শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন
জলভাত একেক সময় খুব হালকা আর তরল হয়ে যাচ্ছে। জলের পরিমাণ বেশি হলে জলো হবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তবু এবার আমরা একটু রাস্তা বদল করছি, এবার আমাদের পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভরসা।
সংস্কৃত সাহিত্যের টীকাকারেরা বলেছিলেন, ‘উপমা কালিদাসস্য’। একালের অবিস্মরণীয় লেখক, রামকৃষ্ণ জীবনীকার স্বর্গত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘উপমা রামকৃষ্ণস্য।’
সরাসরি রামকৃষ্ণদেবের দু’-একটা চিরচেনা সরস গল্প দিয়ে শুরু করি।
মায়াকে যদি চিনতে পার আপনি লজ্জায় পালাবে। হরিদাস বাঘের ছাল পরে একটা ছেলেকে ভয় দেখাচ্ছিল।
যাকে ভয় দেখাচ্ছে, সে বললে, ‘আমি চিনেছি, তুই আমাদের হরে।’ তখন সে হাসতে হাসতে চলে গেল।
পরের গল্পটি আরও চমকপ্রদ।
ছুতোরদের মেয়েরা চিঁড়ে বেচে। তারা কতদিক সামলে কাজ করে।
ঢেঁকির পাট পড়ছে। এক হাতে ধানগুলি ঠেলে দিচ্ছে। আর এক হাতে ছেলেকে কোলে কোরে মাই দিচ্ছে।
আবার খদ্দের এসেছে। চেঁকি এদিকে পড়ছে, আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথাও চলছে। খদ্দেরকে বলছে, তা হলে তুমি যে কয় পয়সা ধার আছে, সে কয় পয়সা দিয়ে যেয়ো আর জিনিস নিয়ে যেয়ো।
ছেলেকে মাই দেওয়া, চেঁকি পড়ছে, ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান ভোলা। আবার খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলা একসঙ্গে করছে।
কিন্তু পনেরো আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে পাছে হাতে পড়ে যায়।
আর বাকি এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া, খদ্দেরের সঙ্গে কথা কওয়া।
না হলে সর্বনাশ।
ঢেঁকির পাটে হাত পড়ে যাবে।
শুধু উপমা বা গল্প নয়, কথনভঙ্গি, বিশ্লেষণ এবং বর্ণনা সেখানেও রামকৃষ্ণ অতুলনীয়, বিশ্বের সেরা কথাসাহিত্যিক রামকৃষ্ণের কাছে শিখে নিতে পারেন কী করে কী ভাবে কীসের কথা বলতে হয়। কী ভাবে বললে লোকে বুঝবে, শুধু বুঝবে তাই নয় কথাটা লোকের হৃদয়ঙ্গম হবে।
একাধিক সংক্ষিপ্ত উদাহরণ হাতের কাছেই উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত স্বামী শান্তরূপানন্দের ‘উপদেশাবলী’ পুস্তিকায় রয়েছে।
যেমন,
ক) যদি গঙ্গার কাছে গিয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে কেউ বলে— গঙ্গা দর্শন স্পর্শন করে এলাম, তা হলেই হল। সব গঙ্গাটা হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ছুঁতে হয় না।
খ) যতক্ষণ না হাটে পৌঁছনো যায় ততক্ষণ দূর হতে শুধু হো হো শব্দ। হাটে পৌঁছালে আর একরকম, তখন স্পষ্ট দেখতে পাবে, শুনতে পাবে।
‘আলু নাও।’ ‘পয়সা দাও।’ স্পষ্ট শুনতে পাবে।
গ) এক মার পাঁচ ছেলে। বাড়িতে মাছ এসেছে। মা মাছের নানারকম ব্যঞ্জন করেছেন— যার যা পেটে সয়। কারও জন্য মাছের পোলোয়া, কারও জন্য মাছের অম্বল, মাছের চচ্চড়ি, মাছ ভাজা, এই সব করেছেন। যেটি যার ভাল লাগে। যেটি যার পেটে সয়— বুঝলে?
***
ঈশ্বর ব্যাপারটা আমি ভাল বুঝি না। অল্প বয়সে হালকা কবিতায় ঈশ্বরকে নিয়ে অল্পবিস্তর ঠাট্টা তামাশা করেছি, তবে সেও অনেকদিন আগের কথা।
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রামকৃষ্ণ কথায় ঈশ্বরকে উল্লেখ না করে উপায় নেই।
কিন্তু এ ঈশ্বর (রামকৃষ্ণের ঈশ্বর) সে ঈশ্বর নয়। এ ঈশ্বর পাশের বাড়ির মেয়ে, অকালমৃত বাল্যবন্ধু। ভালবাসার আত্মীয়।
দু’-একটা উদাহরণ অবান্তর হবে না।
প্রথম উদাহরণে ঈশ্বর বা ভগবান বড়লোকের মেয়ে।
রামকৃষ্ণ বলেছেন,
‘চিকের ভেতর বড়লোকের মেয়েরা থাকে। তারা সকলকে দেখতে পায়, কিন্তু তাদের কেউ দেখতে পায় না।
ভগবান ঠিক সেই রূপে বিরাজ করছেন।’
অন্য এক জায়গায় বলেছেন, ‘যেমন বাতাসে জল নড়লে ঠিক প্রতিবিম্ব দেখা যায় না তেমনি মনস্থির না হলে তাতে ভগবানেরও প্রকাশ হয় না।’
এই সূত্রে অপ্রাসঙ্গিক, তবুও রামকৃষ্ণের একটা অবিস্মরণীয় নির্দেশ আবার স্মরণ করছি।
‘সংসারে নষ্ট মেয়ের মতো থাকবে। মন উপপতির দিকে, কিন্তু সে সংসারের সব কাজ করে।’
শুধু রামকৃষ্ণের উপমাই পারে ঈশ্বরকে উপপতির সঙ্গে তুলনা করতে।
অতঃপর রামকৃষ্ণ কথিত একটি গুরুশিষ্য সংবাদ উপস্থাপন করি একটু কাটছাঁট করে কথিকার আকারে—
শিষ্য: কেমন করে ভগবানকে পাব?
গুরু: আমার সঙ্গে এসো।
গুরু: শিষ্যকে একটা পুকুরে নিয়ে গিয়ে তাকে চুবিয়ে ধরলেন এবং খানিকটা পরে জল থেকে উঠিয়ে আনলেন।
গুরু: তোমার জলের ভেতর কেমন হয়েছিল?
শিষ্য: প্রাণ আটুবাটু করছিল— যেন প্রাণ যায়।
গুরু: দেখ, ভগবানের জন্য যদি তোমার প্রাণ এ রকম আটুবাটু করে তবেই তুমি তাকে লাভ করবে।
কথিকার পরে রামকৃষ্ণের একটা চমৎকার গল্প বলি, প্রায় হুবহু স্বামী শান্তরূপানন্দের ভাষায়।
একজন একখানা চিঠি পেয়েছিল। কুটুমবাড়ি তত্ত্ব করতে হবে, কী কী জিনিস লেখা ছিল।
জিনিস কিনতে দেবার সময় চিঠিখানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কর্তাটি তখন খুব ব্যস্ত হয়ে চিঠির খোঁজ আরম্ভ করলেন।
অনেকক্ষণ ধরে অনেকজন মিলে খুঁজলে। শেষে চিঠিখানা পাওয়া গেল। তখন আর আনন্দের সীমা নেই।
কর্তা ব্যস্ত হয়ে অতি যত্নে চিঠিখানা হাতে নিলেন আর দেখতে লাগলেন, কী লেখা আছে।
লেখা এই, ‘পাঁচ সের সন্দেশ পাঠাইবে। একখানা কাপড় পাঠাইবে,…’ আরও কত কী। তখন আর চিঠির দরকার নেই। চিঠি ফেলে দিয়ে সন্দেশ ও কাপড়ের আর অন্যান্য জিনিসের চেষ্টায় বেরলেন।
চিঠির দরকার কতক্ষণ?
যতক্ষণ সন্দেশ, কাপড় ইত্যাদির বিষয় না জানা যায়। তার পরই পাবার চেষ্টা।