শ্রীরামকৃষ্ণের মথুর
সর্বত্র রাষ্ট্র হয়ে গেছে, কলকাতার অদূরে দক্ষিণেশ্বর নামক গ্রামে এক রানী একটি কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছেন, একেবারে গঙ্গার ধারে। সুরম্য উদ্যান। দুটি বাঁধানো ঘাট, চাঁদনি, পোস্তা। নহবতে সানাই বাজে। সেখানে একটি দিশাজঙ্গল আছে। গঙ্গার পবিত্র পানীয় জল সদাসর্বদাই পাবে। কয়েক রাত নির্জনে কাটাবার মতো কুঠিয়া আছে। সেই রানীর জামাতা, বিত্তশালী জমিদার মথুরমোহন পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থাও রেখেছেন। শুধু তাই নয়, সেখানে এক মহাসাধকের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী করেছেন। তিনি কখনো নিরাকারে, আবার কয়েক মুহূর্ত পরেই সাকারে। এই এখানে, তো সেই সেখানে। দেহ বিসর্জন না দিয়েও মুহূর্তে পৃথিবীর বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার একটি গোপন পথের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছেন। সমাধি তাঁর হাতধরা—করামলকবৎ। গেরুয়া নেই, পাগড়ি নেই, চিমটে নেই, লোটা-কম্বল কিছুই নেই। বাইরে কোন প্রকাশ নেই, লম্বা লম্বা উপদেশ নেই। একটি ধুতি—হাঁটু ছাড়িয়ে নামতে চায় না, আর সেই ধুতির খুঁটটি গায়ে ফেলা। গাছপালা, লতাপাতার আড়াল থেকে তাঁর মুখটি যখন বেরিয়ে থাকে, সেই মুখটি দেখলে মনে হবে নিষ্পাপ এক বালকের মুখ। চোখে একটি বালকের অপার বিস্ময়। জগৎসংসারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহামায়ার লীলা দেখছেন। সেই চোখ-দুটি অপার প্রেমাশ্রুতে সদাই টলটলে। তিনি ফুল তুলতে পারেন না, বেলপাতা ছিঁড়তে পারেন না, দূর্বা ওপড়াতে পারেন না। স্পর্শ করেন, অনুভব করেন—পৃথিবীর বস্তুনিচয় একই চৈতন্যের অধিকারী। এই বোধের উদ্ভাসে তাঁর মুখটি সদাই উদ্ভাসিত। কোমল দুর্বার ওপর দিয়ে কেউ দুর্বিনীতভাবে হেঁটে গেলে তাঁর বুকে লাগে।
তাঁর অনেক শত্রু, কারণ তিনি ঐ জমিদারটিকে যা বলেন তিনি তাই করেন। মধুলোভী বিষয়ীরা এই বশীকরণটি সহ্য করতে পারে না। সাধকের সাধনাকে বলে পাগলামি। তাঁর ভাবকে বলে ঢঙ। তিনি কিন্তু সকলের মিত্র। তিনি জানেন, এক দৈবীশক্তি তাঁকে বেছে নিয়েছে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তিনি অসহায়। ‘আমি’টা খসে গেছে, সবটাই ‘তুমি’। এত প্রেম, কিন্তু বিষয়ী, অবিশ্বাসীদের সহ্য করতে পারেন না। ধর্মের গোঁড়ামিকে বলেন—”শালার মতুয়ার বুদ্ধি”। দক্ষিণেশ্বর শুধু মা ভবতারিণীর মন্দির নয়, অমন ঢাকঢোল বাজানো মন্দির অনেক আছে। ঐ মন্দির এই সাধকের সাধনায় একটি মহা পীঠস্থান। চৈতন্যে জরে আছে। মৃত্তিকার প্রতিটি কণায় বীজমন্ত্র বিড়বিড় করছে। এই মন্দিরের দেবী মধ্যরাতে মূর্তি ফেলে জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। মন্দিরের ধাপে ধাপে তাঁর পায়ের পাঁয়জোরের শব্দ ঝুমুর ঝুমুর করে। মন্দিরের দ্বিতলে কালো কেশ এলিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গঙ্গা দেখেন, কলকাতা দেখেন। কালীঘাট তাঁর সেরেস্তা, দক্ষিণেশ্বর তাঁর আবাসস্থল। রোজ সকালে তিনি মাখনমিছরি খেয়ে চলে যান কালীঘাটের সেরেস্তায়—দীন, দুঃখী, সংসার-জ্বালায় জর্জরিত ভক্তদের দরবারে। সন্ধ্যার সময় ফিরে আসেন দক্ষিণেশ্বরে। এ হলো সাধকের দর্শন। বিষয়ের ছানি পড়া চোখে দেখা যায় না, আসক্ত মনে বিশ্বাস আসে না। ঝমঝম শুনতে না পেলেও বেশি রাতে মন্দিরের দিকে যেতে তাদের গা ছমছম করে।
মথুরমোহন দেখছেন অবাক হয়ে, কি ভেলকি লেগেছে! তন্ত্রসাধনার পর এই সাধকের শক্তি শতগুণ বেড়েছে। দেবালয় হয়েছে ইন্দ্রালয়। মথুরমোহনের ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি বেড়েছে। যে-কাজে হাত দিচ্ছেন, সেই কাজই সফল হচ্ছে। আর লক্ষ্য করছেন, গুরুরা সব শিষ্য হয়ে যাচ্ছেন, বাঘা বাঘা পণ্ডিতরা সব শিশু। কেউ না চিনুক মথুর চিনেছেন, কেউ না জানুক মথুর জেনেছেন। রানীর দেবালয়ে সাধনের ভিয়েন বসেছে। নবদ্বীপ কলকাতার দিকে সরে এসেছে। উনবিংশ শতাব্দী আগামীকালের ওপর ফেটে পড়বে। ইতিহাসের মোড় ঘুরবে। একটা জাগরণ। শাস্ত্র, সাধন একটা নতুন ব্যাখ্যা পাবে। শ্রীরামকৃষ্ণ হবেন একটি আন্দোলনের নাম। “তোমার যা খুশি, তুমি তাই কর, মথুর তোমার পিছনে আছে।”
নিজের ভাবে বিভোর হয়ে বসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আঙুল নিয়ে খেলা করছিলেন। বড় বিস্ময় তাঁর এই আঙুলে। যখন সমাধি হয়, এই জগতের খোলস খুলে পড়ে যায়। হঠাৎ দেখতে পান সর্বত্র গনগনে বহ্নিশিখা, অথবা প্রায় তরল একটি অগ্নিমণ্ড, শত স্ফুলিঙ্গে উৎসারিত কোটি ব্রহ্মাণ্ড, চরাচরে মহাব্যাপ্ত নাভিমণ্ডল থেকে উত্থিত প্রণবধ্বনিতে তাঁর জগৎ-চেতনা যখন আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন বাঁহাতের এই আঙুলগুলো পদ্মমুদ্রা রচনা করে, আর ঊর্ধ্বোত্থিত ডানহাতের আঙুলে আসে আরেকটি মুদ্রা, বলিষ্ঠ একটি ইঙ্গিত— মহাকাশে, মহাবিশ্বে প্রভু তোমার অন্বেষণ!
আঙুল নাড়তে নাড়তে, দেখতে দেখতে একসময় বললেন—ও মথুর, এইবার যে অনেকে আসবে।
কে আসবে?
এই যারা ভক্ত, সাধুসন্ত, বিভিন্ন মত ও পথের ভক্ত আর সাধকরা।
তা আসুন না তাঁরা। আমি তো তাই চাই। জমে যাক তোমার লীলাখেলা। প্রমাণ তো হয়েই গেছে, তুমি সাক্ষাৎ অবতার।
দেখ মথুর, যে যা বলে বলুক, তুমি আমাকে অবতার বলবে না। আমি যেদিন নিজে হাটে হাঁড়ি ভাঙব একমাত্র সেইদিনই জানা যাবে আমি কে। তার আগে নয়। আমি এখন নিজেকে আরো দেখব। মেলাব, মিলব।
এখন যেখানে আছ, সেখানে তুমি কে?
আমি এক রসিক পাগল।
বুঝেছি, বাধাবে গোল—সেবার নদীয়ায়, এবার দক্ষিণেশ্বরে। যাক, এখন বল, তোমার ভক্তদের জন্য কি করতে হবে।
শোন সেজবাবু, সাধু আর ভক্তরা সব ঈশ্বরের প্রতিরূপ। তাদের সেবা আর ঈশ্বরের সেবায় কোন তফাত নেই।
জানি, আমার এ-বিশ্বাস তুমি আগেই তৈরি করে দিয়েছ।
তাহলে বুঝতে পারছ, সাধু-সন্তদের শুধু অন্নসেবা করলেই হবে না, তাঁদের দেহরক্ষার উপযোগী অন্যান্য জিনিসের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বল, কি কি জিনিস?
বস্ত্র, কম্বল, কমণ্ডলু, এমনকি গাঁজা-কলকে।
ঠিক আছে, আমি তোমার জন্য আলাদা ঘরে আলাদা একটা ভাণ্ডার তৈরি করে দিচ্ছি, তোমার খুশিমতো যাকে যা ইচ্ছে তাই দিও। ভাণ্ডারটা সম্পূর্ণ তোমার। তোমার হুকুম ছাড়া কেউ খুলতে পারবে না। কি, খুশি তো!
খুব খুশি।
এইসব খবর মুখে মুখে ছড়াল সাধুসমাজে। দো-চার দিনকে লিয়ে, ঠারনেকা তো ওহি আচ্ছা হায়। গঙ্গাসাগর থেকে দক্ষিণেশ্বর, পুরী যাওয়ার পথে দক্ষিণেশ্বর। শ্রীরামকৃষ্ণের কী আনন্দ!
মথুর, এতে কিন্তু তোমার বিষয় নেই!
তুমি তো আমাকে অবিষয়ের মহাবিষয় চিনিয়েছ। আচ্ছা ঠাকুর! আমার কি কিছু হতে পারে না।
তোমার তো হয়েই আছে, আর কি হবে!
বিষয় সম্পত্তি, সোনাদানা, জুড়ি গাড়ি, চোগা চাপকান, চেন-লকেট—এসব নয়, এর বাইরে। সুরাপানে তো রেমো, শ্যেমোও মাতাল হয়, তোমার মতো সুধাপানে মাতাল!
ধুৎ, এ আবার তোমার কি ইচ্ছে! তাহলে আমার সানাইয়ের পোঁ ধরবে কে? সানাই আর পোঁ, দুটোই যে দরকার গো। একটাকে ছেড়ে আরেকটা তো হয় না মথুর!
কিন্তু আমার যে খুব ইচ্ছা করে, একবার অন্তত পাঁচিল টপকাই
সে কি আমার হাতে! যাঁর হাতে, তাঁকে গিয়ে ধর। মন্দিরে যাও, গিয়ে মাকে বল—মা, আমাকে ভাবসমাধি দাও। আমাকে তো তিনিই দিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে হলে ছুঁচের ফুটো দিয়ে হাতি গলে যায়।
আমি কি রামকৃষ্ণ যে, বললেই হবে! পাথরে প্রাণ একমাত্র তুমিই পার প্রত্যক্ষ করতে। আমার না আছে সাধন, না আছে বিশ্বাস! আমি দেখব পাথরের মূর্তি। পুজো হচ্ছে, আরতি হচ্ছে, ঘণ্টা নড়ছে।
তাহলে কি করে হবে? এ কি ছেলের হাতের মোয়া!
তুমি হওয়ালেই হবে।
আমি কে?
তুমি শিব, কালী, কৃষ্ণ, রাম, ভগবান—তুমি আমার সব, আর আমি তোমার সেবক। তোমার সেবাই আমার সাধনা। তুমি একটা কথা বল, মথুরের সেবায় কোন ত্রুটি আছে?
না, একথা আমি মানছি
তাহলে সেবক কি তোমার কৃপা একটু পেতে পারে না! তোমাকে পেয়েছি, তোমাকে দেখেছি। কিন্তু তুমি যেখানে থাক, সেই জায়গাটা একবার দেখাবে না!—থেকে থেকে তুমি যেখানে চলে যাও!
আরে, সে-জায়গার কি কোন ঠিকানা আছে, না পথ আছে, না গাড়ি আছে? উড়িয়ে নিয়ে যায়।
তুমি পাশ কাটাতে চাইলেও আমি ছাড়ছি না। বাবা, তোমায় করে দিতেই হবে। অন্তত একবার আমি ভাবসমাধিতে যেতে চাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরমোহনের আরো অন্তরঙ্গ হয়ে বললেন, ওরে কালে হবে, কালে হবে। একটা বিচি পোঁতামাত্রই কি গাছ হয়ে তার ফল পাওয়া যায় বাবা! কেন, তুই তো বেশ আছিস—এদিক-ওদিক দুদিক চলছে। ওসব হলে এদিক থেকে মন উঠে যাবে, তখন তোর বিষয়-আশয় সব রক্ষা করবে কে? বার ভূতে সব যে লুটে খাবে। তখন কি করবি?
সে যা হয় করব, আমার ভাবসমাধি চাই।
আচ্ছা শোন, আমি তোকে আরেক ভাবে বলি। ভাল করে শোন, যারা ভক্ত, ওরে, তারা কি কিছু দেখতে চায়! তারা সাক্ষাৎ সেবার অধিকার চায়। তাদের সেবাতেই আনন্দ। ঈশ্বরকে দেখলে শুনলে তাঁর ঐশ্বর্যজ্ঞানে ভয় আসে, ভালবাসা চাপা পড়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন। গোপীরা সব বিরহে আকুল! শ্রীকৃষ্ণ তাদের অবস্থা জেনে উদ্ধবকে পাঠালেন বোঝাতে। উদ্ধব জ্ঞানী কিনা! বৃন্দাবনের কান্নাকাটি ভাব, খাওয়ানো-পরানো—এসব উদ্ধব বুঝতে পারত না। গোপীদের শুদ্ধ ভালবাসাকে ভাবত মায়িক, ছোট করে দেখত। শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে পাঠালেন আরো এই কারণে, যাতে গোপীদের দেখে তারও শিক্ষা হয়—ভালবাসা কাকে বলে! উদ্ধব গিয়ে গোপীদের বোঝাতে লাগল—’তোমরা সব কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কেন অমন করছ? জানই তো, তিনি ভগবান, সর্বত্র আছেন; তিনি মথুরায় আছেন আর বৃন্দাবনে নেই—এটা তো হতে পারে না। অমন করে হা-হুতাশ না করে একবার চোখ বুজে দেখ দেখি, দেখবে, তোমাদের হৃদয়মাঝে সেই নবঘনশ্যাম মুরলীবদন বনমালী সর্বদা রয়েছেন।’ উদ্ধবের জ্ঞানের কথা শুনে গোপীরা বলেছিল—’উদ্ধব! তুমি কৃষ্ণসখা, জ্ঞানী। তুমি এসব কি কথা বলছ! আমরা কি ধ্যানী, না জ্ঞানী, না ঋষি-মুনির মতো জপ-তপ করে তাঁকে পেয়েছি! আমরা যাঁকে সাক্ষাৎ সাজিয়েছি-গুজিয়েছি, খাইয়েছি-পরিয়েছি, ধ্যান করে তাঁকে আবার ঐসব করতে যাব! আমরা তা কি করতে পারি? যে-মন দিয়ে ধ্যান-জপ করব, সে- মন আমাদের থাকলে তো তা দিয়ে ঐসব করব! সে-মন যে অনেক দিন হলো কৃষ্ণপাদপদ্মে অর্পণ করেছি! আমাদের বলতে আমাদের কি আর কিছু আছে যে, তাইতে অহং-বুদ্ধি করে জপ করব?’ উদ্ধব তো শুনে অবাক! তখন সে কৃষ্ণের প্রতি গোপীদের ভালবাসা যে কত গভীর আর সে-ভালবাসা যে কি বস্তু, তা বুঝতে পেরে তাদের গুরু বলে প্রণাম করে চলে এল। তাহলে মথুর, এইবার তুমি বল, ঠিক ঠিক ভক্ত কি তাঁকে হৃদয়ে ধ্যানমন্দিরে দেখতে চায়? তাঁর সেবাতেই তার পরমানন্দ। তার অধিক দেখাশুনা সে চায় না; তাতে তার ভাবের হানি হয়।
মথুরমোহন সব শুনলেন, কিন্তু তাঁর সেই এক গোঁ—বাবা, তোমার সব কথা আমি মানছি, কিন্তু একবার আমার ভাবসমাধি চাই। তোমার কৃপায়। আমার কোন সাধন-ভজন নেই। আমার শুধু তুমি আছ।
নাছোড়বান্দা মথুরমোহনকে শ্রীরামকৃষ্ণ শেষে বললেন, তা কি জানি বাপু! মাকে বলব, তিনি যা হয় করবেন।
মথুরমোহন মহা খুশি। তুমি আমার রাজা, রাজরাজেশ্বর। আজকে যাত্রা হবে। আমরা দুজনে আসরে বসে শুনব।
কি পালা দিলে?
বিদ্যাসুন্দর।
বাঃ, বেশ দিয়েছ। অনেক গান আছে গো। দেশে মানিকরাজার আমবাগানে পাঠশাল থেকে পালিয়ে এসে কত যাত্রা করেছি! কার ভাল লাগে বল তো মানসাঙ্ক, শুভঙ্করী, লিয্যে, লিয্যে, কুড়োবা লিয্যে, দুই দু-গুণে চার, তিন দু- গুণে ছয়। ওসব তোমাদের! আমি এক গণ্ডমূর্খ!
ভাগ্যিস মূর্খ হতে পেরেছিলে! পণ্ডিত হয়ে গেলে কী সর্বনাশটাই না হতো! কোথায় ঘটির জল আর কোথায় গঙ্গার জল! কোথায় মাথায় ছেটানো, আর কোথায় অবগাহন!
না গো! কত ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে বাবার মতো সংসারী হয়ে আমার কামারপুকুরে ঘুরে বেড়াব। চণ্ডীমণ্ডপে বসে পাঠ শুনব। চিনু শাঁখারী, গয়াবিষ্ণু, আরো যত সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হাসিঠাট্টা, মস্করা করব। বহুরূপী সাজব। যাত্রাপালায় শিব হব।
সে তো হয়েছিলে, তারপর তো দেখলে কি হলো? আসল শিব কেমন করে নকল শিব হবে!
তাই তো বলছি গো মথুর, মা আমায় কি করে দিলেন!
যাক, আর দুঃখ করে কি হবে, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কূপ না হয়ে সমুদ্র হয়ে গেছ। এখন লহরীর আনন্দ!
শ্রীরামকৃষ্ণ কেমন একটা দুঃখ দুঃখ ভাব করে বসে রইলেন আরো কিছুক্ষণ। ‘মা, আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলি মা!’ হঠাৎ ভাব এসে গেল, বিভোর হয়ে গাইতে লাগলেন-
আর ভুলালে ভুলব না গো!
আমি অভয় পদ সার করেছি,
ভয়ে হেলব দুলব না গো।।
বিষয়ে আসক্ত হয়ে,
বিষের কূপে উলব না গো।
সুখ দুঃখ ভেবে সমান
মনের আগুন তুলব না গো।
ধনলোভে মত্ত হয়ে
দ্বারে দ্বারে বলব না গো।
আশাবায়ুগ্রস্ত হয়ে
মনের কথা খুলব না গো।
মায়াপাশে বদ্ধ হয়ে
প্রেমের গাছে ঝুলব না গো।
রামপ্রসাদ বলে দুধ খেয়েছি,
ঘোলে মিশে ঘুলব না গো।।
খুব ধুম লেগেছে আজ দক্ষিণেশ্বরে। ফলহারিণী কালিকা-পূজা। আলোতে, মালাতে, ভক্তসমাগমে, ঘণ্টাধ্বনিতে, সানাইয়ের সুরে জমজমাট দেবালয়। সাজপোশাকের বাস্কপ্যাঁটরা নিয়ে যাত্রার দল এসেছে। আলাদা ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে কেউ শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে হুঁকো টানছে, কেউ ঘুরে ঘুরে হাত নেড়ে নেড়ে পাঠ মুখস্থ করছে। এঁদের জন্য আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। মন্দিরের রান্না চলবে না। দলের নানাজনের নানান বায়না। দলের সঙ্গেই পাচক আর সহযোগীদের আগমন। কাটা, ধোয়া, মাজা, ঘষা, ওদিকে এক মহা কর্মযজ্ঞ। ওদেরই মধ্যে দু-একজন ভাবুক প্রকৃতির পঞ্চবটীতে, গঙ্গার ধারের পোস্তায় আপন মনে ঘুরছে।
শ্রীরামকৃষ্ণেরও খুব আনন্দ! যেখানে ভগবান সেখানে ভক্ত, যেখানে ভক্ত সেখানেই ভগবান। মথুরমোহনের হাত খুলেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঠাকুরকে চিনেছেন। “তস্মিন্ তুষ্টে জগৎ তুষ্টম্।” দক্ষিণেশ্বরে তাই ইদানীং আনন্দের হাটবাজার। আনন্দময় ঠাকুরকে ঘিরে যত আনন্দ! ভবিষ্যৎদ্রষ্টা শ্রীরামকৃষ্ণ ও জানেন, যতদিন মথুর ততদিন একরকম, তারপরেই সব অন্যরকম হয়ে যাবে। তা চিরকাল কি একরকম থাকে নাকি! যখন যেমন তখন তেমন!
সন্ধ্যার আরতির পরই শুরু হয়ে গেল কনসার্ট। ভ্যাঁপপোরো, ভ্যাঁপপোরো, ঝ্যাহ। কর্নেট, ফুলুট, ঝাঁঝ সব মিলিয়ে সেই চিত্তনর্তনকারী সুর। বাল্যে যেমন হতো, এখনো তেমন হচ্ছে—চল মথুর চল, কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। পরে গেলে আমরা আর জায়গা পাব না।
মথুরমোহন অভিভূত। কী অদ্ভুত বালকস্বভাব! এ যেন সেই ষোড়শবর্ষীয় শুকদেব। জ্ঞানের প্রতিমূর্তি কিন্তু বালক। সব সমস্যা, সব দর্শন মথুরকে বলা চাই, পরামর্শ চাই, অথচ নিজে সব জানেন। মথুর ভাবেন—এমন বন্ধু, এমন অভিভাবক, এমন কল্যাণকামী মঙ্গলময় তিনি আর কোথায় পাবেন!
মথুরমোহন হাসতে হাসতে বললেন, আমরা যাওয়ার আগে একবার আরম্ভ করে দেখুক না, আবার গোড়া থেকে আরম্ভ করাব। আসরে যাবে, তোমাকে একটু সাজাব না! ভাল করে ধুতিটাও পরতে শিখলে না! কোঁচা-কাছার ছিরি দেখ! এস দেখি।
এত বড় একটা চোদ্দ হাতি ফরাসডাঙার ধুতি দিয়েছ, এ কি সহজে বাগে আনা যায়! আট দাও, দশ দাও, দেখিয়ে দিচ্ছি বাহার!
থাক, সেও আমি দেখেছি। এখন একটু স্থির হয়ে দাঁড়াও, কাছার পুঁটলিটা ঠিক করে দিই।
দেব অঙ্গের স্পর্শে মথুরমোহনের শিহরণ হচ্ছে। মনের তামস-পরত খুলে যাচ্ছে। কলকাত্তাইয়া কায়দায় কাছা-কোঁচা রপ্ত হলো।
মথুরমোহন বললেন, নাও, ঠিক যেন শ্রীগৌরাঙ্গ! পালাচ্ছ কোথায়! এখনো বাকি আছে। আসগর আলির উমদা বেলি আতর কানের দুপাশে একটু লাগাও। যাত্রা দেখতে যাচ্ছি, ‘বিদ্যাসুন্দর পালা’, আতর ছাড়া হয়!
দুজনে এসে আসরে বসলেন। মখমল-মোড়া তাকিয়া। পাশে ফরসি। গোলাপজলের ঝারি। তলায় বিছানো দামী কার্পেট। অধিকারী এসে সসম্ভ্রমে নমস্কার করলেন। দুজনকে দুটো গোড়ের মালা দিলেন। দুই জমিদার যেন পাশাপাশি! ঠাকুরের সে-ভাব দেখে কে! কনসার্টের জমজমা জোরে শুরু হলো। দুই রাজা পাশাপাশি, একজন জানবাজারের জান, আরেকজন!
কানু পরশমণি আমার।
কর্ণের ভূষণ আমার সে নাম শ্রবণ।
নয়নের ভূষণ আমার সে রূপ দরশন।।
বদনের ভূষণ আমার তার গুণ গান
হস্তের ভূষণ আমার সে পদ সেবন।
ভূষণ কি আর বাকি আছে!
আমি শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রহার পরিয়াছি গলে।।
মথুরমোহন তাঁর বাবার সামনে দশ দশ টাকার নোটের থাক পর পর সাজালেন। একটু পরেই পালা শুরু হলে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে আত্মহারা হয়ে গায়ক আর অভিনেতাদের দিকে পুরস্কার ছুঁড়তে থাকবেন। প্রথমে উত্তরীয়, তারপর জামাটা খুলে ছুঁড়ে দেবেন, অবশেষে পরিধানের বস্ত্রও খসে পড়বে, এবং সমাধিস্থ। মথুরমোহনের এই অভিজ্ঞতা পূর্বে একাধিকবার হয়েছে। এত দামী শালটা এইভাবেই গেছে। সেই কারণে মথুরমোহন আজকাল প্রচুর টাকা নিয়ে বসেন বাবার পাশে। কিছু সাজিয়ে রাখেন হাতের কাছে—দশ দশের ভাগা, আর বেশ কিছু নিজের ঝুলিতে মজুত। যাঁর কাছে ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’, তিনি অল্পে সন্তুষ্ট হবেন কি করে! মুঠো মুঠো চাই। সামান্য হলে বলবেন : মথুর, ছি ছি, তোমার নজর এত ছোট! বদনাম আছে, মথুরবাবুর একটু হাতভারি স্বভাব। সেই মথুরবাবু বাবার বেলায় আকাশ-উদার। ঠাকুর বিভোর হয়ে শ্রেষ্ঠ নট-নটীর দিকে টাকা ঠেলে দিয়ে তৃপ্ত হচ্ছেন। মুখে আনন্দের ভাব। মথুরের প্রাণ ভরে যায়। আমি আর কি চাই—”ভূষণ কি আর বাকি আছে!/আমি শ্ৰীকৃষ্ণ চন্দ্রহার পরিয়াছি গলে।”
পালা খুব জমে উঠেছে, বিদ্যা গান গাইছে ঘুরে ঘুরে। শ্রীরামকৃষ্ণ এতটাই তন্ময় যে, মনে হচ্ছে মানুষ নয় পাথরের মূর্তি। মথুরমোহন পাশে বসে পাখার বাতাস করছেন। গান শেষ হতেই ঠাকুর দশ টাকার একটি থাক তার দিকে ঠেলে দিলেন। দর্শকরা হর্ষ প্রকাশ করলেন।
শেষ রাতে শেষ হলো পালা। মন্দির-চূড়ায় ডাকছে শেষ প্রহরের প্যাঁচা। মথুরমোহন দক্ষিণেশ্বরেই আছেন, ঠাকুর কোন্ লোকে চলে গেছেন, তিনিই জানেন। এক পাশে হৃদয় আরেক পাশে মথুরমোহন, মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণ- চলেছেন কুঠিবাড়ির দিকে। শূন্য আসরে বহুমূল্য কার্পেটের ওপর রুপো- বাঁধানো ফরসির নলটা সাপের মতো শুয়ে আছে।
ভোরের বিছানায় পাশ ফিরতে ফিরতে মথুরমোহন প্রার্থনা করছেন : বারেকের জন্য ভাবসমাধি দাও ঠাকুর। তুমি সব পার। আবার আমিও তোমার জন্য সব পারি। মনে আছে, কাশীতে গিয়ে তুমি আমাকে বললে, মথুর! ‘কল্পতরু’ হয়ে দান কর। যে যা চায় তাকে তাই দান কর।
শেষ দৃশ্যটা মনে পড়তেই মথুরমোহনের চোখে জল এল। সারাদিন ধরে দানধ্যান হলো। সবশেষে মথুরমোহন অনুরোধ করলেন, বাবা! এইবার তুমি কিছু চাও।
অনেকক্ষণ ভাবলেন, শেষে বললেন, তাহলে তুমি আমাকে একটা কমণ্ডলু দাও।
যেমন মা, তাঁর তেমন ছেলে! তাঁকে বললাম, সেবা করতে চাই, বলুন কি লাগবে আপনার! বললেন, সবই তো আছে বাবা, কোনকিছুর অভাব তো তুমি রাখনি!
তাহলেও একটা কিছু!
বেশ, তাহলে তুমি বাবা আমাকে এক পয়সার দোক্তাপাতা আনিয়ে দাও।
দেবতার ঘরেই দেবতা জন্মায়!
মথুরমোহন জানবাজারে ফিরে গেলেন। যথারীতি বিষয়ের ভূত এসে ঘাড়ে চাপল আবার। দিন কয়েক গেল। হঠাৎ এক সকালে মনে হলো—কার বিষয়? কিসের বিষয়? অনেক হয়েছে! মাথা ফাটাফাটি, মামলা-মকদ্দমা, স্তাবক- চাটুকার, খয়ের খাঁ! উঠে পড়লেন সেরেস্তা ছেড়ে। সোজা অন্দরমহলে। সবাই ভাবলে, বাবুর শরীর খারাপ হয়েছে।
মথুরমোহন চুপ করে বসে আছেন নির্জনে। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মূর্তি চোখের সামনে ভাসছে। ভাবে কথা বলছেন মায়ের সঙ্গে, আর অনবরত জল ঝরছে দুচোখ বেয়ে। চোখ- দুটো জবা ফুলের মতো লাল। বুক সবসময় থরথর করে কাঁপছে। নায়েব জানাতে এসেছিলেন—মামলার দিন পড়েছে, নবদ্বীপে যেতে হবে। কাকে বলছেন, কে শুনছেন! থেকে থেকে বলছেন—মন-পাখি তুই কৃষ্ণকথা বল। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। তিনদিন চলে গেল, অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। কেউ কেউ বললে, হাওয়া লেগেছে।
স্ত্রী জগদম্বা দক্ষিণেশ্বরে খবর পাঠালেন—ঠাকুর, একবার আসুন।
মজার ঠাকুর রসিক ঠাকুর মথুরমোহনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ‘কি গো সেজকত্তা!’ ঠাকুর হাসছেন মুচকি মুচকি। মথুরমোহন সোজা ঠাকুরের পায়ের ওপর। পা-দুটো জড়িয়ে ধরে বলছেন, বাবা ঘাট হয়েছে! আজ তিনদিন ধরে এই অবস্থা চলেছে, বিষয়কর্মের দিকে চেষ্টা করলেও মন যাচ্ছে না কিছুতেই। সবদিকেই সব গোলমাল হয়ে গেল, ক্ষতিও হলো অনেক। তোমার ভাব তুমি ফিরিয়ে নাও। আমার চাই না।
ঠাকুর বললেন, সেকি রে! তুই যে ভাবসমাধি চেয়েছিলিস!
বলেছিলাম, আনন্দও আছে; কিন্তু হলে কি হয়, এদিকে যে সব যায়! বাবা, ও তোমার ভাব তোমাকেই সাজে। আমাদের ওসবে কাজ নেই! ফিরিয়ে নাও।
ঠাকুর হাহা করে হাসতে হাসতে বললেন, তোকে তো একথা আগেই বলেছি!
হ্যাঁ বাবা বলেছিলে, কিন্তু তখন কি অত-শত জানি যে, ভূতের মতো ঘাড়ে এসে চাপবে আর তার গোঁয়ে আমার চব্বিশ ঘণ্টা ফিরতে হবে? ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারব না!
শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরমোহনের বুকে ধীরে ধীরে হাত বোলাচ্ছেন আর বলছেন, ফিরে আয়, ফিরে আয়, ওরে ও বড় সর্বনাশা পথ। যে করে আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ। সংসার এক নকশ খেলা, তোরা একটু একটু কাটা থাকবি বেশ, আমার মতো সবটা কাটলে জ্বলে যাবি। একটু, একটু!