দুই
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল মেয়েটি। খুঁজে খুঁজে একটা পাতকুয়োর ধারে এসে দাঁড়াল। এক আঁজলা জল তুলে মুখে দিতে যাবে, কোত্থেকে একটা লোক এসে হাজির! শূন্য থেকে একটা পেয়ালা এনে এগিয়ে ধরল তার দিকে। আশ্চর্য! লোকটিকে আগে দেখতেই পায়নি সে।
‘আমার স্মৃতিতে এই পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কণ্ঠ সিক্ত করো, হে রমণী!’ লোকটি ঘোষণা করল বেশ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে।
মাথা নামিয়ে মেয়েটিও অভিবাদন জানাল তাকে। তারপর জল খেল ঢকঢক করে। পেয়ালাটা ফেরৎ দিতেই লোকটি সেটা ফের শূন্যে অদৃশ্য করে ফেলল। মেয়েটি হেসে বলল, ‘বাঃ দারুণ ভেল্কি তো! মস্ত জাদুকর আপনি! যাক, আপনিই তবে বলতে পারবেন ঈশ্বর কোথায়।’
জাদুকর: তোমার মধ্যেই। আমার মধ্যেও বটে।
কালো মেয়ে: কিন্তু তিনি স্বয়ং আমি, না আমার কেউ?
জাদুকর: বলতে পার তোমার পিতা।
মেয়েটি মোটেই খুশি হল না এ কথায়। বলল, ‘মাতা নয় কেন?’
জাদুকরও কেমন যেন একটু দমে গেল এ কথায়। বলল, ‘আমার কথাই বলি। মাকে ধরে বসে থাকলে ঈশ্বর সন্ধান হতোই না। তবে হ্যাঁ তাঁর আঁচলে আঁচলে থাকলে কিছু টাকা-কড়ি হাতে নিয়ে জমিয়ে বসতে পারতাম। এমন দলছুট ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না।’
কালো মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আর আমার কথা বলি। বাপটা সবসময় পেটাতো আমায়। তারপর বড় হতে এই ডাণ্ডাটা হাতে পেলাম। একদিন বাপটাকেই এক বাড়ি মেরে মাটিতে পেড়ে ফেললাম একেবারে। জানেন, একটা সাদা মানুষের কাছে আমায় বিক্কিরি করে দিচ্ছিল আর একটু হলেই। না না, ঈশ্বর আমার বাপ একথা বলবেন না দয়া করে।’
জাদুকর হেসে বলল, ‘বাপ বলে না মানো, এটা মানো তো যে ঈশ্বরের করুণায় আমরা একে অপরকে ভালোবাসি নিজেরই ভাই বোনের মতো?’
কালো মেয়েটি জবাব দিল, ‘উঁহু। মেয়েদের ভালোবাসা ভাইয়ের থেকে এক সময় ঘুরে যায় অপরিচিত মানুষের দিকে। এই যেমন আমার যাচ্ছে, আপনার দিকে।’
জাদুকর: আচ্ছা আচ্ছা, ভাইবোন বা মা এসব পারিবারিক উপমা ছেড়ে দাও। আমরা হচ্ছি মানবগোষ্ঠী। এক পরিবারভুক্ত। সকলে সকলকে ভালোবাসি— এই ভাবে বললে কেমন হয়? যে তোমায় ঘৃণা করে, তাকে ভালোবাসো। যে তোমায় অভিশাপে ভস্ম করে তাকে তুমি আশীর্বাদে ভরিয়ে দাও।’
মেয়েটি তবু খুশি হয় না। বলে, ‘না না, সক্কলকে ভালোবাসা বিলানো যায় না। এই ধরুন আমার এই ডাণ্ডাটা দিয়ে সকলকে পেটানো উচিৎ কি? অথচ ঈশ্বর কিছু লোক তৈরি করেছেন যাদের আমি পছন্দ করি না, আর তারাও আমায় করে না। তাই পেটাতেই হয়। আর এমন কিছু লোক আছে যাদের এক্ষুনি সাপের মত মেরে ফেলা উচিৎ। কারণ তারা মানুষকে শুষে খায়।’
জাদুকর: ঐ সব খারাপ লোকেদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমায় কষ্ট দিও না, দোহাই।
কালো মেয়ে: যা খারাপ তা ভুলে থাকলে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু তাতে সুফল কিছুই মেলে না। আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন?
জাদুকর: একটু কুঁকড়ে গেল এই প্রশ্নে। কিন্তু পরমুহূর্তে হেসে বলল, ‘এসব বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যেও না।’
কালো মেয়ে: কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যাপারে আর উৎসাহ না থাকলে কোন কিছুরই তো মানে হয় না। এই তো বললেন আমার উচিৎ সব্বাইকে ভালোবাসা। তাহলে আমি আপনাকে ভালোবাসি একথা বলতে পারি তো? এটা কি ছোট মুখে বড় কথা হল মনে করেন?
জাদুকর: ছি ছি, তা কেন? ওসব ভেবো না। তুমি কালো হতে পার, আর আমি সাদা। কিন্তু দুজনেই ঈশ্বরের সৃষ্টি, দুজনেই সমান।
কালো মেয়ে: এ আবার কী ভেবে বসলেন! কালো-সাদার কথাটা তো চিন্তাই করিনি আমি। ধরুন আমি এক সাদা চামড়ার রানী আর আপনি আমার রাজা। —ওকী, চমকে উঠছেন কেন?
জাদুকর: না না, ও কিছু না। মানে, কী জানো, আমি হচ্ছি দীনের অধিক দীন। তাও নিজেকে মাঝে মাঝে রাজা বলে ভেবে বসি। কেন জানো? কপটতা পেয়ে বসে।
কালো মেয়ে: আ হা হা, রাজা যেন কী একটা মহান বস্তু! মহাপাজী হয় কিছু রাজা। যাকগে, ধরুন আপনি হলেন রাজা সলোমন আর আমি হলাম রানী শিবা। বাইবেলে যেমন আছে আর কি। আপনার কাছে এসে বললাম, ওগো, তোমাকে ভালবাসি। তার মানে আমি তোমাকে চাই, অর্থাৎ অধিকার করতে চাই। এইভাবে প্রেমের নামে এক মত্ত সিংহীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি আপনাকে দখল করে নিলাম। আপনাকে এরপর থেকে চলতে হচ্ছে আমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী। আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম আর নেই। আপনি আর ঈশ্বর-এর মাঝে আমি এসে হাজির হচ্ছি। এটা কি অত্যাচার নয়? ভালোবাসা প্রেম এসব না মানুষকে আসলে গিলে খেতে আসে। আপনি কি চাইবেন স্বর্গেও এই প্রেম বিরাজ করুক?
জাদুকর: প্রেম ছাড়া আবার স্বর্গ হয় নাকি?
কালো মেয়ে: হয় না, তবে সে প্রেম আলাদা। সে প্রেম মহান। ‘আমি তোমার, তুমি আমার’ বলে জাপটা জাপটি প্রেম নয়। এ ওর গলা ধরে ঝুলে পড়া নয়। জানেন, সাদা মানুষগুলো আমার সঙ্গে বড় একটা মেশে না পাছে কালো চামড়ার মেয়ের প্রেমে পড়তে হয়! ভাই বোন সেজে ভগবানের সেবা করতে বেরোয় তো ওরা। সমস্ত প্রেম নিবেদন করে ঈশ্বরকে আর নিজেরা উপোসী থাকে।
জাদুকর: দুঃখের কথা।
কালো মেয়ে: দুঃখের কথা তো বটেই! বোকা কোথাকার। শরীর যেমন প্রেম চায়, তেমনি মন চায় একাকীত্ব। সেখানে অপরের প্রেমের দৌরাত্ম্য অচল। একটা শরীর, একটা মন নিয়ে চলা যায় না। প্রত্যেকের প্রয়োজন আর একটা শরীর, আর একটা মন। কিন্তু হৃদয়, আত্মা? সে চায় একাকীত্ব। —ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেম। তাই আপনার মতো মানুষের কাছে যখন কোন নারী এসে বলে দেহ দাও, মন দাও, আত্মা দাও, হৃদয় দাও, সব দাও, তখন আপনি আর্তনাদ করে ওঠেন। ঈশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে একা চলতে হয়, সবাইকে প্রেম বিলোও এ সব কথা ছলনা ছাড়া কী বলুন তো? যে শিকারী তার ক্ষুধার্ত শিশুর জন্য প্রাণী হত্যায় বেরিয়েছে, তাকে ‘রক্তপাত ঘটিও না’ বলে উপদেশ দেওয়া যায় কি? ঈশ্বরের প্রেমের মাঝে আবার জীবে প্রেম বলে মানুষকে টানা কেন?
জাদুকর: তবে কি বলতে চাও এই বাণী বিলোব যে তোমরা একে অপরকে হত্যা করো?
কালো মেয়ে: দেখুন আপনাদের বাণী-টানীগুলো, সব না সস্তার দাওয়াই। বেশ চলে বাজারে। আমি ওসব বাণীর সন্ধানী নই। আমি ঈশ্বর সন্ধানী।
জাদুকর: তবে চালিয়ে যাও তোমার সন্ধান। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন এই কাজে।
বলে অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুকর।
আরো মাইলখানেক হেঁটে মেয়েটি দেখা পেল এক জেলের। সেই কবেকার মান্ধাতার আমলের লোক। কাঁধে একটা প্রকাণ্ড গীর্জা বয়ে নিয়ে চলেছে। মেয়েটি তাই দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে আরে নড়বড়ে ঘাড়টা ভাঙল বুঝি!’ এই বলে সে সামলাতে গেল জেলেকে। জেলে বলল, ‘উঁহু, কিচ্ছুটি হবে না আমার। আমি পাথর আর আমার কাঁধে এই দেবতার আধার।’ বেশ উৎফুল্লই দেখাচ্ছিল তাকে। কালো মেয়ে তবু চেঁচাল, ‘কে বলেছে তুমি পাথর? চেপ্টে মরবে যে!’ জেলে বলল, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ।’ তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আসলে এটা কাগজের তৈরি। এই দেখ এটা নিয়ে কেমন নাচতে পারি।’ এই বলে গীর্জা কাঁধে নাচতে নাচতে বুড়ো জেলে চলে গেল। গীর্জার ঘণ্টাগুলো তালে তালে বাজতে লাগল দুলুনিতে, রিনটিন রিনটিন করে। এর পরই ঢুকল কোত্থেকে সব দলে দলে লোক। সব্বার ঘাড়ে একটা করে কাগজের গীর্জা। আর সবার মুখেই এক কথা— ওগো মেয়ে, জেলেকে বিশ্বাস কোরো না। আমার গীর্জাটা একদম খাঁটি, সত্যিকারের। মেয়েটার এসব অসহ্য লাগল। পথ ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। ঢুকতেই হল, কারণ লোকগুলো এরই মধ্যে বচসা বাধিয়েছে, এ ওকে ঢিল, পাথর ছুঁড়ে মারতে লেগেছে। নাঃ এখানে ঈশ্বরের খোঁজ মিলবে না মোটেই।
ওরা চলে যেতে মেয়েটি কী মনে করে রাস্তাতেই এসে দাঁড়াল। দেখা পেল এক ইহুদির। ইহুদিটি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনি এসেছেন কি?’
কালো মেয়ে: ‘তিনি’টি কে?
ইহুদি ঐ যে যিনি বলেছিলেন আসবেন! তাঁর এক্ষুনি আসা দরকার। মানুষ মানুষকে ধরছে আর মারছে।
কালো মেয়ে: কেউ এলেই এই মারামারি থেমে যাবে ভাবছেন?
ইহুদি তিনি আসবেনই আসবেন। সব কিছু ঠিকঠাক করে দেবেন তিনি।
কালো মেয়ে: সব কিছু ঠিকঠাক হবার জন্যে বসে থাকলেই হয়েছে আর কী! তাহলে চিরকালই বসে থাকুন।
এই না শুনে ইহুদিটি হায় হায় করে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দিল মেয়েটির গায়ে। তারপর গটমট করে চলে গেল।
এই ইহুদিটাও বেশ বুড়ো। এই বুড়োগুলোর পাল্লায় পড়েই মেয়েটা নাজেহাল। ইহুদিটি চলে যেতে তাই সে খুশিই হল। হাঁটতে হাঁটতে এল একটা গাছের ছায়ায় ঘেরা সরোবরের ধারে। দেখল সেখানে জনা পঞ্চাশেক ওরই জাতের কালো মানুষ কতগুলো সাদা সাহেবের চাকর হয়ে এসেছে। চাকরেরা নিজেদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সারছিল। একটু দূরে বসেছিল ওদের সাদা প্রভুরা আর তাদের সাদা সাদা বউরা। টুপি আর আঁটোসাঁটো প্যাণ্টালুন পরা প্রভুদের দেখে বোঝাই যাচ্ছিল এরা পর্যটক।
চাকরদের সর্দারটিকে ইশারায় ডেকে কালো মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘এরা কীসের পর্যটনে বেরিয়েছে?’
সর্দার চাকরটি বলল, ‘এঁরা ”কৌতূহল” সংস্থার মানুষজন।’
মেয়েটি আরো জানতে চাইল, ‘এরা ভালো না খারাপ?’
‘ভালো খারাপের বোঝেটা কী এরা? শুধুই নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির করে ঝগড়া করে। উদ্ভট সব বিষয় নিয়ে তর্ক করে।’ চাকরটি জানাল। একটা মেমসাহেব হঠাৎ কালো মেয়েটিকে দেখতে পেল। দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই মেয়ে, চলে যাও! হটো হটো। চাকরগুলোর সব মাথা খাবে দেখছি।’
কালো মেয়েটিও চেঁচিয়ে বলল, ‘মাথাতো খেয়েই নিয়েছেন আগে।’
মেমসাহেবটি গর্জে উঠল, ‘কী! আমার পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়ে গেল, আমি খাব ওদের মাথা? যাও যাও নিজের কাজে যাও।’
কালো মেয়ে কিন্তু নড়ল না। বলল, ‘ওরা আপনাদের মত মেমসাহেব নয়, ওদের মাথা সাফ থাকবে। আচ্ছা, আপনারা ”কৌতূহল” সংঘের লোকজন, তা কীসের কৌতূহল জানতে পারি কি?’ তারপর একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঈশ্বর সম্বন্ধীয় ব্যাপারস্যাপার কিছু?’
‘ঈশ্বর সম্বন্ধীয়’ শুনেই তারা এমন হেসে গড়িয়ে পড়ল, যে সাহেবগুলো, যারা এতক্ষণ ঢুলছিল, চমকে-টমকে একাকার। ‘কী হয়েছে, হয়েছেটা কী’ বলে তারাও বেশ আগ্রহ দেখাতে লাগল। হাসির কারণটা তখন তাদের বেশ করে বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দিতে হল। শুনে সাহেবদের মধ্যে একজন বলল, ‘সভ্যদেশে বহুদিন হল ঈশ্বর-চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে।’ একজন বলল, ‘সেই কোন কালের শেক্সপীয়র কী পীর নাকি? আঠারশো শতাব্দীর জাতীয় সঙ্গীতে ঈশ্বর নেই? তাঁর সঙ্গে নোংরা রাজনীতি জড়িয়ে গান লেখা হয়নি?’ সেই দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, ‘না-না, সে ঈশ্বর এ ঈশ্বর নন! . . . মধ্যযুগের ঈশ্বর আমাদের নাকে ঝামা ঘষেছেন! বুর্জোয়ারা এসে ঈশ্বরের নাকেই ঝামা ঘষল।’ প্রথম ভদ্রলোকটি বলল, ‘আর তারপর পেটি বুর্জোয়ারা? তারা দেবদূতের পরিষ্কার স্লেটে দুনম্বরী রোজগারের হিসেব কষতে লাগল।’ তৃতীয় ভদ্রলোক বলল, ‘এই দুই ঈশ্বরই এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন, কী বল?’ কালো মেয়ে মনে মনে কী সব হিসেব কষে বলল, ‘তাহলে ঈশ্বর সংখ্যা দাঁড়াল ছয়। কিন্তু যে-ঈশ্বরকে আমি খুঁজছি তিনি এরা কেউ নন।’
প্রথম ভদ্রলোক: তুমি ঈশ্বরকে খুঁজছ? তোমার গোষ্ঠীতে কী সব ভূত প্রেত আছে শুনি, তাদের নিয়েই তো থাকলে পারো। ভাবছ আমাদের ঈশ্বর তাদের চেয়ে বড় কিছু হবেন?’
তৃতীয় ভদ্রলোক: আমাদের তো নানারকম পাঁচমিশেলি ঈশ্বর। তাদের একটাকেও তোমাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না।
কালো মেয়ে আপনাদের যাজকেরা আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাস দিয়েছেন, আর আপনারাই যদি এভাবে ঈশ্বর বিরোধী হন তাহলে আমাদের হাতে কোনদিন খুন হয়ে যাবেন! আমরা সংখ্যায় অগুন্তি। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রও আছে।
দ্বিতীয় ভদ্রলোক: এ কথাটা ভাববার মত বটে। আমরা যা মানি না তা এদের শেখাতে আসি কেন? এ অন্যায়। কেন সত্যি কথাটা এদের শেখাই না যে পৃথিবীর সৃষ্টি নিছক প্রাকৃতিক কারণে, আর ঈশ্বর হচ্ছেন গল্পকথার নায়ক?
প্রথম ভদ্রলোক: এসব বললে ওরা কী শিখবে জানেন? ধর্ম নেই, পাপ বলে কিছু হয় না, তাই জোর যার মুল্লুক তার। আর সেটা শিখলেই আমাদের ওরা গুঁড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন ওদের জোর কিছু কম নয়। আমরা ওদের ধরে ধরে চাকর বানিয়েছি কেন সে তো ভালোই জানি— ওরা আমাদের চেয়ে বেশি চটপটে, বেশি পরিচ্ছন্ন। আর বুদ্ধিতেও ওরা পিছিয়ে নেই।’
‘ওদের আচার ব্যবহারও অতীব প্রশংসনীয়’— এক ভদ্রমহিলার স্বীকারোক্তি শোনা গেল।
‘ঠিক,’ জানালেন প্রথম ভদ্রলোক। ‘একটা ঈশ্বর-টিশ্বরে ওদের মতি করান দরকার। সেই ঈশ্বরই ওদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে যেদিন আমাদের ঈশ্বর-অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ওরা জেহাদ ঘোষণা করবে।’
এক চশমা পরা মহিলা বেশ গম্ভীর গলায় এবার বলে উঠলেন, ‘কোন কিছুকে ঋণাত্মক কোন সংখ্যার বর্গমূল দিয়ে ভাগ করতে বললে ওরা পারবে? পারবে না। তাই বলছি ঈশ্বর-টিশ্বর বোঝান, কিন্তু সৌরজগৎ নিয়ে যেন কিছু বলতে যাবেন না। ঐ বর্গমূলের মধ্যেই সৌর রহস্যের আসল চাবিকাঠি।’
দ্বিতীয় ভদ্রলোক: বাজে কথা। ঋণাত্মক সংখ্যার বর্গমূলটা স্রেফ ধাপ্পা। আসলে প্রাকৃতিক পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার।
এক ভদ্রলোক হতাশ জর্জর গলায় হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এসব কথার কী প্রয়োজন? আসল কথা, দিনে দিনে সূর্যের হল্কা কেমন যেন কমে আসছে। আমরা কোনদিন না ঠাণ্ডায় জমে মরি! এই নির্মম সত্যের নিরিখে এসব আলোচনার কোন মানে নেই, থাকতে পারে না।’
‘সাধু সাধু!’ কে একজন ছোকরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে গলা ঝেড়ে বক্তৃতা শুরু করল— ‘আমাদের এই ভ্রাম্যমাণ সঙ্ঘের প্রধান চিকিৎসক রূপে আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে যতক্ষণ না সৌর বিকিরণের ঘটনাবলি ত্যাগ করছেন ততক্ষণ বিশ্বাস রাখতেই হবে যে সূর্য দিন-দিন উত্তপ্ত হচ্ছে এবং এর ফলে আমরা না ঝলসে মরি কোনদিন!’
হতাশ ভদ্রলোক বললেন, ‘এসব কথায় কীসের সান্ত্বনা? একদিন না একদিন তো আমাদের বিলীন হয়ে যেতেই হবে!’
প্রথম ভদ্রলোক: উঁহু, তা মোটেই জোর দিয়ে বলা যায় না।
‘না, বেশ জোর দিয়েই তা বলা যায়!’ হতাশ ভদ্রলোক রূঢ়স্বরে জানালেন। ‘তাপের অন্তঃস্থলে জীবনের অনুভূতি বিদ্যমান, এটা প্রমাণিত সত্য এবং এ সত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলাই অবান্তর। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া বাতাসে যেমন বাঁচতে পারি না ঠিক তেমনি শবদাহের চুল্লিতেও না। পৃথিবী এই দুইয়ের যে কোন একটি অবস্থায় পৌঁছলেই তো আমরা খতম!’
প্রথম ভদ্রলোক: দূর! তাও আবার হয় নাকি? এই দেহ, যা কিনা আমাদের একান্ত অংশ, যা কিনা তাপমাত্রার একান্ত অসহায় শিকার, তা একদিন বিলীন হবেই এবং তা হবে ঘরে দোরেই, স্বাভাবিক আলো হাওয়ার মাঝেই। কিন্তু মরা আর জ্যান্তে তো তফাৎ আছেই! কোন না কোন উপায়ে তা তাপমাত্রার অধীন কিনা সেটার প্রমাণ পাওয়ার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। না হাড়, না মাস, না রক্ত— কোনটা দিয়েই এ তফাৎ করা যাবে না যদিও এই হাড় মাস রক্তই বিচিত্র এক নিয়মে গড়ে তোলে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তফাৎটা অশরীরী। এটা বুঝতে হলে তড়িৎ চুম্বকীয় স্রোতকেই অবলম্বন করতে হবে তার কম্পনের হার অনুযায়ী, ইথার তরঙ্গের ঘূর্ণীতে, অবশ্য ইথার বলে যদি কিছু থাকে। অর্থাৎ কিনা ইথারের যদি কোন অস্তিত্ব থাকে এবং থাকলেও তা ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া কোন গ্রহেই আছে কিংবা আছে গনগনে সূর্যের জ্বালামুখে।’
এই দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘জানছেন কেমন করে যে সূর্য অতি গরম বস্তু?’
সেই হতাশ ভদ্রলোকটি ওপর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘অ্যাঁ, আফ্রিকার রোদে বসে এই কথা বলছেন!’
‘ফোড়নও কড়ায় পড়লে মনে হয় গরম, কিন্তু সেই গরমে কি দেশলাই কাঠি জ্বালানো যায়?’ ভদ্রমহিলাটি তর্ক জমালেন।
‘মনে অমনি হলেই হল? মনে হতে পারে পিয়ানোর ডান ধারের স্বরলিপি বুঝি বাঁ ধারের চেয়ে উচ্চগ্রামের। আসলে তো তারা সমান সমান!’ বেশ উৎসাহ ভরে আর এক মহিলা কাটান দিলেন। অন্য এক মহিলা চিৎকার জুড়লেন, ‘মনে হতে পারে বুনো কাকাতুয়ার রঙ বুঝি খুব চড়া, কিন্তু তা আসলে ঘরোয়া চড়ুইয়ের রঙের চেয়েও ফিকে। মনে অমনি হলেই হল?’
এক ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভদ্রলোক সমঝোতা করতে চাইলেন, ‘এসব হেঁয়ালির জবাব দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এসব প্রাচীন কূট তর্ক। আমি মশাই ছুরি কাঁচি ধরা বদ্যি। আমি বলছি, শুনুন সকলে, মেয়েছেলেদের ঘিলুতে যে বাটির মত জিনিসটা থেকে রক্ত চালান যায় সেটা ব্যাটাছেলেদের বাটির চেয়ে কিঞ্চিৎ বৃহৎ। ফলত ক্ষরিত রক্তের আধিক্য ওঁদের, অর্থাৎ মেয়েছেলেদের ভাবনা চিন্তাকে কিঞ্চিৎ জট পাকিয়ে দেয়। ফলত ফোড়নের ঝাঁঝকে গরম মনে হয়, পিয়ানোর স্বরলিপিকে মনে হয় হেঁড়ে গলায় হাঁকডাক, বুড়ো কাকাতুয়ার রঙকে ওরা চড়া স্বরের হৈচৈ ভেবে বসে।’
সেই প্রথম ভদ্রলোকটি এই শুনে বললেন, ‘বাঃ, ডাক্তারবাবুর সাহিত্যবোধ খুব প্রশংসনীয়। কিন্তু এটাই আমার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। কথা ছিল সেটি কী বস্তু, যা কিনা সূর্যের তাপ হয়েও গরম ফোড়ন? সেটি কি চাঁদের নাকি বরফের হিম, নাকি নিছক গোবেচারি লোকের প্রতি নিক্ষিপ্ত ব্যঙ্গের ঝাল? এই সমস্ত অঘটনেরই তো অকুস্থল এই পৃথিবী।’ সেই হতাশ ভদ্রলোক বললেন, ‘উঁহু, পৃথিবীর শীতলতম অঞ্চল অকুস্থল হতে পারে না। কারণ তা বাসযোগ্য নয়।’
প্রথম ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু উষ্ণতম অঞ্চল যোগ্য তো বটে! এবং এও বলে দিচ্ছি, শীতল অঞ্চলেও মানুষকে বাস করতে হবে একদিন যেদিন জনসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া মেরু অঞ্চলে তো পেঙ্গুইনরা দিব্যি রয়েছে। আর সূর্যের মধ্যিখানেও তো বাস করার ক্ষমতা রাখে সালামাণ্ডার সরীসৃপ। আমাদের ঠাকুমাদিদিমারাও তো নরকের কুণ্ডে দিব্যি রয়েছেন!’ হতাশ ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে অমনি বলে উঠলেন, ‘নরকে যাদের বিশ্বাস আছে, হাবিজাবি সব জিনিসেই তাদের বিশ্বাস। এমনকী তারা বংশপরম্পরায় অর্জিত অভ্যাসেও বিশ্বাসী।’
এই শুনে দলের প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোকটি বললেন, ‘আপনি বিবর্তনবাদে বিশ্বাস রাখেন নিশ্চয়ই?’
হতাশ ভদ্রলোক জানালেন, ‘নিশ্চয়ই। আমাকে কি আপনি মৌলবাদী ঠাওরালেন নাকি যে এ প্রশ্ন করছেন?’ ‘যদি তাই হয় তবে যাবতীয় অভ্যাস এবং বংশপরম্পরায় অর্জিত অভ্যাসে আপনার তো বিশ্বাস থাকা উচিত। কিন্তু হায়, সেই স্বর্গীয় উদ্যানের বিশ্বাসই যে রক্তে বইছে সবার! নতুন বিশ্বাস গ্রহণ করুন, সেই সঙ্গে পুরনোগুলোকে দূর করে দিন। তা না, বিজ্ঞান-বিজ্ঞান করছেন আর অন্তরে মৌলবাদী হয়ে বসে রয়েছেন। তাই বলি, আপনারা নির্বোধ; প্রতিক্রিয়াশীল বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার পয়লা নম্বরের শত্রু। নড়ে বসতে হলেই আপনারা চেল্লাতে থাকেন— থামাও থামাও, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’
সেই প্রথম ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ, এসব ভাঙাটাঙার ব্যাপারে সবাই একমত। যদিও অন্য কোন ব্যাপারে মতৈক্য হওয়াটা বড়ই কঠিন।’
একজন মহিলা একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘অন্তত এই মুহূর্তে ওঁরা কিন্তু একটি বিষয়ে একমত।’ প্রথম মহিলাটি উৎসুক হলেন, ‘কী, কী বিষয়ে?’
‘ঐ যে, ঐ বিষয়ে—’ বলে সেই মহিলা আঙুল তুলে কালো মেয়েটিকে দেখালেন।
প্রথম মহিলা একবার ভালো করে কালো মেয়েটিকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আরে, তুমি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছ? কখন চলে যেতে বলেছি!’ কালো মেয়ে নিরুত্তর। মন দিয়ে মহিলাটিকে সে দেখতে লাগল; তার হাতের মধ্যে ডাণ্ডাটি মৃদু মৃদু পাক খেতে লাগল। চলে তো সে গেলই না, উল্টে অঙ্কবিদ মহিলাটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী সব মূল-টুল বলছিলেন না? কোথায় হয় ওসব, জানতে পারি কি?’
‘কোথায় আবার কী হবে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অঙ্কবিদ মহিলা।
‘ঐ যে মূল না মূলো কী বলছিলেন?’
মহিলাটি এবার নরম হয়ে বললেন, ‘আসলে ওটা বর্গমূল, অর্থাৎ একটা সংখ্যা। . . .আচ্ছা, তুমি এক দুই করে গুনতে পার?’ কালো মেয়েটি কর গুনে গুনে বলল, ‘এক দুই তিন চার পাঁচ— এইভাবে বলছেন?’
‘ঠিক!’ অঙ্কবিদ মহিলা বললেন, ‘এবার একের থেকে উল্টো দিকে গুনে যাও দেখি!’
‘এক, একের চেয়ে কম এক, একের চেয়ে কম দুই, একের চেয়ে কম তিন. . .’ মেয়েটি হিসাব করে চলে।
অমনি হাততালি পড়ে যায়। একজন বলে ওঠে, ‘চমৎকার!’ কেউ বলে, ‘স্বয়ং নিউটন!’ কেউ আহ্লাদিত হয়ে বলল, ‘লিবনিজ!’ কেউ চেঁচাল ‘আইনস্টাইন!’ একজন জাতিতত্ত্ববিদ ছিলেন সেই দলে। আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘বন্ধুগণ, বলেছিলাম না, পরবর্তী সভ্যতার ধারক এবং বাহক হবে এই কালা আদমিগুলো! হে সাদা মনিষ্যির দল, তোমাদের মেয়াদ শেষ। দলে দলে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়।’
কালো মেয়েটি না বলে পারল না, ‘তোমরাও আমাদের মত হও না। বোকার মত অত অবাক হবার কী আছে? ঐ যে তোমাদের বন্দুক, এও তো বেশ একটা আশ্চর্যেরই বস্তু। আমরা হয়ত একদিন ঈশ্বরকে পেয়ে যাব তবু কস্মিনকালেও বন্দুক তৈরি করতে পারব না। ঐ বন্দুক উঁচিয়ে তোমরা আমাদের দাস বানিয়েছ। এতই কুঁড়ে, ওগুলো আমাদেরই হাতে তুলে দিয়ে ছুঁড়তে বলছ তোমাদের কাজে। তাই একদিন হয়ত বলবে, আর পারি না বাপু, বন্দুকটা তৈরি করে নিয়ে এস তো! এই বলে বন্দুক তৈরির মন্ত্রটাও আমাদের শিখিয়ে দেবে। এমন রঙিন জল তৈরি করেছ যা খেলে লোকে ঈশ্বর-টিশ্বর ভুলে গিয়ে অকপটে খুনখারাপি করে বেড়াতে পারে। সে সব জল আমাদেরই বিক্রি করেছ, তৈরি করতেও শেখাচ্ছ। আর সব সময় আমাদের জমি চুরি করে অনাহারে রেখে তোমাদের ওপর শুধু ঘৃণাই সৃষ্টি করাচ্ছ। আমরা তোমাদের কুটিল সাপের চেয়েও ঘৃণা করি। কিন্তু এর পরিণতি কি জানো? একদিন তোমাদের ঐ রঙিন জল-টল খেয়ে তোমাদের মারতে বের হব আমরা তোমাদেরই বন্দুকগুলো দিয়ে। তোমরা যেমন তোমাদের মধ্যে মারামারি করে মরছ, আমরাও তারপর আমাদের মধ্যে মারামারি বাধাব। যতক্ষণ না ঈশ্বর হাজির হন, ততদিন চলবে এ মারণযজ্ঞ। তিনি যে কোথায় তা যদি জানতাম! আপনারা কেউ দয়া করে বলে দেবেন তিনি কোথায়?’
এক ভদ্রলোক রেগেমেগে বলে উঠলেন, ‘ওরে মেয়ে, আমাদের তৈরি বন্দুক হাতে তোরা যে বাঘ সিংহের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিস, তার বেলা?’
‘হ্যাঁ, ওদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আমরা পড়ছি তোমাদের খপ্পরে। বাঘ সিংহের সঙ্গেই থাকি আমরা, ওরা আমাদের শরীরটা থেঁতো করে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে, হৃদয়টা তো আর থেঁতো করতে পারে না! আর ওদের যখন পেট ভরা থাকে, ওরা আমাদের ছোঁয় না। কিন্তু তোমাদের তো লোভের শেষ নেই, প্রভু! তোমরা আমাদের বংশকে বংশ গতর খাটিয়ে মেরে শেষ করছ। খেতে দাও না, পরতে দাও না, শুধু নিংড়ে নিতে জানো। তোমরা জানো না আমাদের চাহিদার ন্যূনতম মাত্রাটাও। তোমাদের ঈশ্বর নকল, ঝুটো! তোমরা পাষণ্ড, বর্বর। নিজেরাও ঠিকভাবে বাঁচতে শিখলে না, অন্যদেরও বাঁচতে দিতে শিখলে না। ঈশ্বরকে যদি কোন দিন খুঁজে পাই, বলব, হে করুণাময়, ঐ সাদা প্রভুগুলোকে মারবার শক্তি দাও, আর শিক্ষা দাও যাতে আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না মরি।’
প্রথম মহিলা এবার অতি ব্যগ্র হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দেখেছ! কী বলেছিলাম! আমাদের চাকরগুলোর মাথা খাবে মেয়েটা। ওরা কী রকম মন দিয়ে মেয়েটার কথা গিলছে! ওদের চোখগুলো দেখো, কী বীভৎস চাউনি! বন্দুকটা কোথায়! আমি গুলি করে শেষ করব ঐ মেয়েটাকে।’ এই বলে ফস করে একটা রিভলবার বার করে ফেললেন মহিলাটি। কিন্তু অস্ত্রটা খাপ থেকে বার করে বাগিয়ে ধরবার আগেই কালো মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর, ডাণ্ডাটা ঘুরিয়ে এক ঘা কষিয়ে দিয়ে দে ছুট। কালো মানুষের দল ফেটে পড়ল উল্লাসে।
মেয়েটি বহুক্ষণ ছুটে পিছন ফিরে দেখল কেউ ওকে ধাওয়া করে আসছে কিনা। হাঁটতে হাঁটতে পুরনো পথের দিকেই ফিরল সে। সেই ‘কৌতূহলী’ সংঘ তখন অন্য দিকে চলে গেছে। মেয়েটি চলতে চলতে এক সময় দেখল সে সেই কুয়োটার ধারেই ফের এসে দাঁড়িয়েছে। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। সেখানে কারা একটা ছাউনির ঘেরাটোপ খাটিয়ে ঘর মতন বানিয়েছে। সেই ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে কাঠ আর মাটির নানারকম মূর্তি। এ ধরণের মূর্তি বাজারে বিক্রি হয়। হঠাৎ দেখে একটা ক্রুশে হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই জাদুকর। আর ঘরের মালিকটি সেই জাদুকরকে দেখে কাঠ কুঁদে একটা মূর্তি গড়ছে। ঠিক তাদের সামনে পাতকুয়ার পাড়ে চড়ে বসে আছে এক পাগড়ি পরা আরবী। কোমরে গোঁজা আছে ছোরা। সে একমনে মূর্তি গড়া দেখছে আর দাড়ি আঁচড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে গজ গজ করছে— ‘এসব মূর্তি টুর্তি আবার কেন? দেবতার সুসমাচারে এ সব তো লেখা নেই। নেহাৎ পাপাচারে দুর্বল হয়ে আছে, নইলে এই ছুরি বসিয়ে শেষ করতাম।’
জাদুকর বলল, ‘মূর্তি সেজে বেরিয়েই তো রুটির জোগাড় করি। শিল্পীদের কাছ থেকে খাবার পয়সা জুটে যায়। এই জন্যেই ক্রুশের ওপর পড়ে আছি এত কষ্ট করে; খানকতক মূর্তি গড়া হলে তবে ছুটি পাই। ছুটি পেয়েই চলে যাই মানুষের কাছে সত্যের সন্ধান দিতে। কিন্তু কেউ কান দেয় না আমার কথায়। আর তখনই ভেল্কিবাজি দেখাই। ওরা বোকা বনে যায়। অবাক হয়ে পয়সা ছোঁড়ে। ভেল্কির ফাঁকি ধরতে পারে না। ওদের স্বভাবও বদলালো না কোনদিন। যে নিষ্ঠুর সেই নিষ্ঠুরই রয়ে গেল ওরা। নাঃ, ঈশ্বর আমার সহায় নন।’
আরবীটি দাড়ি চুলকে বলল, ‘ঈশ্বরের এমন ব্যাভার মোটেই ভালো নয়। আমিও বেরিয়েছি সত্যের সন্ধান দিতে। আমি বলেছি সব মূর্তিকেই পুজো কর, মূর্তি না জুটলে পাথর এনে মাথায় ঠেকাও। সবের মধ্যেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ বিরাজমান। তাঁর মূর্তি আজও কেউ গড়তে পারেনি, পারবেও না। যদি সে মূর্তি কেউ গড়ে ফেলে তবে বলব স্বয়ং ঈশ্বর নির্দয়। নিজের হাতে টুঁটি টিপে মারব ঈশ্বরকে।’ একটু ভেবে বলল, ‘কিন্তু মারতে গেলে তো তাঁকে সশরীরে পাওয়া চাই!’
জাদুকরটি হাঁ হাঁ করে উঠল— ‘না, না, আমার বাণী হচ্ছে রক্তপাত ঘটিও না।’
আরবী যাদের বাঁচার অধিকার নেই তাদের তো মরতেই হবে। বাগানে ফুল ফোটাতে গেলে আগাছা তো সাফ করা চাই।
জাদুকর: তা, কাকে বাঁচাতে হবে আর কাকে মারতে হবে সে বিচার করবেটা কে? আমার দেশের পাদ্রী মহোদয়েরা জটলা করে কী রায় দিয়েছেন শুনবে? আমার নাকি বাঁচারই অধিকার নেই। হয়ত তাঁরাই ঠিক!
দীর্ঘশ্বাস পড়ল জাদুকরের।
আরবী: আরে, ঐ জন্যে তো আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার পিছনেও হুলিয়া, আমাকে নাকি খুন হতে হবে।
জাদুকর: তোমার বুকের পাটা আছে দেখছি। আমি তো ভয়েই মরছি।
আরবী: না না, প্রশংসার কিছু নেই। মনের জোর পেয়েছি ভগবৎভক্তিতে। সবই তাঁর ইচ্ছা। . . .আচ্ছা, তুমি কখনও কোন বই-টই লিখেছ?
জাদুকর: বই লিখলে কি আর এই ক্রুশে শুয়ে থাকতে হয় আমায়? ছাপার অক্ষরেই তাহলে ছড়িয়ে দিতে পারতাম আমার বার্তা সারা দুনিয়ায়। পয়সাও হত যথেষ্ট। লেখক নই, তবে উপাসনার গান একটা লিখেছিলাম বটে একবার। বুঝলাম, ঈশ্বর চান না আমি লিখি। তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন যে! কথা বলাই আমার কাজ।
আরবী: আমিও আল্লার দয়ায় বেশ কয়েক পাতা লিখে ফেলেছি। কিন্তু কিছু শয়তান বাগড়া দিচ্ছে। আর আল্লাও ওদের চটাতে চান না। তাই করলাম কী, ঐ শয়তানগুলোর পড়ার জন্যে বই লেখা শুরু করলাম। নরকে গিয়ে ওদের কী হাল হবে সেইসব রক্ত জল করা বর্ণনা সাজালাম। পাশাপাশি সাজালাম স্বর্গের পরম শান্তিময় ছবি।
জাদুকর: তুমি তো বেশ প্রতিভাবান লোক হে! নামযশ জুটবেই তোমার কপালে একদিন।
শেষের কথাটা উচ্চারিত হল কিছুটা হতাশায়!
আরবী: যৌবনে শাদী করেছিলাম এক বিধবাকে। ওর দাস হয়ে ছিলাম বলতে পার। ওকে উটে চড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে হত। আর আজ এই অধম আল্লাহ ছাড়া আর কারও দাস নয়। তাঁর আশ্রয়েই বেঁচে আছি শয়তানের কলুষ স্পর্শ বাঁচিয়ে।
খোদাই করতে করতে এবার শিল্পী মুখ খুললেন— ‘যা সুন্দর তাই সত্য। সেই সুন্দরের পুজো কর। যে ঈশ্বর নিজের মূর্তি গড়তে নিষেধ করেন, সে ঈশ্বরে বাপু আমার মতি নেই।’
শুনে আরবীটি একেবারে খিঁচিয়ে উঠল, ‘পাষণ্ড, অবিশ্বাসী! ঈশ্বরের নামে যে সব জন্তুর মূর্তি তৈরি হয়েছে সেখানেও মানুষ মাথা নত করবে বলতে চাও?’
জাদুকর শিল্পীকে দেখিয়ে বলল, ‘এই ছুতোরটার গড়া মূর্তিও নাকি ঈশ্বর!’ শুনে আরবী ভক্তটি বকে চলল একটানা, ‘হ্যাঁ, খ্রীস্টানগুলো তো ভেড়ার মূর্তিকেও ঈশ্বর বলে পুজো করতে শুরু করেছে। তাঁর কোন মূর্তিই হয় না, তো গড়বে কী? তা না পেরে তাঁর তৈরি ভেড়াকে নকল করে তৈরি করছিস আর পুজো করছিস! পাপী কোথাকার! আর তুমিও বলিহারি! ক্রুশে পড়ে আছ সেই নকলের কাজে ইন্ধন জোগাতে! তুমিও কি কম পাপী? তাঁর তৈরি আকাশ মাটিকে নকল করতে বসেছো! খোদার ওপর খোদকারি! বন্ধ কর এসব।’
শিল্পী হাসলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। বললেন, ‘থামো। ঘরের কোণে ঐ পর্দাটা তুলে দেখে এস; এমন সব রূপবান গ্রীক দেবতার মূর্তি গড়েছি যে তোমার আল্লাহও হিংসেয় জ্বলে মরবে। আরে, শিল্পী আরও বড় ঈশ্বর। তোমার আল্লাহ তো মেয়েমানুষ গড়েছেন, পারবেন তিনি প্রেমের দেবী গড়তে?’ এই বলে পর্দা সরিয়ে ভেনাসের মূর্তিটি এনে শিল্পী গর্বভরে বসিয়ে দিলেন।
কালো মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল, ‘ও মেয়ের দেহ তো ঠাণ্ডা, কোথায় ওর প্রাণের স্পন্দন?’
মেয়েটিকে এতক্ষণ কেউ লক্ষ্য করেনি। আরবীটি সেই শুনে চমকে উঠে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘ঠিক, ঠিক কথা বলেছে ও! জ্যান্ত মূর্তি খুঁতো হওয়াও ভালো— মরা মূর্তি? দুয়ো দুয়ো! কথা দিয়ে নয়, ছুরি বিঁধিয়ে এইসব উদ্ধত শিল্পীদের শেষ করে দেওয়া উচিত।’
এই ভয়ঙ্কর কথাতেও কোন বিকার ঘটল না শিল্পীর। বললেন, ‘আমি তবুও বেঁচে থাকব। আমার ভেনাসকে দু’টুকরো করলে সে পাথরই থাকবে— ঠাণ্ডা, নিষ্পাপ পাথর। আর ঐ মেয়েটিকে তোমার ছুরি দিয়ে দু’ ফালা কর— কী থাকে ওর দেখ।’
আরবী মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হয়।’ তারপর সে মেয়েটির দিকে ফিরে যেন বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘হে বালিকা, আমার আর একটি ভার্যার অতীব প্রয়োজন। তুমি সে আশা পূর্ণ করো।’
‘তা, কটা বৌ আছে তোমার?’ কালো মেয়ে জিজ্ঞাসা করল। আমতা আমতা করে আরবী বলল, ‘এই মানে, একটু হিসেব করে বলতে হবে তো; তবে এটুকু জেনে রেখো, আমি অত্যন্ত দায়িত্বশীল স্বামী। তোমাকে সুখী করতে আমি সদা সচেষ্ট—’
‘আমি তো সুখ চাই না, আমি চাই ঈশ্বর।’
‘সেকী! এখনও তাকে পাওনি?’ —ক্রুশে শুয়েই ধড়ফড় করে উঠল জাদুকর।
‘পাব না আবার! অনেক ঈশ্বর পেয়েছি। যার সঙ্গেই দেখা, সেই বলেছে সে ঈশ্বর। আর শিল্পীর কাছে তো ঘরভর্তি ঈশ্বর। তার সবকটাই আধমরা। তবে মানুষ না পাঁঠা যেটা বাঁশি বাজাচ্ছে, ওটাকে তবু একটু ঈশ্বর ঈশ্বর লাগে। সত্যিকার বলে মনে হয়। আমি তো নিজেই না মেয়ে না একটা রামছাগল। আমিও কি চাই না কোন দেবী বনে যেতে? . . .আচ্ছা, ঈশ্বর মানেই পুংলিঙ্গ কেন?’
শিল্পী: ব্যস্ত হয়ে কাজ থামিয়ে ভেনাসকে দেখিয়ে বললেন, ‘কেন, ইনি তো মহিলা!’
‘তা ওঁর নিচের দিকটা অমন মোটা কাপড়ে ঢাকাঢুকি কেন? এই বাকি অর্ধেক শরীরটুকু নিয়ে ওঁর এত লজ্জা! সাদা মানুষদের ঘরে ঘরে শোভা পান উনি; খুব তো সমাদর শুনি ওঁর। অথচ আমার কাছে ওঁর কানাকড়িও দাম নেই।’
জাদুকর বলল, ‘একটু মানুষ-মানুষ গন্ধ ওঁদের দেহে না থাকলে তোমার সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগটা হবে কী করে বলো তো?’
‘মানুষ নয়, মানুষী বলুন!’ —কালো মেয়েটির দাবি।
‘মেয়ে: ঈশ্বর মানেই মহান।’ এই শুনে আরবী ভক্তটি প্রায় কেঁদে ফেলল— ‘হে আল্লা, এইসব কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়েছেলের হাত থেকে আমায় রক্ষা করো! এই মেয়েছেলেরা তোমার এত অপরূপ সৃষ্টি, অথচ কী ঝঞ্ঝাটটাই না বাধাতে পারে এরা! যা খুশি তাই করে।’ তারপর কালো মেয়েকে বলল, ‘শোনো মেয়ে, মহান আল্লার করুণার কথা তো তুমি কানেই তোলো না। কোন ঈশ্বর তোমায় খুশি করবেন?’
‘কোনো ঈশ্বরই খুশি করতে পারেন না কাউকে। অমন ঈশ্বর আবার হয় নাকি?’ শিল্পী বললেন।
কালো মেয়ে: জগতের রহস্য নাকি লুকিয়ে আছে কী সব বর্গমূলোয়। তিনিই নাকি দেবতা। হ্যাঁ গো, সাদা মেমদিদিরা তাই তো বলছিলেন। কী সব সংখ্যাটংখ্যা নাকি বসে আছেন ঈশ্বর হয়ে। তাঁরা বিয়ে করেন না, অথচ গুণ করলেই বেড়ে চলেন। হঠাৎ কেমন যেন মনে হয় তাঁদের শুরুও নেই, শেষও নেই। এক এক কম করে গুণে যাও, তবু শুরুতে কোনদিনই পৌঁছতে পারবে না। আচ্ছা, তিনি কি অনন্ত?
আরবী অনন্তটনন্তর মূল্য কানাকড়িও নেই আমার কাছে। অনন্ত যদি সত্যি হয়ে ধরাই না দিল, তো তাকে নিয়ে আমার দরকারটা কী?
মেয়ে সংখ্যা নিয়ে একটাই সত্যি কথা, তা হল, সে অনন্ত। অন্য সব সত্যিই ভুল সত্যি। আমার তাই মনে হয় সংখ্যাই ঈশ্বর।
শিল্পী: সংখ্যাকে খাওয়াও যায় না, বিয়ে করাও যায় না।
মেয়ে: ঈশ্বর তো খাওয়া আর বিয়ে করার জন্য অন্য জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আমরা আমাদের মধ্যেই তো বিয়ে-থা করতে পারি।
শিল্পী: সংখ্যাকে কি আঁকা যায়? তবে সংখ্যা নিয়ে আমার কী হবে?
আরবী: কেন, আমরা তো সংখ্যা আঁকতে পারি। জানো, সংখ্যার চিহ্ন এঁকে দুনিয়া জয় করতে পারি আমরা। এই দেখ— বলে আরবীটি বসে পড়ে মাটিতে কী সব কাটাকুটি খেলতে লাগল।
কালো মেয়ে: যিনি আমায় দীক্ষা দিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর হচ্ছেন এক যাদু সংখ্যা। তিনি নাকি তিনের মধ্যে এক, একের মধ্যে তিন।
আরবী: হ্যাঁ, সেটা তো সোজা ব্যাপার। শোনো তবে। এই যেমন আমি হচ্ছি ছেলের বাপ, বাপেরও ছেলে বটে। মনুষ্য চরিত্রের নানা রূপ। আল্লাহই একক এবং অদ্বিতীয়। নিজেই নিজের সঙ্গে গুণ করেন, যোগ করেন। পেঁয়াজের খোসা আর কি। ছাড়াতে ছাড়াতে সবই ফক্কা। অসংখ্য তারার সংখ্যাটি তিনিই। বাতাসের ভরের পরিমাপ যদি থাকে তবে তা তিনিই।
শুনে শিল্পী বলে উঠলেন, ‘তুমি দেখছি পুরোদস্তুর কবি!’ আর যায় কোথা, এই শুনে আরবীটি রেগে লাল। কোমর থেকে ছোরাটা বের করে বলল, ‘কী! আমি কবি? অশ্লীল ছড়াকার? এর জবাব দেব আমি রক্তপাতে।’ শিল্পী অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘আরে শোনো শোনো, আমি ঠিক সেভাবে বলিনি। ছড়াকার ভেবে লজ্জা পাচ্ছ? মানুষ মরে হেজে যায়, ছড়া বেঁচে থাকে চিরকাল। তোমার দেখছি কথায় কথায় খুন চড়ে— আরে মানুষ মেরে মড়া বানানো কি সৃষ্টিশীল কাজ? মড়াকে সাজিয়ে রাখা যায় ঘরে? পুঁতে ফেলতে হয়, নইলে পচে বদ গন্ধ ছাড়ে যে।’ আরবীটি এই শুনে শান্ত হয়ে ছোরাটি খাপে পুরে বসে পড়ল পাতকুয়োর পাড়ে। বলল, ‘ঠিক! শয়তানের নোংরা কণ্ঠস্বর আল্লার স্বর্গীয় সুষমায় স্নাত হয়ে ধন্য হয়। বিশ্বাস কর, আমি ধূ ধূ মরুর বুকে উট ছুটিয়ে যেসব গান শোনাতাম, তার জন্যে এক পয়সাও কখনো চাইনি সওয়ারীদের কাছে।’
জাদুকর বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও এসব বিষয়ে সাচ্চা মনিষ্যি। ঈশ্বর আমার পিতা, আমার পরিবার, আমার পরিজন— আমি আর কাউকে মানি না। বাবা মাকেও না।’
আরবী: তবে মন মেজাজ চাঙ্গা রাখতে দু’চারটে বউ-টউ চাই। একটা মাত্র মেয়েমানুষ দিয়ে মেয়ে জাতটার বিচার করা যায় না। প্রথম বউটাকে সত্যিকারের চিনলাম যখন শেষ বিয়েটা করলাম। শেষ ছুঁড়িটা একেবারে পাক্কা শয়তান। তাকে পেয়েই তো বুঝলাম যে প্রথম বউটা ছিল সত্যিকার দেবী।
কালো মেয়ে: আর বউগুলোর কি আরো বিয়ের দরকার নেই তোমাদের মত পুরুষগুলোকে চিনতে?
এই শুনে আরবীটি একমনে আল্লাকে ডাকতে ডাকতে বিড়বিড় করে বলল, ‘এই কালো মেয়েমানুষটার ছোঁয়াটাও কী ভয়ানক!’ তারপর মেয়েটাকে বলল, ‘শোনো, পুরুষের কথার ওপর কথা বলো না। যখন জ্ঞানবিদ্যার কথা হচ্ছে তখন এসব আচরণ কি শোভা পায়? পুরুষ হচ্ছে আল্লার প্রথম সৃষ্টি। মেয়েমানুষ তার পরে।’
কালো মেয়ে মানি, একা পুরুষে সৃষ্টি থাকে অসম্পূর্ণ। ঈশ্বর তাই মহিলা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এক পুরুষের পঞ্চাশটি মেয়েমানুষ দরকার আর পঞ্চাশটি মেয়েমানুষকে খুশি থাকতে হবে একটি পুরুষকে নিয়ে? এ কীরকম বিচার গো?
শুনে আরবীটি কানে আঙুল দিল। বিড়বিড় করতে লাগল, ‘হে আল্লাহ, পরজন্মে যেন আইবুড়ো হয়ে জন্মাই। এই উদ্ধত মেয়েগুলোকে আর তো সহ্য হয় না। . . .শোন তবে, আমি এক বউ চাইলেই তো হল না, অন্য অনেক মেয়েমানুষ যে আমাকে চাইবেই! বিদ্যেধরী কোন মেয়েছেলে নিশ্চয়ই একটা নিরেট গোমুখ্যু ব্যাটাছেলেকে চাইবে না। ভালো বংশধর তৈরি করতে সে আমার কাছেই আসবে, হ্যাঁ, পঞ্চাশ নম্বর বউ হয়েও আসবে।’
কালো মেয়েও ছোড়নেওয়ালী নয়। বলল, সে বিদ্যেধরীটি পঞ্চাশ ব্যাটাছেলে না ঘাঁটলে জানবে কী করে আপনার মূল্য?
‘হা আল্লাহ, এসব কী বিশ্রী কথা শুনতে হচ্ছে! তার চেয়ে তোমার চরণে আশ্রয় দাও।’ ককিয়ে উঠল আরবীটি। তারপর বলল, ‘ওরে নির্বোধ, যে মেয়েছেলের পঞ্চাশটি স্বামী তার সন্তানের পঞ্চাশটি বাপ! হায় হায় হায়! সে সন্তানকে পিতৃহীন বলাই তো ভালো।’
কালো মেয়ে কিছুই বোঝ না দেখছি। সে সন্তানের মা থাকলেই তো হল। তাছাড়া পঞ্চাশটি নয়, ঐ পঞ্চাশের মধ্যে কোন একজনই তার বাপ।
‘তাহলে জেনে রাখ’— আরবীটি চেঁচাল, ‘পৃথিবীতে এমন নির্লজ্জ পাপী মেয়েছেলেও আছে যে অসংখ্য পুরুষকে পটিয়েছে, কিন্তু কোনদিনও মা হতে পারেনি। আর আমি যে মেয়েমানুষকে মনে ধরেছে, বিয়ে করেছি একের পর এক। তারা সবাই মা হয়েছে।’ এই বলে খুব গর্বের সঙ্গে সে জানাল— ‘আমি এই ধরাধামে রেখে যাব অসংখ্য বংশধর।’ বলেই চলল সে— ‘মেয়েদের গর্ভযন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। পুরুষরা বাবা সেদিক দিয়ে বেঁচে গেছে। কী আর করবে বল, মেয়েছেলেদের প্রতি আল্লাহর এই রকমই বিচার। এটাই মেনে নাও, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আল্লাহ এর অন্যথা করেন কী করে?’
কালো মেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘জানি জানি, তোমার আর সাধ্য কী যে সন্তান ধারণ কর। প্রকৃতির নিয়ম মানি। কিন্তু জেনে রাখো, একটি মেয়েমানুষের অনেক পুরুষ থাকতেই পারে, আর প্রতি পুরুষের কাছ থেকেই সে সন্তান পেতে পারে।’
‘হে আল্লাহ, মেয়েমানুষেই নাকি শেষ কথা বলে? এই উদ্ধত মেয়েমানুষটিকে দেখে তোমার এই বাণী আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি বাক্যহীন। আমায় ক্ষমা করো।’ এই বলে আরবীটি ঈশ্বরের উদ্দেশে নত হয়ে রইল।
শিল্পী তার কাজ করতে করতে বলল, ‘পঞ্চাশটি মেয়েছেলে যখন একটি পুরুষকে ঘিরে ধরে তাদের শেষ কথা শোনায় তখন হট্টগোলটা কেমন হয় একবার ভাবো!’
আরবী বিড়বিড় করে বলেই চলে, ‘মনে পড়ে যায় সেই নরকের কথা যেখানে এদের মতো পাপীরা পাপ মুক্ত হয়ে পরম করুণাময়ের আশ্রয় লাভ করে ধন্য হয়।’
কালো মেয়েটি চলে যেতে যেতে শুনিয়ে দিয়ে গেল, ‘যে পুরুষ মানুষেরা শুধু মেয়েমানুষের গপ্পো করে, তাদের কাছে ঈশ্বর খুঁজতে চাই না আমি।’ শিল্পীটি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘আর যে মেয়েমানুষেরা পুরুষ নিয়ে গালগপ্পো করে সেখানেও যেন ভিড়ো না!’