শ্যামাসঙ্গীত (কালী কীর্তন)

শ্যামাসঙ্গীত (কালী কীর্তন)

[ কালীসাধনায় সঙ্গীত একটি অপরিহার্য বিষয়। শ্যামা-মায়ের নাম-গুণগানে মাতৃসাধকরা বিভোর হয়ে যেতেন। এ-ব্যাপারে সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাজি নজরুল ইসলামের শ্যামাসঙ্গীত দারুণ উল্লেখযোগ্য। তাঁর মধুর লেখনীতে ফুটে উঠেছে,—

”বলরে জবা বল—
কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ তল?”

কিংবা ”কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” বা ”রূপ যদি তোর এতই ভালো মুণ্ডমালা কেন গলে/দয়াময়ী নাম যদি মা শিব কেন তোর চরণতলে।” প্রভৃতি গানগুলি মাতৃসাধনার এক চরম রসাস্বাদন সৃষ্টি করে অনুপম মাধুর্য দান করে। একথা মনে রেখেই উক্ত কালজয়ী গানগুলির সঙ্গে সঙ্গে রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত এবং আরও অন্যান্য মাতৃভক্তদের অপূর্ব সব সঙ্গীত এখানে সন্নিবেশ করে দেওয়া হল, যাতে পাঠকগণ মাতৃভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত গেয়েও জীবন ধন্য করতে পারেন। ]

জয়জয়ন্তী—চৌতাল

ত্বং অপারা, বিশ্বসারা, বিশ্বাধারা বিশ্বরঞ্জনী;

সর্ব্বভূত-আত্মভূত, সর্ব্ববিভূতি-প্রবিধায়িনী।।

ত্বং অনল-ক্ষিতি-অনিল, ব্যোম-সলিল-সংরূপিণী,

তুমি অমেয়া মহেশজায়া, ভো অভয়া ভয়বারিণি।।

বিরাজিতা শব-আসনে, কভু প্রমত্তা আসব পানে,

কভু যুক্তা শিব সনে, শিবে গো শিবানি;

ওমা ত্রিগুণধারিণি, গুণাতীতা ত্রিনয়নি,

প্রেমিকের ত্রিতাপের তাপ সংহর হর-মোহিনি।।

 —প্রেমিক

দেশ-তেওরা

(ওমা) কালভয়বারিণি কপালিনী, কালরূপিণী,

শম্ভুভামিনী, নিশুম্ভঘাতিনী, সমরবাসিনী, সুরবন্দিনী।।

 পুর-হর-মনোমোহকারিণী, সত্যবাদিনী;

তত্বদায়িনী, ত্রাসনাশিনী, ত্রাণকারিণী, তিমিরবরণী।।

ত্রিগুণধারিণী, ত্রিদেবজননী, ত্রিলোকেশী, তেজরূপিণী;

অন্নদায়িনী, অমরপালিনী, অসুরদলনী, আদিকারিণী,

 আশুতোষ-হৃদিবিলাসিনী, আত্মরূপিণী।।

 —আশুতোষ দেব

খাম্বাজ-চৌতাল

দীনতারিণী, দূরিতহারিণী, সত্বরজস্তম ত্রিগুণধারিণী,

সৃজন-পালন-নিধনকারিণী, সগুণা নির্গুণা সর্ব্বস্বরূপিণী।।

ত্বং হি কালী তারা পরমাপ্রকৃতি, ত্বং হি মীন কূর্ম্ম বরাহ প্রভৃতি,

ত্বং হি স্থল জল অনল অনিল, ত্বং হি ব্যোম ব্যোমকেশ-প্রসবিনী।।

সাংখ্য পাতঞ্জল মীমাংসক ন্যায়, তন্ন তন্ন জ্ঞানে ধ্যানে সদা ধ্যায়,

 বৈশেষিক বেদান্ত ভ্রমে হ’য়ে ভ্রান্ত,

 তথাপি অদ্যাপি জানিতে পারেনি।।

নিরুপাধি আদিঅন্তরহিত, করিতে সাধক জনার হিত,

গণেশাদি পঞ্চরূপে কালবঞ্চ, ভবভয়হরা ত্রিকালবর্ত্তিনী।।

সাকার সাধকে তুমি যে সাকার, নিরাকার উপাসকে নিরাকার,

কেহ কেহ কয় ব্রহ্ম জ্যোতির্ম্ময়, সেই তুমি নগতনয়া জননী;

যে অবধি যার অভিসন্ধি হয়, সে অবধি সে পরব্রহ্ম কয়,

তৎপরে তুরীয় অনির্ব্বচনীয় সকলি মা তারা ত্রিলোকব্যাপিনী।।

 —মহারাজ শিবচন্দ্র

সুরট-মল্লার—তেওরা

বড় ধুম লেগেছে, হৃদিকমলে।

মজা দেখিছে আমার মন-পাগলে।।

হতেছে পাগলের মেলা ক্ষেপাতে ক্ষেপীতে মিলে,

আনন্দেতে সদানন্দে আনন্দময়ী পড়ছে ঢলে।।

দেখে অবাক লেগেছে তাক ইন্দ্রিয় আর রিপুদলে,

পেয়ে সুযোগ এই গোলযোগ জ্ঞানের কপাট গেছে খুলে।

প্রেমিক পাগল বলে সকল, তা ব’লে আমার মন কি টলে,

(যার) পিতামাতা বদ্ধ পাগল ভাল হয় কি তাদের ছেলে।।

শোন মা তারা ভূভারহরা এই বেলা মা রাখছি ব’লে

(যখন) ভাসব’ জলে অন্তকালে তনয় ব’লে করিস কোলে।।

 —প্রেমিক

পরজ-বাহার—ঝাঁপতাল

গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়,

কালী কালী কালী বলে অজপা যদি ফুরায়।।

ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী পূজা সন্ধ্যা সে কি চায়,

সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায়।।

জপ যজ্ঞ পূজা হোম আর কিছু না মনে লয়,

মদনের যাগ যজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙ্গা পায়।।

কালী নামের এত গুণ কেবা জানতে পারে তায়,

দেবাদিদেব মহাদেব যাঁর পঞ্চমুখে গুণ গায়।।

সুরট মল্লার—তেওরা

শ্যামা, মন-ছাঁচে তোমাকে ফেলে

মনোময়ী মূর্তি আজ ল’ব তুলে।।

মন যে আমার খাদে ভরা, তোমার ভাবে কৈ মা গলে,

 ভাবরূপিণী হও তারিণি, গ’লে আমার ভাব অনলে।।

দেখিব রূপ তোমার স্বরূপ, যে রূপেতে ভোলা ভোলে,

 পুরাও আশা, কৃত্তিবাসা, দিয়ে দেখা হৃদিকমলে।।

গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা কি হবে মা বনফুলে

 কি দিয়ে পূজিব তোমায় ভাবছি ব’সে তাই বিরলে।।

আমি আমার নই জননি, আমার নাই কিছুই ভূতলে

 এ ব্রহ্মাণ্ড তোমার সৃষ্টি, দৃষ্টিহীনে আমার বলে।

প্রেমিক বলে শোনরে যুক্তি যথাশক্তি ভক্তিজলে,

 ধু’য়ে দে মা’র রাঙ্গা চরণ, মনফুল দে পদতলে।

 —প্রেমিক

 সুরট-মল্লার—ঝাঁপতাল

 অন্তরে জাগিছ গো মা, অন্তরযামিনি,

 কোলে করে আছ মোরে দিবস যামিনী।।

অধম সুতের প্রতি, কেন এত স্নেহ প্রীতি,

 প্রেমে আহা একেবারে যেন পাগলিনী।।

কখনো আদর করি, কখনো সবলে ধরি

 পিয়াও অমৃত শুনাও মধুর কাহিনী;

নিরবধি অবিচারে কত ভালবাস মোরে,

 উদ্ধারিছ বারে বারে পতিতোদ্ধারিণি।।

বুঝেছি এবার সার, মা আমার আমি মার,

 চলিব সুপথে সদা শুনি তব বাণী;

করি মাতৃস্তন্যপান, হব বীর বলবান,

 আনন্দে গাহিব জয় ব্রহ্মসনাতনী।। —ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল

গৌড়সারঙ্গ—ঝাঁপতাল

অভয়ার অভয়পদ কর মন সার,

ভবভয় সব দূরে যাবে রে তোমার।।

অকর্ম্মজনিত ভয় যদি ভোগাধীন হয়,

ভয়হরা তারা নামে পাইবে নিস্তার।।

ভ্রান্তিযুক্ত শ্রান্তিহীন, হেলায় হারালে দিন,

এখনো কর বিধান মনরে আমার;

আদিভূতা সনাতনী চরণ কররে ধ্যান,

না হইও অকিঞ্চন আকিঞ্চনে বদ্ধ আর

 —রঘুনাথ রায় (দেওয়ান)

মনোহরসাহী—ঝাঁপতাল

সকলি তোমার ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।

তোমার কর্ম্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি।।

পঙ্কে বদ্ধ কর করী পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি।

কারে দাও মা ব্রহ্মপদ, কারে কর অধোগামী।।

আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী।

আমি রথ তুমি রথী, যেমন চালাও তেমনি চলি।।

 —রাজা নবচন্দ্র

সিন্ধু খাম্বাজ—যৎ

 মন গরিবের কি দোষ আছে।

তুমি বাজীকরের মেয়ে শ্যামা, যেমনি নাচাও তেমনি নাচে।।

 তুমি কর্ম্ম ধর্ম্মাধর্ম্ম মর্ম্ম কথা বুঝা গেছে,

ওমা তুমি ক্ষিতি তুমি জল, ফল ফলাচ্ছ ফলা গাছে।।

তুমি শক্তি, তুমি ভক্তি, তুমিই মুক্তি শিব বলেছে,

ওমা তুমি দুঃখ, তুমি সুখ, চণ্ডীতে তা লেখা আছে,

প্রসাদ বলে কর্ম্ম সূত্র সে সূতার ফাটনা কেটেছে,

ওমা মায়া সূত্রে বেঁধে জীব ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপি খেল খেলিছে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

বসন্ত বাহার—একতালা

কালী কালী বল রসনা।

কর পদধ্যান, নামামৃত পান,

যদি হতে ত্রাণ থাকে বাসনা।।

ভাই বন্ধু সুত, দারা পরিজন,

সঙ্গের দোসর নহে কোন জন।

দুরন্ত শমন, বাঁধিবে যখন,

বিনে ঐ চরণ, কেহ কার না।

দুর্গা নাম মুখে বল একবার,

সঙ্গের সম্বল দুর্গানাম আমার।

অনিত্য সংসার নাহি পারাপার

সকলি অসার, ভেবে দেখ না।।

গেল গেল কাল, বিফলে গেল,

দেখ না কালান্ত নিকটে এল।

প্রসাদ বলে ভাল, কালী কালী বল,

দূর হবে কাল-যম-যন্ত্রণা।।

 —রামপ্রসাদ সেন

কীর্ত্তন—ঝাঁপতাল

 নামেরি ভরসা কেবল শ্যামা গো তোমার।

 কাজ কি আমার কোশাকুশি, দেঁতোর হাসি লোকাচার।।

নামেতে কাল-পাশ কাটে, জটে তা দিয়েছে রটে,

 আমরা ত সেই জটের মুটে, হয়েছি আর হব কার।।

নামেতে যা হবার হবে, মিছে কেন মরি ভেবে,

 নিতান্ত করেছি শিবে, শিবেরি বচন সার।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

ভৈরবী—একতালা

মা ত্বং হি তারা, তুমি ত্রিগুণধারা পরাৎপরা।

আমি জানি গো ও দীনদয়াময়ী তুমি দুর্গমেতে দুখহারা।।

তুমি জলে তুমি স্থলে, তুমি আদ্যমূলে গো মা,

আছ সর্বঘটে অক্ষপুটে সাকার আকার নিরাকারা।।

তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী, তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা,

অকূলের ত্রাণকর্ত্রী, সদা শিবের মনোহরা।।

কানাড়া—একতালা

শ্রীদুর্গা নাম ভুল’না—ভুল’না, ভুল’না, ভুল’না।

শ্রীদুর্গা স্মরণে সমুদ্রমন্থনে, বিষপানে বিশ্বনাথ ম’লনা।।

যদ্যপি কখনও বিপদ ঘটে, শ্রীদুর্গা স্মরণ করিও সঙ্কটে,

তারায় দিয়ে ভার সুরথ রাজার, লক্ষ অসিঘাতে প্রাণ গেল না।।

বিভু নামে এক রাজার ছেলে, যাত্রা করেছিল শ্রীদুর্গা বলে,

 আসিবার কালে সমুদ্রের জলে ডুবেছিল তবু মরণ হ’ল না।।

 —রামপ্রসাদ সেন

সিন্ধু খাম্বাজ—যৎ

মা যার আনন্দময়ী সে কি নিরানন্দে থাকে।

ইহকালে পরকালে মা তারে আনন্দে রাখে।।

সদানন্দময়ী তারা সদানন্দের মনোহরা,

এই মিনতি করি তারা ঐ পদে যেন মতি থাকে।। —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

ভৈরবী—একতালা

 জয় জয় জগবন্দিনী।

 দেবি, দুঃখহারিণী তারিণী মহেশ-হৃদয়বাসিনী।।

সুরাসুরনর সবার পূজিতা আগম নিগমে সৃজনকারিণী,

জ্ঞানদা বরদা সুখদা মোক্ষদা তুমি মা অন্নদা জয়পরায়ণী।।

ভৈরবী ভবানী নগেন্দ্রনন্দিনী, নাগ-নাগ-পাশা ঘোরনিনাদিনী,

জ্ঞানেন্দ্র উপেন্দ্র যোগেন্দ্রাদি কত চরণে পড়িয়া দিবস রজনী।।

গুরুমুখে শুনি তুমি মা ভবানী, আদ্যাশক্তি শিবে সবার জননী,

মা মা বলে ডাকে মা তোমারে, তাই মা তোমারে মা বলিয়ে জানি।।

বেহগ—কাওয়ালি

আশাবাসা ঘোর-তমোনাশা বামা কে (মোহিনী)।

ঘোর ঘটা কান্তিছটা ব্রহ্মকটা ঠেকেছে।

রূপসী শিরসি শশী, হরোরসি এলোকেশী;

মুখজ্বালা সুধাঢালা কুলবালা নাচিছে।।

দ্রুত চলে আস্য টলে, বাহু বলে দৈত্যদলে;

ডাকে শিবা কব কিবা নিশি দিবা ক’রেছে।।

ক্ষীণ-দীন ভাগ্যহীন দুষ্টচিত্ত সুকঠিন;

রামপ্রসাদে কালীর বাদে কি প্রমাদে ঠেকেছে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

জংলা—একতালা

সে কি এমনি মেয়ের মেয়ে!

যার নাম জপিয়ে মহেশ বাঁচেন হলাহল খেয়ে।।

সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করে মা কটাক্ষে হেরিয়ে।

আবার অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড রাখে উদরে পুরিয়ে।।

যে চরণে শরণ ল’য়ে দেবতা বাঁচেন দায়ে।

দেবের দেব মহাদেব যার চরণে লুটায়ে।।

প্রসাদ বলে রণে চলে মা রণময়ী হ’য়ে।

শুম্ভ নিশুম্ভকে বধে হুঙ্কার ছাড়িয়ে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

বেহাগ—ঠুংরি

 রণবেশে হেসে হেসে ঐ বামা এসেছে।

 করে অসি পদে শশী কি রূপসী সেজেছে।।

নয়নে অনল জ্বলে, নরশির শোভে গলে,

দলিতে দনুজদলে ঢলে ঢলে চলেছে।।

রুধির লেগেছে গায়, নীল জলে জবা প্রায়,

 আঁখি না ফিরিতে চায়; কি সুখেতে মজেছে।

আ মরি কি রূপ হায়, অরূপ উথলে তায়,

 সাধে কিরে ঐ পায় পশুপতি পড়েছে।।

 —স্বামী চণ্ডিকানন্দ

বাউল—জলদ একতালা

 রণে নেমেছে রে কার বামা ওকে দেখতে যাবি;

(তোরা) দেখতে যাবি, দেখতে যাবি, রূপ দেখিলে অবাক হবি।।

(মায়ের) মাথার মুকুট গগনে ঠেকে (গলায়) নরশির-হার,

 পদভার সইতে নারে ধরা হ’ল ভার।।

(মায়ের) রূপ ত নয়, আ মরে যাই, কাজল জিনেও কাল,

(আবার) কি অদ্ভুত মূর্ত্তি ধ’রে ভুবন করে আলো।।

খাম্বাজ—জলদ একতালা

 দনুজদলনী, নিজজন-প্রতিপালিনী শ্রীকালী।

চণ্ড মুণ্ড খণ্ড খণ্ডি, মহিষাসুর ছিন্দি ভিন্দি,

 শুম্ভ নিশুম্ভ সভট সমরে নিমেষে মহাকালী।।

ধ্যাত তুয়া পাওত, ইন্দ্রাদিক-সুর অষ্টসিদ্ধি,

 অর্থাদিক চতুরবর্গ তুয়া কৃপা মৃড়ানী;

মাঙ্গে তুঁঝে অচলা ভক্তি, দীজে নিজ দাস জানি,

 সদা ভক্তবৎসল হো মাত: তুঁ কৃপালী।।

খাম্বাজ—আদ্ধা-কাওয়ালি

সমরে নাচেরে কার এ রমণী

নাশিছে তিমিরে তিমিরবরণী।।

হুহুঙ্কার রবে মগনা তাণ্ডবে,

চমকে দমকে যেন রে দামিনী।।

অট্ট অট্ট হাসি সমর উল্লাসি,

দিতিসুত নাশে দনুজদলনী।।

অসুরে সংহারে অসির প্রহারে,

বরাভয় করে সৃজন-পালিনী।।

বামা ভয়ঙ্করা ভীষণে মধুরা;

হরমনোহরা মানসমোহিনী।।

সংসার-অরণ্যে অনন্যশরণ্যে,

শ্রীরামপ্রসন্নে শরণদায়িনী।।

 —রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়

বারোয়া—আড়খেমটা

নব-সজল-জলধর-কায়।

শ্যামারূপ হেরিলে, প্রাণ গলে যায়।।

কপালে সিন্দুর, কটিতে ঘুঙ্গুর, রতন-নূপুর পায় (মায়ের);

হাসিতে হাসিতে, দানব নাশিছে, রুধির লেগেছে গায় (মায়ের)।।

চরণ যুগল, অতি সুশীতল, প্রফুল্ল কমল প্রায় (আ মরি);

কমলাকান্তের মন নিরন্তর, ভ্রমর হইতে চায় (ও পদে)।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

ভীমপলশ্রী—একতালা

 জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।

ভক্তি রথে চড়ি, লয়ে জ্ঞান তূণ, রসনা ধনুকে দিয়ে প্রেম গুণ,

 ব্রহ্মময়ীর নাম ব্রহ্ম অস্ত্র তাহে সন্ধান করে।।

আর এক যুক্তি রণে, চাই না রথরথী, শত্রুনাশে জীব হবে সুসঙ্গতি

রণভূমি যদি করে দাশরথি ভাগীরথীর তীরে।।

 —দাশরথি রায়

ভীমপলশ্রী—একতালা

 দোষ কারো নয় গো মা,

 আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।

ষড়রিপু হ’ল কোদণ্ড স্বরূপ, পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ;

 সে কূপে বেড়িল কালরূপ জল, কাল-মনোরমা।।

আমার কি হবে তারিণী, ত্রিগুণধারিণী, বিগুণ করেছে সগুণে;

কিসে এ বারি নিবারি, ভেবে দাশরথির অনিবার বারি নয়নে;

ছিল বারি কক্ষে, ক্রমে এল বক্ষে, জীবনে জীবন কেমনে হয় মা রক্ষে,

আছি তোর অপিক্ষে, দে মা মুক্তি ভিক্ষে, কটাক্ষেতে ক’রে পার।।

 —দাশরথি রায়

ঝিঁঝিট খাম্বাজ—একতালা

 মা তুমি কে, কেউ জানে না।

 তোমায় নানা লোকে বলছে নানা।।

 বেদাগমে পুরাণেতে বলে গেছে নানাখানা,

তাই যে তোমার ঠিক মহিমা একথা ত কেউ বলে না।।

বেদান্তে যে আছে অন্ত তাত কভু যায় না জানা

সাংখ্য পাতঞ্জল মীমাংসায় মীমাংসা কিছুই হল না।।

অনন্তরূপিণীর অন্ত বৈশেষিকেতেও মিলে না,

চিদাকাশে যার যা ভাসে তাই তাদের বোধের সীমানা।।

প্রেমিক বলে গোলেমালে সেরে গেছে সব ক’জনা,

ব্রহ্মা বিষ্ণু শূলপাণি (তোমার) স্বরূপ দেখতে সবাই কানা।।

 —প্রেমিক

ছায়া-খাম্বাজ—একতালা

কখন কি রঙ্গে থাক মা, শ্যামা সুধাতরঙ্গিণি।

তুমি রঙ্গে ভঙ্গে অপাঙ্গে অনঙ্গে ভঙ্গ দাও জননী।।

লম্ভে ঝম্পে কম্পে ধরা, অসিধরা করালিনী।

(তুমি) ত্রিগুণা ত্রিপুরা তারা ভয়ঙ্করা কালকামিনী।।

সাধকের বাঞ্ছা পূর্ণ কর নানা-রূপ-ধারিণী।

(কভু) কমলের কমলে নাচ মা পূর্ণব্রহ্ম-সনাতনী।।

 —সাধক

মনোহরসাহী—ঝাঁপতাল

সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী।

তুমি আপনি নাচ, আপনি গাও, আপনি দাও মা করতালি।।

আদিভূতা সনাতনী শূন্যরূপা শশী-ভালী।

ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।।

সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, আমরা তোমার তন্ত্রে চলি।

তুমি যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, যেমনি বলাও তেমনি বলি।।

অশান্ত কমলাকান্ত দিয়ে বলে, মা, গালাগালি।

এবার সর্বনাশী ধ’রে অসি ধর্মাধর্ম দুটো খেলি।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

প্রসাদী—একতালা

 ভাব কি ভেবে পরাণ গেল; (মায়ের)।

(যাঁর) নাম হরে কাল, পদে মহাকাল, তাঁর কেন কাল রূপ হল।

কাল রূপ অনেক আছে, এ বড় আশ্চর্য কাল,

(যাঁরে) হৃদমাঝারে রাখলে পরে হৃদয়পদ্ম করে আলো।।

নামে কালী রূপে কালী, কাল হতেও অধিক কাল,

(ও রূপ) যে দেখেছে সেই মজেছে অন্যরূপ লাগে না ভাল।।

প্রসাদ বলে কুতূহলে, এমন মেয়ে কোথায় ছিল,

(যাঁরে) না দেখে নাম শুনে কানে মন গিয়ে তায় লিপ্ত হ’ল।।

 —রামপ্রসাদ সেন

মাল্লার—একতালা

শ্যামা মা কি আমার কাল রে।

লোকে বলে কালী কাল, আমার মন ত বলে না কাল রে।।

কখনও শ্বেত কখনও পীত কখনও নীল লোহিত রে,

(আমি) আগে নাহি জানি কেমন জননী, ভাবিয়ে জনম গেলরে।।

কখনও পুরুষ কখনও প্রকৃতি কখনও শূন্যরূপা রে,

(মায়ের) এ ভাব ভাবিয়ে কমলাকান্ত সহজে পাগল হ’ল রে।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

কীর্তন—ঝাঁপতাল

ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।

ভুলো না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হ’য়ে মায়াজালে।।

যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে।

সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে।।

দিন দুই তিনের জন্য ভবে, কর্ত্তা বলে সবাই মানে!

সে কর্ত্তারে দেবে ফেলে কালাকালের কর্ত্তা এলে!!

 —রামপ্রসাদ সেন

ভীমপলশ্রী—একতালা

 আমি ‘দুর্গা’ ‘দুর্গা’ বলে মা যদি মরি।

আখেরে এ দীনে, না তার কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী।।

নাশি গো ব্রাহ্মণ, হত্যা করি ভ্রূণ, সুরাপান আদি বিনাশি নারী।

এ সব পাতক, না ভাবি তিলেক, ব্রহ্মপদ নিতে পারি।।

পিলু-বাহার—যৎ

মন বলি ভজ কালী ইচ্ছা হয় তোর যে আচারে।

 গুরুদত্ত মহামন্ত্র দিবানিশি জপ করে।।

শয়নে প্রণাম জ্ঞান, নিদ্রায় কর মাকে ধ্যান,

 আহার কর মনে কর আহুতি দিই শ্যামা মারে।।

যত শোন কর্ণপুটে, সবই মায়ের মন্ত্র বটে,

 কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে।।

আনন্দে রামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজেন সর্বঘটে,

 নগর ফের মনে কর প্রদক্ষিণ শ্যামা মারে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

সিন্ধু খাম্বাজ—যৎ

মজলো আমার মন-ভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে।

(শ্যামাপদ নীল কমলে, কালীপদ নীল কমলে)

যত বিষয়মধু তুচ্ছ হ’লো কামাদি কুসুম সকলে।।

চরণ কাল ভ্রমর কাল, কালোয় কালো মিশে গেল,

 পঞ্চতত্ব প্রধান মত্ত রঙ্গ দেখে ভঙ্গ দিলে।।

কমলাকান্তের মনে, আশা পূর্ণ এত দিনে

(তায়) সুখ দুখ সমান হ’ল আনন্দ-সাগর-উথলে।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

প্রসাদী—একতালা

ডুব দেরে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।

রত্নাকর নয় শূন্য কখন, দু’চার ডুবে ধন না পেলে।

তুমি দম সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুলকুণ্ডলিনীর কূলে।।

জ্ঞান সমুদ্রের মাঝে রে মন, শান্তিরূপা মুক্তাফলে।

তুমি ভক্তি ক’রে কুড়ায়ে পাবে, শিবযুক্তি মত চাইলে।।

কামাদি ছয় কুম্ভীর আছে, আহার-লোভে সদাই চলে।

তুমি বিবেক-হলদি গায় মেখে যাও, ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে।।

রতন মাণিক্য কত প’ড়ে আছে সেই জলে।

রামপ্রসাদ বলে, ঝম্প দিলে মিলবে রতন ফলে ফলে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

প্রসাদী—একতালা

ক্ষেপার হাট-বাজার, মা তোদের ক্ষেপার হাট-বাজার।

 (গুণের কথা কব কার, মা)

তোরা দুই সতীনে কেউ বুকে কেউ মাথায় চড়িস তাঁর।।

কর্ত্তা যিনি ক্ষ্যাপা তিনি ক্ষ্যাপার মূলাধার।

(আবার) চাকলা-ছাড়া চেলা দুটো সঙ্গে অনিবার।।

গজ বিনে গো আরোহণে ফিরিস কদাচার।

মণি মুক্তা ফেলে পরিস গলে নরশির হার।।

শ্মশানে মশানে ফিরিস কার বা ধারিস ধার।

এবার রামপ্রসাদকে ভবঘোরে করতে হবে পার।। —রামপ্রসাদ সেন

প্রসাদী—একতালা

কাজ কি মা সামান্য ধনে

(ও কে) কাঁদছে গো তোর ধন বিহনে।।

সামান্য ধন দিলে তারা পড়ে রবে ঘরের কোণে,

যদি দাও মা আমায় অভয় চরণ রাখি হৃদি পদ্মাসনে।।

গুরু আমায় কৃপা ক’রে মা যে ধন দিলেন কানে কানে।

এমন গুরু-আরাধিত মন্ত্র তাও হারালেম সাধন বিনে।।

প্রসাদ বলে কৃপা যদি মা হবে তোমার নিজ গুণে।

আমি অন্তিম কালে জয় দুর্গা বলে, স্থান পাই যেন ঐ চরণে।।

 —রামপ্রসাদ সেন

সুরট-মল্লার—একতালা

 সুখের বাসনা কর আর ক’দিন।

ত্যজি অন্য বোল ‘কালী’ ‘কালী’ বল মানব জনম যদিন।।

পাবে ব্রহ্মপদ অক্ষয় সম্পদ স্মরণ করিবে এদিন।

সৃষ্টি স্থিতি লয় যা হইতে হয় সে হবে তোমার অধীন।।

যখন যেমন বিধির লিখন সেইরূপে যাবে সেদিন।

ভাবিলে বিষাদ ঘটিবে প্রমাদ কালী না বলিবি যেদিন।।

কমলাকান্ত হইয়ে ভ্রান্ত ভুলেছ ন’মাস ন’দিন।

বারে বারে আসি দুঃখ রাশি রাশি যাতনা সবে আর ক’দিন।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

প্রসাদী—একতালা

অভয় পদে প্রাণ সঁপেছি।

আমি আর কি যমের ভয় রেখেছি।।

কালী নাম কল্পতরু, হৃদয়ে রোপন করেছি।

এ ভক্তি দিয়ে ভবের হাটে দুর্গানাম কিনে এনেছি।।

দেহের মধ্যে সুজন যেজন, তাঁর ঘরেতে ঘর ক’রেছি।

এবার স্বয়ম এলে হৃদয় খুলে দেখাব ভেবে রেখেছি।।

সারাৎসার তারা নাম, আপন শিখাগ্রে বেঁধেছি।

রামপ্রসাদ বলে দুর্গা বলে, যাত্রা করে বসে আছি।।

 —রামপ্রসাদ সেন

কালেংড়া—ঝাঁপতাল

 যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে।

মন তুই দ্যাখ আর আমি দেখি, আর যেন কেউ নাহি দেখে।।

কামাদিরে দিয়ে ফাঁকি, আয় মন বিরলে দেখি

 রসনারে সঙ্গে রাখি, সে যেন মা ব’লে ডাকে।।

কুরুচি কুমন্ত্রী যত, নিকট হ’তে দিও নাক,

 জ্ঞান নয়নে প্রহরী রেখ, সে যেন সাবধানে থাকে।।

কমলাকান্তের মন, ভাই আমার এই নিবেদন,

 দরিদ্রে পাইলে ধন সে কি অযতনে রাখে।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

প্রসাদী—একতালা

মন রে কৃষি কাজ জান না।

এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ ক’ল্লে ফলতো সোনা।।

কালী নামে দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবে না।

সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।

অদ্য কিম্বা শতাব্দান্তে বাজাপ্ত হবে জান না।

এখন আপন একতালে, (মনরে) চুটিয়ে ফসল কেটে নে না।।

গুরুদত্ত বীজ রোপণ করে, ভক্তিবারি সেঁচে দে না।

একা যদি না পারিস মন রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না।।

 —রামপ্রসাদ সেন

সিন্ধু-খাম্বাজ—যৎ

আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারু ঘরে।

যা চাবি তা ব’সে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।।

পরম ধন ঐ পরশমণি, যা চাবি তা দিতে পারে।

কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাচ দুয়ারে।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

প্রসাদী—একতালা

শ্যামা মা উড়াচ্ছো ঘুড়ি (ভব সংসার বাজার মাঝে)।

আশা বায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি।।

কাক গণ্ডি মণ্ডী গাঁথা পঞ্জরাদি নানা নাড়ী।

ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা কারিগরি বাড়াবাড়ি।।

বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা, কর্কশা হ’য়েছে দড়ি।

ঘুড়ি লক্ষের দুটো একটা কাটে, হেসে দেও মা হাত চাপড়ি।।

প্রসাদ বলে দক্ষিণা বাতাসে ঘুড়ি যাবে উড়ি।

ভবসংসার সমুদ্র পারে পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি।।

 —রামপ্রসাদ সেন

ভৈরবী—একতালা

গো আনন্দময়ী হ’য়ে মা আমায় নিরানন্দ কোরো না।

ও দুটি চরণ বিনে আমার মন, অন্য কিছু আর জানে না।।

তপন-তনয়, আমায় মন্দ কয়, কি বলিব তায় বল না।

ভবানী বলিয়ে ভবে যাব চলে, মনে ছিল এই বাসনা।

অকূল পাথারে ডুবাবি আমারে (ওমা) স্বপনেও তাতো জানি না।।

আমি অহর্নিশি দুর্গানামে ভাসি, তবু দুঃখ রাশি গেল না।

এবার যদি মরি ও হর-সুন্দরী, তোর দুর্গানাম আর কেউ লবে না।।

তিলক-কামোদ—কাওয়ালি

জাগো জাগো কুলকুণ্ডলিনী!

আদি শকতি পরাবিদ্যা নারায়ণী, ব্রহ্মসনাতনী, বাগবাদিনী।।

ত্রিভুবন-মোহিনী, ত্রিজগত-জননী,

কোটীবিজলীপ্রভা জীবগতি-দায়িনী,

আধারপদ্মে ত্রিকোণপীঠে স্বয়ম্ভূ-হর-বেষ্টিনী।।

(ষড়) চক্রভেদিনী, সহস্রারগামিনী,

শিবসঙ্গ-বিলাসিনী জয় জয় যোগিনী,

অকূল সাধকে তুমি কুলদায়িনী, পরমকলা কুলীনা কুলকামিনী।।

 —স্বামী অম্বিকানন্দ

ভৈরবী—একতালা

জাগ মা কুলকুণ্ডলিনী, তুমি নিত্যানন্দ-স্বরূপিণী

 তুমি ব্রহ্মানন্দ-স্বরূপিণী,

 প্রসুপ্ত ভুজ গাকারা, আধার-পদ্মবাসিনী।

ত্রিকোণে জ্বলে কৃশানু, তাপিত হইল তনু,

 মূলাধার ত্যজ শিবে স্বয়ম্ভূ-শিব-বেষ্টিনী।।

গচ্ছ সুষুম্নার পথ, স্বাধিষ্ঠানে হও উদিত

 মণিপুর অনাহত বিশুদ্ধাজ্ঞা সঞ্চারিণী।।

শিরসি সহস্রদলে, পরম শিবেতে মিলে,

 ক্রীড়া কর কুতূহলে সচ্চিদানন্দদায়িনী।।

পরজ—একতালা

শ্যামা ধন কি সবাই পায়, রে কালী ধন কি সবাই পায়,

 অবোধ মন বুঝে না একি দায়।

শিবেরও অসাধ্য সাধন মন মজান রাঙ্গা পায়।।

ইন্দ্রাদি সম্পদসুখ তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায়।

সদানন্দ সুখে ভাসে শ্যামা যদি ফিরে চায়।।

যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র যে চরণ ধ্যানে না পায়।

নির্গুণ কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়।। —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

কাফি-সিন্ধু—কাওয়ালি

 দেহি পদতরণী, জননী।

দিন দিন যায় দিন, আসে মাগো সেই দিন

 দিনে রেতে তাই তোরে ডাকি দীনতারিণি।।

জানি না কি বলে আমি ডাকিব গো মা তোমায়,

শিখায়েছ মা বলিতে মা বলিয়ে ডাকি তাই,

কুপুত্র যদিও হয়, কুমাতা কখনও নয়,

 চরণে শরণ তাই লয়েছি নিস্তারিণি।।

সংসার-প্রান্তরে শ্মশান-বাহিনী কূলে,

এ দীন পথিক বসে বিষয়-পাদপ মূলে,

আসে ঐ কাল-ফণী, দংশিতে মোরে জননী,

 ত্রাসিতে পরাণে তাই ডাকি মা ত্রিনয়নি।।

মায়া মায়াবিনী মোরে কুপথেতে লয়ে যায়,

দেখাও সুপথ মোরে সদা জ্বলি সে জ্বালায়,

যায় যায় প্রাণ যায়, তাই ডাকি মা তোমায়,

 অকূলে কর মা কোলে ওমা কূলদায়িনী।।

ছায়ানট—কাওয়ালি

আর কিছু নাই সংসারের মাঝে কেবল শ্যামা সার রে।

ধ্যান কালী জ্ঞান কালী প্রাণ কালী আমার রে।।

আসিয়ে ভুবনে এ তনুধারণে যাতনা না হয় কার রে।

(একবার) হেরিলে ও কায়, সব দুঃখ যায়, এই গুণ শ্যামা মার রে।।

এ ভবে এসেছে, কেহ সুখে আছে, পেয়ে শিরে রাজ্যভার রে।

(আমার) দরিদ্রের ধন, ও রাঙ্গা চরণ, গলায় করেছি হার রে।।

কমলাকান্ত, হইয়ে ভ্রান্ত, যাওয়া আসা বারম্বার রে।

(মায়ের) অভয় চরণ, লহরে শরণ, অনায়াসে পাবি পার রে।।

 —কমলাকান্ত চক্রবর্তী

কীর্তন—একতালা

একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে।

তোমার ভুবনভরা রূপটি একবার দেখে লই মা নয়নে।।

তুমি অন্নপূর্ণা মা, শ্মশানে শ্যামা, কৈলাসেতে উমা, তুমি বৈকুণ্ঠে রমা

ধর বিরিঞ্চি-শিব-বিষ্ণুরূপ সৃজন-লয়-পালনে।।

তুমি পুরুষ কি নারী, বুঝিতে নারি! স্বয়ং না বুঝালে তাকি বুঝিতে পারি,

তুমি আধা রাধা আধা কৃষ্ণ সাজিলে বৃন্দাবনে।।

তুমি জগতের মাতা, যোগীজনানুগতা, অনুগত জনে কৃপাকল্পলতা,

তোমায় মা বলে ডাকিলে নাকি কোলে নাও ভক্তজনে।।

দুঃখ-দৈন্যহারিণী, চৈতন্যকারিণী, অন্য কিছু চাইনা বিনা চরণ দুখানি

আমি প্রেম-সরোজে সাজাব পদ বাসনা মনে মনে।।

পরিব্রাজক ভিখারী সাধ মনেতে ভারী, মধুহাসিমাখা মার মুখখানি হেরি,

বসে মায়ের কোলে মা মা ব’লে মাতিব যোগধ্যানে।।

 —স্বামী কৃষ্ণানন্দ

কাফী—ঠুংরি

কোন হিসাবে হরহৃদে দাঁড়ায়েছ মা পদ দিয়ে।

সাধ ক’রে জিভ বাড়ায়েছ মা, যেন কত ন্যাকা মেয়ে।।

জেনেছি জেনেছি তারা তারা গো তোর এমনি ধারা,

তোর মা কি তোর বাবার বুকে দাঁড়িয়েছিল এমনি করে।।

মিশ্র-রাগ

আমার মনের কালী অঙ্গে মেখে

 হলি মা’ তুই কালী।

তাই বুঝি মা মলিন হ’লো

 অমন রূপের ডালি।

অশান্ত এই ছেলের তরে

 শান্তি বুঝি নেই মা ঘরে,

ওমা কেশ এলিয়ে শ্মশানে তুই

 বেড়াস রাজ-দুলালী।

মিশ্র-দেশ—দাদরা

 বলরে জবা বল—

কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ তল?

 মায়া তরুর বাঁধন টুটে

 মায়ের পায়ে পড়লি লুটে,

মুক্তি পেলি, উঠলি ফুটে আনন্দবিহ্বল।

তোর সাধনা আমায় শেখা জীবন হোক সফল।।

কোটি গন্ধ কুসুম ফুটে বনে মনোলোভা—

কেমনে মার চরণ পেলি তুই তামসিক জবা;

 তোর মত মার পায়ে রাতুল

 হ’ব কবে প্রসাদী ফুল

 কবে উঠবে রেঙে

ওরে মায়ের পায়ের ছোঁয়া লেগে,

কবে তোরই মত রাঙবে রে মোর মলিন চিত্তদল।। —নজরুল

বাগেশ্রী—দাদরা

(আর) লুকাবি কোথায় মা কালী।

বিশ্বভুবন আঁধার ক’রে তোর রূপে মা সব ডুবালি।।

সুখের গৃহ শ্মশান ক’রে বেড়াস মা তুই আগুন জ্বালি।।

(আমায়) দুঃখ দেওয়ার ছলে মা, তোর ভুবনভরা রূপ দেখালি।।

পূজা ক’রে পাইনি তোরে (মাগো) এবার চোখের জলে এলি।।

বুকের ব্যথায় আসন পাতা বস মা সেথা দুখ-দুলালী।।

 —নজরুল

ভৈরবী—একতালা

 ভুবন ভুলাইলি মা ভবমোহিনী।

 মূলাধারে মহোৎপলে বীণাবাদ্য-বিনোদিনী।।

শরীর শারীর যন্ত্রে, সুষুমনাদি ত্রয় তন্ত্রে,

 গুণ ভেদে মহামন্ত্রে তিনগ্রাম-সঞ্চারিণী।।

আধার ভৈরবাকার, ষড়দলে শ্রীরাগ আর,

 মণিপুরেতে মল্লার বসন্তে হৃদপ্রকাশিনী।।

বিশুদ্ধ হিন্দোল সুরে, কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে,

 তান-মান-লয়-সুরে ত্রিসপ্ত-সুরভেদিনী।।

মহামায়া মোহপাশে, বদ্ধ কর অনায়াসে,

 তত্ব লয়ে তত্বাকাশে স্থির আছে সৌদামিনী।

শ্রীনন্দকুমার কয়, তত্ব না নিশ্চয় হয়,

 তব তত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ-আচ্ছাদিনী।।

 —মহারাজ নন্দকুমার রায়

জৌনপুরী—দাদরা

কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।

মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব, যাঁর হাতে মরণ বাঁচন।।

কালো মায়ের আঁধার কোলে শিশু রবি শশী দোলে,

(মায়ের) একটুখানি রূপের ঝলক—স্নিগ্ধ বিরাট নীল গগন।।

পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশিথিনীর দুলিয়ে কেশ,

নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার যে তাঁর নাইক শেষ।।

সিন্ধুতে মার বিন্দুখানিক ঠিকরে পড়ে রূপের মাণিক,

বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না মা আমার তাই দিগবসন।। —নজরুল

মিশ্র—রাগ

রূপ যদি তোর এতই ভালো মুণ্ডমালা কেন গলে

দয়াময়ী নাম যদি মা শিব কেন তোর চরণতলে।

যার রূপে হয় ভুবন আলো তার কেন হায় বরণ কালো

যার করুণায় বিশ্ব মাতায় খড়গ তাহার করতলে।

যোগী ঋষি তোমার লীলা পায় না আজও ধ্যানের মাঝে

অভয়া তোর চরণ ছায়া রাখিস আমার হৃদয় মাঝে।

কাঁদলো তোরই ছেলে মেয়ে শ্যামা মা তোর পথ চেয়ে।

পূজার ডালা সাজিয়েছি মা ব্যথায় ভরা নয়ন জলে।

 —ফটিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *