‘শ্রীম’ ও ‘কথামৃত’

‘শ্রীম’ ও ‘কথামৃত’

শ্রীকৃষ্ণের যেমন গীতা, শ্রীরামকৃষ্ণের তেমনি ‘কথামৃত’। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ ‘শ্ৰীম-কথিত’। অর্থাৎ ‘শ্রীম’ দ্বারা লিপিবদ্ধ। ‘শ্রীম’ হচ্ছেন শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর মুখ থেকে যেমন-যেমন শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তা-ই ‘কথামৃত’। এমন নয় যে, তিনি অন্যের মুখ থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ যা শুনেছেন, তা-ও কিছু কিছু লিখেছেন। তিনি নিজে যেসব দিন উপস্থিত ছিলেন, নিজে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ থেকে যা শুনেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি যা যা করতে দেখেছেন বা শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতিতে অন্য ভক্তেরা যা যা আলোচনা করেছেন—সেসবই তিনি শুধু লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তার কিছুটা তিনি পুস্তকাকারে বের করেছেন, তা-ই ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’। ‘শ্রীম’ লিখেছেন; ‘আমরা তাঁহার (শ্রীরামকৃষ্ণের) নিজের মুখে যাহা শুনিয়াছি ও নিজের চক্ষে যাহা দেখিয়াছি’ সে-সমস্তই ‘কথামৃতে’র মধ্যে ‘সাজাইয়া দেওয়া হইয়াছে’। ‘কথামৃত’ পাঁচ খণ্ডে সম্পূর্ণ। তাঁর কাছে যেসব উপাদান ছিল, শোনা যায় তাতে আরও পাঁচ-ছয় খণ্ড বের করা যেত। কিন্তু পঞ্চম খণ্ড বের হওয়ার আগেই তিনি শরীর রক্ষা করেন। তবে পঞ্চম খণ্ডের সব কাজ তিনি করে গেছিলেন। আংশিক ছাপাও দেখে গেছিলেন। শেষদিন পর্যন্ত পঞ্চম খণ্ডের প্রুফ দেখেছেন। প্রুফ দেখতে দেখতেই রাত্রিবেলা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন সকালবেলা শরীর যায়।* তাই পঞ্চম খণ্ডটাই শেষ খণ্ড। তারপর আর কোন খণ্ড বের হয়নি।

‘কথামৃত’ সম্বন্ধে বলতে গেলেই ‘শ্রীম’ সম্বন্ধে একটু না বললে চলে না। দুজন ব্যক্তি ‘কথামৃতে’ সবসময় আছেন। একজন শ্রীরামকৃষ্ণ, অপরজন ‘শ্ৰীম’। অধিকাংশ স্থলেই ‘শ্ৰীম’ নেপথ্যে আছেন। যেসব জায়গায় তাঁকে সামনে আসতে হয়েছে সেখানেও নানা ছদ্মনাম ব্যবহার করে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। তবুও এটা বেশ বোঝা যায় যে, তিনি আছেন। সেই মানুষটি যে কে, তা হয়তো আমরা সবসময় ধরতে পারি না। কিন্তু এটা বুঝতে পারি, শ্রীরামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে যেসব দৃশ্য ‘কথামৃতে’ একের পর এক উপস্থাপিত হচ্ছে তার একজন দর্শক আছেন। ‘শ্রীম’ সেই দর্শক—নিরপেক্ষ দর্শক, এবং অধিকাংশ স্থলেই নীরব দর্শক। ‘কথামৃতে’ তিনি ‘মাস্টার’, ‘মণি’, ‘মোহিনীমোহন’, ‘একজন ভক্ত’ ইত্যাদি নানা নাম ব্যবহার করেছেন। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমণ্ডলীতে ‘মাস্টারমশাই’ বলেই তিনি পরিচিত। শিক্ষকতা করতেন, তাই তাঁকে বলা হত মাস্টারমশাই। স্কুলে পড়াতেন, কলেজেও পড়াতেন। ছাত্রজীবনে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন, আবার যখন শিক্ষকতা শুরু করলেন তখনও খুব সুনাম অর্জন করলেন। খুব ভাল পড়াতে পারতেন। ছাত্ররা খুব পছন্দ করতেন তাঁর পড়ানো। সেক্সপীয়র নাকি তিনি খুব ভাল পড়াতেন। খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন। স্বামী বিরজানন্দ রিপন কলেজে যখন পড়তেন, তখন মাস্টারমশাই সেখানে পড়াতেন। বিরজানন্দ বর্ণনা করছেন: রাস্তা দিয়ে যখন তিনি যেতেন, কোন দিকে তাকাতেন না, আর একটা আঙ্গুল সবসময় ঠোঁটের কাছে ঠেকিয়ে রাখতেন—যেন বলছেন: keep silence —চুপ্‌, কথা বলো না। পোশাক পরতেন সাদা ধুতির উপরে কালো একটা চাপকান। মুখে দাড়ি ছিল। ছাত্ররা খুব সমীহ করত তাঁকে। আর, একটা ধর্মভাব বরাবরই ছিল তাঁর মধ্যে। চৈতন্যচরিতামৃত আর বাইবেল খুব ভাল করে পড়া ছিল। বাইবেল থেকে প্রায়ই মুখস্থ বলতেন তিনি।

প্রথম প্রথম মাস্টারমশাই ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন। হঠাৎই একদিন ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে পড়লেন। বরানগরে তাঁর ভগ্নীপতির বাড়িতে কয়েকদিন এসে ছিলেন। সেখান থেকে একদিন বিকেলবেলা সিধু (সিদ্ধেশ্বর মজুমদার) নামে বরানগরের এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে দক্ষিণেশ্বরে চলে এলেন। ‘কথামৃত’ থেকেই তার বর্ণনা দিচ্ছি: মাস্টার সিধুর সঙ্গে বরানগর এ বাগানে ও বাগানে বেড়াইতে বেড়াইতে এখানে (অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে) আসিয়া পড়িয়াছেন। আজ রবিবার,—২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৫ই ফাল্গুন—অবসর আছে, তাই বেড়াতে এসেছেন; শ্রীযুক্ত প্রসন্ন বাঁড়ুয্যের বাগানে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বেড়াইতেছিলেন। তখন সিধু বলিয়াছিলেন, ‘গঙ্গার ধারে একটি চমৎকার বাগান আছে, সে বাগানটি কি দেখতে যাবেন? সেখানে একজন পরমহংস আছেন।’ (১-১-২)

সিধুর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এলেন। এসে তাঁরা ঠাকুরের ঘরের দিকে গেলেন। বাইরে থেকে দেখলেন: শ্রীরামকৃষ্ণ তক্তপোশে বসে ধর্মপ্রসঙ্গ করছেন আর এক ঘর লোক নিস্তব্ধ হয়ে বসে তাঁর ‘কথামৃত’ পান করছেন। এই প্রথম দর্শন। মাস্টারমশায়ের মনে হল: যেন সাক্ষাৎ শুকদেব ভগবৎ কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নাম গুণকীর্তন করিতেছেন। শুনতে পেলেন, ঠাকুর বলছেন: যখন একবার হরি বা একবার রাম নাম করলে রোমাঞ্চ হয়, অশ্রুপাত হয়, তখন নিশ্চয়ই জেনো যে সন্ধ্যাদি কর্ম—আর করতে হবে না। (ঐ) অবাক হয়ে ঠাকুরের কথা শুনছেন। খুব ভাল লাগছে। মনে মনে বলছেন: কি সুন্দর স্থান! কি সুন্দর মানুষ! কি সুন্দর কথা! এখান থেকে নড়তে ইচ্ছা করছে না। (ঐ) তারপর ভাবলেন : একটু ঘুরে ফিরে দেখে নিই জায়গাটা, তারপর আবার এসে এঁর কথা শুনব।

ঘুরে ঘুরে সব দেখছেন। সন্ধ্যাবেলা, আরতি শুরু হয়ে গেছে। কাঁসর, ঘণ্টা, খোল, করতাল—এসব বাজছে আর বাগানের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে নহবতের মধুর শব্দ ভেসে আসছে। বসন্তকাল, সবে জ্যোৎস্না উঠেছে। খুব সুন্দর পরিবেশ। মাস্টার দ্বাদশ শিবমন্দিরে, শ্রীশ্রীরাধাকান্তের মন্দিরে ও শ্রীশ্রীভবতারিণীর মন্দিরে আরতি দর্শন করিয়া পরম প্রীতিলাভ করিলেন। সিধু বললেন: এটি রাসমণির দেবালয়। (ঐ)

দুজনে কথা বলতে বলতে আবার শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরের সামনে এলেন। এবার দেখিলেন, ঘরের দ্বার দেওয়া। এইমাত্র ধুনা দেওয়া হইয়াছে। মাস্টার ইংরাজী পড়িয়াছেন, ঘরে হঠাৎ প্রবেশ করিতে পারিলেন না। (ঐ) বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন কি করা যায়।

বাইবেলে যীশুখ্রীষ্ট বলছেন: ‘Knock, and it shall be opened unto you. —আমি তোমার জন্য দরজা খুলে দিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু তোমাকেও একটু কিছু করতে হবে, দরজায় করাঘাত করতে হবে। এখানেও যেন তাই দেখছি—ঘরের ভিতরে রয়েছেন মাস্টারমশায়ের আরাধ্যদেবতা—তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন—জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক তাঁদের মধ্যে। মাস্টারমশাই তা জানেন না—কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরে বলেছিলেন: তোমাকে শ্রীচৈতন্যের পার্ষদদের সঙ্গে দেখেছি; তোমার চৈতন্য-ভাগবত পড়া শুনে চিনেছি। শ্রীরামকৃষ্ণই তো শ্রীচৈতন্যরূপে লীলা করে গেছেন। আবার এসেছেন তিনি কতদিন পরে। তিনি এসেছেন, আর তাঁর পার্ষদরাও এসেছেন — যাঁরা তাঁর লীলাসহচর। মাস্টারমশাই তাঁর অন্যতম লীলাসহচর। কতদিন পরে দেখা হচ্ছে তাঁদের, ভক্ত-ভগবানের মিলন হচ্ছে কত যুগ পরে। দরজা বন্ধ তো কি হয়েছে? ঠেলে ঢুকতে হবে। মাস্টারমশাইও ঢুকবেন ঘরে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু একটু ইতস্তত করছেন প্রথমটায়।

এমন সময় দেখলেন একটি স্ত্রীলোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে—বৃন্দে ঝি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন:

—হাঁ গা, সাধুটি কি এখন এর ভিতর আছেন?

বৃন্দে—হাঁ, এই ঘরের ভিতর আছেন।

মাস্টার—ইনি এখানে কতদিন আছেন?

বৃন্দে—তা অনেকদিন আছেন—

মাস্টার—আচ্ছা, ইনি কি খুব বই-টই পড়েন?

বৃন্দে—আর বাবা বই-টই! সব ওঁর মুখে! (ঐ)

—খুব অবাক হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই! বই-টই পড়েন না, তাহলে এ কি রকম সাধু?

তারপর জিজ্ঞেস করলেন: আচ্ছা, ইনি বুঝি এখন সন্ধ্যা করবেন?—আমরা কি এ ঘরের ভিতর যেতে পারি?—তুমি একবার খবর দিবে?

বৃন্দে—তোমরা যাওনা বাবা। গিয়ে ঘরে বসো। (ঐ)

তাঁরা ঢুকলেন ঠাকুরের ঘরে—দেখলেন, ঘরের মধ্যে আর কেউ নেই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরে একাকী তক্তপোশের উপর বসিয়া আছেন। ঘরে ধুনা দেওয়া হইয়াছে ও সমস্ত দরজা বন্ধ। মাস্টার প্রবেশ করিয়া বদ্ধাঞ্জলি হইয়া প্রণাম করিলেন। (ঐ)—একটা স্মরণীয় মুহূর্ত। ‘কথামৃতে’র জন্মমুহূর্ত বলা যেতে পারে।

মাস্টারমশাইকে ঠাকুর বসতে বললেন, জিজ্ঞেস করলেন: কোথায় থাকো, কি করো, বরানগরে কেন এসেছ, ইত্যাদি। মাস্টারমশাই লক্ষ্য করলেন যে, ঠাকুর কথা বলছেন, কিন্তু মনটা যেন অন্য কোথায় রয়েছে। পরে তিনি শুনেছিলেন যে, এরই নাম ভাব, মাঝে মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে একেবারে বাহ্যশূন্য হয়ে পড়েন।

সেদিন বিশেষ কথাবার্তা হল না। দু-একটা কথা বলেই মাস্টারমশাই বিদায় নিলেন। ঠাকুর বললেন: আবার এসো। (ঐ)

ফেরবার পথে মাস্টারমশাই ভাবছেন, এ সৌম্য কে?—এঁর প্রতি এত আকর্ষণ অনুভব করছি কেন? বই না পড়লে কি মানুষ এত মহৎ হয়?—কি আশ্চর্য, আবার আসিতে ইচ্ছা হইতেছে। ইনিও বলিয়াছেন, ‘আবার এসো!’ কাল কি পরশু সকালে আসিব। (ঐ)

দ্বিতীয়বার যেদিন এলেন, সকালবেলা এসেছেন। এসে দেখেন যে ঠাকুর দাড়ি কামাচ্ছেন। কামাতে-কামাতেই মাস্টারমশায়ের সাথে কথা বলতে লাগলেন। একথা-সেকথার পর জিজ্ঞেস করলেন: তুমি বিয়ে করেছ? মাস্টারমশাই উত্তর দিলেন: হ্যাঁ, বিয়ে করেছি। সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরের সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া, একেবারে শিউরে উঠলেন: ওরে রামলাল*! যাঃ, বিয়ে ক’রে ফেলেছে। (১-১-৪)

মাস্টারমশাই খুব অবাক হয়ে গেলেন। মাথা নীচু করে চুপ করে রইলেন, যেন কত অপরাধ করে ফেলেছেন। মনে মনে ভাবছেন: বিয়ে করা কি এত দোষের?

ঠাকুর আবার জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কি সন্তান আছে? মাস্টারমশাই খুব ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন: আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে। ঠাকুর আবার খুব আক্ষেপ করতে লাগলেন। মাস্টারমশাই আর কি করবেন? চুপ করে আছেন। তিনি একজন ইংরেজি-শিক্ষিত লোক, নাম করা অধ্যাপক, স্কুল-কলেজে তিনিই ছাত্রদের তিরস্কার করেন—তাঁকে যে আবার কেউ এভাবে বকতে পারেন, এ তিনি ভাবতেও পারেননি। তাঁহার (মাস্টারমশায়ের) অহঙ্কার চুর্ণ হইতে লাগিল। (ঐ)

কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর মনে হয় একটু সদয় হলেন তাঁর উপর, সস্নেহে বলছেনঃ দেখ, তোমার লক্ষণ ভাল ছিল, আমি কপাল, চোখ এ সব দেখলে বুঝতে পারি। আচ্ছা, তোমার পরিবার কেমন? (ঐ) এখানেই মাস্টারমশাই একটু গোলমাল করে ফেললেন, বলে বসলেন: ভাল, কিন্তু অজ্ঞান। (ঐ) সঙ্গে সঙ্গে আবার তিরস্কার: স্ত্রী অজ্ঞান, আর তুমি বুঝি জ্ঞানী?

মাস্টারমশাই তো অবাক—তিনি এত পড়াশুনো করেছেন, ছাত্রদের পড়ান, তিনি জ্ঞানী নন তো কে জ্ঞানী? (মাস্টারের) এই ভ্রম পরে দূর হইয়াছিল। তখন শুনিলেন যে, ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না জানার নামই অজ্ঞান। ঠাকুর বলিলেন—‘তুমি কি জ্ঞানী?’ মাস্টারের অহঙ্কারে আবার বিশেষ আঘাত লাগিল। (ঐ)

তারপর ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কিসে বিশ্বাস? সাকারে না নিরাকারে? মাস্টারমশাই ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন, বললেন: আমার নিরাকারই ভাল লাগে। ঠাকুর বললেন: খুব ভাল। তোমার যদি নিরাকারে বিশ্বাস থাকে তো সেইটিই ধরে থাকো। তবে এইটে সবসময় জানবে যে, সাকার-নিরাকার দুই-ই সত্য। মাস্টারমশাই আরও অবাক হয়ে গেলেন: সাকার-নিরাকার দুই-ই সত্য? এ কি হয় কখনও? একথা তো তাঁহার পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নাই। তাঁহার অহঙ্কার তৃতীয়বার চুর্ণ হইতে লাগিল। (ঐ) কিন্তু তখনও সম্পূর্ণ ভাঙেনি, তাই আর একটু তর্ক করতে চেষ্টা করলেন। বললেন: আচ্ছা, তিনি সাকার এ নাহয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তিনি তো আর মাটির প্রতিমা নন। ঠাকুর বলছেন: মাটি কেন গো। চিন্ময়ী প্রতিমা। (ঐ) মাস্টারমশাই বললেন; তাহলে, যারা মাটির প্রতিমা পুজো করে, তাদের তো এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার? যেই এইকথা বলা, অমনি ঠাকুর খুব বিরক্ত হয়েছেন; বলছেন: তোমাদের কলকাতার লোকের ওই এক। কেবল লোক্‌চার দেওয়া, আর বুঝিয়ে দেওয়া। (ঐ)

ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, সেইসময় কলকাতায় লেকচারের ধুম পড়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মধর্মের বক্তৃতা হচ্ছে, খ্রীষ্টান মিশনারীরা বক্তৃতা দিচ্ছেন, সনাতন হিন্দুধর্মের কেউ কেউ বক্তৃতা করছেন—সবার নজর ঐদিকে। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ এর মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনি বলছেন: তুমি নিজে আগে জান তাঁকে। তারপর তাঁর সম্বন্ধে বলবে। তুমি যা জান না, তার সম্বন্ধে বলার তোমার অধিকার কোথায়? তা ছাড়া, ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনিই এসে জোটে। যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁকে আর লোক ডেকে আনতে হয় না; তাঁর এমন আকর্ষণী শক্তি যে, মানুষ আপনা-আপনি তাঁর চারপাশে এসে ভিড় করে। তাঁর জীবনটাই যেন বক্তৃতা। তাঁকে দেখেই মানুষ তখন শেখে। এমন কি, তিনি যদি কথা না বলেন, মৌনব্রত অবলম্বন করে থাকেন, তাতেও কিছু যায় আসে না।

ঠাকুর তাই খুব বিরক্ত হয়েছেন মাস্টারমশায়ের কথা শুনে, বলছেন: আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নাই। তুমি বুঝাবার কে? যাঁর জগৎ, তিনি বুঝাবেন। যিনি এই জগৎ ক’রেছেন, চন্দ্র, সূর্য, ঋতু, মানুষ, জীব-জন্তু ক’রেছেন; জীব-জন্তুদের খাবার উপায়, পালন করবার জন্য মা-বাপ ক’রেছেন, মা-বাপের স্নেহ ক’রেছেন, তিনিই বুঝাবেন। তিনি এত উপায় ক’রেছেন, আর এ উপায় ক’রবেন না? যদি বুঝাবার দরকার হয় তিনিই বুঝাবেন। তিনি ত অন্তর্যামী। যদি ঐ মাটির প্রতিমা পূজা করাতে কিছু ভুল হ’য়ে থাকে, তিনি কি জানেন না—তাঁকেই ডাকা হচ্ছে? তিনি ঐ পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। ওর জন্য তোমার মাথা ব্যথা কেন? তুমি নিজের যাতে জ্ঞান হয়, ভক্তি হয়, তার চেষ্টা কর। (ঐ) কথাগুলো নতুন মাস্টারমশায়েব কাছে, কিন্তু বুঝলেন যে, একেবারে ঠিক কথা! তাঁর অহঙ্কার এবার একেবারে চূর্ণ হল। আর কোনদিন তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তর্ক করেননি। ঠাকুরের সহিত তাঁহার এই প্রথম ও শেষ তর্ক! (ঐ)

এরপর পুরোপুরি আত্মসমর্পণ। বাড়িতে সবসময় শ্রীরামকৃষ্ণের কথাই শুধু চিন্তা করেন। আর ছুটির দিনে দক্ষিণেশ্বরে ছুটে যান। একবার পরপর দু-দিন ছুটি পড়েছে—রবিবার ও সোমবার। চতুর্থ দর্শনের ঘটনা সেটা। রবিবার দিন এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে, আবার সোমবার দিনও এসে উপস্থিত হয়েছেন। ঠাকুরের ঘরে ঢোকামাত্র ঠাকুর ঠাট্টা করে বলছেন: ঐ রে, আবার এসেছে! বলছেন: একজন একটা ময়ূরকে আফিম খাইয়ে দিয়েছিল, তার পর থেকে প্রতিদিন ঐ সময়ে ময়ূরটা আসত আফিমের নেশায়, তোমার অবস্থা ঐ ময়ূরের মতো। মার্কস ধর্মের নিন্দা করে বলেছেন: এ হচ্ছে আফিম। এক অর্থে সত্যিই ধর্ম আফিম। এর এমন নেশা, একবার যে এতে আনন্দ পেয়েছে, সে একে ছাড়তে পারে না। শুধু ঈশ্বরীয়-প্রসঙ্গ ভাল লাগে, যেখানে ঈশ্বরীয়-প্রসঙ্গ হয়, সেখানে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। ঠাকুরের আকর্ষণ ঐ আফিমের মতো, ঈশ্বরময় পুরুষ তিনি, ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করছেন সবসময়। একবার যে তাঁকে দেখেছে বা তাঁর কথা শুনেছে তার আর উপায় নেই, আবার তাকে আসতেই হবে তাঁর কাছে। মাস্টারমশায়ের সেই অবস্থা। বলছেন: বাড়িতে যাই কিন্তু দিবানিশি ইঁহার দিকে মন পড়িয়া থাকে—কখন দেখিব, কখন দেখিব। এখানে কে যেন টেনে আনলে! মনে করলে অন্য জায়গায় যাবার যো নাই, এখানে আসতেই হবে! (১-১-৯) এমনই আকর্ষণী শক্তি ঠাকুরের।

ছাত্রজীবন থেকেই মাস্টারমশায়ের ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল। ঠাকুরের কাছে যাবার পর থেকেই ঠাকুরের সাথে যেসব কথা হত, ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। তখন তিনি ভাবেননি যে, বই হিসেবে বের করবেন। নিজের জন্যই লিখে রাখতে শুরু করেছিলেন। তিনি তো ছুটির দিন ছাড়া ঠাকুরের কাছে যেতে পারতেন না। ঠাকুরের কাছে গিয়ে যা-যা শুনতেন, বাড়ি ফিরে বার, তিথি, নক্ষত্র, তারিখ দিয়ে ডায়েরীতে লিখে রাখতেন। ঠাকুরের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়িতে বসে বসে তিনি সেগুলি পড়তেন আর মনে-মনে সেসব নিয়ে চিন্তা করতেন। সাড়ে চার বছর তিনি ঠাকুরের সঙ্গ করেছেন—১৮৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঠাকুরকে প্রথম দেখলেন আর ঠাকুরের শরীর যায় ১৮৮৬-র ১৬ আগস্ট। এই সাড়ে চার বছরে যে-যে দিন তিনি ঠাকুরের কাছে গেছেন, সেসব দিনের বর্ণনা ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলেন—সংক্ষেপে, সাঙ্কেতিকভাবে। এমনভাবে, যা দেখে তিনি নিজে উদ্ধার করতে পারতেন সম্পূর্ণ দিনের বর্ণনা, অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্রীচৈতন্যের যেমন মুরারি গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের তেমনি মহেন্দ্র গুপ্ত। তিনি এই কাজের জন্য নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। মহাপুরুষ মহারাজ (স্বামী শিবানন্দ) একবার শ্রীরামকৃষ্ণের কথাবার্তা সব লিখে রাখতে শুরু করেছিলেন। ঠাকুরকে কিছু জানাননি। কিন্তু ঠাকুর নিজেই একদিন বুঝতে পেরে বললেন: ‘তোর ওসব কিছু করতে হবে না—তোদের জীবন আলাদা।’ অর্থাৎ ‘কথামৃত’-রচনার কাজ আর কারও জন্য নয়। এই কাজ মাস্টারমশায়ের জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে আছে। এই কাজের জন্য তিনি চিহ্নিত। তিনি জানতেন না, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন যে, তাঁকে এই কাজ করতে হবে। ‘কথামৃতে’ মাঝে মাঝে দেখা যায়, কোন দুরূহ প্রসঙ্গ হয়তো উঠেছে, ঠাকুর বিশেষ করে মাস্টারমশাইকে সেই প্রসঙ্গের মানে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আবার যাচাই করে দেখছেন, মাস্টারমশাই সেসব কথা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছেন কি না বা সব শুনেছেন কি না। এসব থেকে মনে হয়, শ্রীরামকৃষ্ণ আগে থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর কথামৃত মাস্টারমশাই-ই জগতে ছড়িয়ে দেবেন।

মাস্টারমশাই যে ডায়েরী লিখছেন কাউকে জানতে দেননি। গোপনে লিখতেন, গোপনেই সেসব পড়তেন, আর নিজের মনে মনে আলোচনা করতেন। বিশেষ করে ঠাকুরের শরীর যাবার পর। ঠাকুর নেই, তাই সেগুলিই তখন তাঁর একমাত্র উপজীব্য। স্বামী বিরজানন্দ বর্ণনা করছেন: তাঁরা দেখতেন, তাঁদের এই অত্যন্ত রাশভারী শিক্ষকটি ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অবসর পেলেই ছাদে চলে যান, আর সেখানে বসে একমনে কি পড়েন। ধীরে ধীরে জানাজানি হয়ে গেল, কি পড়েন তিনি। সবাই বলল: এ তো অপূর্ব জিনিস! এ ছাপা হওয়া দরকার, সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। একদিন শ্রীশ্রীমাকে পড়ে শোনালেন ‘কথামৃত’ থেকে। মা শুনে আশীর্বাদ করে বললেন: যেন ঠাকুরের কথাই শুনছি। ‘কথামৃতে’র প্রথমেই মায়ের সেই আশীর্বাণী ছাপানো রয়েছে। জয়রামবাটী থেকে মা ২১শে আষাঢ় ১৩০৪ সালে মাস্টারমশাইকে লিখছেন: ‘বাবাজীবন, তাঁহার নিকট যাহা শুনিয়াছিলে, সেই কথাই সত্য। ইহাতে তোমার কোন ভয় নাই। এক সময় তিনিই তোমার কাছে এ সকল কথা রাখিয়াছিলেন। এক্ষণে আবশ্যকমত তিনিই প্রকাশ করাইতেছেন। ঐ সকল কথা ব্যক্ত না করিলে লোকের চৈতন্য হইবে নাই, জানিবে। তোমার নিকট যে সমস্ত তাঁহার কথা আছে তাহা সবই সত্য। একদিন তোমার মুখে শুনিয়া আমার বোধ হইল, তিনিই ঐ সমস্ত কথা বলিতেছেন।’—এর থেকে বড় সার্টিফিকেট আর কিছু হতে পারে না। স্বামী ঈশানানন্দ (মায়ের অন্যতম সেবক) বলেছেন: তাঁরা শ্রীশ্রীমাকে সন্ধ্যার সময় ‘কথামৃত’ পড়ে শোনাতেন। মা শুনে বলতেন: ‘আহা! যেন সামনেই সব কথা হচ্ছে। গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠছে!’ ‘কথামৃত’ যে কতটা প্রামাণ্য, এ থেকেই বোঝা যায়। শ্রীশ্রীমা একবার বলেছিলেন: ‘এখনকার লোক সব সেয়ানা—ছবিটি তুলে নিয়েছে। এই যে মাস্টারমশাই—এরা কি কম লোক গা? যত কথা সব লিখে নিয়েছে। কোন্ অবতারের ছবি আছে, বা কথাবার্তা এই রকম করে লেখা আছে?’ আর একবার বলেছিলেন: মাস্টারই যত কথা ‘কথামৃতে’ ছাপিয়ে দিয়েছে।

‘কথামৃত’ প্রথম প্রকাশিত হয় কিন্তু ইংরেজিতে, ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে। প্রথমে ‘ব্ৰহ্মবাদিন্‌’ পত্রিকায়, পরে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ এবং অন্যান্য পত্রিকায়ও বের হতে শুরু করে। আর একই সঙ্গে বা কিছু আগে-পরে পুস্তিকার আকারেও খণ্ডে খণ্ডে বের হতে থাকে মাদ্রাজ থেকে। তার নাম হল: ‘The Gospel of Sri Ramakrishna’ (according to M., a son of the Lord and disciple), or the ideal Man for India and the World. শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলছেন: ভগবান। তারপর আরও বলছেন যে, ভারতের এবং সমস্ত জগতের তিনি আদর্শ পুরুষ। আর ‘M’ (অর্থাৎ মাস্টারমশাই) তাঁর সন্তান এবং শিষ্য।

কেউ কেউ আবার বলেন, ‘কথামৃত’ প্রথম বাংলাতেই বেরিয়েছিল। এখন যে-চেহারায় দেখি সে-চেহারায় হয়তো নয়, বা এই নামে হয়তো নয়—কিন্তু বেরিয়েছিল। কারণ দেখা যায়, স্বামীজী ১৮৮৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মাস্টারমশাইকে একটা চিঠি লিখেছেন। তাতে লিখেছেন: ‘I thank you a hundred thousand times, Master! You have hit Ramakrishna in the right point. Few, alas, few understand him! My heart leaps with joy—and it is a wonder that I do not go mad when I find anybody thoroughly launched into the midst of the doctrine which is to shower peace on earth hereafter.’—মাস্টারমশাই, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রীরামকৃষ্ণকে আপনি ঠিক ঠিক তুলে ধরেছেন। দুঃখের বিষয় খুব অল্প লোকেই তাঁকে বুঝতে পারে। যে শিক্ষা ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে শান্তিবারি-রূপে ঝরে পড়বে, তার মধ্যে যখন কাউকে সম্পূর্ণভাবে ডুবে থাকতে দেখি, তখন আমি আনন্দে প্রায় আত্মহারা হয়ে যাই—পাগল যে হয়ে যাই না, সেটাই আশ্চর্যের। অনেকে মনে করেন, ‘শ্রীম’ ঠাকুরের যেসব কথা লিখে রেখেছিলেন, তার সাহায্যে ঠাকুরের উপদেশের একটা বাংলা বই বের হয়েছিল।—তার সম্বন্ধেই স্বামীজী ঐ মন্তব্য করেছেন। তবে এটা ঠিকই, ইংরেজি কথামৃতই কিন্তু প্রথম সাড়া জাগিয়েছিল। সবাই অবাক হয়ে গেছিল—একবাক্যে বলেছিল, এ একটা অদ্ভুত জিনিস, অভূতপূর্ব! Gospel-এর প্রথম খণ্ড পড়েই স্বামীজী একটা চিঠি লিখলেন মাস্টারমশাইকে। তিনি তখন পাশ্চাত্য থেকে ফিরেছেন, উত্তর ভারত ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন; রাওয়ালপিণ্ডিতে লালা হংসরাজ বলে একজন পাঞ্জাবী-ভদ্রলোকের বাড়িতে অতিথি হয়ে আছেন। সেখান থেকে মাস্টারমশাইকে চিঠি লিখছেন: ‘Many thanks for your publication. Only, I am afraid it will not pay its way in a pamphlet form. …Never mind, pay or no pay—let it see the blaze of daylight.’ —আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আমার ভয় হচ্ছে, আপনি এত ছোট আকারে বের করেছেন—আপনার খরচ উঠবে না। তারপর অভয় দিয়ে বলছেন: দাম উঠুক বা না উঠুক, এ বের হোক, এই সত্য প্রকাশিত হোক। বলছেন: ‘You will have many blessings on you and many more curses’—আপনি অনেকের অনেক আশীর্বাদ পাবেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশী পাবেন অভিশাপ, ‘but বৈসাহি সব কাল বন্‌তা সাহেব। (that is always the way of the world, Sir.)’—দুনিয়ার নিয়মই হচ্ছে তাই। শেষে বলছেন: ‘This is the time.’ —আপনি বইটা একেবারে ঠিক সময়ে বের করেছেন, এই সময়ই বইটা বের হওয়া উচিত ছিল।

যখন Gospel-এর দ্বিতীয় ভাগ বের হল, আরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন স্বামীজী; ‘It is indeed wonderful. The move is quite original and never was the life of a great Teacher brought before the public untarnished by the writer’s mind, as you are presenting this one.’—সত্যিসত্যিই একটা আশ্চর্য জিনিস হয়েছে এটা। সম্পূর্ণ নতুন পদক্ষেপ। এর আগে অনেক আচার্য এসেছেন, জগদ্‌গুরু এসেছেন, তাঁদের যেসব বাণী সেসব লেখাও হয়েছে। কিন্তু যাঁরা সেসব লিখেছেন, তাঁবা তার মধ্যে নিজেদের কথা সংযোজন করেছেন। কিন্তু আপনি যা লিখেছেন, untarnished—এতটুকু ভেজাল নেই এর মধ্যে। ঠাকুরের কথা সম্পূর্ণভাবে ঠাকুরেরই কথা, একেবারে নির্ভেজাল—তার মধ্যে আপনার কথা আপনি যোগ করে দেননি কখনও। ‘The language also is beyond all praise, so fresh, so pointed, and withal so plain and easy.’—ভাষাও এত সুন্দর যে প্রশংসার অতীত। অত্যন্ত সজীব, সরাসরি সবকিছুর বর্ণনা করেছেন আপনি, অথচ কী সহজ এবং স্বচ্ছন্দ! ‘I cannot express in adequate terms how I have enjoyed the leaflets.’—কী ভাল যে আমার লেগেছে, আমি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তারপরে লিখছেন: ‘OurTeacher and Lord was so original, and each one of us will have to be original or nothing. I now understand why none of us attempted his life before. It has been reserved for you, this great work. He is with you evidently.’—আমাদের যিনি প্রভু, আমাদের যিনি গুরু, তিনি সব দিক দিয়েই ছিলেন মৌলিক। আমরাও যা কিছু করব, তার মধ্যে মৌলিকতার ছাপ থাকবে। তা যদি না হয়, তাহলে আমরা অপদার্থ। আমি এখন বুঝতে পারছি, কেন আমরা কেউ তাঁর জীবনী লিখতে চেষ্টা করিনি। কারণ, সেই বিরাট কাজটা আপনার জন্যেই নির্দিষ্ট ছিল। তিনি আপনার সঙ্গে আছেন সন্দেহ নেই। তিনিই আপনাকে দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। পরে ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখছেন: ‘The Socratic dialogues are Plato all over, you are entirely hidden.’—সক্রেটিস প্রাচীন গ্রীসের একজন বিরাট মনীষী। তাঁর সঙ্গে প্লেটোর সংলাপ লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সেই সংলাপের আগাগোড়াই প্লেটো। প্লেটোর কথাই বেশী এসে গেছে। সক্রেটিসকে আলাদা করে খুঁজে নেওয়া কঠিন। স্বামীজী মাস্টারমশাইকে বলছেন: এই ‘কথামৃতে’ কিন্তু আপনি সম্পূর্ণ আড়ালে রয়েছেন।—বস্তুত, এটাই ‘কথামৃতে’র সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এত নিরহংকার ‘শ্ৰীম’ যে, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া নিজেকে তিনি কোথাও প্রকাশ করেননি, লুকিয়ে রেখেছেন সবসময়। অনেক জায়গায় অনেক বর্ণনা আছে—সেগুলি তাঁরই বর্ণনা, তাঁরই ভাষা। যেমন, শ্রীরামকৃষ্ণ হয়তো সমাধিস্থ হয়েছেন, ভক্তেরা তাঁকে ঘিরে বসে আছেন—সেই দৃশ্যটা তিনি বর্ণনা করছেন। সেটা তিনি করছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ কি পরিবেশে কি পরিমণ্ডলে আছেন, সেটাকে ফুটিয়ে তুলবার জন্য। নিজের সাহিত্যশৈলী প্রকাশ করবার জন্য নয়। ‘কথামৃতে’ সাহিত্যরস অবশ্যই আছে—কিন্তু সেই রসসৃষ্টি হয়েছে তাঁর অজ্ঞাতসারে। এতে যেসব বর্ণনা আছে, সেগুলি অত্যন্ত সংযত এবং সংক্ষিপ্ত। একেবারে বাহুল্যবর্জিত। কিন্তু এমনই ‘শ্রীম’র ক্ষমতা যে দু-একটা কথার আঁচড়েই এক একটা সম্পূর্ণ চিত্র এঁকে দিয়েছেন—কি ঘটেছিল, কি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল—সবকিছুর এক একটা বাস্তব ছবি চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু খুব প্রয়োজন ছাড়া নিজেকে তিনি প্রকাশ করেননি। সব সময় যেন কত সঙ্কোচ, কত সতর্কতা—পাছে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে ছাপিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেন, পাছে শ্রীরামকৃষ্ণের এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েন। যেখানে তিনি বাধ্য হয়েছেন নিজেকে সামনে আনতে, সেখানেও তিনি নরেন, রাখাল, ভবনাথ বা আরও দশটি চরিত্রেরই একজন—তার বেশী নয়। ‘কথামৃতে’র এত মাধুর্য এইজন্যই যে, এখানে শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলো হুবহু পাচ্ছি। শ্রীরামকৃষ্ণেরই কথামৃত—গ্রন্থরচয়িতার কথা নয়।

‘কথামৃত’ যখন ইংরেজিতে বেরোতে থাকল তখন সবাই বলতে লাগল: এমন জিনিস! এ ইংরেজিতে বের না করে শ্রীরামকৃষ্ণের নিজের ভাষায় বের করলে ভাল হয়—বাংলায় বের করলে ভাল হয়। আর ‘শ্রীম’ তখন ‘তত্ত্বমঞ্জরী’, ‘উদ্বোধন’ প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলায় ‘কথামৃত’ বের করতে থাকলেন। তারপর সেইগুলি সব একত্র করে ১৯০২ সালে গ্রন্থাকারে বের হল ‘কথামৃতে’র প্রথম ভাগ। নাম হল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত—শ্রীম-কথিত’। ‘কথামৃত’ তখন কিন্তু বের হয়েছিল ‘উদ্বোধন’ প্রেস থেকে। ঠাকুরের জন্মতিথিতে বেরিয়েছিল, আর উৎসর্গ করা হয়েছিল শ্রীশ্রীমাকে। উৎসর্গ-পত্রে লেখা হয়েছিল: ‘মা, ঠাকুরের জন্ম মহোৎসব উপস্থিত। এ আনন্দের দিনে আমাদের এই নৈবেদ্য গ্রহণ করুন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত আমাদের এই নূতন নৈবেদ্য। আশীর্বাদাকাঙ্ক্ষী আপনার প্রণত অকৃতী সন্তানগণ। তারিখ, ১লা ফাল্গুন, ১৩০৮ (১৯০২)।’ তারপর ধীরে ধীরে অন্য খণ্ডগুলিও বের হল। পঞ্চম এবং শেষ খণ্ড বের হল ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে ‘শ্রীম’র দেহত্যাগের কিছুদিন পরে।

বাংলা ‘কথামৃত’ যখন পাঁচ খণ্ডে বেরিয়ে গেল, তখন সমস্ত ‘কথামৃত’ ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন স্বামী নিখিলানন্দ—নিউইয়র্ক থেকে বের হল সেই বই। আর তার ভূমিকা লিখলেন Aldous Huxley। খুব নামকরা সাহিত্যিক। ‘কথামৃত’ সম্পর্কে সেই ভূমিকাতে তিনি লিখেছেন: ‘…a book unique, …in the literature of hagiography.’ —জীবনী-সাহিত্যে এরকম বই আর নেই, কোন দেশে, কোন ভাষার সাহিত্য আমি এরকম বই দেখিনি। আর একটা কথা তিনি বললেন যে, ‘photographic detail’—ফটোতে যেমন সব তুলে ধরে, সেরকম। ফটো মিথ্যে কথা বলে না। সেইরকম নিখুঁতভাবে ‘শ্রীম’ ঠাকুরকে তুলে ধরেছেন। আর একটা খুব মূল্যবান কথা বলেছেন Aldous Huxley যে, এই প্রথম কোন অবতার পুরুষের কথা, বা কোন মহাপুরুষের কথা যেমন যেমন ভাবে তিনি বলেছেন; সেইভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে রইল। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, চৈতন্য এঁদের যেসব কথা পাই, সেগুলি লেখা হয়েছে তাঁরা চলে যাওয়ার অনেক পরে। তাঁদের উপদেশ বা বাণী হিসেবে যেগুলি পাই, তার মধ্যে অন্যের কথা ঢুকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ- কথামৃতে’ সে অবকাশ নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ থেকে ‘শ্রীম’ যেদিন যা শুনেছেন, সেদিনই বাড়ি গিয়ে সেগুলি লিখে রেখেছেন। খুব তীক্ষ স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর। কাজেই, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আর এই কথাগুলি যে সত্য, আর একটা জিনিস থেকে বোঝা যায়। ‘কথামৃত’ প্রকাশ হওয়ার আগে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজ থেকে ঠাকুরের কিছু কিছু উপদেশ প্রকাশ করেন। আরও কেউ কেউ প্রকাশ করলেন। এঁদের সবাই যে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সববিষয়ে একমত, তা নন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের যেসব উপদেশ বের করেছেন, ‘শ্রীম’র ‘কথামৃতে’ও সে সব আছে। এগুলিই প্রমাণ করে যে, ‘শ্রীম’ ঠাকুরকে যেমন দেখেছেন, বা ঠাকুরের কথা যেমন শুনেছেন তাঁর মুখ থেকে—তা-ই বর্ণনা করে গেছেন। তবে ভাষা এবং পরিবেশনের ভঙ্গি আলাদা। ‘শ্রীম’র উপস্থাপনা অনেক সহজ সরল। ঘরোয়া ভঙ্গিতে ঠাকুরকে উপস্থাপিত করেছেন। ঠাকুরকে সেখানে অনেক বেশী বাস্তব মনে হয়। চোখের সামনে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছেন। চলচ্চিত্র যেন। যেমন তিনি সমাধিস্থ হচ্ছেন দেখছি, যেমন তিনি গান গাইছেন দেখছি, যেমন তাঁকে ভক্তদের সাথে নৃত্য করতে দেখছি, তেমনি দেখছি তিনি রঙ্গরস করছেন, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বেড়াচ্ছেন, ঝাউতলার দিকে যাচ্ছেন, কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ারগাড়ি করে ঘুরছেন, আবার হল-এ বসে থিয়েটার দেখছেন। একটা জীবন্ত চরিত্র।

‘কথামৃতে’র শ্রীরামকৃষ্ণ জীবন্ত। স্থূলদেহেই যেন আছেন—হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, কথা বলছেন। শ্ৰীম-কথিত ‘কথামৃতে’র চরিত্র সম্পর্কে রোমাঁ রোলাঁ তাই বলছেন :’Their exactitude is almost stenographic.’—স্টেনোগ্রাফার যেমন, যা কিছু বলা হয় হুবহু তা-ই লিখে নেয়—একটি শব্দও বাদ দেয় না, আবার যোগও দেয় না; ‘শ্রীম’-ও তা-ই করেছেন। ঠাকুর যা যা বলেছেন, তা-ই লিখে নিয়েছেন। একটি কথাও বাদ দেননি, নিজের একটি কথাও ঠাকুরের কথার সঙ্গে যোগ করেননি। একেবারে শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের কথা পাচ্ছি ‘কথামৃতে’।

বাংলায় ‘কথামৃত’ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক পণ্ডিত ব্যক্তিরা এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। নগেন্দ্রনাথ ঘোষ সেই সময়কার একজন নামকরা পণ্ডিত। তিনি ‘ইণ্ডিয়ান নেশন’ পত্রিকায় (১৯ মে, ১৯০২) লিখলেন: ‘Ramakrishna Kathamrita by M., Part I, is a work of singular value and interest. …He has done a kind of work which no Bengalee had ever done before, which, so far as we are aware, no native of India had ever done. It has been done only once in history, namely by Boswell. …But then the immortal biography is only the life of a scholar and a kindhearted man. This Kathamrita, on the other hand, is the record of the sayings of a Saint. What is the wit or even the worldly wisdom of the great Doctor by the side of the divine teachings of a genuine devotee? …Its value is immense. We say nothing of the sayings themselves, for the character of the teacher and the teaching is well-known. They take us straight to the truth, and not through any metaphysical maze.’ —এ একটা অনন্য জিনিস। যতদূর জানি, এরকম কাজ এর আগে আর কোন বাঙালী বা ভারতবাসী করেননি। এমন কি পৃথিবীর ইতিহাসেও এ রকম কাজ একবারই মাত্র হয়েছে, আর তা করেছেন বসওয়েল।—বসওয়েল ডক্টর জনসনের জীবনী রচনা করেছিলেন। কিন্তু তারপরে নগেন্দ্রনাথ ঘোষ আবার বলছেন: বসওয়েলের থেকেও ‘শ্রীম’র কৃতিত্ব বেশী। কারণ, বসওয়েল যাঁর জীবনী রচনা করেছেন, সেই জনসন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। বড়জোর একজন সদাশয় ব্যক্তি। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ একজন বিরাট সাধু ও ভক্ত। তাঁর উপদেশের পাশে জনসনের কথাবার্তা—তার মধ্যে যতই বুদ্ধির ছাপ থাকুক, যতই পাণ্ডিত্য থাকুক—কিছুতেই দাঁড়াতে পারে না। কাজেই ‘কথামৃতে’র উৎকর্ষ আরও বেশী। তারপর বলছেন: ‘Their style is Biblical in its simplicity. What a treasure would it have been to the world if all the sayings of SriKrishna, Buddha, Jesus, Mahomet, Nanak and Chaitanya could have been thus preserved!’—বাইবেলের মতো সহজ ভঙ্গি ‘কথামৃতে’র। শ্রীরামকৃষ্ণের কথাগুলো যেভাবে ‘শ্রীম’ ধরে রেখেছেন, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, নানক, চৈতন্য এঁদের সব কথাগুলিও যদি ঠিক এইভাবে ধরে রাখা থাকত, তাহলে পৃথিবীর মানুষের কাছে তা কত বড় সম্পদ হত।

সেই সময়কার আর একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তিনি বলছেন ‘কথামৃত’ সম্বন্ধে: ‘The Gospel of Ramakrishna Paramahansa is a record taken at first hand. The words were taken down as they came fresh from the lips of the Master.’—শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ থেকে যা যা বেরিয়েছে, তা-ই সরাসরি লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সেইগুলিই আছে ‘কথামৃতে’। ‘His spoken words are available to all almost just as he uttered them.’—তাঁর উপদেশগুলি প্রায় হুবহু তিনি যেমন যেমন বলেছিলেন সেইরকম অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

বাস্তবিক, ‘কথামৃত’ ধর্ম-সাহিত্যে একটা অতুলনীয় সম্পদ। এরকম দ্বিতীয় একটি বই আমরা দেখতে পাই না। অবশ্য শ্রীরামকৃষ্ণের সব উপদেশই ‘কথামৃতে’ নেই। তাঁর অন্যতম ত্যাগী-সন্তান স্বামী সারদানন্দ তাঁর যে জীবনী লিখলেন, ‘লীলাপ্রসঙ্গ’, তাতে এমন অনেক কিছু আছে যা ‘কথামৃতে’ নেই। তার একটা কারণ হল, ‘শ্ৰীম’ তো রোজ যেতেন না ঠাকুরের কাছে—ছুটির দিনে শুধু যেতেন। কাজেই, ঠাকুরের অনেক উপদেশই তিনি শোনার সুযোগ পাননি। আর একটা কারণ হল, ঠাকুর যখন তাঁর ত্যাগী-সন্তানদের উপদেশ দিতেন, নিভৃতে দিতেন। অন্যদের সামনে দিতেন না। কারণ, তাঁদের জীবন আলাদা, তাঁদের জন্য আলাদা পথ। তাঁদেরকে যা বলা চলে, অন্যদের তা বলা চলে না। যার পেটে যা সায়। তাঁদেরকে ঠাকুর অনেক কথা বলেছেন, যা ‘শ্ৰীম’ জানতে পারেননি—তাঁরাই শুধু জানতেন সে সব কথা। মহাপুরুষ মহারাজ, বাবুরাম মহারাজ, এঁরা সেইজন্য বলতেন: অনেক কথা ‘কথামৃতে’ নেই। সেজন্য ‘কথামৃত’ যেমন আমাদের পড়া উচিত, সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজীর রচনাবলী, ‘লীলাপ্রসঙ্গ’, ঠাকুরের অন্যান্য ত্যাগী-সন্তানদের কথোপকথন, পত্রাবলী এসবও পড়া দরকার। বিশেষ করে স্বামীজীর রচনাবলী। কারণ, স্বামীজী হচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষ্য। এই দুটো যদি একসাথে পড়ি তাহলেই শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ সম্বন্ধে আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাব। কেউ যেন এ থেকে মনে না করেন যে, ‘কথামৃত’কে ছোট করছি। কখনই আমরা তা করতে পারি না। স্বামী বিজ্ঞানানন্দ ‘শ্রীম’কে বলেছিলেন, ‘অনুসন্ধানের পর আমি এই সিদ্ধান্ত করেছি যে শতকরা আশিজন বা তারও বেশী সন্ন্যাসী কথামৃত পাঠ করে এবং আপনার সান্নিধ্যে এসে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেছেন।’ বাস্তবিক, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অনেক সন্ন্যাসীই ‘কথামৃত’ পড়েই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হন। অনেক বিদেশী বা অবাঙালী সাধু বাংলা শেখেন শুধুমাত্র ‘কথামৃত’ পড়বেন বলে। যাঁরা সন্ন্যাসী নন তাঁদের সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। কোনোভাবেই ‘কথামৃতে’র মূল্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না। দিন দিন এর আবেদন বাড়ছে, এবং বাড়বেও। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে এই বই। ‘কথামৃত’ বের হওয়ার পর প্রথম ভাগের সতেরোটি সংস্করণ হয়েছে আর তার সপ্তদশ সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে সতেরোবার। দ্বিতীয় ভাগের এগারোটি সংস্করণ হয়েছে, একাদশ সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে সতেরোবার। তৃতীয় ভাগের নটি সংস্করণ হয়েছে—সেই নবম সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে পনেরবার। চতুর্থ ভাগের নটি সংস্করণ হয়েছে, নবম সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ হয়েছে তেরবার। পঞ্চম ভাগের ছটি সংস্করণ এবং ষষ্ঠ সংস্করণের চোদ্দবার পুনর্মুদ্রণ।*

এই প্রসঙ্গে আর একটি ‘ঘটনা’র উল্লেখ করা উচিত বলে মনে করি। ‘কথামৃত ভবন’ প্রকাশিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থের কপিরাইটের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে। তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ‘কথামৃত’ প্রকাশের জন্য ছোট, বড়, মাঝারি অনেক প্রকাশন-সংস্থা কাজ শুরু করে দেন। ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি কমপক্ষে গোটা ছয়েক প্রকাশন-সংস্থা বিভিন্ন আকারে ‘কথামৃত’ প্রকাশ করেন। তার অল্পদিনের মধ্যে আরও গোটা দশেক প্রকাশন-সংস্থা ‘কথামৃত’ প্রকাশ করেন। আশ্চর্যের কথা, সব প্রকাশকের বই-ই—যার সংখ্যা কয়েক লক্ষ হবে—কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রী হয়ে যায়। আর এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে ‘কথামৃত ভবন’ থেকে প্রকাশিত ‘কথামৃতে’র বিক্রীও। কে কত কম দামে লোকের হাতে বইটি দিতে পারে সে নিয়ে প্রকাশকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ‘কথামৃত ভবনে’র পাঁচ খণ্ডের দুরকম বাঁধানো ‘কথামৃতে’র দাম যথাক্রমে ষাট ও সত্তর টাকা। অন্যান্য প্রকাশকরা কেউ সম্পূর্ণ ‘কথামৃতে’র দাম করে দেন পনের, কেউ কুড়ি, কেউ পঁচিশ। আবার কেউ বা ঘোষণা করে বসলেন যে সম্পূর্ণ ‘বিনামূল্যে’ বইটি দেবেন তাঁরা। তার জন্যে মাত্র আঠারো টাকা দিয়ে একটি ‘স্থায়ী সদস্য কার্ড’ সংগ্রহ করে নিতে হবে। এর ফলে বিনামূল্যে সম্পূর্ণ ‘কথামৃত’ ছাড়া সদস্যরা সংশ্লিষ্ট প্রকাশন-সংস্থার যাবতীয় গ্রন্থ আজীবন বিশেষ আকর্ষণীয় কমিশনে পাবেন। এত সব সত্ত্বেও কিন্তু ‘কথামৃত ভবনে’র বই-এর চাহিদা এবং বিক্রী কিছুমাত্রও কমেনি। কলেজ স্ট্রীট পাড়ায় ‘কথামৃত’ নেবার জন্যে এত ভিড় হয়েছিল যে তা সামলাতে পুলিশ ডাকতে হয়েছে, কোথাও কোথাও লাঠিও চালাতে হয়েছে। প্রকাশক এবং পুস্তক-ব্যবসায়ীরা বলেছেন: ‘একটি ধর্মগ্রন্থের জন্য এমন উন্মাদনা নজির বিহীন।’ ‘কথামৃতে’র এই ‘বিক্রয় বিস্ফোরণ’ নিয়ে সংবাদপত্রে অনেক লেখালিখিও হয়েছে। ১৯৮৩ সালে কলকাতার অষ্টম বইমেলায়ও দেখা গেল ‘কথামৃতে’র অসাধারণ চাহিদা ও জনপ্রিয়তা। কোচিনের ‘The Week’ পত্রিকায় (মার্চ ১৩-১৯, ১৯৮৩ সংখ্যায়) ‘Ramakrishna outsells Marx’—এই নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধকার সেখানে লিখেছেন: ‘In just 45 days, the publishers of the religious book have sold 2.5 lakh copies worth Rs. 45 lakh and are all set to touch the Rs 1 crore mark within the next two months. The sale of Kathamrita from January 1 to February 14 surpassed the total sale of Marxian literature in West Bengal in the last three years.’ শোনা যায় যে অষ্টম বইমেলায় যত বই বিক্রী হয়েছে তার শতকরা পঁচাত্তর ভাগই ধর্মমূলক বই এবং এর প্রায় সমস্তটাই ‘কথামৃত’।

এ তো গেল শুধু বাংলা ‘কথামৃতে’র কথা। দেশী-বিদেশী আরও কত ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। সেসবেরও কত সংস্করণ বের হচ্ছে। সব ভাষাতেই এর বিপুল সমাদর। সম্ভবত আর কোন ধর্মগ্রন্থ এত জনপ্রিয় হয়নি। এর প্রধান কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণের উদার মত। তিনি কোন ধর্মমতকে ছোট করেননি, আবার কোন ধর্মমতকে অতিরিক্ত প্রাধান্যও দেননি। সব মতেরই সার্থকতা আছে। ‘যত মত তত পথ’। ঈশ্বর যেমন অনন্ত, তাঁকে পাওয়ার পথও তেমনি অনন্ত। যে-কোন একটা পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। যার যেটা ভাল লাগে। পথ মুখ্য নয়, ঈশ্বর লাভই মুখ্য। যো সো করে ঈশ্বরকে পেতে হবে—সেটাই মুখ্য। এই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা। ‘কথামৃতে’র মধ্যে ধর্মের যা সারকথা তা পাওয়া যায়। কোন বিশেষ ধর্মের নয়—সব ধর্মের। তাই সর্বধর্মের মানুষ এই গ্রন্থ পড়ে আনন্দ পায়। শ্রীরামকৃষ্ণ নানা জনের কাছে নানা ভাবে কথা বলতেন। তিনি তরুণ ছাত্রদের কাছে একভাবে বলেছেন, খ্রীষ্টান মিশনারীদের কাছে আর একভাবে বলেছেন, সংসারী ব্রাহ্মদের কাছে ভিন্নভাবে। জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম—সকল প্রকার কথা। যাঁরা ‘কথামৃত’ খুঁটিয়ে পড়েছেন তাঁরা দেখবেন, এর মধ্যে ভক্তির কথা যেমন আছে জ্ঞানের কথাও প্রচুর আছে—বেদান্তের কথা। এর মধ্যে দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদ আছে, সাকার-নিরাকার আছে, শাক্ত-বৈষ্ণব আছে, যোগ-তন্ত্র আছে, নানারকমের লৌকিক ধর্মও আছে। বস্তুত শ্রীমায়ের ভাষায় বললে, হাঁচি-টিকটিকি থেকে আরম্ভ করে একেবারে অদ্বৈতবাদ পর্যন্ত সব আছে। ‘কথামৃতে’র মধ্যে গভীর তত্ত্বকথা আছে, কিন্তু তা বলা আছে অত্যন্ত সহজ ও সরস ভঙ্গিতে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রত্যক্ষ জ্ঞানের আলোকে যা দুর্জ্ঞেয় তাকে স্পষ্ট ও সহজবোধ্য করে তুলেছেন। বাংলা ভাষার, বিশেষ করে, কথ্য বাংলার কি শক্তি তা দেখিয়ে গেছেন। নতুন বাংলাভাষা সৃষ্টি করে গেছেন বলা যেতে পারে। ধর্ম ও দর্শনের কথা যে এত সহজ ভাষায় বলা যায় তাঁর আগে ধারণাতীত ছিল। বলছেন, হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙো। আবার বলছেন, কচ্ছপ যখন চরতে বেরোয়, তখন মনটা আড়ায় রেখে দেয়, কেননা আড়ায় তার সন্তান রয়েছে। তেমনি মনটা তুমি ভগবানের দিকে রেখে সংসার কর। এইভাবে শাস্ত্রের কথাই শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন ছোট ছোট উপমা দিয়ে, আর আমাদের কাছে অর্থটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্র বলছে, ‘তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি’। তাঁর আলোতেই সবকিছু প্রকাশমান। তিনি থাকলে সব থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন: কিরকম জান? এক লিখে তার পিঠে শূন্য দাও, দশ হবে, আর একটা শূন্য দাও—একশ, আর একটা শূন্য—হাজার। শূন্য যতই দিচ্ছ অঙ্ক বাড়ছে। কিন্তু যেই ‘এক’টা মুছে ফেললে—সব শূন্য, এতগুলি শূন্য সব বৃথা। তেমনি ঈশ্বর যদি থাকেন সব আছে, নইলে কিছু নেই। কী সব উপমা! কী সব গল্প! বলা হয় ‘উপমা কালিদাসস্য’। অর্থাৎ উপমায় কালিদাস অতুলনীয়। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ কালিদাসকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর উপমার শেষ নেই। আর তার বৈচিত্র্যই বা কত! তাই একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-শিল্পী অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলছেন: ‘উপমা রামকৃষ্ণস্য’। সৈয়দ মুজতবা আলীও একই কথা বলেছেন। সব ধর্মগুরুই উপমা ও গল্প দিয়ে তাঁদের বাণী প্রচার করে গেছেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মতো এমনটি আর কাউকে দেখি না। তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার। আর একটা জিনিস উল্লেখযোগ্য—যা তিনি বলেছেন, সব শাস্ত্রের কথা। নিজের ভাষায়, নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেছেন—কিন্তু সব শাস্ত্রের কথা। কেউ যদি মিলিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন যে তাঁর সব কথাই উপনিষদ্, গীতা, ভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃতে আছে। বস্তুত এই গ্রন্থগুলিই হিন্দুর শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রগ্রন্থ। বহু পুরাণের কাহিনীও ‘কথামৃতে’ আছে। এককথায় ‘কথামৃত’ সর্বশাস্ত্ৰসারসংগ্রহ। সমস্ত শাস্ত্র মন্থন করে যে অমৃত শ্রীরামকৃষ্ণ তুলেছেন, তা রয়েছে এই গ্রন্থে। ‘শ্রীম’ সেই অমৃতভাণ্ড আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কোনদিনও আমরা তাঁর ঋণ শোধ করতে পারব না।

শ্রীম’কে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে অনেকে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হয়েছেন, অনেকের জীবনের গতি একেবারে পালটে গেছে। আমরা ছাত্রাবস্থায় খুব যেতাম তাঁর কাছে, সাধু হওয়ার পরও গেছি। তখন তিনি মর্টন ইনস্টিটিউশনের উপরতলায় থাকতেন। আমরা তাঁর কাছে বসে আছি, তিনি হয়তো জিজ্ঞেস করলেন: আজ কত তারিখ, কি বার? আমরা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শুরু করতেন: এরকম একটা দিনে ঠাকুর এই বলেছিলেন—বলে যেতে লাগলেন ঠাকুরের কথা। তিনি যে আমাদের শোনানোর জন্য বলছেন তা নয়। নিজের মনে স্মৃতিচারণ করছেন, যেন ধ্যানের গভীর থেকে কথাগুলো বলছেন—আমরা যদি শুনি, ভাল, না শুনলেও তাঁর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি বলে যাচ্ছেন নিজের আনন্দে। আর লক্ষ্য করতাম তাঁর বর্ণনা করার ক্ষমতা—‘কথামৃতে’ও তার পরিচয় পাই। দু-একটা কথা বলতেন, তাতেই একটা চিত্র ফুটে উঠত—একটা বাস্তব ছবি আমরা চোখের সামনে দেখতে পেতাম। অদ্ভুত মানুষ ছিলেন! দেখলেই বোঝা যেত, অসাধারণ। ‘শ্রীম’ সম্বন্ধে পল ব্রানটন তাঁর ‘ইন সার্চ অব সিক্রেট ইণ্ডিয়া’ বইতে বলছেন: তাঁকে যখন দেখলাম মনে হল, বাইবেলের পৃষ্ঠা থেকে যেন একজন ধর্মযাজক আমার সামনে নেমে এসেছেন। ঋষিসুলভ ব্যক্তি ছিলেন ‘শ্রীম’। ঋষিই ছিলেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণময় পুরুষ।

‘কথামৃতে’র শুরুতেই আমরা একটা শ্লোক লেখা দেখি। ভাগবত থেকে নেওয়া। শ্লোকটি হল এই:

তব কথামৃতম্‌ তপ্তজীবনম্ কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততম্‌ ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ ॥ (১০/৩১/৯)

‘তব কথামৃতম্’ —তোমার কথা অমৃতের সমান। ‘তপ্তজীবনম্‌’ — ত্রিতাপদগ্ধ মানুষের প্রাণে তোমার কথামৃত সঞ্জীবনী সুধা সিঞ্চন করে, শান্তিবারি বর্ষণ করে, মানুষের সমস্ত জ্বালা দূর করে দেয়। কতরকমের দুঃখ-তাপে আমরা ক্লিষ্ট। সংসারতাপে তপ্ত মানুষের প্রাণ। তোমার কথায় মনে শান্তি পাওয়া যায়, সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়। ‘কবিভিরীড়িতম্‌’—কবি অর্থাৎ যাঁরা জ্ঞানী, তাঁরা তোমার বাণীকে স্তুতি করেন, প্রশস্তি করেন। ‘কল্মষাপহম্‌’। কল্মষ অর্থাৎ মলিনতা। মনের সবচেয়ে বড় মলিনতা অজ্ঞানতা। তোমার কথা, ভগবানের কথা মানুষের সেই অজ্ঞানতা ‘অপহত’ করে, দূর করে দেয়। ‘শ্রবণমঙ্গলম্‌’—তোমার কথা শুনলেই জীবের মঙ্গল হয়। ‘শ্রীমদ্‌’—শ্ৰীযুক্ত, সুষমাযুক্ত, সৌন্দর্যমণ্ডিত। ঈশ্বরের কথায় এমন সুষমা, এমন সৌন্দর্য যে, তা সহজেই আমাদের মন কেড়ে নেয়। ‘আততম্‌’—বিস্তৃত। শেষ নেই তোমার কথার। ‘ভুবি’—ভূমণ্ডলে। ‘গৃণন্তি’—গান করেন, স্তুতি করেন বা বলেন যাঁরা। ‘ভূরিদা জনাঃ’—তাঁরাই প্রকৃত দানবীর। কারা ভূরিদা? কারা সবচেয়ে বড় দাতা? যারা টাকাকড়ি ধনদৌলত দান করে তারা নয়। পৃথিবীতে তাঁরাই বড় দাতা যাঁরা ঈশ্বরীয় কথা প্রচার করেন, ঈশ্বরের নাম-মাহাত্ম্য কীর্তন করেন। শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে ভাগবতের এই শ্লোকটিকে ‘শ্ৰীম’ ব্যবহার করেছেন ঠাকুরের সম্বন্ধে। ঠাকুরের কথাকে তিনি বলছেন: অমৃত। কেন অমৃত? কারণ, এই কথা আমাদের মৃত্যুর পারে নিয়ে যায়। শুধু মৃত্যুর পারেই নয়, জন্মেরও পারে। জন্মমৃত্যুর পরপারে চলে যাই আমরা, মোক্ষ লাভ করি—যদি এই কথা শুনি, এই কথা অনুযায়ী জীবন যাপন করি। সেইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণের কথা অমৃত। ‘শ্রীম’ সেই অমৃত মানুষকে পরিবেশন করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একটা গানে বলা হচ্ছে: বঙ্গ-হৃদয় গোমুখী হইতে করুণা-গঙ্গা বহিয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ করুণার গঙ্গা। তাহলে ‘শ্রীম’ হচ্ছেন ভগীরথ—সেই করুণাধারা ঘরে ঘরে বয়ে দিলেন তিনি। আজও ‘শ্রীম’ সেই কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর ‘কথামৃতে’র মধ্যে দিয়ে। অত্যন্ত লাজুক-প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ‘কথামৃতে’ নিজেকে লুকিয়ে রাখবার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি, সফল হননি। নিজেকে মুছে দিতে গিয়েই তিনি অমর হয়ে গেছেন। যতদিন শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের হৃদয়ে থাকবেন, যতদিন জগতে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর প্রয়োজনীয়তা থাকবে, ততদিন ‘শ্রীম’ও থাকবেন আমাদের মধ্যে।

আকর-তালিকা

 । ‘কথামৃত’, ৪র্থ ভাগ, ১ম সংস্করণের নিবেদন দ্রষ্টবা।

 । New Testament, St. Luke, Chapter 11, Verse 9 (The Holy Bible, Authorized or King James Version, 1948)

 । মায়ের কথা, ২য় ভাগ, পৃঃ ৯৮

 । C. W., Vol. VI, 1978, pp. 412-13

 । Letters, 1970, p. 372

 । The Life of Ramakrishna, Romain Rolland, 1970, p. 300

 । Seven, Noble Lives, Nagendranath Gupta, Published by Hind Kitabs Limited Publishers, Bombay, 1950, pp. 71-2, Article: Ramakrishna Paramahansa

 । কবি শ্রীরামকৃষ্ণ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ১৩৬০, পৃঃ ১৬

 । সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, ২য় খণ্ড, ১৩৮১, পৃঃ ৩২২

* মাস্টারমশাই ‘ ঁফলহারিণী কালিকা-পূজার পরদিবস ১৯৩২ খ্রীঃ ৪ঠা জুন সকালে সাড়ে ছয়টার সময় শ্রীগুরুপাদপদ্মে মিলিত হন। পূর্বরাত্রি নয়টায় ‘কথামৃত’ পঞ্চম ভাগের প্রুফ দেখিতে দেখিতেই হাতের স্নায়ুশূলের অসহ্য যন্ত্রণা আরম্ভ হয় এবং প্রাতঃকালে “মা, গুরুদেব, আমাকে কোলে তুলে নাও” বলিতে বলিতে তিনি চিরনিদ্রায় চক্ষু নিমীলিত করেন।’ (ভক্তমালিকা, ২য় ভাগ, পৃঃ ২৩৪-৩৫)

* রামলাল হচ্ছেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুস্পুত্র, দক্ষিণেশ্বরেই আছেন তখন, কালীমন্দিরের পূজারী।

* এই হিসাব ‘কথামৃত ভবন’ থেকে প্রকাশিত সংস্করণের—১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *