শ্বাপদ সনে – ৮

অধ্যায় ৮ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে

এরকম ঝাঁ ঝাঁ রোদের সকালে বিছানায় শুয়ে থাকা চলে না। চোখ মেলে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়েই তড়াক করে উঠে বসলাম।

হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখি, শিপলু একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে। পা পদ্মাসনের মত ভাঁজ করা। হাতে একটা সিগারেট। টানছে না, হাতটা মুখের কাছে ধরে আছে কেবল।

ওর পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। “কি রে? কি করিস?”

“দেখছি,” সামনে তাকিয়েই জবাব দিলো শিপলু।

আমিও সামনে তাকালাম। বাংলোর সামনের জায়গাটা, যেটা এককালে হয়তো লন ছিলো, আগাছা আর ঝোপজঙ্গলে ভরা। তাদের ওপরে আলো-আঁধারির ঝালর ফেলেছে অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা কয়েকটা আম-লিচু আর নাম না জানা গাছের পাতার ছাউনি। সবকিছু ছাপিয়ে দূরে বিস্তির্ণ ধানখেত দেখা যাচ্ছে। এইসবের মাঝে দেখার কি আছে কে জানে।

চোখ কুঁচকে শিপলুর দিকে তাকাতেই ও বললো, “দুনিয়াটা বড়ই ডিসিভিং। কোনোকিছুর আসল রূপ বোঝার উপায় নাই।”

চোখ কুঁচকে ফেললাম আমি। “সাত সকালে হঠাৎ এই ফিলসফি?”

“আজকের সকালটার কথাই দেখ। আবহাওয়াটা কেমন লাগছে তোর কাছে?”

“চমৎকার।”

“রিফ্রেশিং?”

“হুমম।”

“কিন্তু আমি যে সবকিছুতে একটা অশুভ গন্ধ পাচ্ছি,” ফিসফিস করে বললো শিপলু। আস্তে আস্তে সিগারেটটা লাগালো ঠোঁটে।

অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো আমার। শিপলুর কথায় ভয় পেয়ে নয়, প্রসঙ্গটার কারণেই। শিপলুর সাথে দেড় বছরের বন্ধুত্ব আমার, ওর সাথে বেশ কয়েকটা অ্যাডভেঞ্চারও করা হয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি অলৌকিকের ব্যাপারে এখনো সংয়শবাদী। নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে লাথি মেরে এসেছে চব্বিশ বছর আগে, যখন আমার বয়স এক। এখনকার এই জমানায় ভুত-জ্বিন-স্কন্ধকাটা- অয়্যারউলফের কিস্সা হাস্যকর লাগে। শিপলুর সাথে এতগুলো কেস দেখার পরেও।

“অনেক অশুভ সংকেতই বুঝতে পারি আমি,” যেন আমার মনের কথা বুঝেই বললো শিপলু। “ছোটবেলায় মানুষের অনেক রকম হবি থাকে। গল্পের বই পড়া, ডাকটিকেট জমানো, মুদ্রা জমানো, পছন্দের নায়ক বা নায়িকার ছবি কেটে দেয়ালে লাগানো। আমার এইরকম কোনো ফ্যাসিনেশন ছিলো না। স্কুলে যেতাম-আসতাম। বিকালে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতাম। আর কিছু না। আমার মত নির্লিপ্ত, কৌতুহলবিহীন ছেলে আর দুটো ছিল কিনা জানি না। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু পাল্টে গেল। তখন আমি সিক্সে পড়ি…

“একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আমার বিছানার পাশে আব্বু-আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চেহারায় ভয়। আমি নাকি ঘুমের মাঝে চেঁচাতে চেঁচাতে বিছানায় উঠে বসেছি। অথচ আমার কোনো স্বপ্ন দেখার কথা মনে নেই। স্বপ্নের মাঝে কি দেখে অমন ভয় পেয়েছিলাম, তাও জানা নেই।

“পরের রাতেও এই রকম হলো। তার পরের রাতেও। এইভাবে প্রায় একমাস যাবত প্রতি রাতে আমি রাত ঠিক তিনটা পাঁচ মিনিটে চেঁচাতে চেঁচাতে জেগে উঠতাম। আব্বু ততদিনে ডাক্তার দেখাতে দেখাতে শেষে মরিয়া হয়ে কবিরাজ দেখানো শুরু করেছেন। কেউ কিছু করতে পারছে না।

“তারপর হঠাৎ একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। রাতের বেলা চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙা বন্ধ হয়ে গেল আমার। তবে সবকিছু কিন্তু আগের মতো হয়ে গেল না। একটা জিনিস চেঞ্জ হয়ে গেল চিরতরে। আমি। অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃত নিয়ে মেতে উঠলাম ভীষণভাবে। অকাল্ট নিয়ে কত বই পড়েছি, তা তো বলেছিই। কিন্তু সত্যিকারের কাজের কাজটা করলাম যখন সারা দেশে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম। মানুষের মুখে শুনে হোক, বা সস্তা ট্যাবলয়েড পত্রিকা থেকেই হোক, যেখানেই কোনো খাপছাড়া ঘটনার কথা জানতে পারতাম, ছুটে যেতাম। কয়েকদিন পরে শুরু করলাম পীর- ফকির-ওঝা-তান্ত্রিকের পিছু নেয়া।”

“আর তখনই দুঃখের সাথে খেয়াল করলি, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আসলে ভন্ড।” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি। শিপলুর কাছে এই গল্প আগে বহুবার শুনেছি। আসলে লম্বা ভূমিকা না দিয়ে কথা শুরু করতে পারে না ও।

“হ্যা। স্বভাবতই চরম হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে দেশের প্রত্যন্ত এক জেলার এক শ্মশানে এক তান্ত্রিকের দেখা পেলাম। সারা শরীর ছাই মাখা, মাথায় বিশাল জটা, পেট পর্যন্ত দাড়ি। চোখ জবা ফুলের মত লাল। কথা বলে হিন্দিতে। নিজেকে দাবি করলো অঘোরি সাধু হিসেবে, ইন্ডিয়া থেকে নাকি এসেছে বর্ডার টপকে।” শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ফেলে দিলো শিপলু। “বেশ ভড়ংও জানে দেখলাম। মড়ার খুলিতে করে পানি আর মদ খায়। গাঁজার কল্কেতে এমন দম দেয় যে দেখলে তোরই দম আটকে আসবে। যাহোক, সে লোকের কাছে মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম আমি। তান্ত্রিকটা ভ্রুক্ষেপই করলো না, যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। তিন দিনের দিন রাতে সেই লোক একটা আগুনের কুন্ড জ্বালিয়ে সাধনা শুরু করলো।

“সেই রাতে আমি কি দেখেছিলাম জিজ্ঞেস করিস না। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, সেইদিনের পর থেকেই আমার মাঝেও অনেক ক্ষমতা জন্মেছে। অনেক কিছু বুঝতে পারি। অনেক কিছুর অস্তিত্ব টের পাই।” একটু থামলো শিপলু। “কালকে রাতে যখন আসছি, তখনই টের পাচ্ছিলাম অশুভ কোনোকিছুর উপস্থিতি। তখন পাত্তা দেইনি। ভেবেছিলাম ফলস অ্যালার্ম। কিন্তু আজ সকালে…”

“টের পাচ্ছিস চারপাশে থিকথিক করছে অশরীরি?” কন্ঠের ব্যাঙ্গের সুরটা কাটানোর কোনো চেষ্টা করলাম না আমি।

কোনো জবাব দিলো না শিপলু। হঠাৎ মাথা ঘোরালো আমার দিকে। “কালকে রাতে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।”

আমজাদ আলী ট্রে-তে করে চা নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে একটা কাপ তুলে নিলাম আমি। চুমুক দিতে দিতে বললাম, “চিৎকারটা নার্ভের ওপরে চাপ দিচ্ছিলো। তার ওপরে নতুন একটা জায়গায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, তার ওপর…” থেমে গেলাম আমি, গত পরশু রাতের কথা মনে পড়ে গেছে।

“তোর হাতে তো বন্দুক ছিলো,” চায়ে চুমুক দিয়ে মলিন একটা হাসি হাসলো শিপলু। “সাহসটা অন্তত ফিরে পেয়েছিলি। আমার কথা চিন্তা কর। ঘুম থেকে উঠে দেখি সারা ঘরে হারিকেনের মৃদু আলো, দূরে কোথাও পিশাচটা ডাকছে, তুই ঘরের মাঝখানে উবু হয়ে আছিস, হাতে অ্যান্টিক রাইফেল! কলজে কেঁপে উঠেছিল!”

“বোকামি হয়েছিল, স্বীকার করছি,” বললাম আমি। “অত রাতে সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় আরো বেশি অজানা এক জানোয়ারের পিছু নেবার চিন্তাটা একেবারে পাগলামি ছিলো।’

শেষের কথাটা আমার নিজের কানেই ঝনঝন করে উঠলো।

একেবারে পাগলামি ছিলো।

একেবারে পাগলামি ছিলো।

একেবারে…

গত কয়েক দিন যাবত এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? কালকের ওই ডিমেনশিয়া আর ওই ভয়ংকর স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি নি। এমনকি কালকে রাতে শিপলু আর সামাদ আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিছানায় পাঠানোর পরও ছাড়া ছাড়া অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি অনেকক্ষণ। কোনো আগা মাথা নেই কোনো স্বপ্নেরই। একবার দেখলাম আমার কোচ খালেকুজ্জামান স্যার আমার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁত বের করে হাসছেন। তারপরই আমি সুন্দরবনে একটা গাছের ওপরে, মাচায়। টোপ ফেলে বাঘ মারতে এসেছি। বাঘ এলো, কিন্তু বাঘটা পূর্ণবয়স্ক না, বাচ্চা…তারপরই দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন, তার চারপাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জামশেদ, কখনো ভুলবে না আমি কে ছিলাম। খুব সাবধান। আসল নকল বিচার করবা, বাবা, আসল নকল বিচার করবা….” এরপরই আমি কমনওয়েলথে, সোনা জিতেছি, মেডেল নেবার জন্য প্ল্যাটফর্মেও উঠেছি, কিন্তু পদক না, কর্তৃপক্ষ যা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, সেটা একটা হাতকড়া…সোনার হাতকড়া…

একটা ভট ভট শব্দে চিন্তার সুতো ছিঁড়লো আমার। তাকিয়ে দেখলাম, একটা মটরসাইকেল এগিয়ে আসছে এদিকেই। খানিক বাদেই বাংলোর আঙিনায় চলে এলো ওটা। মটর সাইকেলটার সাইলেন্সার নষ্ট নিশ্চয়ই, কারণ ওটার আশি সিসি ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে কান পাতা দায়, কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছি মটরসাইকেলের আরোহীর দিকে।

পুলিশ।

খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ।

রিভলভারওয়ালা একজন পুলিশ।

মাথায় ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে আমার। হচ্ছেটা কি? কালকে এত রাতে এলাম, আর আজ সকালেই পুলিশ হাজির? তাহলে কি পুলিশ সব জেনে গেছে? কে জানালো? রাশেদ? কিন্তু বোমা মজিদের সাথে তার অ্যাসোসিয়েশনের কথা ফাঁস হয়ে যাবার ঝুঁকি সে কেন নিলো? তাহলে কি বোমা মজিদের সাথে থাকা কেউই পুলিশকে ইনফর্ম করেছে? যে-ই ইনফর্ম করে থাকুক, আমি যে এখানে আছি, জানলো কি করে? পুলিশ ঢাকা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে আমাকে ফলো করে এলো কি করে?

শিপলুর দিকে তাকালাম। একদম ফ্যাকাশে মেরে গেছে ও-ও। বিড়বিড় করে কেবল বললো একবার, “পুলিশ!”

পুলিশটা বারান্দার কাছাকাছি এসে মটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে আয়েশ করে ভুঁড়ি দুলিয়ে নামলো ওটা থেকে। বেশ নাদুস নুদুস চেহারা লোকটার। কুচকুচে কালো গায়ের রং। মাথার সামনের দিকে টাক। টুপিটা কাঁধের শোল্ডার ব্যাজের ভেতরে গুঁজে রাখা, কেন কে জানে। ঘামছে সে, পকেট থেকে রুমাল বের করে টাকের ঘাম মুছলো। তার যে মাত্র কয়েক হাত দূরে বারান্দায় আমরা বসে আছি, সেটা যেন চোখেই পড়েনি তার। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাদের গাড়িটাকে জরিপ করলো বেশ আগ্রহ নিয়েই।

“কথা যা বলার আমাকেই বলতে দিস,” ফিসফিসিয়ে বললো শিপলু।

বাংলোর বাইরের সবকিছু যেন চোখের ভেতরে গেঁথে নিয়ে শোল্ডার ব্যাজের ভেতর থেকে টুপিটা বের করে মাথায় দিলো সে, তারপর বারান্দায় উঠে এসে সরাসরি দাঁড়ালো আমাদের সামনে।

লোকটার শরীর-স্বাস্থ্য দশাসই হলেও, চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ধারালো। সেই চোখে একবার আমার দিকে, আরেকবার শিপলুর দিকে তাকালো সে। আমরা দু- জনই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি।

পালা করে তিন-চার বার আমার আর শিপলুর মুখের দিকে দেখার পরে আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ হেসে হাতটা এগিয়ে দিলো সে।

“আপনিই মনে হয় শিকারিসাহেব?” রংপুরিয়া টানে বলে উঠলো সে, মুখে একান-ওকান জোড়া দন্ত বিকশিত হাসি।

গোটা ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে সম্বিত ফিরতে ফিরতে সেকেন্ড দুয়েক খরচ করে ফেললাম আমি, তারপরই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার হাত ধরলাম। “আ- আপনি?”

“দারোগা মফিজ উদ্দিন।” মুখে হাসি ধরে রেখেই বললো লোকটা। “কালকে রাইতে আপনারা আসছেন শুনলাম। অত রাইতে তো আর দেখা করা যায় না। তাই বিহান বেলা চলি আইলাম।”

লোকটার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি এখন। শিপলু আমার শিকারি স্ট্যাটাসটা বেশ ভালোভাবেই চাপিয়ে দিয়েছে, আর যাই হোক। বুকের ওপর থেকে যেন এক মণ সাইজের একটা পাথর নেমে গেছে আমার। চোরের মন যে আসলেই পুলিশ পুলিশ, হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়ে গেলাম সেটা।

আমি পরের কথাটা কি বলবো ভাবছি, এমন সময় পর্দা ঠেলে বারান্দায় হাজির সামাদ। ওর মুখে কখনো এক্সপ্রেশন ভালোভাবে আসে না, সব সময় গম্ভির। কিন্তু মফিজ দারোগাকে দেখে তার চেহারাটা হলো দেখার মতো। ভুত দেখার মতো ফ্যাকাশে মুখ, চোখ বিস্ফোরিত, কাঁধ ঝুলে পড়েছে হাল ছেড়ে দিয়েছে যেন, জেলে গিয়ে পঁচিশ বছর ধরে পাথর ভাঙার নিয়তি মেনে নিয়েছে। শিপলু তাড়াতাড়ি “সামাদ, আরো দুইটা চেয়ার দিতে বলো তো আমজাদ আলীকে,” বলে ওকে ভেতরে পাঠিয়ে না দিলে ও যে আরো কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো, কে জানে।

গোটা ব্যাপারটা সামলে নিয়ে আরেকদফা চা নিয়ে বারান্দায় সামাদসহ আমরা চারজন জেঁকে বসতে আরো দশ মিনিট পেরিয়ে গেল।

মফিজ দারোগা চায়ের কাপে ফড়ফড় করে একটা চুমুক দিয়ে চিন্তিত চোখে তাকালো আমার দিকে। “জামশেদসাহেব, গ্রামের মানুষ কি যে ভয় পাইছে, আপনাক কয়া বুঝাবার পারবো না। সবার মাথা খারাপের অবস্থা। সন্ধ্যার পর বাড়ি থাকি বাইর হওয়া তো বাদ দিছে কবে। এখন তো দিনের বেলাও বাইর হইতে ভয় পায়। আমি আর কি সাহস দেবো। তিনটা মানুষ মরলো, কিছু কইরবার পারলাম না। আমার কতা মানুষ কেন শুনবে কন?”

আমি ফিলানথ্রপিস্ট না, মানুষ ডিল করা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই আমার। বিশেষ করে তারা যদি দেশের দরিদ্রতম জেলার অশিক্ষিততম মানুষ হয়। কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, “জন্তুটা না থাকলে ওদের ভয় থাকবে না। সাহসও ফিরবে।”

“জন্তু?” চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে ঝুঁকে এলো মফিজ দারোগা। “শিকারিসাহেব, আপনি এত শিওর হইতেছেন কেমন করি যে ওইটা কোনো জন্তু?”

ভুরু দুটো ওপরে তুলে লোকটার তেলতেলে কালো মুখের দিকে তাকালাম আমি। “দেখুন আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না যে…”

“আমি কি বিশ্বাস না করি সেটা তো ব্যাপার নাসাহেব!” মফিজ দারোগার চোখ চকচক করছে। “বাস্তবতাটা দেখেন। তিন তিনটা লোক মরলো, কিন্তু কেউ পিশাচটাক চউখেও দেখতে পারলো না। ব্যাপারটা…’

জিম করবেটের বই স্কুলে থাকতেই পড়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলেছিলাম। সে জ্ঞান কাজে লাগলো এখন। “ভাই আমরা এখানে কি নিয়ে ডিল করছি, সেটা আগে দেখতে হবে। প্রাণীটা সম্ভবত বিড়াল শ্রেণীর। মানে বাঘ টাইপের। এদের শরীরের ডিজাইনটাই এমন যে হাটাচলা করতে পারে কোনো শব্দ ছাড়াই। পায়ের নিচে প্যাডের মতো থাকে। আপনার পেছন পেছন এক মাইল হেটে আসবে, টেরও পাবেন না। এদের চোখের পাওয়ারও অন্যরকম। রাতের বেলা সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পারে।”

“আপনি কইতে চাইতেছেন রংপুরে বাঘ আছে?” এখনো আমার দিকে চকচকে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগা।

“রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মোস্ট প্রোব্যাবলি নট।” ছোট বাচ্চাকে বোঝানোর মত করে ধীরে ধীরে বললাম আমি। “কিন্তু রয়েল বেঙ্গল তো দুনিয়ার একমাত্র বাঘ না। ফেলাইন গোত্রীয় প্রাণীর বংশতালিকা বিশাল। আমাদের বাড়িতে পোষা বিড়াল থেকে শুরু করে সুন্দর বনের বাঘ আর আফ্রিকার সিংহ, সবাই এরমধ্যে আছে। এই গ্রামের জন্তুটা মেছোবাঘ-চিতা-গেছোবাঘ টাইপের কিছু একটা হবে। অন্তত আমার যতদূর মনে হয়।”

“কিন্তু এইখানে আপনার মেছোবাঘই বা আসবে কোন্টে থাকি?”

“মেছোবাঘ দেশের কমবেশি অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। সেগুলো যে সব সুন্দরবনে সেঁধিয়ে আছে, তা নয়।”

“সেটাও বুঝলাম, সাহেব।” মফিজ দারোগা মিটিমিটি ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললো, “কিন্তু মেছোবাঘ মাছ না খাইয়া মানুষ খাইতে আসবে কেন?”

আমার হয়ে জবাবটা দিয়ে দিল সামাদ। “আসতেই পারে, যদি তার র‍্যাবিস হয়।”

“কি হয়?” অবাক হয়ে বললো মফিজ দারোগা।

“র‍্যাবিস। জলাতঙ্ক। এই রোগের জীবাণুর কাজই হচ্ছে মাথা খারাপ করে দেওয়া। সেটা মানুষ বা কুত্তা বা মেছোবাঘ যা-ই হোক।” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সামাদ, যেন চশমার ওপর দিয়ে অবাধ্য ছাত্রের দিকে কটাক্ষ করা হেডমাস্টার। “তখন যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়ানো শুরু করে।”

“আপনাদের কথায় আমার তো খটকা লাগতেছে ভাই।” মাথা নাড়তে নাড়তে বললো মফিজ দারোগা।

“খটকা লাগার কি আছে?” ঝাঁঝের সাথে বললাম। “আমি তো যুক্তির কথা বলছি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার।”

মফিজ দারোগা লাল চোখে তাকালো আমার দিকে। আমিও ছাড়লাম না, কটমট করে তাকিয়ে আছি সোজা তার চোখের দিকেই। লোকটার মেন্টালিটি বুঝতে পারছি অল্প-অল্প। স্থানীয় থানার দারোগা সে, বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষের কাছে সে স্বয়ং মূর্তিমান আইন। তার কথায় এখানে অনেককিছুই চলে। কিন্তু আমার কাছে পাত্তা চাইতে এসে তো লাভ নেই।

শিপলু এতক্ষণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সবার কথা শুনছিলো। পরিবেশ গরম হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে গৌতম বুদ্ধের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললো ও। “এত কথায় তো কোনো কাজ নেই। আগে গোটা জায়গাটা সরেজমিন ঘুরে দেখতে হবে, তাহলে অন্তত সিনারিওটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। দুপুর হতে অনেক দেরি আছে। রোদ এখনো চড়েনি। আমরা এখনই যদি বেরিয়ে পড়ি তো বেশ হয়।”

উঠে দাঁড়ালাম আমরা। কেউ কোনো কথা না বলে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নামছি,, শুনলাম মফিজ দারোগা বিড়বিড় করে বলছে, “সব তো ঠিক আছেসাহেব। আমাক শুধু কন, কোন বাঘ রাইতের বেলা ওইরকম করি চিল্লায়?”

ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠলো আমার, তারপর শামুকের গতিতে একটা ঠান্ডা স্রোত নামতে লাগলো শিরদাঁড়া বেয়ে। কালকে রাতের বিভীষিকার কথা মনে পড়ে গেছে।

থমকে দাঁড়ালাম আমি, সেই সাথে অন্যরাও। “আমার বন্দুকটা মনে হয় সাথে নেয়া দরকার।” কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠলো আমার, অনেক চেষ্টার পরও।

*

মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে শরতের কড়া রোদ।

এই মুহূর্তে জগদানন্দপুরের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া উঁচু মেঠো পথটা ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমরা চারজন বাদে রাস্তাটা ফাঁকাই বলতে গেলে। কেবল একটা লোক তার মান্ধাতার আমলের হারকিউলিস সাইকেলের ফ্রেমের মাঝের তিনকোণা জায়গাটায় একটা স্বাস্থ্যবান ধানের বস্তা চাপিয়ে কে জানে কোথায় যাচ্ছিলো, আমাদেরকে দেখে থতমত খেয়ে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়লো। মফিজ দারোগার চোখের ইশারায় অবশ্য আবার বুক সমান উঁচু জংধরা সাইকেলটায় চড়ে বসতে দেরি করলো না সে।

“গ্রামে কয়ঘর মানুষের বাস?” শিপলুর প্রশ্ন। আমার মাথাতেও কথাটা ঘুরছিলো বেশ অনেকক্ষণ যাবত।

“অনেক কম।” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো মফিজ দারোগা। “আঠারো বিশ ঘরের বেশি হবান্নয়।।”

একটা গ্রামের জনসংখ্যা কেমন হয় তা নিয়ে আমার ধারণা নেই বটে, কিন্তু শিপলুর মুখ দেখে বুঝলাম এই গ্রামের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কম

“এত কম!” অবাক হয়ে বললো শিপলু।

“দেশের জনসংখ্যা দশ কোটি পেরোতে চললো, আর এইখানে এত কম যে?” আমার প্রশ্ন।

“আর কইয়েন না। এই গেরামের ভাগ্যেই কুফা।” মফিজ দারোগা পিচিক করে মাটিতে থু থু ফেলে বললো। “আগে থাকি এই গেরামখ্যান আছিলো ম্যালেরিয়ার আড্ডা। বিটিশ আমলে মঙ্গা হইলো। কত যে মানুষ মরছিলো ঠিক নাই। মানুষ নাকি ওই সময় খিদায় মাটিও খাইছে, এমন কথা শুনছি আমার দাদার কাছে। যাই হউক, পাকিস্তান হইলো। এই গেরামের আর উন্নতি হইলো না। কয়েক বছর পর পর কলেরা হয়। দেখার কেউ নাই। ম্যালেরিয়া তো আছেই। কিন্তু একাত্তরের সাথে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না ভাইজান। এই গেরাম আছিল হিন্দুপ্রধান। ভদ্র মোসোলমান পরিবারও আছিলো, হিন্দুদের সাথে মিলিমিশি থাকতো। সেইটায় হইলো কাল। খান সেনারা আসিয়া…” চুপ করে গেল মফিজ দারোগা। অবশ্য নীরবতাটাও যথেষ্ট অর্থপূর্ণ। একটু চুপ থেকে বললো, “রাজাকাররাই নিয়া আসছিলো এইদিক পাকিস্তানি আর্মিরে। এই গেরামে আশ্রয় নিতে আসছিলো শহরের এক ফেমিলি। কারমাইকেল কলেজ আছে না রংপুরে? তার বাংলার পোরফেসর। পোরফেসরসাহেব আছিলেন জয় বাংলার ভক্ত। ওনাদের গেরামের বাড়ি আছিলো এই গেরামে। তেনারা আসিয়া কিন্তু বাঁইচবার পারলো না। কারমাইকেলেরই আরেক মাস্টার আছিলো, পোরফেসরসাহেবের শত্রু, রাজাকারে যোগ দিছিলো। পোরফেসরসাহেবের ফেমিলির পিছন পিছন আসিয়া …” মফিজ দারোগা আরেকবার কথা অসমাপ্ত রেখে দিল। হাটার গতি কমে এসেছে। সামনের দিকে একটা আঙুল তুললো সে। “হুই যে।”

আমরা যে উঁচু মাটির রাস্তাটা দিয়ে এগোচ্ছিলাম এতক্ষণ, সেটা থেকে আরেকটা সরু কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। মফিজ দারোগার পেছন পেছন আমরা নেমে গেলাম সেটা ধরে। রাস্তা না বলে পায়ে-চলা পথ বলে ডাকাই বোধহয় ভালো, মাটির আলের উন্নত ভার্সন। দু-পাশে দুটো পতিত জমি। তাতে আগাছা আর ঝোপঝাড়। সামনে কয়েকটা বাঁশের ঝাড়। সেখানে পায়ে চলা পথটা বেঁকে গেছে। বাঁকটা ঘোরার পরই বুঝলাম মফিজ দারোগা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে এসেছে।

জায়গাটার একটু বর্ণনা দেয়াটা সঙ্গত কারণেই দরকার। হাতের বামে বিস্তির্ণ পতিত জমি, তাতে ছাড়া ছাড়াভাবে নানান জায়গায় ভুট্টা আর ধান চাষের চেষ্টা করা হয়েছে। ফসল পেকে ঝরে গেছে অনেক আগেই, কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা যে কেউ করেনি সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। জমিটা বহুদূরে ওইদিকে গিয়ে হঠাৎ নেই হয়ে গেছে, ওদিকে সম্ভবত একটা নদী আছে। হাতের ডানে প্রথমে খানিকটা ঘন ঝোপঝাড়, তারপর প্রায় একটা দুর্ভেদ্য দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘন জঙ্গলের প্রান্তভাগ। দিনের বেলাতেও ছায়া-ছায়া অন্ধকার সেখানটায়।

সন্দেহ নেই এটাই জগদানন্দপুরের খালিভিটা

“খালিভিটা,” বিড়বিড় করে বললো সামাদ। একটা গাছের নিচে দাঁড়ানোয় ওর অন্ধকার মুখটা আরো অন্ধকার দেখাচ্ছে।

“দেশের মানুষ রাতের বেলা কোথায় শুবে সেই জায়গা পায় না, আর এইখানে এতখানি জমি পড়ে থাকার কারণ?” পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো শিপলু।

“যুদ্ধের আগে এই সবই চাষের জমি আছিলো,” মফিজ দারোগা চোখ কুঁচকে আছে, সেটা শরতের তীব্র রোদের কারণে হতে পারে। “খান সেনারা যখন গেল, এই সব জমি নেওয়ার মতো কাঁয়ো বাঁচি ছিলো না। বুঝলেনসাহেব?” শিপলুর বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে তিনটা সিগারেট বের করে নিলো সে। শিপলুর ভুরু দুটো ওপরে উঠে গিয়েই আবার নেমে গেল। “বাইশ বছর যাবত পড়ি আছে। মাঝে মাঝে কাঁয়ো কাঁয়ো চাষ করার চেষ্টা করে। এইবারও করছিলো। কিন্তু ফসল কাটার আগেই পিচাশটার উৎপাত শুরু হইলো। যা ধান ভুট্টা হছিলো সব জমিতে পড়ি আছে, দ্যাখেন না? কাটি নিয়া যাওয়ার সাহস নাই কারো।”

“আর জঙ্গল?” আঙুল তুলে দেখালাম। “আমাজনের ছোটভাই মনে হচ্ছে।”

“এই গ্রামের সবচেয়ে বুড়া লোকটার নাম হইলো পচা শেখ,” সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো মফিজ দারোগা। কথা বলার সময় ভকভকিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে তার নাক মুখ দিয়ে। “একশো বিশ বছর বয়স। তাক জিজ্ঞাস করছিলাম এই জঙ্গল কখন থাকি আছে। সে কইছিলো সে জানে না, কিন্তু তার দাদারা যখন এইদিকে বাড়ি বানায়, তখন থাকিয়া এই জঙ্গলটা দেখতেছে। যখন এই এলাকাত মানুষ থাকতো না,সাহেব, তখনো এই জঙ্গল ছিলো।”

“মানুষ কেটে সাফ করে না কেন?”

মফিজ দারোগা এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমার মাথাটা গেছে, এই মুহূর্তে আমাকে হেমায়েতপুরে পাঠিয়ে শক ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার। “কী যে কনসাহেব! মাইনষের জানের ভয় নাই?”

“জানের ভয় মানে?”

“এই জঙ্গলোত ঢুকিয়া আইজ পর্যন্ত কেউ বত্তা বাইর হইতে পারে নাই। “ থমথমে গলায় বললো মফিজ দারোগা।

বত্তা শব্দটার মানে নিশ্চয়ই জীবিত। কী আর বলবো এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোককে? কেবল বললাম, “তাই নাকি?”

“হ।” গম্ভির মফিজ দারোগা কষে টান দিলো সিগারেটে, সুঁচালো বানিয়ে ফেললো সিগারেটের সামনের আগুনটাকে। তারপরই এক কাঠুরের গল্প শুরু করলো, পেটের দায়ে পড়ে সাহস করে এই জঙ্গলে কাঠ কাটতে ঢুকে কি বীভৎস মৃত্যু হয়েছিল তার। এইধরণের গল্প দেশের সব গ্রামের মানুষের ঝুড়িতেই একটা-দুইটা আছে, শিপলুর সাথে ঘুরে জানা হয়ে গেছে আমার। কাজেই কান দিলাম না বড় একটা। হুঁ-হাঁ করতে করতে বরং চারপাশটা দেখে নিতে লাগলাম যতদূর সম্ভব। কারণ পাগলা জন্তুটা যদি কোথাও থেকে থাকে তো সেটা নিশ্চিতভাবেই এই জঙ্গল। জায়গাটার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়াটা খুবই দরকার।

হাতের বামের পতিত জমিটা জরিপ করার দরকার আছে কি? আছে, কারণ ওটার বেশিরভাগ জায়গা ঢাকা ঘন ভুট্টা গাছের সারির আবরণে। বেশিরভাগ গাছই মরে শুকিয়ে ঝুনো হয়ে গেছে। ভুট্টা পেকে-টেকে মাটিতে পড়ে একাকার। ওইখানে জানোয়ারটার আস্তানা থাকতেই পারে। ভুট্টার খেতকে বন ভেবে নিয়ে সেখানে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানানো একটা শেয়ালের জন্য খুবই সম্ভব। মেছোবাঘ হয়তো পছন্দ করবে না। তার জন্য ভালো জায়গা হবে উল্টোদিকের বনটা। মফিজ দারোগা তো বলছেই, গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজন জঙ্গলের এদিকটায় মোটেই আসে না। ওইদিকেই মনোযোগ দেয়া যাক।

মফিজ দারোগাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জঙ্গলের কিনারায় হাটাহাঁটি শুরু করলাম আমি। গোটা জিনিসটা কতটা জায়গা জুড়ে আছে, তার আন্দাজ পাবার চেষ্টা করছি। আর ভাগ্যক্রমে কোনো ট্র্যাক পাওয়া গেলে তো কথাই নেই।

যেন আমার হয়েই সামাদ নিচু গলায় প্রশ্ন করলো, “বনটার সাইজ কেমন হবে?”

“চাইর-পাঁচ কিলোমিটার হইবে,” মফিজ দারোগা গম্ভির গলায় বললো। তার গল্পে আমার কান না দেবার ধৃষ্টতা নিশ্চয়ই হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। “এইপাকে দেখেন। ভুট্টার জমিটা ওইদিক যায়া আর নাই, দেখেন? ওইপাকে একটা ছোট নদী আছে। ঘাঘট নদী। নদীটা ওইপাকে যায়া একটা বাঁক নেছে। জঙ্গল এপাকে শুরু, ওপাকে নদীর সাইড পর্যন্ত যায়া শ্যাষ। নদীর ওইপাড়ে আবার আছে শ্মশানঘাট।”

“এই পতিত জমিটা, যেখানে এখন ভুট্টাখেত, সেখানে বোধহয় গণকবরও আছে, তাই না?” শিপলুকে বলতে শুনলাম।

জঙ্গলের সামনে অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা জায়গার ঘনত্ব একটু অদ্ভুত মনে হলো। সেইদিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কাঁধে স্ট্র্যাপে ঝোলানো ছিল রাইফেল, সেটা এখন নামিয়ে হাতে নিলাম আমি।

“হ।” অবাক গলায় বললো মফিজ দারোগা। “আপনি জানলেন কেমন করি?”

“অনুমান করলাম।” তৃপ্ত স্বরে বললো শিপলু। “উত্তরাঞ্চলের মানুষ সহজ-সরল বটে, কিন্তু ফাঁকা পড়ে থাকা চাষের জমি দখল না করে ফেলে রাখার মতো বোকা নিশ্চয়ই নয়। যেটুকু ভুট্টাগাছ আছে তা দেখলে বোঝা যায়, কয়েকটা জায়গা সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে চারা পোঁতা হয়েছে। যেসব জায়গায় ভুট্টা গাছ নেই সেগুলো খুঁড়তে গিয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছিল নিশ্চয়ই, আর সেজন্য জমিটার পুরো দখল নেয়নি কেউ, পতিত পড়ে আছে।”

“হুম।” বললো মফিজ দারোগা। “নদীর সাইডে মানুষ দাঁড়া করায়া গুলি করি মারছিলো পাকিস্তানি শোহোরের বাচ্চারা। কিছু লাশ পানিত ভাসি গেছিল। যেইগলা যায় নাই, সেইগলা গ্রামের মানুষেই মাটিত গর্ত করি পুঁতি থুছিল।”

দোমড়ানো ঝোপটার কাছে গিয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল আমার। ঝোপটার মাঝ দিয়ে একটা ট্রেইল দেখা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই এইদিক দিয়ে কোনো কিছু চলাফেরা করে। নিয়মিত চলাফেরা করে। কারণ ঝোপটার মাঝের ফাঁকটা একদিনে তৈরি হয়নি।

নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। কাঁপছে ওটা। বেশ কয়েকবছর আগে থেকে এই সমস্যা আমার, সেই কমনওয়েলথের বাছাইতে বাদ পড়ার পর থেকে।

সব সমস্যারই সমাধান থাকে। আমার সমস্যারও আছে। আমি রাইফেলটা দ্রুত কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে আমার চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা বের করে ছিপি খুলতে শুরু করলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরলো কে যেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখি কখন যেন ঠিক আমার পেছনে হাজির হয়েছে মফিজ দারোগা। লোকটা বেড়ালের মত নিঃশব্দে চলাফেরা করে দেখছি।

“করেন কি!” দম আটকানো বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো সে। চোখদুটো যেন ঠিকরে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ওর। “মদ খাইতেছেন! করতেছেন কি ভাই!”

আমি কোনো রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে গেলাম না। “হাত ছাড়ন!”

“ছাড়বো মানে!” পাল্টা চেঁচিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আপনি কোন কাজে এইখানে আসছেন ভাই? মাল খায়া কি সেই কাজ হয়?”

“আপনি আমার হাত ছাড়বেন কিনা বলেন।” আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম। “আপনার কাজ আপনি করেন, আমার কাজ আমাকে করতে দিন।”

“আশ্চর্য!” খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আপনি মাতাল অবস্থায় একটা বন্দুক নিয়া গ্রামের মধ্যে বেড়াইবেন, আবার কইবেন আপনার কাজ আপনি করতেছেন? মাইনষের সেফটির দিকটা আমাক দেখতে হবে না?” আর এই কথাটা বলার পরপরই ঝিকিয়ে উঠলো তার চোখদুটো। “আপনার বন্দুকের লাইসেন্স তো দেখি নাই! লাইসেন্স আছে তো? লাইসেন্স দেখান! যতক্ষণ না লাইসেন্স দেখাইবেন ততক্ষণ ছাড়বো না!”

জানি দারোগার কথায় যুক্তি আছে, একজন পুলিশ অফিসার সিভিলিয়ানের বন্দুকের লাইসেন্স দেখতে চাইতেই পারে, কিন্তু এ-ও আমার জানা আছে মফিজ দারোগা ঠিক এই মুহূর্তে লাইসেন্স দেখতে চাইছে আমাকে অপমান করার জন্য, আর কিছু নয়। নাহলে কথাটা আগেও তুলতে পারতো সে, বন্দুকটা প্রথমবার বের করার সময়ই। তাছাড়া এই গ্রামে এসেছিই তো শিকার করতে মফিজ দারোগার কালচে গোল আলুর মত মুখটা বেপরোয়া দাপটে কুঁচকে আছে দেখে রাগে অন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো আমার। কোথাকার কোন পাণ্ডববিবর্জিত থানার দু-পয়সার দারোগার এত তেজ-স্রেফ এটা তার এলাকা, এইজন্য? মনে হলো যেন আমার হাত না, আমার কলার ধরে আছে লোকটা। আমি বরফ শীতল গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “দারোগাসাহেব, হাত ছাড়েন, নইলে ভালো হবে না।”

“জামশেদ!” হঠাৎ ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো শিপলু।

শিপলু আর সামাদ এতক্ষণ চোখ ছানাবড়া করে কান্ডকীর্তি দেখছিল, কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। আমাকে চটানোর সাহস ওদের নেই, আবার দারোগার কথার পাল্টা জবাব কিভাবে দেবে, সেটাও নিশ্চয়ই মাথায় আসছিলো না। কিন্তু শিপলুর গলা দিয়ে এমন শব্দ বেরোতে শুনিনি কখনো ঝট করে ওর দিকে মাথা না ঘুরিয়ে পারলাম না।

কাঠের পুতুলের মত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে শিপলু আর সামাদ, চোখ বিস্ফোরিত। শিপলুর একটা হাত সামনের দিকে তোলা, কাঁপছে ওটা, তর্জনিটা নির্দেশ করছে আমার পেছনের কোনো কিছুর দিকে।

মফিজ দারোগা হুমকির সুরে কিছু একটা বলছিলো, কিন্তু সেদিকে কান নেই আমার, ঝট করে মাথা ঘোরালাম শিপলু যেদিকে দেখাচ্ছে সেদিকে।

মফিজ দারোগা আমার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করার আগে যে-ট্রেইলটা খুঁজে পেয়েছিলাম, সেটার গোড়াতেই এখন দাঁড়িয়ে আছি আমি। শিপলু দেখাচ্ছিল ওইদিকেই। ওদিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই চোখে পড়লো না আমার-এতক্ষণ রোদ- ঝলসানো খালিভিটার দিকে তাকিয়ে থাকায় জঙ্গলের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে ভালোমত কিছু দেখতে পারছি না। আর তার এক সেকেন্ড পরেই অবয়বটা চোখে পড়লো।

চারপেয়ে কোনোকিছুর অবয়ব। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে ওটা। আর এইদিকে আমার বন্দুক-ধরা হাত আটকা পড়ে আছে দুর্নীতিবাজ এক পুলিশের হাতে। আরেক হাতে মদের ফ্লাঙ্ক।

জানোয়ার ঠিক কি, সেটা বুঝতে পারছি না আমি, কিন্তু বুঝতে পারছি গুঁড়ি মেরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ওটা, আর ওটার গলার গভির থেকে বেরিয়ে আসছে একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ

মফিজ দারোগা কিছুই দেখেনি, কিছুই জানে না। ঘৃণায় বিকৃত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে, লোহার সাঁড়াশির মত শক্ত হাতে ধরে আছে আমার হাত।

আমি ঝটকা দিলাম একটা, কিন্তু ছাড়িয়ে আনতে পারলাম না আমার হাত। শিপলু আর সামাদ চেঁচাচ্ছে মফিজ দারোগার উদ্দেশে, কিন্তু ওরা তো আমারই লোক, তাদের কথায় আমার হাত কেন ছাড়বে সে?

জানোয়ারটা খুব কাছে এগিয়ে আসছে। ওটার ঘড়ঘড় শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি এখন-আমার থেকে দশ ফুট দূরেও আর নেই ওটা।

“ছাড়েন বলছি!” মফিজ দারোগার মুখের ওপর চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “আপনি বুঝতে পারছেন না-”

“কি বুঝবার পারতিছি না?” পাল্টা খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “লাইসেন্স না দেখাইলে-”

মরিয়া হয়ে প্রচন্ড একটা ঝটকা দিলাম আমি, কোনোমতে ছাড়িয়ে আনলাম আমার হাত, একই সাথে ঘুরে গেলাম বামদিকে, জানোয়ারটা আছে ওদিকেই।

রাইফেলটা শুধুই ডানহাতে ধরা আমার, কিন্তু একহাতে গুলি করতে পারবো না, সম্ভব না। বাম হাতে ধরা মদের ফ্লাঙ্কটা ফেলে দিয়েই রাইফেল ধরলাম, বামে ঘুরছি এখনো। রোদে ধাঁধানো চোখে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না বলে প্রচন্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।

আমার আধপাক ঘোরাটা সম্পূর্ণ হয়েছে, জানোয়ারটার মুখোমুখি এখন আমি। কেবল আউটলাইনটা দেখতে পাচ্ছি ওটার, আর তাতেই বুঝতে পারছি, এক্ষুণি ঝাঁপ দেবে।

রাইফেলের বাটটা কাঁধে ঠেকতে না ঠেকতেই ট্রিগার টানলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *