পরিশিষ্ট

শ্রীরামকৃষ্ণর আকুতি : বিদ্যাসাগরের উপেক্ষা

শ্রীরামকৃষ্ণর আকুতি : বিদ্যাসাগরের উপেক্ষা

আশীষ লাহিড়ী

দামোদর সাঁতরে মার কাছে যাওয়া, কিংবা ছোটবেলায় রাস্তায় গ্যাসবাতির আলোয় লেখাপড়া করার (যদিও কলকাতার রাস্তায় যখন গ্যাসবাতি চালু হয়, তখন তাঁর বয়স সাঁইত্রিশ) মতন প্রচুর মিথ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে প্রচলিত। তার মধ্যে নিরন্তর প্রচারের গুণে যে-মিথটি হিন্দু বাঙালির কাছে বড়ই প্রিয়, এবং কার্যত অবিসংবাদিত, সেটি হল: যতই তেজস্বী পণ্ডিত হোন বিদ্যাসাগর, ‘ঠাকুর’ তাঁকে যুক্তিতর্কে ধরাশায়ী করেছিলেন এবং ‘পরাজিত’ বিদ্যাসাগর ‘ঠাকুর’-এর প্রতি ভক্তিতে গদ্‌গদ হয়েছিলেন! আজ এই জন্মদ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি যে-সমস্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে অনেক সময়েই দেখানো হচ্ছে, বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণর প্রতি ভক্তিপরায়ণ। বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়ি কিংবা কার্মাটাঁড়-এর বাসভবন, সর্বত্রই শ্রীরামকৃষ্ণর মহিমা বিশেষরূপে প্রকট। খুব সচেতনভাবে এই মিথটিকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে; কেননা বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদ আর শ্রীরামকৃষ্ণর ভক্তিবাদ একই মোহনায় এসে মিশেছিল, এই গল্পটি চালু করে দিতে পারলে আমাদের দু’ নৌকায় পা-দেওয়া নীতিবোধ পরম স্বস্তি লাভ করবে।

ভদ্রলোক বাঙালির আত্মপ্রবঞ্চনার সর্বোত্তম নিদর্শন এটি। বিদ্যাসাগরের জীবন কিংবা চিন্তাচেতনার ওপর শ্রীরামকৃষ্ণর প্রভাব কতটুকু? আদৌ ছিল কি? এসব প্রশ্ন তোলা যেন বারণ। তাই শুরুতেই খুব দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা দরকার যে, মিথটি— অধিকাংশ মিথের মতন— সর্বৈব মিথ্যা। বরং ঘটনা লোকবিশ্বাসের ঠিক বিপরীত। বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণই বিদ্যাসাগরকে দলে টানতে না পেরে নিতান্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর সশ্রদ্ধভাবে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। বেশি গবেষণা করতে হবে না, উদ্বোধন-শংসায়িত দুই খণ্ডে প্রকাশিত কথামৃত তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।

কথামৃত -য় বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ সরাসরি এসেছে অন্তত বাইশ বার, অনুষঙ্গাত্মক বিচারে আরও অনেক বার। তার মধ্যে ১৮ এপ্রিল ১৮৮৬-র উল্লেখটি ‘বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে’ নরেন্দ্রনাথের চাকরি সংক্রান্ত, সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে অনুপস্থিত (এ নিয়ে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি); আর ৮ মে ১৮৮৭-র উল্লেখের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ প্রয়াত। অতএব এখানে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে কথামৃত-য় শ্রীরামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগর সংক্রান্ত বাকি উল্লেখগুলির মধ্যে। বলা বাহুল্য, এর সবটাই যেহেতু মহেন্দ্রনাথের বয়ান, সেহেতু স্বয়ং মহেন্দ্রনাথও আমাদের আলোচনায় উঠে আসবেন মাঝে মাঝে।

প্রথম ও শেষ দেখা

কামারপুকুর গ্রাম বীরসিংহ থেকে খুব দূরে নয়। রামকৃষ্ণ ‘বাল্যকাল হইতে বিদ্যাসাগরের দয়ার কথা শুনিয়া আসিতেছেন। দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে থাকিতে থাকিতে তাঁহার পাণ্ডিত্য ও দয়ার কথা প্রায় শুনিয়া থাকেন’। ভক্ত এবং কথামৃত-সংকলক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান স্কুলের শ্যামপুকুর শাখার প্রধান শিক্ষক, তাঁর কাছে রামকৃষ্ণর অনুনয়: ‘আমাকে বিদ্যাসাগরের কাছে কি লইয়া যাইবে? আমার দেখিবার বড় সাধ হয়’। মহেন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে সেই কথা বলাতে বিদ্যাসাগর সানন্দে ‘তাঁহাকে একদিন শনিবারে ৪টার সময় সঙ্গে করিয়া আনিতে বলিলেন’। সেইমতো শ্রীরামকৃষ্ণ ৫ আগস্ট ১৮৮২ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে গিয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ ‘কিরকম ‘‘পরমহংস’’? তিনি কি গেরুয়া কাপড় পরে থাকেন?’ মহেন্দ্রনাথ জানান, ‘আজ্ঞা না, তিনি এক অদ্ভুত পুরুষ, লালপেড়ে কাপড় পরেন, জামা পরেন, বার্নিশ করা চটি জুতা পরেন’। ১৮৮২ সালেও রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের কোনও কিছু না-জানাটা একটু অস্বাভাবিক এবং খুবই তাৎপর্যময়; বিদ্যাসাগরকে বুঝতে সাহায্য করে এ ঘটনা। কেননা, এর আগেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ বিদ্যাসাগরের— এবং সমাজে— সুপরিচিত অনেক ব্যক্তির সঙ্গেই শ্রীরামকৃষ্ণর সাক্ষাৎ হয়েছে, দ্বিতীয়োক্ত ও তৃতীয়োক্ত ব্যক্তি শ্রীরামকৃষ্ণর মায়ায় আত্মসমর্পণও করেছেন। সুতরাং বিদ্যাসাগরের ‘কিরকম পরমহংস’ এবং তিনি গেরুয়াধারী কি না’, প্রশ্নটির মধ্যে কিঞ্চিৎ শ্লেষ নিহিত থাকা অসম্ভব নয়। গেরুয়া জগৎটিকে তিনি বরাবরই এড়িয়ে চলেছেন। হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণ গেরুয়াধারী নন বলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে অসম্মত হননি বিদ্যাসাগর।

অপর দিকে, রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের কথা ভাল করে জানতেন। শুধু তাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তির জন্য নয়, মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর সচেতন প্রয়াসেও। বিদ্যাসাগরের ঘরে টেবিলের ওপর ছড়ানো চিঠিপত্র দেখে মহেন্দ্রনাথের মনে যে-ভাব জেগে উঠেছিল তা যেমন শ্রদ্ধামিশ্রিত, তেমনি বাস্তবানুগ: ‘কোন বিধবা হয়তো লিখিয়াছে, আমার অপোগণ্ড শিশু অনাথ, দেখিবার কেহ নাই, আপনাকে দেখিতে হইবে। কেহ লিখিয়াছেন, আপনি খরমাতার [য] চলিয়া গিয়াছিলেন, তাই আমরা মাসহারা ঠিক সময়ে পাই নাই, বড় কষ্ট হইয়াছে। কোন গরিব লিখিয়াছে, আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হইয়াছি, কিন্তু বই কিনিবার ক্ষমতা নাই’ ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। অনুমান করা যেতে পারে, বিদ্যাসাগরের এসব জনহিতকর প্রয়াসের কথা মহেন্দ্রনাথ তাঁর গুরুকে জানিয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগরের দর্শনভাবনার মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধেও মহেন্দ্রনাথের ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি আগেই এ বিষয়ে অবহিত করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। নইলে কথামৃত-য় রামকৃষ্ণর বিদ্যাসাগর-সন্দর্শনে যাওয়ার বিবরণের সমান্তরালে ওইসব প্রসঙ্গ নিজের জবানিতে লিখবেন কেন? ‘ধর্ম-বিষয়ে বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না’। হিন্দুদর্শন সম্বন্ধে তিনি বলতেন, ‘আমার তো বোধ হয়, ওরা যা বুঝতে গেছে, বুঝাতে পারে নাই’। অপর দিকে, বিদ্যাসাগর ‘হিন্দুদের ন্যায় শ্রাদ্ধাদি ধর্মকর্ম সমস্ত করিতেন, গলায় উপবীত ধারণ করিতেন, বাঙলায় যে-সকল পত্র লিখিতেন, তাহাতে “শ্রীশ্রীহরিশরণম” ভগবানের এই বন্দনা আগে করিতেন’। এ বর্ণনা একেবারেই বাস্তবসম্মত।

