তিন
দূর থেকে হাত নেড়ে এ কথায় সম্মতি জানিয়ে হেসে বিদায় নিল মেয়েটি। চলতে চলতে বনের প্রান্তে একটা সুন্দর ছবির মত গ্রামের ধারে এসে পৌঁছল। সেখানে একটা শুকনো, চিমড়ে মত লোক বসে বসে মাটি কোপাচ্ছে। তবে তার চোখ দুটো উজ্জ্বল— মুখের মধ্যে খাড়া নাকটাই যেন সর্বস্ব। দুষ্টুমিতে ভরা। কেমন যেন মিচকে পারা। কিন্তু মোটের ওপর বেশ বুদ্ধিমান চোখ মুখ বুড়োটার।
‘এই যে শুনছেন!’ মেয়েটি ডাকল।
বুড়োটা মুখ তুলে বলল, ‘কী চাই?’
‘ঈশ্বর কোথায় জানতে চাই। মনে হচ্ছে আপনিই বলতে পারবেন।’
‘ভেতরে এস, এই বাগানেই পাবে তাঁকে! মাটি খুঁড়লেই বেরোবেন তিনি। চলে এস।’
‘দূর! ওভাবে তাঁকে পাওয়া যায় নাকি? যাক গে, অনেক ধন্যবাদ। চলি।’ মেয়েটি নিরাশ হয়ে বলল।
‘ওহে শোনো শোনো, কীভাবে তাকে পাবে বলে মনে কর?’
‘যে ভাবেই পাই, আপনার ঐ উপায়ে নয়।’
বুড়োটা বলে, ‘যারাই ঈশ্বরকে পেয়েছে তারাই শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত হয়েছে। তাঁকে পেলেই যে মন খুশ হয়ে যাবে তা যেন ভেবো না।’
‘জানি না। তবে সেই সাদা পাদ্রী দিদিমণি দু’লাইন পদ্য শিখিয়েছেন—
সবার উপরে বিরাজ করেন যিনি
ভালবাসার ধনটি শুধুই তিনি।
‘যে লিখেছে সে হদ্দ বোকা।’ বুড়োটা সাফ জানিয়ে দিল।— ‘সেটাকে ধরে ক্রুশে চড়ানো উচিত। বিষ খাইয়ে মারা উচিত। হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে হাঁড়িকাঠে মুণ্ডু এঁটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া উচিত। চিরটা কাল চাইলাম ঈশ্বরের কাজ করতে। আর আজ যদি শুনি ঈশ্বর আসছেন এই রাস্তা ধরে তবে আমি নেংটি ইঁদুরের মতো ছুট মেরে কোনো গর্তে ঢুকে পড়ে থাকব যতক্ষণ না তিনি পার হয়ে যান। আমায় দেখতে পেলেই তিনি একেবারে পায়ের তলায় থেঁতলে মারবেন। ”হা ঈশ্বর যো ঈশ্বর” যারা করে তারা ভাবে ঈশ্বরের সামনে বুঝি দাঁড়াতে পারবে। মোটেই না। তুমি জুপিটার আর সিমেল-এর গল্প শুনেছ?’
‘না তো, বলুন না, শুনি।’
‘জুপিটার হচ্ছেন এক ঈশ্বর। জানো তো ঈশ্বরের বহু নাম। এই যেমন এইদিকেই কিছুদিন আগে একজন বলল আল্লাহ।’
মেয়েটি বলে উঠল, ‘জানি জানি, আমিও ওটা শুনেছি।’
‘যাই হোক,’ বুড়ো বলে চলল, ‘ঈশ্বর জুপিটার তো সিমেল বলে মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলেন। তিনি চাইলেন মেয়েটির কাছে ঈশ্বর সেজে না থেকে বেশ মানুষ মানুষ আচরণ করবেন। কিন্তু মেয়েটা চায় জুপিটারকে ঈশ্বর রূপেই পেতে। তবেই না পাওয়া! ঐতেই কাল হল মেয়েটির।’
‘কী হল?’ কালো মেয়ে শুধায় উদগ্রীব হয়ে।
‘মহান ঈশ্বরের মহত্ত্বের ছটায় মেয়েটি ঝলসে মরে গেল। একটা মাছি আগুনে পড়ে গেলে যেমন হয় আর কি! তাই তো বলি, সাবধান। ঈশ্বরের মহত্ত্বের ধারেকাছে ভিড়োনা। এই আমার মত একটা ছোট্টখাট্টো বাগান করে ফুল ফোটাও, আগাছা ছেঁটে ফেলো, তাহলেই তাঁর আশীর্বাদ পাবে। আর বেশি কিছু চেও না।’
মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, ‘কোনদিনই কি তাঁর মহত্ত্ব সহ্য করতে পারব না?’
‘উঁহু।’ বুড়োটা ঘাড় নাড়ে। ‘পারবে, যেদিন তুমি তাঁর সব উদ্দেশ্য সাধন করে নিজেই ঈশ্বর বনে যাবে। তাঁর উদ্দেশ্য অনন্ত। সে সব সাধন করতে করতেই একটা মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়। উদ্দেশ্য সমাপনের পর বেঁচে থাকার মতো অবস্থা তোমার আর থাকবে ভাবছ? আধমরা হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে তাঁকে দেখার আনন্দই মাটি হবে। তার চেয়ে চলে এস, তাঁর নাম স্মরণ করে বাগানে হাত লাগাও।’
মেয়েটি ধীরে ধীরে তার ডাণ্ডাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল, তারপর বাগানে ঢুকল। কাজে নেমে পড়ল সে।
মাঝে মাঝে আরো কত লোক আসে এই বাগানে। হাত লাগায়। ওদের দেখে প্রথম প্রথম মেয়েটির হিংসে হত। পরে সবাইকেই সে মেনে নিতে শিখল।
একদিন কোত্থেকে একটা লালচুলো আইরিশ গাঁইয়া এসে জুটল। বাগানের পিছন দিকে মূলোর ক্ষেত সাফ করতে বসে গেল সে।
মেয়েটি তাকে দেখে তিরিক্ষি হয়ে বলল, ‘কে তোমাকে এখানে ঢুকতে বলেছে?’
গাঁইয়াটি থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে, এই নিজের থেকেই ঢুকে পড়েছি আর কি!’
মেয়ে: বাগানটা ঐ বৃদ্ধের, ওঁর অনুমতির প্রয়োজন আছে।
গাঁইয়াটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘দেখো, আমি সমাজবাদী সংঘের লোক। বাগান কারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া ঐ বুড়ো হাবড়া লোকটার গতরে তেমন আর তাগদ নেই। ওর হয়ে আলুটা মূলোটা আমি ফলাতে পারি।’
মেয়ে: ও, তাহলে তুমি এখানে ঈশ্বরের খোঁজে আসনি?
‘দূর দূর! আমি ঈশ্বর খুঁজতে যাব কেন, পারলে ঈশ্বরই আমাকে খুঁজে মরুক না! তাছাড়া ঈশ্বরকে এখনও ঠিকমত গড়াই হয়নি। অনেক ভুল ত্রুটি রয়ে গেছে। এসো না, তুমি আর আমি তাঁকে গড়ে তুলি! লোকে তাঁর চিন্তা তো ছেড়েই দিয়েছে। শুধু নিজের কথাই ভাবছে সবাই।’ এই বলে থকাস করে এক গাল থুতু ফেলে জামায় মুখটা মুছে লোকটা মাটি কোপাতে থাকে।
বুড়ো লোকটা ধারে কাছেই ছিল। রকমসকম দেখে বুঝল লোকটি এক্কেবারে চাষাড়ে। কিন্তু এমন লোককেই তো এ বাগানে দরকার। তার মনে হল লোকটা বেশ বিশ্বস্ত। বাগান ছেড়ে নড়বে না সহজে। তাই তারা দুজনে মিলে আইরিশটিকে সংযত আচরণ আর ভদ্র ভাষা শিক্ষা দিতে লাগল। কিন্তু তাকে কিছুতেই বোঝানো গেল না যে ঈশ্বর শাশ্বত, অপার তাঁর মহিমা। বোঝানো গেল না যে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের কাজ অপরিসীম যা সমাজবাদীর একার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নয়। তবু লোকটাকে শিক্ষাদান করতে করতে তার সঙ্গে এরা বেশ ঘনিষ্ঠই হয়ে উঠল। অভ্যস্ত হয়ে উঠল ঠাট্টা তামাশায়।
একদিন সেই বুড়ো লোকটি কালো মেয়েটিকে বলল, ‘তোমার মতো এমন একটি মেয়ে আর কতদিন আইবুড়ো থাকবে? এবার একটা বরটর জোটাও, চাট্টি ছেলেপিলে হোক। আমি বড্ড বুড়ো, নইলে লড়ে যেতুম পাত্র হিসেবে। এক কাজ করো, ঐ আইরিশটাকেই ধরো।’
শুনে মেয়েটি তো মহা খাপ্পা হয়ে বাগান ছেড়ে চলে গেল। রাত জেগে ভাবতে লাগল, কীভাবে, কখন ঐ ডাণ্ডা পিটিয়ে আইরিশ ভূতটাকে বাগানের বাইরে বার করে দেবে। বুড়োটাকে ছাড়া মেয়েটি আর কাউকেই চিনতে চায় না। সে কিছুতেই মানতে পারছিল না বুড়ো লোকটি তার থেকে ষাট বছরের বড়। ভাবতেই পারছিল না যে শীগগির একদিন বুড়োটা মরে যাবে আর সে পড়ে থাকবে একা।
বুড়ো লোকটা মেয়েটাকে এই রূঢ় সত্য কথাটা বোঝাতে লাগল দিনের পর দিন। মেয়েটা শেষে একদিন রাজি হল বিয়ে করতে।
বুড়োর সঙ্গে পিছনের বাগানে গিয়ে হাজির হল সে। আইরিশটিকে বলল যে তাকে বিয়ে করবে।
এই না শুনে কোদাল কাঁধে তুলে ‘বাপরে’ বলে লোকটা দৌড় দিল। কিন্তু বাগানের ফটকটা ভেবেচিন্তে আগেই তালাচাবি মেরে রেখেছিল বুড়ো। লোকটা প্রাণপণে ফটক ডিঙোবার চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে ওরা ছুটে গিয়ে ওর ঠ্যাং ধরে নামিয়ে আনল।
ধরা পড়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় লোকটা বলল, ‘ঐ কেলে মাগীটাকে বিয়ে করতে হবে?’ এতদিনের শেখানো পরিশীলিত ভাষা সেই মুহূর্তে সব ভুলে গেল সে। ‘আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে, আমি কোন মেয়েছেলেকেই বিয়ে করতে চাই না!’
কিন্তু তা বললে কী চলে! লোকটা ততক্ষণে কালো মেয়েটির লোহার মতো বন্য হাতের মুঠোয় বন্দী। বুড়োটা লোকটাকে বোঝাতে লাগল, ‘আরে ঝুলে পড়ো, খোকা, ঝুলে পড়ো। সাদা ছাই মেমের চেয়ে এই কালো রঙের মেয়ে: অনেক ভালো। দেখ দেখ, কেমন মসৃণ এর গা। আর তাছাড়া কোনো সাদা মেম তো আর ঈশ্বরের খোঁজ রাখবে না।’
তর্ক বিতর্ক চলল বহুক্ষণ। ধমকেধামকে, তুতিয়েপাতিয়ে, গেলাসখানেক দামী মদ গিলিয়ে শেষমেষ লোকটাকে রাজি করানো গেল। লোকটি বলল, ‘ঠিক আছে, না হয় ওটাকেই বউ বলে মেনে নিলাম।’
তারপর তো শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে আইরিশ সাহেবের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটি সংসার সামলাল, সন্তান ধারণ এবং পালন করল (বাচ্চাগুলো পুরোপুরি কালো কিংবা পুরোপুরি সাদা নয় কিন্তু, কফি রঙের), বাগানের কাজের ফাঁকে স্বামীর ছেঁড়া জামা সেলাই করল (আইরিশটা গা থেকে দিনের পর দিন জামা খুলতেই চাইত না), এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে ঈশ্বর-সন্ধানে আর মনই রইল না। তবু মাঝে মাঝে কচি বাচ্চাকে নাইয়ে ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিতে দিতে তার মনে পড়ত মুক্তির কথা, নির্বাণের বাণী। মাঝে মাঝে বাচ্চাগুলোর কানে কানে বলত, ‘এই! যদি ঈশ্বরকে পেয়ে যাই, তাঁর সঙ্গে জীবন কাটাই, তোদের বাপ রেগে যাবে না তো রে!’ বাচ্চাগুলো কিছু না বুঝে হাঁ করে চেয়ে থাকত মায়ের মুখের দিকে।
তো, তারপর বাচ্চাগুলো বড় হল। সংসারের কাজে অবসর পেয়ে কীরকম যেন একা হয়ে পড়ল মেয়েটি। তখন বড্ড মনে পড়ত ঈশ্বরকে। কিন্তু তখন আর শক্তি নেই তার দেহে। ডাণ্ডাটা সে আর তুলতেই পারে না।
১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডে এবং আফ্রিকার গ্রীষ্মে যখন ফিনসনায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য রয়ে গেছি তখনই এই গল্পটি লেখার প্রেরণা জাগে। নাট্যকার হিসাবে এই গ্রন্থটিকে আমার স্বভাবমতো নাটক আকারেই লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেখি আমি কালো মেয়েকে নিয়ে গল্প লিখে চলেছি। এবং গল্পটি যখন লেখা হল আমি ভাবতে লাগলাম বস্তুটির অর্থ কী দাঁড়াল। আমি বার বার পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছি যে আমার বিশ্লেষণ সদা সর্বদা সঠিক নয়। জাত লেখকরা সব কলম্বাসের মতো। এক ‘জাত’ লেখক তাই অন্য ‘জাত’ লেখকদের মতোই আসল লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেন না। এইজন্যই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে বই শেষ করে তাঁদের মধ্যে পালিয়ে বাঁচার একটি প্রবণতা থাকে। তবে এই ভীতিটি একটি পবিত্র ধর্ম। কারণ এই ভীতিটিই ধরিয়ে দিতে পারে তাদের ভুল ত্রুটি, কিংবা বিদ্যাচর্চার দৌড় কতটুকু। সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের মতো আমি দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করি যে আমার যাবতীয় লেখার প্রাণশক্তি আহরিত হয় ঘটনার প্রতি লক্ষ্যে এবং কল্পনার মিশ্রণে। এবং এই দুটি অস্ত্রের প্রয়োগে ত্রুটি থাকতেই পারে এবং বিষয়বস্তু বানিয়েনের ‘হোলি ওয়ার’-এর হাস্যকর এক উলটপুরাণের মতো চিরসমাপ্তিতে পরিণত হতেও পারে।
যাই হোক, গল্পটির কোথায় প্রাণশক্তি সে-সম্বন্ধে আমি-ই না হয় নিজেই একটি বিবৃতি পেশ করি।
কিছু অবুঝ মানুষের মাঝে প্রায়ই শোনা যায় আমরা নাকি প্রাচীন গোষ্ঠীর মানুষ, নূতন চিন্তার আলোক নাকি আমাদের সয় না।
আমি মোটেই তা মানি না।
বরঞ্চ নূতনভাবে ধ্যানধারণা যে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে মানুষ গ্রহণ করে, তা মাঝে মাঝে ভীতির উদ্রেক করে। লোকে লেখার আমোদ উপকরণের উপর বিশ্বাসী। তা তাদের সন্তুষ্ট করে। খরচ করে বই কিনে সেইটাই তাদের লাভ। আমি নিজেকে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতোই বলি যে, গৃহীত ধারণাগুলির মধ্যে যেগুলি আমার, সেগুলির আকর্ষণ একদিন-না-একদিন হারিয়ে যাবেই। শপথবাক্য যখন ভঙ্গুর হয়ে যায় লোকে তাদের ভুলে যায়। এই ধর্ম বাছাই পদ্ধতি, তার মধ্যে যা সত্য, যা অবিনাশী তা সাময়িকভাবে চাপা থাকলেও লোকে ভুলে গেলেও নূতনভাবে আবিষ্কৃত হয়, সেগুলি প্রাথমিক প্রমাণিত সত্য, যাকে আমরা বিজ্ঞান বলি। এইভাবেই আমরা প্রমাণিত সত্যকে গ্রহণ করি ও আমাদের মনকে উর্বর করে তুলি। সেগুলি সত্যকার শিক্ষার রূপ বলে পরিগণিত হতে থাকে। সেগুলি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মেকি শিক্ষার থেকে আলাদা।
দুঃখের বিষয়, এই অতি সাধারণ বিষয়টিতে আমরা মনে রাখি না প্রাচীন সেই মন্তব্যটি— তোমরা নোংরা জলটা ফেলে দিয়ো না, যতক্ষণ না ওটাকে কাজে লাগিয়ে তুমি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হচ্ছ। এই আগে থেকেই ফেলে দেওয়ার অভ্যাসটি ভুল, তোমার সঠিক পরিণতি ঘটছে সেই আপ্তবাক্যটিতে,’যখন তুমি তোমার স্বচ্ছ, পরিষ্কার জলের ধারাটি পাচ্ছ, তখনই তোমার উচিত নোংরা জলটি ফেলে দেওয়া। মনে রেখো, স্বচ্ছ আর নোংরার মিশ্রণ যেন কস্মিনকালেও না ঘটে।’
এবং ঠিক এই জিনিসটিই আমরা শিখিনি। আমাদের অভ্যাস হচ্ছে স্বচ্ছ জলটিকে নোংরা জলটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া। আর তার ফলে আমাদের মনটাতেও ছিটে লেগে যায় এই কুকর্মের। এই অপবিত্র মন যেন গলা, পচা প্রাচীন বস্তুর গুদামঘরের মতো। অকেজো ভাঙা কাচের টুকরো আর ন্যাকড়ার ফালি। এই সংগ্রহশালায় পড়ে থাকে— উইলিয়াম দ্য কংকারার, লিং বা হেনরি দ্য সেভেন্থ, মোজেস এবং জেশাস, সেন্ট অগাস্টিন ও আইজাক নিউটন, কেলভিন এবং ওয়েলেসলি, রানি ভিক্টোরিয়া ও মি এইচ জি ওয়েলস। আর আছেন কিছু সম্পদ যেমন, কার্ল মার্কস ও আইনস্টাইন কিন্তু তাঁরা তো ‘ক্রোক’ হয়ে গেছেন, আর ‘ক্রোক’ হয়েছেন আমায় নিয়ে ডজনখানক মানুষ এবং স্টুয়ার্ট মিল। একেবারে উপরের সারি নিয়ে যাদের কারবার কুকর্মেই তাদের মগজ ভরপুর। আর আমাদের স্কুল-কলেজের বিদ্যা হল সেই শুদ্ধ আর নোংরা জলের মিশ্রণ। তাদের নিয়েই প্রতিটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি। এইসব বিদঘুটে বুদ্ধি যাদের মগজে জন্মে তাদের বিপ্লবচিন্তা ভুল। তাদের রাজনৈতিক ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়াই উচিত। বোকাহাবারাই বরং নেতৃত্ব দিক।
এই উলটপুরাণের ধারণা বাইবেলকেও গ্রাস করেছে। কিছু দেশে ধরা হয় যে বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদের নাকি সাধারণ শৈল্পিক মূল্য এই ধর্মগ্রন্থটি অর্থাৎ বাইবেল আচ্ছন্ন করে রাখত মানুষকে কোনো জাদুবিদ্যায়। এই ক্ষমতা অবশ্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে কারণ ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজি এক মৃত ভাষা, নতুন অনুবাদগুলি ক্রমশই আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণটা সোজা— পুরোনোটি আর সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকছে না। কিছু অনুবাদ সাধারণ মনের খোরাক, তাদের উত্তম বলতেই হয়। আর অন্যগুলি দৈনিক সংবাদপত্রের কচকচির মতো। এই দুই মিলে হঠাৎই বাইবেলের জগতে প্রতিফলিত হল একটি সাধারণ বুদ্ধির পরিবেশ।
তবে এই আধুনিক অনুবাদগুলির উপরে অনেকেই নির্ভর করতে পারেন না, না পেরে তাঁরা বাইবেল পড়া ছেড়েই দেন। নতুন বাইবেলে যাঁরা নিবিষ্ট হন, সে-বাইবেল সৃষ্টির একটি বিরল ঘটনা। তবু তাঁরা চার্চের বাইবেল শোনেন সেই পুরোনো ভাষায়, গুরুগম্ভীর কণ্ঠের নিঃসৃত বাণী। সানডে স্কুলের পড়ুয়াদের বাইবেলের লাইন মুখস্থ করানো হত। পুরস্কার জুটত সেইসব লাইনে ভূষিত ছোটো ছোটো কার্ড। শয়নকক্ষ থেকে নার্সারি স্কুল বাইবেলের বাণী দ্বারা শোভিত থাকত। থাকত নানা নিষেধাজ্ঞা। ব্রিটিশ এবং বিদেশি বাইবেল সোসাইটি বছরে তিরিশ লক্ষেরও বেশি বাইবেল বিলিয়েছে এক শতক ধরে। যদিও সেগুলি মানুষের কাছে হয়ে দাঁড়াত বাড়তি কোনো দ্রব্যের মতন। কোনোদিনই সেগুলির পাতা খোলা হত না। উপহার দেওয়া হত চার্চের ঈশ্বর পিতাদের। তবু এই পদ্ধতিটি চালু ছিল। এখনও সেসব বাইবেলে এমন আইন লিপিবদ্ধ আছে যা রাজনৈতিক মানুষজনও মেনে চলে। সেসব পবিত্রতা ভাঙলে সেটা ধ্বংসাত্মক কাজ বলেই স্বীকৃত হবে। অথচ সেসব বাইবেলে ভৌতিক রাজত্বেরই কর্তৃত্ব। বাইহেল নাকি, নিষ্পাপ, সঠিক এক অভিধান। এই পরিচয়টি বাইবেলে লিপিবদ্ধ করা আছে। যদিও একটি পরিচ্ছেদে ঈশ্বর প্রদত্ত দৈহিক শাস্তিকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। ঈশ্বরের সর্বগ্রাসী প্রভাবকেও। এইসব কথা বেশ জোরালো কণ্ঠে বলা আছে ‘পঞ্চাঙ্কের অধ্যায়’-এ (‘পেন্টাটয়েশ’)।
এই ঘটনার অর্থ দাঁড়ায় যে রাজা প্রথম জেমসের যে অনুবাদ সেটার উৎকর্ষই শ্রেষ্ঠ যদিও রাজার অনুবাদ বলেই এটি বেশি সম্মান পায়। এতে আছে প্রাচীন ইহুদি সাহিত্যের বিষয়বস্তু, তাদের প্রাকৃতিক পরিচয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস। সেসব ধরা আছে কবিতায়, নীতিবোধের ধর্মচর্চায় এবং সংগীত গাথায়। সেটাই বাইবেল। অনুবাদে অসাধারণ দক্ষতার আভাস পাওয়া যায়। অনুবাদকের কাছে সেটা শুধু অনুবাদকর্মেরই উদ্দেশ্য ছিল না, প্রেরণা ছিল প্রাচীন গ্রন্থের একটি সংগ্রহ সৃষ্টি করা। তাতে আছে বিভিন্ন সময়ের নানা সংস্কৃতির অবস্থার মূল্যায়ন। তাঁরা চেয়েছিলেন ভাষা হোক স্বর্গীয় সুষমায় ভরা। শ্রদ্ধা ও যত্নে তৈরি হয়েছিল এক অনির্বচনীয় নান্দনিকতা। তাঁরা কোনো চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেননি। অথচ বোঝানো হয়েছে এটি ঈশ্বরেরই নিজস্ব ভাষা। কে তাকে লঙ্ঘন করবে? মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে স্বর্গীয় উন্মোচনের কোনো সংঘাত বাধেনি। অনুবাদকেরা কোনো নেতিবাচক দিককে বদল করে ইতিবাচক করতে চাননি। তাঁরা নিজেদের পরিপূর্ণ জ্ঞানী বলে কখনোই মনে করেননি। ভাবেননি তাঁদের ভাষা, হিব্রু ভাষা-জ্ঞানকে টেক্কা দিতে পারবে। যখন হিব্রু ভাষা স্ববিরোধে আক্রান্ত হয়েছে তখনও অনুবাদকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেননি। যখন বুঝছেন এই ভাষার বাস্তবতায় ঈশ্বর কর্ণপাত করবেন না, তখনও সেই ভাষাকে অতিক্রম করতে চাননি পাছে সে ভাষাসুষমা কণ্টকিত হয়। একটি উচ্চমার্গের অবস্থান থেকে কৃত এই অনুবাদ। এমন এক এর মহান স্বরমাধুর্য যে এখনও সাধারণ ব্রিটিশেরা কিংবা উত্তর আমেরিকার নাগরিকেরা এই বাইবেলকেই মন থেকে মেনে নিয়ে পূজা করেন। এ যেন একটিমাত্র লেখকের লেখা একটি পুস্তক। তাদের কাছে বইটির লেখক স্বয়ং ঈশ্বর নিজে। এই বইটিতে যে মুক্তির অঙ্গীকার আছে, আছে মহান গরিমার দিক, তা হেন্ডেলের হাতে এক মহান উত্তরণ ঘটেছে। হেন্ডেলই পারতেন নাস্তিককে কাঁদাতে, ভোগবাদীকে পবিত্রতার স্পর্শে রোমাঞ্চিত করতে। ধর্ম যাঁর কাছে এক জাদুকরি ভূতাশ্রিত আত্মা, বাইবেল তাঁর কাছে এক কাগুজে রক্ষাকবচ। বাইবেল তাঁর কাছে এক আশ্রয়স্থল, যে আশ্রয় নাকি সাক্ষীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্যকথা কওয়াতে পারে। জাদুকরি মায়ায়। সেই মায়ায় যোদ্ধার বন্দুক পকেটেই রয়ে যাবে, একটা গুলিও খরচ করতে সে পারবেন না। এমনিই এ বাইবেলের ভূতাশ্রয়ী মহিমা। অন্তত এসব মহামূর্খদের ভাবনাচিন্তা।
মানি, বাইবেলের আকাশছোঁয়া পবিত্রতা। তবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তার পবিত্র দিকটি অলৌকিকতার ছায়ায় বইটিকে হাস্যকর করে তুলবে। সেটা বিপজ্জনকও বটে। কোনো বই তার বক্তব্যে অভ্রান্ত থাকলে বাঁচবার আগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরা অনুভূতিকে আমাদের জীবনে স্বর্গের স্বীকৃতি দিতে পারি। তা সে-বই মোজেসেরই হোক বা এজেকিয়েল, পল, সুইডেনবার্ক, জোসেফ স্মিথ, মেরি বেকার এড্ডি কিংবা কার্ল মার্কস-এরই হোক। তবে বইটি যদি শুধুমাত্র কাল্পনিক হয় তখন সেটা রাজ্যের ভিত্তিমূল বলে যেন স্বীকৃত না হয়। তখন সেটা ব্যথাবেদনা তাড়াবার বড়ি কিংবা আফিম বলেই স্বীকৃত হওয়া উচিত। বেদনাকে অসাড় করে দিয়ে কী লাভ? শুধু শুধুই কি আর নয়া সোভিয়েত রাশিয়ায় গোঁড়া ধর্মীয় নেতারা গ্রিক চার্চের ধর্মকে বাতিল করে? মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে লাভ কী? এই উন্মাদনা ছাড়া আর কিছু জোটে না যদি কেউ বাস্তব থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই ধর্মই তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকগোষ্ঠীর কলুষিত রাজনৈতিক হাতিয়ার। এ ধর্ম এখন ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে জনরোষকে স্তব্ধ করতে পারে। (হয়তো সেই কারণেই অত্যাচারীরাই পুরোহিত বনতে পারেন সবথেকে বেশি সংখ্যায়।) আশা রাখা যায় দূর কোনো ভবিষ্যতে সভ্যতা ফিরে পেতে পারে তার সরল সততা। আবার ভরাডুবির সম্ভাবনাও রেখে গেছে।
সম্প্রতি আমরা মহাসংকটে পড়েছি। একটি দল ধর্মকে সম্পূর্ণ বিলোপ করে আনছেন বিজ্ঞানকে। আরেক দল ধর্মকে একটি ধোঁয়াশার মাঝে রেখে দিয়েছেন। দুটি দিক মারমুখী (যদিও বৃথাই)। বার্মিংহামের বিশপ তার চ্যালাদের চোখ রাঙাচ্ছেন, সাধারণ বিজ্ঞানীদের দলবল গির্জার ভক্তদের ডিঙিয়ে যিশুর মহামান্বিত রূপের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যিশুকে বাঁচাও। আর আমি শুধু বিশপ সেজেই বসে আছি! আমিই তো যত্রতত্র বিজ্ঞানীদের সাবধান করেছি যে তোমাদের মার্কাসাঁটা বিজ্ঞানীদের চেয়ে আমাদের কোয়েকাররা অনেক বেশি বিজ্ঞানমনস্ক তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই বলা যায় যে বাইবেলকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দেওয়া যায় না তাকে সোজাসুজি টেনে আনতে হবে বাস্তবের জমিতে। এটা কী এমন প্রয়োজনীয় বস্তু যে এর নিয়মবিধি ভাঙতে আমরা ভয় পাই।
আমি বিরোধ বাধাতে চাই না। আমি মেনে নিতে রাজি আছি আমার প্রোটেস্টান্ট বন্ধুদের কাছে যে ধোঁয়াশায় ভরা বাইবেল এক সময় কাজে লেগেছে মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে। সেসময়কার চার্চ ও সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সেসব চিন্তার প্রয়োজন ছিল। এই ধোঁয়াশার জন্যই যোদ্ধা এক হাতে বাইবেল, অপর হাতে অস্ত্র নিয়ে দশজন যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়তে পেরেছেন। সেই বিরুদ্ধ যোদ্ধারা ছিল ক্রমওয়েল অরেঞ্জের উইলিয়াম আর গুস্তাফার্স অ্যাডনর্মাবসস। অতি প্রাচীনপন্থীরা এই ধোঁয়াশার বশেই রোমান্সের স্বাদ পেয়েছিল যেমন আয়রন সাইডে ঈশ্বরকে ত্রাতা হিসেবে মেনেছিল ভক্তিনত চিত্তে। কিংবা মনে করুন জলযুদ্ধের নিনাদ যা লন্ডনভেরিকে আক্রমণ মুক্ত করেছিল কিংবা ডুগাল্ড ডাগগেডিকে নিয়েও একটু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায়। কিন্তু গুয়েলফ ও ঘিবেলাই-এর লড়াই-এর ব্যাপারটা তখন থিতিয়ে গেছে। সে-যুদ্ধের শেষ রক্তাক্ত অধ্যায়টি রাজা গুয়েলফ-এর মন্ত্রীমহোদয়গণ মনে করতে পারেন না। মনে করতে পারেন না রাজার নাম কী ছিল, কী ছিল নামের অর্থ। তাঁরা তাঁকে গিবেলিন কাইজার ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্মুখে পরিত্যাগ করেন আর যোদ্ধারা লড়ে গেল এক হাতে মেশিনগান আর অন্য হাতে সেদিনের সংবাদপত্র ধরে। মেশিনগানকে সাধুবাদ যা হাজার লোকের শক্তিকে একা কাজে লাগাতে পারে। আর মহান, পবিত্র বাইবেলের বাণী মুদ্রিত ছিল সেই সংবাদপত্রের পিছনের পাতায়, জোসুয়ার যুদ্ধ করিমার বর্ণনার সঙ্গে। জোসুয়া আমাদের তরবারি লর্ড গিরিয়নের মতো উচ্চ তুলে খ্যাপা কুকুরের মতো আধুনিক অ্যামোলেকাইট ও ক্যানালাইট আর জার্মানদের ছিঁড়ে খেয়েছিল, এই বীরগাথার বর্ণনা ছিল সেই সংবাদপত্রে। যেন সেই নিহত বেচারারা শয়তানের অনুগামী বদমাশ শিশু সন্তানের দল। যদিও রাজা ও রাজত্বজনিত তত্ত্বটি ছিল অন্যরকম, কিন্তু লক্ষ্যটা ছিল এক— মানুষ মারা। লক্ষ্যটি ছিল এক কাল্পনিক দ্বন্দ্ব— জিয়োভার বিরুদ্ধে ব্যালের। জার্মানরাও লড়েছিল তাদের রাজা এবং দেশ নিয়ে। এবং আমাদেরই মতো নিশ্চিত ছিল যে জিয়োভা (Jeova) মহাশক্তিধর এক আশ্রয়দাতাদের লর্ড। জার্মানদের ঈশ্বর। সেই আশ্রয়দাতাদের এমন বলা হয় মহান ব্যাটেলিয়ন। অত্যন্ত আতঙ্কে ভরা ছিল এই যুদ্ধ। মানুষ মানুষকে কসাইখানার প্রাণীর মতো কচুকাটা করেছিল। কিন্তু কী অপরূপ তার বর্ণনা। নিষ্ঠুরতা নাকি অবরোধ প্রক্রিয়া, এইভাবে নিরপেক্ষ বিচার হল। কিন্তু সভ্যতার দেহে যে ক্ষতের সৃষ্টি হল তার প্রাবল্য আমরা জানতে শিখলাম না। শুধু শিখেছি যারা মরল সেটা তাদের নিয়তি। ওল্ড টেস্টামেন্টে একথা সোজাসুজি বলা আছে। ধর্মের ধোঁয়াশায় এই অন্ধকার ও সংস্কারাচ্ছন্ন দিকটি মানুষের ভাবনায় এল না। একমাত্র রাশিয়া সাহস করে ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর সমাচারকে অবজ্ঞা করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা মনে রাখবার মতো ঘটনা। এই কাজের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও তারা শিশুদের নিয়ে তৈরি করেছে একটি ‘নাস্তিক’ বাহিনী। অতএব তারা নাকি বঞ্চিত হয়েছে যিশুর কোলে স্থান পাবার সুযোগ থেকে। আর বার্মিংহামের বিশপের একমাত্র বিশ্বাস যে বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতা নাকি যিশুর কোলেই শেষপর্যন্ত ভক্তকে স্থান দেয়, যদিও একটু বর্বর ভাবে। আর তাই তো আমরা আমাদের শিশুদের গড়ে তুলেছি সেনা অফিসার করে।
এই অবস্থাটিকে আর তুচ্ছ জ্ঞান করা যায় না। কারণ একটি। বোধহীন দুষ্টু ছেলের গুলতির ঘা খেয়ে জিয়োভার প্রাচীন ভক্তগণ একযোগে সবকটা ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারত না। আর এখন মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, এরোপ্লেন, গ্যাস বোমা এইসব মারছে হাজারো বাসিন্দাকে। আর সেইসব শহরের বাসিন্দাদের মারছে যাদের উপর এরা নির্ভর করে আছে খাদ্যের জন্য, তাপবিদ্যুতের জন্য, উন্নত যন্ত্রাংশের জন্য। এইসব অস্ত্র কাজে লাগিয়ে শিশুরাও পারবে আধঘন্টার মধ্যে কোনো দেশকে ভস্মীভূত করতে। সোজা কথা, বাইবেলকে এরা ত্যাগ করতে শিখবে না। কিন্তু সঠিক ধ্যানধারণায় বুঝতে না শিখলে বাইবেলই আমাদের ত্যাগ করে যাবে। সেজন্য নোয়া কিংবা জোসুয়ার থেকে বেশি শিক্ষিত মনস্ক হওয়া প্রয়োজন। সেইসব ভান-ভণিতাগুলো ধরতে হবে যেখানে সেগুলি লুকোনো আছে নানা কায়দায় ব্যাখ্যায় মানুষের উপর স্বর্গীয় কর্তৃত্বের কথা। এইভাবে বাইবেলের সঠিক বিচার করতে হবে, যেমন করা হয় কোরান, উপনিষদ, আরব্যরজনী। এমনকী আজকের ‘টাইমস’ পত্রিকার প্রধান উপকরণটি, কিংবা গত সপ্তাহের ‘পাঞ্চ’ পত্রিকার ব্যঙ্গচিত্রটি। সব কথাই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। ইহলোকের যেকোনো লেখকই ভুল মতামত ব্যাখ্যা করে যেতে পারেন তাঁদের কাব্যে।
বাইবেলের আর কী প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে? একজন প্রাজ্ঞ মানুষের কাছে এর প্রয়োজন থাকতে পারে। সোভিয়েত দেশের মানুষেরা কেন বাইবেলকে জঞ্জালের স্তূপে ফেলবে না? তবে তার আগে একটু সহৃদয় হওয়া প্রয়োজন। মোজেসের দশটি উপদেশের (Ten Commandments) কথায় আসা যাক। মোজেস এই উপদেশের মাধ্যমে মানুষ বশীভূত করার কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারেননি। তিনি ছলছুতোয় বুঝিয়েছেন এই ‘কথা’ গুলি তিনি অলৌকিক উপায়ে লাভ করেছেন। এই বলে, এইভাবেই কিছুটা শ্রদ্ধা ভক্তি আদায় করেছেন। এইসব ‘কথা’র সঙ্গে জুড়তে হয়েছিল লোভিটিকাস এবং ডয়েটেরোনমির অসংখ্য নিয়মকানুন। সেগুলি এখন আর অতি নিয়মনিষ্ঠ ইহুদিও মানে না। সেগুলি না মানলে আমাদের নীতিবোধও তাই রাগান্বিত হয় না। এইসব (Commandments) ‘কথা’গুলি তাই আজ ভাঙা আসবাবের টুকরোর মতো, সূক্ষ্ম শিল্পকলার কিছু জাদু আছে। সেই জাদুগুলি বিপজ্জনক। এর লেখক যদি সুরেলা ভাষার জাদুকর হতেন, নানা দক্ষ উপমার ব্যবহারে, (যা লেখকরা পারেন) তাহলে সে-ভাষা বাইবেলের আদর্শের পরিপন্থী হতে পারত। দশ দশটি ‘বাণী’ মোটেই আর আধুনিক যুগে খাপ খায় না। ওদের কোনো প্রয়োজনই নেই। সেসব ‘বাণী’ ডাকাতি করার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। আর তাই ডাকাতরা তাদের কার্যকলাপ আইনসিদ্ধ করে নিয়েছে। ফলত আমাদের সমাজের নীতির ভিত উপড়ে গেছে। বলছে সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ুক, যেন রাশিয়ার মতো তারাও ঘুম ভাঙাতে যায়।
তবে বর্জনীয় এইসব দিকগুলির একটি সদর্থক দিকও আছে। আগের বইগুলোর ধর্ম জিজ্ঞাসা ও চর্চা অতি নির্দয় আর নিষ্ঠুর। এক দেবতা দ্বিতীয় জলোচ্ছ্বাসের সময় মানবসমাজটিকে বাঁচিয়েছিলেন সমূলে উৎপাটনের হাত থেকে। সেটাই তাঁর নিষ্ঠুরতা; তাঁকে জংলি বলুন আর যা-ই বলুন। সেই নোয়া (Noah) প্রতিটি জীবকে, প্রত্যেকটি পক্ষীজাতকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন দেবতার পায়ে নিবেদনস্বরূপ। এ ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু মানুষের পোড়া গন্ধ বড়ো সুবাস ঢেলেছিল তাঁর নাসিকায়। এই পূজাচার পরবর্তী বইগুলিতে রূঢ়ভাবে নির্ণীত হয়নি। যেমন মাইকা (Mica) এই নিষ্ঠুরতা মেনে নেননি। এটা তাই প্রমাণ করে যে ইহুদিরা চিন্তায় ও সভ্যতায় কত প্রগতিশীল ছিল। তবে প্রশ্ন থেকে যায় মানুষকে উৎপাটনের হাত থেকে বাঁচালেও এই নিষ্ঠুর বলিদানের একটি ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কোনো কোনো দাপুটে রাগী দেবতা মাঝে মাঝেই তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে এই রক্তপাতের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন। ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এ (New Testament) তাই দেখি যিশুর প্রতি নিগ্রহের কথকতা। জেরুজালেমের রোমান গভর্নর নোয়া প্রদর্শিত এই সশ্রদ্ধ বলিদানকে আমরা অম্লানবদনে আদর্শ বলে বিবেচনা করেছি। আমরাও আমাদের বিবেককে কলা দেখিয়ে, নৈতিক দায়িত্বকে দূরে হঠিয়ে সেই কথকতা শুনেছি ও দুষ্কর্মের লজ্জাটিকে ঢাকা দিয়েছি। এইসব পাপাচারকে দিব্যি চাপিয়ে দিয়েছি যিশুর ঘাড়ে। (যিশু ক্ষমা করতে বলেছিলেন পাপীদের।) এর চেয়ে অমানবিক ও অনৈতিক তত্ত্বের কথা চিন্তা করা যায় না। আশ্চর্য ‘বুদ্ধিজীবী সমবায় সমিতি’র কাছেও এই কথকতা তেমন গর্হিত কাজ নয়। জাতিপুঞ্জের কাছেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের এই পাপাচার এমন স্বীকৃত যে বাইবেল এক ধরনের স্বাধীন দুষ্কর্ম (যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে অমরত্ব দান), বাধাবন্ধনহীনভাবে প্রচার করে, আর অবাধ সেই (প্রাণনাশের) বাণী বিতরিত হয়। কোনো সাবধানী আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত সুচেতনার উদ্রেক ঘটে না। মানুষের পাপাচারের জন্য অলৌকিক দাবিগুলি যতক্ষণ না বর্জিত হয় ততক্ষণ এই লীলা চলতেই থাকে।
বাইবেল-বিজ্ঞান আলোচনায় আসা যাক। এই বিজ্ঞান উনিশ শতকের বস্তুবাদী ফ্যাশন। এই ফ্যাশন জীববিজ্ঞানকেন্দ্রিক। জীবনের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে এই বাইবেলে। এখানে পদার্থবিদ্যা কিংবা রসায়নকে ঠেলে সরিয়ে নিজের ঠাঁই তৈরির প্রচেষ্টা নেই। কিন্তু এই বাইবেল প্রাক বিবর্তনযুগের। এটাই বইটির হতাশাব্যঞ্জক দিক। এতে আছে জীবসূত্রের গোড়ার কথা, আর নৈতিক বর্ণনা যা আছে তা রূপকথার পর্যায়ে পড়ে। এই বাইবেলের তারকাখচিত সৌরজাগতিক ধারণা শিশুমনের খোরাক। এর জ্যোতির্বিদ্যা রয়েছে পৃথিবীর মাটিতে। এর ইতিহাসচিন্তায় রয়েছে মহাকাব্যিক গল্প সোজা কথায়। যাঁরা এই বাইবেল থেকে শিক্ষা আহরণ করেছেন তাঁরা এত ভুল তথ্যের শিকার যে সমাজকর্মী রূপে তাঁরা নেহাতই অচল। বংশ পরম্পরার ধারায় যে দায়িত্ববোধ প্রবাহিত, সে-প্রভাবের অভাব আছে এঁদের। এঁদের ভোটাধিকার পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। তাই ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র প্রথম সংস্করণের পাশে এর স্থান হওয়া উচিত। এর কথিত অংশটুকু থেকে এটাই বোধগম্য হয় যে, মানুষ নির্বোধের মতো আগেকার কালে কী বিশ্বাস করত আর আজকের মাপকাঠিতে বিচার করা যাবে আধুনিক মানুষ সেসব অচল বিশ্বাসগুলি কীভাবে পরিত্যাগ করে এগিয়ে এসেছে।
রাশিয়া তবুও বাইবেলকে বর্জন করেনি আজকেও। সে-বাইবেলের বেশ কিছু অংশ আজকের সংবাদপত্রের চেয়েও বেশি সজীব। আজকের পার্লামেন্টের তর্কাতর্কির ভাষা থেকে বেশি প্রাণবন্ত। আজকের চটকদারি ইতিহাস বইয়ের চেয়ে এই বাইবেলের ইতিহাসও কখনো বেশি আকর্ষণীয়। এই বাইবেলের ইতিহাস অংশ আজকের ইতিহাস বইয়ের মতো সাজানো গল্পকথা নয়। এখানে নেই বৈজ্ঞানিক বুলিতে ভরা গালমন্দ কিংবা অবাস্তব যত স্বর্গকল্পনা। আর সেইসব নেই বলেই রাসকিন, কার্লাইন কিংবা মার্কসের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নিয়েছে। এই বাইবেল মহাকাব্যের মহানায়কদের চিহ্নিত করেছে মহাবজ্জাত রূপে। এমনকী হোমারকেও বিরাট কোনো প্রতিভাশালী মনে করারও অবকাশ নেই। এখানে শেক্সপিয়রও ছিটেল বলে প্রতিভাত হন। এতে আছে একটি মহৎ প্রেমগাথা যা একজন নিষ্ঠাবান প্রেমিককেই আনন্দ দেয়। শেলির ‘এপিসাইসিডিয়ন’ এই বাইবেলের কাছে বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর ছাড়া আর কিছুই নয়। কিংবা কোনো ভাঙা ঠ্যাঙের প্লাস্টার।
এটি এমন একটি জগতের দৃষ্টান্ত যা তৈরি হয়েছে শিহরন জাগানো সব উদাহরণ দিয়ে। কেন্দ্রে আছেন আদিবাসী সমাজের মালমশলা। সেই মানুষগুলির ছিল বলিষ্ঠ মানসিক ক্ষমতা, কাল্পনিক শক্তি আর ছিল জোর খাটিয়ে স্বয়ম্ভর হবার প্রবণতা। তারা এই মিথ্যাটা সহজেই হজম করেছিল যে তারা ঈশ্বরের বাছাই করা জীব, পৃথিবীর ভোগসুখের অধিকারী। তারা বিশ্বাস করত ভোগসুখের পর স্বর্গবাস করবে শাশ্বত সৌন্দর্যের মাঝে। তাদের কাছে স্বচ্ছ বাস্তবটি হল এইসব মিথ্যার ভিত্তিভূমিটি। তারা জাতিচ্যুত হল, নানা ছলছুতোয় তাদের মরতে হল আর নিয়মনিষ্ঠ মানুষের কাছে। ওইসব নিয়মনিষ্ঠ জাতিরা এই আদিবাসীদের মতোই স্বর্গকে একান্ত নিজেদের রাজ্য বলে আঁকড়েছে আর ইহুদিদের পিঠ চাপড়েছে কারণ ইহুদিরা হিব্রুদেবতা ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের মেনে নিয়েছে বলে। আর অন্য কোনো বিকল্পের চেয়ে এইসব বেশি কাজে লেগেছে উৎকট সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের। তবে এই বন্য মানুষ আর বাইবেল পড়া মানুষের মধ্যে ফারাক বিস্তর যদি পড়ুয়া মানুষটি বাইবেলের রাবিশ টপকে তাঁর পঠনপাঠনকে বিস্তারিত করতে পারেন। যদি এড়াতে পারেন বোকাহাবাদের লেখা ভুল ইংরেজির বাইবেলগুলো। এইসব ভুলে যাওয়া বাইবেলগুলি বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হলে ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক দাঁড়ায়। যারা পড়ুয়া তাদের কাছে তো বটেই, তাদের ধারেকাছের অনুবাদকদের কাছেও। এই পতন ঘটবে বোকাহাবাদেরও যারা অন্তঃসারশূন্য উপন্যাস পড়ে, ফুটবলের হালচাল ও শহুরে চুটকিতে ডুবে থাকে।
যেসব কথা পেশ করা হল তা বাইবেল ভক্তদের খুশিই করবে কিন্তু তারা এই ভেবে স্বস্তি পাবে না যে তাদের পৌত্তিলকতা এবার বুঝি যুক্তির মাটি খুঁজে পেল। ভবঘুরে বালকের চেয়ে নোয়া কি অ্যাব্রাহাম কিংবা একজন আইজাক নিউটন হওয়া ঢের ভালো। কারণ আজকাল অনাথ ভবঘুরে বালকদের আর জনসাধারণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা নেই। আগে ছিল এটা একটা প্রাথমিক কর্তব্য। ‘জেনেসিস’-এর বিকল্প পুস্তক আর শুধুই অজ্ঞানতা নয়। সেগুলি এইচ জি ওয়েলস-এর ‘আউটলাইনস অফ হিস্ট্রি’র মতো নির্দিষ্ট পত্রিকা যারা বিরাট সাফল্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। শেষ দু-শো বছরের ইতিহাসে যে ইতিহাস, কাব্য, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা রচিত হয়েছিল, সেই একই রহস্যজনক অনুপ্রেরণায় এই গ্রন্থ রচিত। আজকের বাইবেল পড়া একজন মানুষ অশিক্ষিতের দলেই পড়েন। যদি কথাটা বিশ্বাস না হয় তবে বাইবেলের জ্ঞান থেকে সেই মানুষটিকে একটি চাকরির পরীক্ষায় পাশ করাতে পারেন কি না দেখুন তো! তিনি পারবেন না। আর আপনি যদি ফেল করেন তবে আপনিও ভাগ্যবান। অর্থাৎ আপনি অন্তত উন্মাদ নন। এই প্রশংসাপত্রটি আপনাকে দেওয়া যায়। বাইবেলে নির্ভুলভাবে ধরা ছিল বিজ্ঞানের বিশাল কিছু বিস্তৃতি। এখন নৈরাশ্যজনকভাবে সেই জ্ঞান কিছুটা দমিত হয়ে পড়েছে।
একটিমাত্র ব্যতিক্রম এখনও বেঁচে আছে। তার নাম ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান। তাও সেগুলি পণ্ডিতজনের হাতে পড়ে আর তল খুঁজে পাচ্ছে না। বস্তুবাদী বিজ্ঞানীরা এটাকে নাক সিটকে বিজ্ঞান বলা অন্যায় বলে ধরে নিয়েছেন। অথচ বস্তুবাদের নানা কর্মকাণ্ড ক্ষমতায় আসীন মানুষগুলির মাঝে অজ্ঞ মনের কদর্য কোনো নিদর্শন কোথাও দেখা যায় না। একমাত্র ঈশ্বর বিজ্ঞানকে ঘৃণা করার ক্ষেত্রে ছাড়া। একজন মানুষ, তিনি যে-ই হোন, গণিতজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, দুঁদে রাজনীতিবিদ, এমনকী ঘোড়ার মাঠের অতি সফল জুয়াড়ি, তিনি যদি এই সৌরজগতে বাস করেও কখনো প্রশ্ন না তোলেন আকাশভরা সূর্য তারার আয়োজনের অর্থ কী, তবে তিনি একজন ক্যালভিন কথিত পাষণ্ড।
আর এদের জন্যই তাই বাইবেল আজ বিজ্ঞানের কাছে সর্বস্তরেই অচল। বাইবেল আজ শুধুমাত্র ঈশ্বর ধারণার আধার। মনে রাখি না, এই ঈশ্বর ধারণাই কিন্তু প্রথম সভ্য মানুষদলের প্রতিপাদ্য বিষয়। —কোত্থেকে এলাম আমরা, আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই-বা কী। মানুষের সভ্যতার শুরুর অনুসন্ধিৎসা ছেলেমানুষের মতোই করা উচিত। কে এই প্রেতপুরুষ যিনি বজ্র হয়ে হেঁকে ওঠেন, ভূমিতে কম্পন তোলেন, দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে জর্জরিত করেন, চক্ষু অন্ধকার, বর্ণ বধির করা মারণমুখী শক্তি, কে তিনি? কে তিনি যিনি রাত্রির শেষে সূর্যোদয় ঘটান, কার ক্ষমতায় চন্দ্রের ক্ষয়-বৃদ্ধি, চার ঋতুর আনাগোনা আর কোন জাদুবলে সেইসব ঋতু বীজ হয়ে মাঠ ভরে দেখা দেয় শস্যে। তিনি যেন এক নিঃস্বার্থ সাধক কিংবা কোনো পরম প্রেম-প্রীতি ভরা পিতা। তিনি তো দেহ ধারণ করেন না। তিনি জিজ্ঞাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে। তাঁকে নানা বিমূর্ত ধারণায় ধরতে চান পণ্ডিতেরা।
বন্য, অশিক্ষিত, ঈশ্বরবিশ্বাস কীভাবে উচ্চ দার্শনিক অনুসন্ধানে উন্নীত হল তার ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। মুক্ত মন ও সত্যিকার বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে সেই ইতিহাসচর্চা করলে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় জানা যায়। কিন্তু আমরা অলস, কুৎসিত অভ্যাসের দাস। পরিশুদ্ধ জল পেলেই আমরা তাকে নোংরা জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। বাইবেল নানা পরম্পরায় হাজির করে অনেক ঈশ্বর। প্রতিটি ঈশ্বরই তার আগেরটির চেয়ে উন্নততর। এতে বোঝায় মানুষের ঊর্ধ্বগতি, একটি সৎ, মহৎ ‘প্রকৃতি’র ধারণা। প্রতিটি ধাপেই শুদ্ধ হচ্ছে জীবনের বারি। একটিমাত্রই তার লক্ষ্য— জলধারাটি পরিশুদ্ধ করতে নির্যাসটি ঢেলে নেওয়া। যতক্ষণ না ফের আধারটি নূতন শুদ্ধ জলে ভরে ওঠে। কিন্তু হায়, এই আশীর্বাদ ব্যর্থ হয়ে যায় নবীন শুদ্ধ জলে নোংরা জল ঢেলে। এই ভুল করে চলি আমরা বার বার। যতক্ষণ না আমাদের মনগুলি হয়ে ওঠে নোংরা পাঁকের মতো। আর তথাকথিত পরিচ্ছন্ন বুদ্ধির নাস্তিকদের কাছে পরিণত হই করুণার পাত্র রূপে। সেই নাস্তিকেরা দর্শনজ্ঞানশূন্য হয়েও মানুষের পবিত্র ঊর্ধ্বগতিকে খেলো, অর্থহীন প্রচেষ্টা বলে মনে করে। কেজো লোকের কাছে এইধরনের মনে করাটা পাগলামি।
বাইবেলের এই ঊর্ধ্বগতির ধাপগুলো অনুসন্ধান করা যাক। নোয়ার (Noah) দেবতাচিন্তা জোবের (Job) দেবতাচিন্তা নয়। যে দেবতাটি শয়তানকে সঙ্গী করে জোবকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেন তিনি কি যুক্তিবাদী নন? তিনি কি নন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? যিনি এই দুই দেবতার মধ্যে পার্থক্যটি ধরতে পারেন না তাঁর মগজ বলে কোনো বস্তু নেই, তাঁর দুই ধরনের মানুষকে আলাদা করে চেনবার কোনো শিক্ষা নেই, যদিও জোবের দেবতাটি নোয়ার দেবতার থেকে এক ধাপ এগিয়ে তিনি কিন্তু তার্কিক হিসেবে নেহাতই কাঁচা। তবুও তাঁকে প্রশংসা করতেই হয় তাঁর নিজের পরাজয় বাঁচানোর প্রচেষ্টা দেখে। জোব শয়তানের অস্তিত্বের সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন, বলেছিলেন ঈশ্বর মহিমার বিরুদ্ধাচরণের কথা। তিনি একটি তিমিমাছ সৃষ্টি করতে অপারগ নিরীহ পাখির সঙ্গে খেলা করার মতো তিমির সঙ্গে খেলতে পারেননি। তাই বলে তাঁকে ব্যঙ্গ করার কিছু নেই। নোয়ার দেবতার দেহে একটি সন্দেহের আঁচড় আছে। সেই দেবতা জোবের দেবতার সঙ্গে জটিল সম্পর্কটিকে উপেক্ষা করেছিলেন, তিনি মেনে নিতে পারেননি সত্যিই প্রাণী বলি দেওয়া হয়েছিল (সাতটি ষাঁড় ও সতিটি ভেড়া) আর ইলিহুর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ একটি পবিত্র ‘জোচ্চুরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল তথ্যটি লুকিয়ে ফেলার কায়দা এটি। আসল যে কাব্যোপাখ্যান তা শয়তানকে নিয়ে সমস্যার সমাধান করেনি এবং জোবের সমালোচনারও জবাব দেয়নি। এটি অজানাই থেকে গিয়েছিল যতদিন না সৃষ্টির বিবর্তনতত্ত্ব এটির সমাধান করে।
আমরা দেখি মাইকা কেমন নোংরা জলটি নির্ভয়ে ফেলে দিচ্ছেন। তাঁর দেবতা নোয়ার দেবতা নয়, ষাঁড় ও ভেড়াওয়ালা জোবের দেবতাও নয়। ঈশ্বরতত্ত্বকে তিনি উচ্চতম এক বিন্দুতে উন্নীত করলেন। সেখানে রক্তাক্ত বলিপ্রদানের তীব্র নিন্দাবাদ আছে। আর আছে উৎসাহ উদ্রেককারী সেই দাবি— তোমার ঈশ্বরকে প্রয়োজন শুধুমাত্র ঠিক পথে চলার জন্য। বিকৃত সংস্কারের বিরুদ্ধে হৃদয়বৃত্তির এই জয়ের পূর্বে নোয়া আর জোবের দেবতার দ্রুত পতন ঘটেছিল। পুনর্বার তাদের উত্থান হয়নি। তবু আমাদের ছেলেপুলেদের হৃদয়বৃত্তির এই জয়কে ভালো চোখে না দেখানোর চেষ্টা হয়। এটি যে প্রেতপুরুষের জান্তব ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে বিপুল জয়, তারা তা জানতই না। তাদের শোনানো হয় মাইকার দেবতা, নোয়ার দেবতা, জোবের দেবতা সর্বত্রই এক এবং অদ্বিতীয়। আর তাই তাদের বোঝানো হয় ভালো ছেলেটি হয়ে ন্যায়বিচার, ক্ষমা এবং বিনয়ের মতি রাখো বলিপ্রদত্ত মানুষের পোড়া মাংসের ক্ষুধাটুকুর সঙ্গে। এই ধরনের বুদ্ধিহীন খ্যাপামোই মানুষের ধর্মচর্চা।
এরপর এলেন যিশু। তিনি এদের চেয়ে উচ্চমার্গে উঠতে ভয় পান। তিনি বললেন মানুষের মাঝেই বিরাজ করেন দেবতা। উদাহরণ তিনি নিজে। সঙ্গেসঙ্গে এই বাণীতে আতঙ্কিত হয়ে শ্রোতারা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারতে লাগল। তারা বুঝে ফেলল এই বাণীর মধ্যে যিশু নিজেকে দুর্বৃত্তের মতো জিয়োভায় (Jeova) পরিণত করতে চাইছেন। এই যে ভুল বোঝাবুঝি, নোংরা জলের এই যে ধর্মবিজ্ঞান তাকে আঠারোশো বছর পরে এমানুয়েল সুইডেনবার্গ ধর্মের প্রতিপাদ্য বিষয় করে তুলেছিলেন।
কিন্তু যিশুর নির্ভেজাল উপদেশাবলি মাইকার ঈশ্বরচিন্তার এক ধাপ উপরে। কারণ মাইকা অতি সবিনয়ে নতমস্তকে সত্যিকার ঈশ্বরের সম্মুখে চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন। তিনি সেই মানুষটির কাছে নিতান্তই হীন, তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন ঈশ্বরের একটি আধার। তাঁকে পরিচালিত করছে শুধুমাত্র তাঁর অন্তরের একটি স্ফুলিঙ্গ। বাইবেলে ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্টের মধ্যে এইটি সবচেয়ে বড়ো ব্যবধান। তবুও হায়, সেই নোংরা জলটি অর্থাৎ ব্যবধানটি নিতান্তই নিষ্ফলা করে তুলেছে বাইবেলকে। কারণ, দেখাই যাচ্ছে পল যিশুকে এফেসিয়ানদের কাছে তুলে ধরছেন ‘ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত মিষ্টি এক সুস্বাদু ‘বলি’ হিসাবে। এইভাবেই খ্রিস্টধর্মকে টেনে ফের নামিয়ে আনছেন নোয়ার পর্যায়ে। এই স্তর থেকে কোনো ধর্মগুরুই উন্নীত হতে পারছেন না। ফলে মাইকা ও যিশু যেটুকু উন্নতি সাধন করলেন, তা বাতিল হয়ে গেল। পড়ে রইল ঐতিহাসিক এক খ্রিস্টধর্ম যার সৃষ্টি জিয়োভার হাঁড়িকাঠে, যিশু সেখানে পলির পাঁঠা।
মাইকা এবং যিশু যদি কোনোদিন ফিরে আসেন তবে তাঁরা দেখবেন তাঁদের নাম ও কৃতিত্ব জড়িয়ে রয়েছে তাঁদের ঘৃণিত পূজ্যপাদের সঙ্গে। যিশুর বদনাম করতেই হয়, কারণ তিনি নির্বিচারে যত মূর্খ-শিশু বাছাই করেছিলেন। এই নিন্দাবাদের আগে আমাদের এই বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন যে যিশুর ঠিক ঠিক শিষ্য বাছাই করার ক্ষমতা ছিল। এমন কথা উল্লেখের লোভ সম্বরণ করা যায় না যে এমন সব মুহূর্ত আছে যখন তিনি বাছলেন এমন এক শিষ্য যে খ্রিস্টান নয়। এবং এও বলা যায় একমাত্র জুডাসের মধ্যেই ছিল সত্যকার বিবেচনা বোধের আভাস। যিশুর মানসিক ক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাদের বোধের অতীত। তারা তাঁকে মহামানব এবং অলৌকিক ক্ষমতাশালী কোনো জীব বলে পুজো করত। তারা যিশুকে তাদের কিছু অর্থহীন আবেগের বস্তুতে পরিণত করেছিল। তারা যিশুর মধ্যে দেখেছিল ‘পিউরিটান’ গোষ্ঠীর প্রতি মাথা নত করার মনোভাব। এই মনোভাবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাধারণ স্তরের ন্যায়নীতি বোধ ও মাথা পেতে শাস্তি মেনে নেওয়ার প্রকৃতি। যদিও ওসব আবেগের কিছু কিছু শোভন ও সৎ তবু তারা কোনোদিন পৌঁছোল না যিশুর বুদ্ধিবৃত্তির স্তরে। সবচেয়ে কদর্য প্রতিফলন ঘটল ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। টর্কুমাডার ইহুদি নিধনে, মেকি নকল চার্চের বর্বরতায় যখন সেইসব চার্চ ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে বসল।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল যিশুর মৃত্যু; যা যিশুরই মতবাদকে কদর্যতায় ভরিয়ে দিল এবং মতবাদটি অধরাই রয়ে গেল। রোমানরা তাদের রাজনৈতিক পাপীদের টারপিয়ন পর্বত থেকে ছুড়ে ফেলে মারলেও ক্রুশবিদ্ধ করে ক্রীতদাসদের শাস্তি দিতে লাগল। তারা ছ-হাজার বিপ্লবী ও স্পার্টাকাস অনুগামী গ্ল্যাডিয়েটরদের ক্রুশবিদ্ধ করে মারল যখন যিশুকে একই গোত্রের বিপ্লবী বলে একশো বছর আগে ইহুদিদের ঊর্ধ্বতন পুরোহিত নিন্দাবাদ করেছিল! একইভাবে যিশুকে নিপীড়িত হতে হল এবং নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল। এবং আশ্চর্য, সেই ক্রুশ ও অত্যাচারের সরঞ্জামগুলো তিনশো বছর পরে হয়ে উঠল যিশুখ্রিস্টের আইনি প্রতীক! সমস্ত খ্রিষ্টান রাজ্য জুড়ে অত্যাচারের ক্রুশটাই হল ধর্মের বিধিসম্মত অঙ্গ। মোমের ঘর যেমন আগুনের কাছে এক ভয়ংকর অবস্থান, ক্রুশবিদ্ধ নৃশংসতাও তেমন ভয়ংকর এক অবাধ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়াল। ভয়ংকরতা হয়ে উঠল প্রাপ্তমনস্ক খ্রিস্টানদের এক আরাধ্য বস্তু। যিশুর পবিত্র জীবনবারি পূতিগন্ধময় হয়ে উঠল। সেই দুর্গন্ধ জল বয়ে এল আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। আর আমাদের ধর্মযাজকরা বাইযাপাস ও পন্টিয়াস পদ্ধতিকে সেই আরাধ্য বস্তু করে তুলল তাদের ঘৃণিত ও বর্জিত ‘পূজার বলি’টির নামে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি আরও ঘোরালো হয়ে উঠল যিশুর জন্যই। নৃশংসতাজনিত যিশুর হতাশা, কূটনৈতিক অকর্মণ্যতা, নানা ভুলত্রুটির জন্য আক্ষেপ ইত্যাদিতে জর্জরিত যিশু। এই জর্জরতায় আক্রান্ত হলেন সুইফট, রাসকিনের মতো অনেকেই। তাঁদের যুক্তিবাদ পীড়িত হল মানবতার এই অবমাননায়। এই হতাশা বোধে আক্রান্ত হয়েই যিশু পিটারকে বোঝালেন যে স্বয়ং তিনি পরিত্রাতা; মৃত্যু তাঁকে রুখতে পারবে না এবং তাঁর ‘পুনর্জাগরণ’ (resurrection) ঘটবে এবং পৃথিবীতে কায়েম হবে তাঁরই রাজত্ব। এবং তা চিরকালের জন্য। শিষ্যদের যা বুদ্ধির বহর তাতে যিশুর এই অলীক কল্পনা সমাজে বেশ ভালোভাবে গেঁথে গেল। যিশুর সমাজতত্ত্ব তাঁদের মাথায় ঢুকলই না। যিশুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল ‘ক্রাইস্ট’ নয় ‘ক্রুশ’-এর তত্ত্বে; যাকে বলে ‘খ্রিস্টানিবি’। তারপর এক গাঁজাখোরের বর্ণনায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘উন্মোচন’ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বলে, যিশু তাঁর শপথ অনুযায়ী এক হাজার বছর পরে ফিরে আসবেন এই ধরিত্রীতে। ১০০০ সালে তাঁর সেই আগমনের দিনটি পার হয়ে গেল। কিন্তু এই বিলম্বও তখন মানুষের এতই গা সওয়া হয়ে গেছে যে তারা এই দিনটিকে বদল করে দ্বিতীয় একটি দিন ঘোষণা করল যেদিন যিশুর আবির্ভাব ঘটবে। সেদিনও যিশু এলেন না। আশ্চর্য, যিশুর আবির্ভাবের বিষয়টি কিন্তু সন্দেহাতীত! এই হল এখন এক কায়েমি খ্রিস্টধর্ম।
সমগ্র প্রক্রিয়াটিই একটি আজগুবি জগাখিচুড়ি। যিশুর আবির্ভাবের পরেই সভ্যতার পতন নেমে এল এবং এই বিভ্রান্তিটি উত্তমরূপে প্রচারিত হয়ে গেল, যিশুর মতবাদ নাকি সবার ঊর্ধ্বে এই বিভ্রান্তিকর প্রচারটির জন্যই দায়ী নয়। মধ্যযুগের অন্ধকার, আর এই অন্ধকার থেকে আমাদের ক্রমমুক্তি ঘটছে যিশুরই প্রগতিশীল সব চিন্তার সূত্রকে আঁকড়ে ধরে। এইভাবেই আমরা সভ্যতাকে বাঁচাতে চাইছি। যিশুর চ্যালাদের জগাখিচুড়ি থেকে।
যিশুর মৃত্যুর দু-শো বছর মহম্মদ প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলাম ধর্ম। নিষ্প্রাণ পাথরপ্রতিমা পুজোকে পিছে ফেলে ইতিহাস অনেকটা এগিয়ে গেল। তিনি জয়ী নৃপতিরূপেই মৃত্যুবরণ করেন। তবুও তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আরবদের নিয়ন্ত্রণ করার তার নেই যতক্ষণ না ধার্মিকদের প্রাণে এক রমণীয় জীবন বিশ্বাস সৃষ্টি করা যাচ্ছে। বলেছিলেন, পাপীকে তার মৃত্যুর পর এক শাশ্বত শাস্তির ভয় দেখিয়ে বশে আনতে হবে। তবে কিছু কিছু অহিংসা প্রতিবাদের পর তাঁর শিষ্যদের শিশুসুলভ কিছু কুসংস্কার মেনে নিতে হবে। এইসব কারণে মহম্মদকেও নূতন করে আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। যতক্ষণ না ‘ইসলাম’ একটি প্রাণবন্ত ধর্মে পরিণত হচ্ছে। আর এখন তাই মনে হচ্ছে ‘শ্যামাঙ্গী’র ঈশ্বর-অভিযানটির ব্যাপারে আর ধন্দ রইল না। এই অভিযানের গন্ধ কোনো শ্বেতচর্মের মহিলার নাসিকায় ঢুকবে না। কারণ তিনি জন্মাবধি মেকি খ্রিস্টান চার্চে জারিত হয়ে এসেছেন। আমি ধরে নিচ্ছি গল্পের ধার্মিক মানুষটি হল মানবের প্রেত বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে একটি নিরপেক্ষ বাইবেলের মূল্যায়নে, একের পর এক ঈশ্বরের ক্রমান্বয়ে যতক্ষণ না তার ধ্যানধারণা বদল হয়। ঈশ্বর হয়ে ওঠেন প্রেতপুরীর প্রাণীর থেকে শ্রদ্ধেয় এক পিতা। অবশেষে মেয়েটির উত্তরণ দেহ, কামনা-বাসনা থেকে হৃদয়ের জমিতে। এবং সর্বশেষে সেই হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয় ‘ভালোবাসাই ঈশ্বর’ বাণীটি। প্রাচীন দুই ঈশ্বর দমনে মেয়েটির মুগুরটি যথেষ্ট। কিন্তু সে যখন সন্ধানের শেষ সীমায় পৌঁছোচ্ছে তখন তাকে বুঝতে হচ্ছে ভালোবাসাই সব নয় (এডিথ ক্যাভেলের দেশপ্রেম সম্বন্ধে এই একই ধরনের আবিষ্কারের মত)। ভলতেয়ারের উপদেশটি গ্রহণীয়। বাগান পরিচর্যা করে তার কালো কালো দুধের শিশুগুলোকে বড়ো করে তোলাই শ্রেয়। হাতের মুগুর নিয়ে সৌরজগতের রহস্য খুঁজে পাওয়ার শপথ গ্রহণ করে ঘুরে বেড়ানো সমীচীন নয়।
কিন্তু মুগুরটির মূল্য ফুরোয়নি। পথ সীমা করার কাজে সেটা লাগবেই। ধর্ম বিদ্রোহী হওয়াটাই সব নয়। নব্য সভ্যতার যুগে নোয়ার ঈশ্বরকে মেনে নেওযার প্রশ্ন উঠলে আমাদের সন্তানসন্ততি পাপমুক্ত হতে সেই ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দেবে; নাকি নিজেকে আরও সস্তা প্রতিপন্ন করে আরও একজনের আড়ালে ঠাঁই নেবে যিনি ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রাণ? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মুগুরটি সরিয়ে রেখে বাহুবলকে তুচ্ছ করা হাস্যকর ঘটনা। যে বা যিনি এই শক্তিপ্রয়োগে অপারগ, আধুনিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় তার স্থান নেই। এই উপদেশটির মূল্য আজকের পৃথিবীতে এতই জরুরি যে আমার প্রেরণার গহনে তা উপলব্ধি করে এই কাহিনিটিকে মঞ্চের হাস্যকৌতুকের সঙ্গে নাট্যসাহিত্যকে ভারাক্রান্ত না করে গল্পের আকারেই প্রকাশ করতে হল।