শ্রীরামকৃষ্ণের ‘অস্ত্রভাণ্ডার’
ধারালো একটি ছুরি, তার নাম ‘বিচার’।
শক্তিশালী একটি চিমটে, তার নাম ‘বোধ’।
ভয়ঙ্কর একটি অগ্নি আবর্ত, যাতে কাঁচা পুড়ে পাকা হয়।
এইসব অস্ত্র প্রযুক্ত হবে নিজের প্রতি। তৈরি হও। প্রথমে ‘আমি’। আমি যাব ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। আমি শুনব তাঁর অমৃতবাণী। আমি উপদেশ ধারণ করব, পালন করব। আমার শ্বাসে-প্রশ্বাসে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রবাহিত হবেন। আমার ‘আমি’র দখলদারি নেবেন তিনি। সেই ‘আমি’টা কোন্ আমি! সদাচঞ্চল, পরশ্রীকাতর, কামনা-বাসনায় ভরপুর, অবিশ্বাসী, সঙ্কীর্ণ এক ‘আমি’। সে তো মাছির মতো। এই মধুতে, তো ঐ বিষ্ঠায়। তিনি তো আমাকে চান, আমি কি তাঁকে চাই! আমি কি এই বিচারে বসি না—শ্রীরামকৃষ্ণ আমাকে কি দিতে পারেন?
এ-প্রশ্ন কোন্ ‘আমি’র? কাঁচা ‘আমি’র—যে-আমিটা একটা দেহ বয়ে নিয়ে বেড়ায়। থমথমে গম্ভীর মুখে আস্ফালন করতে থাকে, বলে—’আমার বাড়ি’, ‘আমার টাকা’, ‘আমার বিদ্যা’, ‘আমার ঐশ্বর্য’!
ঠাকুর বললেন, বুঝলে হে! এটি হলো, ‘বজ্জাত আমি’। ‘বজ্জাত আমি কে? যে-’আমি’ বলে, জানে না আমি কে! আমার এত টাকা, আমার চেয়ে বড়লোক আছে? যদি চোরে দশটাকা চুরি করে থাকে, প্রথমে টাকা কেড়ে নেয়, তারপর চোরকে খুব মারে। তাতেও ছাড়ে না, পাহারাওয়ালা ডেকে পুলিসে দেয় ও ম্যাদ খাটায়। ‘বজ্জাত আমি’ বলে, আমার দশ টাকা নিয়েছে! এত বড় আস্পর্ধা! তুমি সেই গল্পটা জান?
কোন্টা ঠাকুর?
একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা থাকত। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গেছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল আর বলল, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! টাকার এত অহঙ্কার!
আজ্ঞে হ্যাঁ। ব্যাঙ বলেছিল, উঁচকপালী, চিরুনদাঁতী, আমায় যে বড় ডিঙোলি!
‘অহঙ্কার’ শব্দটাই তো একটা প্রশ্ন। ‘অহং’ কার? মান করে বসে আছেন শ্রীরাধিকা। বৃন্দে বললেন, এ ‘অহং’ কার? এ তাঁরই ‘অহং’। কৃষ্ণের গরবে গরবিনী।
মানুষের ‘আমি’, ‘আমি’ শুনে মহাকাল মুচকি হাসেন। নির্বোধের টঙ্কার। ক্যাক করে টিপে ধরব গলা, তিন খাবিতে ‘আমি’র লম্ফঝম্প শেষ! মৃত্যুকে স্মরণে রাখ, দেখবে ‘বজ্জাত আমি’টা নেতিয়ে পড়বে।
সেদিন কেশব সেনের সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা হচ্ছিল। কেশব বললে, আরো বলুন। আমি বললুম, আর বললে দলটল থাকে না। তখন কেশব বললে, তবে আর থাক মশাই। তবু কেশবকে বললুম। তুমিও শোন, যদি ধরতে পার তাহলে তোমার বেঁচে থাকার রঙ পালটাবে। ‘ব্যাঙ-মানুষ’ থেকে ‘বোধ-মানুষ’-এ রূপান্তরিত হবে। ‘আমি’র ক্যানেস্তারা বাজিয়ে ঘুরছ, তখন একতারাতে তুঁহু তুঁহু বাজবে। কেশবকে বললুম : “আমি, আমার—এটি অজ্ঞান। আমি কর্তা আর আমার এইসব স্ত্রী, পুত্র, বিষয়, মান, সম্ভ্রম-এ-ভাব অজ্ঞান না হলে হয় না।” তখন কেশব বললে : “মহাশয়, ‘আমি’ ত্যাগ করলে যে আর কিছুই থাকে না!”
