অধ্যায় ৯ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কান ফাটানো সনিক বুম, ব্যারেলের ডগায় আগুনের ঝলকানি, পোড়া করডাইটের গন্ধ আর কাঁধে তীব্র রিকয়েল।
গুলি লেগেছে কি-না দেখার সময় নেই, যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ঝটকা দিয়ে পাশে সরে গেলাম আমি আগে, কারণ গুলি মিস হয়ে থাকলে ঠিক এখনটাতেই হামলে পড়বে জানোয়ারটা। হাতদুটো কাঁপছে আমার, জানি, কিন্তু সেটাকে পাত্তা দেবার সময় এখন নয়, জামশেদ, চেম্বারে একটা গুলি এখনো আছে-পাশে সরতে সরতে বোল্টটা টানো তুমি। হ্যা, এইতো। হাত কাঁপছে? ব্যাপার না, পাত্তা দিও না। এবার কাঁধে রাইফেলটা তোলো আবার, রোদে ধাঁধানো চোখ নিয়েই দেখার চেষ্টা করো জানোয়ারটা কোথায়, তোমার প্রথম গুলিটা লেগেছে কি- না।
যে জায়গায় জানোয়ারটা লাফিয়ে এসে পড়বে ভেবেছিলাম, সেখানেই রাইফেলটা তাক করলাম আগে। নেই।
ঝট করে রাইফেল ঘোরালাম ঝোপের ফাঁকটার দিকে। এইমাত্র কি কোনোকিছুকে ঝোপঝাড় ভেঙে উল্টো দিকে দৌড়ে যেতে শুনলাম? নাকি সবটাই আমার কল্পনা? গুলির শব্দে ঝালাপালা কানে ভুল শুনছি না তো?
ঝোপের ফাঁকটা দিয়ে ট্রেইলের ভেতরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম দ্রুত। রাইফেল তৈরি, চোখ মাটির দিকে। ছায়ার ভেতরে চলে এসেছি, কম আলোর সাথে চোখ মানিয়ে নিচ্ছে দ্রুত।
কয়েক ফুট জায়গা খুঁজতেই চোখে পড়লো জিনিসটা। এক গুচ্ছ লোম। বাদামি- খয়েরি রং। আর তার পাশেই শুকনো পাতার ওপর পানের পিক ফেলার মত একটা দাগ।
রক্তের ছোপ।
জিনিসটাকে গুলি লাগাতে পেরেছি আমি।
শিপলু চলে এসেছে পেছন পেছন। লোমগুলো হাতে তুলে নিলো ও ঝুঁকে পড়ে। “মসৃণ, মিহি, দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা। কি মনে হয় রে, কিসের লোম?”
“রং দেখে মনে হচ্ছে শেয়ালের,” শিপলুর হাতের তালুতে রাখা লোমগুলোর দিকে একঝলক তাকিয়ে আবার সামনে চোখ রাখলাম আমি রাইফেলের সাইটের মধ্য দিয়ে। জানোয়ারটা ফিরবে এমন সম্ভাবনা নেই, জানি, তবু সাবধানের মার নেই। আশপাশের ঝোপক’টা জরিপ করছি তীক্ষ্ণ চোখে। হাত কাঁপছে আমার, তবু প্রাণপণে চেষ্টা করছি যাতে রাইফেলটা সোজা থাকে।
কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়লো না। বাতাসে মৃদু কাঁপছে কেবল কয়েকটা ঝোপ। গুলির শব্দে তল্লাটের সব পাখি গাছের ডাল ছেড়ে আকাশে পাখা মেলেছিল, এখন সেগুলো সাহস করে একটা দুটো করে ফিরতে শুরু করেছে, আর উত্তেজিত স্বরে কিচিরমিচির করে জানতে চাচ্ছে- “ঘটনা কি? কে কাকে গুলি করে? ব্যাপার কি?”
জানোয়ারটা পালিয়েছে নিশ্চিত হবার পরে রাইফেল নামিয়ে নিলাম আমি, কাঁধে ঝোলালাম স্ট্র্যাপে করে। ঘুরলাম তারপরে, গটগট করে সোজা হেটে গেলাম মফিজ দারোগার সামনে। তার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, কেবল দুইঞ্চি ফারাক থাকলো লোকটার ভুঁড়ির সাথে আমার পেটের। নাকের সাথে নাক প্রায় লাগিয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকালাম আমি ভষ্ম করা দৃষ্টিতে। “আমার কাজে নাক গলাতে আসার ফলটা কি হলো দেখলেন তো?” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি। “লাগাতে পারলাম না। আর তার পুরো দোষটাই আপনার। নেক্সট টাইম এরকম আর না হয় যেন। বোঝা গেল?” বলেই ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে আবার ফেরত গেলাম ট্রেইলের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব মফিজ দারোগা কাতল মাছের মত মুখটা কয়েকবার খোলা-বন্ধ করলো কেবল, কোনো শব্দ বের হলো না গলা দিয়ে।
সামাদও পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসেছে রক্তের ছোপওয়ালা জায়গাটার দিকে। শিপলু মাটিতে উবু হয়ে বসে খুঁটিয়ে দেখছে আশপাশটা। আমি মাটি থেকে আমার মদের ফ্লাঙ্কটা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের পাশে।
“কি মনে হয়, কতটুক ঘায়েল হয়েছে?” সামাদকে জিজ্ঞেস করলাম আমি, সেই সাথে এক ঢোক তরল পেটে চালান করে দিলাম ফ্রাঙ্কটা থেকে। সামাদের ডাক্তারি নলেজ এই ব্যাপারে কাজে লাগবে ভালো।
জবাব দিল না সামাদ। তার বদলে শিপলুর সাথে যোগ দিলো ভূমি জরিপে। ওর এই অভ্যাস অবশ্য পুরনো-কোনো ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে মুখ খোলে না ও কক্ষণো। বিরক্তিটা চেপে রেখে আরো বড় দু’ঢোক হুইস্কি খেয়ে নিলাম। গলা দিয়ে আগুন ধরাতে ধরাতে নেমে গেল যেন তরলটুকু।
আগে মুখ খুললো শিপলুই। “এইদিকে আরো রক্তের ছোপ আছে। জঙ্গলের ভেতরের দিকে চলে গেছে। বেশ পরিষ্কার ট্রেইল।”
সামাদও উঠে দাঁড়ালো। “খবর ভালো না, জামশেদ ভাই। বড়জোর ফ্লেশ উন্ড। মাংস ফুটো করে বের হয়ে গেছে গুলি, ক্রিটিক্যাল স্ট্রাইক করতে পারেনি। কিংবা ভাগ্য খারাপ হলে স্রেফ চামড়া ছিঁড়েছে খানিকটা, লোম উঠেছে, আর তেমন কিছু হয়নি।”
“হুম।” ফ্লাঙ্কে আরেকটা চুমুক দিলাম। “তোরা কেউ ভালো করে দেখতে পেরেছিস, জিনিসটা কি? আমার চোখ রোদে এমন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, আর এত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল যে ভালোমত দেখারও চান্স পাইনি।”
“সেম হিয়ার,” শিপলু বললো, “ঝোপের অন্ধকারে কেবল ওটার অবয়বটা দেখতে পাচ্ছিলাম। কোনো ডিটেইলস চোখে পড়েনি।”
“যতটুকু মনে হয়েছে, শেয়াল একটা,” নিচু গলায় বললো সামাদ, “অস্বাভাবিক রকম বড় একটা শেয়াল।” এক মুহূর্ত থামলো ও। “তারমানে যা ভেবেছিলাম। র্যাবিসওয়ালা শেয়াল।”
হঠাৎ নিজের হাতের ওপর চোখ পড়লো আমার। এতক্ষণ তিরতির করে কাঁপছিলো ওগুলো, এখন ঠিক হয়ে এসেছে। কাঁপছে না একদম। সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে এখন ওগুলো। ঠিক এইরকম স্টেডি হাত নিয়েই ‘৮৮ সালের সাফ গেমসে সোনা জিতেছিলাম টেন মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে।
সাথে সাথে আমার মাথার ভেতরে কে যেন বলে উঠলো, যা করার এখনই করে ফেল। এই মুহূর্তে।
ফ্লাঙ্কটার ছিপি বন্ধ করে কোমরে গুঁজে কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামালাম আমি। চেম্বারে থাকা বুলেটটা চেক করলাম, তারপর বেল্টের সাথে লাগানো পকেট থেকে কাট্রিজ বের করে লোড করলাম রাইফেলে। বোল্ট টানলাম কান জুড়ানো ক্লিক শব্দে।
এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল শিপলু, শব্দ পেয়ে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। “ব্যাপার কি?”
“শেয়ালটার পেছন পেছন যাচ্ছি।”
চোখ বড়বড় করে ফেললো শিপলু। “পাগল হলি নাকি? আহত একটা বুনো জানোয়ারের পিছু নিবি এই জঙ্গলের মাঝে?”
“ওটা জাস্ট একটা শেয়াল, শিপলু।” শান্ত গলায় বললাম।
“র্যাবিসওয়ালা শেয়াল,” রুক্ষ গলায় শুধরে দিলো শিপলু।
“স্টিল, জাস্ট আ ফক্স,” বললাম আমি। “রক্তের ট্রেইল তো আছেই। সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই চলবে। মনে হয় না বেশিদুর গেছে।”
“ওটার র্যাবিস হয়েছে, জামশেদ ভাই,” সামাদ বললো নিচু গলায়। “ওটা এমনিতেও আর বাঁচবে না।”
“আর তার আগে যদি আরেকটা মানুষকে মেরে রেখে যায়?” আমি খেঁকিয়ে উঠলাম
অকাট্য যুক্তি। চুপ হয়ে গেল সামাদ-শিপলু।
আমি গোড়ালিতে ভর করে পাঁই করে ঘুরলাম জঙ্গলের দিকে। “তাহলে আর কি? আমি যাচ্ছি ওটার পেছনে। ওটা বেশিদূর গেছে বলে মনে হচ্ছে না। এ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন।”
সামাদ খুব সাবধানে একটা হাত তুললো। “জামশেদ ভাই, এখন আপনার যাওয়া ঠিক হচ্ছে না, মানে, আপনার বোধ হয়…”
“তুই বলতে চাচ্ছিস আমি বেশি গিলে ফেলেছি?” মুখ খিঁচিয়ে বললাম আমি। “তোর মাথা! এই মুহূর্তে আমার নিশানা যতটা সোজা আছে ততটা যদি…” কমনওয়েলথের বাছাইপর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল আমার। মাথা ঝাঁকি দিয়ে ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। “তোরা এখানে অপেক্ষা কর। আমি যাবো আর আসবো।”
রাইফেল বাগিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিকে যাওয়া শুরু করলাম আমি। যাবার আগে শেষবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, নার্ভাস ভঙ্গিতে জঙ্গলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে শিপলু আর সামাদ, আর তাদের বেশ কিছুটা পেছনে থুতনিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মফিজ দারোগা, গভিরভাবে চিন্তা করছে কোনোকিছু। দুইচোখে কুটিল দৃষ্টি, সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
জঙ্গলের ভেতরটা চুপচাপ, আর অন্ধকার।
আমার কাঁধে রাইফেলটা তোলা। আঙুল ট্রিগারে। সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি।
সতর্ক দৃষ্টি চালাচ্ছি চারপাশে। বেশ ঘন জঙ্গলটা—মোটা মোটা গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে কোনো প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের থামের মতো, তাদের পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে লতা পাতা, আর তার গোড়ায় ঝোপ-ঝাড়ের রাজত্ব।
মাথা ওপরে তুললাম আমি। আকাশ ঢাকা পড়ে আছে উঁচু গাছগুলোর পাতার চাঁদোয়ায়। সেগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে উজ্জ্বল আকাশের ছিটে ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। চারপাশটা ওইজন্যেই ছায়া-ছায়া অন্ধকার।
আমার চোখ এখনো মানিয়ে নেয়নি অন্ধকারের সাথে। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, চেপে বন্ধ করে রাখলাম চোখ দুটো কয়েক সেকেন্ড। তারপর খুললাম আবার। হ্যা, এবার কাজ চালানোর মত দেখা যাচ্ছে চোখদুটো দিয়ে।
কোথায় যেন একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা একটানা ডেকে যাচ্ছিলো, এইমাত্র চুপ করলো ওটা।
আমি বোঝার চেষ্টা করছি ট্রেইলটা কোনদিকে গেছে। দেখলেই বোঝা যায়, বড় কোনো জন্তুর চলাচলে তৈরি হয়েছে ট্রেইলটা। মানুষের তৈরি হতে পারে কি? না, মফিজ দারোগা জোর দিয়ে বলেছে এ জঙ্গলে কেউ আসে না। সে লোকাল লোক, তার কথা সত্য হবার সম্ভাবনা বেশি। তাহলে বন্য জন্তুর অপশনটাই বাকি থাকলো। আর এই জঙ্গলে বন্য জন্তু বলতে শেয়ালই হতে পারে, আর কোনো কিছু হবার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তো ধরে নেওয়াই যায় এই পথেই শেয়ালটা গেছে।
কান খাড়া রেখে ধীরে ধীরে মাটিতে বসলাম আমি হাটু ভাঁজ করে। মাটি বলতে মাটি নয় আসলে—সবকিছুতে শুকনো পাতা আর শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। সেগুলো জরিপ করতে লাগলাম চোখ সরু করে। যা চাচ্ছি সেটা পেতেও সময় লাগলো না। তাজা রক্তের দাগ, সাদা হয়ে যাওয়া একটা পাতার ওপর ফুটে আছে পরিষ্কার হয়ে। হ্যা, শেয়ালটা এদিক দিয়েই গেছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম আবার। ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু কললাম আগের মত।
কাজটা সহজ নয়। একবার মাটির দিকে চোখ রাখতে হয়-রক্তের দাগ চেক করার জন্য, আরেকবার আবার চোখ রাখতে হয় সামনে।
শেয়ালটা কি আরো কোনো দাগ রেখে যাচ্ছে? না, পায়ের ছাপ সম্ভব না। পাতাগুলো শুকনো। সেগুলোতে পা রেখে চাপ দিয়ে পা আবার তুলে নিলে সেগুলো আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
আশেপাশের ঝোপের ভাঙা ডাল? না। শেয়ালটা এদিক দিয়ে নিয়মিতই আসা যাওয়া করে। ডাল যা ভাঙার আগেই ভেঙেছে। তাজা কোনো ভাঙা ডাল পাওয়া যাবে না।
শেয়ালটা মরে সামনে কোথাও পড়ে আছে, এই সম্ভাবনা আছে কি? মনে হয় না। সামাদ যা বললো সেটাই মানতে হচ্ছে, কারণ ও ডাক্তার, কাটা-জখমের ব্যাপারে ও-ই বেশি জানে। আমি শেয়ালই চোখে দেখছিলাম না, শেয়ালের কোথায় গুলি লেগেছে সেটা তো দূরের ব্যাপার।
শেয়ালটা ঘুরে পাল্টা অ্যাটাক করতে পারে, এই সম্ভাবনাটা হঠাৎ মনে পড়লো আমার।
একটা সুস্থ শেয়াল কখনো একজন মানুষকে ঘুরে আক্রমণ করবে না। কিন্তু র্যাবিসের জীবাণুভয়ংকর। আক্রান্ত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র বিগড়ে দেয় ওরা। প্রচন্ড যন্ত্রণায় মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকা জীবটা তখন পরিণত হয় ওদের কন্ট্রোল করা জোম্বিতে যাকে সামনে পায়, তাকেই কামড়ে দেবার চেষ্টা করে। কারণ র্যাবিসের জীবাণু তখন কামড়ের মাধ্যমে আরেকটা দেহে ছড়ানোর সুযোগ পায়! ভয়ংকর ব্যাপার। সামাদের কাছে যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন গা রি-রি করে উঠেছিল।
সমস্যা নেই, যেমন কুকুর তেমন মুগুর। শেয়ালটার র্যাবিস আক্রান্ত মাথাটা আক্ষরিক অর্থেই উড়িয়ে দেবার মত ফায়ারপাওয়ার আমার বন্দুকের আছে।
আরেকটু এগোতেই কানে পড়লো শব্দটা। থমকে গেলাম আমি।
কিসের শব্দ? শেয়ালটা—
আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল শব্দটা আবার হওয়াতে। দম আটকে ফেললাম আমি। কানে কি ভুল শুনছি?
ফিসফিসানির শব্দ! এই জঙ্গলে ফিসফিস করবে কে?
বিভ্রান্ত আমি পেছনে তাকালাম একবার। আমার সাথীদের কেউ শব্দ করছে না তো? সাথে সাথেই অবশ্য বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। ওরা অনেক পেছনে পড়ে গেছে। আর তাছাড়া ওরা আমাকে কিছু বলতে হলে ফিসফিস করবেই বা কেন?
আবার!
ফিসফিসানিটা শুনতে পেলাম আবারও।
ওটার উৎসটা কোথায় বোঝার জন্য মাথা ঘোরাতে গিয়ে বোকা বনে গেলাম। শব্দটা চারদিক থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে।
যেন আমার চারপাশ ঘিরে ফিসফিস করছে অদৃশ্য কেউ
তীক্ষ্ণ চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমি। না, কোথাও কেউ নেই।
ঠিক যেন মনে হচ্ছে আমার মাথার ভেতরে ফিসফিস করছে কেউ।
কথাটা মনে পড়তেই থমকে গেলাম।
গত কয়েকদিনে অদ্ভুত সব ব্যাপার হয়েছে আমার সাথে। বাবার মৃত্যুর পরে। সামাদের কাছে স্বীকার না করলেও, ব্যাপারটা যে কোনো না কোনো রকমের মানসিক সমস্যা, সেটা জানি আমি। এবং এটাও জানি, সমস্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। আমি যতই ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন।
এটাও নতুন কোনো সিম্পটম নয়তো?
আবার শুনতে পেলাম ফিসফিসানিটা। অদ্ভুত আর খাপছাড়া সব স্বপ্ন দেখা। নিজের মেজাজের ওপর যে সামান্য নিয়ন্ত্রণটুকু ছিলো সেটাও হারানো। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সেই অদ্ভুত ভিজিট
গোলাগুলির পরে প্রায় আঠারো ঘন্টার অ্যামনেশিয়া।
গাড়ির মধ্যে ঘুম ভাঙার আগে দেখা আরেকটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।
আবার শোনা যাচ্ছে ফিসফিসানি। কিন্তু এটাকে তো বড় বেশি বাস্তব লাগছে। আর এখন ওটাকে চারপাশে না, একটা নির্দিষ্ট দিকেই শুনতে পাচ্ছি। আমি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলাম শব্দটার উৎস আন্দাজ করে।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম একবার। এক ফোঁটা রক্ত। শেয়ালটাও এদিকেই গেছে।
তাহলে শব্দটা লক্ষ্য করেই এগোনো যাক। শব্দটা যেন আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কোনো দিকে। আমি সতর্ক পায়ে যতই এগোচ্ছি, শব্দটার জোর যেন ততই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে একটা কন্ঠ নয়, অনেকগুলো কন্ঠ ফিসফিস করছে ওদিকে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে চললাম আমি। শরীরের প্রত্যেকটা পেশি টানটান, রাইফেল কাঁধে, হাত ট্রিগারে। মাটির দিকে চোখ রাখছি মাঝে মাঝে। জঙ্গলে ঢোকার পর প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট কেটে গেছে অল্প আলোর সাথে একদম মানিয়ে নিয়েছে আমার চোখ। পরিষ্কার দেখতে পারছি এখন সবকিছু। মাঝে মাঝে একটা দুটো রক্তের ফোঁটা চোখে পড়ছে এখনো।
ফিসফিসানিটা বাড়ছে, বাড়ছেই। বাড়তে বাড়তে ফুল ভলিউমে ছাড়া আনটিউনড রেডিওর হোয়াইট নয়েজের মত তীব্রতা ধারণ করেছে ওটা-তিন চারটা কন্ঠ শুনতে পারছি আলাদাভাবে কিন্তু পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছে ওগুলো।
আমার দুই কান জুড়ে ফিসফিসানিটা ছাড়া আর কিছু নেই।
সামনে জঙ্গলটা যেন অনেক ঘন হয়ে এসেছে একটা জায়গায়, এমন ঘন বুনটে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো যে ওগুলো পেরিয়ে কোনোকিছু দেখার জো নেই। ফিসফিসানিটা ওদিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ওদিক থেকেই আসছে ফিসফিসানিটা।
এতক্ষণ ভ্যাপসা গরম লাগছিল আমার, ঘামছিলাম অল্প অল্প। কিন্তু আর কয়েক পা এগোতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে।
হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া। যেন বরফের চাঁই ছুঁয়ে এসেছে বাতাসটা। আমি এগিয়ে চললাম ঘন, অন্ধকার জায়গাটার দিকে। কয়েক পা এগোতেই হোঁচট খেলাম কোনোকিছুর সাথে। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো আমার। জিনিসটা শ্যাওলা মাখানো, ভাঙা, এবড়োথেবড়ো-তবু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা ইঁট ওটা।
আমি চোখ তুললাম সামনে, আর চোখে পড়লো ভাঙা মন্দিরটা।
আসলো গোটা সময়টাই ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি, কিন্তু এমনভাবে গাছ, শ্যাওলা আর লতাপাতা জড়িয়ে আছে ওটাকে, যে চিনতেই পারিনি। মনে করেছিলাম জঙ্গলের ঘন অংশ
শিপলুর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যশোরে এরকম একটা মন্দির দেখেছিলাম। ভালোমত তাকাতেই গোটা অবয়বটা পরিস্কার ফুটে উঠলো চোখের সামনে। মন্দিরটার ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি নিশ্চয়ই-কারণ মুখ ব্যাদান করা একটা দরজাকৃতি ফাঁক দেখা যাচ্ছে আমার চোখের সামনে, ওটাই হয়তো ফটক ছিলো এককালে। ফটকের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের ওপরের গম্বুজটা। মুসলিম স্থাপত্যের গম্বুজ স্তনাকৃতি হয়, কিন্তু এটা ঘন্টার আকৃতির, তার মানে মন্দিরই বটে এটা। গম্বুজটার ওপরে গজিয়েছে বিশাল একটা বট না-হয় পাকুড় না-হয় অশ্বত্থ গাছ, শেকড় ছড়িয়ে দিয়েছে মাটি পর্যন্ত, যেন শিবের মাথার বিশাল জটা।
আরেক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগলো আমার গায়ে। মন্দিরের ভেতর থেকেই আসছে ওটা। সাথে একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ। আর ফিসফিসানি। যেন পাগল হয়ে গেছে কণ্ঠগুলো। বলতে চাইছে আমাকে কোনোকিছু, কিন্তু পারছে না, কারণ ওদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।
আমি নিচের দিকে তাকালাম। যেন আমাকে দেখানোর জন্যই এক ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে ফটকের গোড়াতেই। বড় করে একটা শ্বাস নিলাম, তারপর ঢুকে পড়লাম ভেতরে। এতদূর এসে আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সাথে সাথে যেন নতুন সাড়া পড়লো ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলোর মাঝে। আর তার সাথে যোগ দিয়েছে আরেকটা নতুন শব্দ। অনেকগুলো মাছি ভনভন করলে যেমন শোনায়, তেমন।
আমার কানদুটো ঝালাপালা করে দিচ্ছে শব্দদুটো।
জঙ্গলের ভেতরটা এমনিতেই অন্ধকার, আর মন্দিরের ভেতর তো আলো ঢোকার কোনো উপায়ই নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না কোনোকিছুই। আর কিছু না, স্রেফ আন্দাজের ওপর ভর করেই এগোচ্ছি আমি।
ভুল বললাম। শব্দটা যেন বশ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আর তীব্র পচা গন্ধটাও।
মন্দিরে ঢোকার পরই প্রথমে একটা বড়সড় ঘরের মত জায়গায় পড়েছি আমি। এটার দু-পাশে দুটো ভাঙাচোরা জানালার মত আছে, সেটা দিয়ে যে আলো আসছে তাতে বুঝলাম এই ঘরটায় কেবল ঝোপঝাড় ছাড়া কিছু নেই। ঘরটার পেছনে আরেকটা দরজা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেটার দিকে।
সাথে সাথে শিউরে উঠলাম ঠান্ডায়। বাইরের চাইতে এই জায়গার তাপমাত্রা অন্তত দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম বাড়িয়ে বলছি না।
বাতাসের আরেকটা ঝলক বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভক করে পচা গন্ধটা নাকে লাগলো। নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠলো আমার।
পেছনের দরজাটা দিয়ে একটা করিডোরের মত জায়গায় এসে পড়েছি আমি। প্রায় রাতের বেলার মত আঁধার এখানে। দু-পাশে আরো ঘর আছে, বুঝতে পারছি, কিন্তু সেগুলো দেখার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। আমি যত এগোচ্ছি,
ফিসফিসানির শব্দটা আরো জোরালো হচ্ছে। আমি জানি, যা থাকার, সামনেই আছে।
পচা গন্ধটাও বাড়ছে। আর বাড়ছে ঠান্ডা। যেন প্রতি পদক্ষেপে ধীরে ধীরে একটা ডিপ ফ্রিজের মাঝে সেঁধিয়ে যাচ্ছি আমি। ঠান্ডাটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে-মাংস ভেদ করে হাড়ে কামড় বসাচ্ছে যেন। মাঘের তীব্রতম শৈত্যপ্রবাহও এত ঠান্ডা হয় না।
আমার দাঁতে দাঁত লেগে খটখট শব্দ ওঠা শুরু হয়েছে। আমার নাক-মুখ দিয়ে বেরোনো নিশ্বাস জমে কুয়াশার মতো হয়ে যাচ্ছে। ফিসফিসানিটা যেন ফাটিয়ে দেবে দুই কানের পর্দা। আর সেই সাথে মাছি ওড়ার ভন-ভন।
যখন মনে হচ্ছে আমার হাতটা জমে যেতে শুরু করেছে, বাড়িয়ে ধরা রাইফেলটা আর অনুভব করতে পারছি না, ঠিক তখনই আবছা একটা দরজার মতো চোখে পড়লো করিডোরের শেষে। বরফের মত ঠান্ডা বাতাসটা আসছে ওখান থেকেই। আমি এক পা-এক পা করে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকেই। আঙুল ট্রিগারে।
মৃদু একটা গরগর শব্দ শুনতে পাচ্ছি কি? নাকি ফিসফিসানির তীব্র শব্দের মাঝে ভুল শুনছি কানে?
আমি ঢুকে পড়লাম।
আরেকটা বড়সড় ঘরের মাঝে হাজির হয়েছি। যেদিক দিয়ে এসেছি ওটার উল্টোদিকে একটা ভাঙাচোরা জানালা আছে-আর তার আলোতেই দেখে নিলাম যা দেখার।
মেঝেতে পড়ে আছে কিছু একটা সম্ভবত একটা মরা ছাগল, আর সেটার ওপর ঝুঁকে আছে বিশাল একটা প্রাণী। আমার দিকে পিঠ দেয়া ওটার।
কোনো শেয়াল এত বড় হয় না। কোনো শেয়াল এই রকম বাঘের মত বড় হয় না।
ঘরটার তাপমাত্রা যেন শূণ্যেরও নিচে-হাত-পা স্থির রাখতে পারছি না আমি। আমার মুখের সামনে নিশ্বাসের ধোঁয়া।
আমার সাড়া পেয়ে আস্তে আস্তে ঘুরলো জানোয়ারটা, আর সেই সাথে যেন পাগল হয়ে উঠলো ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো, কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।
আমার দিকে তাকালো জানোয়ারটা। লাল অঙ্গারের মত জ্বলজ্বল করছে ওটার চোখদুটো। ঠোঁট সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে একসারি ঝকঝকে ধারালো দাঁত।
এ-পর্যন্তই দেখেছিলাম। সোজা ওটার মাথার দিকে তাক করলাম। তারপরই টান দিলাম ট্রিগারে।
মিস করেছি আমি!
জানোয়ারটা ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের জানালাটা দিয়ে লাফিয়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। আমিও ঘুরলাম উল্টোদিকে। আর পারছি না। মাথা ঘুরছে। তীব্র পচা গন্ধে নাড়ি-ভুড়ি পাক দিয়ে উঠছে। ঠান্ডায় হাত পা অসাড়।
টলতে টলতে ফিরে চললাম বাইরের দিকে। টের পাচ্ছি, কমে আসছে ঠান্ডাটা, ফিসফিসানি আর ভনভন শব্দ মিলিয়ে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে পেছনে।
মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এসেই হুড়হুড়িয়ে বমি করে দিলাম।
কেস স্টাডি : ‘তদন্তম’
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইনভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল—সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
এই ঘটনাটা আমার নিজের জীবনের।
আমি অলৌকিক ঘটনা নিয়ে প্রথম আগ্রহি হই ছোটবেলাতেই। ক্লাস সিক্সে থাকতে ব্যাপারটার শুরু।
বলছি সত্তুরের দশকের শেষ দিকের কথা। আমি অসাধারণ কোনো ছেলে ছিলাম না। সব কিছুতেই মাঝারি-পড়াশোনা বলুন, খেলাধুলা, দস্যিপনা, মারামারি বলুন-সবকিছুতেই। আমার অনেক বন্ধুর অনেক রকম হবি ছিল-আমার কিছুই ছিল না। ওয়াহেদ ডাকটিকেট জমাতো-দুনিয়ার প্রায় সব দেশের ডাকটিকেট ছিলো ওর কাছে, সবাইকে দেখিয়ে মজা পেতো। আলম বাগান করতো, যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতো আদরের বাগানটা। ফাহিম ছিলো বইয়ের পোকা, বিশেষ করে মহাকাশ সম্বন্ধে ফ্যাসিনেশন ছিলো ওর, আর্মস্ট্রং আর গ্যাগারিনকে ঈশ্বর জ্ঞান করতো। আমি এইসব কিছুই করতাম না।
তবে হঠাৎই সব পাল্টে যেতে শুরু করলো।
এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। আবিষ্কার করলাম, খাটের ওপরে সোজা বসে আছি আমি, চেঁচাচ্ছি গলা ফাটিয়ে। চেঁচাতে চেঁচাতে খাটের কিনারে চলে এসেছি একেবারে। আমার ঘরে ছুটে এসেছে আব্বু, আম্মু আর ছোট ভাই। সবাই উদ্বিগ্ন।
আশ্চর্য, আমি কিন্তু বলতে পারলাম না স্বপ্নে কি দেখে ভয় পেয়েছি।
ঘড়িতে তখন রাত তিনটা পাঁচ। এর পরের রাতেও একই ঘটনা। তার পরের রাতেও।
একমাস ধরে চললো এমনটা। ততদিনে আব্বু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে নিতে কাহিল হয়ে শেষে কবিরাজ-ঝাড়ফুঁকের দ্বারস্থ হবেন ভাবছেন। এমনি সময় হঠাৎ একদিন ঠিক হয়ে গেল সব। আর দুঃস্বপ্ন দেখে জাগলাম না, প্রতি রাতে চমৎকার ঘুম হতে লাগলো। সব আগের মত হয়ে গেল, কেবল একটা জিনিস বাদে। আমি। আমি চিরতরে পাল্টে গেলাম।
অলৌকিকের ব্যাপারে তুমুল নেশা জন্মালো। যেখানে যত ভুতের গল্পের বই পেলাম, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে শুরু করলাম। তাতেও নেশা মেটে না। কয়েকদিন পর শুরু করলাম নানান ভুতুড়ে জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। গোরস্তান, পোড়োবাড়ি, শ্মশান। কখনো একাই যাই, কখনো আমার সাথে থাকে ফাহিম-বইয়ের পোকা ফাহিম। অদ্ভুত যে কোনো কিছুতে উৎসাহ ওরও।
আমাদের জেলায় দেখার মত প্রায় সব ভুতুড়ে সেমি ভুতুড়ে জায়গা দেখা শেষ, এমন সময় মনে পড়লো -লাশ কাটা ঘরটাই দেখা হয়নি। কুখ্যাত লাশ কাটা ঘর।
আমাদের জেলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিলো না। লাশ কাটা, মানে ময়না তদন্তের কাজটা হতো একটা আলাদা একটা ভবনে, সদর হাসপাতাল থেকে একটু দূরে। ভবন বলতে আহামরি কিছু না, বারান্দাওয়ালা এক রুমের ইঁটের দালান। দালানটা খাস জমির ওপরে রাস্তা থেকে একটু দূরে। চারপাশে ঝোপঝাড় আর গাছপালা। দিনের বেলাও অন্ধকার হয়ে থাকে। সঙ্গত কারণেই ওখানে মানুষ জনের আনাগোনা কম, কেউ বেশি একটা ঘেঁষতে চায় না ওদিকটায়।
ওখানেই একদিন রওনা দিলাম ফাহিমের সাথে। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। অক্টোবর মাস।
বিকেল পড়ে আসছে। খেলতে যাবার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ফাহিম অপেক্ষা করছিলো পাড়ার রাস্তার মোড়টাতে। দু-জনে কাছাকছি এসে একে অন্যের চোখের দিকে তাকালাম কুচক্রির মতো- তারপর হাটতে শুরু করলাম কোনো কথা না বলে।
“টর্চ এনেছিস?” খানিক পরে বললো ফাহিম।
“হুঁ,” জবাব দিলাম
“টাকা-পয়সা?”
“আছে দশ টাকার মতো।”
তখন দশ টাকাই অনেক ছিলো। খুশি হয়ে উঠলো ফাহিম।
লাশ কাটা ঘরটা আমাদের পাড়া থেকে একটু দূরে, রিকশায় গেলে ভালো হয়। আমরা অবশ্য হেটেই চললাম। হেমন্তের বিকেলে বন্ধুর সাথে প্রিয় শহরের অলিগলিতে হাটার মধ্যেও আলাদা মজা আছে।
ফাহিম বইয়ের পোকা। দুনিয়ার বই পড়ে-আর সেগুলোর রিভিউ দেয় আমাকে। এমনিতে ক্লাশের মাঝে বড্ড চুপচাপ ও, কিন্তু প্রিয় কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে খই ফুটতে থাকে ওর মুখে। ওর সাথে থেকে অবশ্য একটা লাভ হয়েছিল আমার প্রচুর ক্লাসিক বইয়ের ব্যাপারে জেনেছিলাম ওর কাছে থেকেই, একজন সাধারণ মানুষ যেগুলোর নাম হয়তো সারাজীবনেও শোনে না। বই ছাড়াও, নতুন যে কোনো কিছু নিয়ে চরম উৎসাহ ওর। যেমন আমার ঘোস্ট-হান্টিং।
হাটছি, আর কথা বলছি আমরা। একটা হেরিং বোন রাস্তা ধরে এগোচ্ছি বড় রাস্তার দিকে। ফুরফুরিয়ে বাতাস বইছে। রাস্তার পাশে একটা খেলার মাঠ, ফুটবল খেলছে আমাদের বয়সি ছেলেপেলেরা। গালের একপাশে নরম সোনালি রোদ এসে পড়েছে আমার, বড্ড আরাম লাগছে।
“তো তারপর! রাশিয়ানরা তো স্পেস স্টেশন বসালো কক্ষপথে, স্যালিউট-১, কিন্তু সেখানে তো মানুষ পাঠাতে হবে! পাঠালোও তারা, তাদের বিখ্যাত সয়ুজ রকেটে করে। সয়ুজ—১০। তারা কিন্তু স্পেস স্টেশনের কাছে গেল, কিন্তু উঠতে পারলো না-রকেটের সাথে স্পেস স্টেশনের হ্যাচ ঠিকমতো জোড়েনি, তাই। পরের মিশন-সয়ুজ ১১। ছয় জুন ১৯৭১-এ লঞ্চ করলো রকেটটা, স্পেস স্টেশনের কাছে গেল, জুড়লোও-তিন কজমোনট তেইশ দিন পার করলেন সেখানে। ফেরার তারিখ ঘনিয়ে এলো। সোভিয়েত রাশিয়ার কাজাখস্তানে ল্যান্ড করলো সয়ুজের ল্যান্ডিং পড়। সফট ল্যান্ডিং। রেসকিউ টিম পৌঁছানোর পরে স্পেসক্র্যাফটের গায়ে নক করলো। কোনো সাড়া নেই। ক্র্যাফটের ঢাকনি খোলা হলো। ভেতরে মরে পড়ে আছে তিন কজমোনট, যেন ঘুমিয়ে আছে। তিন বীরের নাম গর্গি ডোবরোভলস্কি, ভ্লাদিস্লাভ ভলকভ, ভিক্তর পাতসায়েভ। সেদিন ৩০ জুন, ১৯৭১। একটা এয়ারভাল্ব ঠিকমতো কাজ না করায় সব বাতাস বেরিয়ে যায় তাদের স্পেসক্র্যাফট থেকে, মহাশূণ্যে থাকতেই মারা যায় তারা। মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে একাকি মৃত্যু।”
এইসব বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে ফাহিমের। আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সিগারেট কিনি। হ্যা, ওই বয়সেই প্রায়-চেইন স্মোকার হয়ে উঠেছিলাম আমি।
কাছাকাছি চলে এসেছি। বড় রাস্তায় চলে এলাম। ওটা পেরিয়ে ওপাশে গেলে সদর হাসপাতাল। পেরিয়ে এলাম ওটাও। আরো মিনিট দুয়েক হাটার পরে একটা শ্যাওলা পড়া লাল ইঁটের দেয়াল চোখে পড়লো।
“এসে গেছি,” রুদ্ধশ্বাসে বললাম।
একটা জং ধরা লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা। কেউ নেই আশপাশে। সুট করে ঢুকে পড়লাম আমি আর ফাহিম।
প্রাচীর ঘেরা জায়গাটার ভেতরে একপাশে অটোপসি রুমটা, চলতি ভাষায় যেটাকে বলছিলাম লাশ কাটা ঘর। একেবারে সাধারণ দেখতে একটা এক ঘরের একতলা পাকা ঘর, সামনে একটা ছোট বারান্দা আছে। ওখানেই অটোপসি হয়। ছোট শহর, খুব বেশি খুন-খারাপি হয় না, আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস থাকলেও সেগুলো চলে যায় পাশের জেলার মেডিকেল কলেজের মর্গে। কাজেই বেশিরভাগ দিনে আমি বন্ধই পড়ে থাকতে দেখেছি লাশ কাটা ঘরটাকে।
আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লাশ কাটা ঘরের বারান্দার গ্রিলের দরজাটাও যথারীতি বন্ধ। তালামারা।
“একটু আড়ালে যাই,” ফহিম বললো। “লোকজন নেই হয়তো এখন, কিন্তু আসতে পারে। আর আমাদের বয়সি ছেলেপেলে দেখলেই মানুষ মনে করে কোনো বদ মতলব নিয়ে এসেছে! হাজার বলেও বোঝাতে পারবো না।”
অটোপসি রুমের পেছন দিকে চলে এলাম আমরা। জায়গাটা অন্ধকার, ঝোপঝাড়ে ভরা, আর দুনিয়ার মশা।
ঘরটার পেছন দিকে একটা জানালা আছে। কাঁচের। সেটা অবশ্য না থাকারই মতো। বানানোর পর থেকে আজতক খোলা হয়েছে বলে মনে হয় না। পরতের পর পরত ধুলো জমে ভেতরে দেখার কোনো উপায় নেই। তবু আমি ঘষাঘষি করে একটু জায়গা পরিস্কার করালাম। বিধি বাম। ভেতরে অন্ধকার। স্পষ্ট করে কোনোকিছু দেখার জো নেই। তবু একটা লম্বাটে আকার চিনতে পারলাম। সেটাকে একটা খালি স্ট্রেচার বা লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা লাশ—যে কোনো কিছু বলে কল্পনা করা যায়।
গা-টা ছমছম করে উঠলো। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরও একই অবস্থা।
“কতক্ষণ থাকবি? সন্ধ্যে তো প্রায় হয়ে আসছে।” ফাহিম জিজ্ঞেস করলো।
“সন্ধ্যের পরও আধা ঘন্টা, ধর,” ঘড়ি দেখে বললাম, “সারা রাত থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু বাড়িতে কোনোভাবেই এক্সপ্লেন করতে পারবো না। সন্ধ্যের পর আধাঘন্টা বাইরে কি করছিলাম, সেটা বোঝাতেই জান বেরিয়ে যাবে!”
যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়েছি সেটা লাশ কাটা ঘরের পেছনটা আর সীমানা প্রাচীরের মাঝের একটা চিপা জায়গা। একটা নাম-না-জানা মোটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম আমরা দু-জনে। একটা সিগারেট ধরালাম। চুপচাপ অপেক্ষা করছি আমি আর ফাহিম। চোখ ঘুরছে চারপাশে।
এই যে বিকেলবেলা আমাদের লাশ কাটা ঘর দেখতে আসা, লাশ কাটা ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ‘ভৌতিক কোনোকিছু দেখার অপেক্ষা করা-এসব বড্ড ছেলেমানুষি মনে হতে পারে আপনাদের কাছে। ভুলবেন না, তখন আমরা তা-ই ছিলাম। অন্তত আমাদের বয়সি অন্য ছেলেপেলেদের থেকে আলাদা কিছু তো করছিলাম, আর যাই হোক।
খানিক বাদে মাগরিবের আজান শুনলাম। ততক্ষণে দিগন্তে লাল আলো ছড়িয়ে সূর্যটা গায়েব হয়ে গেছে। চারপাশে দ্রুত আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
জায়গাটা গাছপালায় ঘেরা, আগেই বলেছি। খানিক বাদেই দেখা গেল চোখের সামনে মেলে ধরা হাতটাও স্পষ্ট দেখতে পারছি না।
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেল সে খানিক পরেই। চারপাশে আর কোনো লোকজন নেই বলেই বোধহয় আমাদের দু-জনকে ছেঁকে ধরেছে ঝাঁক ঝাঁক মশা। শরীরের সবখানে কামড়াচ্ছে। কোনো কোনো অতি উৎসাহি মশা শার্টের কলার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে আমার পেটের রক্তও খেয়ে এল। ভূত দেখবো কি, গায়ের এখানে-ওখানে চাপড় মারতে মারতেই অবস্থা খারাপ। আর তাদের সে-কি গান! তাজা রক্ত খাওয়ার আনন্দেই মনে হয় ব্যাটাদের পাখায় এমন গান খুলেছে।
ফাহিম অনেকক্ষণ ধরেই উসখুশ করছিলো। এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো, “দোস্ত। শিপলু।”
আমি কানের পাশে গান গাইতে থাকা দুটো মশাকে হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “বল।”
“অনেকক্ষণ তো হলো মনে হয়.” অসহায় গলায় বললো ফাহিম।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সূর্য ডোবার পর প্রায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে কিছুই অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি এই পান্ডববর্জিত জায়গায়। গা-টা হয়তো ছমছম করছিলো, কিন্তু সেটা তো মানসিক ব্যাপার
“যাবি?” কাঁচুমাচু করে বললাম।
“আ…যাওয়া উচিৎ মনে হয় দোস্ত। এখন থেকে বাসা পর্যন্ত যেতেও সময় লাগবে, ভুলিস না,” ফাহিম বললো।
কথা সত্য। আমিও আর দাঁড়ানোর কোনো অর্থ দেখলাম না। “চল,” বললাম ফাহিমকে।
লাশ কাটা ঘরের পেছন থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে আসতে শুরু করলাম দু- জনে। মনটা খারাপ আমার। এর আগে যতখানে গেছি, কিছু না কিছু অন্তত চোখে পড়েছে, যেটা দিয়ে অন্তত নিজেকে বুঝ দিতে পেরেছি যে অলৌকিক কিছু দেখেছি। কিন্তু আজকে মনে হয় মশার কামড় খাওয়াই সার হলো, আর কিছু না। অথচ একটা সত্যিকারের হন্টেড জায়গায় গেলে, অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুর আভাস পেলে যেমন গাট-ফিলিং হয় আমার, সেটা পুরোদমেই হচ্ছিলো, এখনো হচ্ছে। আমার মনে বলছে এখানে অপার্থিব কোনোকিছু আছে।
হয়তো তাই, কারণ আর কয়েক পা এগোতেই আবছা একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমাদের থেকে কয়েক হাত সামনে।
আমি জমে গেছি জায়গাতেই। ফাহিমও দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, থ হয়ে গেছে ও-ও। এই আঁধারে কোনোকিছু ঠিকমতো বোঝার উপায় নেই বটে, কিন্তু তবুও কোনোমতে দেখা যাচ্ছে, মূর্তিটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
আমার হাত পা কাজ করছে না। কি করবো বুঝতে পারছি না। কি ওটা? আর ওটা আমাদের দিকে আসছে কেন? দৌড় দেবো? কিন্তু পাঁচিল ঘেরা জায়গাটা থেকে বেরোনোর লোহার গেটটা কোনদিকে?
মূর্তিটা আরো এগিয়ে এসেছে আমাদের দিকে। একটা ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।
এমন সময় আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে জ্বলে উঠলো ফাহিমের হাতের টর্চটা।
চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে বোকা বনে গেলাম।
একটা বাহাত্তুরে বুড়ো চোখের সামনে এক হাত তুলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আরেক হাতে একটা লাঠি। বুড়োর পরনে একটা লুঙ্গি, কিন্তু গায়ে খাকি চৌকিদারের পোশাক।
“চোখের সামনে থাইকা লাইট সরা!” বুড়ো খেঁকিয়ে উঠলো। “বজ্জাতের দল! এত রাইতে এইখানে কি?”
আমি আর ফাহিম বোকার মতো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম। এমন অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স! ধুস শালা!
ঘুরে জোরে হাটা দিলাম জং ধরা লোহার গেটটার দিকে।
পেছনে বুড়ো চেঁচাচ্ছে, “ওই, তোরা কারা? তগো বাপের নাম কি?”
দৌড়ে বড় রাস্তায় আসার পরে গোটা ব্যাপারটার মজার দিকটা মাথায় ঢুকলো আমাদের। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়তে শুরু করলাম আমি আর ফাহিম। পেটে ব্যথা হয়ে গেল হো-হো করে হেসে।
“অনেকদিন মনে থাকবে, দোস্ত,” চোখের পানি মুছে বললাম ফাহিমকে। “লাশ কাটা ঘরে ভুত দেখতে এসেছিলাম, আর দেখলাম এক বুড়ো চৌকিদারকে!”
বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করলাম। একটু পর পর হাসি আসছে, হাসতে হাসতে কুঁজো হবার অবস্থা।
সবগুলো পাড়া অন্ধকার। কারেন্ট গেছে মনে হয়। সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আর্লি এইটটিজে লোডশেডিং জিনিসটা আরো কমন ছিলো
ফাহিমদের বাড়ির কাছে চলে এলাম। বাড়িতে ঢোকার আগে ঘুরে দাঁড়ালো ফাহিম। “সেদিনের বইটা পড়া শেষ,” বললো ও। “অ্যালান পো’র গল্পের বাংলা অনুবাদ। দারুণ বই! নিবি আজকেই? আয়, ভেতরে এসে নিয়ে যা।”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে দোস্ত,” মাথা চুলকে বললাম। “বাসায় যাই না-হয়। কাল স্কুলে নিয়ে আসিস বইটা।”
“আরে, আমার বাসার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছিস,” হেসে বললো ফাহিম। আঁধারের মাঝে আবছা দেখা গেল কেবল ওর দাঁত। “আয় ভেতরে। বইটা দিচ্ছি তোকে।”
আমি এক পা দু-পা করে ফাহিমের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। হকচকিয়ে গেলাম ভেতরে ঢুকে। লোডশেডিং চলছে ঠিকাছে কিন্তু এত আঁধার কেন? ওদের বাড়িতে কেউ আলো জ্বালেনি?
“এই দিকে,” ফাহিম বললো। “আমার পেছন পেছন আয়।”
হাতড়ে হাতড়ে ফাহিমের ঘরের ভেতরে এসে ঢুকলাম উঠোন পেরিয়ে। “দোস্ত, কিছু তো দেখি না চোখে।”
“দেখবি, দেখবি। আর অন্ধকার থাকবে না একটু পরে।” ফাহিম হঠাৎ হেসে উঠে বলে।
আমি কেন যেন অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করি। এক বিন্দু আলো দেখতে পেলেও শান্তি পাবো এখন। কিন্তু টর্চটা তো ফাহিমের হাতে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেই আমি। একটা দেশলাই আছে। ওটা মুঠো করে ধরি। “দোস্ত, বইটা দে, আমি চলে যাই।”
“পাবি, পাবি। এত অধৈর্য কেন?” ঠান্ডা গলায় বলে ফাহিম।
খড়খড় করে একটা শব্দ, তারপর ফস-স্-স্-স্। আমি দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়েছি।
দেখলাম, ফাহিমের ঘর না, আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছোট একটা ঘরে, যার এখানে-ওখানে পড়ে আছে দু-তিনটে ডিসেকটিং টেবিল। টেবিলের পাশে ছোট ট্রে’তে নানারকম ইন্সট্রুমেন্ট রাখা।
সেই আলোতে দেখা গেল ফাহিমকে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। খালি গা। থুতনি থেকে তলপেট পর্যন্ত চেরা। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসে লুটাচ্ছে মেঝেতে।
ফাহিমের চোখে খুনে দৃষ্টি। দৃশ্যটা দেখেছিলাম বড়জোর এক সেকেন্ড। তারপরই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করলাম। চোখের পলকে বেরিয়ে এলাম বাইরে, গাছপালা ঘেরা একটা জায়গায়। এই জায়গা আমি চিনি। লাশ কাটা ঘরের সামনের প্ৰাঙ্গন।
ওইদিন আমি যত জোরে দৌড়েছিলাম, জীবনে আর কখনো তত জোরে ছুটিনি। চোখের পলকে আলো ঝলমলে সদর হাসপাতালের গেটে চলে এলাম। থামলাম না ওখানেও। দৌড়ে চলে এলাম আমাদের পাড়ায়। শরীরের প্রতিটা কোষে তখন ক্লান্তি।
একটু শান্ত হয়ে বাসায় এসে ঢুকলাম। কাউকে কিছু বলিনি।
পরের দিন খবরটা পেলাম সকালে। ফাহিমের লাশ পাওয়া গেছে লাশ কাটা ঘরের পেছনে। থুতনি থেকে তলপেট পর্যন্ত চেরা, নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
অনেকদিন পেরিয়ে গেছে তারপর। পুলিশ অনেকদিন তদন্ত করেছিল, আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে অনেক।
কিন্তু কে বা কারা ফাহিমকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল, আজ পর্যন্ত বের করা যায়নি।