এসব জেনেই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর সঙ্গে রামকৃষ্ণ ‘কলিকাতার রাজপথ দিয়া ঠিকা গাড়ি করিয়া বাদুড়বাগানের দিকে আসিতেছেন।’ শক্তিশালী প্রতিপক্ষর সঙ্গে সাক্ষাতের উত্তেজনায় একটু রণং দেহি ভাব কি ছিল তাঁর মনে? বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল রামকৃষ্ণর গাড়ি। ‘ঠাকুর গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন।… উঠানে ফুলগাছ, তাহার মধ্য দিয়া আসিতে আসিতে ঠাকুর বালকের ন্যায় বোতামে হাত দিয়া মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “জামার বোতাম খোলা রয়েছে— এতে কিছু দোষ হবে না?” গায়ে একটি লংক্লথের জামা, পরনে লালপেড়ে কাপড়, তাহার আঁচলটি কাঁধে ফেলা। পায়ে বার্নিশ করা চটি জুতা’।

দোতলার ঘরে ‘প্রবেশ করিলে পর বিদ্যাসাগর দণ্ডায়মান হইয়া অভ্যর্থনা করিলেন।… বিদ্যাসাগরের বয়স আন্দাজ ৬২/৬৩। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অপেক্ষা ১৬/১৭ বৎসর বড় হইবেন। পরনে থান কাপড়, পায়ে চটি জুতা, গায়ে একটি হাত-কাটা ফ্লানেলের জামা। মাথার চতুষ্পার্শ্ব উড়িষ্যাবাসীদের মতো কামানো। কথা কহিবার সময় দাঁতগুলি খুব উজ্জ্বল দেখিতে পাওয়া যায়,— দাঁতগুলি সমস্ত বাঁধানো। মাথাটি খুব বড়। উন্নত ললাট ও একটু খর্বাকৃতি। ব্রাহ্মণ— তাই গলায় উপবীত’।

রায়দান-মনস্ক রামকৃষ্ণ

ভাবাবিষ্ট হয়ে বেঞ্চের ওপর বসলেন রামকৃষ্ণ। ‘একটি ১৭/১৮ বৎসরের ছেলে সেই বেঞ্চে বসিয়া আছে— বিদ্যাসাগরের কাছে পড়াশুনার সাহায্য প্রার্থনা করিতে আসিয়াছে। ঠাকুর… একটু সরিয়া বসিলেন ও ভাবে বলিতেছেন, “মা! এ-ছেলের বড় সংসারাসক্তি! তোমার অবিদ্যার সংসার! তোমার অবিদ্যার ছেলে!”’ অন্য একটি ছেলেকে দেখে ‘ঠাকুর বলিলেন, “এ-ছেলেটি বেশ সৎ, আর অন্তঃসার যেমন ফল্গুনদী, উপরে বালি, একটি [একটু] খুঁড়লেই ভিতরে জল বইছে দেখা যায়!”’ রামকৃষ্ণকে প্রথম থেকেই এত বেশি রায়দান-মনস্ক (জাজমেন্টাল) দেখে একটু অস্বস্তি লাগে।

ঠিক এর আগেই শ্রীম বিদ্যাসাগরের সেবামূলক কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি করে লিখেছেন, ‘কোন গরিব লিখিয়াছে, আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হইয়াছি, কিন্তু বই কিনিবার ক্ষমতা নাই’। তার অব্যবহিত পরেই কথামৃত-র বয়ানে একটি অভাবী, সাহায্যপ্রার্থী ছাত্রর তথাকথিত ‘সংসারাসক্তি’ দেখে রামকৃষ্ণর এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করার মধ্যে গুরুর প্রতি কোথাও কি একটু প্রচ্ছন্ন সমালোচনার আভাস দিলেন তিনি?

বিদ্যাসাগর অবশ্য এসব কিছু গ্রাহ্য না করে রামকৃষ্ণকে সাদরে মিষ্টান্নভোজনে আপ্যায়িত করলেন। এরপর সেই বিখ্যাত সংলাপ:

শ্রীরামকৃষ্ণ— আজ সাগরে এসে মিললেম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি। (সকলের হাস্য)

বিদ্যাসাগর (সহাস্যে)— তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান! (হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ— না গো! নোনা জল কেন! তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! (সকলের হাস্য)। তুমি ক্ষীরসমুদ্র। (সকলের হাস্য)

বিদ্যাসাগর— তা বলতে পারেন বটে।

এরপর বিদ্যাসাগর চুপ। খানিকটা পিঠ চাপড়ানোর ঢঙে রামকৃষ্ণ একাই বলে চলেন: ‘তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ, এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলে এতেই ভগবান লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্য, পুণ্যের জন্য, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তুমি তো আছই’। বিদ্যাসাগরের সস্মিত প্রশ্ন, তিনি কী করে ‘সিদ্ধ’ হলেন? ইঙ্গিতটা যেন এই যে, তিনি তো ও-পথের পথিক নন। রামকৃষ্ণর নিজস্ব ঢঙের সহাস্য কিন্তু তাৎপর্যময় উত্তর: ‘আলু পটল সিদ্ধ হলে নরম হয়, তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া। (হাস্য)’। শোনা মাত্র ‘বজ্রের মতো কঠিন এবং কুসুমের মতো কোমল’ বিদ্যাসাগর বুঝিয়ে দেন, এই ‘কমপ্লিমেন্টে’ ভোলবার পাত্র তিনি নন। তিনিও হাসতে হাসতে বলেন, ‘কলাই বাটা সিদ্ধ তো শক্তই হয়’। রামকৃষ্ণ এবার অন্য পথ ধরলেন: ‘তুমি তা নও গো; শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া! না এদিক, না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, তার নজর ভাগাড়ে। যারা শুধু পণ্ডিত, কিন্তু তাদের কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি— শকুনির মতো পচা মড়া খুঁজছে। আসক্তি অবিদ্যার সংসারে। দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য বিদ্যার ঐশ্বর্য’। তিনি কি এই ইঙ্গিত দিলেন যে বিদ্যাসাগর সেরকম ‘অবিদ্যা’র পণ্ডিত নন? বিদ্যাসাগর কিন্তু কামিনী-কাঞ্চনে অনাসক্ত নন; তিনি স্বাবলম্বী সংসারী পুরুষ এবং লোক না ঠকিয়ে অর্জিত প্রভূত অর্থের মালিক, যে-অর্থর বিপুল অংশই জনহিতে এবং সমাজ সংস্কারে ব্যয় হয়।

মহেন্দ্রনাথ জানেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত। ষড়্‌দর্শন পাঠ করিয়া দেখিয়াছেন, বুঝি ঈশ্বরের বিষয় কিছুই জানা যায় না’। তাই ঈশ্বর নিয়ে না ভেবে ‘আমাদের নিজের এরূপ হওয়া উচিত যে, সকলে যদি সেরূপ হয়, পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত যাতে জগতের মঙ্গল হয়’। এ মত রামকৃষ্ণর একেবারে বিপরীত। বিদ্যাসাগর ইচ্ছে করলেই রামকৃষ্ণর সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করতে পারতেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। হয়তো বলেওছিলেন, যার বিবরণ রামকৃষ্ণ-ভক্ত শ্রীম লিপিবদ্ধ করেননি। ব্রায়ান হ্যাচার-এর কথায়, ‘বিদ্যাসাগরকে কখনওই কোনও আলোচনার শেষ কথা বলতে দেওয়া হয়নি’ কথামৃত-য়। ‘তবু, তাঁর মূল অবস্থানটি বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।’

রামকৃষ্ণ বলেই চললেন, ‘ব্রহ্ম যে কি, মুখে বলা যায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে। বেদ পুরাণ, তন্ত্র, ষড়্‌দর্শন— সব এঁটো হয়ে গেছে! মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চারণ হয়েছে— তাই এঁটো হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস উচ্ছিষ্ট হয় নাই, সে জিনিসটি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যে কি, আজ পর্যন্ত কেহ মুখে বলতে পারে নাই’।

অজ্ঞেয়বাদী বিদ্যাসাগরের এ কথাটি ভাল লাগল। ঈশ্বর আর ব্রহ্মকে যদি এক ধরা যায়, তা হলে এ মত তো তাঁরও। মহেন্দ্রনাথকে তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁকে তো জানবার জো নেই!’ কাজেই রামকৃষ্ণর ওই বিশেষ কথাটি শুনে তিনি বলে ওঠেন, ‘বা। এটি তো বেশ কথা! আজ একটি নূতন কথা শিখলাম’। নূতন কথাটি এই যে, শাস্ত্র পড়ে, শাস্ত্রীয় আচার মেনে, কেউ ব্রহ্ম লাভ করতে পারে না। ব্রহ্মকে যদি পরম সত্য বলা চলে, তাহলে শাস্ত্র মারফত সে-সত্যে পৌঁছনো অসম্ভব। তফাত এই, শ্রীরামকৃষ্ণর মতে, তা সত্ত্বেও ব্রহ্মকে পাওয়ার সাধনা চালিয়ে যেতে হবে; বিদ্যাসাগরের মতে সে-চেষ্টা অর্থহীন।

এর পরেও রামকৃষ্ণ নানান তত্ত্ব-প্রসঙ্গর অবতারণা করে চলেন, যার মূল কথাটি হল বাস্তব জগতের সঙ্গে ভাল এবং মন্দ সবরকম সম্পর্ক ত্যাগ না করলে, বাস্তব জগৎকে বদলানোর সমস্ত রকম প্রয়াস থেকে বিরত না হলে, ব্রহ্মজ্ঞান হওয়ার জো নেই: ‘ঋষিদের ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল। বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ঋষিরা কত খাটত’। এ খাটনি কিন্তু সংসারের সমস্তরকম কাজ থেকে সরে থাকার খাটনি। ঋষিরা ‘সকাল বেলা আশ্রম থেকে চলে যেত। একলা সমস্ত দিন ধ্যান চিন্তা করত, রাত্রে আশ্রমে ফিরে এসে কিছু ফলমূল খেত। দেখা, শুনা, ছোঁয়া— এ-সবের বিষয় থেকে মনকে আলাদা রাখত, তবে ব্রহ্মকে বোধে বোধ করত’। খাটনির এই পরিমানক (প্যারামিটার) শুনে বিদ্যাসাগর নীরব হয়ে রইলেন।

অনেকক্ষণ পর বিদ্যাসাগর একটি প্রশ্ন করেন: ‘তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ তাঁর মনের কথাটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঈশ্বরের চোখে সবাই যদি সমান হয়, তা হলে এক এক জন মানুষের শক্তি এক এক রকম কেন? অর্থাৎ ঈশ্বর কি সমদর্শী? রামকৃষ্ণর উত্তর: ‘তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন, পিঁপড়েতে পর্যন্ত। কিন্তু শক্তিবিশেষ। তা না হলে একজন লোকে দশজন লোককে হারিয়ে দেয়, আবার কেউ একজনের কাছ থেকে পালায়, আর তা না হলে তোমাকেই বা সবাই মানে কেন? তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? (হাস্য) তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে— অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে। তুমি এ-কথা মানো কি না?’ রামকৃষ্ণ কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রশ্নটিকেই উত্তর হিসেবে হাজির করলেন, কোনও ব্যাখ্যা দিলেন না। শুনে বিদ্যাসাগর কোনও উত্তর না দিয়ে ‘মৃদু মৃদু’ হাসতে লাগলেন। পরে আমরা দেখব, বিদ্যাসাগরের তোলা এই প্রসঙ্গটিই রামকৃষ্ণকে আলোড়িত করেছিল সবচেয়ে বেশি, অবশ্যই নেতিবাচক অর্থে।

সুমিত সরকারের পথ অনুসরণ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়ে ব্রায়ান হ্যাচার এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি নির্ভুলভাবেই ধরেছেন, এখানে আলোচ্য প্রশ্নটি ‘অধিকারভেদ’-এর, যা হিন্দু বিশ্বাসের একটি প্রধান স্তম্ভ। গীতায় অধিকারভেদের পক্ষে সবিস্তার যুক্তিজাল বিছানো হয়েছে। বিদ্যাসাগর অধিকারভেদ তত্ত্বে অবিশ্বাসী; সারা জীবনে গীতা সম্বন্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। পক্ষান্তরে শ্রীরামকৃষ্ণর মতে, কেউ বিদ্যাসাগর হয়, কেউ রানি ভিক্টোরিয়া হয়, কেউ-বা শ্রীরামকৃষ্ণ, এসবই যে-যার পূর্বনির্দিষ্ট ‘অধিকার’-বলে। শ্রীরামকৃষ্ণর এই বিশ্বাসের মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই; কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরের অবস্থানের মধ্যে অবশ্যই নতুনত্ব আছে। বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাদী দর্শনচর্চা ছাড়াও হ্যাচার এর মূল অনুসন্ধান করেছেন বিদ্যাসাগরের জীবনের মধ্যে: বিদ্যাসাগরের মা, কুলীন ব্রাহ্মণকন্যা ভগবতী দেবী নাকি ছোটবেলায় অস্পৃশ্য জাতির মেয়েদের সঙ্গে খেলা করতেন।১০

সমাজ সংস্কার, মঙ্গল-অমঙ্গল, মানুষের অসাম্য, দুঃখ-যন্ত্রণা এগুলো রামকৃষ্ণর আলোচ্য বিষয়ই নয়। তিনি সগর্বে জানান, ব্রহ্মলাভই তাঁর অ্যাজেন্ডার একমাত্র পদ। দাস্যভাবে, আমি-বোধ-বিবর্জিত হয়ে সাধনা করলে তবে প্রকৃত জ্ঞান হয়। ভাল কাজ, মন্দ কাজ, মানবমঙ্গল, জনসেবা, এসবের কোনও মূল্য নেই, কেননা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ‘আমি’। তাই অধিকারভেদের প্রশ্ন তুলে, বিদ্যাসাগরকে একটু ঠেস দিয়ে রামকৃষ্ণ শুধালেন: ‘আচ্ছা, তোমার কি ভাব?’ ততক্ষণে বিদ্যাসাগর বুঝে গেছেন, তাঁর ও রামকৃষ্ণর জগৎ আলাদা, এ দুই জগতের মধ্যে ভাবের, চিন্তার কোনও আদান-প্রদান সম্ভব নয়, যুক্তিতর্কর তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই বিদ্যাসাগর রঙ্গচ্ছলে, ‘মৃদু মৃদু’ হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, সে-কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব’। যেন শিশু ভোলালেন।

রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরকে ‘সহাস্যে’ বললেন, ‘তাঁকে [ব্রহ্মকে] পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করা যায় না’। পাণ্ডিত্যর ওপর তাঁর খুব রাগ, কেননা পাণ্ডিত্যর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ‘আমিত্ব’-বোধ। এটা বোঝাবার জন্য রামকৃষ্ণ গলা ছেড়ে গান ধরলেন: ‘কে জানে কালী কেমন?/ ষড়দর্শনে না পায় দরশন’, এবং গানের শেষে আবার জোর গলায়, যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে জানান, ‘দেখলে, কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন! আর বলছে, ষড় দর্শনে না পায় দরশন’— পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। আশ্চর্যর ব্যাপার হচ্ছে, পাঁচশো বছরের পুরনো সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ-র এ-যুগের সম্পাদক (১৮৫৮) বিদ্যাসাগর কিন্তু একবারের জন্যও তাঁকে বলছেন না, কী তাঁর নিজের আদর্শ, কী তাঁর মতে মুক্তির পথ; রামকৃষ্ণ নিজেই নিজের ধারণাবশত একতরফা বক্তব্য পেশ করে যাচ্ছেন। তাঁর কাছে জগৎটা দুটো পরিষ্কার ভাগে বিভক্ত: একদল ইহজগতের ‘কাজ’ নিয়ে ব্যস্ত (চুরিজোচ্চুরি, সমাজ সংস্কার, লেখাপড়া শেখানো, দরিদ্রসেবা সবই তাঁর মতে বিষয়কর্ম); অন্যদল ব্রহ্মকে পাওয়ার তাগিদে ইহজগৎকে— কাজকে— ভুলতে রাজি, যেমন তিনি নিজে, যেমন নাকি প্রাচীন কালের ঋষিরা। এই দ্বিতীয় দলকে, নিজেকেও, তিনি অনেক ঊর্ধ্বে স্থাপন করেন; কিন্তু কেন, সেটা বোঝা যায় না। তাঁর কাছে যা আরাধ্য, অন্যের তা আরাধ্য না-ও হতে পারে, এবং অন্যের আরাধ্যটাও খুব মহৎ হতে পারে, এ বোধ তাঁর ছিল না। মুশকিল হচ্ছে, ষড়্‌দর্শনের বাইরে, শাস্ত্র চর্চার বাইরেও যে জ্ঞান চর্চার বিরাট একটা ক্ষেত্র আছে, সে সম্বন্ধে তিনি হয় অচেতন নয় বিরূপ। বিদ্যাসাগর যে ‘তাঁকে’— ব্রহ্মকে— বিচার করতে চাইছেন না, তিনি চাইছেন ইহজগৎকে বুঝে মানুষের দুঃখ দূর করার পথ বার করতে, সেটা রামকৃষ্ণ কিছুতেই বুঝছেন না, অথবা বুঝলেও একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এমনকী ছোট করছেন। পক্ষান্তরে, অসীম ধৈর্য নিয়ে বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণর একতরফা কথা শুনে যাচ্ছেন, কখনও প্রতিবাদ করছেন না, তর্কে ঢুকছেন না, প্রতিপক্ষকে আঘাত করছেন না। কেবল ‘মৃদু মৃদু হাস্য’ করে অবস্থাটা সামাল দিচ্ছেন। স্নেহভাজন কিন্তু দুরন্ত বালকের দুরন্তপনা যেভাবে মানুষ সহ্য করে নেয়, অনেকটা সেই ঢঙে। নিরপেক্ষ পাঠকের মনে না হয়ে পারে না যে, অন্যর দৃষ্টিভঙ্গি জানবার ব্যাপারে অনীহা এবং আপন মতটাকেই সর্বশিরোধার্য বলে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রামকৃষ্ণর মধ্যে অত্যন্ত প্রকট। অথচ, ‘আমি’কে বিসর্জন দিতে না পারলে মুক্তি আসবে না, এটাই তাঁর মত। অন্তত এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটিতে রামকৃষ্ণর ‘আমি’ যে বিদ্যাসাগরের ‘আমি’র চেয়ে বেশি প্রবল, বস্তুত অদম্য, রূপে প্রতিভাত হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। শ্রীম সেইভাবেই দু’জনকে দেখাতে চেয়েছিলেন হয়তো।

বিদ্যাসাগর কিছুতেই প্ররোচিত হচ্ছেন না দেখে রামকৃষ্ণ সরাসরি ব্যক্তিগত আক্রমণের পথ বেছে নেন, হয়তো অচেতনভাবেই। বিদ্যাসাগরের মতো কর্মযোগীকে ‘জ্ঞান’ দিয়ে তিনি বলেন:

তুমি যে-সব কর্ম করছ এতে তোমার নিজের উপকার। নিষ্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের ওপর তোমার ভালোবাসা আসবে। ভালোবাসা এলেই তাঁকে লাভ করতে পারবে। জগতের উপকার মানুষে করে না, তিনিই করছেন।১১

প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের কাছে এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি মুখ না খুললেও, পরোপকার, মানবমঙ্গল প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর বিরাগ যে কত তীব্র ছিল তা তাঁর নিজস্ব বুলিতে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রর কাছে:

দয়া! পরোপকার! তোমার সাধ্য কি যে তুমি পরোপকার করো? মানুষের এত নপর-চপর কিন্তু যখন ঘুমোয়, তখন যদি কেউ দঁাড়িয়ে মুখে মুতে দেয়, তো টের পায় না, মুখ ভেসে যায়। তখন অহংকার অভিমান, দর্প কোথায় যায়? (১৮৮৪, ৬ ডিসেম্বর)১২

আশঙ্কা হয়, বুঝি-বা বিদ্যাসাগর মেজাজ গরম করে ফেলবেন। তাঁর সারাজীবনের কাজকর্মর মূলে যে-আদর্শ কাজ করছে, যার জন্য তিনি অজস্র দুঃখভোগ করেছেন, তাকে একজন মানুষ অযাচিতভাবে তাঁরই বাড়িতে বসে, বিনা প্ররোচনায় নস্যাৎ করে দিচ্ছেন! কিন্তু অটল সংযমে তিনি এর কোনও প্রতিবাদ করলেন না, এমনকী ‘মৃদু মৃদু’ হাস্যও করলেন না।

কার্যত একমুখী এই আলাপচারিতার অন্তে রামকৃষ্ণ বলেন, ‘এ-যা বললুম, বলা বাহুল্য আপনি [এতক্ষণ পর হঠাৎ ‘আপনি’!] সব জানেন— তবে খপর নাই। (সকলের হাস্য) বরুণের ভাণ্ডারে কত কি রত্ন আছে! বরুণ রাজার খপর নাই!’ বিদ্যাসাগর আবার সহাস্যে বলেন, ‘তা আপনি বলতে পারেন’। এর অর্থ কি এই যে বিদ্যাসাগর মেনে নিলেন, তাঁর অন্তরে সত্যিই রত্ন আছে? এর পর তাঁকে ‘রাসমণির বাগান’ দেখতে আসার নিমন্ত্রণ জানান রামকৃষ্ণ। বিদ্যাসাগর ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে বলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাব। এখানেও অতি নিপুণ শ্লেষের খেলা খেলেন এঁরা দু’জনেই। রামকৃষ্ণ ঠেস দিয়ে বলেন, ‘আমরা জেলেডিঙি। খাল বিল আবার বড় নদীতেও যেতে পারি। কিন্তু আপনি জাহাজ, কি জানি যেতে গিয়ে চড়ায় পাছে লেগে যায়’। ‘বিদ্যাসাগর সহাস্যবদন, চুপ করিয়া আছেন। ঠাকুর হাসিতেছেন’। এবার রামকৃষ্ণ বলেন, ‘তার মধ্যে এ-সময় জাহাজও যেতে পারে’। এবার সপাটে উত্তর দেন বিদ্যাসাগর, যদিও ‘সহাস্যে’— ‘হাঁ, এটি বর্ষাকাল বটে!’১৩ বুঝিয়ে দিলেন, উন্নত জাহাজের ‘নেভিগেশনে’র ক্ষমতা জেলেডিঙির চেয়ে বেশি, বিশেষত ‘বর্ষাকালে’, বিজ্ঞানোন্নত জ্ঞানসঞ্চয়ের মরশুমে! তা ছাড়া জেলেডিঙির পক্ষে তো ‘সাগর’ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়।

সাক্ষাৎকার শেষ। সৌজন্যে এতটুকু খামতি না রেখে বিদ্যাসাগর নিজে বাতি হাতে রামকৃষ্ণকে পথ দেখিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে সাহায্য করলেন। এমনকী মহেন্দ্রনাথকে ‘মৃদুস্বরে’ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাড়া কি দেব?’ এরপর বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য সকলে নাকি ‘ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন’, এমনটাই দাবি শ্রীম-র। মিথ-নির্মাতারা যুগ যুগ ধরে ওই শব্দটির ভিত্তিতেই তাঁদের বিকল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। কিন্তু আসলে ওটা প্রণাম নয়, নমস্কার: ‘প্রায় ১৬ বৎসরের ছোট রামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগর নমস্কার করেছিলেন বলেই মনে হয়।’১৪ বাস্তবিক, কথামৃত-র স্বামী নিখিলানন্দ-কৃত ইংরেজি অনুবাদে আছে বিদ্যাসাগর ‘bowed to Sri Ramkrishna’।

কাটাছেঁড়া

এর উনিশ দিন পরে, ২৪ আগস্ট, ১৮৮২ বিদ্যাসাগরকে আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার বলে রায় দেন বিচারক রামকৃষ্ণ:

ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের সব প্রস্তুত কেবল চাপা রয়েছে। কতকগুলি সৎ কাজ করছে, কিন্তু অন্তরে কি আছে তা জানে না, অন্তরে সোনা চাপা রয়েছে। অন্তরে ঈশ্বর আছেন,— জানতে পারলে সব কাজ ছেড়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে ইচ্ছা হয়।১৫

তবে তখনও তাঁর ধারণা, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যে-কর্ম করে সে ভাল কাজ— নিষ্কামকর্ম করবার চেষ্টা করে’।

কিন্তু ক্রমে এত নরম করে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। মাস চারেক পর, ১৮৮২-র ১৪ ডিসেম্বর জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনা হতে হতে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ উঠে এল। বেশ তীব্র আকারে। মহেন্দ্রনাথ বলেন—

বিদ্যাসাগর অভিমান করে বলেন, ঈশ্বরকে ডাকবার আর কী দরকার! দেখ চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাঠ আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে; ক্রমে প্রায় এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতিরা এসে বললে মহাশয়, এদের খাওয়াবে কে? সঙ্গে এদের রাখলে আমাদের বিপদ। কি করা যায়? ছেড়ে দিলেও বিপদ। তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে কি করা যায়; ওদের সব বধ কর। তাই কচাকচ করে কাটবার হুকুম হয়ে গেল! এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন? কই একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না। আমার তো উপকার হল না।

সর্ব অর্থে অমানুষিক এই বর্বরতা রামকৃষ্ণকে একটুও বিচলিত, এমনকী অপ্রতিভও করল না। তিনি এই ভয়ংকরতাকে ঈশ্বরের লীলা বলে মেনে নেবার পরামর্শ দিলেন:

ঈশ্বরের কার্য কি বুঝা যায়, কি উদ্দেশ্যে তিনি কি করেন? তিনি সৃষ্টি, পালন, সংহার সবই করছেন। তিনি কেন সংহার করছেন আমরা কি বুঝতে পারি? আমি বলি, মা, আমার বোঝবারও দরকার নাই, তোমার পাদপদ্মে ভক্তি দিও।১৬

এর মধ্যে কোনও দ্ব্যর্থকতা নেই। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, যাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া একটা গাছের একটি পাতাও নাকি নড়ে না, তিনি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিনা দোষে কষ্ট পাবে কেন, তা নিয়ে সংশয়হীন ভক্ত রামকৃষ্ণ ভাবতে রাজি নন, কিছু করা তো দূরের কথা। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মানবদরদি সংশয়বাদী মন মানুষের কষ্ট দেখার পর ঈশ্বর নামক কোনও মঙ্গলময় সত্তাকে মানতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, তাঁর বেকন-বাদী যুক্তিনিষ্ঠ মন তাঁকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বোঝাল, প্রকৃতি ও মানুষের হাতে মানুষের এই হেনস্থার কারণ জানতে গেলে, সে-হেনস্থাকে প্রতিহত করতে গেলে, বিজ্ঞানমনস্ক হতে হয়। আর বিজ্ঞান জানতে গেলে ভাবনাচিন্তার পরিমণ্ডলটাকে প্রশ্নাকুল, বাস্তবমুখী, বিশ্লেষণমুখী করতে হবে। ‘আমি বলি, মা, আমার বোঝবারও দরকার নাই’— এ কথা বললে দুনিয়া বদলানোর প্রথম ধাপটুকুও পেরনো যায় না। রামকৃষ্ণ ভাবধারার সঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাবধারার আসল সংঘাত এই জায়গায়— মানুষের নৈসর্গিক ও সামাজিক যাতনাকে ভগবানের লীলা বলে উড়িয়ে না দিয়ে তাকে বাস্তবসম্মতভাবে বোঝা এবং বিজ্ঞানসম্মত কর্মর মধ্যে দিয়ে তার মূল উৎপাটনের চেষ্টা করা।

১৮৮৩-র ১৫ এপ্রিল রামকৃষ্ণর পুনরায় খেদ: কিছু কিছু মানুষকে ঈশ্বর শ্রেষ্ঠ করে গড়েছেন, অর্থাৎ অধিকারভেদ একটা প্রশ্নাতীত সত্য, এ কথা বিদ্যাসাগর মানতে চাননি।১৭ ১৫ জুন ওই প্রসঙ্গ তুলে তাঁর নিজস্ব রায়দানের ভঙ্গিতে বলেন:

বিদ্যাসাগরের এত বিদ্যা, এত নাম, কিন্তু এমন কাঁচা কথা বলে ফেললে… । ঈশ্বরকে না জানলে ক্রমশঃ ভিতরের চুনোপুঁটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু পণ্ডিত হলে কি হবে?১৮

একই কথা বলেন ১৮৮৩-র ২৮ নভেম্বর।১৯ ১৮৮৪ সালের ৩০ জুন ‘কুইন ভিক্টোরিয়ার এত মান, নাম কেন’ এই যুক্তি দিয়ে তিনি পুনরপি বিদ্যাসাগরের ‘কাঁচা’ যুক্তি ‘খণ্ডন’ করেন! ২০ ‘কুইন ভিক্টোরিয়ার এত মান’, এত নামের মূলে তো নিছক উচ্চশ্রেণির মানুষের তৈরি কতকগুলো কৃত্রিম রীতি, তাঁর কোনও বিশেষ কৃতিত্ব কিংবা গুণ নয়। ২০ জুন ১৮৩৭ আঠারো বৎসর বয়স্ক আলেকজান্ড্রিনা ভিক্টোরিয়া তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন: ‘ভোর ছটায় মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালেন, ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ আর লর্ড কনিংহ্যাম এসেছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। বিছানা থেকে উঠে ড্রেসিং গাউন পরেই আমি আমার বসবার ঘরে গেলাম, একলা। কথা হল ওঁদের সঙ্গে। লর্ড কনিংহ্যাম তখন আমায় জানালেন, রাজা, মানে আমার বেচারী কাকা, আর নেই। রাত ২টো বেজে ১২ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাই আমি এখন রানি।’ সেই থেকে ১৯০১ সালে পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের রানি। পক্ষান্তরে বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের এত মান, এত নামের মূলে আছে তাঁর সংগ্রাম, তাঁর গুণ, তাঁর অর্জিত কৃতিত্ব। দুটো কী করে এক মানদণ্ডে বিচার্য হল, এ প্রশ্ন তাঁর ভক্তরা কেউ তুললেন না। এরই রেশ চলে ১৮৮৪-র ১৯ অক্টোবরে২১, এমনকী ১৮৮৫-র ২৮ জুলাই-এও।২২ আগেই আলোচনা করেছি, এখানে মূল প্রশ্নটি আসলে অধিকারভেদের, যার ওপর ব্যক্তিমানুষের কোনও হাত নেই। বিদ্যাসাগর আর শ্রীরামকৃষ্ণর মধ্যে এটিও একটি মৌলিক সংঘাতের জায়গা। এখানে কোনও আপস চলে না।

এর মাঝে ১৮৮৩-র ২২ এপ্রিল বিদ্যাসাগরের প্রশ্ন তুলে রামকৃষ্ণ এই বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছিলেন যে:

আমি বিদ্যাসাগরকে বলেছিলাম, সব জিনিস এঁটো হয়ে গেছে, কিন্তু ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হয় নাই। অর্থাৎ ব্রহ্ম কি, কেউ মুখে বলতে পারে নাই। মুখে বললেই জিনিসটা এঁটো হয়ে যায়। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত, শুনে ভারী [য] খুশি।২৩

একই কথা বলেন ১৮৮৩-র ১৬ ডিসেম্বর।২৪ বিদ্যাসাগর কেন এ কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন, এবং খুশি হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের দু’জনের মধ্যে যে-দুস্তর ব্যবধান, তা নিয়ে ওপরে আলোচনা করেছি।

বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রামকৃষ্ণর নেতিবাচক রায়দানের প্রক্রিয়া অব্যাহত। ১৮৮৩ সালের ২২ জুলাই তাঁর পুনরুক্তি:

বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য আছে, দয়া আছে, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি নাই। অন্তরে সোনা চাপা আছে, যদি সেই সোনার সন্ধান পেত, এত বাহিরের কাজ যা কচ্ছে সে-সব কম পড়ে যেত; শেষে একেবারে ত্যাগ হয়ে যেত।২৫

অর্থাৎ মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে করে বিদ্যাসাগরের ক্লান্তি আসছে না কেন, কেন তিনি সাধনভজনে লিপ্ত হচ্ছেন না, এটাই রামকৃষ্ণর প্রধান অভিযোগ।

অথচ একইসঙ্গে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন—

ঈশ্বর বিদ্যাসাগর যেরূপ কাজ করছে সে খুব ভাল। দয়া খুব ভাল। দয়া আর মায়া অনেক তফাত। দয়া ভাল, মায়া ভাল নয়। মায়া আত্মীয়ের উপর ভালবাসা— স্ত্রী, পুত্র, ভাই, ভগিনী, ভাইপো, ভাগনে, বাপ, মা এদেরই উপর। দয়া সর্বভূতে সমান ভালবাসা।

বাস্তবিক, বিদ্যাসাগরের আদর্শ ছিল, রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখসাধন’, আর পাঁচজন লোকের মতো তা আদৌ তাঁর পরিবারের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার বিপরীত; তাঁর পরিবারের অনেকেই, এমনকী তাঁর স্ত্রীও, তাঁর ওপর বিরূপ হয়েছিলেন এই তথাকথিত অভিযোগে যে, তিনি ঘরের উন্নতির দিকে নজর না দিয়ে ‘বাইরের’ লোকের ভাল করে বেড়াতেন।২৬

এতদ্‌সত্ত্বেও, রামকৃষ্ণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি যে, তাঁর আকুল আহ্বানে বিদ্যাসাগর কর্ণপাত মাত্র করলেন না। এই সুভদ্র উপেক্ষা তাঁর অন্তরে গিয়ে বেজেছিল। আসলে ব্রাহ্মসমাজের এবং অন্যান্য অনেক শিক্ষিত হিন্দু মানুষকে দেখে, শ্রীরামকৃষ্ণর ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে তাঁর মধুর বচন শুনে তাঁরা সকলেই বিনা প্রশ্নে তাঁর কাছে নতজানু হয়ে পড়বেন। কেশব সেনকে তিনি ১৮৭৫ সাল থেকে চিনতেন। ১৮৮৪-র ৫ জানুয়ারি তাঁর ব্রাহ্মভক্ত মণি মল্লিককে তিনি বলেন: ‘কেশব আগে খ্রীষ্টানী ধর্ম, খ্রীষ্টানী মত খুব চিন্তা করেছিলেন।— সেই সময় ও তার আগে দেবেন্দ্র ঠাকুরের ওখানে ছিলেন’। মণি মল্লিকের টিপ্পনী: ‘কেশববাবু প্রথম প্রথম যদি এখানে আসতেন তাহলে সমাজ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত হতেন না। জাতিভেদ উঠানো, বিধবা বিবাহ, অন্য জাতে বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্ম লয়ে অত ব্যস্ত হতেন না’। উত্তরে বিজয়গর্বে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন: ‘কেশব এখন কালী মানেন— চিন্ময়ী কালী— আদ্যাশক্তি। আর মা মা বলে তাঁর নামগুণকীর্তন করেন’। অতঃপর তাঁর ভবিষ্যদ্‌বাণী:

হ্যাঁ, সনাতন ধর্ম ঋষিরা যা বলেছেন, তাই থেকে যাবে। তবে ব্রাহ্মসমাজ ও ওইরকম সম্প্রদায়ও একটু একটু থাকবে। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে যাচ্ছে।২৭

বিদ্যাসাগরও তাঁর কাছে নতজানু হোন এবং কেশবের মতো সনাতন ধর্মের ‘কনভার্ট’-এ পরিণত হোন, এই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণর ঈপ্সা।

এ প্রসঙ্গে নিরঞ্জন ধরের বিশ্লেষণটি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে রামকৃষ্ণর ‘তথাকাথিত ভাবসমাধি… ব্রাহ্মনেতাদের মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি।… শিবনাথ [শাস্ত্রী] রামকৃষ্ণের পুনঃপুনঃ সমাধিস্থ হওয়াকে একটা স্নায়বিক দৌর্বল্যজনিত রোগ বলে বর্ণনা করেছেন।… ব্রাহ্মসমাজের অধিকাংশ সদিচ্ছাসম্পন্ন সদস্যের সুচিন্তিত অভিমতও ছিল তাই।’ শুধু তাই নয়, ‘কেশব-অনুরাগী মহেন্দ্রনাথ বসুর বর্ণনানুযায়ী, কেশবের সংশ্রবের [য] ফলে “হিন্দুসাধুটি” (অর্থাৎ রামকৃষ্ণ) সাধারণভাবে বুঝতে শুরু করেন যে এই মূর্ছা যাওয়া তাঁর ধর্ম জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর এবং “অশ্রুপূর্ণ চোখে” এর থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে বহুবার প্রার্থনা করেছেন।’ তা সত্ত্বেও ‘প্রায় সব ব্রাহ্ম নেতাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, রামকৃষ্ণ সমাধির জন্য বড় নন, [?] অবস্থায় “আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য” যেভাবে বিতরণ করেন তার জন্য বড়।’২৮ বিদ্যাসাগর সেইটুকু স্বীকৃতিও তাঁকে দেননি। ‘আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য’র কোনও প্রয়োজন ছিল না তাঁর। বরং কেশবচন্দ্রর ঈশ্বর-বিভাব নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন তিনি। রসিকতা করে যমরাজের কাল্পনিক বয়ানে কেশবের উদ্দেশে বলেছিলেন: ‘তুই নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু জানিস না, আবার পরকে উপদেশ দিছিলি? ওরে কে আছিস— একে আর পঁচিশ বেত দে।’২৯

রামকৃষ্ণকে তাঁর একজন সৎ ও আন্তরিক সাধু ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি; রামকৃষ্ণর সাধুতা ও সরল আন্তরিকতাকে সম্মান জানিয়েছিলেন তিনি; তাঁর সাধনাকে নয়। শ্রীরামকৃষ্ণর কাছে এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। তাই এত বার করে এত আকুতি জানানো সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর যে একবারও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন না, এতে তাঁর প্রচণ্ড অভিমান হল। ১৮৮৩-র ২৬ সেপ্টেম্বর মহেন্দ্রনাথকে তিনি বললেন:

বিদ্যাসাগর সত্যকথা কয় না কেন?… সেদিন বললে, এখানে আসবে, কিন্তু এল না।… পণ্ডিত আর সাধু অনেক তফাত। শুধু পণ্ডিত যে, তার কামিনী-কাঞ্চনে মন আছে। সাধুর মন হরিপাদপদ্মে। পণ্ডিত বলে এক, করে আর।৩০

অথচ বিদ্যাসাগর ঠিক এর বিপরীত। তিনি যা বলেন, তাই করেন। রামকৃষ্ণর কাছ থেকে বিদ্যাসাগরের যে কিছু পাবার নেই, এই সরল সত্যটা রামকৃষ্ণ তো অনুধাবন করতে পারছেন-ই না, তাঁর ভক্তমণ্ডলীও কেউ সে কথা তাঁকে বুঝিয়ে বলছেন না। এমনকী মহেন্দ্রনাথও না, যিনি ব্যাপারটা অন্তত খানিকটা বুঝেছিলেন।

১৮৮৪-র ২৫ জুন রামকৃষ্ণর সঙ্গে দেখা হল শশধর তর্কচূড়ামণির, যিনি হাঁচি-কাশি-টিকটিকির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেবার জন্য স্মরণীয় (রবীন্দ্রনাথের ব্যঙ্গ স্মরণীয়)। আশ্চর্যর ব্যাপার, শশধরকে দেখে রামকৃষ্ণ স্মরণ করলেন বিদ্যাসাগরকে, দু’জনেই তাঁর চোখে নিছক ‘পণ্ডিত’:

মা! সেদিন ঈশ্বর বিদ্যাসাগরকে দেখালি! তারপর আমি আবার বলেছিলাম, মা! আর-একজন পণ্ডিতকে দেখব, তাই তুই আমায় এখানে এনেছিস।৩১

১৮৮৫ সালেও বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে সেই একই আক্ষেপ রামকৃষ্ণর:

দেখলাম বিদ্যাসাগরকে— অনেক পড়া আছে, কিন্তু অন্তরে কি আছে দেখে নাই। ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে আনন্দ। ভগবানের আনন্দের আস্বাদ পায় নাই। শুধু পড়লে কি হবে? ধারণা কই? পাঁজিতে লিখেছে, বিশ আড়া জল, কিন্তু পাঁজি টিপলে এক ফোঁটাও পড়ে না (১৮৮৫, ২৩ মে)।৩২

মহেন্দ্রনাথের দোলাচল

এখানে মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর ভূমিকা খানিকটা ধরি-মাছ না-ছুঁই-পানি গোত্রর। একদিকে বিদ্যাসাগরের মতো মহাপণ্ডিত, তেজস্বী মানবতাবাদীর উজ্জ্বল উপস্থিতিকে অস্বীকার করা তাঁর মতো কৃতবিদ্য মানুষের পক্ষে অসম্ভব; অন্যদিকে, রামকৃষ্ণ-ভক্ত হিসেবে তিনি বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর-তথা-রামকৃষ্ণ অনীহাকে প্রসন্ন মনে নিতে পারেননি। ১৮৮২ সালে মার্চ মাসে তিনি প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শন করেন। আর ওই বছরই ৫ অগস্ট শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের কাছে নিয়ে যান। ১৮৮৫ সালের ২৫ অক্টোবর ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা, এঁর [রামকৃষ্ণর] বিষয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কি মত?’ উত্তরে শ্রীম জানান, ‘সেদিন [৫ অগস্ট, ১৮৮২] খুব ভক্তি করেছিলেন। তবে কথা কয়ে দেখেছি, বৈষ্ণবেরা যাকে ভাব-টাব বলে, সে বড় ভালবাসেন না। আপনার মতের মতো’।৩৩ আসলে সেদিন বিদ্যাসাগর নিছক ভদ্রতা-সৌজন্যই দেখিয়েছিলেন, ‘ভক্তি’ করেননি।

আরেকটি ঘটনা বেশ শিক্ষাপ্রদ। মহেন্দ্রনাথকে অনেকে ‘ছেলেধরা মাস্টার’ বলত। তিনি ইস্কুলের ছেলেদের দক্ষিণেশ্বর নিয়ে যেতেন। সিমলেপাড়ার পূর্ণচন্দ্র ঘোষ তেমনই একজন ছাত্র। তিনি ‘ছাত্রাবস্থায় অতি শৈশবেই মাষ্টার মহাশয়ের পরামর্শে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সংস্পর্শে আসেন।… শ্রীশ্রীঠাকুর বলিয়াছিলেন পূর্ণচন্দ্রের ‘‘বিষ্ণুর অংশে জন্ম’’ এবং তাঁহার আগমনে ওই শ্রেণীর ভক্তদের আগমন পূর্ণ হইল’।৩৪ খুবসম্ভব এই পূর্ণ ছিলেন বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইন্‌স্টিটিউশনের শ্যামপুকুর শাখার ছাত্র, যে-শাখার প্রধান শিক্ষক মহেন্দ্রনাথ। দক্ষিণেশ্বরে কিশোর পূর্ণর যাতায়াতে তার বাড়ির সম্মতি ছিল না। তাই তাকে লুকিয়ে আনতে হত। একদিন পূর্ণ আসেনি কেন, রামকৃষ্ণর এই প্রশ্নর উত্তরে শ্রীম জানান: ‘সভায় আসতে চায় না, তার ভয় হয়, আপনি পাঁচজনের সাক্ষাতে সুখ্যাতি করেন, পাছে বাড়িতে জানতে পারে’। শুনে কেজোবুদ্ধি মানুষের মতো রামকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ বলেন: ‘হাঁ, তা বটে। যদি বলে ফেলি, তা আর বলব না।…’

শুধু বাড়ির লোক নয়, পড়াশোনার ক্ষতি করে ছাত্রদের এইভাবে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বিদ্যাসাগরেরও একেবারেই পছন্দের ছিল না। ছাত্রদের পড়ানোর ব্যাপারটা তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ইস্কুলের রেজাল্ট খারাপ হলে শিক্ষকদের ডেকে কৈফিয়ত চাইতেন তিনি, এমনকী প্রয়োজন মনে করলে বরখাস্তও করতেন, তার ভূরি ভূরি নিদর্শন আছে। পূর্ণকে নিয়েও সম্ভবত এরকম কিছু-একটা ঘটেছিল। তাই ১৮৮৫ সালের ৬ এপ্রিল রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, ঠিক আছে, ও এখানে নাই-বা এল, ‘… পূর্ণকে তুমি ধর্মশিক্ষা দিচ্ছ, এ তো বেশ’। উত্তরে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে মহেন্দ্রনাথ বলে ওঠেন:

তা ছাড়া বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বইয়েতে Selection-এ ওই কথাই (“With all thy Soul love God above./ And as thyself thy neighbour love”) আছে, ঈশ্বরকে দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। এ কথা শেখালে কর্তারা যদি রাগ করেন তো কি করা যায়?

এই ‘তা ছাড়া’টি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। ফেটে ভেঙে বললে এর মানে দাঁড়ায়, বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে যে-আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, দক্ষিণেশ্বরের শিক্ষা তো তারই সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, বিদ্যাসাগরের ইস্কুলে পাঠ্য ইংরেজি বইতেই তো বলা আছে, ঈশ্বরকে দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে। তা হলে দক্ষিণেশ্বরে এলে দোষের কী আছে?

রামকৃষ্ণ ইঙ্গিতটা লুফে নিয়ে বললেন:

ওদের বইয়েতে অনেক কথা আছে বটে, কিন্তু যারা বই লিখেছে, তারা ধারণা করতে পারে না। সাধুসঙ্গ হলে তবে ধারণা হয়।… শুধু পণ্ডিত যদি বই লিখে বা মুখে উপদেশ দেয়, সে কথা তত ধারণা হয় না (১৮৮৫, ৬ এপ্রিল)।৩৫

মহেন্দ্রনাথ এখানে বিদ্যাসাগর-নির্বাচিত (সংকলিত কি না জানি না) সিলেকশন্‌স নামক পাঠ্যবই থেকে যে-ইংরেজি দ্বিপদীটি তুলে দিয়েছেন, সেটি স্পষ্টতই বাইবেলের মথি-লিখিত সুসমাচারের ২২; ৩৭-৩৯ সংখ্যক সূত্রর ছন্দোবদ্ধ রূপ। সুসমাচারের বয়ানটি এইরকম:

Master, which is the great commandment in the law?

Jesus said unto him, Thou shalt love the Lord thy God with all thy heart, and with all thy soul, and with all thy mind.

This is the first and great commandment.

And the second is like unto it, Thou shalt love thy neighbour as thyself.

(Matthew 22:36-39, King James Version)

সিলেক্‌শন্‌স-এর দ্বিপদীটি এরই সরল, ছাত্রপাঠ্য, ছন্দোবদ্ধ রূপ, যা ইংরেজি সাহিত্যপাঠের অঙ্গ। এই দ্বিপদীটির নিদর্শন দেখিয়ে রামকৃষ্ণর কাছে বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর-চিন্তার প্রসঙ্গ তোলাটা রীতিমতো কষ্টকল্পিত এবং নিশ্চিতভাবে মহেন্দ্রনাথের মনের অস্থিরতার পরিচায়ক। যেভাবে পারা যায়, একটা খুঁটি খুঁজছিলেন তিনি।

এই সিলেকশন প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত ই-মেলে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, সাল জানা যায় না ‘তবে ১৮৬৭-র আগে বিদ্যাসাগর Selections from the Writings of Goldsmith, Poetical Selections from English Literature, আর Poetical Selection নামে তিনটি বই বার করেছিলেন।’ দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন তাঁর পদমঞ্জরী (১৮৬৭, ১৯২৪ সংবৎ)-তে লিখেছেন, ‘শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁহার সঙ্কলিত ইংরাজী পোয়েটীকাল সিলেকশন হইতে কয়েকটি বিষয় অবলম্বন করিয়া লিখিতে আদেশ দেন।’ [গোপাল হালদার, প্রসঙ্গ : বিদ্যাসাগর , করুণা প্রকাশনী, ১৯৯১, পৃ ১২৮, ১৩২ দ্র.] শ্রীম কি পরমহংসকে এইরকম কোনও সিলেকশন-এর কথা বলেছিলেন?

আরও প্রশ্ন: মহেন্দ্রনাথ-কথিত ওই ‘কর্তারা’ কারা— পূর্ণর অভিভাবকরা, না কি মেট্রোপলিটান ইস্কুলের কর্তৃপক্ষ— অর্থাৎ স্বয়ং বিদ্যাসাগর? ঠিক করে বলা অবশ্য মুশকিল।

মহেন্দ্রনাথের মনের অস্থিরতার যথেষ্ট কারণ ছিল। তার অনেকটাই ব্যক্তিগত। যেদিন পূর্ণর প্রসঙ্গ উঠল, সেইদিনই প্রচণ্ড গরমে কাতর রামকৃষ্ণ মহেন্দ্রনাথকে তাঁর [মহেন্দ্রনাথের] ছোট্ট বাসগৃহর কথা তুলে বলেন:

শ্রীরামকৃষ্ণ— তুমি কেমন করে ওইটুকুর ভিতর থাকো? উপরের ঘরে গরম হয় না?

মাষ্টার— আজ্ঞা, হাঁ! খুব গরম হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ— তাতে পরিবারের মাথার অসুখ, ঠাণ্ডায় রাখবে।

মাষ্টার— আজ্ঞা হাঁ, বলে দিয়েছি। নিচের ঘরে শুতে।৩৬

খানিক পরে রামকৃষ্ণ মহেন্দ্রনাথকে বলেন, ‘তুমি এ রবিবারে যাও নাই কেন?’ উত্তরে মহেন্দ্রনাথ অসহায়ভাবে তাঁর স্ত্রীর মানসিক অসুস্থতার কথা বলেন: ‘আজ্ঞা, বাড়িতে তো আর কেউ নাই। তাতে আবার (পরিবারের মাথার) ব্যারাম। কেউ দেখবার নাই’। মহেন্দ্রনাথের বিড়ম্বিত, বেদনাময় দাম্পত্য জীবনের কথা কথামৃত-য় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। বস্তুত ওই অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তির একটা আশ্রয় লাভের আশাতেই তিনি শ্রীরামকৃষ্ণর শরণ নিয়েছিলেন।

আর ঠিক এই সময়েই মেট্রোপলিটান শ্যামপুকুর শাখার শিক্ষার মান নেমে যাওয়ায় বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। ১৮৮৬ সালে শ্যামপুকুর শাখার ফল খুব খারাপ হওয়ায় বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রনাথের কাছে কৈফিয়ত দাবি করেন। মহেন্দ্রনাথের কবুলতি: ‘বিদ্যাসাগর মশায়ের স্কুলে কাজ করতাম হেডমাষ্টারের শ্যামবাজারে। ঠাকুর কাশীপুরে অসুস্থ ছিলেন। ওখানে বেশী যাতায়াত করতাম। স্কুলের ফল ভাল হয় নাই। তাই বিদ্যাসাগর মশায় অসন্তুষ্ট হয়ে একদিন এই কথা বললেন, “ওখানে বড্ড বেশী যাতায়াত করায় তোমার স্কুলের ফল ভল হয় নাই”। অমনি রিজাইন (কর্মত্যাগ) করলাম’।৩৭ এ নিশ্চয়ই মহেন্দ্রনাথের আদর্শনিষ্ঠার প্রমাণ। তবে একইসঙ্গে এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, সে আদর্শ বিদ্যাসাগরের আদর্শর সম্পূর্ণ বিপরীত।

উপসংহার

শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের ‘সাধ’ মেটানোর জন্য ৫ অগস্ট ১৮৮২ বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণর সনির্বন্ধ অনুনয় সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর কোনওদিন দক্ষিণেশ্বরে ‘রাসমণির বাগানে’ যাননি। কথামৃত-র সাক্ষ্য অনুযায়ী, ১৮৮২ থেকে ১৮৮৬, যে-বছর রামকৃষ্ণ মারা যান, এই চার বছরে রামকৃষ্ণ অন্তত কুড়িবার বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ তুলেছেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর জীবনে একবারও রামকৃষ্ণর কথা তোলেননি, যদিও রামকৃষ্ণর মৃত্যুর পর তিনি আরও পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন। ‘১৮৮২ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েক বার কার্মাটাঁড়ে গিয়েছেন; কলকাতার নিকটবর্তী চন্দননগর, ফরাসডাঙ্গা ইত্যাদি জায়গাতেও যাতায়াত করেছেন, কিন্তু রাসমণির বাগান তাঁর কাছে অগম্য এবং অপরিচিতই রয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিদ্যাসাগরের অবশিষ্ট জীবনের ধারাও রামকৃষ্ণের ধর্মালোচনার দ্বারা সামান্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। এই সাক্ষাৎ সম্পর্কে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়াও কারুর কাছে ব্যক্ত করেননি। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে তাঁর কোনো মন্তব্যও পাওয়া যায়নি’।৩৮

কার্যত তিনি রামকৃষ্ণকে অবজ্ঞা করেছিলেন। তবে রামকৃষ্ণর সক্রিয় বিরোধিতাও তিনি করেননি। রামকৃষ্ণর মতো সনাতন ধর্মীয় খাঁটি সাধকদের প্রতি তাঁর মনোভাব ছিল এই যে, তাঁরা তাঁদের মতো সাধনা করুন, কিন্তু জনসাধারণকে পথ দেখানোর কাজটা যেন না করেন। কেননা তা হলে আধুনিক জগতের সঙ্গে এদেশের মানুষকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জরুরি প্রক্রিয়াটা বাধা পাবে। রামকৃষ্ণ নিজে আদৌ আধুনিক অর্থে লোকশিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন না। সমাজ সংস্কার, লোকসেবা এসবকে তিনি সাধনপথের বিঘ্ন মনে করতেন। কোনও আন্দোলন গড়ে তোলা তো তাঁর স্বপ্নেরও অতীত ছিল। বস্তুত বিবেকানন্দর মতো প্রতিভাবান, উচ্চাশী, কর্মোদ্যোগী, ইংরেজি-জানা মানুষকে শিষ্য হিসেবে না পেলে তিনি হয়তো লোকনাথ ব্রহ্মচারী কিংবা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতো আরেক জন সাধু হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকতেন, শিক্ষিত সমাজের ওপর তাঁর বিরাট কোনও প্রভাব পড়ত না। আত্মজীবনীতে বিজয়কৃষ্ণ-শিষ্য বিপিনচন্দ্র পাল এ কথাটা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন।

কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, হিন্দু ‘অহম্মন্যতা-মূলে আঘাত’ করলেও বিদ্যাসাগর সে-মূল উৎপাটন করতে পারেননি। অচিরেই রামকৃষ্ণর ভাবস্রোত প্রবল হয়ে উঠে বিদ্যাসাগরের ঈপ্সিত বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদের ধারাকে স্তিমিত করে আনে। প্রবল হয়ে ওঠে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী ধারা। বিদ্যাসাগরের মতো জ্ঞানী এবং সৎ মানুষ ঈশ্বর সম্বন্ধে নিস্পৃহ থেকে ইহজগতের মঙ্গল করে চলেছেন, এটা রামকৃষ্ণর কাছে ভারী অদ্ভুত, কার্যত অন্যায় বলে মনে হয়েছিল। তাঁর এই ভাবনা তাঁর শিষ্যবর্গকেও প্রভাবিত করেছিল। তার ওপর তাঁদের একদল গুরুর দেখানো নিভৃত সাধনার পথ ছেড়ে সাহেবি ধাঁচে মিশন গড়ে জনসাধারণের মধ্যে বৈদান্তিক শিক্ষা ছড়ানোর পরিকল্পনা করেন। স্বভাবতই বিদ্যাসাগরের বেদান্তবিরোধী, অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন-ভিত্তিক শিক্ষাভাবনার বিপরীত পথে হাঁটতে হল তাঁদের। বিদ্যাসাগরের মধ্যে ভক্তিভাব না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে একজন মহৎ মানুষ বলে বুঝতে ভুল হয়নি রামকৃষ্ণর। কিন্তু তাঁর শিষ্যরা কেউ কেউ বিদ্যাসাগরের প্রতি অশোভন তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন। শেষপর্যন্ত সমাজের কর্তারা এঁদেরই মূলস্রোত বলে মান্যতা দিয়েছেন; বিদ্যাসাগর যে-ধর্মবিযুক্ত বিজ্ঞানদর্শনের স্রোতে বাঙালি হিন্দুদের অবগাহন করাতে চেয়েছিলেন, তা অল্পকালের মধ্যে মূলস্রোতের সেই শক্তিশালী উত্থানের সামনে পরাজয় মেনে নেয়। আমাদের স্বদেশি আন্দোলন, আমাদের জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন, সব কিছুতেই বিদ্যাসাগর ব্রাত্য, বিজয়ী রামকৃষ্ণ-শিষ্যদের যুক্তিবাদ-বিরোধী ভাবধারা। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখের কর্মকাণ্ড (ব্যতিক্রম হেমচন্দ্র কানুনগো) কি তারই সাক্ষী নয়?

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. এ প্রবন্ধর আগাগোড়াই উদ্বোধন কর্তৃক দুই খণ্ডে প্রকাশিত (১৯৯৬) কথামৃত থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।

. দ্র. আশীষ লাহিড়ী, স্বামী বিবেকানন্দ ও বাঙালির সেকিউলার বিবেক, অবভাস, ২০১৮ (২০১২)।

. কথামৃত, ১:৪৭।

. তদেব, ১:৪৮।

. তদেব, ১:৫১।

. তদেব, ১:৪৯।

. তদেব, ১:৫০।

. তদেব, ১:৫১।

. Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian, Routledge, London, New York, New Delhi, 2019 (2014), pp. 45-46.

১০. Brian A. Hatcher, ibid.

১১. কথামৃত, ১:৬০।

১২. তদেব, ২:১২১৪।

১৩. তদেব, ১:৬১।

১৪. অমিয়কুমার সামন্ত, বিদ্যাসাগর, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০১২, পৃ. ২৭০।

১৫. কথামৃত, ১:৬৫।

১৬. তদেব, ১:১৪৪।

১৭. তদেব, ১:২০২।

১৮. তদেব, ১:২৫৫।

১৯. তদেব, ১:৩৫৮।

২০. তদেব, ১:৫৯০।

২১. তদেব, ১:৭৭৩।

২২. তদেব, ২:৯৯৫।

২৩. তদেব, ১:২১০।

২৪. তদেব, ১:৩৯০।

২৫. তদেব, ২:২৮২।

২৬. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য আশীষ লাহিড়ী, ‘বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার: যুক্তিবাদ ও ব্যক্তি-পরিপার্শ্ব’, প্রবন্ধ সংকলন ১/যুক্তিবাদ ধর্ম জাতীয়তাবাদ, সাহিত্য সংসদ, ২০১৯।

২৭. তদেব, ১:৪৪৪।

২৮. নিরঞ্জন ধর, রামকৃষ্ণ— অন্য চোখে, রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়, ২০০৯, পৃ. ২১-২২।

২৯. দ্র. কথামৃত, ২:১২৩৯।

৩০. তদেব, ১:৩২৫-২৬।

৩১. তদেব, ১:৫৬২।

৩২. তদেব, ২:৯৫১।

৩৩. তদেব, ২:১০৬৭।

৩৪. তদেব, ২:১৩২৫।

৩৫. তদেব, ২:৯০৩-৯০৪।

৩৬. তদেব, ২:৯০৫।

৩৭. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., ২০০১), পৃ. ৫৮৮।

৩৮. সামন্ত, পৃ. ২৭০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *