শ্রীরামকৃষ্ণ : সমাধিমন্দিরে
শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি হত। এ একটা বিস্ময়কর জিনিস। ভগবানের নাম করতে করতে মানুষ এমন অবস্থায় পৌঁছতে পারে, যখন আর তার সামান্যতম বাহ্যজ্ঞানও থাকে না। জগৎ আছে এই বোধ থাকে না, এমনকি শরীরটা যে আছে সেই বোধই থাকে না। খুব দুর্লভ জিনিস এই সমাধি। সাধনার একেবারে চরম অবস্থা। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, শ্রীরামকৃষ্ণেরমুহুর্মুহুঃ সমাধি হত। গানের যন্ত্র যদি বাঁধা থাকে তাহলে হাতে নিয়েই আমরা তাতে একটা সুর তুলতে পারি। শ্রীরামকৃষ্ণের মনটা সেই রকম—ঈশ্বরীয় চিন্তায় সবসময় বাঁধা আছে। একটুতেই তিনি উচ্চতম আধ্যাত্মিক স্তরে চলে যান। সামান্য উদ্দীপনেই সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। শুকনো দেশলাই যেমন সামান্য একটু ঘষলেই ফস্ করে জ্বলে ওঠে।
‘শ্রীম’ এক জায়গায় বর্ণনা দিচ্ছেন ঠাকুরের সমাধির।শরীর চিত্রার্পিতের ন্যায় স্থির ! ইন্দ্রিয়গণ কাজে জবাব দিয়া যেন চলিয়া গিয়াছে ! নাসিকাগ্রে দৃষ্টি স্থির। নিঃশ্বাস বহিছে, কি না বহিছে। শরীরমাত্র ইহলোকে পড়িয়া আছে! আত্মপক্ষী বুঝি চিদাকাশে বিচরণ করিতেছে। (১-৫-১) ঠাকুরকে সমাধি অবস্থায় দেখে মনে হচ্ছে ‘চিত্রার্পিত’—চিত্রে অর্পিত। একটা ছবি যেন বসানো আছে। একবার এই অবস্থায় ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ঠাকুরকে পরীক্ষা করেছিলেন। ঠাকুর যখন সমাধিস্থ হতেন, তাঁর চোখ পুরোপুরি বন্ধ থাকত না। অর্ধনিমীলিত থাকত—যেমন দেখি আমরা ছবিতে। এমনিতে কি হয়, আমাদের চোখের কাছাকাছি যদি কেউ একটা আঙুল নিয়ে আসে—আঙুলটা চোখে ছোঁয়ানোরও দরকার হয় না, তার আগেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। Reflex action বলে একে। আমাদের সবারই এই অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু ঠাকুরের সমাধি অবস্থায় ডাঃ সরকার তাঁর চোখের একেবারে ভিতরে আঙুল দিচ্ছেন, তবুও চোখের পাতা পড়ছে না। নাড়ী পাওয়া যাচ্ছে না। মৃত্যুর লক্ষণ সব। অথচ মৃত্যু না! ‘শ্ৰীম’ যেমন বর্ণনা করছেন : নিঃশ্বাস বইছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, শরীরটা শুধু পড়ে আছে। একবার দেশে গেছেন, কামারপুকুরে, আশেপাশের গ্রামে রটে গেছে : অদ্ভুত এক লোক এসেছে, দিনে সাতবার মরে, সাতবার বাঁচে। একটা আশ্চর্য অবস্থা। লোকে বুঝতে পারত না। কি করে বুঝবে? যা আমার এলাকার অনেক বাইরে, তা আমি কি করে বুঝব ? কেউ বলত মৃগী রোগ—কেউ বলত মাথার গোলমাল। কেশব সেনের সাথে প্রথম যখন সাক্ষাৎ হচ্ছে—‘কে জানে কালী কেমন’ এই গানটা করতে করতে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন। কেশব সেন অত পণ্ডিত, অত বড় মহাপুরুষ—তিনিও বুঝতে পারছেন না কিছু ভাবছেন : এ আবার কী! অশ্বিনীকুমার দত্তর সাথে দেখা—‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’ এই গানটা গাইতে গাইতে সত্যিই ‘ডুব’, একেবারে সমাধিস্থ। অশ্বিনীকুমার অবাক। বুঝতে পারছেন না কিছু। শিবনাথ শাস্ত্রী এসব দেখে বলতেন : পরমহংসদেবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠাকুরের কানে যেতে ঠাকুর শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলেছিলেন : সে কী শিবনাথ ! তোমরা দিনরাত বিষয়চিন্তা করে মাথা ঠিক রাখতে পারলে, আর চৈতন্যের চিন্তা করে আমি অচৈতন্য হলাম ? তা কি হয় কখনও ? বাস্তবিক, কে তাঁকে বুঝবে? তাঁরই তো সেই উপমা : বেগুনওয়ালা কি কখনও হীরের কদর বুঝতে পারে?
অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও আছে। আর সেটা ভাবলে বড় অবাকই লাগে। একজন বিদেশী অধ্যাপক বুঝেছিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি হয়। উইলিয়াম হেস্টির কথা বলছি। খ্রীস্টান মিশনারি, জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের ‘Excursion’ কবিতাটা পড়াচ্ছিলেন ক্লাসে। স্বামীজী আছেন সেই ক্লাসে। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের সম্বন্ধে শোনা যায় যে, তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে অতীন্দ্রিয়রাজ্যে চলে যেতেন। সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে করতে হেস্টি সাহেব বললেন ; আমি একজনকে জানি, যাঁর এরকম সমাধি হয়। তিনি দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংস। তোমরা একদিন গিয়ে তাঁকে দেখে এসো। ভাবতে অবাক লাগে যে, যখন অনেকেই শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি সম্বন্ধে বলছেন, মাথার ব্যামো বা অন্য কোন অসুখ, তখন এই খ্রীস্টান ভদ্রলোক কি করে বুঝতে পারলেন যে, এটা আর কিছু নয়, সমাধি !
‘কথামৃতে’ দেখি, ঠাকুরকে একজন জিজ্ঞাসা করছেন : মহাশয় ! আপনার এই সমাধি অবস্থায় কি বোধ হয় ? ঠাকুর বলছেন : শুনেছো, কুমুরে পোকা চিন্তা করে আরশুলা কুমুরে পোকা হ’য়ে যায় ; কি রকম জানো ? যেমন হাঁড়ির মাছ গঙ্গায় ছেড়ে দিলে হয়। (১-৫-২)
কুমুরে পোকাও বলে, আবার কুমীরে পোকাও বলে। বোধ হয় কুমীরের মতো দেখতে, সেইজন্য এই নাম।* এই পোকা আরশোলার ঘাড়ে চেপে বসে। আরশোলা দেখতে অনেক বড় কুমুরে পোকার চেয়ে—কিন্তু নড়তে-চড়তে পারে না, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে, আর সমস্ত মনটা তার কুমুরে পোকার দিকে পড়ে থাকে। কুমুরে পোকার চিন্তা করতে করতে আরশোলা কুমুরে পোকাই হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণমঙ্গলেও এই উদাহরণটা দেখছি আমরা :১
এক গোটা পতঙ্গ যখন মাত্র ধরে।
চিত করি কুম্ভিরিকা তাহা দৃষ্টি করে ॥
যেই রূপ দেখি মৈল সেই রূপ হৈল।
কুম্ভিরিকা হৈয়া সেই পতঙ্গ উড়ি গেল॥
এ একটা প্রচলিত বিশ্বাস। এর পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক সত্য আছে বলে মনে হয় না। ভাগবতে এটা একটু অন্য রকমভাবে বলা হয়েছে। সেখানে আছে :২
কীটঃ পেশস্কৃতং ধ্যায়ন্ কুড্যান্তেন প্রবেশিতঃ।
যাতি তৎসাত্মতাং রাজন্ পূর্বরূপমসংত্যজন্ ॥
তেলাপোকা কোটরে ঢুকে কাঁচপোকার ধ্যান করতে থাকে। এর ফলে তার শরীরটা তেলাপোকাই থাকে, কিন্তু স্বভাবটা কাঁচপোকার মতো হয়ে যায়। কথাটার তাৎপর্য হল : আমরা যা চিন্তা করি, তা-ই হয়ে যাই। ঠাকুর বলতে চাইছেন : সমাধির সময় ঈশ্বরের সাথে সাধক একাত্ম হয়ে যায়। নদী যেমন সমুদ্রে পড়লে তার আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, বিন্দু সিন্ধুর সঙ্গে মিশলে যেমন সিন্ধুই হয়ে যায়। নিজেকে ব্রহ্ম ভাবতে ভাবতে মানুষ ব্ৰহ্মই হয়ে যায়। সমাধি অবস্থায়ও ঠিক তাই হয়। মানুষ জগৎ ভুলে যায়, দেহ ভুলে যায়, তার যত সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে যায়—অনন্তের সঙ্গে সে এক হয়ে যায়, সসীম অসীম হয়ে যায় তখন।
যোগশাস্ত্রে আছে, সমাধি কাকে বলে। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি—এই আটটি ধাপ আছে যোগে! ‘যম’ হচ্ছে অহিংসা, সত্যবাদিতা, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ ইত্যাদি। এক কথায় বলতে গেলে—সংযম-অভ্যাস। সংযম-অভ্যাসের ফলে চিত্তশুদ্ধি হয়। যে পথেই আমরা যাই না কেন, এগুলি ধর্মের একেবারে অপরিহার্য অঙ্গ। ‘নিয়ম’ হচ্ছে তপঃ, স্বাধ্যায়, সন্তোষ, শৌচ আর ঈশ্বর-প্রণিধান। এরপর আসছে ‘আসন’। একটা নির্দিষ্ট আসনে বসে যোগ অভ্যাস করতে হবে। আসনে বসে প্রথমে আমার প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করব। আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, শ্বাসটাকে ধরে রাখছি, আবার শ্বাসটা ছাড়ছি—সবটার মধ্যে একটা ছন্দ থাকবে, এলোমেলো হলে চলবে না। সেটাই হচ্ছে ‘প্রাণায়াম’। প্রাণায়ামের পরে আসছে ‘প্রত্যাহার’। আমার মন, ইন্দ্রিয় এগুলি সব বহির্মুখী। আমি এগুলি বাইরে থেকে গুটিয়ে আনছি, অর্থাৎ প্রত্যাহার করছি। বাইরের বস্তু থেকে টেনে এনে মনকে আমি পরমাত্মাতে লাগাতে চেষ্টা করছি। একে বলা হচ্ছে ‘ধারণা’। প্রথম প্রথম এটা করতে কষ্ট হয়, মনে নানা রকম তরঙ্গ ওঠে। কিন্তু চেষ্টা করে যেতে হয়, মনে যাতে মাত্র একটা তরঙ্গ থাকে—একটা চিন্তা, পরমাত্মার চিন্তা। কঠিন, কিন্তু তবুও চেষ্টা করে যেতে হয়। বেদান্তসারে বলছে :৩ ‘অদ্বিতীয়বস্তুনি বিচ্ছিদ্য বিচ্ছিদ্যান্তরিন্দ্রিয়বৃত্তিপ্রবাহো ধ্যানম্।’ ‘অদ্বিতীয় বস্তু’ অথাৎ ব্রহ্ম বা পরমাত্মা। তাঁর চিন্তায় মনটাকে আমি নিবিষ্ট করতে চাচ্ছি। হয়তো দু-মিনিট মনটা ব্রহ্মে স্থির রইল, আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল ; আবার হয়তো কিছুক্ষণ মনটা ব্রহ্মে স্থির হল। সেইজন্য বলছে : ‘বিচ্ছিদ্য’—আমি ব্ৰহ্মচিন্তা করছি, কিন্তু তাতে মাঝে মাঝে ছেদ পড়ে যাচ্ছে।—এই অবস্থাটাকেই বলা হচ্ছে ধ্যান। আর, ধ্যানের গভীর অবস্থাই ‘সমাধি’। তখন শুধু একটা তরঙ্গ আছে মনে, একটা বৃত্তি—‘ব্রহ্মাকারা বৃত্তি’। আর কোন বৃত্তি নেই, তরঙ্গ নেই। এই হল সমাধি। এ কিন্তু নির্বিকল্প সমাধি না—সবিকল্প সমাধি। নির্বিকল্প সমাধি থেকে একধাপ নীচে এই সবিকল্প সমাধি। সবিকল্প ও নির্বিকল্প সমাধিকে ‘সম্প্রজ্ঞাত’ ও ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ সমাধিও বলা হয়। বলা হয় যে, নির্বিকল্প সমাধি লাভ করার পথে চার রকম বিঘ্ন আসে। প্রথম হচ্ছে ‘লয়’। ধ্যান করবার সময় হয়তো ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল। এই একটা বিঘ্ন—‘লয়’ বলে একে। আর একটা বিঘ্ন হচ্ছে ‘বিক্ষেপ’। মনটা ব্ৰহ্মচিন্তা না করে অন্য চিন্তা করছে, বিষয়চিন্তা করছে। এই হচ্ছে ‘বিক্ষেপ’। আর একটা বিঘ্ন হচ্ছে ‘কষায়’। আমি এই জন্মে কিংবা আগের জন্মে হয়তো অনেক কিছু ভোগ করেছি, তার একটা ছাপ মনে রয়ে গেছে। সেই ছাপ বা সংস্কারের জন্য আমার মনটা অনেক দূর গিয়েও হঠাৎ থেমে পড়ে, একটা জড়ভাব এসে যায় কোথা থেকে। ব্রহ্ম বা পরমাত্মার চিন্তায় মনটা বসতে চায় না। এই হল ‘কষায়’। এর থেকেও সূক্ষ্ম বিঘ্ন হচ্ছে ‘রসাস্বাদ’। কি সেটা? আমার ‘সবিকল্প সমাধি’ হয়েছে। সবিকল্প সমাধির আনন্দ ছেড়ে মন আর এগিয়ে যেতে চাচ্ছে না। ঠাকুর যেমন,যতবার নির্বিকল্প-ভূমিতে যেতে চাইছেন, ততবার ‘মা’ এসে সামনে দাঁড়াচ্ছেন। আর মায়ের অমন ভুবন-আলো-করা রূপ—তা ছেড়ে মন আর এগুতে চাইছে না। শেষে অনেক চেষ্টা করে মাকে ছাড়লেন। বলছেন : জ্ঞান-অসি দিয়ে মাকে দ্বিখণ্ড করলাম। তখন হু হু করে মন নির্বিকল্প ভূমিতে চলে গেল। বেদান্তশাস্ত্রে বলছে : ‘রসাস্বাদ’ও একটা বিঘ্ন। কারণ, আমার লক্ষ্য হচ্ছে ‘নির্বিকল্প সমাধি’। ‘সবিকল্প সমাধি’তেই আটকে থাকলে চলবে না। সেখান থেকেও এগিয়ে যেতে হবে। এই চারটে বিঘ্ন অতিক্রম করে নির্বিকল্পভূমিতে পৌঁছতে হবে। যখন সবিকল্পভূমিতে আছি, তখন জ্ঞান, জ্ঞেয়, জ্ঞাতা—এই তিনটের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু নির্বিকল্প সমাধি যখন হল, তখন এই তিনটে এক হয়ে গেল। বেদান্তসারে বলছে :৪ ‘নির্বিকল্পকস্তু জ্ঞাতৃজ্ঞানাদিবিকল্পলয়াপেক্ষয়াদ্বিতীয়বস্তুনি তদাকারাকারিতায়াশ্চিত্তবৃত্তেরতিতারামেকীভাবেনাবস্থানম্—জ্ঞান, জ্ঞেয় আর জ্ঞাতা এই তিনটি জিনিসের পৃথক অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে গেছে। সবিকল্প সমাধিতে যে তদাকারাকারিত চিত্তবৃত্তি অর্থাৎ ব্রহ্মাকারা চিত্তবৃত্তি অবশিষ্ট ছিল, সেই চিত্তবৃত্তি এখন অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে লীন হয়ে গেছে। কি রকম? ‘তদা তু জলাকারাকারিতলবণানবভাসেন জলমাত্রাবভাসবদদ্বিতীয়বস্ত্বাকারাকারিতচিত্তবৃত্ত্যনবভাসেনাদ্বিতীয়বস্তুমাত্রমবভাসতে’৫—নুন জলে মিশলে যেমন নুনের আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, শুধু জলই থাকে— তেমনি নির্বিকল্প সমাধিতে সমস্ত চিত্তবৃত্তি লুপ্ত হয়ে অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুই শুধু বর্তমান থাকে। ‘ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি।’ ব্রহ্মকে জেনে সাধক তখন ব্রহ্মই হয়ে গেছে। ঠাকুর ঠিক একই উদাহরণ দিচ্ছেন ‘কথামৃতে’। বলছেন : নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছিল, একটু নেমেই গলে গেল। ‘তদাকারাকারিত’। তখন কে আর উপরে এসে সংবাদ দেবে, সমুদ্র কত গভীর! (ঐ) সেই অবস্থায় কি অনুভূতি হয় বলতে পারে না মানুষ। তখন ‘মূকাস্বাদন’—নীরবে শুধু আস্বাদন।
ঠাকুর বলছেন : সমাধি অনেক প্রকার। (২-৭-২) একবার হৃষীকেশ থেকে এক সাধু এসেছিলেন ঠাকুরের কাছে। সমাধি সম্বন্ধে তিনি যা যা বলেছিলেন, সব ঠাকুরের অনুভূতির সঙ্গে মিলে গেছিল। বলছেন : হৃষীকেশের সাধুর কথার সঙ্গে আমার অবস্থা মিলে গিছলো। কখন দেখি শরীরের ভিতর বায়ু চলছে যেন পিঁপড়ের মত ; কখন বা সড়াৎ সড়াৎ করে বানর যেমন এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফায়। কখন মাছের মত গতি। (ঐ)
যোগশাস্ত্রে বলে যে, মস্তিষ্ক থেকে মেরুদণ্ডের নীচ পর্যন্ত একটা পথ আছে। তার নাম সুষুম্না। ঐ মেরুদণ্ডের নীচে কুণ্ডলিনী-শক্তি ঘুমিয়ে আছে। কুণ্ডলিনী-শক্তিকে একটা সাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সেই সাপ যেন মাথাটা নীচের দিকে করে ঘুমিয়ে আছে। আমরা যে পথেই যাই না কেন—ভক্তিপথ কিংবা জ্ঞানের পথ কিংবা যোগের পথ—আমরা জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে চেষ্টা করি এই কুণ্ডলিনী-শক্তির ঘুম ভাঙাতে। গোটা সুষুম্না পথটাকে ছটা ভাগে ভাগ করে ছটা নাম দেওয়া হয়। ‘ষট্চক্র’ বা ‘ষট্পদ্ম’ বলা হয়। সবচেয়ে নীচে, মেরুদণ্ডের ঠিক তলায় হচ্ছে—‘মূলাধার’ চক্র। তার একটু উপরে ‘স্বাধিষ্ঠান’ চক্র, তারও একটু উপরে নাভির কাছে আছে ‘মণিপুর’ চক্র, বুকের কাছে আছে ‘অনাহত’ চক্র, গলার কাছে ‘বিশুদ্ধ’, তারও উপরে ভ্রূ-এর মধ্যে আছে ‘আজ্ঞা’ চক্র। এই ষট্চক্র। আর সুষুম্না যেখান থেকে শুরু হয়েছে, আমরা যাকে ব্রহ্মতালু বলি, তার নাম সহস্রার। এই সহস্রারে আছেন পরমাত্মা বা ভগবান। আর মূলাধারে রয়েছেন কুণ্ডলিনী-শক্তি। পরমাত্মা বা ভগবান সব সময় এই কুণ্ডলিনী-শক্তিকে আকর্ষণ করছেন। কিন্তু কুণ্ডলিনী এখন ঘুমিয়ে আছে, তাই সেই আকর্ষণ অনুভব করতে পারছে না, তাই মানুষ ঈশ্বরকে ভুলে বিষয় নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু যখন মানুষ আধ্যাত্মিক পথে এগুতে চেষ্টা করবে, তখন এই কুণ্ডলিনী-শক্তির ঘুম ভাঙবে, ধীরে ধীরে সে সুষুম্না বেয়ে উপরে উঠতে থাকবে। এক একটা চক্রে সে পৌঁছবে, আর এক এক রকম অনুভূতি হতে থাকবে মানুষের। কখনও হয়তো জ্যোতি দর্শন হবে। কখনও হয়তো প্রণব শুনতে থাকবে—এই রকম নানা ধরনের সব অনুভূতি। ঠাকুর বলছেন : কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর এই সব পদ্ম ক্রমে পার হয়ে হৃদয়মধ্যে অনাহত পদ্ম—সেইখানে এসে অবস্থান করে। তখন লিঙ্গ, গুহ্য, নাভি থেকে মন সরে গিয়ে চৈতন্য হয় আর জ্যোতিঃ দর্শন হয়। সাধক অবাক হয়ে জ্যোতিঃ দ্যাখে আর বলে, ‘একি!’ ‘একি!’ (৪-৯৬-১) এইভাবে উঠতে উঠতে কুলকুণ্ডলিনী যখন সহস্রারে গিয়ে পৌঁছবে তখনই সমাধি হবে। এই ষট্চক্র আর সহস্রারকে বেদান্তের ভাষায় বলে ‘সপ্তভূমি’। বেদমতে এসব চক্রকে—‘ভূমি’ বলে। সপ্তভূমি। (ঐ) বলছেন ; হৃদয়—চতুর্থ ভূমি। (ঐ) অনাহত চক্র যেখানে। অনাহত পদ্ম, দ্বাদশ দল। (ঐ) বারোটি পাপড়ি অনাহত পদ্মের। বিশুদ্ধ চক্রপঞ্চম ভূমি। এখানে মন উঠ্লে কেবল ঈশ্বরকথা বলতে আর শুনতে প্রাণ ব্যাকুল হয়। এ চক্রের স্থান কণ্ঠ। ষোড়শ দল পদ্ম। (ঐ) ষোলটি পাপড়ি-বিশিষ্ট পদ্ম। বিশুদ্ধ চক্র বা পঞ্চম ভূমিতে যার মন এসেছে, তার অবিদ্যা অজ্ঞান সব দূর হয়ে গেছে। তার তখন ঈশ্বরীয় কথা বই অন্য কোন কথা শুনতে বা বলতে ভাল লাগে না। যদি কেউ অন্য কথা বলে, সেখান থেকে উঠে যায়। (১-৩-৬) মনের ষষ্ঠ ভূমি—কপাল। (ঐ) অর্থাৎ আজ্ঞা চক্র যেখানে। আজ্ঞা চক্র—দ্বিদল পদ্ম। এখানে কুলকুণ্ডলিনী এলে ঈশ্বরের রূপ দর্শন হয়। (৪-১৬-১) কিন্তু তখনও একটু ‘আমি’ থাকে। সে ব্যক্তি সেই নিরুপম রূপ দর্শন করে উন্মত্ত হয়ে, সেই রূপকে স্পর্শ আর আলিঙ্গন করতে যায় কিন্তু পারে না। যেমন লণ্ঠনের ভিতর আলো আছে, মনে হয়, এই আলো ছুঁলুম ছুঁলুম ; কিন্তু কাঁচ ব্যবধান আছে বলে ছুঁতে পারা যায় না। (১-৩-৬) কী অদ্ভুত বর্ণনা! প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না হলে, শুধু লোকমুখে শুনে বা শাস্ত্র পড়ে এমন খুঁটিনাটি বর্ণনা করা যায় না। তারপর সপ্তভূমি। সহস্রার পদ্ম। সেখানে কুণ্ডলিনী গেলে সমাধি হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব আছেন—তিনি শক্তির সহিত মিলিত হন। শিব-শক্তির মিলন! (৪-১৬-১) তন্ত্রমতে বলা হয় শিব আর শক্তি। সাধক সমাধিস্থ হলে তন্ত্রমতে বলা হবে শিব-শক্তির মিলন হয়েছে, যোগমতে বলা হবে পরমাত্মা-জীবাত্মার মিলন হয়েছে, আর বেদান্ত মতে বলা হবে জীব ব্রহ্মের সাথে এক হয়ে গেছে। সহস্ৰারে মন এসে সমাধিস্থ হয়ে আর বাহ্য থাকে না। সে আর দেহ রক্ষা করতে পারে না। মুখে দুধ দিলে দুধ গড়িয়ে যায়। এ অবস্থায় থাকলে একুশ দিনে মৃত্যু হয়। কালাপানিতে গেলে জাহাজ আর ফেরে না। (ঐ)
ঠাকুর বলছেন : সুষুম্না দিয়ে কুণ্ডলিনী নানারকমভাবে সহস্রারের দিকে এগুতে থাকে। কখনও পিঁপড়ের মতো করে, কখনও বানরের মতো, কখনও বা মাছের মতো। লীলা প্রসঙ্গে দেখি, ঠাকুর কুণ্ডলিনীর আরও তিন রকম গতির কথা বলছেন। সাপের মতো গতি, ব্যাঙের মতো গতি, আর পক্ষিগতি। ঠাকুরের এই সব অনুভূতি, হৃষীকেশের সাধুর বর্ণনার সঙ্গে মিলে গেছিল। কারণ, শাস্ত্রসমর্থিত এসব। তাঁর জীবনটা যেন সমস্ত শাস্ত্রের প্রমাণ। ঠাকুর কখনও কখনও চেষ্টা করতেন বলতে, সমাধি অবস্থায় কি অনুভূতি হয়। পারতেন না। ‘সমাধির সময় এই হয়’—এই বলতে না বলতেই আবার সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন। শাস্ত্রে বলছে :৬ বাক্য-মনের অতীত অবস্থা সেটা—‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’ ভাষা সেখান থেকে ফিরে আসে, মনও সেখানে পৌঁছতে পারে না। কি করে কথা দিয়ে বোঝাবেন সেই অবস্থার কথা? বলছেন : যার হয়, সেই জানে। জগৎ ভুল হয়ে যায়। মনটা একটু নামলে বলি, মা! আমায় ভাল কর, আমি কথা কব। (২-৭-২)
যারা সাধারণ জীব, সমাধির পর মাত্র একুশ দিন তাদের শরীর থাকে। তারপরে তাদের শরীর ত্যাগ হয়ে যায়। কারণ, শরীরটা থাকে কোন একটা বাসনা থাকলে। সমাধিমান পুরুষের কোন বাসনা নেই, কাজেই শরীরটা তার একুশ দিন পর ত্যাগ হয়ে যায়। আপনা-আপনিই খসে পড়ে। কিন্তু যাঁরা অবতার বা ঈশ্বরকোটি, তাঁরা এর ব্যতিক্রম। ঠাকুর বলছেন : ঈশ্বরকোটী—অবতারাদি—এই সমাধি অবস্থা থেকে নামতে পারে। তারা ভক্তি ভক্ত নিয়ে থাকে, তাই নামতে পারে। তিনি তাদের ভিতর ‘বিদ্যার আমি’ ‘ভক্তের আমি’ :লোকশিক্ষার জন্য রেখে দেন। তাদের অবস্থা যেমন ষষ্ঠ ভূমি আর সপ্তম ভূমির মাঝখানে বাচ্খেলা। (৪-১৬-১) ঐ দুই ভূমির মাঝে তাদের মনটা আনাগোনা করে। ষষ্ঠ ভূমির নীচে কখনও নামে না। ঠাকুরকে আমরা দেখি যে, যে অবস্থায় সাধারণ জীবের মাত্র একুশ দিন শরীর থাকে, সেই অবস্থায় তিনি একটানা ছ’ মাস ছিলেন। জড়ের মতো হয়ে গেছিল তাঁর শরীর। নাকে মুখে মাছি ঢুকে যেত, তিনি বুঝতে পারতেন না। মাথার চুলে জট ধরে গেছে। কোথা দিয়ে দিন রাত কেটে যাচ্ছে, কোন বোধই নেই। সেই সময় একজন সাধু এসেছিলেন কোথা থেকে, তিনি তাঁকে দেখেই বুঝেছিলেন যে, জগতের কল্যাণের জন্য এঁর জীবন। এঁর শরীরটা টিকিয়ে রাখা দরকার। একটা লাঠি দিয়ে মেরে মেরে তিনি চেষ্টা করতেন ঠাকুরের মনটাকে একটু নীচে নামিয়ে আনতে। মাঝে মাঝে তাতে কাজ হত, মনটা সত্যিই একটু নীচে নেমে আসত, একটু হুঁশ হত ঠাকুরের—সঙ্গে সঙ্গে সেই সাধু একটু খাবার ঠাকুরের মুখে গুঁজে দিতেন। আবার তিনি সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন। এইভাবে ছ’ মাস ছিলেন তিনি। ছ’ মাস এইভাবে থাকার পর শুনলেন, ‘মা’ তাঁকে বলছেন : তুই ভাবমুখে থাক্। লোকশিক্ষার জন্য তুই ভাবমুখে থাক্। তার পরই তাঁর খুব পেটের অসুখ হল—রক্ত-আমাশা। মায়েরই ইচ্ছা বলতে হবে। কারণ, ঐ অসুখের ফলেই ধীরে ধীরে তাঁর মনটা স্বাভাবিক ভূমিতে নেমে এল।
ঠাকুরকে একজন জিজ্ঞাসা করছেন : সমাধি অবস্থায় আপনার কি একটুও অহং থাকে না? ঠাকুর বলছেন : হাঁ,আমার প্রায় একটু অহং থাকে।(১-৫-২). দু রকম সমাধি আছে, আগেই বলেছি। সবিকল্প সমাধি বা ভাব-সমাধিতে একটু ‘অহং’ বোধ থেকে যায়। ‘আমি ভক্ত’ এই বোধটা থেকে যায়। ঠাকুর বলছেন যে, তাঁর সমাধি অবস্থায় একটু অহং বোধ থেকে যায়। অবতারপুরুষ তো, তাই একটু ‘অহং’ রেখে দেন লোককল্যাণের জন্য। একটুও যদি অহং না থাকে তাহলে কোন কাজ করা যায় না। তিনি এক জায়গায় বলছেন : গুটি যদি পেকে যায়, তাহলে আর খেলা হয় না। অবতারপুরুষ তাঁর লীলাপুষ্টির জন্য একটু ‘আমি’ রেখে দেন। উদাহরণ দিয়ে বলছেন : সোনা যতই ঘষা যাক না কেন, একটু সোনার কণা থেকেই যায়। তেমনি, তাঁরও সমাধি যখন হয় একটু ‘অহং’ থেকে যায়। বলছেন : বাহ্যজ্ঞান চলে যায়, কিন্তু প্রায় তিনি একটু ‘অহং’ রেখে দেন। (ঐ) কেন? বিলাসের জন্য! আমি তুমি থাকলে তবে আস্বাদন হয়। রসের আস্বাদন হয় (ঐ) দুই না থাকলে বিলাস হয় না। ঈশ্বর রসস্বরূপ, ভক্ত হচ্ছেন রসিক। ‘ভগবান, তুমি আছ’ আর ‘ভক্ত, আমি আছি’—এই হলে তবে রসের আস্বাদন হয়। কিন্তু কখন কখন সে আমিটুকুও তিনি পুঁছে ফেলেন।(ঐ) এক এক সময় তাঁর ‘অহং’ একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়। তখন যে সমাধি হয় তার নাম জড় সমাধি—নির্বিকল্প সমাধি। তখন কি অবস্থা হয় মুখে বলা যায় না। (ঐ) উদাহরণ দিচ্ছেন : নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গেল। সমুদ্রে গিয়ে সে গলে গেল, সমুদ্রের সাথে মিশে গেল, সমুদ্রই হয়ে গেল সে—তার আর কোন পৃথক অস্তিত্ব রইল না। তদাকারাকারিত। (ঐ) তখন সে আর কি করে বলবে সমুদ্র কত গভীর? নির্বিকল্প সমাধি যখন হয় মানুষের, মানুষ তখন ‘অবাক’ হয়ে যায়। কি অনুভূতি হয়, বলতে পারে না। নীরবে সে শুধু আস্বাদন করে। ‘মূকাস্বাদনবৎ’। অন্যকে বুঝিয়ে বলতে পারে না। যার হয়েছে, সেই শুধু বুঝতে পারে। মহাভারতে বর্ণনা দেখছি : শ্রীকৃষ্ণের সমাধি হয়েছে। তখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভীষ্ম শরশয্যায় আছেন। হঠাৎ যুধিষ্ঠির দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ কিরকম গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। ‘দদর্শ কৃষ্ণমাসীনং নীলমেঘসমদ্যুতিম্’।৭ দেখলেন যে, কৃষ্ণ স্থির হয়ে বসে আছেন। নীলমেঘের মতো দীপ্তিময়। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করছেন :৮ কি হয়েছে মাধব? তুমি এ রকম করে বসে আছ কেন? ‘নেঙ্গন্তি তব রোমাণি’—তোমার গায়ের লোমগুলো পর্যন্ত নড়ছে না। ‘স্থিরা বুদ্ধিঃ’—তোমার বুদ্ধি স্থির। ‘তথা মনঃ’—মনটাও স্থির। ‘কাষ্ঠকুড্যশিলাভূতঃ’—তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কাঠের দেয়াল। আর পাথরের মতো নিশ্চল। প্রাণ নেই যেন। ‘নিরীহশ্চাসি মাধব’—নিরীহ, নিশ্চেষ্ট, স্থির, অচল হয়ে রয়েছ। ‘যথা দীপো নিবাতস্থো নিরিঙ্গো জ্বলতে পুরঃ তথাসি ভগবন্! দেব! পাষাণ ইব নিশ্চলঃ’—বায়ুশূন্য স্থানে প্রদীপের শিখা যেমন স্থিরভাবে জ্বলে, একটুও নড়ে না, ভগবান, তুমিও ঠিক তেমনি পাষাণের মতো বসে আছ। কি হয়েছে তোমার বুঝতে পারছি না। আবার ভক্তিশাস্ত্রেও দেখা যায় যে, শ্রীমতীর মহাভাব হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণের বিরহে তাঁর এমন অবস্থা হচ্ছে যে, বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সখীরা ভাবছেন, তিনি বুঝি দেহরক্ষা করেছেন। আবার ‘কৃষ্ণ’ নাম শুনতে শুনতে তাঁর মধ্যে জীবনের লক্ষণ ফিরে আসছে। এই মহাভাব আসলে সমাধি ছাড়া আর কিছু না।
আবার আমরা দেখি যে, চৈতন্যদেবেরও সমাধি হচ্ছে। চৈতন্যদেব সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন যে, চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা হ’ত। (২-১১-১) বাহ্যদশা, অর্ধবাহ্যদশা আর অন্তর্দশা। বাহ্যদশা যখন, তখন তাঁর মন রয়েছে স্থূল আর সূক্ষ্ণে। যখন অর্ধবাহ্যদশা তখন কারণ শরীরে, কারণানন্দে মন গিয়েছে। (ঐ) আর যখন অন্তর্দশা, তখন মহাকারণে মন লয় হ’তো। (ঐ) এই শেষ অবস্থাটা হচ্ছে সমাধির অবস্থা। উপনিষদে আমরা দেখি বিশ্ব, তৈজস, প্রাজ্ঞ আর তুরীয় এই চারটি অবস্থা। ‘বিশ্ব’ হচ্ছে জাগ্ৰৎ অবস্থা, যখন আমি এই স্থূল জগৎকে জানতে পারছি। ‘তৈজস’ হচ্ছে স্বপ্নাবস্থা। আমি স্বপ্ন দেখছি, ঘুমিয়ে আছি—কিন্তু ভিতরে আমার ‘তেজ’ আছে, অর্থাৎ চৈতন্য আছে। যার ফলে আমি স্বপ্ন দেখছি, মনে মনে কত কিছু করছি। তারপরে আছে ‘সুষুপ্তি’ অবস্থা—স্বপ্ন নেই মোটে। সেটাকে বলা হচ্ছে ‘প্রাজ্ঞ’ অবস্থা। এর পরে যে অবস্থা—সেটাকে বলা হচ্ছে ‘তুরীয়’ অবস্থা। একই অবস্থার কথা বিভিন্ন ভাষা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে। বিশ্ব-তৈজস-প্রাজ্ঞ-তুরীয় ইত্যাদি শব্দের দ্বারা যা বোঝানো হচ্ছে, তা-ই বোঝানো হচ্ছে স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ—এই শব্দগুলির সাহায্যে। ঠাকুর বলছেন : বেদান্তের পঞ্চকোষের সঙ্গে, এর বেশ মিল আছে ! (ঐ) কি কি সেই পঞ্চকোষ? প্রথমে আসছে অন্নময় কোষ, তারপর প্রাণময় কোষ, তারপর মনোময় কোষ, এর পরে বিজ্ঞানময় কোষ আর সবশেষে আনন্দময় কোষ। একটা কোষের ভিতর আর একটা কোষ যেন বসানো আছে পর পর। সবচেয়ে ভিতরে আছেন ব্রহ্ম। ব্রহ্মই হচ্ছেন এই পঞ্চকোষের ‘আত্মা’। বলছেন : স্থূলশরীর, অর্থাৎ অন্নময় ও প্রাণময় কোষ। সূক্ষ্ম শরীর, অর্থাৎ মনোময় ও বিজ্ঞানময় কোষ। কারণ শরীর, অর্থাৎ আনন্দময় কোষ। মহাকারণ পঞ্চকোষের অতীত। মহাকারণ অর্থাৎ ব্রহ্ম। (চৈতন্যদেবের) মহাকারণে যখন ,মন লীন হ’ত তখন সমাধিস্থ।—এরই নাম নির্বিকল্প বা জড় সমাধি। (ঐ)।
আপাতবিচারে সুষুপ্তি আর সমাধি—এই দুই অবস্থায় কিছুটা মিল থাকলেও, দুটো কিন্তু এক নয়। সুষুপ্তিতেও মানুষ এই বাইরের জগৎ ভুলে যায়, মনটা কোথায় যেন চলে যায়, মনে হয়, ‘আমি’ নেই আর। কিন্তু তবু সেটা সমাধি নয়। কারণ, ‘কারণ’ শরীরটা রয়ে গেছে। অবিদ্যা রয়ে গেছে। যার জন্য আবার আমার দেহবুদ্ধিটা ফিরে আসে। অবিদ্যার বীজটা রয়ে গেছে বলে আমি আবার সাধারণ অবস্থায় ফিরে আসি। কিন্তু সমাধি যখন হল সেই বীজটা নেই আর, আমার সব অবিদ্যা দূর হয়ে গেছে। ‘কারণ’ ‘মহাকারণে’ লয় পেয়ে গেছে। সেটাকেই বলা হচ্ছে তুরীয় অবস্থা। চৈতন্যদেবের সেই অবস্থা হত। ঠাকুর বলছেন ; যখন তিনি বাহ্যদশায় থাকতেন তখন তিনি নামসঙ্কীর্তন করতেন। অর্ধবাহ্যদশায় ভক্তদের নিয়ে নৃত্য করতেন। আর যখন তাঁর অন্তর্দশা, তখন তিনি সমাধিস্থ হয়ে থাকতেন। জড়বৎ রয়েছেন। একেবারে বুঁদ হয়ে রয়েছেন। ‘তদাকারাকারিত’। ঠাকুরের সমাধির যেমন বর্ণনা দিচ্ছেন ‘শ্রীম’, ঠিক সেই রকম। শরীরটা শুধু পড়ে রয়েছে তাঁর, তিনি নিজে অন্য কোন রাজ্যে বিচরণ করছেন। চৈতন্যচরিতামৃতে দেখছি সেই বর্ণনা : ৯
এইমত মহাপ্রভু রাত্রি দিবসে।
আত্মস্ফুর্তি নাহি, রহে কৃষ্ণপ্রেমাবেশে ॥
—অন্তর্দশায় রয়েছেন মহাপ্রভু। সমাধিস্থ হয়ে রয়েছেন। আত্মস্ফুর্তি নেই—জীবনের কোন প্রকাশ নেই বাইরে। আবার :
কভু ভাবে মগ্ন, কভু অর্দ্ধবাহ্যস্ফূর্তি।
কভু বাহ্যস্ফূর্তি,—তিন-রীতে প্রভুর স্থিতি ॥
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও চৈতন্যদেবের মতো এই অবস্থাগুলি দেখা যেত। তাঁরও কখন অন্তর্দশা—তখন জড়বৎ চিত্রার্পিতের ন্যায় বাহ্যশূন্য হইয়া পড়েন। কখন বা অর্দ্ধবাহ্যদশা—তখন প্রেমাবিষ্ট হইয়া নৃত্য করিতে থাকেন। আবার কখন বা শ্রীগৌরাঙ্গের ন্যায় বাহ্যদশা—। তখন ভক্তসঙ্গে সংকীর্তন করেন। (২-২-৪)
শুধু ঠাকুরেরই না, শ্রীশ্রীমায়েরও সমাধি হত। মা তখন ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে আছেন। সেই সময় যোগানন্দ মহারাজ মাঝ রাতে একদিন দেখেছিলেন : চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। নহবতের দরজার কাছে মা বসে আছেন—নিশ্চল, সমাধিস্থ। বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে মা যখন থাকতেন, তখন রাতে কে একজন বাঁশি বাজাত। সেই বাঁশির শব্দে মায়ের সমাধি হয়ে যেত। তবে মার খুব ভাব চেপে রাখার ক্ষমতা ছিল, তাই লোকে তাঁর ভাব বা সমাধির কথা বিশেষ জানতে পারত না। বাবুরাম মহারাজ বলছেন : ঠাকুরকে পর্যন্ত এটা দেখিনি। ঠাকুর পারতেন না—মুহুর্মুহুঃ সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন। মায়ের ভাব, সমাধি—এসব কত হচ্ছে, কিন্তু কাউকে তিনি তা জানতে দিচ্ছেন না !
স্বামীজীরও সমাধি হত। ঠাকুর স্থূলদেহে থাকতেই তাঁর সমাধি হয়েছিল। ঠাকুর তখন কাশীপুরে রোগশয্যায়। ঠাকুরকে প্রায়ই বলেন : যাতে তাঁর সমাধি হয়। শুকদেবের মতো নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকবেন—এই তাঁর ইচ্ছে। শেষে একদিন সন্ধ্যায় ধ্যান করতে বসেছেন তিনি আর বুড়োগোপাল মহারাজ (স্বামী অদ্বৈতানন্দ), এমন সময় তাঁর সমাধি হল, নির্বিকল্প ভূমিতে চলে গেলেন তিনি। সমাধি যখন ভাঙল, তখন আর শরীরটাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। চিৎকার করে উঠেছেন : গোপালদা, আমার শরীর কোথায় গেল? গোপালদা তখন তাঁর হাত-পা টিপে টিপে দেখাতে লাগলেন : এই তোমার হাত, এই তোমার পা,⋯। স্বামীজী সম্বন্ধে বলা হয় যে তিনি ধ্যানসিদ্ধ। ধ্যানের গভীর অবস্থাই তো সমাধি। গিরিশ ঘোষ স্বামীজীর ধ্যানের বর্ণনা দিচ্ছেন। নরেন আর তিনি ধ্যান করতে বসেছেন। ধ্যান করবেন কি—মশার কামড়েই অস্থির। কিন্তু নরেনের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, দিব্যি ধ্যানে ডুবে গেছেন। মশায় গা একেবারে ছেয়ে ফেলেছে, দেখে মনে হচ্ছে একটা কালো কম্বল যেন তাঁর গায়ে জড়ানো আছে। কিন্তু তিনি ধ্যান করে যাচ্ছেন। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। পাথরের মতো বসে আছেন। মনটা তাঁর শরীর ছাড়িয়ে কোথায় চলে গেছে। স্বামীজী থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে যখন ছিলেন সেই সময়কার ঘটনা। তার পরদিনই তিনি সেখান থেকে বিদায় নেবেন। একটা খোলা জায়গায় ধ্যান করতে বসেছেন দু’জন শিষ্যাকে নিয়ে, ইতিমধ্যে ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি, মেঘ ডাকছে, একজন শিষ্যা ছাতা ধরেছে স্বামীজীর মাথার উপরে কিন্তু তাঁর ধ্যান আর ভাঙে না, ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো বসে আছেন। অনেক পরে তাঁর ধ্যান ভাঙল। সমাধিস্থ হয়ে গেছিলেন তিনি। জন্ম থেকেই স্বামীজী ধ্যানসিদ্ধ। ছোটবেলায় ‘ধ্যান-ধ্যান’ খেলতেন বন্ধুদের সাথে। অন্যদের কাছে সেটা খেলা। কিন্তু তাঁর কাছে সত্যিই ধ্যান। একদিন ঐ রকম ‘ধ্যান-ধ্যান’ খেলার সময় একটা সাপ এসে হাজির। বন্ধুরা সব ছুটে পালাল। কিন্তু তিনি ধ্যানস্থ। সাপ এসে চলে গেল—তিনি জানতেও পারলেন না। তাঁর যে ধ্যানমূর্তির ছবিটা আমরা দেখি, সেটা তাঁর সমাধিস্থ অবস্থার ছবি। বিদেশে তোলা। তাঁর ফটো তোলা হবে, তাঁকে বলা হয়েছে, আপনার ধ্যানমূর্তির একটা ছবি নেব আমরা। সেই জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছেন তিনি—চোখ বুজেছেন, সঙ্গে সঙ্গে সমাধিস্থ। আর একবার স্বামীজী আছেন মিঃ লেগেটের বাড়িতে। তাঁদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আছেন। তাঁরা যেখানে থাকতেন, তার কাছেই বড় একটা হ্রদ আছে। স্বামীজী সেই হ্রদের ধারে মাঝে মাঝে গিয়ে ধ্যান করতেন। এক দিন ধ্যান করতে বসে তাঁর সমাধি হয়েছে। বাড়ির একটি লোক ঘুরতে ঘুরতে সেখানে গেছে, গিয়ে দেখে স্বামীজী সেখানে পড়ে আছেন। সে অনেক ডাকল স্বামীজীকে, ধাক্কাধাক্কি করল। সাড়া পেল না, দেখল যে, স্বামীজীর নিঃশ্বাস পড়ছে না। ছুটে এসে সে বাড়িতে খবর দিল: স্বামীজী মারা গেছেন। সবাই ছুটল স্বামীজীর কাছে! অনেক পরে স্বামীজীর দেহবুদ্ধি ফিরে এল—সমাধি ভাঙল। তাঁর লেখা একটা বিখ্যাত গান আছে, সেই গানটা পড়লে মনে হয় তিনি সমাধির কথাই বলছেন :১০
নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর,
ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব চরাচর ॥
অস্ফুট মন-আকাশে, জগৎসংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর।
ধীরে ধীরে ছায়াদল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি’ ‘আমি’—এই ধারা অনুক্ষণ ॥
সে ধারাও বদ্ধ হ’ল শূন্যে শূন্য মিলাইল,
‘অবাঙ্মনসোগোচরম্’, বোঝে—প্রাণ বোঝে যার ॥
—প্রথমে ধীরে ধীরে সূর্য, চন্দ্র, সমস্ত জ্যোতির রেখা লোপ পেয়ে গেল। বিশ্বচরাচরকে একটা ছায়ার মতো মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে বাহ্যজগৎ মুছে যাচ্ছে। কিন্তু তখনও ‘অহং’ বোধ একটু রয়ে গেছে—‘বহে মাত্র “আমি” “আমি” এই ধারা অনুক্ষণ।’ ধীরে ধীরে অহং বোধ সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল, ‘শূন্যে শূন্য মিলাইল।’ সমাধিস্থ। তখন কী অনুভূতি হচ্ছে, কেউ বলতে পারে না। যার হয়েছে সেই বুঝতে পারে শুধু। বলছেন : ‘বোঝে—প্রাণ বোঝে যার।’ সমাধি স্বামীজীর করায়ত্ত ছিল। কিন্তু, ঠাকুরের ইচ্ছায়, লোককল্যাণের জন্য তিনি সেই অবস্থা থেকে একটু নীচু ভূমিতে বিচরণ করতেন।
রাজা মহারাজ বা স্বামী ব্রহ্মানন্দকেও দেখা যেত, অধিকাংশ সময়ই তিনি সমাধিস্থ হয়ে আছেন। তিনি বলতেন যে, প্রকৃত ধর্মজীবন শুরু হয় নির্বিকল্প সমাধির পরে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, তাঁর ঐ অবস্থা হয়েছিল। মহাপুরুষ মহারাজেরও সমাধি হত বলে জানা যায়। রোমাঁ রোলাঁকে তিনি একটা চিঠিতে লিখছেন :১১ শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনবার আমি সমাধিসুখ উপলব্ধি করেছি।
বাস্তবিক, ধর্মজগৎটা এত ব্যাপক, এত বিচিত্র—এ সহজে লোকে বাইরে থেকে ধারণা করতে পারে না। অনেক মহল আছে ধর্মজগতে—বাইরের মহল আছে, ভেতরের মহল আছে। আমরা হয়ত কেউ কেউ বাইরের মহলেও যেতে পারি না—দূর থেকে একটু দেখি শুধু। কেউ কেউ হয়তো ভিতরে একটু প্রবেশ করি। বিশেষ ভাগ্যবান যাঁরা, তাঁরা অনেক ভিতরে প্রবেশ করেন। সেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকে হোরেশিওকে হ্যামলেট বলছেন :১২ ‘There are more things in heaven and earth, than are dreamt of in your philosophy.’—এই সংসারে এমন অনেক কিছু আছে, যা হয়তো তোমাদের দার্শনিকেরা ধারণাও করতে পারবে না। ধর্মজগতে এই কথাটা খাটে। কত কী কাণ্ড ঘটে ধর্মজগতে। যা আমাদের জীবনে ঘটে না, আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু যুগে যুগে মহাপুরুষরা আসেন। তাঁদের জীবন অ-লৌকিক। অ-লৌকিক এই জন্য যে, তাঁদের ত্যাগ অ-লৌকিক, তাঁদের পবিত্রতা অ-লৌকিক, তাঁদের তপস্যা অ-লৌকিক। শ্রীচৈতন্য এইরকম ব্যক্তি, শ্রীরামকৃষ্ণ এইরকম ব্যক্তি, শ্রীশ্রীমা বা ঠাকুরের অন্যান্য সন্তানরা এই ধরনের ব্যক্তি। তাঁদের জীবন দেখে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, ভাব, সমাধি—এগুলি মিথ্যে নয়। ধর্মজীবনের বিশেষ বিশেষ স্তরে মানুষের ঐ সব অনুভূতি হতে পারে।
