‘শ্যামলে শ্যামল তুমি’
রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে, ‘এলো যখন সাড়াটি নাই/গেল চলে জানালো তাই৷’ আবার লিখেছেন ‘চোখের আলোয় দেখে ছিলেম/ চোখের বাহিরে’ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেড়ে সম্পর্ক যখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো অতীন্দ্রিয় বোধের আকাশে বিচরণ করে, তখন সম্পর্কের ব্যাপ্তি ধরা পড়ে৷ অনেক মহান শিল্পী, সংগীতস্রষ্টাদের হারিয়ে অন্তরের আলোয়, অনুভূতির গোচরে তাদের দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি তাদের অসীম গুণের পরিধিকে উপলব্ধি করে৷ মনের দিক থেকে প্রত্যাশিত গায়কীর শূন্যতা যখন অসম্ভব অনুভব করছি, এমনই একদিন দুপুরে গড়িয়া মোড়ের একটি ছোট্ট ক্যাসেটের দোকান থেকে শুনলাম ভেসে আসছে শ্যামলদার কণ্ঠস্বর৷ দাঁড়িয়ে গেলাম— প্রাণটা জুড়িয়ে গেল৷ বহু তাপদগ্ধ হৃদয়ে শীতল প্রেমের স্পর্শ পেলে যেমন বলতে ইচ্ছে করে ‘পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যুঁথির মালা/সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা’ আমার তেমনই অবস্থা হল৷ দাঁড়িয়ে গেলাম আর অনুভূতি সাড়া দিয়ে আমার মনে বার্তা পাঠাল— কী অদ্ভুত গায়কী, কী অদ্ভুত পেলব কণ্ঠস্বর৷ কী সুন্দর দম নেওয়া৷ গীতি কবিতাটির ভাবানুযায়ী বাণীর ভাগের ব্যঞ্জনা৷ শ্যামলদা নিঃসন্দেহে আমার অতি প্রিয় চিরদিন— তবু সেদিন নতুন করে তাকে আবিষ্কার করলাম৷ মনে হল এমন শিল্পী— যার তুলনা সে নিজেই৷ যুগ যুগ অতিক্রান্ত হবে এমন শিল্পীর সন্ধান সমাজ সহজে পাবে না৷ শ্যামলদা যে কী শিল্পী তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য— কারণ তা হৃদয়ের ভাষায় অভিদ্যোতনা৷ আর হৃদয়ের ভাষা হৃদয় দিয়েই পড়তে হয়৷ শ্যামলদার গান কীরকম তা লিখে বোঝানোর চেষ্টা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়৷ শ্যামলদার গান শুনতে হয়৷ ভাল sound system-এ cd চাপিয়ে মনে মনে পাখির মতো উড়ে বেড়াতে হয় নিজের হৃদয়ের আকাশে আর সেই মনের সঙ্গে বেধে নিতে হয় প্রণয়িনীর আঁচলের একটি কোনা, যে আঁচল উড়বে৷ শিউলি কুড়িয়ে আঁচল ভরবে, যে আঁচল থেকে সৌরভ ছড়াবে ভিজে যুঁথি বা রাতের রজনীগন্ধা৷ একজন শিল্পী যদি শ্যামলদার গান গাওয়া নিয়ে উপলব্ধির জগতে গবেষণা করে তাহলেই সে বুঝতে পারবে একটা গান নিয়ে কী করতে হয়৷ শ্যামলদা আজ আমাদের মধ্যে নেই— কিন্তু তার পটের দিকে চেয়ে গাইতে ইচ্ছে হয়—
‘শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তায় অন্তরের মিল৷’
(রবীন্দ্রনাথ)
কিশোরকুমার জিনিয়াস— তিনি একটি গান গেয়ে ফেলার পর সেটি আর কোনও কণ্ঠে শ্রবণ করে তৃপ্ত হব, এমন ভাবাই যায় না৷ কিন্তু কিশোরবাবুর কণ্ঠে গীত ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর’ গানটি যিনি সুরকার স্বয়ং শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে শুনেছেন, তিনি জানেন— জিনিয়াসকেও মাঝে মাঝে অতিক্রম করা সম্ভব, যা শ্যামল মিত্র করতে পেরেছিলেন৷
শ্যামলদার সঙ্গে পরিচয় এমন আন্তরিক বন্ধুত্বের পরিবেশের মধ্যে যে, পাশাপাশি থেকে একসঙ্গে কাজ করেও সমসাময়িককালে তাঁর উচ্চতা মাপতে পারিনি, সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি৷ যা আজ পারছি, তাঁকে হারিয়ে৷ তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর মতো নিঃশব্দে প্রবেশ করেছিলেন আমার মনে, অনুভূতিতে, ভাললাগায়, ভালবাসায়৷ আজ তাঁর অন্তর্ধানে, সৃষ্টিশীল মনের শূন্যতায় বুঝতে পারছি, শূন্য হওয়া জায়গাটার ফাঁক কত বড়৷ কত অসহনীয়৷ এখনও নিয়মিত কাজ করছি সংগীতের, সে-সব অনেক গানেই তাঁর অভাব সমস্ত রক্তে, স্নায়ুতে অনুভব করি৷ হঠাৎ ওপরের পর্দায় কোমল গান্ধারে গিয়ে যদি কোনও গানের দাঁড়ানো থাকে তবে সেই পর্দার আবেগকে ধরে রাখবে কে? বিশেষ করে যে গানে ওই রকম প্রয়োজন হবে সেই গানের মূল ও পূর্ণ ভাব বুঝে? গানটির সামগ্রিকের মধ্যে ওই ওপরের কোমল গান্ধারের অবদান কতটুকু সেটাই বা বুঝবে কে? বা কাকে বোঝাব? শ্যামল মিত্র তো নেই৷ তিনি আমাদের ছেড়ে, কাঁদিয়ে, ভাসিয়ে চলে গেছেন৷ আমি বলব অসময়ে৷ কিছুটা দুঃসময়ে৷ স্বর্ণযুগের কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে, খুব কম সময়ে, কিছু শিল্পী ও সংগীতকারের লাইন ধরে চলে যাওয়া, সিম্ভনি সংগীতের অন্দরমহলে ‘ক্যাকোফোনি’ শব্দের প্রবেশের দুয়ার উন্মোচন করে দিয়েছে৷ আজও হেমন্তদার কণ্ঠে ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’ বা শ্যামলদার কণ্ঠে ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’— বেজে উঠলে মনে হয়— কে বলবে সংগীত মানে কেবলই আওয়াজ? অনুভূত হবে সংগীতের ধ্বনি হচ্ছে জীবনের শম ও শান্তির অনির্বচনীয় অপ্রাকৃত মন্ত্র৷ ওঙ্কারের সুর-দ্যুতি নিয়ে যেন এঁদের জন্ম৷
শুনেছি শ্যামলদা নৈহাটি গণনাট্য সঙ্ঘের শাখার মূল কণ্ঠশিল্পী ছিলেন৷ এবং সলিলদা (সলিল চৌধুরি) মাঝে মাঝে সেখানে যেতেন৷ আর সেই সুবাদে সলিলদার সঙ্গে শ্যামলদার যেমন অঘোষিত শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ছিল, তেমন কিছু বন্ধুভাব৷ শ্যামলদা দাদা বলতেন৷ সলিলদা তুই বলে সম্বোধন করতেন৷ এমনই সম্পর্কের আবেষ্টনীর মধ্যে শ্যামলদার সঙ্গে আমার পরিচয়৷ তখন আমি পুরোদস্তুর গণনাট্য সঙ্ঘের কণ্ঠশিল্পী, আবার অনেক গানের সুরকার৷ মনের প্রাণের আনাচে-কানাচে কোনও বাণিজ্যিক সংগীত-জগতের কেউ বলে নিজেকে ভাবি না— এমনই পরিমণ্ডলে পরিচিত হওয়ার সুবাদে শ্যামলদা অতি সহজেই খুব কাছের মানুষ, আপন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই তো গত বছর রবীন্দ্রসদনে সৈকত (শ্যামল-পুত্র) তাঁর বাবার স্মরণসভায় আমায় আমন্ত্রণ জানায়৷ আমি গিয়ে নানা যুক্তির মাধ্যমে বললাম, মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, শ্যামল মিত্র বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন— তিনি কোনও চিহ্নিত সময়ের বা যুগের শিল্পী নন— তিনি মহাকালের মহাজীবনের বৈতালিক৷ পরের দিন সৈকত জানতে চাইল আমার কোনও অসুবিধা হয়নি তো? আমি সৈকতকে বললাম, ‘সৈকত, শ্যামল মিত্র কি শুধু তোমার বাবা— আমার কেউ নয়?’ শ্যামল মিত্রের জীবনে সৈকতের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই আমাদের হৃদ্যতা৷ সৈকত যতদিন তার বাবার স্নেহ পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় আমি তাঁর ভালবাসা পেয়েছি৷ আমার আবদারে ঢাকুরিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে মাত্র পঞ্চাশ টাকায় শ্যামলদা গান গেয়ে গেছেন, যখন তিনি বেশ জনপ্রিয় এবং সমাজের মাপে একটি বেবি অস্টিনের মালিক৷
একজন বড়মাপের শিল্পী, একজন বড়মাপের মানুষ হতে বাধ্য৷ যেমন হেমন্তদার শেষ জীবন পর্যন্ত একটা আলাদা খরচ ছিল— অনেক সংসারকে টানতে হত বলে৷ কিন্তু তার প্রায় সবটাই গোপনীয়তা বজায় রেখে, আত্মপ্রচারে নিজেকে জাহির করার বাসনা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে৷ শ্যামলদারও ছিল অনেক গোপন দান, সাহায্য৷ এর আমি প্রত্যক্ষ ভোক্তা৷ মানুষ শ্যামল মিত্র কেমন তার একটা পরিচয় দিই৷ ঘটনাটা ঘটে ‘অমানুষ’ সুপারহিট হওয়ার পর৷ আমি মনে মনে চিন্তা করছি এবার শ্যামলদার পুজোর গানটা করতে পারলে ভাল হয়, কিন্তু সাহস পাচ্ছি না৷ কেবল মানে হচ্ছে— ‘অমানুষ’ সুপারহিট— এখন যদি মানসিকভাবে আমার আবেদনে সাড়া দেওয়ার মতো অনুভবে না থাকেন, যদি আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের স্পন্দন আজ তাঁর মনে সাড়া না দেয়— তবে তো খুব কষ্ট পাব৷ এই রকম দোনামনা করতে করতে শেষে হাজির হলাম শ্যামলদার বাড়ি, এক সকালে৷ সবে ঘুম থেকে উঠেছেন৷ যেতেই সেই পরিচিত আন্তরিক আহ্বান৷ — আয়৷ আমি আশ্বস্ত হলাম— উনি বললেন, বল৷ বুদ্ধিমান লোক— বুঝেছিলেন অভিজিৎ বিনা কারণে আসেনি৷ আমি আমার পুজোর গান গাইবার প্রস্তাব দিলাম৷ তিনি উত্তর দিলেন, কিছুটা বড় ভাইয়ের ভর্ৎসনার সুর মিশ্রিত কণ্ঠে— এতদিন কি ঘুমোচ্ছিলি, আগে এলি না কেন? আমার তো আগামী পরশু পুজোর গান রেকর্ডিং৷ আমি বললাম আমার দ্বিধার কথা৷ বললাম, ‘আসলে অমানুষ সুপারহিট— আপনি কেমন মুড-এ বিরাজ করছেন কে জানে৷ যদি অনভিপ্রেতভাবে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তো খুব দুঃখ পাব, তাই আসতে সঙ্কোচ ও সংশয় হচ্ছিল৷ শ্যামলদা কথাটা শুনে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো কণ্ঠে বললেন, ‘তোরাও যদি এরকম বলিস’— অর্থাৎ আমরা তাঁর নিজের লোক৷ আমাদের এই রকম অভিব্যক্তি তাঁর মনে আঘাত করেছে— তাঁকে বেদনা দিয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আজই কথা দিচ্ছি, সামনের বছর পুজোয় আমি তোর সুরে গাইব৷ কথা তো কথাই— সময় তো সময়ই— একেবারে হেমন্তদার অনুসারী৷ পরের বছর নিজেই যোগাযোগ করলেন৷ গানের স্কুলে এসে গান শিখলেন,— রেকর্ড করলেন৷ আজ এই মূল্যবোধহীন সময়ে, অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বিনিময়ের অবক্ষয়ের যুগে হেমন্তদা, শ্যামলদা, নচিদা, সুধীনদা, সলিলদাদের কথা বারবার মনে হয়৷ আর ভাবি, ভগবান! কালটা কলি বলে কি তোমার রাজত্বে তুমিও নীরব থাকবে? সেই বছর পুজোয় প্রকাশিত এই গান দুটি ‘হংস পাখা দিয়ে’-র মতো জনপ্রিয় হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটি গান— ‘ছেড়ে যেতে হবে সব/জীবনের কলরব’ আজ আমার বিদায়ী জীবনের অবসন্ন অবসরের আন্তরিক অবলম্বন৷ আর একটা কথা মনে পড়ে— উল্টোদিকের গানটি— ‘তুমি রূপসী রূপাঞ্জনা’ গাইবার সময়ে ‘চড়ার পঞ্চম’টি গাইতে গিয়ে একটু বকলেন— ‘কী রে তুই? এখন এই বয়সে কি আর চড়ার পঞ্চম আগের মতন লাগাতে পারি৷ না এত দম আছে?’ তথাপি ঠিক দমে ঠিকভাবেই ‘পা’টি লাগিয়েছিলেন৷ আসলে আজ যেমন অনেক শিল্পী বা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিজেদের সম্পর্কে কোনও মাপ জ্ঞান না বুঝেই কাজে হাত দেয়, কোনটা পারবে কোনটা পারবে না বোধ না নিয়েই কাজ করে— হেমন্তদা, শ্যামলদাদের তা ছিল না৷ অসম্ভব বুঝতে পারতেন, কোনটা তাঁদের দখলে আছে, কোনটা তাঁদের নেই৷ আবার এটাও বুঝতেন কোন গানের কোন অংশটি উৎকর্ষে তাঁর গলায় উতরে যাবে বেশি৷ নিজের deficiency এবং brilliance দুটোই শ্যামল মিত্রের জানা ছিল৷
নিজস্ব মাপবোধ আবার মর্যাদা বোধ কতটা ছিল তা আমি অনুভব করেছি৷ ‘দোলে দোদুল দোলে’— দেয়া নেয়া ছবিটির এই দ্বৈত সংগীতটিতে৷ নিজে গাইলেন— উত্তমবাবুর মুখের গানটি আর বন্ধু মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ালেন তরুণকুমারের মুখে৷ প্রযোজক, সংগীত-পরিচালক ও গায়ক এই তিন সত্তার বিচার ও বুদ্ধি প্রয়োগ অথচ প্রতিটি মানুষকে মর্যাদা দেওয়া ও নিজের মর্যাদা রক্ষা করা এই একটি গানের মধ্যে প্রকাশিত হল৷ এক এক করে বলি৷
১. বাংলা চলচ্চিত্র জগতে উত্তমকুমারের lip-এ যে সংগীত পরিচালকের বা শিল্পীর গান নেই তার 60% Cross, যেমন আমার৷ ছবিটির প্রযোজক ও সংগীত পরিচালক শ্যামলদা নিজে৷ তিনি কাপালিকের মতো অপর শিল্পীর মুণ্ডু না কেটেও— নিজে উত্তমবাবুর lip-এ গাইলেন— এ তাঁর বাণিজ্যিক বুদ্ধি৷
২. সহশিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষিত একজন সংগীতশিল্পী ও সুর রচয়িতা— শাস্ত্রীয়সংগীতের অসম্ভব পারদর্শী— রক্ষা করলেন তাঁর মর্যাদা— নিজে বেশিরভাগ Melodic part ও কাব্য প্রাধান্যের অংশ গাইলেন— আর মানবদাকে দিলেন এমন এমন অংশ যেখানে মানবদা তাঁর শাস্ত্রীয় দক্ষতার স্বকীয় বুৎপত্তিকে কাজে লাগাতে পারেন৷
৩. শেষে সঙ্গীতের তানটি রাখলেন যুগলে যাতে মনে হতে না পারে শ্যামল মিত্র অদক্ষ বা কম দক্ষ৷ দুজনের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করে একটি অসাধারণ বাংলা গানের জন্ম দিলেন৷
তাঁর brilliance-কে তো ব্যবহার করলেনই— তা ছাড়া নৈষ্ঠিক প্রয়োগে নিজেরও উচ্চ উৎকর্ষ প্রমাণ করলেন৷ বোঝা যায় দৃষ্টিটা ব্যক্তি ছাপিয়ে শিল্পসৃষ্টির দিকেই ছিল প্রধান৷
আজ কাজ করার সময়ে এসব বোধহীনতার অসুবিধাও খুব অনুভব করি৷ বাণীর মধ্যে প্রবেশ, তাকে আত্মীকরণ করা, ভাবানুযায়ী দমের মধ্যে ফেলে তাকে emotional scan করা, এসব শ্যামল মিত্রর ছিল স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত শিল্প-নন্দন বোধের প্রধান প্রকাশ বা প্রচেষ্টা৷ ছবিতে, Basic record-এ আকাশবাণীর রম্যগীতিতে বিভিন্ন ধরনের আঙ্গিকের গান তাঁকে দিয়ে গাইয়েছি৷ সব ক্ষেত্রেই অসম্ভব নিষ্ঠা ও যথাযথ বোধ দিয়ে voice modulation করতে পারতেন৷ একটা ছবিতে মাতালের একটা গান ছিল৷ একটা take করলাম, কিন্তু আমার মনে হল, যে লোকটা গাইছে, সে মদ না খেয়ে মাতাল৷ তখন একটা কথা চালু ছিল, সত্য মিথ্যা জানি না৷ কোনও কোনও জায়গায় দশ আনায় বাংলা মদ পাওয়া যায়৷ আমি খুব Raw ভাষায় কথা বললাম recording room থেকে, শ্যামলদা আর দশ আনার পান করে নিন— কী আশ্চর্যজনক sensitive artiste ‘singing room’ থেকেই উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে রে’— আছে শব্দটি উচ্চারণ করলেন এমনভাবে, মনে হল আকণ্ঠ পান করেই লোকটি ওই ‘ঠিক আছে রে’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন এবং সেই tone ও তার প্রাসঙ্গিক modulation-এ গানটি অভিপ্রেত অভিব্যক্তিকে একেবারে বাস্তব করে কণ্ঠে প্রকাশ করে দিলেন৷ কী অসাধারণ দক্ষতা! ভাবুন, যে শিল্পী ‘পুতুল নেবে পুতুল’ গাইতে গিয়ে কণ্ঠে ফিরিওয়ালাকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন,— সেই একই শিল্পী কণ্ঠের তুলি দিয়ে বাউলের জীবনতত্ত্বকে একেবারে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারলেন ‘কমললতা’য় ‘ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে’— এই গানটিতে৷ আমার অগ্নিময় জীবনে জ্বলন্ত বক্ষ-চিতার সামনে পূর্ণাঙ্গ জীবন হয়ে কতবার যে আমায় কাঁদিয়েছে এই গান, তা আমি নিজেই জানি না৷ আজও কাঁদায়, যতদিন বাঁচব ততদিন কাঁদাবে, আর মনে মনে শ্যামলদাকে বলব, ‘শ্যামলদা আপনি কী জানেন, অভিজিৎ আজও আপনার ওই গান শুনে কাঁদে আবার বাঁচে?’ নিজের সম্পর্কে নিজের মাপজ্ঞানটা প্রখর ছিল— গান শুনেই বুঝতে পারতেন গানটির কোন কোন জায়গায় তার দক্ষতার ঊর্ধ্বে তাঁকে কাজ করতে হবে এবং একটু মুচকে হেসে দিতেন, এবং সঠিক অনুশীলনে সেই গানটিকে উতরে দিতেন৷ এর অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখেছেন ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ ছায়াছবিতে৷ ওখানে এমন একটা আওয়াজ ব্যবহার করেছিলেন যা তিনি সারা জীবনে আর কোথাও ব্যবহার করেননি৷ একেই বলে বোধিদীপ্ত শিল্পী৷
আমার সুরে তাঁর গীত প্রথম গান— ‘ছিপখান তিন দাঁড়’৷ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত বিখ্যাত কবিতার কিছু অংশের সুরারোপিত কাব্যসংগীত৷ এই গানটিই আমার জীবিকা-নির্ভর সংগীত পরিচালক হওয়ার বাস্তব ভিত্তিভূমি৷ এটি আমার প্রথম প্রকাশিত গান নয়— প্রথম প্রকাশিত পুজোর দুটি যুগপৎ প্রকাশের একটি৷ কিন্তু এই গান প্রকাশের পথে লম্বা একটা ইতিহাস আছে, যার সবটুকু এই প্রবন্ধের আওতায় পড়ে না বলে লিখছি না৷ শুধু একটু ছোঁয়া থাকবে আমার এই রচনার পুষ্টি জোগাতে৷ গানটি রেকর্ড করার ও গ্রামাফোন কোং-এর সঙ্গে কথা পাকা করার সিদ্ধান্ত সলিলদার, শিল্পী নির্বাচনও সলিলদার, গান তোলানোর দায়ও সলিলদা নেন, রেকর্ডিংয়ে সলিলদা অর্গানও বাজান৷ এখন বলছি শ্যামলদার অবদানের কথা৷ কোনও এক শনিবার সলিলদার কাছ থেকে পুরো গানটি তুলে, পরের দিন রবিবার নিখুঁতভাবে শ্যামলদা এই গানটি আমায় গেয়ে শোনালেন৷ অভিব্যক্তির কোনও সূক্ষ্মতম অংশ আমায় সংশোধন করতে হয়নি৷ এমন অদ্ভুত smart শিল্পী খুব কমই দেখা যায়৷ সুরে, মননে আশ্চর্যজনক সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত৷ আমার প্রথম প্রকাশিত ছবি ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ছবিতে একটা গান ছিল ‘রসের ঘটা দেখবি যদি’— উনি studio-তে এসে গানটি শিখে record করেছিলেন— আর আমি খুঁতখুঁতে লোক হয়েও এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলাম, কারণ আমি তাঁর দক্ষতা সম্পর্কে এতটাই বিশ্বাসী ছিলাম যে ওই শর্ত মানতে দ্বিধা হয়নি৷ জানি ওনার পক্ষে এটা সম্ভব৷
চিরদিন সৃষ্টিশীল কাজকে বড় ভালবেসে, বড় আপন করে নিয়ে সম্পন্ন করেছি৷ স্বর্ণযুগের নির্মাতা ও প্রয়োগ শিল্পীরা সবাই তাই ছিলেন৷ ফলে একটি গান আমাদের কাছে সব সময় বিশেষ একটি ভাব, একটি বিষয় হয়ে ধরা দিত এবং বিশেষ একটি গান নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিবেশনের শেষ পর্যন্ত সেই attachment-কে অনুভবে ধারণ করে থাকত৷ এ বিষয়ে শব্দের ওপরও নির্মাতাদের এবং পরিবেশকদের খুব সজাগ বোধ কাজ করত৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘আকাশ’ শব্দটির উচ্চারণ যেন সাংগীতিক অভিব্যক্তির এক ভিন্ন অভিধান৷ এই ধরনের চিন্তা থেকে উঠে আসে ‘তুমি’ শব্দটির ব্যঞ্জনা৷ সেই সময় একটা কথা চালু হয়ে গিয়েছিল হেমন্তদার ‘তুমি’ divine আর শ্যামলদার ‘তুমি’ earthly৷ দুজনেই দমের হাওয়া ছাড়ার সঙ্গে ‘তুমি’ শব্দটা উচ্চারণ করতেন৷ যেখানে হেমন্তদার ‘তুমি’ শুনে প্রেমকে পূজা করতে ইচ্ছা করে, শ্যামলদার ‘তুমি’ যেন প্রেমরসভরা বৈষ্ণব দম্পতির দুবাহুর আলিঙ্গন৷ এসব উপলব্ধি পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা নয়৷ মহান শিল্পীদের প্রকাশের উৎকর্ষ থেকে উঠে আসা অনির্বচনীয় অনুভবের দীপ্তি৷ সময়ের বদল হবে, যুগ বদলাবে, শ্যামল মিত্ররা পুরাতন হবেন না— সনাতন হয়ে বিরাজ করবেন৷ শুধু ইতিহাস হবে না— চলমানতার স্রোতে গতিধারা হয়ে মিশে থাকবে৷ শ্যামল মিত্র অমর৷ শ্যামল মিত্র গীত সেই সব সংগীত যখন এখনও শুনি,— ভাবি যখন দেহে ছিলেন, পাশে ছিলেন, কাছে ছিলেন, তখন তো এই ঘ্রাণ অনুভব করিনি তেমনভাবে? কাছের মানুষ যখন দূরের তারা হয়ে দেখা দিলেন তখন তার দু্যতিতে দৃষ্টি বিস্মিত হয়েছে অনেক বেশি৷ ভাবতে চাই না শ্যামলদার কথা— কষ্ট হয়, তবু এক একটা নতুন গান নির্মাণের পর তাঁর মুখখানা ভেসে ওঠে৷ এখনও unrecorded এমন কিছু গান আমার কাছে যা হয়ত শ্যামল মিত্রের অভাবের জন্যেই আর কোনওদিন রেকর্ড করা যাবে না৷
প্রাজ্ঞ স্রষ্টা শ্রদ্ধেয় হীরেন বসু রচিত, স্বর্গত অনুপম ঘটক সুরারোপিত, হেমন্তদা গীত, ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি, লেখনি তরে, হে বলাকা’ গানটি আমার অতি-প্রিয়৷ খাদের সুরের দরবারি রাগের ব্যঞ্জনময় প্রকাশ আমার মনকে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মধ্যে নিয়ে ফেলে৷ আমার প্রিয় বন্ধু (এখন প্রয়াত) অমিয় দাশগুপ্ত একটি গান রচনা করে আনলেন৷ ‘হংসপাখা দিয়ে ক্লান্ত রাতের তীরে’— লেখাটি পেয়েই আমার মনে, প্রিয়ার প্রেমের লিপি গানটি, বিশেষ করে উদারার দরবারির পর্দা অনুরণিত হয়ে উঠল৷ আমি তখন সবেমাত্র ‘মিয়া মল্লার’ শিখেছি শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরু স্বর্গত ঊষারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে৷ মনে হল, এই রাগেও সেই খাদের পর্দার চলন আনা সম্ভব এবং ওপরের দিকেও এই সুরকে লীলায়িত করা যায়৷ গানটি এমনই এক ভাবনা থেকে সুর করে ফেললাম— মাথায় তখন বিরাজ করছেন হেমন্তদা৷ গ্রামোফোন কোং-এর তৎকালীন পরিচালক, শ্রদ্ধেয় পবিত্র মিত্র চোখ বুজে এক অলস ভঙ্গিমায় শুয়ে শুয়ে গানটি শুনলেন৷ তারপর উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে বললেন, ‘বুঝছি আপনি হেমন্তবাবুরে ভাইব্যা করছেন, কিন্তু আপনি এটা শ্যামলরে দেন, দেখেন কী হইব৷’ তারপর শ্যামলদা সেই গান গাইলেন— সেই গান কী হল তা আর আমায় লিখে বলতে হবে না৷ গণদেবতার দরবারে তার কেবল সুবিচার হয়েছে তা নয়, — অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরের সৃষ্টির আকাশে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করছে সেই গান৷ ওই গানটি আমায় প্রতিষ্ঠিত করার পথে ১০টি গানের মধ্যে একটি বললে কমই বলা হয়৷ খুব বড়মাপের শিল্পীরাও একটি গান পরিবেশনায় সুরকারের পূর্ণ আবেগকে প্রকাশ করতে পারে না৷ সেখানে শ্যামল মিত্র ‘হংস পাখা’ গাইতে গিয়ে আমার আবেগ প্রকাশের দক্ষতা অতিক্রম করে এমন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন যে, আমি, উল্টে গানটি গাইবার সময় শ্যামলদার কণ্ঠ স্মরণে, মননে আনি৷ খাদের পর্দা, ওপরের ‘র্জ্ঞ’ পর্দায় দাঁড়ানোর সময় শ্যামলদার গলার আওয়াজকে নিজের গলায় আনার চেষ্টা করি৷ সুরস্রষ্টার জীবনে এ এক পরম পাওয়া৷ এই গানটি রেকর্ড করার আগের দিন শ্যামলদা reharsal করেত করতে উঠে পড়লেন বললেন, অভিজিৎ মোহনবাগানের খেলা আছে —দেখতে যাচ্ছি-তুই পবিত্রদাকে বলবি-আমার reharsal হয়ে গেছে৷ নিচে নামলে যথারীতি পবিত্রদা ধরেছেন—’reharsal না দিয়া তুমি চইল্যা যাইতেছ’-উনি বললেন, ‘আমার rehersal হয়ে গেছে৷’ পবিত্রদা বললেন, ‘ঠিক আছে কাল গোলমাল হইলে দেখামু মজা৷’ পরের দিন প্রথম গানে প্রথম গান, আহা একটি পারিজাত ৯টি take হল৷ বাজনদারদের ভুলে শ্যামলদা ৯ বারই একরকম গাইলেন৷ এইটাই দক্ষ শিল্পী৷ এই শ্যামল মিত্র আমার হৃদয়ের স্নায়ু ও রক্তে কীভাবে মিশে আছে তা সৈকত কল্পনাও করতে পারবে না৷
আমরা কিছু শিল্পী পেয়েছি, যাঁরা একাধারে যেমন বড়মাপের শিল্পী৷ তেমনি খুবই বড়মাপের সুরকার৷ পঙ্কজকুমার মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা এর মধ্যে পড়েন৷ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, দিলীপ সরকার, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায় অনেকেই আছেন৷ কেবল নিজের কাজ করলেও মৃণাল চক্রবর্তীও কি কম শক্তিমান সুর-শিল্পী? সুবীর সেন? আজকের দিনের নচিকেতাকেই ধরুন না— কী বলিষ্ঠ সংগীত-নির্মাতা! হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো অবিসংবাদিত স্রষ্টা৷ কিন্তু এঁদের মধ্যে সবাই-ই প্রায় তাঁদের কণ্ঠশিল্পী সত্তার অস্তিত্বে এতটাই উজ্জ্বল যে, তাঁদের সুরস্রষ্টা হিসেবে অসাধারণ দক্ষতার প্রতি সাধারণ মানুষ অভিপ্রেতভাবে মনস্ক নয়৷ শ্যামল মিত্র তেমনি অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সংগীত-নির্মাতা৷ সুধীরলাল চক্রবর্তীর রাগাশ্রয়ী সৃষ্টির উৎকর্ষ ও সলিল চৌধুরির আধুনিকতার চরম বিকাশ দুটোই শ্যামল মিত্রের সৃষ্টিসত্তার গভীর মর্মবোধকে স্পর্শ করেছিল৷ তা ছাড়া আমরা, যারা তাঁর সমসাময়িক, তাদের প্রত্যেকের সুর সম্পর্কে এতটাই তাঁর সজাগ অনুসন্ধান ছিল যে, কে কেমন ধরনের সুরকার সব তাঁর বোধে বোধ ছিল৷
শ্যামলদা Film এবং Non-Film এই দু’ধরনের সংগীত নির্মাণেই এক সফল সংগীত পরিচালক৷ Film-এর কাজ তাঁর জনপ্রিয়তাকে তাঁর জীবনের শীর্ষে আরোহণ করতে সাহায্য করেছে সন্দেহ নেই৷ তবু তাঁর Non-Film গানে সুরবৈচিত্র্য ও তাকে শিল্পী অনুযায়ী প্রয়োগ করার যে সুবিবেচক চিন্তা ও দক্ষতার পরিচয় রেখেছে — সেটা তাঁকে অনেক বেশি মৌলিক করে প্রকাশ করেছে৷ গ্রামোফোন কোম্পানি এবং এই প্রবন্ধ লেখক যখন বছর বছর পুজোর গানে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিদেশি সুরের চলন-বলনসমৃদ্ধ গান করাবার জন্যে অবিচ্ছিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, আমি তো তখন বছর বছর গান করছি, — ‘তোলপাড় মনের কথা’, ‘কলকাতার মেয়ে’, ‘ম্যাগনোলিয়া ক্যামেলিয়া’ ধরনের গান, যাতে মনে হয় গানগুলো যেন Western number, প্রায় সেই সময়েই শ্যামলদা তরুণদাকে দিয়ে এক বছর রেকর্ড করালেন — ‘কাজল নদীর জলে/ভরা ঢেউ ছলছলে/প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া/সোনার বরণী মেয়ে/বল কার পথ চেয়ে/আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া৷’ বাণী পবিত্র মিত্র৷ সেটা শোনার পর সেই যে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল — তরুণদার বহু কাজ করা সত্ত্বেও সে মাথা আর আমি উঁচু করে ওঠাতে পারিনি৷ নির্মাতা হিসেবে শ্যামলদার কাছে এ আমার একটা চরম পরাজয়৷ একাধিকবার আমি ওইভাবে শ্যামলদার কাছে পরাজিত হয়েছি৷ প্রতিমা ব্যানার্জি- গীত আমার সুরে গান, ‘তোমার দু’চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’ গানটি আজও জনপ্রিয় — এখনও এই প্রজন্মের শিল্পীরা মাঝে মাঝে ওই গান গেয়ে থাকে এবং রেকর্ডও করে৷ হেমন্তদা, শ্যামলদা, মানবদা, নচিদা থেকে শুরু করে এমন কেউ নেই যে আমার এই নির্মাণ নিয়ে আমাকে না প্রশংসা করেছেন৷ কিন্তু আমি আজও ওই নির্মাণ সম্পর্কে নিজে খুব কৃতিত্ব দিতে পারি না নিজেকে, মনে হয় প্রতিমাদের অসামান্য কণ্ঠসারল্যই ওই সংগীতটিকে মূলত জনপ্রিয় করেছে৷ এমন সব ভাবনার মধ্যে দিয়ে যখন প্রতিমাদি-গীত শ্যামলদা সুরারোপিত ‘কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে…’ গানটি শুনলাম, আমায় যেন কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিল৷ প্রতিমাদির কণ্ঠের আধুনিকতার সবটুকু রস যেন নিংড়ে সৃষ্টি ওই মধুর সংগীতটি (‘কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে ইছামতীর কূলে’)৷ আবার শ্যামলদার কাছে পরাজয়৷
চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার সুযোগ একেবারে নেই, তা নয়৷ সলিল চৌধুরির নির্মাণ ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নির্মাণের তফাত ধরা যায়৷ তবু সেক্ষেত্রে সংগীত পরিচালক ছবির পরিচালকের দৃষ্টি দিয়েই দৃশ্যকে আত্মীকরণ করেন ও সেই অনুযায়ী সুর সংযোজনা করেন৷ কিন্তু non-film গানে সুরকার অনেক স্বাধীন৷ যে কোনও সুর যে কোনও art form-এ সৃষ্টি করার তাঁর মৌলিক অধিকার আছে — সেই অধিকারের নৈপুণ্য শ্যামল মিত্রের সৃষ্টিতে কত মনোরম ফুল ফুটিয়েছিল তা বলে শেষ করা যায় না৷ অথচ তাঁর সৃষ্টির উৎকর্ষে কোনওদিন সুধীরলাল চক্রবর্তীর বনেদিয়ানা ও সলিল চৌধুরির আধুনিকতা কখনও বিস্মরণ হয়নি, বরঞ্চ ইতিবাচকভাবে বলা যায় তাঁদের প্রভাব যোগ্য মর্যাদা পেয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে৷ অথচ শ্যামল মিত্র স্বকীয়৷
সলিল চৌধুরিকে তিনি গলাধঃকরণ করেননি — হজম করেছিলেন৷ শ্যামল মিত্র তাই সৃষ্টিশীলতায় মৌলিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন৷ মধুমতী তখনও release করেনি৷ বম্বে গিয়ে শুনে এলেন মধুমতীর গান৷ তখন তাঁর পুজোর গান রেকর্ড হয়ে গেছে — কিন্তু মধুমতীর সুহানা সফরের ‘ও হো হো’ হামিংটা শ্যামলদার অসম্ভব পছন্দ হয়েছিল৷ চিন্তা করলেন এই অংশটা তাঁর গানে ব্যবহার করবেন৷ কলকাতা ফিরে এসেই বসে গেলেন পবিত্র মিত্রকে নিয়ে গান তৈরির জন্যে — সৃষ্টি হল একটি অনবদ্য সংগীত৷ ‘এই পথে যায় চলে/ঝরা পাতা যায় দলে৷’ কেউ বলতে পারবেন ওই সৃষ্টি স্বকীয় নয়৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাজমহল, তানসেন থেকে আমরা প্রেরণা নেব, কিন্তু গৃহনির্মাণে গম্বুজও লাগাব না আর আপন সংগীতে তানসেনকে বমন করব না! বলেছেন অনুকরণ দোষ, স্বীকরণ দোষণীয় নয় গ্রহণীয়৷ অন্যের সুর থেকে প্রায় সমস্ত সৃষ্টিশীল সুরকারই সুর গ্রহণ করেছেন৷ কিন্তু যা যখন অনুকরণ হয়েছে তা সার্থক হয়নি — যা স্বীকরণ হয়েছে তা নবসৃষ্টির মর্যাদা পেয়েছে৷ একই অসমিয়া সুর থেকে পরেশ ধর নিলেন — হেমন্তদা গীত ‘ঝিমিমিকি জল নদী টলমল’, আমি করলাম ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো’, সলিলদা ‘ও মোদের দেশবাসীরে’, আর শ্যামলদা করলেন, ‘কাজল নদীর জলে!’ শ্যামলদা আধুনিকতার মিশ্রণে একেবারে মৌলিক — পর্দা ব্যবহারে scanning-এ নিজস্ব মুনশিয়ানা৷ যেমন ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’ গানটিতে ভেবেছিল একটি পাখি — ‘একটি’ শব্দটা ভেঙে ব্যবহার করলেন৷ এখানে শব্দ থেকে প্রাধান্য পেল সুর — এটা শ্যামলদার style৷ যেটা আমার নির্মাণে হয় না৷ শব্দকে তার বাণীধ্বনি আমি নষ্ট হতে দিই না৷ এরকম আরও উদাহরণ দেওয়ার গান আছে৷ সেখানে সুরকে স্বীকরণ করা হয়েছে৷
একবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে ধর্মঘট হয়, মিটলে নতুন কার্যভার গ্রহণ করেন ক্ষিতীশ বসুর স্থলে পবিত্র মিত্র৷ এদিকে গণনাট্য সঙ্ঘে সলিলদার নেতৃত্বে নতুন গানের আসর বসে৷ নতুন নতুন গান নিয়ে সভ্যদের মধ্যে নানা বিনিময় হয় — সেই থেকেই সূত্রপাত সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা সমবেত প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন গান উঠে আসা৷ যে স্রোত এসে পরবর্তীকালে প্রবলবেগে স্পর্শ করেছিল স্বর্ণযুগের সংগীতকারদের নির্মাণ প্রচেষ্টার সম্প্রীতির মধ্যে দিয়ে৷ এতে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন মানুষের কাছে নতুন গান অনুসন্ধান করা ও সার্থক সংগীতগুলোকে কী করে জনসমক্ষে হাজির করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার প্রবণতা গড়ে উঠল৷ সলিলদার প্রেরণায় এই মানসিকতার আবেগ নিয়ে একদিন শ্যামলদা-সৃষ্ট বেশ কয়েকটা গান শুনলাম, যার মধ্যে ছিল ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ’, ‘এমন দিন আসতে পারে’৷ মনে পড়ে ‘মহুল ফুলে জমেছে মউ’ শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ তখন গণনাট্য সঙ্ঘের মতাদর্শের আলোয় আমাদের মধ্যে একটা প্রবল প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল folk element-কে কতটা আধুনিক সংগীত নির্মাণের বাহন করা যায়৷ আমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির মধ্যেই এই প্রেরণা তখন প্রবল৷ সবে ধর্মঘট মিটেছে—সুরকার হিসেবে প্রথমেই ডাক পেলাম আমি, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান করার জন্যে৷ পরিচয় হল পবিত্র মিত্রের সঙ্গে—জানতাম না তাঁর সঙ্গে শ্যামলদার পূর্ব পরিচয় ছিল এবং সেই সম্পর্ক খুবই কাছাকাছির৷ জানতাম না তাঁরা উভয়েই সুধীরলাল চক্রবর্তীর সাংগীতিক পরিবারভুক্ত৷ আমাদের গণনাট্য সঙ্ঘ করার মানসিকতা থেকেই পবিত্রদাকে বললাম—’পবিত্রদা শুনবেন, শ্যামলদা কী ভাল ভাল সুরে সব গান করেছেন৷’ শ্যামলদা তখন শিল্পী হিসেবেই পরিচিত, তিনি যে এক বড়মাপের সুরকার, সেটা তখনও প্রতিষ্ঠিত নয়৷ কথাগুলো আমাদের গণনাট্যকর্মের দায়বোধ থেকেই আমি পবিত্রদাকে বলেছিলাম৷ আজ ভেবে লজ্জা পাই আমার সদিচ্ছার ইন্ধনে সেদিন পবিত্র মিত্রকে যে অনুরোধ করেছিলাম, তা ছিল মায়ের কাছে মাসির গল্পের মতো৷ কারণ উভয়ের পরিচয়ে নিখাদ আন্তরিকতা ছিল সুধীরলাল চক্রবর্তীর সাংগীতিক পরিবারভুক্ত হওয়ার কারণেই৷ কিন্তু আমার সেই ভাললাগায় কোনও খাদ ছিল না, যা পরে মুগ্ধতায় চরমভাগে বিকশিত৷ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-গীত ‘হয়ত কিছু নাহি পাবো’ শ্যামল মিত্র-সৃষ্ট অনবদ্য সংগীত৷ পর্দার চলনে সুধীরলাল চক্রবর্তী মহাশয়ের Melody movement, বিশেষ করে অন্তরায়৷ আর স্থায়ীতে ‘পাবো’র রে-তে এসে chord change করে দাঁড়ানো, সলিল চৌধুরির format অত্যন্ত শ্রুতিসুখকর এবং দক্ষ নির্মাতার পরিচয়৷ তাঁর সৃষ্টিতে সুধীরলাল চক্রবর্তী ও সলিল চৌধুরি মননে এত ভাল হজম হয়েছিল যে, দুজনের সৃষ্টির মূল রস শ্যামলদা স্বকীয় রসে মিশ্রিত করে নিজেকে সুরকার হিসেবে একেবারে মৌলিক করে তুলেছিলেন৷ তাঁর সজাগ শ্রবণ ও মনন, স্বকীয় ভাবের রসে জারিত হয়ে যে নিজস্ব সংগীত সৃষ্টি করেছেন তা আদ্যোপান্ত শ্যামল-সংগীত৷ একটা ছবিতে মাতালের গান থাকলেই আমরা নয় বিদেশি সুর [‘এই দুনিয়ায় ভাই’]কে অবলম্বন করি না হলে লোকগানের কোনও ধারা যেমন ‘আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’ ব্যবহার করি৷ কিন্তু শ্যামলদা যখন ‘বিপিনবাবুর কারণ সুধা’ তৈরি করলেন, এ দুটোর কোনও আঙ্গিকটার ওপরই অন্ধ নির্ভরশীল হলেন না, একটা নিজস্ব style-এর মিশ্রণ নিয়ে এলেন৷ তাঁর অসাধারণ কণ্ঠস্বর ও তাঁর range, তাঁর rendering এতটাই ভাল ছিল যে সুর করার সময় নিজে গেয়ে বুঝতে পারতেন, সুরটি প্রয়োগে ও প্রকাশে কী দাঁড়াতে পারে৷ কিছু গান সত্যি আমায় আজও ভাবায়— ‘সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যায়’ সুরকার বড় না গায়ক বড়, নির্ধারণ করা দুষ্কর৷ হয়ত সুধীরলাল চক্রবর্তীর গুণমুগ্ধরা আমার গলা কাটতে আসবেন, তবু গলা না কাটা পর্যন্ত চিৎকার করে একটি উচ্চারণ করে যাব যে সৈকত ছাড়া আর কারও মুখে শুনতে চাই না—
‘স্মৃতি তুমি বেদনার৷’
আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমি উচ্চারণ করে যাব, ‘শ্যামলে শ্যামল তুমি’৷
‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে৷
নাহি ক্ষয় নাহি শেষ’— রবীন্দ্রনাথ
মানুষের গোত্র নশ্বর, শিল্পীর গোত্র অবিনশ্বর৷ দেহ ক্ষয়শীল, শিল্পী অক্ষয়৷ শ্যামল মিত্র এক তরঙ্গ— মিলিয়ে গেছেন, রেখে গেছেন তাঁর অজস্র শিল্পতরঙ্গ৷ শ্যামল মিত্র নামে ফুলটি ঝরে গেছেন, ফুল ফুটিয়ে গেছেন অজস্র— যাদের নাম কেবল শৈবাল আর সৈকত নয়— তারা সব শ্যামল তরঙ্গসাগরের অজস্র ঝিনুক, মুক্তা, উজ্জ্বল রত্নাবলি৷ এই প্রজন্ম ভাববে না উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা কী পেলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, সলিল চৌধুরি, নচিকেতা ঘোষদের কাছে? এঁরা কি করে ‘আঙুল কাটিয়া কলম বানাল,’ জানবে না? তবে নবযুগ ফলবন্ত হবে কী করে? শিল্প তো বস্তু নয়, শিল্প যে মননের পুষ্টি! কেবল industry তো নয় art, আর এ বোধ তখনই সত্যি যখনই তা কেবল matter নয়— তা mind, কখনই তা আর production নয়— Re-production, আর এই Reটাই ঐতিহ্য— পিতৃমাতৃ পরিচয়৷ চলমান স্রোতকে বাহিত রাখার দায় যে শিল্পীদের৷ শিল্পস্রষ্টাদের৷ তাই তো শ্যামল মিত্ররা নিজেদের সজীব প্রবাহে শিল্পকে স্রোতস্বিনী করে গেছেন আগামীর দিকে৷ বর্তমান প্রজন্ম ঝাঁপিয়ে ধরুক সেই গতিকে, তবে তা আরও বেগমান হবে৷ যে তরঙ্গ মিলিয়ে গেছে তা নব তরঙ্গে আরও গতি পাবে এটাই তো অভিপ্রেত৷ তাই জানতে হবে, বুঝতে হবে পূর্বসূরিদের আবেগ, সাধনা, নিষ্ঠা, আনুগত্য, ভালবাসার অভিব্যক্তিকে৷ দিতে হবে তাদের প্রাপ্য সম্মান৷ আবার উত্তরসূরিদেরও অত্যন্ত আন্তরিক সংবেদনশীলভাবে প্রেরণাপ্রযুক্ত হয়ে, প্রেরণাপ্রদীপ্ত হয়ে মর্যাদা দিতে হবে পূর্বসূরিদের৷ এস ডি বর্মনকে মর্যাদা দিয়েছেন আর ডি বর্মন, আবার আর ডি বর্মনকে মর্যাদা দিয়েছেন এস ডি৷ হেমন্তদা আবিষ্কার করেছেন সলিল চৌধুরিকে (গাঁয়ের বধূ) আবার তাঁকে সম্মান করেছেন৷ তাঁর সৃষ্টিকে যোগ্য মর্যাদায় স্থাপিত করেছেন৷ কথাটা আজকের দিনে বড় প্রাসঙ্গিক৷ কারণ দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে বর্তমান সময়ে বিগত ও আগত প্রজন্মের মধ্যে অলিখিত কাজিয়ায় যোগ্য মর্যাদা বিনিময় নেই৷ এটা সংগীত জগতের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর৷ তাই আমি শ্যামল মিত্রের জীবন থেকে ৩টি ঘটনা তুলে ধরব, যাতে প্রমাণ পাওয়া যাবে অগ্রজ-অনুজ সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিকতা৷ প্রেম, আনুগত্য, বিশ্বাস এই সব মূল্যবোধের প্রয়োজন শিল্পীজীবনে কতটা৷ মানুষ শ্যামল মিত্রের অগ্রজদের ভালবাসা আদায় করে নেওয়ার যোগ্যতা কতটা ছিল এবং সেখানে তাঁর নিজস্ব আনুগত্য ও গুরুস্থানে মাথা নিচু করার কতটা দক্ষতা ও মহৎ হৃদয় ছিল৷
আকাশবাণীতে একটি রম্যগীতির গান রেকর্ড করছি শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে৷ বাংলা ঢোলের সঙ্গে গানটি হয়েছিল৷ গানটির প্রথম লাইন ‘ঢ্যাম কুড় কুড় নকুড় নকুড়’৷ এ গান হংসপাখা বা সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা নয়, এমনকি পুতুল নেবে বা মহুল ফুলে জমেছে মৌও না— পুরো কবিয়ালের ঢঙে গান৷ প্রযোজক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব সর্বজন শ্রদ্ধেয়, প্রণম্য শ্রীজ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ৷ জ্ঞানদা কখনওই তাঁর অস্তিত্বের গুরুত্ব দিয়ে কারও মনে চাপ সৃষ্টি করতেন না৷ তথাপি নিজে এক মহাবিদ্যালয় হওয়াতে একটা চাপ আমাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হতই৷ শ্যামলদা এই গান গাইবার আগে রম্যগীতিতে কয়েকটি গান গেয়ে তাকে জনপ্রিয় করে দিয়েছেন৷ বাজারে তখন তাঁর Basic record এবং film-এর প্রচুর গান জনপ্রিয়, যে গানটা গাইছেন সেটাও আমার সুরের— কাজেই সমীহ করার মতো কেউ নেই৷ কিন্তু শ্যামলদা গানটি রেকর্ড করে এসে জ্ঞানদার সামনে দাঁড়িয়ে শুনবেন ভাবতে পারছেন না— এতটাই সমীহবোধ— দেখি, যে ঘরে গানটা শোনা হচ্ছে, সেই ঘরের একটা টেবিলের নিচে আড়ালে বসে গানটি শুনছেন আর ভয়ে ভয়ে জ্ঞানদার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছেন৷ আমার সুরে গান হচ্ছে— আমি মনটা শ্রবণের দিকে মনস্ক রাখব এইটাই তো অভিপ্রেত কিন্তু আমি তা পারলাম না— আমার মনকে কেড়ে নিলেন শ্যামলদা৷ তাঁর মুখে মুচকি হাসি৷ দৃষ্টিতে ভীরুতা৷ জ্ঞানদার অস্তিত্বের প্রতি সমীহমিশ্রিত চাহনি দেখে আমি স্তম্ভিত, অভিভূত৷ আমাদের রুচিশীলতার সাধনায় গড়ে ওঠার পশ্চাতে এসব ঘটনা আমাদের জীবনে তাৎপর্যময় ও ঐতিহাসিক ঔজ্জ্বল্যে দিব্যস্মৃতি সংগ্রহ হয়ে আছে৷
গৌরীদা মানে প্রখ্যাত গীতরচয়িতা শ্রীগৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শ্যামলদাকে খুব স্নেহ করতেন৷ ছায়াছবির জগতে শ্যামলদাকে এগিয়ে দেওয়ার অন্তরালে গৌরীদার অনেক অবদান আছে৷ শ্যামলদাকে খুব ভালবাসতেন৷ গৌরীদা নিজে গানের আঙ্গিক কিছু বুঝতেন না— যেটা পুলকবাবু জানতেন৷ কিন্তু গৌরীদা যখন একটা গান রচনা করতেন সমস্ত শরীরে তার সুরের তরঙ্গ দোলা দিত এবং দেহে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেত— মুখে একটা পরিতৃপ্তির, প্রশান্তির ছাপ পড়ত৷ একদিন শ্যামলদার সুরে গৌরীদা কথার জোগান দিচ্ছেন৷ গানটি ধীরে ধীরে নির্মাণে জমে উঠেছে৷ গৌরীদার সর্বাঙ্গে শুরু হয়েছে তার দোলা— প্রতিক্রিয়া— গৌরীদা যাকে বলে মস্ত৷ এইভাবে গানটির অন্তরা পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেল৷ তারপর গৌরীদা সঞ্চারীর বাণী লিখলেন৷ শ্যামলদা অন্তরা পর্যন্ত যা সুর করেছিলেন সব Major note-এর ওপর৷ আমরা অনেক সময় সঞ্চারীতে Major-কে Minor, অথবা Minor-কে Major-এ নিয়ে সঞ্চারী নির্মাণ করি৷ সেই রকম ভাবনা নিয়ে শ্যামলদা সঞ্চারীতে স্তব্ধ গান্ধার ছেড়ে কোমল গান্ধার ব্যবহার করেছেন৷ গৌরীদা কোমল, শুদ্ধ ও ওসবের ধার ধারেন না— তিন বোঝেন, অনুভব করেন বিষয়বস্তু আবেগ, আবেশ৷ আর ওই গানটিতে হয়ত শুদ্ধ গান্ধারের বদলে কোমল গান্ধার ব্যবহারে গড়ে ওঠা আত্মমগ্নতা ভেঙে গেছে— আর কোথায় যায়— গৌরীদা খেপে উঠে শ্যামলদাকে বললেন, ‘ওটা কী করলি?’ শ্যামলদা বললেন, কোমল গান্ধার লাগিয়েছি৷ গৌরীদার mood কেটে গেছে, রেগে উঠে বললেন, ‘মারব এক লাথি, তোকে কে বলেছে কোমল গান্ধার লাগাতে?’ শ্যামলদা তাঁর স্বভাবমিশ্রিত বুদ্ধিযুক্ত সেই মুচকি হাসি দিয়ে গ্রহণ করলেন গৌরীদার ভর্ৎসনা৷ কী অসাধারণ বিনিময় এই ভালবাসা ও নন্দনচিত্রবোধের৷ সৃষ্টির আকুলতাই বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তিসম্পর্কের অগ্রজ-অনুজের প্রেমে৷ সেদিনের শিল্পীদের বন্ধুত্বের মধ্যে যে নিবিড়তার বিনিময় দেখেছি, তার সব কাহিনী লিপিবদ্ধ করলে নতুন প্রজন্ম চিনতে পারত সেই শিল্পীসমাজ থেকে সাধারণ সমাজের পরিধি অতিক্রান্ত সৃজনী পুষ্পের নন্দনকানন, যেখানে একে অপরের প্রকৃত বান্ধব ছিল৷ প্রতিযোগিতা ছিল প্রতিভা প্রকাশের উৎকর্ষভিত্তিক— ব্যক্তিগত রেষারেষি নয়৷
শ্যামলদা, মানবদা, দ্বিজেনদা, তরুণদা, নির্মলদা— এঁরা সব কাছাকাছি বয়সের৷
হেমন্তদা, ধনঞ্জয়দাকে এঁরা শ্রদ্ধার আসনে রাখতেন৷ কিন্তু শ্যামলদা ওই বাকি চারজনের কাছাকাছি থেকেও একটু তফাত ছিলেন৷ তার কারণ, শ্যামলদা মনে মনে হেমন্তদার ব্যক্তিত্ব, চলা বলা, গোপনে মানুষকে সাহায্য করা প্রভৃতি যে সব মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষ ছিল, সেগুলো follow করার চেষ্টা করতেন৷ তাই আমরা দেখেছি, কোনও ছায়াছবিতে প্রাক মান্না দে-র সময়ে হেমন্তদার পরেই নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন শ্যামল মিত্র৷ শ্যামলদা কোথায় যেন জীবনের পদক্ষেপে হেমন্ত-অনুসারী৷
আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে৷ লালপাথর ছবিতে সবিতা চৌধুরি, শ্যামল মিত্রর একটি দ্বৈত রাগপ্রধান গান রেকর্ড হচ্ছে৷ সংগীত-পরিচালক সলিল চৌধুরি ও সহকারী হিসেবে আমি রেকর্ডিং রুমে আছি৷ গানটির গোড়াতেই একটা ‘আ’ দিয়ে সুর ধরা আছে৷ শ্যামলদা সুরটা ধরছেন৷ কিন্তু tailটা কেঁপে যাচ্ছে৷ বারবার cut করতে হচ্ছে৷ আমি বললাম, শ্যামলদা tailটায় গিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিন৷ open মুখের জন্যে কাঁপছে— সঙ্গে সঙ্গে সেটা গ্রহণ করলেন৷ আমরা যাকে বলি vanity– সেটা একেবারে ছিল না শ্যামলদার৷ এই সব শিল্পী কেন এত ওপরে উঠেছেন তার অন্যতম প্রধান কারণ তাঁরা নিজেকে সেবা না করে শিল্পের সেবা করেছেন৷ কোনও দিন বুঝিনি আত্মদম্ভে স্ফীত হয়ে অশিল্পচিত অশিষ্টভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে৷ এ সম্পর্কে আলাদা বোধও ছিল না৷ বাহাদুরির প্রদর্শনী দেখিনি৷ শিল্পের প্রকাশ দেখেছি৷ শিল্পীর আত্মমগ্নতাই তাদের মধ্যে স্বভাব হয়ে অবস্থান করত৷ তাঁরা প্রাসঙ্গিক ছেড়ে আনুষঙ্গিক নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতেন না৷
ইতিহাস থেকেই মানুষ চলার, এগোবার প্রেরণা নেয়৷ শ্যামল মিত্র সেই জাতের শিল্পী, যার শিল্পবোধ ও প্রকাশের উৎকর্ষ নিয়ে বারবার আলোচনা করলে যে কোনও শিল্পী তার নিজের জীবন প্রকাশের ভাবনাকে পুষ্টি জোগাতে পারবে৷ রবীন্দ্রনাথের এই বাণী— ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ ওঠে’ বা ‘কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফোটে’ এই উক্তি সত্য হবে তখনই যখনই জীবনে তরঙ্গ থাকবে— মরুহারা নদী হবে না৷ সাগরে মিশবে৷ আর জীবন যখন কুসুমের মতো প্রস্ফুটিত হবে তখনই তা সম্ভব— গোলাপই বিকশিত হবে, তার কাঁটাটা নয়৷ শিল্পনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণের কোরকেই প্রস্ফুটিত হবে পূর্ণ পুষ্প, এ যে কোনও সাধনার সত্য শর্ত৷ মহাপ্রভুর কথা— ‘সাধনবিনা সাধ্য বস্তু নাহি হয় লাভ’— এ সাধনা সা রে গ ম প-এর সাধনা শুধু নয়— ওস্তাদের বা পণ্ডিতের ওস্তাদি বা পাণ্ডিত্যের সাধনা নয়— এ সাধনা জীবন শিল্পের৷ তাই তো শ্যামল মিত্র রবীন্দ্রনাথের গানকে জীবন দিয়ে সত্য করে গেছেন৷ ‘জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে৷’ তাই শ্যামল মিত্রের শিল্পীজীবন চিতাভস্মে শেষ হয়নি৷