শ্মশানবিলের ভূতগাছ
ছেলেবেলায় আমাদের আকন্দডিহি গ্রামের মাঝখান দিয়ে বা গ্রামের পাশ দিয়ে গাড়িঘোড়ার একটাও রাস্তা ছিল না। তাই ছোটোদের গাড়িঘোড়া চাপা পড়ার ভয়ও ছিল না। বাঘ, সিংহ, হাতিরও ভয় ছিল না। কেননা, আমাদের গ্রামের একশো মাইলের মধ্যে কোনো জঙ্গলও ছিল না।
জঙ্গল বলতে সেই কোন দূরে সুন্দরবন। একদিন আর একরাত্রি নৌকোয় করে গেলে তবে নাকি সুন্দরবন যাওয়া যেত। তিনটে ছোটো-বড়ো নদী পেরোতে হত। একটা নদীর মোহনা পেরোতে হত। তার নাম সাততলার মুখ। ওখানে নাকি সাতটা নদীর মুখ এসে মিশেছে। সেই সাত নদীমুখো মোহনার জলে নাকি তুমুল ঢেউ। ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’ প্রবাদ বাক্য ওখানেই নাকি সার্থক। নৌকোর চারপাশে কুমির হাঁ করে ঘুরছে। জলে নামলেই কখন হাঙর পা কেটে নিয়ে যাবে টেরই পাওয়া যাবে না। জল থেকে উঠলে দেখা যেত একটা পা নেই। আর ডাঙায়? ডাঙায় নামলেই বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। এসব কথা চন্ডীতলার আটচালার নীচে বসে সন্ধ্যে বেলা আমাদের গ্রামের দাদু-ঠাকুরমার মুখ থেকে শোনা।
তবে ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামে ছোটোদের জন্যে একটা গোটা ভয় নয়, আধখানা ভয়ের খুব চল ছিল। সেটা হল ছেলেধরার ভয়। আমরা যখন ছোটো ছিলাম, সকলেই ছেলেধরার ভয়ে কাঁপতাম। এ ভয়টা বড়োরাই চাউর করে দিতেন। ছেলেধরারা গ্রামে পট দেখিয়ে নাকি রামায়ণ-মহাভারতের গল্পকে গান করে শোনাতে আসত। মা-ঠাকুরমার দল গোল হয়ে বসে সেসব পটের ছবি দেখতেন। সীতাহরণ, সীতার পাতাল প্রবেশ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, অভিমন্যু বধের গল্পের গান শুনতে শুনতে তাঁদের চোখের কোল বেয়ে নেমে আসত অশ্রুর ধারা। সেই সুযোগে পটুয়ারা গানের সুরে চাল চাইত, কাপড় চাইত। এমনকী আলু-বেগুন চাইতেও দ্বিধা করত না। তারপর মা-ঠাকুমা ওসব আনতে যখন বাড়ির মধ্যে যেতেন, তখন নাকি তারা পলক ফেলার সময়টুকুতেই পুটুস করে একদম ছোটো ছেলে-মেয়েকে ধরে অজ্ঞান করে পট রাখার সেই বড়ো ঝোলার মধ্যে ভরে ফেলত। তারপর শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিত।
আবার এও শুনতাম, একটু বেশি রোগা ছেলে-মেয়ে পেলে তাদের নিয়ে গিয়ে একটা বড়ো লোহার কলসির মধ্যে ভরে রেখে দিত বেশ কয়েক মাস। শুধু মুখটা বেরিয়ে থাকত। ওভাবেই খাবার খাওয়াত তারা। তারপর অনেক দিন পরে যখন তাদের সেই লোহার কলসি থেকে বের করত, তখন তারা নাকি পঙ্গু হয়ে যেত। তারপর তাদের শহরের রাস্তার ফুটপাথে বসিয়ে রাখত। লোকে অমন পঙ্গু ছেলে-মেয়েকে দেখে ভিক্ষে দিত। সেসব ভিক্ষের পয়সা দালালরা এসে সব নিয়ে যেত। বিনিময়ে ওই ছেলে-মেয়েদের শুধু খেতে দিত।
আমরা কেউ কখনো পটুয়ার ছদ্মবেশে ঘুরে-বেড়ানো একজনও ছেলেধরা চোখে দেখিনি কোনোদিন। বড়োরাও কেউ কোনোদিন দেখেছেন কি না তাও জানা যায়নি। তবে আমরা গ্রামে অচেনা কোনো লোককে দেখলে খুব সতর্ক হয়ে যেতাম। পারলে তাকে এড়িয়ে চলতাম। যদি ভয় পেতাম, তা হলে একছুটে বাড়ি চলে আসতাম।
তবে সুযোগ পেলে আমাদের চেয়ে ছোটোদের ছেলেধরার ভয় দেখিয়ে আমরা যে কাঁচা আম বা পাকা তেঁতুলের ভাগ আদায় করিনি কোনোদিন, তা নয়।
অনেক পরে জেনেছিলাম, বড়োরা ছেলেধরার ভয় দেখিয়ে আমাদের অচেনা লোক থেকে সতর্ক হতে শেখাতেন।
তবে আমাদের গ্রামে ছোটোদের মনের মধ্যে যে ভয়টা পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে চেপে বসেছিল, তা হল ভূতের ভয়। ভূতের ভয়ে আমরা সন্ধ্যে হওয়ার আগে-আগে খেলার আসর ফেলে বাড়ি ফিরে আসতাম। যদি কোনোদিন একটুখানি দেরি হয়ে যেত, তখন ভূতের ভয়ে সতেরোর নামতা মুখস্থ বলতে বলতে দৌড় লাগাতাম। এই কথা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন নিবারণ জ্যাঠা। তিনি বলতেন, ‘অন্ধকারে ভূতের ভয় পেলে সতেরোর বা তেরোর নামতা মুখস্থ বলতে থাকবি। দেখবি, ভূত কোথায় পালিয়ে যাবে!’
আমরা বলতাম, ‘কেন, তেরো বা সতেরোর নামতা বললে ভূত পালিয়ে যাবে কেন?’
নিবারণ জ্যাঠা বলতেন, ‘ওই দুটো কঠিন নামতা ভূতরা যে একদম পারে না রে! তাই!’
ভূতেরা নামতা পারুক আর না-ই পারুক, আমরা পারলে অঙ্ক করতে যে খুব সুবিধে হয়, তাতে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমাদেরও ছিল না। শুধু নামতাই নয়, ইশকুলের দু-পাতা হাতের লেখা কখনো ফেলে রাখতাম না। অঙ্ক যথাসম্ভব বেশি করার চেষ্টা করতাম। সবচেয়ে বড়ো কথা, কখনো মিথ্যে কথা বলতাম না। বড়োরা বলতেন, ‘মিথ্যে বললে নাকি ভূত সবচেয়ে বেশি অখুশি হয়।’
এমনও দেখতাম, বড়োরাও কেউ কেউ ভূতের ভয় পেতেন খুবই। তাঁদের দেখাদেখি ভূতের ভয়টা আমাদের মনের মধ্যেও চেপে বসে থাকত।
এখন তো একটু বড়ো হয়েছি। হাতেনাতে প্রমাণ না পেলে কোনো কিছু ঠিকঠাক মেনে নিতে মন চায় না। তাই সুযোগ পেলেই ভূত সত্যি আছে কি না, তার প্রমাণ খুঁজে বেড়ায়।
আমাদের ক্লাস সেভেনের পরীক্ষা শেষ। আমি, পুলিন আর ব্রজেন, আমরা অলায়গলায় তিন বন্ধু। যেখানেই যাই, আমরা একসঙ্গে যাই। একদিন ঠিক করলাম, আমরা শ্মশানবিলের জলে যকের ভূত আছে কি না দেখতে যাব। এও শুনেছি, সেই যক নাকি জলের নীচে সোনার মোহরভরা সাতটা ঘড়া পাহারা দিয়ে বেড়ায়। ভিতু ছেলেদেরকে যক করে নিজের পাহারার কাজে লাগায়। আমরা তিনজন কেউ ভিতু নই, একথা হলপ করে বলতে পারি। তা ছাড়া যকের সোনার মোহরভরা ঘড়া পাহারা দেওয়ার আমাদের কারও ইচ্ছেই নেই।
বেরোব বেরোব করে শেষমেষ আমরা যখন বেরোলাম, তখন বিকেল গড়িয়ে পড়েছে দিগন্তের পিঠে। রোদও কমে এসেছে। শ্মশানবিল আসলে একটা মস্ত বড়োপুকুর। আমাদের গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূর। তার চারপাশের পাড়ে বড়ো বড়ো খিরীষ, আকাশমণি আর মহানিমের গাছ। তার ফাঁকে দু-তিনটে রাধাচূড়া আর জারুল গাছও আকাশে মাথা তুলে রামধনু দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই কবে থেকে। কিন্তু সেই বিলের কাছে-দূরে কোথাও শ্মশানের চিহ্নমাত্র নেই। তবু তার এরকম নাম কেন, বড়োদের জিজ্ঞেস করেও আমরা সদুত্তর পাইনি।
শ্মশানবিলের কাছে যেতেই দেখলাম, দূরে একটা ছায়া মতো কিছু সরে গেল যেন। আমি বললাম, ‘ওই দ্যাখ, দূরে কেউ আমাদের দেখতে পেয়ে গাছের আড়ালে সরে গেল যেন?’
পুলিন বলল, ‘অখিল, তোর যদি এত ভয়, তা হলে ভূত দেখতে আসার দরকারটাই বা কী?’
ব্রজেন বলল, ‘চুপ কর, চুপ কর। এক্ষুনি আমিও যেন কাউকে দেখলাম বলে মনে হল।’
অগত্যা পুলিনও চোখ চিরে দেখার চেষ্টা করল। অমন সময় আমি দেখলাম, একটা লোক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ভয়ের তরাস কাটিয়ে বললাম, ‘ও মা, ওই তো জগনদাদু আসছে!’
জগনদাদুর ভালো নাম জগন্নাথ দাস। বিয়েথা করেনি। সংসারে একলা মানুষ। সারাদিন গাছেপালায়, আদাড়েবাদাড়ে ঘুরে-বেড়ায়। কী খায়, কখন কোথায় থাকে, কোথায় যায়, তার হদিশ রাখা বড়োদের পক্ষেই কঠিন। আমরা তো কোন ছার! এই লোকটা সত্যিই জগনদাদু তো?
তবে আমরা যে শুনেছিলাম, জগনদাদু বেশ কিছুদিন হল বেপাত্তা হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের কেউ বলেছিল, কোনো না কোনো ভিন গাঁয়ে সিঁধেলচুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন পুলিশের খপ্পরে। কে একজন শহর থেকে ফিরে এসে আমাদের গ্রামে রটিয়েও দিয়েছিল, জগনদাদু নাকি এখন জেলে আছে। জেল ফেরত কোনো একটা চোর নাকি তাকে কথাটা বলেছে। জেলের ভিতর সেই চোরটার সঙ্গে নাকি দেখাও হয়েছে জগনদাদুর।
আবার কে একজন বলেছিল, জগনদাদুকে নাকি ভূতে কামড়েছে।
আমাদের গ্রাম থেকে গোটা পাঁচেক গ্রামের ওপাশে রঙ্গনডাঙা গ্রামের পরেশ সাঁতরার বউকে একদিন সন্ধ্যেরাতে তেঁতুল গাছ থেকে নেমে এসে একটা পেতনি ভর করেছিল। জগনদাদুর ডাক পড়েছিল। রঙ্গনডাঙায় যাওয়ার পথে আমাদের গ্রামের দু-একজনের সঙ্গে সেদিন নাকি দেখাও হয়েছিল জগনদাদুর। তারপর আজ প্রায় মাস তিনেক হতে চলল, আমাদের গ্রামের আর কেউ জগনদাদুকে দেখেনি। কেউ কেউ বলে পরেশ সাঁতরার বউকে ভর করা সেই পেতনিটার কামড় খেয়েই নাকি মারা গেছে জগনদাদু। তা হলে এখন আমরা যাকে দেখছি, এই লোকটা কে?
জগনদাদুকে নিয়ে আমাদের গ্রামে নানারকম গুজব ছড়িয়েছিল। সেটা হওয়ার একটাই কারণ, জগনদাদু গ্রামের কারও সঙ্গে বিশেষ একটা মেলামেশা করত না। গ্রামের একদম একটেরে জায়গায় তালপাতায় ছাওয়া তার একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর ছিল। সেখানেই আপন মনে থাকত জগনদাদু। লোকে বলত, ভূত-প্রেত নিয়ে যাদের কর্মকান্ড, তারা নাকি এরকমেরই হয়। কারও সঙ্গে মেশে না। লোকজনের সঙ্গে মিশলে নাকি ভূতেরা আর বিশ্বাস করতে চায় না। ছোটো বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে অনেক মা-ই জগনদাদুর নাম বলে ভয় দেখাত। বাচ্চারা জগনদাদুর নাম শুনলেই চটপট ঘুমিয়েও পড়ত। জগনদাদুকে নিয়ে এরকম অনেক গল্পই ছড়িয়েছিল আমাদের গ্রামে।
কেউ বলে জগনদাদু নাকি সিঁধেল চোর। হাতে টাকাপয়সার টান পড়লে জ্যোৎস্না রাত দেখে চুরি করতে বেরোত। একবার এক পূর্ণিমা রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। লোকে তো আঁধার রাত দেখে চুরি করতে বেরোয়। জগনদাদু জ্যোৎস্না রাতে বেরোয় কেন? ধরা পড়ার পর জনতার এই প্রশ্নের উত্তরে জগনদাদু নাকি বলেছিল, ‘জ্যোৎস্না রাতে চারদিক ভালো করে দেখা যায় তো! জোছনায় মনটা ফুরফুর করে। চুরি করতে মন লাগে গো।’
সেসব নাকি অনেক দিন আগের কথা। আমাদের জন্মেরও আগে। সত্যি, না গুজব, এখন আর কেউ সঠিক করে বলতে পারে না। আবার কেউ বলে, জগনদাদু নাকি মন্ত্রতন্ত্র জানে। ভূতের সঙ্গে কথা বলে। অমাবস্যা রাতে শ্মশান জাগায়।
শ্মশান জাগানো কী জিনিস জানতে আমরা একদিন জগনদাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘জগনদাদু, তুমি নাকি শ্মশান জাগাও? সেটা কীরকম গো?’
জগনদাদু হেসে বলেছিল, ‘সে তোরা আর একটু বড়ো হ। তখন একদিন শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তোদের দেখিয়ে আনব।’
আমরা বলেছিলাম, ‘ওসব শ্মশান-মশান জাগাও কেন? তাতে কি তোমার টাকাপয়সা রোজগার হয়?’
জগনদাদুর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠেছিল, ‘ধুর, টাকায় কি আর সব হয় রে? ওসব হল গে নেশা।’
আমরা অবশ্য কোনোদিন জগনদাদুর সঙ্গে শ্মশানে যাওয়ার সাহস দেখাইনি। তবে জগনদাদুর কথা শুনে মনে একটা বিশ্বাস হয়েছিল, ভূতটূত নিয়ে জগনদাদু কিছু একটা জানে।
শ্মশানবিলের ধারে আমাদের দেখে জগনদাদু বলল, ‘তোরা এখানে কেন রে? তোদের জ্বালায় যে দু-একটা পুঁচকে ভূত নামাব, তারও উপায় নেই। সেই কবে থেকে একটা পুঁচকে ভূত খুঁজে বেড়াচ্ছি। একটা লোক চেয়েছে। অনেক দিন পর আজ একটা পুঁচকে ভূত পেয়েছি! যা, তোরা এখান থেকে পালা তো।’
আমি বললাম, ‘আমরা তো শ্মশানবিলের জলের যকের ভূত দেখব বলে এসেছি।’
জগনদাদু তুড়ি মারার মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘তোরা দেখবি ভূত? শ্মশানবিলের জলে? যকের ভূত? তোদের সে সাহস আছে?’
আমি বললাম, ‘ভূত দেখার জন্যে সাহস লাগে নাকি?’
তক্ষুনি মাথার ঝাঁকড়া চুল ডান দিকে ঘুরিয়ে, বাঁহাত শূন্যে তুলে তর্জনী দিয়ে আকাশে ইড়িংবিড়িং দাগ কেটে বলল, ‘ফুস, ফুস, ফুসন্তি!’
পুলিন জিজ্ঞেস করল, ‘ওসব কী করলে গো দাদু? ভূতের ঘরের দরজায় দাগ কেটে দিলে? একেই কি ভূতকে দুয়ো দেওয়া বলে?’
পুলিনের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, সামনের মহানিমের গাছের মাথাটা ধুলো-ঝড়ের মতো পাক খেয়ে উঠল। আর কোথাও কিচ্ছু নেই। শুধু মহানিমের গাছের মাথায় কালবৈশাখীর ঘূর্ণিঝড় উঠল যেন।
আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি দেখে জগনদাদু ফের মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলোকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে, ডান হাত তুলে শূন্যে কনিষ্ঠা আঙুলে আকাশে হ্যাস কাটল। মুখে বিকট জোরে একটা শব্দ করল, ‘ভুস, ভুস, ভুসন্তি!’
ও মা, সত্যি তো! কোথায় গেল ঘূর্ণি আর কোথায় গেল ধুলো-ঝড়। সব ভোঁ ভোঁ। একদম শান্ত। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।
ভয় কাটানোর জন্যে চোখে গুঁড়ো পড়েছে, এমন ভান করে দু-হাতে চোখ কচলে সত্যি ভয় কাটালাম। তারপর আমি বললাম, ‘বাব্বা:! কোত্থেকে এমন ঝড় এসে হাজির হল রে বাবা! ও ঝড় কেন দেখালে গো দাদু? আমরা কি ঘূর্ণি-ধুলোঝড় এর আগে দেখিনি নাকি? এই তো বছর দুয়েক আগে ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শিবদুর্গা মাঠে এসেছি কি আসিনি, এর চেয়েও বেশি ঘূর্ণিঝড় উঠল। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে আমরা দু-চোখ অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
জগনদাদু মুচকি হেসে বলল, ‘সে-ঝড়ও তো আমিই তোদের ভয় দেখানোর জন্যে পাঠিয়েছিলাম।’
ব্রজেন বলল, ‘কই, সেদিন তো আমরা কেউ ভয় পাইনি?’
পুলিন বলল, ‘ঝড় কি ভয় পাওয়ার জিনিস যে, ভয় পাব?’
হঠাৎ জগনদাদুর চোখ দুটো আমড়া আমড়া হয়ে গেল। টকটকে লাল। মুখ দিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস পড়তে লাগল, যেন একটা ছোটোখাটো ঝড় উঠেছে। জগনদাদুর এসব কান্ড দেখে আমরা তিনজন যে একটুও ভয় পাইনি তা নয়। তবু, ভয় না পাওয়ার ভান করলাম। বেশ একটা সাহস দেখানোর চেষ্টা করলাম বুক উঁচিয়ে।
তারপর আমাদের সামনে থেকে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল জগনদাদু। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, জগনদাদু কোথাও নেই।
পুলিন বলল, ‘জানিস তো, জগনদাদু ভেবেছিল, আমরা ভয় পেয়ে যাব। কিন্তু যখন মোটেও ভয় পেলাম না, তখন নিজেই লজ্জায় পালিয়েছে।’
আমাদের তাক লাগিয়ে তক্ষুনি জগনদাদু শ্মশানবিলের পশ্চিম পাড় থেকে বলল, ‘অ্যাই, তোরা এদিকে আয়। তোরা শ্মশানবিলের জলের যকের ভূত দেখবি যে?’
এবার আমরা তিনজনেই যেন সত্যি সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ব্রজেন চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি তোমার কাজে যাও তো জগনদাদু। আমরা ভূত দেখতে এসেছি, আমাদের একা একা ভূত দেখতে দাও।’
হঠাৎ দেখি জগনদাদু একদম আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনেই বেশ চমকে গেলাম। বিলের ও পাড় থেকে কী করে এক মুহূর্তে, চোখের পলক না ফেলতেই এ পাড়ে আমাদের পাশে আসা সম্ভব?
জগনদাদু আমার হাতের কবজিটা ধরে ফেলল খপ করে। উঃ! কী পাথরের মতো জোর জগনদাদুর হাতে! পুলিন আর ব্রজেন পালাবে কি না ভাবছে যখন, ওরা তখন আবিষ্কার করল, ওদের পাগুলো যেন গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়েও নাড়াতে পারছে না। সব যেন এক-একটা পাথরের তৈরি থাম। তার মানে কি আমাদের নজরবন্দি করে ফেলল জগনদাদু? শুনেছি, কাউকে ভূতে ধরলে, যারা তুকতাক জানে, তারা নাকি মন্ত্র পড়ে ভূতকে প্রথমে এরকম নজরবন্দি করে ফ্যালে।
জগনদাদুর চোখ এড়িয়ে আমি একবার আমার পা দুটো নাড়াতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। যেন আমার পায়ে লম্বা শিকড় গজিয়ে গেছে মাটির অনেক নীচ পর্যন্ত। গাঁইতি দিয়ে গর্ত না করলে আমার পায়ের শিকড় মাটির গভীর থেকে তোলা যাবে না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, জগনদাদু মন্ত্রতন্ত্রের সঙ্গে এক ফাঁকে ম্যাজিকটাও শিখে নিয়েছে। ম্যাজিক না শিখলে এসব সম্ভব নাকি? মুখে কিছু বলতে পারলাম না, পাছে জগনদাদু শুনে ফ্যালে।
জগনদাদু খিলখিল করে হেসে বলল, ‘যা, তোরা তোদের মতো করে শ্মশানবিলের জলের যকের ভূত দ্যাখ গে যা। আমার হাতে এখন অনেক কাজ।’
আমরা ভূত দেখব কী, নিজেরাই তো নড়তে পারছি না। এমন হলে বাড়ি যাব কী করে? আঁধার হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘জগনদাদু, তুমি তোমার মতো করে ভূত নামাও। আমাদের এবার বাড়ি যেতে দাও।’
জগনদাদু চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বাড়ি? যাবি? যা। কে তোদের আটকে রেখেছে?’
পুলিন বলল, ‘আটকে তো তুমিই রেখেছ গো জগনদাদু। আমরাও বড়ো হয়ে, বিজ্ঞান পড়ে এমন সব কান্ড শিখে ফেলব, তখন তুমিও হাঁ হয়ে যাবে। এখন আমাদের বাড়ি যেতে দাও।’
এবার জগনদাদু হা হা করে হাসল প্রায় মিনিট খানেক। তারপর সে হাসি খিকখিকে হাসির স্তরে নেমে এল। সেও চলল প্রায় আরও মিনিট খানেক। তারপর বলল, ‘চল, তোদের ভূত দেখাই। তোরা শ্মশানবিলের জলের যকের ভূত দেখবি যে?’
আমরা তিনজনে একসঙ্গে বললাম, ‘সে তুমি একদিন আমাদের ডেকো, তখন এসে দেখে যাব। এখন আমরা চলে যাব। এক্ষুনি তো সন্ধ্যে নেমে আসবে। বাড়ি ফিরতে হবে। বাড়িতে গিয়ে ক্লাস এইটের দশটা অঙ্ক কষতে হবে। এখন থেকে নতুন ক্লাসের অঙ্ক প্র্যাকটিস না করলে ফেল বাঁধা।’
জগনদাদু নাছোড় ভঙ্গিতে দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘না না, তা হয় নাকি? ভূত দেখতে এসে, না দেখে চলে যাওয়া, সে তো ভূতেরও অপমান। তারপর তোদের মুখের কথা শুনে লোকে বলে বেড়াবে, সত্যিই ভূত বলে কিছুই নেই।’
আমি বললাম, ‘না গো জগনদাদু, আমরা ভূতের কথা চিরদিন প্রচার করব। তোমার কথাও প্রচার করব যেখানে সুযোগ পাব। কে বলেছে ভূত নেই? ভূত না থাকলে…তুমি আমাদের ছেড়ে দাও দাদু!’
তবু জগনদাদু তেমনই নাছোড় ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল। ব্রজেন একবার যেন ছুটে পালাবার চেষ্টা করল, পারল না। আমার হাতটা তেমনই জগনদাদুর হাতের মুঠোর চাপে গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একবার আমাদের ইশকুলের মাঠে ম্যাজিশিয়ান বিমলকুমার ম্যাজিক দেখাতে এসেছিল। হাতের ইশারা করে আমাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি বাড়ি যেতে চাও?’
আমি মুখ থেকে শুধু বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ!’
তখন বিমলকুমার বলেছিল, ‘যাও, বাড়ি চলে যাও!’
আমি অনেক চেষ্টা করেও পা নাড়াতে পারছিলাম না।
তারপর ম্যাজিশিয়ান বলেছিল, ‘যাও। দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাড়ি যাবে না?’
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিলাম, ‘যাব কী করে? পা যে নড়ছে না একটুও।’
তখন ম্যাজিশিয়ান হা হা করে হেসে বলেছিল, ‘আমি কি তোমাকে বেঁধে রেখেছি নাকি? যাও!’
তারপর হঠাৎ দেখলাম, আমার পা আর কোনো কিছুতেই আটকে নেই। আমি গটগট করে হেঁটে সোজা বাড়ি চলে এসেছিলাম। সেদিন আর একটাও ম্যাজিক দেখার চেষ্টা করিনি। এখন যেন তেমনই কান্ড ঘটছে ব্রজেন আর পুলিনের মধ্যে।
আর আমার হাতটা যেন কোনো পাথরের মূর্তির হাতের মধ্যে আটকে আছে। হঠাৎ দেখলাম, জগনদাদু কোথায় যেন চলে গেল। মানে, যেন হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে গেল। কিন্তু আমরা যে যে-অবস্থায় ছিলাম, সেই অবস্থায় আটকে থাকলাম।
পুলিন ফিসফিস করে বলল, ‘অখিল, চল, এবার পালাই।’
ব্রজেন হতাশ গলায় বলল, ‘আজ আমরা বোধ হয় বাড়ি ফিরতে পারব না রে। জগনদাদুর হাত থেকে রেহাই পাব বলে মনে হয় না।’
পুলিন বলল, ‘দ্যাখ, অত ভয় পাস না। জগনদাদু তো আর কাপালিক বা নরখাদক নয় যে আমাদের…?’
আমি পুলিনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, লোকটা কি সত্যিই ভূত নামাতে পারে? যদি আমাদের ভূত বানিয়ে রেখে দেয় এই শ্মশানবিলের জলে? লোকে যে বলে, জগনদাদু ভূতের সঙ্গে কথা বলে, এসব কথা কি সত্যি?’
সত্যি-মিথ্যে যাই হোক, তক্ষুনি জগনদাদু কোথা থেকে যেন দৌড়োতে-দৌড়োতে ফিরে এল। এসেই বলল, ‘চল, চল। ক-দিন হল শ্মশানবিলের জলের যকের ভূতটাকে কবজা করেছি। তোরা দেখবি চল।’
আমি বললাম, ‘দাদু, আজ আর ভূত দেখে কাজ নেই। তুমি আমাদের বাড়ি যেতে দাও। সকাল বেলা যে অঙ্ক দুটো পারিনি, বাড়ি ফিরে গিয়ে সে দুটো করতে হবে তো!’
‘না না, বেশি দেরি হবে না রে। তোদের ভূতটাকে দেখিয়েই ছেড়ে দেব। তোরা তো ভূতে বিশ্বাস করিস না।’ মুখটা একটু করুণ করে কথাগুলো বলল জগনদাদু।
তারপর হনহন করে এগিয়ে চলল শ্মশানবিলের দক্ষিণ পাড়ের দিকে। চারপাশে বাবলা, খিরীষ, মহানিম আর আকাশমণি গাছের জঙ্গল। তারই কয়েকটা গাছে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠেছে স্বর্ণলতিকার গাছ। আরও কী সব লতা ওইসব বড়ো বড়ো গাছের ডালে-পাতায় এমন সংসার পেতেছে যে, দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে একটা সবুজের চাঁদোয়া কেউ টাঙিয়ে রেখেছে।
আমরা তিনজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো জগনদাদুর পিছন পিছন চলেছি। পুলিন একবার বাড়ির দিকে ছোটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল বলে মনে হল। আমি আর ব্রজেন সে-চেষ্টা করলামই না। মনে হল, ও চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। আমরা এখন জগনদাদুর হাতের পুতুল। জগনদাদু যা করতে বলবে, এখন আমাদের তা-ই করতে হবে।
একটা জায়গায় গিয়ে জগনদাদু থামল। ঝুপ ঝুপ করে আঁধার নেমে আসছে শীতের কুয়াশার মতো। দেখতে দেখতে পুবের আকাশ জুড়ে গাছপাতার আড়ালে মুখ তুলছে একটা গোল চাঁদ। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো জগনদাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা ঝাঁকড়া গাছের লম্বা ছায়াকে ফাঁকি দিয়ে এক চিলতে জ্যোৎস্না পড়েছে শ্মশানবিলের কালো জলে। জগনদাদু আমাদের বলল, ‘ওই দ্যাখ।’ বলে জলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।
আমি দেখলাম, জগনদাদুর হাতটা অসম্ভব রকম লম্বা। কোনো মানুষের হাত কি অত লম্বা হতে পারে? মহাভারতের কোনো একটা চরিত্রের হাত নাকি অনেকটা লম্বা ছিল। তার ওই হাতকে বলা হয় ‘আজানুলম্বিত বাহু’। একথা বাংলার ক্লাসে একদিন স্যার বলেছিলেন। ভয়ের চোটে মহাভারতের সেই চরিত্রের নামটা এখন একদম মনেই করতে পারলাম না। পুলিন আর ব্রজেনের কি চোখে পড়ল জগনদাদুর হাতের ব্যাপারটা?
আমি দেখলাম, কাচের মতো শ্মশানবিলের পরিষ্কার জলে চাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না? একবার মনে হল, পুলিন আর ব্রজেন কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? ওদের মুখের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে ভালো করে ওদের মুখটাই দেখতে পেলাম না।
জগনদাদু বলল, ‘আরে, তোরা দেখতে পাচ্ছিস না? ওই তো, জলের নীচে। একটা লোক। হামাগুড়ি দিয়ে আগলে রেখেছে সাত-সাতটা বড়ো জালা। ওই তো। ওগুলো সব সোনার মোহরে ভরতি।’
এই ঘন অন্ধকারেও জগনদাদুর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। আমরা কিন্তু যখন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, অঙ্কের ক্লাসে একটা সহজ অঙ্ক বুঝতে না পারলে যেমন করে অঙ্কস্যার গলা চড়িয়ে বকতে থাকেন, অমন করে জগনদাদু প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আরে ওই তো, ঝিম কালো লোকটা জলের নীচে ঘুরে-বেড়াচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে। ওই তো!’
জগনদাদুর কথা সত্যি যদি হয়ও, কিন্তু জলের মধ্যে একটা লোক হামাগুড়ি দেবে কী করে? আমি যখন কিছু ভেবেই পাচ্ছি না, হঠাৎ ব্রজেন শ্মশানবিলের জলের দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওই তো লোকটা!’
ব্রজেনের কথা শুনে হঠাৎ আমারও যেন মনে হতে লাগল, একটা লোক জলের নীচে তরতর করে সরে যাচ্ছে শ্মশানবিলের মাঝখানের দিকে। লোকটার পিছন পিছন ভেসে যাচ্ছে কয়েকটা বড়ো মাটির জালা। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের পলক না ফেলতেই।
জগনদাদু গর্বের হাসি হেসে বলে উঠল, ‘হল তো তোদের ভূত দেখা? যা, এবার সব বাড়ি যা। আর ভূত দেখে কাজ নেই। বাড়ি গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া কর গে যা।’
আমরা অনেকটা অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে জগনদাদু বলল, ‘তোরা তিনজনেই তখন অঙ্ক নিয়ে কী যেন বলছিলি?’
আমি বিস্ময়ভরা চোখে তাকালাম জগনদাদুর দিকে। অন্ধকারে জগনদাদুর মুখটাই দেখতে পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম, লেখাপড়া জানে বলে তো কক্ষনো শুনিনি। তা হলে অঙ্ক নিয়ে কথা বলছে যে বড়ো?
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বাড়ি গিয়ে ক্লাস এইটের অঙ্ক প্র্যাকটিস করতে হবে তো।’
জগনদাদু বলল, ‘তোদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, অঙ্কে তোরা তিনজনেই বেশ কাঁচা। অঙ্কে তোদের খুব ভয়। তাই তো?’
পুলিন বলল, ‘না, মানে তেমন ভয় নয়। ওই আর কী। নতুন ক্লাসে ওঠার আগে একটু প্র্যাকটিস করে রাখলে সুবিধে হবে, এই আর কী!’
জগনদাদু ফের শ্মশানবিলের জঙ্গল কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন হা হা করে। আমাদের গ্রামে ‘শাহজাহান’ যাত্রাপালা হয়েছিল গতবার শীতে। তাতে অমন করে হেসেছিল ঔরঙ্গজেব।
তারপর জগনদাদু বলল, ‘চল, তোদের আর একটা জিনিস দেখাই।’
এমনিই আমরা তিনজনেই ভয়ে ঘামছি। আর নতুন করে ভূত দেখে কাজ নেই। আমি বললাম, ‘না দাদু, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। না হলে বকুনি খেতে হবে যে!’
জগনদাদুর গলাটা কেমন যেন মায়াময় হয়ে উঠল। বলল, ‘চল না। দেখবি, এবার থেকে কঠিন অঙ্ক কেমন করে জলের মতো সোজা হয়ে যায়!’
ফের যেন জগনদাদু আমাদের নজরবন্দি করে নিয়ে চলল শ্মশানবিলের পুব পাড়ের পাশের জঙ্গলের মধ্যে। অন্ধকারেও মনে হল, বেশ কিছুটা জায়গা কেউ যেন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে যত্ন করে। আর ওই পরিষ্কার জায়গাটার মাঝখানে গোটা দশেক ইউক্যালিপটাস গাছের মতো লম্বা গাছ যেন আকাশ ছুঁইছুঁই।
জগনদাদু একটা গাছের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘তুই বাঁদিকে যা চলে যা!’
ও মা, আমাদের দু-চোখ সত্যিই ছানাবড়া হয়ে গেল অবাক কান্ড দেখে। জগনদাদু যে গাছটার দিকে আঙুল তুলে নির্দেশ দিয়েছিল, সত্যিই সে গাছটা সুড়সুড় করে বাঁদিকে সরে গিয়ে একটা জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফের আর একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে জগনদাদু বলল, ‘তোর তো এদিকে থাকার কথা নয়। যা, তোর জায়গায় সরে যা!’
এ গাছটাও সত্যিই একটা জায়গায় সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এবার আমাদের অবাক করে দিয়ে জগনদাদু ওই লম্বা গাছগুলোর পাশের একটা একদম বেঁটে মতো গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গাছটা যেন সার্কাসের বামন জোকারদের মতো এইটুকু। তারপর জগনদাদু হাততালি দিয়ে বলল, ‘নাচ রে গাছুয়া, নাচ তো!’
ও মা, গাছটা সত্যি সত্যিই জগনদাদুর হাততালির সঙ্গে তালে তালে নাচতে লাগল। অমনি ব্রজেন মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আমি কোনো রকমে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলাম ব্রজেনকে। ওর মাথার পাশে বসতে গিয়ে পুলিনও ধপাস করে সটান মাটিতে শুয়ে পড়ল।
জগনদাদুর লম্বা হাত দুটো বেশ খানিকটা লম্বা হয়ে এগিয়ে গিয়ে আঁজলা করে শ্মশানবিল থেকে জল তুলে এনে ওদের চোখে ছিটিয়ে দিল।
আমি তখন ঠকঠক করে কাঁপছি কি না দেখার কেউ নেই। একটু পরে পুলিন উঠে বসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘অখিল, আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।’
ওর গলার স্বর শুনে ব্রজেনও উঠে বসল। আমরা অন্ধকারে গাছটার পাতাগুলো দেখতে কেমন, গাছে কুঁড়ি বা ফুল ফুটেছে কি না কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘দাদু, ওগুলো কি ভূতগাছ?’
জগনদাদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘না রে, না! দুর, গাছ আবার ভূত হয় নাকি? ওগুলো হল মনস্কামনা গাছ।’
ব্রজেন খুব ক্ষীণ গলায় বলে উঠল, ‘ও গাছ কী কাজে লাগে?’
জগনদাদু বলল, ‘প্রত্যেকটি গাছই কোনো-না-কোনো কাজে লাগে বই কী। তোরা এখানে চুপ করে বসে থাক। এক্ষুনি আসছি।’
বলে জগনদাদু জঙ্গল সরাতে সরাতে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। এক-একটা মুহূর্তকে এক-একটা ঘণ্টা বলে মনে হচ্ছিল। এমন সময় জগনদাদু ফিরে এল হাঁসফাঁস করতে করতে। আমরা অন্ধকারেও আবছা দেখলাম, জগনদাদুর হাতে তিনটে ছোটো ছোটো গাছের চারা।
এসে জগনদাদু বাঁহাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। তারপর আমাদের তিনজনকে বলল, ‘তোদের এই তিনটে গাছের চারা দিলাম। নিয়ে গিয়ে তোদের পড়ার ঘরের জানলার পাশে টবে লাগিয়ে দিবি। কোনোদিন কোনো কঠিন অঙ্ক না পারলে, রাতের বেলা উঠে গিয়ে এই গাছকে বলিস, তোদের চটপট অঙ্ক শিখিয়ে দেবে!’
আমরা তিনজন তিনটে গাছ যেই হাতে নিয়েছি, তাকিয়ে দেখি, জগনদাদু নেই। ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে অন্ধকারে কোনো রকমে শ্মশানবিলের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাড়ি ফিরে সেদিন তিনজনকেই খুব বকুনি খেতে হয়েছিল। পরদিন আমরা যত্ন করে প্রত্যেকের পড়ার ঘরের জানলার পাশে নতুন টবে গাছ তিনটে লাগিয়েছি। কাউকে বলিনি গাছ তিনটের কথা। তবে এখনও একদিনও আমরা কেউ মনস্কামনা গাছটাকে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাইনি, সত্যিই গাছটা অঙ্ক শিখিয়ে দিতে পারে কি না। কেননা, এখন সব অঙ্কই যে আমরা পটাপট করে ফেলছি!
সেদিন জগনদাদুর সঙ্গে যে আমাদের দেখা হয়েছিল শ্মশানবিলের জঙ্গলে, একথা আজও আমাদের আকন্দডিহি গ্রামের কেউ বিশ্বাসই করে না।