আরও আশ্চর্য ব্যাপার, এই ভাব বা সমাধি—বা ধর্মজগতে যে-কোন অনুভূতিই—কোন ধর্মের, কোন দেশের, কোন জাতি বা কোন যুগের একচেটিয়া নয়। চিরন্তন সত্য এগুলি—সবার জন্য সত্য। সব দেশের সাধক-সাধিকারই এইসব অনুভূতি হয়েছে। খ্রীষ্টান সাধকদের মধ্যে দেখি, বৌদ্ধ সাধকদের মধ্যে দেখি—এমনকি মহম্মদের জীবনে পর্যন্ত দেখি। মহম্মদেরও ভাব হত, সমাধি হত। যীশুখ্রীষ্টের সম্বন্ধেও সেরকম শোনা যায়। যীশুখ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হল, তারপর তাঁর দেহ কবর দেওয়া হল। এরপর শুরু হল জোর ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাত। বৃষ্টি থামলে দেখা গেল, মৃতদেহ নেই। খ্রীষ্টানরা একে বলে ‘রেজারেকশন’—খ্রীষ্টের পুনরুত্থান। মেরি ম্যাগডালিন আর জেমসের মা মেরি, যাঁরা সমাধিস্থল পাহারা দিচ্ছিলেন, তাঁরা যীশুখ্রীষ্টকে কবর থেকে উঠে আসতে দেখেছিলেন। এই রেজারেকশন সম্বন্ধে একটা মত হচ্ছে যে, যীশুখ্রীষ্ট আসলে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাননি, সমাধিস্থ হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে কবর দেওয়া হয়। সমাধি ভাঙলে পরে তিনি কবর থেকে বেরিয়ে আসেন। একটা কিংবদন্তী অনুসারে তিনি ভারতবর্ষের কাশ্মীরে চলে আসেন। কাশ্মীরে একটি জায়গা দেখিয়ে আজও লোকে বলে যে, এটা ঈশা অর্থাৎ যীশুখ্রীষ্টের সমাধিস্থান। আমার ছাত্রজীবনে একবার রেভারেণ্ড বি.এ.নাগের একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম এই বিষয়ে। তিনি বলেছিলেন, যীশুখ্রীষ্ট ভারতবর্ষে এসেছিলেন। পুরীতেও এসেছিলেন তিনি। সেখানে এসে তিনি এদেশের সাধুদের সঙ্গ করেছিলেন।
উইলিয়ম জেমসের ‘Varieties of Religious Experience’ বলে একটা বই আছে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, বিভিন্ন ধর্মের সাধকদের কি কি অনুভূতি হয়। উইলিয়ম জেমসকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের একজন জনক বলা হয়। স্বামীজীর সাথে তাঁর ভাল পরিচয় ছিল, স্বামীজীর ‘রাজযোগ’ পড়েছিলেন তিনি। তাঁর ঐ বইতে একজায়গায় উইলিয়ম জেমস বর্ণনা করেছেন ধ্যানে কি অনুভূতি হয়। আমাদের সমাধির ধারণার সঙ্গে সেটার খুব মিল আছে। বলছেন :১৩ ‘…the mystical feeling of enlargement, union, and emancipation has no specific intellectual content whatever of its own’ —একটা রহস্যময় অনুভূতি হয়। মনে হয়, আমি ছোট নই, আমি বড় হয়ে গেছি—ভগবানের সাথে আমার যোগ হয়ে গেছে। মুক্তির আস্বাদ পাচ্ছি আমি। মনে হচ্ছে, আমার মনটা এখন শূন্য হয়ে গেছে, শান্ত, স্থির —সেখানে আর কোন চিত্তবৃত্তি নেই, চাঞ্চল্য নেই।
ঠিক এরকম একটা বর্ণনা পাওয়া যায় এমিলি ব্রন্টির একটা কবিতায় :১৪ ‘…first, a hush of peace’—প্রথমেই একটা নিস্তব্ধ শান্তি। ‘a soundless calm descends’—সব নিঃশব্দ, নিথর, শান্ত। ‘The struggle of distress, and fierce impatience ends’—যত ব্যথা সব থেমে গেছে, মনে কোন অস্থিরতা নেই আর। ‘Mute music soothes my breast’—নিঃশব্দ সঙ্গীত শুনছি আমি। আমার সমস্ত মন-প্রাণ তাতে শীতল হয়ে যাচ্ছে। ‘unuttered harmony, that I could never dream’—একটা অনুচ্চারিত ঐকতান শুনছি আমি যা আমার স্বপ্নাতীত। ‘till Earth was lost to me.’—ধীরে ধীরে সমস্ত জগৎ আমার কাছে মুছে গেল। আমার বাহ্যজ্ঞান চলে গেল। কি চমৎকার বর্ণনা! আমাদের সমাধির বর্ণনার সঙ্গে খুব মিল।
সমাধি সম্বন্ধে গীতাতে বলছে :১৫ ‘ব্রাহ্মী স্থিতিঃ’। অর্থাৎ ব্রহ্মে স্থিতি। বেদান্তসারে বলছে :১৬ ‘চিত্তং নিবাতদীপবৎ’—বায়ুশূন্য স্থানে একটা প্রদীপ জ্বলছে। তার শিখাটা স্থির হয়ে আছে—কোন চাঞ্চল্য নেই তাতে। তেমনি ‘অচলং সদখণ্ডচৈতন্যমাত্রমবতিষ্ঠতে’—শুধু অখণ্ডচৈতন্য, শুধু ব্রহ্মচৈতন্য—এছাড়া আর কিছু নেই। আমি একটা আলাদা সত্তা, ঈশ্বর একটা আলাদা সত্তা—এ বোধ নেই। ঈশ্বরময় হয়ে গেছি, ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু জানি না। ‘অখণ্ডচৈতন্য’। খণ্ড নেই, দুই নেই। আমি আর ঈশ্বর একাকার হয়ে গেছি। তদাকারাকারিত। এই হচ্ছে নির্বিকল্প সমাধির অবস্থা। ভাষা দিয়ে অবশ্য এই অবস্থার কথা বর্ণনা করা যায় না।—তবে কিছু যদি বলতে হয়, তাহলে এই হচ্ছে সেই অবস্থা। অত্যন্ত দুর্লভ অবস্থা। অথচ ঠাকুরের কাছে অনায়াস-লভ্য। মুহুর্মুহুঃ সমাধিস্থ হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, সমাধি থেকে নেমে আসাটাই তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে যেত। মনে তো কোন বাসনা নেই। বাসনা না থাকলে কি করে নামবেন? তখন জোর করে মনে একটা ছোট্ট বাসনা আনতেন—‘জল খাব’ কিংবা ‘তামাক খাব’। ঐ বাসনাটা অবলম্বন করে নীচে নেমে আসতেন। বাল্যকালেই দেখি তাঁর সমাধি হচ্ছে—আকাশের বুকে বক উড়ে যাচ্ছে, তাই দেখে তিনি সমাধিস্থ হয়ে পড়ছেন। তোতাপুরী চল্লিশ বছরের সাধনায় নির্বিকল্প ভূমিতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। ঠাকুর সেই ভূমিতে তিনদিনে পৌঁছে গেলেন। তোতাপুরী অবাক হয়ে যাচ্ছেন এই অদ্ভুত শিষ্যকে দেখে। বলছেন : এ কি ‘দৈবী মায়া’। সত্যিই দৈবী মায়া। মায়ার কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। ঠাকুরের আধ্যাত্মিক অনুভূতিরও কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তিনি যেন নিজের বশে নেই আর। চেষ্টা করেও পারছেন না সমাধিস্থ না হয়ে। আমাদের মনের স্বাভাবিক গতি বিষয়ের দিকে। ঠাকুরের মনের স্বাভাবিক গতি ঊর্ধ্বদিকে, নির্বিকল্প ভূমির দিকে। একদিনের চিত্র দিচ্ছি ‘কথামৃত’ থেকে। ঠাকুরের কাছে নরেন্দ্রনাথ আছেন, ডাক্তার সরকার আছেন, আরও কেউ কেউ আছেন। মাস্টারমশাই তো আছেনই। ঠাকুরের তখন গলার অসুখ শুরু হয়েছে। ভক্তরা সবসময় সতর্ক আছেন, পাছে তাঁর ভাব হয়, কারণ তাতে তাঁর শরীরের ক্ষতি হতে পারে। যেদিনের কথা বলছি, নরেন্দ্রনাথ সেদিন গান করছেন একের পর এক। প্রথম গান করেছেন ‘চমকার অপার জগৎ রচনা তোমার।’ তারপরে গাইছেন : ‘নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে অরূপরাশি।’ উদ্দীপনাময়ী গান সমস্ত। দ্বিতীয় গানটা যখন করছেন, মাস্টারমশাইকে ডাক্তার সরকার বলছেন : It is dangerous to him! (১-১৮-১) অর্থাৎ এই গানের যা ভাব এ শুনে এক্ষুনি ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়বেন, আর তাহলেই বিপদ। ঠাকুর কথাটা শুনেছেন। ডাক্তারকে বলছেন : না, না, কেন ভাব হবে? (ঐ)—যেন কত চেষ্টা করছেন যাতে ভাব না হয়। কিন্তু পারলেন না। নিজেকে বশে রাখতে পারলেন না। ডাক্তারের আশঙ্কাই ঠিক হল। দেখতে না দেখতে সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন ঠাকুর। শরীর স্পন্দহীন, নয়ন স্থির! অবাক! কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় উপবিষ্ট। (ঐ)
আর একদিনের চিত্র দিচ্ছি। সেদিনও ওরকম গান শুনে সমাধিস্থ হয়েছেন। তারপর প্রকৃতিস্থ যখন হয়েছেন, লজ্জা পাচ্ছেন। বলছেন : কি একটা হয় আবেশে ; এখন লজ্জা হচ্ছে। যেন ভূতে পায়, আমি আর আমি থাকি না।(১-১৬-৩) নিজের উপর যেন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। মাঝে মাঝে বলতেন : ঐ এলো, ঐ এলো। বলতে বলতেই সমাধিস্থ। যেন একটা বিরাট প্লাবন এসে গ্রাস করছে তাঁকে। জ্যোতির সমুদ্র। তার বিরুদ্ধে তাঁর কিছু করবার নেই। চেষ্টা করেও তিনি নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে পারছেন না। বলছেন : যেন ভূতে পায়, আমি আর আমি থাকি না।(ঐ) ভূতে পেলে মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়। যার প্রেতাত্মা তার মধ্যে ভর করেছে, তার মতো সে আচরণ করে। শ্রীরামকৃষ্ণও অ-স্বাভাবিক আচরণ করছেন, যখন তাঁর মধ্যে ঈশ্বরীয় ভাবের আবেশ হচ্ছে। বলছেন : আমি আর আমি থাকি না। এ অবস্থার পর গণনা হয় না। গণ্তে গেলে ১-৭-৮ এই রকম গণনা হয়। (ঐ) অর্থাৎ সাধারণ মানুষের বেলায় যে নিয়ম খাটে, সেই নিয়ম তিনি তখন রাখতে পারেন না। সমস্ত জাগতিক হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। মাস্টারমশাই মন্তব্য করছেন ; আশ্চর্য গণিত! সত্যিই আশ্চর্য!
শ্রীরামকৃষ্ণের সবই আশ্চর্য। তাঁর সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে একজন জীবনীকার কখনও তাঁকে বলছেন : Man-God আবার কখনও বলছেন God-man। ঠিক করতে পারছেন না কি বলবেন। সত্যিই কোন্ ভাষায়, কোন্ অভিধায় তাঁকে চিহ্নিত করব, এ আমরা বুঝতে পারি না। এই যে ‘সমাধি’—এর সম্বন্ধে শাস্ত্রে বর্ণনা আছে, আগেও অনেকের হয়েছে বলে শোনা গেছে—কিন্তু তিনি যদি না আসতেন তা হলে তো এযুগে আমরা এ বিশ্বাস করতে পারতাম না। আজ ঘরে ঘরে তাঁর সমাধিমূর্তির ছবি দেখা যাচ্ছে। আমরা বুদ্ধের ধ্যান-মূর্তি পাই, চৈতন্যের ছবি পাই কিন্তু সেসব কল্পনা। এই প্রথম পাচ্ছি সমাধিস্থ পুরুষের ছবি। আঁকা ছবি নয়—ফটো। যখন তিনি সমাধিস্থ হতেন, রূপ একেবারে ফুটে বেরোত। যাঁরা তাঁকে দেখেছেন সমাধি-অবস্থায় তাঁরা বর্ণনা করেছেন যে, অপূর্ব রূপ। তাঁকে সমাধিস্থ দেখে একবার একজন বলছেন : প্রেমমূর্তি, আনন্দমূর্তি। বাস্তবিক, ভালবাসা আর আনন্দ যেন ছড়িয়ে পড়ত সেই মূর্তি থেকে। তাঁর ভাইঝি লক্ষ্মীদিদি বলছেন : তাঁর যখন সমাধি হত, তখন মনে হত, পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে সুন্দর মানুষ আর কেউ নেই। একটা অপার্থিব রূপ ফুটে বেরুত সর্বাঙ্গ থেকে। চোখ অর্ধনিমীলিত, আর মুখে অদ্ভুত এক হাসি। স্বর্গীয় হাসি। কোন কোন ফটোতেও সেই হাসির আভাস দেখতে পাওয়া যায়। বাস্তবিক, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি না আসতেন, এই ভাব, সমাধি প্রভৃতি আধ্যাত্মিক রাজ্যের অনুভূতিগুলিকে আমরা হয়ত অবিশ্বাস করতাম। কিন্তু তাঁর মধ্যে দেখলাম ; এই একটি লোক এই যুগে আমাদের মধ্যেই বাস করে এই এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন। অতএব এগুলি বিশ্বাস না করে পারি না আমরা। বেদমূর্তি শ্রীরামকৃষ্ণ। ধর্মমূর্তি। ধর্মস্বরূপ। ধর্মজগতের যত সম্পদ আছে, সব তিনি নিজের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছেন। তিনি যেন একটা সংগ্রহশালা। যতরকম আধ্যাত্মিক অনুভূতি সম্ভব, সব সেখানে রয়েছে। তিনি বলতেন : এখানকার অনুভূতি বেদ-বেদান্তকে ছাড়িয়ে গেছে। সত্যিই তাই। সমস্ত শাস্ত্রে যা আছে, তার ঘনীভূতরূপ তিনি। এই সমাধির কথা আমরা কতটুকু পাই? বিভিন্ন শাস্ত্রে ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। কিন্তু তাঁর অনুভূতির মধ্যে আমরা সে সবকিছুর একটা সামগ্রিক রূপ দেখতে পাচ্ছি। আবার সেইসব অনুভূতি তিনি স্বয়ং বলে যাচ্ছেন। যেন চ্যালেঞ্জ করছেন : শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নাও। শাস্ত্রকেই মিলিয়ে নাও আমাকে দেখে, শাস্ত্রের প্রামাণ্য যাচাই করে নাও আমার কাছ থেকে। তাঁর জীবনটা যেন একটা মণিকোঠা—তার দরজা অল্প একটু ফাঁক হয়ে গেছে আমাদের সামনে। আর তার ভিতরে উঁকি মেরে আমরা দেখছি যে, সমস্ত শাস্ত্র মন্থন করে যা রত্ন উঠেছে, তা থরে থরে সাজানো রয়েছে সেখানে।
আকর-তালিকা
১। শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, মাধবাচাৰ্য, ১৩৩৩, পৃঃ ৩৩৪
২। ভাগবত, ১১/৯/২৩
৩। বেদান্তসার, ২০৭
৪। ঐ, ১৯৭
৫। ঐ, ১৯৮
৬। তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ২/৯
৭। মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৪৫/১৩
৮। ঐ, ৪৫/২৫-৬
৯। চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা, ১৫শ পরিচ্ছেদ
১০। বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৩৮৩, পৃঃ ২৬৭
১১। The Life of Ramakrishna by Romain Rolland, 1970, p. 216 f.n.
১২। Hamlet, Act I, Scene v
১৩। The Varieties of Religious Experience by William James, 1936, pp. 416-17
১৪। Poems of Emily Bronte, 1906, p. 19, ‘The Prisoner’
১৫। গীতা, ২/৭২
১৬। বেদান্তসার, ২১৪
* সংস্কৃত নাম কুম্ভীরমক্ষিকা। দ্রষ্টব্য : বঙ্গীয় শব্দকোষ —হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়