কেশব ঠিকই বলেছিল। বিচার করতে করতে আমি-টামি আর কিছুই থাকে না। পেঁয়াজের প্রথমে লাল খোসা তুমি ছাড়ালে, তারপর সাদা পুরু খোঁসা। এইরূপ বারবার ছাড়াতে ছাড়াতে ভেতরে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।
তা কেশবকে একটা পথ বাতলালুম। বললুম, কেশব! তোমাকে সব ‘আমি’ ত্যাগ করতে বলছি না, তুমি ‘কাঁচা আমি’ ত্যাগ কর। ‘আমি কর্তা’, ‘আমার স্ত্রী-পুত্র’, ‘আমি গুরু—এসব অভিমান ‘কাঁচা আমি’। এইটি ত্যাগ করে ‘পাকা আমি’ হয়ে থাক—’আমি’ তাঁর দাস, আমি তাঁর ভক্ত, আমি অকর্তা, তিনি কর্তা। তবে বাপু তোমাকে সত্য কথাটা বলি, ‘আমি’ মলে ঘুচিবে জঞ্জাল। হাজার বিচার কর, ‘আমি’ যায় না। তোমার আমার পক্ষে ‘ভক্ত আমি’এ- অভিমান ভাল।
‘আমি’কে তুমি তিনভাবে রাখতে পার—’দাস আমি’, ‘ভক্তের আমি’, ‘বালকের আমি’। মনে মনে বলতে থাক, ‘হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা, আর এসব তোমার জিনিস—বাড়ি, পরিবার, ছেলেপুলে, লোকজন, বন্ধুবান্ধব—এসব তোমার জিনিস।
শোন, বিজয় গোস্বামীকে আমি যা বলেছিলুম তোমাদেরও তাই বলি, ‘দুই একটি লোকের সমাধি হয়ে ‘অহং’ যায় বটে, কিন্তু প্রায় যায় না। হাজার বিচার কর, ‘অহং’ ফিরে ঘুরে এসে উপস্থিত। আজ অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, কাল আবার সকালে দেখ ফেঁকড়ি বেরিয়েছে। একান্ত যদি ‘আমি’ যাবে না, থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে। ‘হে ঈশ্বর! তুমি প্রভু, আমি দাস’ এইভাবে থাক। ‘আমি দাস’, ‘আমি ভক্ত’–এরূপ ‘আমি’তে দোষ নাই; মিষ্ট খেলে অম্বল হয়, কিন্তু মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয়।
শুনছ তুমি?
শুনছি ঠাকুর। ‘আমি’ একটা লেংটি ইঁদুর। চিত্তের কুটিরে অহঙ্কারের ছোট ছোট ধারালো দাঁতে বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান, শাস্ত্র সব কুড়কুড় করে কাটছে।
তাতে কি হয়েছে! এই অহঙ্কারটুকু রাখলে কি হয়! সতের অহঙ্কার। ‘আমি তাঁর সন্তান।’ তোমাকে তিনি ধরে রাখবেন, ধরে থাকবেন। তাই বলি, কলিযুগের পক্ষে ভক্তিযোগ। ভক্তিপথ সহজ পথ। আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে তাঁর নামগুণগান কর, প্রার্থনা কর। ভগবানকে লাভ করবে, কোন সন্দেহ নাই। যেমন জলরাশির ওপর বাঁশ না রেখে একটি রেখা কাটা হয়েছে। যেন দুই ভাগ জল। আর রেখা অনেকক্ষণ থাকে না। ‘দাস আমি’, কি ‘ভক্তের আমি’, কি ‘বালকের আমি’–এরা যেন ‘আমি’র রেখামাত্র।
‘আমি’টাকে ঈশ্বরের কৃপায় ফুরফুরে করা যায়। নাসিকার বাতাসের মতো থাকবে, যেন বোঝা না যায়। সব ‘আমি’র সঙ্গে মিলেমিশে যতদিন পৃথিবীতে আছি থাকুক না। রাম নামে যেমন ভূত পালায়, ভগবানের নামে সেইরকম বিষয় পালায়। তাঁর দেওয়া বোধের চিমটে দিয়ে মন থেকে বিষয়ের গিরগিটি, টিকটিকি, আরশোলা সব তুলে ফেলে দাও।
এখন আমার কথা আপনাদের বলি। আসুন, রামকৃষ্ণ-হোমাগ্নিতে ‘কাঁচা আমি’কে পুড়িয়ে পাকা করি। সংসারের আগুন ঝলসায়, রামকৃষ্ণ-অগ্নি সোনা করে দেয়।
দূরত্ব যদি মাপতেই হয়, শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে দূরত্ব কতটা—বোধের ফিতে ফেলে মাপি। দুহাতে ধরতে গেলে হাতদুটো খালি করতে হবে। দুহাতের তালু থেকে সংসারের লাড্ডুদুটো ফেলতে হবে। সে দুটো হলো—কাম আর কাঞ্চন। সে-রূপ দেখতে হলে খুলতে হবে চশমা। সেই কণ্ঠের অমৃতবাণী শুনতে হলে ভিতরের কোলাহল শান্ত করতে হবে। সেখানে বসে আছে শেয়ার মার্কেট। অজস্র পাটোয়ারের পাটোয়ারি, কলকোলাহল।
ঠাকুর বলেছেন, আনন্দ তো বাইরে নেই। আছে তোমার অন্তরে। তোমার অন্তরের চেয়ে অন্তরঙ্গ আর কে আছে। আমার যখন পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল তখন ভাবলুম, হাত ভেঙেছে সব অহঙ্কার নির্মূল করবার জন্য। এখন আর ভেতরে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। খুঁজতে গিয়ে দেখি, তিনি রয়েছেন। অহঙ্কার একেবারে না গেলে তাঁকে পাওয়ার জো নাই।
অন্তরে আমার ঠাকুরকে বসাতে হলে আর কিছু নয়, সেই অঞ্চলটিকে পরিষ্কার করতে হবে। কার সঙ্গে চালাকি? ঠাকুরের সঙ্গে? তিনি যে চালাকের চালাক। ভেতরটা দেখেন। পবিত্রতার গন্ধ পেলে, ভক্তির ঘণ্টাধ্বনি শুনলে তবেই প্রবেশ করবেন, নইলে যেমন বলেছিলেন, ভক্ত এখানে যারা আসে— দুই থাক। এক থাক বলছে, ‘আমায় উদ্ধার কর! হে ঈশ্বর!’ আরেক থাক তারা অন্তরঙ্গ, তারা ওকথা বলে না—তাদের দুটি জিনিস জানলেই হলো। প্রথম—আমি (শ্রীরামকৃষ্ণ) কে? তারপর, তারা কে—আমার সঙ্গে সম্বন্ধ কি?