শ্যাডো–এ প্যারাবল
আপনারা, যারা পাঠক তাঁরা তো এখন দিব্যি জীবিত আছেন। কিন্তু আমি যে লেখক, বহু আগেই আমি ছায়ার দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছি। আমি এখন অন্য লোকে দিন গুজরান করছি।
আমার এ স্মৃতিকথা মানুষের নজরে পড়ার আগে বহু অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে, বহু গোপন ব্যাপার স্যাপার প্রকাশ পেয়ে যাবে, পার হয়ে যাবে বহু শতক। আরও, আরও অনেক কিছুই ঘটবে।
আর আমার এ স্মৃতিকথা যখন মানুষের নজরে পড়বে তখনও কেউ করবে, কেউ বা সন্দেহের চোখে দেখবে, আর লোহার স্কাইলাস দিয়ে খোদাই করে করে যে বর্ণগুলো ফুটিয়ে তুলছি, তাতে কেউ কেউ বহু চিন্তার সুযোগ পাবে, হাজারো চিন্তার তথ্য।
সেটা এক আতঙ্কের বছর ছিল, আর আতঙ্কের চেয়েও তীব্রতর এক অনুভূতির, যার নামকরণ পৃথিবীতে আজ অবধি সম্ভব হয়নি।
বহু অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে গিয়েছে, দেখা দিয়েছে বহু লক্ষণ, আর জলে-স্থলে ও দূরবর্তী নিকটবর্তী অঞ্চলে সর্বত্র মহামারীর কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। যাদেও ভগ্য ভালো তারা আঅবধি জানে না যে, স্বর্গেও এ ব্যাধির বীজ ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি, আর আমি গ্রীক ওইলও পরিষ্কার অনুধাবন করতে পেরেছি, সাতশো চুরানব্বইতম বছরের সে কল্পকালের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যখন মেষরাশির সঞ্চারের মাধ্যমে শনিগ্রহের ভয়ঙ্কর রক্তিম বলয়ের সঙ্গে বৃহস্পতির মিলন ঘটেছে।
আমার যদি অস্বাভাবিক ভুল না হয়ে থাকে, দূরবর্তী আকাশের ওই শক্তিগুলোর প্রভাব যে কেবলমাত্র পৃথিবীর বলয়ের ওপর পড়ে প্রভাবান্বিত করেছে এমন কথা মনে করা ঠিক হবে না, মানুষের কল্পনার ওপরও অবশ্যই প্রভাব পড়েছে। আর এটা যে হতেই হবে।
রক্তাভ চীনা মদের বোতলের ছিপি খুলে এক রাতে একটা বড়সড় হলঘরের মধ্যে আমরা সাতজন মুখোমুখি বসেছিলাম। সেটা ছিল টোলেমাইস নগরের একটা হলঘর। সেটাতে ঢোকার পথ একটাই। পিতলের উঁচু আর চওড়া একমাত্র দরজার কথা বলছি। এটা ছাড়া হলঘরটায় ঢোকার আর দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না।
কারিনোস নামক এক মিস্ত্রি দরজাটার নির্মাতা। এমন অত্যাশ্চর্য কৌশলে দরজাটা নির্মাণ করা হয়েছিল যে, সেটাকে কেবলমাত্র বন্ধ করা সম্ভব।
হলঘরটায় আলো-আঁধারী বিরাজ করত। তার দরজায় ঝোলানো একটা কালো পর্দা আকাশ, তারা, চাঁদ আর জনমানবশূন্য রাস্তাঘাটকে সর্বদা আড়ালে রাখত। সবকিছুকে আড়ালে আবডালে রাখলেও অশুভের পূর্বাভাষ আর অতীত স্মৃতিকে আড়াল করে রাখা সম্ভব হয়নি।
এমনকিছু বাস্তব আর অবাস্তব আমাদের চারদিকে বিরাজ করছিল যার কোনো স্পষ্ট বিবরণ আমার দেওয়া সম্ভব নয়। জগদ্দল পাথরের মতো ভারী একটা ভার যেন আমাদের মাথার ওপর ঝুলন্ত অবস্থায় বিরাজ করছিল। বিরাজ করছিল আমাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর। বিরাজ করছিল আমাদের আসবাবপত্র আর পানপাত্রগুলোর ওপর।
আর সে ভারের চাপ সহ্য করতে না পেরে, ভারের চাপে সবকিছু যেন নিচে নেমে আসছিল। সবকিছুর কথা বললাম বটে, কিন্তু কেবলমাত্র মাথার ওপরের ঝুলন্ত সাতটা লোহার বাতিদান যেখানে অবস্থান করছিল, সেখান থেকেই দীর্ঘ ও সরু আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়েনিস্তর-নিথরভাবে অনবরত জ্বলতে লাগল।
আমরা যে আবলুশ কাঠের টেবিলটায় বসেছিলাম, আলোর রেখাগুলো তার ওপর পতিত হয়ে যেন রীতিমত একটা আয়নায় রূপান্তরিত হল। তার সে আয়নাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আমরা সবাই নিজের নিজের মুখচ্ছবি আর সঙ্গিদের চঞ্চল চোখের মণি দেখতে পেলাম।
তবু আমরা গলা ছেড়ে হাসতে আরম্ভ করলাম আর উদ্ভট আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিলাম। আর গলা ছেড়ে অ্যানাক্ৰিয়নের যেসব গান ধরলাম, তাকে পাগলামি ছাড়া আর কী ই বা অ্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে? আর টকটকে লাল মদ রক্তের কথা মনে করিয়ে দিলেও আমরা সে মদ গিলে গিলে বুঁদ হয়ে গেলাম।
আমরা ছাড়া আরও একজন বাসিন্দা আমাদের ঘরে উপস্থিত ছিল। সে এক যুবক। তার নাম সৈলাস। সে টানটান হয়ে শুয়েছিল। আর তার মৃতদেহটা কফিনে মোড়া ছিল। তাকে বিশেষ দৃশ্যটার খলনায়ক ভাবা যেতে পারে।
উফ! কী অভাবনীয় কাণ্ড! আমাদের হৈ হট্টগোল, আনন্দ ফুর্তির মধ্যে নিজেকে কিছুতেই জড়ায়নি। কেবলমাত্র তার প্লেগরোগে বিকৃত মুখাবয়ব আর মৃত্যুর জন্য আধা-বিকৃত চোখ দুটোর দিকে নজর পড়ায় মনে হল, আমাদের আমোদ-উল্লাসে সে ঠিক ততটাই অংশগ্রহণ করেছে যতটা আগ্রহ একটা একজন মৃত ব্যক্তির পক্ষে দেখানো সম্ভব। আসন্ন মৃত্যু জনা কয়েকের আমোদ-আহ্লাদে।
আমি ওইনস বুঝতে পেরেছিলাম, খুবই সত্য বটে, মৃতের চোখ দুটো আমার দিকে স্থির নিবদ্ধ, তা সত্ত্বেও আমি না বোঝার ভান করলাম, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে বুঝেও কিছুই বুঝিনি এমন ভাব দেখাতে লাগলাম। আসলে আমি বুঝতেই চাইলাম না, বরং সামনের আবলুস কাঠের আয়নার গভীরে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলাম। পর মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় তার স্বরে গাইতে আরম্ভ করলাম। কোন গান–কোন গানের সুর? টিয়স-পুত্রের গানগুলো।
না, বেশিক্ষণ গান গাওয়া সম্ভব হলো না। কয়েকটা পংক্তি গাইতে না গাইতেই আমার গলা ক্রমে নেমে যেতে আরম্ভ করল। তারপর এক সময় গান না থামিয়ে পারলাম না।
গান থামিয়ে দিলেই কি গানের রেশটুকু পুরোপুরি মিলিয়ে গেল? না, অবশ্যই তা নয়। আমার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ঘরের লোমশ পর্দার গায়ে বাধা পেয়ে, পর্দার ওপর চক্কর খেতে খেতে ক্রমে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হতে হতে দূরে, বহু দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেল।
ব্যস। আবার একেবারে শুনশান, ঘরে যেন কবরখানার নীরবতা নেমে এলো।
আরে ব্যস! এ কী! এ কী অবিশ্বাস্য কাণ্ডরে বাবা! যে লোমশ পর্দাটার গায়ে বাধা পেয়ে আমার কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে গেল, সেখান থেকে একেবারে অবিশ্বাস্য উপায়ে একটা ছায়ামূর্তির আর্বিভাব ঘটল। তবে ছায়ামূর্তি স্পষ্ট তো নয়ই বরং খুবই অস্পষ্ট। আকাশের গায়ের ঝুলন্ত ধবধবে রূপালি চাঁদটা যখন পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসে তখন একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব মানুষের অবয়ব থেকে এমন একটা ছায়ামূৰ্ত্তি গড়ে তুলতে। সত্যি, একমাত্র চাঁদ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাতে। কিন্তু সে ছায়ামূর্তিটা কীসের? কোনো মানুষের কি? না, অবশ্যই নয়। তবে? তবে কি কোনো দেবতার ছায়ামূর্তি?
মানুষের নয়, দেবতার ছায়ামূর্তিও নয়, এমনকি কোনো পরিচিত কারোই নয়, আজব ব্যাপার তো!
যাক গে, সদ্য আবির্ভূত ছায়ামূর্তিটা কি করল? নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল কি? না, নিশ্চয়ই যদি থাকবে তবে আর মিছেমিছি আর্বিভূত হতেই বা যাবে কেন?
ছায়ামূর্তিটা কয়েকমুহূর্ত পর্দার আড়ালে থেকে নড়াচড়া করল। তারপর আচমকা পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে পিতলের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সেটা যেন থেকে থেকে এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরাতে লাগল।
কিন্তু অনুসন্ধিৎসু নজরে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না, ছায়ামূর্তিটা কীসের? না, মানুষের তো অবশ্যই নয়, গ্রীসের দেবতারও নয়। ফ্যালাডিয়ার দেবতার তো নয়। এমনকি মিশরের দেবতার ছায়মূর্তি নয়। তবে? না, কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব হলো না যে, ছায়ামূর্তিটা কীসের!
তবে? এ আশ্চর্য ব্যাপারই বটে। আর্বিভুত ছায়ামূর্তিটা কীসের? আবার চোখ দুটোকেও তো অবিশ্বাস করা যায় না। অস্পষ্ট, খুবই অস্পষ্ট হলেও সেটা সে একটা ছায়ামূর্তি এতে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই, থাকার কথাও নয়।
হ্যাঁ, ওই, ওই তো সে ছায়ামূর্তিটা দরজায় খিলানের তলায় দাঁড়িয়ে।
এবার সে দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় দাঁড়িয়ে একচুলও নড়াচড়া করছে না। ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতটুকুও নড়ল তো না-ই, এমনকি কথা বলা তো দূরের ব্যাপার টু-শব্দটিও করল না।
এখন আমার যেটুকু মনে আছে, অর্থাৎ ঝাপসা স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে বলতে পারি, দরজাটা ছিল তরুণ সৈলাসের শবদেহের, আচ্ছাদিত শবদেহের পায়ের কাছে।
আমরা যে সাতজন সেখানে উপস্থিত ছিলাম সবাই এমন একটা অভাবনীয়, রীতিমত অবিশ্বাস্য একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে ধরতে গেলে পৌনে মরা হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি কারোই চোখ মেলে বুক কাঁপানো ছায়ামুর্তিটার দিকে তাকানোর সাহসও হলো না।
ছায়ামূর্তিটার দিকে কিছুতেই তাকাতে না পেরে শেষপর্যন্ত আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত চোখে আবলুস কাঠের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপর একসময় ওইনসই, আমি গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিসিয়ে দুএকটা কথা বললাম।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় কোনো রকমে ছায়ামূর্তিটার নাম-ধাম জানতে চাইলাম।
আমাদের কথার জবাব না দিয়ে ছায়ামূর্তিটা আগের মতোই দরজায় হেলান দিয়ে নীরবে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েই রইল।
আমি সাহসে ভর করে অপেক্ষাকৃত গলা চড়িয়ে এবার ছায়ামূর্তিটাকে বললাম– ‘তোমার নাম কী হে? কোথায় থাক, মানে তোমার ঠিকানা কী?
ছায়ামূর্তিটা ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল–‘আমার নাম-টাম নেই, একটা ছায়ামূর্তি। ব্যস, এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাক।
‘সে না হয় হল। কিন্তু তোমার ঠিকানা তো একটা না একটা আছেই। তোমার ঠিকানাটা?’
‘ময়লা পানির খাল–ফেরোলিয়াম খালের নাম শুনেছ কী?
‘হ্যাঁ, তা শুনেছি বটে।
‘সে খালের তীরবর্তী হেলুসিয়ন প্রান্তরের কাছাকাছি টোলেমাইস নামক সমাধিক্ষেত্র আছে, জান নিশ্চয়?
‘তা-ও জানি বটে।
‘সে সমাধিক্ষেত্রটাই আমার ঠিকানা, মানে সেখানেই আমি থাকি।’
ছায়ামূর্তিটার কথা কানে যেতেই আমরা সবাই এক সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে তড়াক্ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাকে সর্বাঙ্গ বলি প্রদত্ত পশুর মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল।
আমি এও স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম, ছায়ামূর্তিটার কণ্ঠস্বর কোনো একজন মানুষ বা অন্য কোনো জীবের কণ্ঠস্বর অবশ্যই নয়। অসংখ্য মানুষ যেন সমস্বরে, বিচিত্র সুরে কথাগুলো বলল। হাজার হাজার পরলোকগত বন্ধু যেন তাদের বিস্মৃত কণ্ঠস্বরে কথাগুলো আওড়ে গেল।