শ্বাপদ সনে – ৭

অধ্যায় ৭ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে

রাস্তাটা কাঁচা। বেশ উঁচুনিচু। খানাখন্দে পড়ে বারবার লাফিয়ে উঠছে গাড়িটা।

মেইন রোড থেকে নেমে এসে কাঁচা একটা অন্ধকার রাস্তা ধরে চলেছে ওটা। গাড়ির সামনে হেডলাইটের আলো বাদে এই দুনিয়ায় আর কোনো আলো আছে বলে মনে হচ্ছে না।

শিপলু আর সামাদের মুখে কোনো কথা নেই। শিপলু এমনকি সিগারেটও খাচ্ছে না অনেকক্ষণ যাবত। গাড়ির জানালার ওপর একটা হাত আলগোছে রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামাদ রোবটের মত গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর থেকে আমার সাথে কোনো কথা হয়নি ওর।

নাকি হয়েছে?

গাড়িতে কখন উঠেছি, কয়টার সময়, সাথে কি কি নিয়েছি, বাসা ছেড়ে আসার সময় আক্কাস মিয়াকে কি বুঝ দিয়েছি—কিছুই মনে আসছে না।

কিচ্ছু না।

গাড়িতে ওঠার আগের আমার সর্বশেষ স্মৃতি হচ্ছে গলির ভেতর ওই শুটআউট। যাতে বোমা মজিদকে খুন করেছি আমি। ব্যাপারটা মনে হতেই পাকস্থলিটা মোচড় দিলো আমার। একটা মানুষকে মেরে ফেলেছি আমি! হ্যা, বোমা মজিদ আমাকে একেবারে তুচ্ছ এক কারণে মারতে এসেছিলো—সেটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে একেবারে মেরেই ফেলেছি ওকে! একটা মানুষ খুন কোনোমতেই ‘চাইলাম, ভুলে গেলাম টাইপের ব্যাপার নয়। গোটা ব্যাপারটা আমাকে বহুদিন তাড়িয়ে বেড়াবে। না, ভুল বললাম। বহুদিন নয়, সারা জীবন।

বিবেকের তাড়না-ফাড়না বাদ দেই…কিন্তু আইন? বোমা মজিদ যত বড় খুনিই হোক না কেন, আই অ্যাম নট দ্য জাজ, জুরি অ্যান্ড এক্সিকিউশনার। আইন নিজের হাতে তুলে নেবার কোনো অধিকার তো আমার নেই। পুলিশ ধরতে আসবে না আমাকে?

আসতে পারে। আবার না-ও আসতে পারে।

আসতে পারার পক্ষে যুক্তি কি? যুক্তি একটাই, আমি তাকে খুন করেছি। সত্যি খুন করেছি। পুলিশ ভুঁড়ি কাঁপিয়ে না ঘুমিয়ে একটু ভালোভাবে তদন্ত করলেই আমার সাথে ওই তুমুল শুটআউটের সম্পর্ক বের করে ফেলতে পারবে।

কিন্তু আমাকে ধরে ফেলাটা এত সহজ হবে না। আমি যে খুন করেছি, তার সাক্ষি কে দেবে? বোমা মজিদের তিন বা চার জন আহত সঙ্গি, আর শিপলু-সামাদ গোটা ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শি। শিপলু সামাদ বাদ। বাকি যে কয়জন থাকলো, ওরা আর কি সাক্ষী দেবে? ওরা নিজেই তো আসছিলো আমাকে মারতে। বিশ্বাসযোগ্য গল্প খাড়া করানো কঠিন হবে ওদের পক্ষে। নিজেদেরকে বাঁচাতে পারবে না।

কিন্তু রাশেদ? পুলিশকে প্রচুর টাকা যদি সে খাওয়ায়, ধরুন কোটি দুয়েক…এই ‘৯৩ সালেও দুই কোটি টাকা অনেক কিছু।

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম আমি। হ্যা, আমার মাথার ওপর বিপদের খড়গ ঝুলছে, সেটা ঠিক। এখন ঢাকা থেকে দূরে থাকাটাই ভাল। রংপুরে কয়দিন কাটিয়ে অ্যালিবাইটা যদি কয়েকদিন পিছিয়ে দেখাতে পারি, নানাজনকে টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ রেখে, তাহলে কোর্টকে দেখাতে পারবো গোলাগুলির রাতে আমি ছিলাম ঢাকা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে। সুতরাং চলে এসে ভালোই করেছি।

নিজের গোঁফে তা দিয়ে খানিকটা সময় পার করলাম। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস এসে মুখে লাগছে, দারুণ অনুভূতি। সামাদ ঠিকই বলেছিলো, গ্রামে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসা দরকার আমার। বিশেষ করে এই সময়ে।

কিন্তু সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, এই যে এতদূর রাস্তা ক্রস করে দেশের আরেক মাথায় আসলাম, সেই দীর্ঘ যাত্রার কোনোকিছুই আমার মনে নেই কেন? সকালে কখন গাড়িতে উঠলাম? ঢাকা কখন ছাড়লাম? যমুনা নদীর ফেরি কখন পার হলাম?

ওইসব স্মৃতির বদলে শিপলুর সাথে বিচ্ছিরি এক বাড়িতে গিয়ে ভয়ানক একটা জিনিস দেখার স্মৃতি কেন আমার মাথায়? সুস্থ স্বাভাবিক কোনো মানুষের তো এমনটা হয় না।

সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে সাক্ষাতের কথা মনে হলো আমার। লোকটার কথাগুলো আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিত ছিলো।

সত্যিই কি আমার কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে?

কমনওয়েলথে যাবার আগে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম। আমার বাবার মৃত্যু। আইরিনের সাথে ঝামেলা। আর কালকে রাতে বোমা মজিদকে…আমার মগজে চাপ দেবার মতো কম ঘটনা ঘটেনি।

“এবার কোনদিকে, শিপলু ভাই?” সামাদের প্রশ্ন। হেডলাইটের আলোতে দেখতে পাচ্ছি কাঁচা রাস্তাটা এক চৌরাস্তায় এসে পড়েছে। চৌরাস্তাটা ঘিরে একটা গ্রাম্য বাজারের মত, যতদূর বুঝতে পারলাম। সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ অবশ্য। কোথাও জনমনিষ্যি নেই।

“ডানের রাস্তাটা দিয়ে যেতে থাকো,” শিপলু মাথা বাড়িয়ে বাইরে দেখে বললো।

ডানের রাস্তাটায় মোড় নিলো গাড়ি। এই রাস্তাটার দু-পাশে মোটা মোটা গাছ, নিঃশব্দে উল্টো দিকে সরে যাচ্ছে।

আরো কিছুক্ষণ যাবার পরে হঠাৎই হেডলাইটের আলোয় ভোজবাজির মত উদয় হলো একটা বাড়ির অবয়ব। যতদূর বুঝলাম, বৃটিশ ধাঁচের পুরনো ইঁটের তৈরি দালান, লাল টালির ছাদ। দালানটার সামনে ঝোপঝাড়ে ভরা, অন্ধকার, বেশ কয়েকটা গাছও আছে। সম্ভবত এককালে পুরো বাংলোটা ঘিরে একটা খাটো প্রাচীরের মত ছিলো, এখন সেটার ধ্বংসাবশেষ আছে মাত্র। বোঝাই যায় এইদিকে মানুষের পা খুব একটা পড়ে না।

“এই বাংলোটার কথাই বলেছিলাম,” আমাকে না, যেন বাতাসকে বললো শিপলু।

প্যাঁ প্যাঁ করে হর্ন বাজালো সামাদ। কয়েক সেকেন্ড পরই হারিকেন হাতে বাংলোর বারান্দায় উদয় হলো সাদা দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা এক লোক। বাংলোর কেয়ারটেকার হবে হয়তো।

গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সামাদ। শিপলু দরজা খুলে নেমে এগিয়ে গেল হারিকেনওয়ালা বুড়োর দিকে। বারান্দায় উঠে বুড়োকে কি কি যেন বললো ও, বুড়ো মাথা নেড়ে হারিকেনটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলো। দরজা খুলে নেমে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্কটা খুলে দিল সামাদ। মালপত্র নামাতে লাগলো বুড়ো।

গাড়ি থেকে নামলাম আমিও। শরীর খুব একটা ভালো লাগছে না, মাথাটা যেন ঘুরছে একটু-একটু। আমি কি ড্রিঙ্ক করছিলাম? তা-ও মনে নেই! অ্যামনেশিয়া বলবো এটাকে, না ব্ল্যাকআউট? এমনটা কখন হয় মানুষের? সামাদের কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিতে হবে।

বাতাসটা বেশ তাজা। বুক ভরে কয়েকবার দম নিলাম আমি। মাথাটা একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে যেন। খিদেও লেগেছে বেশ।

বাংলোটার দিকে তাকালাম। ওটার জানালাগুলো অন্ধকার, যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে অশুভ দৃষ্টিতে। বারান্দায় শিপলুর কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। ও আরেকটা সিগারেট টানার জোগাড়যন্তর করছে।

“এদিকে এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি দেখছি।” যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলাম আমি। গাড়িতে যে কান্ডটা করেছিলাম, সেটার পর থেকে এখনো শিপলু আর সামাদের সামনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না।

“দেশের কত জায়গায় কারেন্ট আছে আর কত জায়গায় নেই, সেটার রেশিও করলে অবাক হয়ে যাবি, মনে হবে কারেন্ট থাকাটাই অস্বাভাবিক,” হেসে বললো শিপলু। “আশা করি দুই হাজার সাল আসতে আসতে দেশের সব জায়গায় কারেন্ট পৌঁছাবে।”

হারিকেনটা তুলে নিলো শিপলু। “চল একটু ভেতরটা কেমন, দেখে নেই। বহু পুরনো যদিও, তবু আশা করি কয়েকটা দিন ভালোমতই থাকতে পারবো।” কাঠের দরজাটায় ঠেলা দিল ও। ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে গেল ওটা।

হারিকেনের হলদে আলোয় প্রথমের ঘরটা একটা বসার ঘর বলে মনে হলো। কয়েকটা মলিন সোফা পড়ে আছে। দেয়ালে কয়েকটা চেনার অযোগ্য পেইন্টিং ঝুলছে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই ঘরে এসে ঢুকলো সামাদ, আর সেই বুড়োটা। শিপলু বললো, “ইনি এই বাংলোর কেয়ারটেকার, আমজাদ আলী। খুব কাজের মানুষ।”

লোকটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। শকুনের মতো জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে অদ্ভুত এক ভাব, যেটাকে ঠিক কিসের সাথে তুলনা করবো জানি না। আমার বিস্মিত চেহারা দেখেই যেন স্বাভাবিক হলো বুড়ো। বললো, “আসেন, আপনাদেক গোছলখানা দ্যাখে দেই। হাত মুখ ধুয়া নেন, আমি খাবার দাবার গুলা সাজে থুচ্ছি।”

বুড়ো এগিয়ে গেল। আমি ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে আছি।

*

“রান্না কাকে দিয়ে করিয়েছ, আমজাদ আলী?” মুরগির হাঁড় চিবুতে চিবুতে বললো শিপলু।

“হালিমের মা। এই গ্রামোতে থাকে। কেউ বাংলোয় থাকবার আইলে রান্না-বান্না করি দেয়।”

“যাক, আমার মানি অর্ডার পেয়েছো তাহলে। এইটা নিয়েই টেনশনে ছিলাম।” শিপলু বললো।

“হ। সময়মতোই আসছে। মুরগি কিনি থুইছি আরো দুইটা। কাইল খাওয়াবো ঘাঘট নদীর মাছ।” শিপলুর প্লেটে আরেকটু ভাত তুলে দিতে দিতে বললো আমজাদ আলী। আর এই কাজ শেষে করেই আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো সে। চোখে সেই শকুনের মত দৃষ্টি। ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখা হারিকেনটার আলোয় চোখদুটো যেন জ্বলছে তার।

বেশ আরাম করেই খাচ্ছিলাম, খাওয়া মাথায় উঠলো আমার। বুড়ো এইভাবে আমার দিকে দেখছে কেন? কারণ কি? কেউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, বিশেষ করে খাওয়ার সময়ে। আমাদের বাড়ির আব্বাস মিয়া বহুবার ধমক খেয়েছে সেজন্য। আব্বাস মিয়ার চোখের দৃষ্টিতে তাও মা-মরা এই আমার জন্য স্নেহ মেশানো থাকতো, কিন্তু এই বুড়োর চোখের দৃষ্টি কুটিল।

রেগেমেগে কিছু একটা বলেই বসতাম, কিন্তু শিপলুর দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ। ও চোখ দিয়ে ইশারা করছে, চুপ থাক। আমি ভুরু কোঁচকাতেই ও স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমজাদ মিয়া, শিকারিসাহেব আজকে ক্লান্ত, বুঝলে? কালকে গোটা গ্রামটা ঘুরে দেখবো আমরা। তুমিও কালকে শিকারিসাহেবের কাছ থেকে বাঘ মারার গল্প শুনো। এখন না।”

প্রথম কয়েক সেকেন্ড বুঝতেই পারলাম না কিসের কথা বলছে শিপলু। তারপরই মাথায় ঢুকলো ব্যাপারটা। আমাকে শিকারি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে শিপলু। গ্রামবাসির সমাদর আর বাংলোতে জায়গা পাওয়াটা নিশ্চিত হয়েছে বটে তাতে, কিন্তু এই পরিচয়টা আমার নিজের কাছে এত কিম্ভুত মনে হলো যে ভাত গিলতেও ভুলে গেলাম কয়েক মুহূর্ত। বিষম খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে হলো।

কেয়ারটেকার আমজাদ আলী অবশ্য এখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে, একইভাবে। অবশ্য তার ওইরকম দৃষ্টির অর্থ আমার কাছে এখন স্পষ্ট, কৌতূহল। নির্বোধটার ধারণা তার গ্রামকে একটা রহস্যময় জন্তুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছি আমি, আর তাতেই আমাকে নিয়ে এত কৌতূহল তার।

“সাহেব অনেক বাঘ মারছেন বুঝলাম,” বললো আমজাদ আলী, একইভাবে তাকিয়ে আছে, কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। “কিন্তু হামার গ্রামের এখান তো বাঘ না! অন্যকিছু! উয়্যাক চোখ দিয়া দেখা যায় না, এমন জোরে দৌড়ায়! দৌড়াইলে কোনো শব্দ হয় না! বিলাই দৌড়াইলেও শব্দ হয়, কিন্তু এই পিচাশ দৌড়াইলে হয় না, বোঝনেন বাহে?”

পিচাশ, মানে কিনা পিশাচ। আমার হাসি পেল। ব্যাটারা কোন যুগে বাস করে? উনিশশো তেরানব্বইতে, না আঠারোশো তেরানব্বইতে?

“কয়জন মারলো পিশাচটা?” স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো শিপলু।

চোখ ঘুরিয়ে তেরছাভাবে ছাদের দিকে চাইলে আমজাদ আলী, গভির ভাবনার ছাপ চোখে-মুখে। যেন সে মস্ত বড় কোনো মহাকবি, নিজের লেখা মহাকাব্য স্মরণ করার চেষ্টা করছে গোড়া থেকে। “সবার পোথমে তো মরলো আপনার রাজ্জাক মিয়ার পোষা গাই গরুটা। সবায় আমরা খুব দোক্ষ পাইছলাম বাহে। গরীব মানুষ, তায় গরুটা পুষছিল এইবারবহুত আশা করিয়া, বোলে যদি এখান বাছুর হয় তাইলে দুধও বেচাইবে, বাছুরটাকো পালবে…”

“গরুটা কিভাবে মরলো তাই বলো,” তাড়া দিলো শিপলু।

“হ হ। গরুটাক চরাবার নিয়া গেছিল খালি ভিটাত। সে গরুও আছিল চঞ্চল, বোঝনেন, কতা শুনবার চায় নাই। খালি দড়ি ছিড়ি পালাবার চাছিল। সেদিনও দড়ি ছিড়িয়া গেছিল জঙ্গলের ওপাকে। সইন্ধ্যাবেলা সবায় সবার গরু নিয়া গেল, রাজ্জাক মিয়া তো আসি তার গরু পায় না। শ্যাষে খোঁজতে-খোঁজতে-খোঁজতে-খোঁজতে পাইলো জঙ্গলের সাইডোত। কাঁইবা গরুটাক মারি অর্ধেকটা খায়া গেইছে!” গায়ে কাঁটা দেয় আমজাদ আলীর।

“মোট গরু কয়টা মারা গেছে?” মহাকাব্য এড়ানোর জন্যই বললো শিপলু।

“সাতটা। পোথমে হইলো আপনার রাজ্জাক মিয়ার, তারপর ছদরুলের…” আঙুলের কড়া গুনতে গুনতে বলে আমজাদ আলী।

“আর ছাগল?” তাড়াতাড়ি বলে শিপলু।

“সেখানের তো হিসাব থুই নাই। মেলা মরছে। দশটার উপরে হইবে। “ “মানুষ কয়টা মারা গেছে?” সামাদের ঠান্ডা, শীতল গলা বলে। সারাদিনে মনে হয় এই প্রথম কথা বললো ও।

“তিনজন,” আমজাদ আলী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “পোথথোমে মরি পাতা কুড়ানি চেংরিটা, অমিছা। এমনিতে ওমার দুঃখের শ্যাষ নাই, ওমার বাড়িত থাকে খালি দু-জন, অর মা আর অঁয়, মাইয়াটা সিয়ানা হছিল, কেবল বিয়ার বয়স হছিল…’

“আর?” আমি বাধা দেই।

“সিদ্দিকের বউয়ের দুধের ছইলটা। বয়স ছয়-সাত মাস হইবে। সিদ্দিকের বউ বাচ্চাটাক থুয়া কেবল খালি পানি আইনবার গেইছে পুকুর থাকি, সিদ্দিক তখনো আইসে নাই, কিষানের কাজ কইরবার গেছিল চেয়ারমেনের জমিত, আসি দেখে ছইলটা নাই! সে কি কান্দন সিদ্দিকের বউয়ের, বড় গলায় কান্দা শুরু করছিল….”

“বাচ্চাটাকে পাওয়া গেছে?” বলেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো শিপলু। “মানে, বাচ্চাটার…”

“হ, বাহে। খালিভিটাত। জঙ্গলের সাইডোত। একবারে ছিড়িবিড়ি শ্যাষ করি ফালইছল বাহে, হায়রে মাসুম দুধের বাচ্চা…”

“আর শেষেরজন?” সামাদের প্রশ্ন।

“চেয়ারমেনের ছোট ব্যাটা। রিপন। বাউদিয়া আছিল। নেশারু। জুয়া খ্যালে বেড়াছিল এ গ্রামোত ও গ্রামোত। রাইতোত বাড়িত থাইকবার চাইতো না। এই তিন চাইরদিন নিখোঁজ আছিল। এই গত জুম্মাবার খালিভিটাত পাওয়া গেছিল উয়্যার লাশ।” আমজাদ আলী কাঁপা গলায় বলে। “টুটি একেবারে ছিড়ি থুয়া গেছিল। কল্লা আলাদা হয়া গেল হয় আরেকনা হইলে।”

লোকটা বারবার খালিভিটা-খালিভিটা করছে। কে জানে কি চিজ ওটা। খাওয়া শেষ আমার, হাত ধুতে ধুতে বললাম, “খালিভিটাটা আবার কি জিনিস, আমজাদ মিয়া?”

“খাস জমি। হামার গ্রামোত যে জঙ্গলখ্যান আছে না, সেটার সাইডোত বড় একখান খাস জমি আছে, কেউ অটে যায় না। অটে…”

“জঙ্গল?” প্রায় শোনা যায়না এমনভাবে বললো সামাদ।

“হ!” চোখ বড় বড় করে বললো আমাজাদ আলী। “পিচাশটা তো অটে থাকে!” নিঃসীম অন্ধকারে জেগে উঠি আমি। প্রথম কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারি না কোথায় আছি। গোটা মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

আমি কোথায়? কিভাবে এলাম এখানে? আমি কি আমার বাসায়? লোডশেডিং চলছে নাকি? কিন্তু তাহলে জানালা দিয়ে রাস্তার আলো চোখে পড়ছে না কেন?

আমি কি…

তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে যায় সব। বোমা মজিদের সাথে শুটআউট। শিপলু আর সামাদের সাথে পালিয়ে চলে আসা। ঘন অন্ধকারে ছাওয়া এক প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানে একের পর এক মানুষ খুন।

কারেন্টবিহীন বাংলোর নিকষ কালো বেডরুম। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙলো কেন? কেউ কি আমাকে ডেকেছে?

অনিশ্চিতভাবে ‘কে’ বলতে যাচ্ছিলাম, বলা আর হলো না। আমার ভোকাল কর্ড কাঁপিয়ে কথাটা বেরেনোর আগেই টানা টানা একটা চিৎকার ভেসে এলো বাতাসে।

আমি থমকে গেছি, আর সেই সাথে রাতের শীতল বাতাসও।

আবার এলো চিৎকারটা। টানা টানা। প্রলম্বিত। যেন একটা নেকড়ে অস্তিত্ববিহীন কোনো পূর্ণিমার চাঁদকে স্বাগত জানাচ্ছে কোনো টিলার ওপরে উঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে। কিংবা অপরিসীম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনো আতঙ্কিত মানুষ। কিংবা রক্তপিপাসু একটা পিশাচ আরেকবার ক্ষুধার্ত হয়েছে।

আমি হাঁপাচ্ছি, যেন দৌড়ে এসেছি অনেকটা পথ। ঘামছি দরদরিয়ে, মাথা আর কাঁধ বেয়ে দরদরিয়ে নামছে ঘামের ধারা।

আমার একটা আলো চাই। এই অন্ধকার অসহ্য লাগছে। একটা দেশলাই চাই। পকেট হাতড়াতে গেলাম আমি। নেই। যে রাতের পোশাকটা পরেছি সেটাতে পকেটই নেই।

মাথা কাজ করছে না আমার, দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আর্তনাদ-নাকি চিৎকার বলবো ওটাকে এখনো চলছে।

স্নায়ুর ওপর প্রচন্ড চাপ ফেলছে আমার। মানুষ চোখে না দেখলে যে এত অসহায় হয়ে পড়ে, জানা ছিল না।

পাগলের মত বালিশের নিচে হাত চালালাম আমি। আছে! পেয়ে গেছি একটা দেশলাই! প্রথম কাঠিটা ধরাতে পারলাম না আমি। তুলতেই পারলাম না আসলে আঙুল দিয়ে, এতই কাঁপছে আমার হাতটা। পরের কাঠিটা বাক্সের গায়ে ঠুকতে গিয়ে ভেঙে গেল। আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে জ্বলে উঠলো তৃতীয় কাঠিটা।

ছোট বেডরুমটা চোখে পড়লো। দু-পাশে দুটো বেড। ওপাশের বেড়ে শিপলু ঘুমে অচেতন। আমার দুই কানে ঝংকার তুলছে চিৎকারের শব্দটা। আমার বন্দুক কোথায়?

সামাদ বলছিল, আমার ফেভারিট তিনটা হান্টিং রাইফেল আর পর্যাপ্ত অ্যামুনিশন আনা হয়েছে। কিন্তু কোথায় ওগুলো?

লাফ দিয়ে খাট থেকে নামলাম আমি। বসে পড়লাম খাটের পাশে। ওই তো খাটের নিচে একটা লাগেজ দেখা যাচ্ছে… আউচ!

কাঠিটা পুড়তে পুড়তে আমার হাতে ছ্যাঁক দিয়েছে। আরেকটা কাঠি জ্বাললাম আমি কাঁপা হাতে। খাটের নিচে একটা লাগেজ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে কোনো রাইফেল আঁটবে না। লাগেজটা ধাক্কা দিয়ে সরালাম আমি। ওইতো, আরেকটা লাগেজ! লম্বা! লাগেজটা খোলার আগে বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিলাম আমি। তারপর তাড়াহুড়ো করে খুলে ফেললাম লম্বা লাগেজটার ডালা।

আমার তেল-চকচকে উইনচেস্টার মডেল নাইন্টিফোর রাইফেলটা যেন হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি ছোঁ মেরে তুলে নিলাম ওটা। একটা আঙুল চলে গেল ট্রিগারে।

আমার প্রত্যেকটা পেশি টানটান। আমি তৈরি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *