতে পাবে, শোনা যায়। সেইটাই নিবিষ্টতা, তন্ময়তা।

ঠাকুর নিজেকে অবতারপুরুষ বলতেন। তিনি কিন্তু মায়ের অনুমতি ছাড়া কোন কাজ করতেন না। মানুষের কথায় সংশয় হলে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে সত্য জেনে আসতেন।

আমরা আমাদের পাকামির ঠেলায় অস্থির। না জানা হলো জীবন, না জানা হলো জীবনাতীত। ঠাকুর বলছেন, কিচ্ছু না, অকপট হওয়ার চেষ্টা কর না। আমরা এমন উজবুক, ঈশ্বরের সঙ্গেও কপটতা! আসলে আমাদের কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই। সংসারেও নেই, ঈশ্বরেও নেই। গোলেমালে গেঁজে আছি। ‘ট্যাঁ’ করে সানাই বাজিয়ে প্রবেশ, ‘হরিবোল’-এ প্রস্থান। মাঝের অবস্থানটুকুতে অহঙ্কারের হাপরের ফোঁসফোঁস। ঈশ্বর কৃপা করে সামনে যদি এসে দাঁড়ানও, ভাবব সেলসম্যান! গুঁড়ো সাবান, কি দাঁতের মাজন বিক্রি করতে এসেছে। বিশ্রী ব্যবহার করে ভাগিয়ে দেব।

ঠাকুর জানতেন, পৃথিবীটা ‘গোলেমালে’ ভরা। কাম-কাঞ্চনের পীঠস্থান। মানুষ ভগবান হলেও পৃথিবীতে প্রবেশ মাত্রই বিস্মৃতি ঘিরে আসে। কে আমি, এলাম কোথা থেকে—ভুলে যাই। ঠাকুর বলছেন, গোলেমালে মাল আছে, গোলটি ছেড়ে মালটি নাও। সেই মালটি হলো নিজের শনাক্তকরণ। তোমার ‘আমি’টাকে আগে শনাক্ত কর। অহং কার? ঠাকুর পদ্ধতি বলছেন : “বেদান্ত মতে স্ব-স্বরূপকে চিনতে হয়। কিন্তু অহং ত্যাগ না করলে হয় না। অহং একটি লাঠির স্বরূপ—যেন জলকে দুভাগ করছে। আমি আলাদা, তুমি আলাদা। সমাধিস্থ হয়ে এই অহং চলে গেলে ব্রহ্মকে বোধে বোধ হয়।”

ঠাকুর কথা বলছেন তাঁরই এক ভক্ত মহিমা চক্রবর্তীর সঙ্গে। বলছেন, ‘আমি’” মহিম চক্রবর্তী, বিদ্বান—এই ‘আমি’ ত্যাগ করতে হবে। তবে বিদ্যার ‘আমি’তে দোষ নাই। শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিলেন।

ঠাকুর পথ বলে দিচ্ছেন, প্রথমে ‘আমি’টাকে হঠাও। হাটালে একটা দরজা খুলে যাবে, এপাশে সসীম ওপাশে অসীম। এপাশে জগৎ, ওপাশে জগৎকারণ ব্রহ্ম। ব্রহ্মই ঈশ্বর। এই জ্ঞানটি আঁচলে বাঁধ। সঙ্গে সঙ্গে অহং নিজের বশে এসে গেল। এই জ্ঞানটি আঁচলে বাঁধ। সঙ্গে সঙ্গে অহং নিজের বশে এসে গেল। ব্রহ্মজ্ঞান না হলে অহংকে বশ করা যায় না। নিজের ছায়াকে ধরা শক্ত।

অপূর্ব! অপূর্ব উদাহরণ। আমি আর আমার ছায়া! দেওয়ালে, মেঝেতে, সিলিঙে। আলো অর্থাৎ জ্ঞান যখন দূরে তখন আমার ছায়া বিশাল এবং তরল। ছায়া ধরা যায় না। ‘আমি’ আর ‘আমি’র ছায়াকে এক করা যায়। যত আমি জ্ঞানালোকের দিকে সরব ততই আমার ছায়া ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হবে। ঠাকুর বলছেন : “সূর্য মাথার ওপর এলে ছায়া আধহাতের মধ্যে থাকে।”

সরবতে চিনি গোলার মতো ‘আমি’টাকে গুলে দেওয়া। আমি নেই। কে আছে? সব আছে। সবেতেই আমি আছি। ভেদবুদ্ধি চলে গেছে। ভেদ গেলে প্রেম আসে। প্রেম এলে মানুষ ঈশ্বর হয়ে যায়।

কাশীপুরে স্বামীজীর একদিন হঠাৎ এই ‘আমি-নাশের’ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বলছেন : “সেই অবস্থায় বোধ হলো যে, আমার শরীর নেই। শুধু মুখটি দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুর ওপরের ঘরে ছিলেন। আমার নিচে ঐ অবস্থা হলো। তিনি ধ্যান করছিলেন। হঠাৎ বোধ হলো, তাঁর মাথার পিছন দিকে জ্বলছে উজ্জ্বল আলো। দেখতে দেখতে সেই আলোর ক্রমবর্ধমান জ্যোতি যেন চন্দ্ৰ, সূর্য, আকাশ প্রভৃতিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। তখন বিশ্বসংসার স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে টলতে শুরু করেছে। তাঁর মন বাহ্যজগৎ ছেড়ে এক অখণ্ড জ্যোতিঃসমুদ্রে নিমজ্জিত হতে চলেছে। দেশ-কাল-পাত্রের বোধ আর রইল না। রইল শুধু অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মসত্তা।” নরেন্দ্রনাথ সেই অভিজ্ঞতাই বলছেন : “সেদিন দেহবোধ একেবারে চলে গিয়েছিল। প্রায় লীন হয়ে গিয়েছিলুম, আর কি? একটু অহং ছিল, তাই সেই সমাধি থেকে ফিরেছিলুম। ঐরকম সমাধিতেই আমি আর ব্রহ্মের ভেদ চলে যায়, সব এক হয়ে যায়—যেন মহাসমুদ্রে জল, আর কিছুই নেই। ভাব আর ভাষা সব ফুরিয়ে যায়।” সমাধি থেকে ফিরে আসার পর, নরেন্দ্রনাথের মনে হলো, তাঁর শরীরের মাথাটা কেবল আছে, বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একেবারে শূন্যে মিশে গেছে। এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন ঘরে ছিলেন বুড়ো গোপাল [স্বামী অদ্বৈতানন্দ]। সমাধি ভঙ্গের পর নরেন্দ্রনাথের কাতর চিৎকারে তিনি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীজী বলছেন : “গোপালদা, গোপালদা, আমার শরীর কোথায় গেল?” গোপালদা তাঁর দেহের বিভিন্ন স্থান টিপছেন আর বলছেন : “কেন নরেন, এই যে, এই যে।” তবু নরেন্দ্রনাথের মনে হতে লাগল, শুধু মুখখানি আছে, আর কিছু নেই। তখন গোপালদা ভয় পেয়ে সকলকে ডেকে আনলেন; কিন্তু কেউ কিছুই বুঝতে না পেরে ওপরে ঠাকুরকে গিয়ে বললেন। ঠাকুর ঈষৎ ভ্রূভঙ্গি করে বললেন : “বেশ হয়েছে, থাক খানিকক্ষণ ঐরকম হয়ে। ওরই জন্যে যে আমায় জ্বালাতন করে তুলেছিল।”

ঠাকুর, স্বামীজী এবং ঠাকুরের অন্যান্য পার্ষদবৃন্দের ত্যাগ, সাধনা, আমাদের জন্য। এমন আবির্ভাব, যোগাযোগ, সংযোগ যুগ-যুগান্তরে একবারই হয়। কিন্তু কেন হয়? ঠাকুর এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, আমি সব করে করে রেখে গেলাম, উদাহরণের মতো। নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি মহাসত্য মহাপ্রশ্নের মহাসমাধান করে দিয়ে গেলাম। সেটি আজ একটি ‘সিম্বল’—আমার সমাধির ভঙ্গি—যা আজ ঘরে ঘরে ছবি। এটি ইচ্ছাকৃত নয়। ঈশ্বরের স্বতঃস্ফূর্ত ইঙ্গিত। যেমন খ্রীস্টের ক্রশ। আমার ডানহাত আকাশের দিকে উঠে যেত। আমার মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হতো। অলৌকিক হাসির সঙ্গে যুক্ত হতো অলৌকিক এক দ্যুতি। সেই ইঙ্গিতের অর্থ হলো—এক এবং অদ্বিতীয়। আমার বুকের কাছে আঙুলের মুদ্রায় যা পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত, সেই বিশ্ববৈচিত্র্য ঐ এক-এরই প্রকাশ।

বিজ্ঞান তো ঐ একই কথা বলছে—”At some point something must have come from nothing.” অর্থাৎ সময়ের শুরু। স্টিফেন হকিঙের ‘হিস্ট্রি অফ টাইম’। কোন একসময়ে ‘কোন কিছু নয়’ থেকে ‘কিছু একটা’র উদ্ভব। “Nothing to something.”

সত্যকে জানা হলো। ঠাকুর জানালেন। সকলেই শুনলেন। উপলব্ধি করলেন একজন। তিনি নরেন্দ্রনাথ। এটি একটি পর্যায়! শ্রীরামকৃষ্ণ এখানেই ‘চ্যাপ্টার ক্লোজ’ করলেন না। কারণ, তিনি উত্তম গুরু। তিনি অবতার। নরেন্দ্রনাথের হলো, তাঁর পার্ষদদের হলো, তিনি ফিরে চলে গেলেন। এমন হলে তিনি কি সর্বকালের সকলের হতে পারতেন!

তোতাপুরীর যা আয়ত্ত করতে চল্লিশ বছর লেগেছিল, ঠাকুর মাত্র তিনদিনে সেই নির্বিকল্পে চলে যাওয়ায় তোতাপুরী মহাবিস্ময়ে বলেছিলেন : “ক্যা দৈবী মায়া!” ঠাকুর কিন্তু নরেন্দ্রনাথের নির্বিকল্পে সেকথা বললেন না। বললেন : “বড় জ্বালাতন করছিল।”

এই অনুভূতির পর উদ্যানবাটীর নিচের ঘরে নরেন্দ্রনাথ কাঁদছেন। তাঁর নিজের বর্ণনা—”বুড়ো গোপাল ওপরে গিয়ে ঠাকুরকে বললেন নরেন্দ্র কাঁদছে।’ তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, ‘এখন টের পেলি, চাবি আমার কাছে রইল!’ আমি বললাম, ‘আমার কি হলো!’ তিনি অন্য ভক্তদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ও আপনাকে জানতে পারলে দেহ রাখবে না; আমি ভুলিয়ে রেখেছি।’

কেন রেখেছিলেন? “নরেন শিক্ষে দিবে।”

কী শিক্ষা দেবেন? শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মের দর্শন। সে-দর্শন কী? পলায়ন নয়, প্রবেশ। ঈশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে জীবনে প্রবেশ। ভিতরে এসে পরিবর্তন। জীবনের ধাঁচটা বদলে দেওয়া। বেঁচে থাকায় আলো আনা। স্বামীজী এই পথ ধরে এগতে এগতে বলবেন, আলো-আলো নিয়ে এস। প্রত্যেকের কাছে জ্ঞানের আলো নিয়ে এস; যতদিন না সকলেই ভগবানলাভ করে।

আন্টিসথেনেস গ্রীক দার্শনিক। তাঁর বিখ্যাত ছাত্র ডায়োজেনেস। তিনি বাস করতেন একটি ব্যারেলের ভিতর। গোল একটা বস্তু—ডাস্টবিনের মতো। সম্বলের মধ্যে একটি জোব্বা, একটি লাঠি আর রুটি রাখার একটি ব্যাগ। যাঁর কিছুই নেই, তাঁর চোরেরও ভয় নেই। কেউ তাঁর এই সুখ হরণ করতে পারবে না। একদিন তিনি তাঁর ব্যারেলের পাশে বসে আছেন। রোদ পোহাচ্ছেন। এমন সময় তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন : “আমি কি আপনার জন্যে কিছু করতে পারি? কোন প্রয়োজন?”

ডায়োজেনেস বললেন : “হ্যাঁ, পারেন। একপাশে সরে দাঁড়ান। আপনি আমার রোদ আটকেছেন।” সূর্যের উত্তাপ! সূর্যের আলো!

শ্রীরামকৃষ্ণ-সূর্যালোকে আমরা ভেসে যাই!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *