শ্রীকান্ত
তৃতীয় পর্ব
এক
একদিন যে ভ্রমণকাহিনীর মাঝখানে অকস্মাৎ যবনিকা টানিয়া দিয়া বিদায় লইয়াছিলাম, আবার একদিন তাহাকেই নিজের হাতে উদ্ঘাটিত করিবার আর আমার প্রবৃত্তি ছিল না। আমার সেই পল্লীগ্রামের যিনি ঠাকুরদাদা তিনি যখন আমার সেই নাটকীয় উক্তির প্রত্যুত্তরে শুধু একটু মুচকিয়া হাসিলেন এবং রাজলক্ষ্মীর ভূমিষ্ঠ প্রণামের প্রত্যুত্তরে শুধু যেভাবে শশব্যস্তে দুই পা হটিয়া গিয়া বলিলেন, তাই নাকি? আহা, বেশ বেশ—বেঁচেবর্তে থাকো! বলিয়া সকৌতুকে ডাক্তারটিকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইয়া গেলেন, তখন রাজলক্ষ্মীর মুখের যে ছবি দেখিয়াছিলাম সে ভুলিবার বস্তু নয়, ভুলিও নাই; কিন্তু ভাবিয়াছিলাম সে আমারই একান্ত আমার—বহির্জগতে তাহার যেন কোন প্রকাশ কোনদিনই না থাকে—কিন্তু এখন ভাবিতেছি, এ ভালই হইল যে, সেই বহুদিবসের বন্ধ দুয়ার আবার আমাকে আসিয়াই খুলিতে হইল। যে অজানা রহস্যের উদ্দেশে বাহিরের ক্রুদ্ধ সংশয় অবিচারের রূপ ধরিয়া নিরন্তর ধাক্কা দিতেছে—এ ভালই হইল যে, সেই অবরূদ্ধ দ্বার নিজের হাতেই অর্গলমুক্ত করিবার অবকাশ পাইলাম।
ঠাকুরদাদা চলিয়া গেলেন। রাজলক্ষ্মী ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া একটুখানি নিষ্ফল হাসির চেষ্টা করিয়া বলিল, পায়ের ধূলা নিতে গিয়ে আমি তাঁকে ছুঁয়ে ফেলতুম না; কিন্তু কেন তুমি ও কথা বলতে গেলে? তার ত কোন দরকার ছিল না! এ শুধু—
বাস্তবিক এ শুধুই কেবল আপনাদের আপনি অপমান করিলাম। ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না। বাজারের বাইজী অপেক্ষা বিধবা-বিবাহের পত্নী যে ইঁহাদের কাছে কত উচ্চ আসন পায় না—সুতরাং নীচেই নামিলাম, কাহাকেও এতটুকু তুলিতে পারিলাম না, এই কথাটাই বলিতে গিয়া রাজলক্ষ্মী আর শেষ করিতে পারিল না।
সমস্তই বুঝিলাম। আর এই অবমানিতার সম্মুখে বড় কথার আস্ফালন করিয়া কথা বাড়াইতে প্রবৃত্তি হইল না। যেমন নিঃশব্দে পড়িয়াছিলাম, তেমনি নীরবেই পড়িয়া রহিলাম।
রাজলক্ষ্মী অনেকক্ষণ পর্যন্ত আর একটা কথাও কহিল না, ঠিক যেন আপনার ভাবনার মধ্যে মগ্ন হইয়া বসিয়া রহিল; তার পরে সহসা অত্যন্ত কাছে কোথাও ডাক শুনিয়া যেন চমক ভাঙ্গিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রতনকে ডাকিয়া কহিল, গাড়িটা শীগ্গির ঠিক করতে বলে দে রতন, নইলে সেই রাত্রি এগারটার ট্রেনে আবার যেতে হবে। কিন্তু সে হলে কিছুতেই চলবে না—ভারি হিম লাগবে।
মিনিট-দশেকের মধ্যেই রতন আমার ব্যাগটা লইয়া গাড়ির মাথার তুলিয়া দিল এবং আমার শোবার বিছানাটা বাঁধিয়া লইবার ইঙ্গিত জানাইয়া নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন হইতে আর আমি একটা কথাও কহি নাই, এখনও কোন প্রশ্ন করিলাম না। কোথা যাইতে হইবে, কি করিতে হইবে, কিছুই জিজ্ঞাসা না করিয়া নিঃশব্দে উঠিয়া ধীরে ধীরে গাড়িতে গিয়া বসিলাম।
দিনকয়েক পূর্বেই এমনি এক সন্ধ্যাবেলায় নিজের বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিলাম। আজ আবার তেমনি এক সায়াহ্নবেলায় নীরবে বাটী হইতে বাহির হইয়া গেলাম। সেদিনও কেহ আদর করিয়া গ্রহণ করে নাই, আজিও কেহ সস্নেহে বিদায় দিতে অগ্রসর হইয়া আসিল না। সেদিনও এমনিই ঘরে ঘরে তখন শাঁখ বাজিতে আরম্ভ করিয়াছিল, এমনিই বসুমল্লিকদের গোপাল-মন্দির হইতে আরতির কাঁসরঘণ্টার রব অস্পষ্ট হইয়া বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছিল। তথাপি সেদিনের সঙ্গে আজিকার প্রভেদটা যে কত বড়, সে কেবল আকাশের দেবতারাই দেখিতে লাগিলেন।
বাঙ্গলার এক নগণ্য পল্লীর জীর্ণ ভগ্ন গৃহের প্রতি মমতা আমার কোনকালেই ছিল না, ইহা হইতে বঞ্চিত হওয়াকেও ইতিপূর্বে আমি ক্ষতিকর বলিয়া কোনদিনই বিবেচনা করি নাই; কিন্তু আজ যখন নিতান্ত অনাদরের মধ্য দিয়াই এই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া চলিলাম, কোনদিন কোন ছলে ইহাতে আবার কখনো প্রবেশ করিব তাহার কল্পনা পর্যন্ত যখন মনে স্থান দিতে পারিলাম না, তখনই এই অস্বাস্থ্যকর সামান্য গ্রামখানি একেবারে সকল দিক দিয়া আমার চোখের উপর অসামান্য হইয়া দেখা দিল; এবং যে গৃহ হইতে এইমাত্র নির্বাসিত হইয়া আসিলাম, আমার সেই পিতৃ-পিতামহের জীর্ণ মলিন আবাসখানির প্রতি আজ যেন আর লোভের অবধি রহিল না।
রাজলক্ষ্মী নীরবে প্রবেশ করিয়া আমার সম্মুখের আসনটি গ্রহণ করিল এবং বোধ হয় কদাচিৎ কোন পরিচিত পথিকের অশোভন কৌতূহল হইতে সম্পূর্ণ আত্মগোপন করিতেই গাড়ির এককোণে মাথা রাখিয়া দুই চক্ষু মুদ্রিত করিল।
রেলস্টেশনের উদ্দেশে আমরা যখন যাত্রা করিলাম তখন সূর্যদেব বহুক্ষণ অস্ত গিয়াছেন। আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথের দুই ধারে যদৃচ্ছা-বর্ধিত বঁইচি, শিয়াকুল এবং বেতবন সঙ্কীর্ণ পথটিকে সঙ্কীর্ণতর করিয়াছে এবং মাথার উপর আম-কাঁঠালের ঘন সারি শাখা মিলাইয়া স্থানে স্থানে সন্ধ্যার আঁধার যেন দুর্ভেদ্য করিয়া তুলিয়াছে। ইহার ভিতর দিয়া গাড়ি যখন অত্যন্ত সাবধানে অত্যন্ত মন্থর গমনে চলিতে লাগিল, আমি তখন দু’চক্ষু মেলিয়া সেই নিবিড় অন্ধকারের ভিতর দিয়া কত কি যেন দেখিতে লাগিলাম। মনে হইল, এই পথের উপর দিয়াই পিতামহ একদিন আমার পিতামহীকে বিবাহ করিয়া আনিয়াছিলেন, সেদিন এই পথই বরযাত্রীদের কোলাহল ও পায়ে-পায়ে মুখরিত হইয়া উঠিয়াছিল। আবার একদিন যখন তাঁহারা স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন, তখন এই পথ ধরিয়াই প্রতিবেশীরা তাঁহাদের মৃতদেহ নদীতে বহিয়া লইয়া গিয়াছিল। এই পথের উপর দিয়াই মা আমার একদিন বধূবেশে গৃহপ্রবেশ করিয়াছিলেন, এবং আবার একদিন যখন তাঁহার এই জীবনের সমাপ্তি ঘটিল, তখন ধূলাবালির এই অপ্রশস্ত পথের উপর দিয়াই আমরা তাঁহাকে মা-গঙ্গায় বিসর্জন দিয়া ফিরিয়াছিলাম। তখনও এই পথ এমন নির্জন এমন দুর্গম হইয়া যায় নাই, তখনও বোধ করি ইহার বাতাসে বাতাসে এত ম্যালেরিয়া, জলাশয়ে জলাশয়ে এত পঙ্ক, এত বিষ জমা হইয়া উঠে নাই। তখনও দেশে অন্ন ছিল, বস্ত্র ছিল, ধর্ম ছিল—তখনও বোধ হয় দেশের নিরানন্দ এমন ভয়ঙ্কর শূন্যতায় আকাশ ছাপাইয়া ভগবানের দ্বার পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠে নাই।
দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল, গাড়ির চাকা হইতে কতকটা ধূলা লইয়া তাড়াতাড়ি মাথায় মুখে মাখিয়া ফেলিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলাম, হে আমার পিতৃ-পিতামহের সুখে-দুঃখে, বিপদে-সম্পদে, হাসি-কান্নায় ভরা ধূলাবালির পথ, তোমাকে বার বার নমস্কার করি। অন্ধকার বনের মধ্যে চাহিয়া বলিলাম, মা জন্মভূমি! তোমার বহুকোটি অকৃতী সন্তানের মত আমিও কখনো তোমাকে ভালবাসি নাই—আর কোনদিন তোমার সেবায়, তোমার কাজে, তোমারই মধ্যে ফিরিয়া আসিব কি না জানি না, কিন্তু আজ এই নির্বাসনের পথে আঁধারের মধ্যে তোমার যে দুঃখের মূর্তি আমার চোখের জলের ভিতর দিয়া অস্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিল, সে এ জীবনে কখনো ভুলিব না।
চাহিয়া দেখিলাম রাজলক্ষ্মী তেমনি স্থির হইয়া আছে। আঁধার কোণের মধ্যে তাহার মুখ দেখা গেল না, কিন্তু অনুভব করিলাম সে চোখ মুদিয়া যেন চিন্তার মধ্যে মগ্ন হইয়া গেছে। মনে মনে বলিলাম, তাই যাক। আজি হইতে নিজের চিন্তা-তরণীর হালখানা যখন তাহারই হাতে ছাড়িয়া দিয়াছি, তখন এই অজানা নদীর কোথায় ঘূর্ণী, কোথায় চড়া, সে-ই খুঁজিয়া বাহির করুক!
এ জীবনে নিজের মনটাকে আমি নানা দিকে নানা অবস্থায় যাচাই করিয়া দেখিয়াছি। ইহার ধাতটা আমি চিনি। অত্যন্ত কিছুই ইহার সহে না। অত্যন্ত সুখ, অত্যন্ত স্বাস্থ্য, অত্যন্ত ভাল থাকা ইহাকে চিরদিন পীড়িত করে। কেহ অত্যন্ত ভালবাসিতেছে জানিবামাত্রই যে মন অহরহ পালাই পালাই করে, সে মন যে আজ কত দুঃখে হাল ছাড়িয়াছে, তাহা এ মনের সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কে জানিবে!
বাহিরের কালো আকাশের প্রতি একবার দৃষ্টি প্রসারিত করিলাম, ভিতরের অদৃশ্যপ্রায় নিশ্চল প্রতিমার দিকেও একবার চক্ষু ফিরাইলাম, তাহার পরে জোড়হাতে আবার যে কাহাকে নমস্কার করিলাম জানি না, কিন্তু মনে মনে বলিলাম, ইহার আকর্ষণের দুঃসহ বেগ আমার নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া আনিয়াছে—বহুবার বহু পথে পলাইয়াছি, কিন্তু গোলকধাঁধার মত সকল পথই যখন বারংবার আমাকে ইহারই হাতে ফিরাইয়া দিয়াছে, তখন আর আমি বিদ্রোহ করিব না—এইবার আপনাকে নিঃশেষে সমর্পণ করিয়া দিলাম। এতকাল জীবনটাকে নিজের হাতে রাখিয়াই বা কি পাইয়াছি? কতটুকু সার্থক করিয়াছি? তবে, আজ যদি সে এমন হাতেই পড়িয়া থাকে, যে নিজের জীবনটাকে এমন আকণ্ঠ-মগ্ন পঙ্ক হইতে টানিয়া তুলিতে পারিয়াছে, সে কিছুতেই আর একটা জীবনকে তাহারই মধ্যে আবার ডুবাইয়া দিবে না।
কিন্তু এ-সকল ত গেল আমার নিজের পক্ষ হইতে; কিন্তু অন্য পক্ষের আচরণ ঠিক আবার সেই পূর্বেকার মত শুরু হইল। সমস্ত পথের মধ্যে একটাও কথা হইল না, এমন কি স্টেশনে পৌঁছিয়াও কেহ আমাকে কোন প্রশ্ন করা আবশ্যক বিবেচনা করিল না। অল্প সময়েই কলিকাতা যাইবার গাড়ির ঘণ্টা পড়িল, কিন্তু রতন টিকিট-কেনার কাজ ফেলিয়া যাত্রিশালার ক্ষুদ্র এককোণে আমার জন্য শয্যারচনায় প্রবৃত্ত হইল। অতএব বুঝা গেল এদিকে নয়, আমাদিগকে সেই ভোরের ট্রেনে পশ্চিমে রওনা হইতে হইবে। কিন্তু সেটা পাটনায় কিংবা কাশীতে কিংবা আর কোথাও, তাহা জানা না গেলেও এটা বেশ বুঝা গেল, এ-বিষয়ে আমার মতামত একবারেই অনাবশ্যক।
রাজলক্ষ্মী অন্যত্র চাহিয়া অন্যমনস্কের মত দাঁড়াইয়া ছিল। রতন হাতের কাজ শেষ করিয়া কাছে আসিয়া কহিল, মা, খবর পেলাম একটু এগিয়ে গেলে ভাল খাবার সব রকমই পাওয়া যায়।
রাজলক্ষ্মী অঞ্চলের গ্রন্থি খুলিয়া কয়েকটা টাকা তাহার হাতে দিয়া কহিল, বেশ ত, তাই যা না। কিন্তু দুধটা একটু দেখেশুনে নিস্, বাসী-টাসি আনিস নে যেন।
রতন কহিল, মা, তোমার নিজের জন্যে কিছু—
না, আমার জন্যে চাইনে।
এই ‘না’ যে কিরূপ তাহা আমরা সবাই জানি, এবং সকলের চেয়ে বেশি জানে বোধ হয় রতন নিজে। তবুও সে বার-দুই পা ঘষিয়া আস্তে আস্তে বলিল, কাল থেকেই ত একরকম—
রাজলক্ষ্মী প্রত্যুত্তরে কহিল, তুই কি শুনতে পাস্নে রতন? কালা হয়েচিস্?
আর দ্বিরুক্তি না করিয়া রতন চলিয়া গেল। কারণ, ইহার পরেও তর্ক করিতে পারে এমন প্রবল পক্ষ ত আমি কাহাকেও দেখি না। আর প্রয়োজনই বা কি? রাজলক্ষ্মী মুখে স্বীকার না করিলেও আমি জানি রেলগাড়িতে বা রেলের সম্পর্কিত কাহারও হাতে কিছু খাইতে তাহার প্রবৃত্তি হয় না। নিরর্থক কঠোর উপবাস করিতে ইহার জোড়া কোথাও দেখি নাই বলিলেও বোধ করি অত্যুক্তি হয় না। কতদিন কত জিনিস ইহার বাটীতে আসিতে দেখিয়াছি, দাসী-চাকরে খাইয়াছে, দরিদ্র প্রতিবেশীর ঘরে বিতরিত হইয়াছে, পচিয়া নষ্ট হইয়া ফেলা গিয়াছে; কিন্তু এ-সকল যাহার জন্য সে মুখেও দিত না। জিজ্ঞাসা করিলে, তামাশা করিলে, হাসিয়া বলিত, হাঁ আমার আবার আচার! আমার আবার খাওয়া-ছোঁয়ার বিচার! আমি ত সব খাই!
আচ্ছা, চোখের সামনে তার পরীক্ষা দাও?
পরীক্ষা? এখন? ওরে বাস রে! তা হলে আর বাঁচতে হবে! এই বলিয়া সে না-বাঁচিবার কোন কারণ না দেখাইয়াই অত্যন্ত জরুরি গৃহকর্মের অছিলায় অন্তর্হিত হইয়া যাইত। সে মাছ-মাংস দুধ-ঘি খায় না আমি ক্রমশঃ জানিয়াছিলাম, কিন্তু এই না-খাওয়াটাই তাহার পক্ষে এত অশোভন এত লজ্জার যে, ইহার উল্লেখেই সে যে লজ্জায় কোথায় পলাইবে খুঁজিয়া পাইত না। তাই সহজে আর খাওয়া লইয়া অনুরোধ করিতে আমার প্রবৃত্তি হইত না। রতন ম্লানমুখে চলিয়া গেল, তখনও কথা কহিলাম না; খানিক পরে ঘটিতে গরম দুধ এবং ঠোঙ্গায় মিষ্টান্ন প্রভৃতি লইয়া ফিরিয়া আসিলে রাজলক্ষ্মী আমার জন্য দুধ ও কিছু খাবার রাখিয়া রতনের হাতেই যখন সমস্তটা তুলিয়া দিল, তখনও কিছু বলিলাম না, এবং রতনের করুণ চক্ষের নীরব মিনতিও স্পষ্ট বুঝিয়া তেমনই নির্বাক রহিলাম।
আজ কারণে-অকারণে কথায় কথায় তাহার না-খাওয়াটাই আমাদের অভ্যাস হইয়া গেছে। কিন্তু একদিন ঠিক এরূপ ছিল না। তখন উপহাস পরিহাস হইতে আরম্ভ করিয়া কঠিন কটাক্ষও কম করি নাই। কিন্তু যত দিন গিয়াছে, ইহার আর একটা দিকও ভাবিয়া দেখিবার যথেষ্ট অবকাশ পাইয়াছি। রতন চলিয়া গেলে আমার সেই কথাগুলাই আবার মনে পড়িতে লাগিল।
কবে, এবং কি ভাবিয়া যে সে এই কৃচ্ছ্রসাধনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিল আমি জানি না। তখনও আমি ইহার জীবনের মধ্যে আসিয়া পড়ি নাই।
কিন্তু প্রথম যখন সে অপর্যাপ্ত আহার্য-বস্তুর মাঝখানে বসিয়া স্বেচ্ছায় দিনের পর দিন গোপনে নিঃশব্দে আপনাকে বঞ্চিত করিয়া চলিয়াছিল, সে কত কঠিন! কিরূপ দুঃসাধ্য! কলুষ ও সর্ববিধ আবিলতার কেন্দ্র হইতে আপনাকে এই তপস্যার পথে অগ্রসর করিতে কতই না সে নীরবে সহিয়াছে! আজ এ বস্তু তাহার পক্ষে এমন সহজ এমন স্বাভাবিক যে, আমাদের চক্ষে পর্যন্ত ইহার গুরুত্ব নাই, বিশেষত্ব নাই—ইহার মূল্য যে কি তাহাও ঠিক জানি না, কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে মনে হইয়াছে, তাহার এই কঠিন সাধনার সবটুকুই কি একেবারে বিফল, একেবারে পণ্ডশ্রম হইয়া গেছে? আপনাকে বঞ্চিত করিবার এই যে শিক্ষা, এই যে অভ্যাস, এই যে পাইয়া ত্যাগ করিবার শক্তি, এ যদি না জীবনের মধ্যে তাহার অলক্ষ্যে সঞ্চিত হইয়া উঠিতে পাইত, আজ কি এমনি স্বচ্ছন্দে, এমনি অবলীলাক্রমে সে আপনাকে সর্বপ্রকারে ভোগ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইতে পারিত? কোথাও কি কোন বন্ধনেই টান ধরিত না? সে ভালবাসিয়াছে। এমন কত লোকেই ত ভালবাসে, কিন্তু সর্বত্যাগের দ্বারা তাহাকে এমন নিষ্পাপ, এমন একান্ত করিয়া লওয়া কি সংসারে এতই সুলভ?
যাত্রিশালায় আর কোন লোক ছিল না, রতনও বোধ করি কোথাও একটু অন্তরাল খুঁজিয়া লইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল। দেখিলাম, একটা মিটমিটে আলোর নীচে রাজলক্ষ্মী চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কাছে গিয়া তাহার মাথায় হাত রাখিতেই সে চমকিয়া মুখ তুলিল; কহিল, তুমি ঘুমোও নি?
না, কিন্তু এই ধুলোবালির উপর একলাটি চুপচাপ না থেকে আমার বিছানায় গিয়ে বসবে চল। এই বলিয়া তাহাকে আপত্তি করিবার অবসর না দিয়াই হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিলাম; কিন্তু নিজের কাছে আনিয়া আর কথা খুঁজিয়া পাইলাম না, কেবল আস্তে আস্তে তাহার একটা হাতের উপর হাত বুলাইতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ এমনি গেল। আমার সন্দেহ যে অমূলক নয়, সে কেবল হঠাৎ তাহার চোখের কোণে হাত দিয়া অনুভব করিলাম। ধীরে ধীরে মুছাইয়া দিয়া কাছে টানিবার চেষ্টা করিতেই রাজলক্ষ্মী আমার প্রসারিত পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া জোর করিয়া চাপিয়া রহিল, কোনমতেই তাহাকে একান্ত সন্নিকটে আনিতে পারিলাম না।
আবার তেমনি নীরবে সময় কাটিতে লাগিল। সহসা একসময় বলিয়া উঠিলাম, একটা কথা এখনো তোমাকে জানানো হয়নি লক্ষ্মী!
সে চুপিচুপি কহিল, কি কথা?
ইহাই বলিতে গিয়া সংস্কারবশে প্রথমটা একটু বাধিল, কিন্তু থামিলাম না; কহিলাম, আজ থেকে নিজেকে তোমার হাতে একবারে সঁপে দিলাম, এর ভাল-মন্দর ভার এখন সম্পূর্ণ তোমার।
বলিয়া চাহিয়া দেখিলাম, সেই স্তিমিত আলোকে সে আমার মুখের পানে চুপ করিয়া চাহিয়া আছে। তার পরে একটুখানি হাসিয়া কহিল, তোমাকে নিয়ে আমি কি করব? তুমি বাঁয়া-তবলা বাজাতে পারবে না, সারেঙ্গী বাজাতেও পারবে না। আর—
বলিলাম, আরটা কি? পান-তামাক যোগান? না, সেটা কিছুতেই পেরে উঠব না।
কিন্তু আগের দুটো?
বলিলাম, ভরসা দিলে পারতেও পারি। বলিয়া নিজেও একটু হাসিলাম।
হঠাৎ রাজলক্ষ্মী উৎসাহে উঠিয়া বসিয়া বলিল, ঠাট্টা নয়, সত্যি পারো?
বলিলাম, আশা করতে ত দোষ নেই।
রাজলক্ষ্মী বলিল, না। তার পরে নিঃশব্দ-বিস্ময়ে কিছুক্ষণ নির্নিমেষে আমার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, দ্যাখ, মাঝে মাঝে তাই যেন আমার মনে হত; আবার ভাবতাম, যে মানুষ নিষ্ঠুরের মত বন্দুক নিয়ে কেবল জানোয়ার মেরে বেড়াতেই ভালবাসে, সে এর কি ধার ধারে? এর ভেতরের এতবড় বেদনাকে অনুভব করাই কি তার সাধ্য! বরঞ্চ শিকার করার মত আঘাত দিতে পারাতেই যেন তার বড় আনন্দ। তোমার দেওয়া অনেক দুঃখই কেবল এই ভেবে আমি সইতে পেরেছি।
এবার চুপ করিয়া থাকার পালা আমার। তাহার অভিযোগের মূলে যুক্তি লইয়া বিচার চলিতেও পারিত, সাফাই দিবার নজিরেরও হয়ত অভাব হইত না, কিন্তু সমস্ত বিড়ম্বনা বলিয়া মনে হইল। তাহার সত্য-অনুভূতির কাছে মনে মনে আমাকে হার মানিতে হইল। কথাটাকে সে ঠিকমত বলিতেও পারে নাই, কিন্তু সঙ্গীতের যে অন্তরতম মূর্তিটি কেবল ব্যথার ভিতর দিয়াই কদাচিৎ আত্মপ্রকাশ করে, সেই করুণায় অভিনিষিক্ত সদাজাগ্রত চৈতন্যই যেন রাজলক্ষ্মীর ঐ দুটো কথার ইঙ্গিতে রূপ ধরিয়া দেখা দিল, এবং তাহার সংযম, তাহার ত্যাগ, তাহার হৃদয়ের শুচিতা আবার একবার যেন আমার চোখে আঙ্গুল দিয়া তাহাকেই স্মরণ করাইয়া দিল।
তথাপি একটা কথা তাহাকে বলিতেও পারিতাম। বলিতে পারিতাম, মানুষের একান্ত বিরুদ্ধ প্রবৃত্তিগুলো যে কি করিয়া একই সঙ্গে পাশাপাশি বাস করে সে এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। না হইলে আমি স্বহস্তে জীবহত্যা করিতে পারি, এত বড় পরমাশ্চর্য নিজের কাছে আর আমার কি আছে? যে একটা পিপীলিকার মৃত্যু পর্যন্ত সহিতে পারে না, রক্তমাখা যূপকাষ্ঠের চেহারা যাহার আহার-নিদ্রা কিছুদিনের মত ঘুচাইয়া দিতে পারে, যে পাড়ার অনাথ আশ্রয়হীন কুকুর-বেড়ালের জন্য ছেলেবেলায় কতদিন নিঃশব্দে উপবাস করিয়াছে—তাহার বনের পশু, গাছের পাখির প্রতি লক্ষ্য যে কি করিয়া স্থির হয়, এ ত কিছুতেই ভাবিয়া পাই না। আর, এ কি শুধু কেবল আমিই এমনি? যে রাজলক্ষ্মীর অন্তর-বাহির আমার কাছে আজ আলোর ন্যায় স্বচ্ছ হইয়া গেছে, সে কেমন করিয়া এতদিন বৎসরের পর বৎসর ব্যাপিয়া পিয়ারীর জীবন যাপন করিতে পারিল!
এই কথাটাই মনে আনিয়াও মুখে আনিতে পারিলাম না। কেবল তাহাকে ব্যথা দিব না বলিয়াই নয়, ভাবিলাম কি হইবে বলিয়া? দেব ও দানবে অনুক্ষণ কাঁধ মিলাইয়া মানুষকে যে কোথায় কোন্ ঠিকানায় অবিশ্রাম বহিয়া লইয়া চলিয়াছে, তাহার কি আমি জানি? কি করিয়া যে ভোগী একদিনে ত্যাগী হইয়া বাহির হইয়া যায়, নির্মম নিষ্ঠুর একমুহূর্তে করুণায় গলিয়া নিজেকে নিঃশেষ করিয়া ফেলে, এ রহস্যের কতটুকু সন্ধান পাই! কোন্ নিভৃত কন্দরে যে মানবাত্মার গোপন সাধনা অকস্মাৎ একদিন সিদ্ধিতে ফুটিয়া উঠে তাহার কি সংবাদ রাখি? ক্ষীণ আলোকে রাজলক্ষ্মীর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে উদ্দেশ করিয়া মনে মনে কহিলাম, এ যদি আমার ব্যথা দিবার শক্তিটাকেই কেবল দেখিতে পাইয়া থাকে এবং ব্যথা গ্রহণ করিবার অক্ষমতাকে স্নেহের প্রশ্রয়ে এতদিন ক্ষমা করিয়াই চলিয়া থাকে ত অভিমান করিবার আমার কি-ই বা আছে!
রাজলক্ষ্মী কহিল, চুপ করে রইলে যে?
বলিলাম, তবু ত এ নিষ্ঠুরের জন্যই সর্বত্যাগ করলে!
রাজলক্ষ্মী কহিল, সর্বত্যাগ আর কই? নিজেকে ত তুমি নিঃস্বত্ব হয়েই আজ আমাকে দিয়ে দিলে, সে ত আর চাইনে বলে ত্যাগ করতে পারলাম না।
বলিলাম, হাঁ, নিঃস্বত্ব হয়েই দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে ত তুমি আপনি দেখতে পাবে না—তাই, সে উল্লেখ আমি করবো না।
কল্লোল লাহিড়ীর লেখা “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” বইটি প্রকাশ করার অনুরোধ রইলো।