শ্যামল-রাণী
মিত্তিরদের মেয়ে সুধা আজ বছর দুই পরে বাপের বাড়ি আসিল। গিয়াছিল যখন—একা আজ পালকি হইতে নামিল, কোলে ননীর পুতুলের মতো একটি শিশু। সাত বছরের ছোট বোন শৈল আহ্লাদের চোটে হাততালি দিয়া উঠিল, “দিদিকে ঠিক ওপর-ঘরের পটের গণেশ- জননীর মতো দেখতে হয় নি মা, যেটা টাঙানো হয়েছে? না গো বউদি?”
সুধা মাকে আর ভাজকে প্রণাম করিয়া হাসিয়া বলিল, “গণেশ জননীর মা তবুও বছরের শেষে একবার করে তাঁর মেয়েকে—”
গলা ভারি হইয়া গেল, চোখ ডবডব করিয়া উঠিল, ঠোটে হাসিটা কিন্তু লাগিয়াই রহিল। বাপের বাড়ি আসার মিশ্র অনুভূতি, এটুকুতেই হাসি ধৌত করিয়া অশ্রু উছলিয়া উঠে।
খোকাকে বুকে লইয়া, চুমা খাইয়া, মা আঁচলে চোখ দুইটা মুছিয়া বলিলেন, ‘মা’র কি অসাধ বাছা! যা সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে দিয়েছি! তারপর ভালো ছিলি সুধা? ওমা, এটা কি চমৎকার হয়েছে গো! ছেলেবেলাতে তুই ঠিক এই রকমটি ছিলি, বেশ মনে আছে কি না!”
মেয়ের আবদারের সঙ্গে নূতন মায়ের গরবের সুর মিশাইয়া সুধা বলিল, “তুমি তো বলবেই। আমি কিন্তু অমন দস্যি ছিলাম না বাপু, কক্ষনোই না। আমায় তো নাজেহাল করে দিয়েছে। সামলানো কি সোজা!”
ভাজ ততক্ষণে খোকাকে লইয়াছে। একটু একান্তে ঠোঁট টিপিয়া বলিল, “একটিতেই?”
ননদ-ভাজের মধ্যে এক ধরনের চোখাচোখি হইয়া গেল।
শৈল খোকার দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল, “দাও আমার কোলে বউদি, আমি তো মাসি হই।”
খোকাকে দিয়া বউদিদি হাসিয়া বলিল, “হ্যাঁ, ক্ষুদে মাসি।”
সুধাও হাসিয়া উঠিল। ছোট ভাইপো মন্তু মা’র পিছনে আঁচল ধরিয়া অপ্রতিভ ভাবে দাঁড়াইয়া ছিল, আর পিসির সহিত পটের গণেশ-জননীর সাদৃশ্য খুঁজিয়া হয়রান হইতেছিল; সুধা তাহাকে কোলে লইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “হ্যাঁ রে খোকা, পিসিকে ভুলে গেলি? দেখছ মা, ছেলের বেইমানি? আর এই পিসি এক দণ্ড না হলে চলত না!”
মন্তু ছুটিয়া পলাইয়া শৈলর কাছে গিয়া দাঁড়াইল এবং যাইতে যাইতে শিশুর দিকে চাহিয়া, নিজের মনোগত সমস্যার একটা মীমাংসা করিয়া লইয়া বলিল, “খোকা ঠিক পটের গণেশের মত মোটা হয়েছে, না মেজপিসি?”
খোকার মাসি চোখ দুইটা কপালে তুলিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, মা’র পানে চাহিয়া ভীত স্বরে বলিয়া উঠিল, “শুনলে মা? খোকা নাকি গণেশের মতো মোটা হয়েছে। এই বেস্পতিবারের বারবেলা ছেলেটাকে খুঁড়লে! ষাট ষাট!”
তাহার রকমখানা দেখিয়া মা, সুধা, বউদিদি তিনজনেই হাসিয়া উঠিল।
সুধা বলিল, “রোববারের সকাল এক্কেবারে বেস্পতিবারের বারবেলা হয়ে গেল! ঠিক সেই রকম গিন্নি আছে শৈলী, না মা? বরং আরও বেড়েছে।”
বউদিদি হাসিয়া বলিল, “তোমার জায়গা দখল করেছে। বাড়িতে একটি থাকা চাই তো, নইলে গরু বেড়াল পায়রা এদের সংসার কে দেখবে বল?”
দুই বৎসর পূর্বে পর্যন্ত সেই ব্যাপারই ছিল। আজ সে কথার উল্লেখে একটু লজ্জা আসিল বটে, কিন্তু সুধা আগ্রহটাও দমন করিতে পারিল না; জিজ্ঞাসা করিল, “পায়রাগুলো বিদেয় করে দিয়েছ নাকি মা? পুসীটার এবারে কটা ছানা হল? আর শ্যামলী? তার বাছুরটা কেমন হল? যাক্, একটা সাধ মিটবে এবার, শ্যামলীর দুধ খেয়ে যাব। ভাবতেও কি রকম হয়, না মা? এই সেদিনকার শ্যামলী, এতটুকু বাছুর, বাড়ি এল—সিঁদুর হলুদ দিয়ে গোয়ালে তোলা হল, আর আজ তার নিজেরই বাছুর!”
বউদিদি যেন ওত পাতিয়া ননদের কথাগুলি শুনিতেছিল। এই পর্যন্ত আসিলে একটু অর্থপূর্ণ হাস্যের সহিত সংক্ষেপে বলিল, “ওই রকমই হয়!’
বাড়িতে আসিয়া পড়িয়াছে। প্রবেশ করিতে করিতে সুধা আবদারে নালিশের সুরে বলিল, “দেখচ মা বউদিকে?”
অল্পক্ষণ পরেই শ্বশুরবাড়ির বউ-মানুষের ভাব আর মাতৃত্বের গাম্ভীর্য যাহা একটু লাগিয়া ছিল, সুধার দেহ-মন হইতে একেবারে অপসৃত হইয়া গেল। জামা-কাপড় ছাড়া, বাক্সপত্তর গোছানো সব ভুলিয়া সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া পুসীটাকে প্রথমে তল্লাশ করিয়া বাহির করিল; এক আঁজলা চাল উঠানের মাঝখানে ছড়াইয়া দিতেই পায়রাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে নামিয়া বক্বকম আওয়াজ করিয়া ভোজের মধ্যে সংস্কৃত-উদগারী পণ্ডিতের মতো এক মহাসমারোহ লাগাইয়া দিল। সুধা তাহাদের সামনে রকে পা ছড়াইয়া বসিয়া পুসীকে কোলে. চাপড়াইতে চাপড়াইতে সুর করিয়া ছড়া কাটিতেছিল—”
“সারা ভারত বাড়ি বাড়ি ষষ্ঠী ঠাকুর বয়ে
একেবারেই হল পুসীর সাতটি ছেলেমেয়ে;
বর দাঁড়াল শাপে গিয়ে, অন্ন দেওয়া ভার—”
এমন সময় বোনপোকে পাড়ায় টহল দেওয়াইয়া শৈল আসিয়া উপস্থিত হইল, পিছনে পিছনে দুইটি বিড়ালছানা। সুধার কাছে পরিচয় করাইয়া দিল, “পুসীর ছানা; একটি শেয়ালের পেটে গেছে, তবুও কি একবার ঘুরে দেখে! মুখে আগুন মায়ের, ওকে আর আদর করো না, দুচক্ষের বিষ। মা-ষষ্ঠী কি দেখে যে ওকে দেন অতগুলো করে! হ্যাঁ দিদি, এই ছেলে হল তোমার দুষ্টু?”
খোকার মাথাটা নিজের কাঁধে চাপিয়া চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলিল, “এমন ঠাণ্ডা ছেলে এ তল্লাটে দেখাক দিকিন কেউ! বাছা আমার ‘মাসি’ বলতে অজ্ঞান।”
মা, বউদিদি সুধা তিনজনেই আবার হাসিয়া উঠিল! সুধা বলিল, “আচ্ছা মা, পাঁচ মাসের একটা শিশু, সে ওকে কখন ‘মাসি’ বললে বল দিকিন? আবার বলতে অজ্ঞান হয়ে গেল!”
মা বলিলেন, “মাসি হয়ে ও-ই জ্ঞানরহিত হয়েছে, কি যে করবে, কি যে বলবে—”
শৈল তাহার মাসিত্ব লইয়া এমন ব্যাখ্যানায় অপ্রস্তুত হইয়া খোকাকে রকে বসাইয়া দুড়দুড় করিয়া পলাইতেছিল। দুয়ারের নিকট হইতে হঠাৎ ছুটিয়া আসিয়া সন্ত্রস্তভাবে বলিল, “ও দিদি, শিগগির পুসীকে নামিয়ে খোকাকে নিয়ে ভব্যিসাব্যি হয়ে বস। তোমার সই, সই- মা, ও-পাড়ার সতীপিসি—একপাল সব দেখতে আসছে তোমায়। দাও নামিয়ে, দিলে?”
সুধা ধীরে-সুস্থে বাটি হইতে একমুঠা চাল উঠানে পায়রার ঝাঁকের উপর ছড়াইয়া দিয়া বলিল, “বয়ে গেছে আমার; শ্বশুরবাড়ির কনে-বউ নাকি?”
.
গাড়িতে সমস্ত রাত্রি জাগার জের; বিকাল হইয়া গেলেও সুধা অঘোরে নিদ্রা দিতেছিল। শৈল হন্তদন্ত হইয়া আসিয়া তাহাকে ঠেলিয়া উঠাইল, “ও দিদি, শ্যামলী ফিরে এসেছে তার বাছুর দেখতে। কি চমৎকার যে হয়েছে, এ তল্লাটে অমন বাছুর কেউ যদি—”
মা ধমক দিয়া উঠিলেন, “না, এ তল্লাটে যা কিছু এক তোদেরই আছে। দেখ দিকিন, সমস্ত রাত ঘুমোয়নি মেয়েটা, মিছিমিছি ডেকে তুললে!”
শৈলর মনে দিদির আর খোকার আসার সঙ্গে সঙ্গে কোথা হইতে একটা তোড় নামিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেটা যেন নিজের বেগেই সব জায়গায় ধাক্কা খাইয়া মরিতেছে। উৎসাহের মুখে মা’র নিকট ধমক খাইয়া বেচারী সঙ্কুচিত হইয়া পড়িয়াছিল, দিদির কথায় আবার সামলাইয়া উঠিল। উঠিতে উঠিতে সুধা হাসিয়া বলিল, “ভাগ্যিস শৈলী তুললে মা! স্বপ্ন দেখছিলাম, খোকাকে না দেখে শ্বশুরের যেন ভীমরতি দাঁড়িয়ে গেছে। এসে বলছেন— এক বছর হয়ে গেল বউমাকে পাঠিয়েছি; কতদিন আর রাখা চলে?—যাবেনই নিয়ে, তোমরা হাতে ধরে কাকুতি-মিনতি করে বলছ—এই মোটে আজ সকালে এসেছে বেইমশাই—। কে শোনে? সেজেগুজে কাঁদতে কাঁদতে বেরুচ্ছি, এমন সময় শৈলী—”
শৈলী চোখ দুইটা বড় বড় করিয়া একেবারে তগত হইয়া শুনিতেছিল; উল্লাসে হাততালি দিয়া নাচিয়া উঠিল—”দেখ, কেমন আমি দিদিকে বাঁচিয়েছি; যদি না—”
তাহার পর সবার হাসিতে নিজের ভুলটা বুঝিতে পারিয়া, একেবারে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া দিদির কোলে মিশিয়া গেল!
সুধা বলিল, “ওঠ, দেখিগে চল।”
নামিতেই খোকা জাগিয়া উঠিল। “দেখেছ?” ওর টনক নড়ে, “কোথাও যদি এক পা যাবার যো আছে!”—বলিতে বলিতে খোকাকে তুলিয়া লইল, ভাজের দিকে চাহিয়া বলিল, “বউদি, তুমিও এস ভাই।”
“হাতের পাটটা সেরে আসছি, তুমি এগোও”—বলিয়া সে পাশের ঘরে চলিয়া গেল।
শ্যামলী গোয়ালঘরে তৃপ্তির গাঢ় নিশ্বাসের সঙ্গে জাবনা খাইতেছিল, আর মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া সামনের খোলা জায়গায় চঞ্চল উৎক্ষিপ্যমান বৎসটির পানে চাহিয়া এক-একটি হ্রস্ব অথচ গভীর আওয়াজ করিয়া নিজের বাৎসল্যস্নেহ প্রকাশ করিতেছিল। সুধা সামনে আসিয়া বলিল, “কই লা শ্যামলী, চিনতে পারিস? ওমা, কত বড়টা হয়ে গেছে গরুটা!
শ্যামলী নাদা হইতে ঘাড়টা বাহির করিয়া জাবনা চিবাইতে চিবাইতে প্রশ্নকর্ত্রীর পানে একটু চাহিল, তারপর হঠাৎ মুখ নাড়া বন্ধ করিয়া দুই পা আগাইয়া আসিয়া সুধার ডান হাতটা সুদীর্ঘ টানের সঙ্গে চাটিতে আরম্ভ করিয়া দিল। বুকের নিকট হইতে একটা অব্যক্ত ভরাট আওয়াজ বাহির হইয়া আসিতে লাগিল, এবং প্রবল নিশ্বাসে মুখের উপরের জাবনার কুটাকাটিগুলা সুধার শাড়ির উপর উড়িয়া সাঁটিয়া যাইতে লাগিল।
খানিকক্ষণ জিবের আঁচড় সহ্য করিয়া সুধা সুড়সুড়িতে ঘাড়টা কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “ওরে থাম, বাছুর চেটে তোর যা জিব হয়েছে, আমার এক পর্দা চামড়া উঠে গেল! দেখ কাণ্ড, আবার খোকাকে চাটতে যায়!”
হাসিয়া দুই পা পিছাইয়া গেল। শ্যামলী ব্যগ্রভাবে একবার দড়িতে টান দিয়া ঘাড়টা নাড়িয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বাছুরটার উপর নজর পড়ায় ‘ম্ভা’ করিয়া ডাক দিয়া উঠিল এবং বাছুরটা ছুটিয়া আসিলে কিছুক্ষণ আগন্তুকদের ভুলিয়া সপ্রেমে তাহার গা-টা ঘন ঘন একচোট চাটিয়া দিয়া আবার সুস্থির হইয়া দাঁড়াইল।
শৈল চোখমুখ কৌতুকে বোঝাই করিয়া বাছুরের সৌন্দর্য ব্যাখ্যান করিতে যাইতেছিল, দুই-একটা কথা বলিয়া দিদির দিকে চাহিতেই চমকিয়া গেল। দিদি ডান হাতের তর্জনীটা গালে চাপিয়া নিতান্ত বিস্ময়ে ঘাড় কাত করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল; বলিল, “দেখলি শৈলী, কাণ্ডটা?”
শৈলী এমন কিছু কাণ্ড দেখিতে পায় নাই, যাহাতে দিদির এতটা ভাবান্তর হইতে পারে। প্রশ্ন করিতে যাইতেছিল, তাহার পূর্বেই সুধা শুরু করিয়া দিল, “দেখলি না ঠেকারটা? খোকাকে চাটতে দিলাম না, তাই স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলে—তোমার খোকা আছে, আমার নেই?—এই দেখ। কেমন ডাকলে, কেমন কোলে টেনে নিয়ে চাটতে লাগল!— হাঁ লা শ্যামলী, গেরস্তকে এতদিনেও একটা নইবাছুর দেওয়ার মুরোদ হল না, উল্টে আমার সঙ্গে টেক্কা দিতে এলি! মুয়ে আগুন, ব্যাটা-বাছুরের আবার গুমোর কি লা? কি কাজে লাগবে? কদ্দিনই বা কাছে ধরে রাখতে পারবি? আমার এই সোনার চাঁদের সঙ্গে তুলনা হল কিনা—”
বউদিদি আর মা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বউদিদি হাসিয়া বলিল—”কি কথা হচ্ছে গো পুরনো সইয়ের সঙ্গে?”
দিদির কথাবার্তা শুনিবার পর শৈলী শ্যামলীর ব্যবহারে দিদির চেয়েও ক্ষুব্ধ ও বিস্ময়ান্বিত হইয়া গিয়াছিল, বড় বড় চোখ করিয়া আরম্ভ করিল, “বললে পেত্যয় যাবে না মা, দিদির কোলে খোকাকে দেখে শ্যামলী ঠেকার করে—”
কোন ফাঁকতালে হঠাৎ ছেলেবেলায় সুধা আসিয়া তাহার মূক সখীর সঙ্গে মুখের আলাপ জমাইয়া তুলিয়াছিল, শরমের স্পর্শে আবার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হইয়া গেল। নদীর মধ্যে হঠাৎ যেন ঝরনার উচ্ছলতা আসিয়া পড়িয়াছিল। শৈলকে ধমক দিয়া সুধা বলিল, হ্যাঁঃ, গরুর নাকি আবার ঠেকার হয়? পাগলের মতো যা-তা বকিস নি শৈলী!”
শ্যামলীর কাণ্ডের চেয়ে দিদির কাণ্ড আরও দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইল; শৈল অপ্ৰতিভ হইয়া হাঁ করিয়া দিদির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
সুধা মাকে কহিল, “বলছিলাম মা, শ্যামলীর শেষে ব্যাটা-বাছুর হল? নই হলে নিয়ে যেতাম আমি। শ্বশুর কি একটা নাকি ভালো ওষুধ জানেন, খাওয়ালে নাকি নই-বাছুর হতেই হবে। হাসছ বউদি, কিন্তু একেবারে নাকি পরীক্ষিত, নড়চড় হবার জো নেই।”
মাও না হাসিয়া পারিলেন না, বলিলেন, “তিনবার তো ‘নাকি’ বললি, অথচ নড়চড়ও হবার জো নেই, শ্বশুর তোর ভারি গুণী তো!”
সুধা লজ্জায় “যাও” বলিয়া মুখ ফিরাইল।
ভাজ বলিল, “তার চেয়ে তুমি শ্যামলীকে নিয়ে যাও না ঠাকুরঝি, ঠাকুর-জামাইয়েরও পণরক্ষা হয়।”
সুধা ঘাড় নীচু করিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়াইয়া বলিল, “না বাপু, আমি চললাম, শাশুড়ি-বউয়ে একজোট হয়ে আমার পেছনে লাগলেন সব!”
.
সে একটা আলাদা কাহিনী, বিবাহের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়ানো। যতই বড় হইতেছে, তাহার লজ্জাটা সুধাকে ততই অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে।
হরবিলাস শর্দার বিবাহ-সংক্রান্ত বিল লইয়া সারা দেশটায় সামাল সামাল রব পড়িয়া গেল; লোকে বলিল, “কালাপাহাড় এবার কলম হাতে করিয়া আবির্ভূত হইয়াছে।” সে আজ প্রায় চার-পাঁচ বৎসরের কথা; সুধা আট পারাইয়া নয়ে পড়িবে। দুপুরে সরকারদের চণ্ডীমণ্ডপে যখন গ্রামের মাতব্বরদের মধ্যে আসন্ন ধর্মবিপ্লব লইয়া সূচ্যগ্র আলোচনা চলিতে থাকে, সে তখন তাহাদের নূতন গোয়াল ঘরের পিছনে লিচুগাছের ছায়ায় খেলাঘর পাতিয়া জীবনের মাঝখানে বিচরণ করিতে থাকে। হালদারদের নিমাই হয় কর্তা, সে হয় গিন্নি। দুই বছরের শিশু শৈল হয় মেয়ে। পুসী বেড়ালটা তখন বাচ্চা, চারখানা ইটের একটা ছোট্ট ঘরে কাপড়ের পাড়ে বাঁধা থাকিয়া অসহায়ভাবে বসিয়া থাকে, মিউ মিউ করিয়া শব্দ করিলে সুধা বিব্রত হইয়া বলে, “ওদিকে গরুটা ডেকে ডেকে সারা হয়ে গেল, কোনদিকটা যে সামলাই!” সই বউমা হয়। নিমাইয়ের ভাই ননী প্রায়ই অসুখে ভোগে, যেদিন আসিতে পারিল, সেদিন হয় সে বাড়ির ছেলে—সই-বউমার বর, সে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকিলে সইকে নূতনত্বের খাতিরে বিধবা বলিয়া ধরিয়া লওয়া হয়।
আসল সংসারে যে সব কথা হয়, নকলে তাহার প্রতিধ্বনি উঠে। সুধা রান্না করিতে করিতে কড়ায় খুন্তির দুই-তিনটা ঘা দেয়, উনানের মধ্যে কাঠটা একটু ঠেলিয়া ঘুরিয়া বসে এবং হাঁটু দুইটা মুড়িয়া ডাকে, “বলি হ্যাঁগা, শুনছ?”
নিমাই আসিয়া উপস্থিত হয়, জিজ্ঞাসা করে, “কথাটা কি?”
সুধা তাহার গাফিলতিতে তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া যায়; নিজের গৃহিণীত্ব ভুলিয়া বলিয়া উঠে, “নাঃ, তোমায় শিখিয়ে শিখিয়ে পেরে উঠলাম না নিমুদা; বাবার মতো হাতে হুঁকো কই?”
ছেলেটা বড় ভুলো মন, খুঁজিয়া পাতিয়া হুঁকাটা লইয়া আসে। একটা পেঁপের ডাঁটার নীচের দিকটা একটু ছেঁদা করা, মাথায় একটা কলকে-ফুল বসানো। একখানা ইট পাতিয়া তাহার উপর বসিয়া প্রশ্ন করে, “কি বলছিলে?”
“বলছিলাম আমার মাথা আর মুণ্ডু; নাকে তেল দিয়ে সব ঘুমুচ্ছ, সরকার বাহাদুর যে এদিকে জাত-কুল নিয়ে টানাটানি লাগিয়েছে—হিদুয়ানি যে যেতে বসল। শুনছি নাকি মেয়েদের আর বাইশ বছরের কমে বিয়ে দিতে দেবে না!”
কর্তা নিমু বলে, “বাইশ, না আঠারো?”
“বড় তফাৎ! আজ আঠারো, কাল পালটে বাইশ করে দেবে। বলি, সুধীটার কথা ভাবছ?”
“আট বছরের শিশু, ওর কথাটা আর কি ভাবব? শুনছি, জেলায় এই নিয়ে একটা মিটিং হবে; গ্রাম থেকে ডালঘেঁটে পাঠাবার জন্যে তারণ খুড়োর কাছে লোক এসেছিল।” সুধা আরও গম্ভীর হইয়া বাধা দিয়া বলে, “বাইরের লোক তোমার জাত বাঁচাবে, সেই ভরসায় আছ? তোমাদের ঘটে কি একটুও বুদ্ধি—”
তাহার কড়া চোখ দেখিয়া নিমাই একটু থতমত খাইয়া যায়; তাহা ছাড়া নিজে একটু হাঁদা বলিয়া কথাটা সাক্ষাৎভাবে আঘাতও করে। আমতা আমতা করিয়া একটু নীচু হইয়া বলে, “হ্যাঁ বুদ্ধি নেই কে বললে? খালি ওই কথা!”
রাগের চোটে সুধা পিঁড়া ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলে, “তোমার দ্বারা হবে না নিমুদা, তুমি বাড়ি যাও। ‘যে মেয়েমানুষের দশ-হাত কাপড়েও কাছা জোটে না, সে আবার বুদ্ধির খোঁটা দেয়’—রেগে এইখানে এই কথাটা বলতে হবে না? শুনলে না, সেদিন বাবা মাকে বললেন?”
সুধার মূর্তি দেখিয়া নিমাইয়ের নিজেরই কাছাকোঁচায় ঠিক থাকে না। কোনোরকমে কাপড়টা সামলাইয়া লইয়া বলে, “আচ্ছা, বলছি, বস; তোর মা কিন্তু ওরকম রেগে কাঁই হয়ে ওঠে না সুধী, তা বলে দিচ্ছি; তোকে নিয়ে ঘর করা বড় শক্ত।”
এই সময় একদিন সুধার বাপ রামরতন বাঘমারীর হাট হইতে শ্যামলীকে কিনিয়া আনিলেন। ইহাতে যে শুধু পুসী বেড়ালটা গাভীত্ব হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল তাহাই নয়, খেলাঘরের ঘরকন্নার পদ্ধতিতেও অনেক পরিবর্তন ঘটিল।
রান্নাবান্না, ঘর ঝাঁট দেওয়া, জল তোলা—এসবের পাট উঠিয়া গিয়াছে; এখন কর্তা গিন্নি, ছেলে বুড়ো সকলে শ্যামলীর পিছনে হয়রান; কোথায় নধর ঘাস জন্মাইয়াছে, কোঁচড় ভরিয়া তুলিয়া আনা; কে কোথায় গাছ কি ডাল কাটিতেছে, পাতা সংগ্রহ করা; ওদিকে গ্রামে সবার বাগানে যে কি হইয়াছে নেউল-তাড়ানো চুন-গাদা হাঁড়িতে আর কাজ হয় না। নিমাই তো সুধাকে তুষ্ট করিবার এখন সুবর্ণ-সুযোগ পাইয়া একেবারে মাতিয়া উঠিয়াছে; এতদিন স্কুলে যে সময়টা নষ্ট হইত, তাহারও বহুলাংশ এখন শ্যামলী পরিচর্যায় সার্থক হইয়া উঠিতেছে! এই সব করিয়া যে সময়টুকু উদ্বৃত্ত হয়, তাহাতে সুধা সকলকে গো-তত্ত্ব শিক্ষা দেয়।
বলে, “তোমরা যে মনে কর মশাই, ওরা আসলে গরু, বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, তা নয়। সব বোঝে, দেখছ না, কি রকম করে আমাদের কথা শুনছে? সত্যযুগে ওরা কথাও কইত।”
ননী বলে, “ওরা তো ভগবতী।”
বাৎসল্যের মৃদু হাস্যের সহিত সুধা বলে, “হ্যাঁ, ভগবতী, তা বলে কি লক্ষ্মী-সরস্বতীর মা ভগবতী? তা নয়; ও অন্য রকম ভগবতী। হ্যাঁ, কি যে বলছিলাম—সত্যযুগে ওরা কথাও বলত, তারপর কোন মুনির শাপে বোবা হয়ে যায়। অনেক কান্নাকাটির পর মুনি বলেন, ‘আচ্ছা, যা, তোদের কোনো কষ্ট হবে না, তোদের বুদ্ধি একটু মানুষের মাথায় সাঁদ করে দিচ্ছি, তোদের নিজের জাত যেমন তোদের ইশারা বুঝবে, মানুষেও সেই রকম বুঝতে পারবে।’ কাছে গেলে শ্যামলী যখন তোমার হাত চাটে, তখন তোমার তো বুঝতে বাকি থাকে না যে, ঘাস পাতা তুলে আনতে বলছে—সে কেমন করে বোঝ মশাই? যখন—”
ভক্তিমান ননী বলে, “আর গরু তো স্বর্গ, ওদের গায়ে তেত্রিশ কোটি দেবতা থাকেন।”
সুধা বলে, “থাকেনই তো, মুখে বেহ্মা থাকেন, মাথায় জগন্নাথ থাকেন, ন্যাজে কার্তিক থাকে—”
সই দয়াপরবশ হইয়া বলে, “আহা কার্তিক ঠাকুরের বড় কষ্ট ভাই; সব্বদা ন্যাজ ধরে ঝুলতে হয়!”
সুধা বলে, “চুপ, বলতে নেই।” তাহার পর নিমাইয়ের পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি হানিয়া বলে, “আর অত দেবতা থাকেন বলেই তো গরুর জন্যে চুরিটুরি করলে কোনো দোষ হয় না, বরং পুণ্যিই হয়। এই দেখ না, একটা পিঁপড়ে মারলেও কত পাপ হয় তো। কিন্তু মা- কালীর সামনে পাঁঠা বলি দিলে কোনো দোষ হয় কি?”
যুক্তিটা অকাট্য; ইঙ্গিতটাও অস্পষ্ট নয়, ফলে নিমাইয়ের গোয়াল হইতে কোঁচড়-ভরা খোল, কুঁড়ো, কলাই হাজির হইয়া শ্যামলীর উদরে প্রবেশ করে। সইও সাধ্যমতো পুণ্য- সঞ্চয়ে মনোযাগী হইয়া উঠে।
.
এদিককার খবর সংক্ষেপত এই—
জেলার মিটিং হইয়াছিল; হরবিলাস শর্দাকে যথাযোগ্য গালাগালির পর ছেলেদের বিবাহযোগ্য বয়স ষোল এবং মেয়েদের বারো ধার্য করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। সরকারদের চণ্ডীমণ্ডপে এর তুমুল আলোচনা হইয়াছিল, তাহাতে হরবিলাস শর্দা এবং জেলার উকিল ও অন্যান্য উদ্যোক্তাদের যথাযোগ্য গালাগালির পর ছেলেদের ন্যূনতম বয়স চৌদ্দ এবং মেয়েদের দশ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে। ও-পাড়ার তিনকড়ি খুড়ীর বাড়িতে উৎকট রকমের এক মেয়ে-মিটিং বসিয়াছিল, তাহাতে হরবিলাস শর্দা, গবর্মেন্ট বাহাদুর, জেলার উকিল এবং সরকারদের চণ্ডীমণ্ডপে যাহারা তামাক পোড়ায়, সকলকেই একসাথে ভাগাড়ে দেওয়া হইয়াছে। গ্রামের নানারূপ কেচ্ছা-কাহিনী আলোচনার পর সকলের মনের বোঝা হালকা হইলে ধার্য হইয়াছে যে, ইহাদের পুরাপুরি মতিচ্ছন্ন হইবার পূর্বেই বয়স-নির্বিশেষে গ্রামের সমস্ত অনূঢ়া কন্যাকে পাত্রস্থা করিয়া জাতি কুল বাঁচাইতে হইবে;—তা বর কানা হউক, খোঁড়া হউক, নুলা হউক, কুঁজা হউক,—মন্ত্রটা কোনো রকমে আওড়াইয়া দিতে পারিলেই হইল।
বিধি-ব্যবস্থার যথেষ্ট অভাব থাকিলেও দুপুরের এই মহিলা মজলিসই সাধারণত জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করে; বিশেষ করিয়া মজলিসের কর্ণধার যদি তিনকড়ি খুড়ির মতো কেহ থাকেন।
পাড়ায় পাড়ায় কন্যা-মহামারী পড়িয়া গেল।
কয়েকদিন পরের কথা। বিকালে সুধা বাগানের এক কোণে শ্যামলীর গলা জড়াইয়া আদর করিতেছিল, “শ্যামলী, শুমলী, শ্যামল-রাণী, তুমি আর কারুর নয় সোনামণি—”
শ্যামলী তাহার সমস্ত পিঠখানি চাটি। চাটিয়া বোধ হয় জানাইতেছিল, না, আমি আর কাহারও নয়, একান্ত তোমারই।
এমন সময় মা আসিয়া বলিয়া উঠিলেন, “দেখ কাণ্ডখানা! সমস্ত পাড়া তোলপাড় করে মরছি, আর মেয়ে কিনা পাঁদাড়ের মধ্যে গরুর সঙ্গে সোহাগে ব্যস্ত। তোকে না আজ দেখতে আসবে সুধী? গা মাজতে হবে না? চুল বাঁধতে হবে না? চলে আয় শিগগির।”
দেখিতে আসিলেন পণ্ডিতপাড়ার সাব-রেজিষ্ট্রারবাবু, নাম জগবন্ধু রায়। বিদেশী লোক, মেদিনীপুরে বাড়ি, কার্যোপলক্ষে বদ ল হইয়া এখানে বছর দুই-তিন আছেন। ছেলেটি এখানে থার্ড ক্লাসে পড়ে; বছর তেরো বয়’। হইবে। জগবন্ধুবাবু একটু বাহিরের খবরাখবর রাখেন এবং প্রত্যেক বিষয়ই যুক্তিতর্কের শেষ সীমানা পর্যন্ত ঠেলিয়া তুলিয়া অনুধাবন করেন। ছেলে তাঁহার একটু ছেলেমানুষ কিন্তু এর পরেই তো সেই আঠারো। অনেক জায়গায় আবার মিটিং করিয়া হাঁকাহাঁকি করিতেছে—”ছেলেদের বয়স করা হউক বাইশ- চব্বিশ।” এক মিস মেয়ো আসিয়াই এই ব্যাপার! ইতিমধ্যে যদি আর একটি আসিয়া পড়ে তো চক্ষুস্থির! ছেলেদের বয়স যে কোথায় গিয়া ঠেকিবে, কে জানে? বিবাহ জিনিসটাই থাকিলে হয়! বোধ হয় বৈদিক বিবাহপদ্ধতি উঠিয়া গিয়া সিভিল ম্যারেজের ধুম পড়িয়া যাইবে। শেষকালে চল্লিশ বছরের বুড়ো ছেলে লাভ করিয়া কোর্টে বিবাহ রেজেস্ট্রি করিয়া কাহাকে ঘরে তুলিবে কে বলিতে পারে? এখন একটু ভুলের জন্য শেষকালে জাত কুল সব যাক আর কি!
মেয়ে খুব পছন্দ। আশীর্বাদও হইয়া গেল, এবং খুব কাছাকাছি একটা দিন স্থির করিয়া যোগাড়যন্ত্র আরম্ভ হইয়া গেল।
সুধার মনটা ভালো নাই। যতদূর জানা আছে, বিবাহ জিনিসটা মন্দ নয়; কিন্তু ভাবনার কথা এই যে, শ্যামলীকে ছাড়িয়া যাইতেই হইবে। আশীর্বাদের পরদিন সকালবেলা সই আসিয়াছিল, সুধার মেজাজের জন্য খেলা জমে নাই। যাওয়ার সময় মুখ ভার করিয়া বলিয়া গিয়াছে, “আচ্ছা লো, আমার একদিন বিয়ে হবে, তখন দেখে নোব।”
সুধা শ্যামলীর জন্য মনমরা হইয়া ঘা। ছিঁড়িতেছিল, নিমাই আসিয়া বলিল, “ওগো শুনছ?”
ঘাড় বাঁকাইয়া শাসনের ভঙ্গীতে সুধা বলিল, “তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি কবে হবে নিমুদা?”
নিমাই ভড়কাইয়া গিয়া প্রশ্ন করিল, “কেন র্যা?”
কেন র্যা! আমায় আর ও-রকম করে ডাকা চলে তোমার?”
নিমাই সব কথা শুনিল; শেষের দিকে পাত্রের পরিচয় পাইয়া উৎফুল্ল হইয়া বলিয়া উঠিল, “চমৎকার হবে। সে তো হরিহর, আাদের স্কুলে থার্ড ক্লাসে পড়ে, খুব জানি তাকে মাইরি বলছি, বেশ হবে ভাই।”
সুধা মুখ গম্ভীর করিয়া বলিল, “তোমাদের তো খুব ফূর্তি; আমার মনে যে কি হচ্ছে—”
নিমাই কোনো রোমান্সের গন্ধ পাই। কিনা সে-ই জানে, মাঝখানেই ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন র্যা সুধী?”
“বাছুরটার কথা ভাবছ? আমি শ্যামলীকে ছেড়ে থাকতে পারব? আর আমায় ছেড়ে শ্যামলীই কি বাঁচবে?” কথাটা বলিয়া নিমাইয়ের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাহিতেই ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল, চক্ষুর কূল ছাপাইয়া দুই ফোঁটা জল জমিয়া উঠিল। নিমাই হাত দিয়া মুছাইয়া দিয়া বলিল, “কাঁদিস নি সুধী, খুড়িমাকে বলব আমি।”
ইহার পর শান্তভাবে চিন্তা করিয়া দেখা গেল, খুড়িমাকে বলাও চলে না, আর ওসব উপায়ে কাজও হইবে না। ক্রমাগতই দুইজনে পরামর্শ হইতে লাগিল—বাগানের ঝোপঝাড়ের মধ্যে বসিয়া, গোয়াল ঘরের কোণে, সন্ধ্যার সময় পুকুর ঘাটের ভাঙা রানার নীচে। খেলা হয় না; ননী, সই আমল পায় না; সই যাইবার সময় নাক কুঁচকাইয়া বলে, “বিয়ের কনের অত বেটাছেলে ঘেঁষা হওয়া ভালো নয় লো, এই শাস্ত্রবাক্য বলে দিলাম।”
বিয়ের রাত। পাশাপাশি দুই গ্রামের বর-কনে; বরপক্ষ কনাপক্ষের লোকজনে বাড়িটা গমগম করিতেছে। উঠানে বিবাহের সরঞ্জাম, চারিদিকে গোল করিয়া বিবাহ-সভা রচনা করা হইয়াছে, ছেলে বুড়া ঠাসাঠাসি হইয়া বিবাহ দেখিতেছে।
অনুষ্ঠানের মধ্যে পুরোহিত সুধার বাপকে বলিলেন, “এইবার তুমি মেয়ের ডান হাতটি তুলে ধর, সম্প্রদান করতে হবে। তুমি হাত পাত তো বাবা শ্বশুরের দান নেবে। কই গো, হাতে জড়াবার মালাগাছটা?”
সুধার বাপ সুধার হাতটা একটু তুলিয়া বাড়াইয়া ধরিলেন।
বর কিন্তু একটা কাণ্ড করিয়া বসিল। তাহার হাতটা এতক্ষণ বাহিরেই ছিল, হঠাৎ কাপড়ের মধ্যে টানিয়া লইয়া গোঁজ হইয়া বসিল। সকলে যেন স্তম্ভিত হইয়া গেল। পুরোহিত পাকা লোক, হাসিয়া বলিলেন, “হাত বের কর বাবা, লজ্জা কি? বড্ড ছেলেমানুষ কিনা!”
সভার মধ্য হইতেও অনুরোধ, উপরোধ, হুকুম, ধমক কিছুই বাকি রইল না। বর কিন্তু ক্রমাগতই হাত শক্ত করিয়া নিজের কোলের মধ্যে চাপিয়া ধরিতে লাগিল। মুখটা রাঙা হইয়া গিয়াছে, ঘাড়টা গুঁজড়াইয়া বুকের উপর আসিয়া পড়িয়াছে।
“বর বেঁকে বসেছে, বর বেঁকে বসেছে!”—বলিয়া একটা রব চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বাড়ির ভিড় চাপ বাঁধিয়া উঠিল। জগবন্ধু আগন্তুকদের দেখাশুনায় বাহিরে ব্যস্ত ছিলেন। ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া হাজির হইলেন। কড়া গলায় বলিলেন, “ব্যাপার কি রে হরে? হাত বের কর! থার্ড ক্লাসে পড়ে স্বাধীনচেতা তরুণ হয়েছ বটে?”
পুরোহিত উঠিয়া তাঁহার পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিয়া বলিলেন, “আপনি একটু ঠাণ্ডা হোন, রাগবার সময় নয়। ব্যাপার আমি বুঝেছি, সব ঠিক করে দিচ্ছি।”
বরের নিকট আসিয়া কানের কাছে মুখ আনিয়া প্রশ্ন করিলেন, “কি চাই তোমার বাবা, বল দিকিন আমায়?”
কোন উত্তর হইল না। আরও একটু অপেক্ষা করিয়া বলিলেন, “বল, শ্বশুরের কাছে তো চাইবেই। আমরাও এই রকম পণ করে বসেছিলাম, এতে লজ্জা কি? সাইকেল চাই? নগদ টাকা? হারমোনিয়াম?”
বর জড়িত কণ্ঠে কি একটা বলিল। বেশ ভালো রকম বুঝিতে না পারিয়া বিস্মিতভাবে পুরোহিত বলিলেন, “স্পষ্ট করে বল, কিচ্ছু লজ্জা নেই।”
বাড়ির মধ্যে একটা খড়কে পড়িলে আওয়াজটা শুনা যায়। এ নিস্তব্ধতার মধ্যে পুরোহিত ঠাকুর এক রকম চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “অ্যাঁ! কি বললে? শ্যামলী- বাছুর!”
নিস্তব্ধতা সেই রকমই রহিল; কেহ যেন কথাটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই। একটা মুহূর্ত, তাহার পর জগবন্ধু অগ্রসর হইয়া নাক মুখ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “হারামজাদা! মানুষের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দোব বলে নিয়ে এলাম, আর ভদ্দরলোক তোকে এখন নই- বাছুর সম্প্রদান করবেন? বের কর হাত, নয় তো তুই আছিস কি আমি আছি। করলি বের?”
হরিহর আস্তে আস্তে হাতটা বাহির করিল, মুষ্টিবদ্ধ অবস্থাতেই রহিয়াছে, একটু একটু কাঁপিতেছে। সুধার বাপ ব্যাপারটার আকস্মিকতায় এতক্ষণ বিমূঢ়ভাবে বসিয়া ছিলেন, এইবার একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া বাম হাতটা হরিহরের পিঠে রাখিয়া সস্নেহে কহিলেন, “ও তো ছোট্ট বাছুর বাবা, তোমায় আমি ভালো এক জোড়া বিলাতী গাই বাছুর কিনে দোব—এই হাটেই। নাও, হাত খোল, লক্ষ্মী আমার।”
জগবন্ধু তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “না না, ও-রকম আসকারা দেবেন না বেইমশাই, ওতে আমার বদনাম। ছেলে পণ করে দুধ খাবার জন্য গাই-বাছুর নিয়ে যাবে, লোকে বলবে—”
বরপক্ষের একজন রসিক বৃদ্ধ কথাটা কাড়িয়া লইয়া বলিলেন, “লোকে বলবে, বাপ- ব্যাটায় মিলে শ্বশুরকে দুইছে।”
যাহারা বুঝিল, তাহাদের মধ্যে হাসি পড়িয়া গেল। সুধার বাপ একটু লজ্জিত হইলেন। জগবন্ধুর মাথায় তাঁহার নিজস্ব পদ্ধতিতে তৰ্ক জাগিয়া উঠিতেছিল; বলিলেন, “একটু থামুন পুরুতমশাই, এর গোড়া এইখানেই মেরে দিতে হবে। দিব্যি এক মতলব বের করেছে তো! আজ বিয়ে করতে বসে পণ, এর পর শ্বশুর-বাড়ি আহারে বসে পণ, তারপর বউমাকে বাড়ি নিয়ে আসবার সময় পণ, প্রত্যেকবারেই শ্বশুর-শাশুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে এটা ওটা সেটা হাতানো! আমি কোথায় শর্দা-আইন বাঁচাতে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে গেলাম, ছেলে আমার ভাবছেন, বাঃ, এ তো খাসা এক রোজগারের পথ বের হল! কোন্ মুখ্যু আর লেখাপড়া করে, এই ব্যবসাই চালানো যাক। বলি, তোকে কে হদিস বাতলে দিলে র্যা? তুই শ্যামলী বাছুরের নামই বা জানলি কেমন করে? বল, তোর ব্যবসার গোড়াপত্তনেই আমি গণেশ ওল্টাব।”
বাপের মুঠার মধ্যে সুধার হাতখানিও কাঁপিয়া উঠিল। এই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে কচি বর-বধূর প্রতি দয়াপরবশ হইয়া সুধার বাপ বলিলেন, “থাক বেইমশাই, ছেলেমানুষ একটা কথা বলে ফেলেছে—”
জগবন্ধু কড়া-ধাতের লোক, নিরস্ত করা গেল না। অনেক বকাবকি-জেদাজেদির পর হরিহর মাথা তুলিয়া একবার পুরোহিতের পানে আড়ে চাহিল। তিনি উদ্দেশ্যটা বুঝিতে পারিয়া তাহার মুখের কাছে কান লইয়া গেলেন, তাহার পর বিস্ময়ের ঝোঁকে প্ৰায় হাতখানেক সরিয়া অসিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সে কি! কনে বলেছে? নিমাই কি করেছিল? চিঠি দিয়ে এসেছিল?”
আরও ধমক-ধামক করার পর চিঠিটার সন্ধান পাওয়া গেল। তিনি যে ছেলেকে টিপিয়া এই পণ করান নাই—সর্বসমক্ষে এটা নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণ করাইবার জন্য জগবন্ধু তখনই বাড়িতে লোক ছুটাইলেন।
হরিহরের নির্দেশমতো সে তাহার ভূগোলের পাতার মধ্য হইতে দলিলখানি সংগ্রহ করিয়া আনিল। তাহাতে লেখা আছে—”
প্রণামাবহব নিবেদন মিদং কার্যঞ্চাগে।
তোমার সহিত আমার বিয়ে ঠিক হইয়াছে। আমি খুব ভাগ্যবান। কিন্তু শ্যামলীরানীকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিব না। অতএব মহাশয় বিয়ের সময় ‘শ্যামলী চাই’ বলিয়া বেঁকে বসবেন। না হইলে আমি আপিম খাইয়া মরিব। আপিম আমার সারির আঁচলেই বন্ধিত থাকিবে, মোটা গেরো তুমি দেখিতে পাইবে। এতে দোষ হয় না। নেত্য পিসিদের বরও সেদিন একটা ঝার লালঠেম চাই বলে বেঁকে বসেছিল। নিয়ে ছাড়িল। মা বলেন জিদই পুরুষের লক্ষণ। এ নিমাই। নিমাই আমায় প্রাণের চেয়েও ভালো বাসে। সে এ চিঠি লিখে দিয়েছে। আমি অবলা নারি লেখা পড়া জানি না শ্যামলী ছাড়া হইয়া থাকিতে হইত। নিমাই ভয়ঙ্কর বিদ্বান আর খুব ভাল ছেলে তোমাদের ইস্কুলে 6th class পড়ে। প্রণাম জানিহ।
ইতি
অভাগিনি
Sudha
সুধাময়ি দাসী
‘ভয়ঙ্কর বিদ্বান’টির হাজার খোঁজাখুঁজি করিয়াও সে রাত্রে বিয়ে-বাড়িতে কোনো সন্ধান মিলিল না। শাড়িতে একটি বড়গোছের গেরো পাওয়া গেল বটে, কিন্তু সুখের বিষয় তাহাতে একটি বড় মার্বেল ভিন্ন অন্য কিছু ‘বন্ধিত’ ছিল না।