অধ্যায় ৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
চায়ের কাপটায় সশব্দে একটা চুমুক দিলো শিপলু। নামালো না, কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে ওর বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমার কাঁচ ঘোলা করে দিচ্ছে। কাপের কোণার ওপর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, মুচকি হাসি ব্যাটার মুখে।
“দেশের দুই প্রেসিডেন্টের জন্মস্থান,” পরম আত্মতৃপ্তির সাথে বললো শিপলু। “মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান। দেশের প্রথম ছাপাখানা এসেছে এখানেই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মহান নেতা নুরুলদীনের জন্মস্থান।” থামলো ও একটু। “কিন্তু এখন যে অবস্থা দেখছি! শহর তো না, শহরের ধ্বংসস্তূপ মনে হচ্ছে। উন্নয়নের হ্রস্ব উ-ও দেখছি না।” মুখের ভাব বদলে গেছে ওর।
আমি জবাব দিলাম না। এই মুহূর্তে আমরা রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরের যে ভাঙাচোরা চায়ের দোকানটায় বসে আছি, সেখানটায় বড্ড ভিড়। একপাশে টুলের ব্যবস্থা, আরেক পাশে চা-ওয়ালার কাউন্টার। চা-ওয়ালার মুখের সামনে ঝুলছে পলিথিনে বন্দি পাঁউরুটি-কেক আর পাকা সাগরকলার ছড়া। এই মুহূর্তে আমার একেবারে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা গোছের এক ময়লা লুঙ্গি পরা লোক কলার দামদর করছে। চা-টা ভালো হওয়া সত্ত্বেও সেটা আরাম করে খাওয়া শিকেয় উঠেছে আমার।
হঠাৎ কাপের বাকি চা-টুকু ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শিপলু। “নাহ, এতো কাজ পড়ে আছে আর আমি স্টেশনে বসে চা খাচ্ছি! আক্কেল আর কবে হবে আমার?”
হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো সে, হতভম্ব আমিও পেছন পেছন চলে এলাম। রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে ঘিঞ্জি বাজার। রাস্তাটা পুরান ঢাকার গলির মত চিপা। রিকশা আর মানুষজনের ভিড় বাঁচিয়ে জোর কদমে কে জানে কোনখানে ছুটে চলে শিপলু, পেছন পেছন আমি। হাটতে হাটতে রাস্তার দু-পাশে নানা রকম দোকানপাট চোখে পড়ে আমার। নূরানী রেস্তোরাঁ, ঘড়ি মেরামত কেন্দ্র, মেসার্স শিকদার এন্ড সন্স, স্টেশন বাজার দোকান মালিক সমিতি, মালা বেকারি, ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরি, সিঙ্গারা হাউজ, নেহাল হোটেল, লালিয়া টেইলার্স আর আরও কত শত দোকান পেরিয়ে দুদ্দাড় করে হেটে চলে শিপলু। আমি ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। বলি, “শিপলু, একটু আস্তে হাট না! এত তাড়া কিসের?”
হাঁটার গতি না কমিয়েই ঘাড় ঘোরায় সে। শেষ বিকেলের সোনালি আলো ঝলসে ওঠে ওর বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমায় লেগে। “লেট হয়ে যাচ্ছে রে। একটা কেস স্টাডি আছে। সে লোক তো আজই আসতে বলেছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম, ধুত্!”
আমি প্রায় দৌড়ে চলেছি শিপলুর পেছর পেছন, আর ভাবছি, রংপুরের এত কিছু চিনলো কিভাবে? ও তো লক্ষীপুরের ছেলে। তবে ও নাকি এর আগে কয়েকবার এসেছিল রংপুর, নানান কাজে। তার মাঝেই এত কিছু চিনে ফেলেছে? এত অলিগলি?
আবার ঘাড় ঘোরায় শিপলু। “জানিস, এই শতকের শুরুতেও রংপুরে তুষারপাত হতো?”
জানা ছিলো না। ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলুর কল্যাণে আমার জ্ঞানের ভান্ডার দিন দিন বাড়ছে।
আমি কেস স্টাডির দিকে প্রসঙ্গ ঘোরাই। “কিসের কেস রে? কোন ক্যাটাগরি?”
“গেলেই দেখতে পাবি।” নাক বরাবর হাটা থামায় না শিপলু।
বাজার ছাড়িয়ে চলে এসেছি আমরা। রাস্তার দু-পাশে একতলা-দুতলা পাকা বাড়ি। সবগুলোই পুরনো ফ্যাশনের। পাকিস্তান আমলের পরে রংপুরে আর কোনো নতুন দালানকোঠা বানানো হয়নি নাকি? দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু কোনো বাড়ির জানালাতেই আলো জ্বলতে দেখলাম না।
“কারেন্ট নেই,” বলে উঠলো শিপলু। ভয়ানক চমকে গেলাম আমি। আমার মনের কথা জানলো কি করে ও?
“মফস্বল শহরের এই এক জ্বালা,” ঠোটের এক কোণা দিয়ে সিগারেট চেপে ধরে আরেক কোণা দিয়ে বললো ও। হাটতে হাটতেই লাইটার বের করে ধরিয়ে নিলো সিগারেট। “যখন তখন কারেন্ট গন! বিশেষ করে সন্ধ্যায় কারেন্ট না থাকলে যা বিরক্ত লাগে!”
একটা তেমাথায় চলে এলাম আমরা। একটা মাজার দেখা যাচ্ছে। “ঘোড়াপীরের মাজার,” আপনমনে বললো শিপলু, যেন আমাকে না, নিজেকেই শোনাচ্ছে। “অনেকদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন। অনেক গালগল্প শোনা যায় ওনার নামে। ঘোড়ায় চড়ে নাকি এসেছিলেন এই রংপুরে। কিন্তু কেউ জানে না উনি কোথা থেকে এসেছিলেন। খুব নাকি গরম মাজার। এইখানে এসে কোনো ভুলভ্রান্তি করলে নাকি সেই মুরিদের আর রক্ষা নেই।”
ছোট্ট পাকা মাজার। ওপরে লালশালু বিছানো। তা পাশে বসে আছে দড়ির মত শুকনো এক লোক, মাথায় পাগড়ি, লম্বা চুলদাড়ি। লোকটা একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা স্রোত নেমে গেল আমার। মানুষের চোখ যে এত শীতল হয়. জানা ছিল না।
ঘোড়াপীরের মাজারের পাশের রাস্তাটা ধরে দ্রুত এগিয়ে চললো শিপলু, আর তার পেছন পেছন আমি। আলো কমে আসছে দ্রুত, সন্ধ্যা নামছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একবার ধোঁয়া ছাড়লো শিপলু। “দেরি হয়ে যাচ্ছে রে। জোরসে পা চালা!”
নির্জন রাস্তা একটাও জনমনিষ্যি নেই। খাদ্যগুদামের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, তারপর একটা গলিতে ঢুকে পড়লো শিপলু, তারপর আরেকটায়, তারপর আরেকটায়। প্রতিটা কদমে যেন গতি বাড়ছে ওর, এই অ্যাথলেটিক আমিও ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি। কতক্ষণ বাদে জানি না, ছোট্ট একটা পুরনো ধাঁচের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ও। বাড়িটার সামনে ছোট্ট বারান্দা, সেখানে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর দেখতে পেলাম না আমি, খালি ঝোপ-ঝাড়। বাড়িটার পেছনে রীতিমত একটা জঙ্গলই আছে মনে হলো।
সিগারেটটা পায়ের তলে পিষে ফেলে বাড়িটার দিকে এগোলো শিপলু, বিড়বিড়িয়ে ‘চল’ বললো আমায়। আমি বিনা দ্বিধায় ওর পিছু নিলাম।
কলিংবেল টিপলো শিপলু। সাড়া নেই। এক মুহূর্ত থামলো ও। ঝুঁকলো দরজার দিকে, আবার চাপলো কলিংবেল।
বাড়িটার ভেতরে, যেন বহুদূরে পাখির ক্ষীণ কিচিরমিচির শুনলাম। কলিংবেলের টিউন। কিন্তু ওই পর্যন্তই, দরজা খুললো না।
একবার আমার দিক তাকালো শিপলু। নার্ভাস লাগছে ওকে। “এই ঠিকানাই তো,” বিড়বিড় করতে শুনলাম ওকে একবার করবো-কি-করবো না ভঙ্গিতে হাতটা কলিংবেল পর্যন্ত তুললো শিপলু। সুইচে ছোঁয়ালো। টিপতে যাবে, ঠিক এই সময়ে বাড়ির ভেতরে কারো পায়ের শব্দ পেলাম। পা ছেঁচড়ে হাটার শব্দ। স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেলে মানুষ যেভাবে হাটে, সেভাবে। এগিয়ে আসছে শব্দটা। ক্রমশ বাড়ছে। যেন অনন্তকাল ধরে এগিয়ে আসার পরে দরজার সামনে এসে থামলো পায়ের শব্দটা। খুট করে একটা শব্দ, করে একটা শব্দ, তারপরে ক্যাঁচ। দরজা খুলে গেছে।
আমাদের সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার চল্লিশের এদিক-ওদিক বয়স। বেঁটেখাটো। মাথার সামনের চুল পাতলা হয়ে আসছে। চোখে বাইফোকাল লেন্সের চশমা। চোখের দৃষ্টিতে মিশে আছে জিজ্ঞাসা, অসহায়ত্ব আর আতঙ্ক। আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বোধহয় কোনো ভরসা পেলো না অসিফের কেরাণিমার্কা চেহারার লোকটা, শিপলুর মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো।
শিপলুর মুখে ততক্ষণে বিশাল একটা হাসি চলে এসেছে। হাসিটা ধরে রেখেই বললো, “আমিই শিপলু। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর। আপনার সাথেই তো চিঠিতে আলাপ হয়েছিল, না? আলতাফসাহেব?”
সাথে সাথে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরলো গোবেচারা লোকটার। অস্বাভাবিক উঁচু গলায় বলে উঠলেন, “হ্যা-হ্যা-হ্যা! শিপলুসাহেব! আরে আমার কি সৌভাগ্য! আপনি সত্যি সত্যি এসে গেছেন। আরে আমার কি সৌভাগ্য!” বাড়ির ভেতরের দিকে মুখ ফেরালেন আলতাফসাহেব। “এই বিন্তির মা! বিত্তির মা! দেখি যাও কাঁয় আসছে! তুমি না কইছিলা আমার চিঠি উনি পড়িয়াও দেখবে না!” তারপর আবার আমাদের দিকে ঘুরলো লজ্জামেশানো হাসি নিয়ে। “আপনারা আসায় কী যে ভালো লাগছে আমার! বুকে নতুন বল পেলাম ভাই। এই কয়টা দিন যে কিভাবে কেটেছে, উফ! চলুন চলুন, ভেতরে চলুন, বিশ্রাম নিতে নিতে সব শুনবেন।”
একটা প্রায়ান্ধকার করিডোর পেরিয়ে ছোট্ট বসার ঘরে এসে ঢুকলাম আমরা। হলুদ একটা চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব ঝুলছে ছাদে। বেতের সোফা আছে বসবার জন্য। টিয়া সবুজ রঙের দেয়ালে কয়েকটা নকশা করা কাপড় বাঁধিয়ে ঝোলানো। পুরো ডেকোরেশনটা বলছে আমার ডিডাকশন ঠিকই ছিলো, লোকটা অফিসের কেরাণির চাইতে বেশি কিছু না।
বসলাম আমরা। আলতাফসাহেব গদগদ স্বরে বলছেন, “আজকে কিন্তু না থেকে আপনারা যেতে পারবেন না। রাতের খাওয়া তো সারবেনই।”
“হাতে সময় থাকলে সেটা সাগ্রহেই করতাম,” ভদ্রতাসূচক একটা হাসি হেসে বললো শিপলু। “কিন্তু আমাদের হাতে সময় বড্ড কম। আপনাদের বাসা থেকে বেরিয়েই আবার চল্লিশ কিলো দূরের একটা গ্রামে যেতে হবে…তো, যত তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়া যায়, আলতাফসাহেব…”
“অবশ্যই অবশ্যই,” অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আলতাফসাহেব। “আপনারা বসুন, আমি ভেতরে বলে আসছি। আর আপনারা চা না খেয়ে কিন্তু যেতে পারবেন না, আমি কিছু শুনবো না…” বলতে বলতে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেলেন তিনি।
সোফায় বসে পড়লাম আমরা। গোটা ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগছে আমার কাছে, তাই আলতাফসাহেব আমাদের কথা শুনছেন না এটা নিশ্চিত হয়ে বললাম, “ব্যাপার কি, দোস্ত? লোকটার বাসায় অলৌকিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার চলছে, বুঝলাম। কিন্তু সেটা তোকে দেখানোর জন্য এত ব্যস্ত কেন তিনি? তোর সাথে যে কয়বার ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়েছি আমি, আর তোর যে কয়টা লেখা পড়েছি, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, যাদের ভাগ্যে এইসব ব্যাপার ঘটে তারা ওগুলো প্রকাশ করতে চায় না। বিশেষ করে অচেনা একজনের কাছে তো না-ই।”
“তার কারণ তাকে আমি বলেছি, তার সমস্যাটা আমি সমাধান করে দিতে পারবো।” অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড়িয়ে বললো শিপলু।
অবাক হলাম আমি। “শিপলু, কোনো সিনেমার পরিচালককে মদ খাইয়ে মাতাল বানিয়ে তার কাছ থেকে বিখ্যাত নায়িকার স্ক্যান্ডালের খবর বের করা এক ব্যাপার, আর এরকম গোবেচারা ছাপোষা একটা লোকের কাছে নিজেকে ওঝা সাজিয়ে পত্রিকার স্টোরি জোগাড় করা…”
“দোস্ত,” আমার দিকে ঘুরে বসলো শিপলু। “অকাল্ট নিয়ে আমার আগ্রহটা আর যে কোনো কিছুর চাইতে পুরনো। ক্লাশ সিক্সে থাকতে প্রথম সুপারন্যচারাল অভিজ্ঞতা হয় আমার। তারপর থেকে যেখানে যত অকাল্টের বই পেয়েছি, পাগলের মত পড়েছি। বিদেশ থেকে বই আনিয়েছি। লাইব্রেরিতে গিয়ে সারাদিন অকাল্ট নিয়ে রিসার্চ করেছি। বাদ দিইনি কিছুই। তারপর যখন একটু বড় হলাম, তখন গোটা দেশে ঘোরা শুরু করলাম অকাল্টের খোঁজে-অদ্ভুত আর অলৌকিক ঘটনার খোঁজে। প্যারনরমাল কেস স্টাডি লিখছি আর ক’দিন হলো, কিন্তু ইনভেস্টিগেশন কিন্তু আমি আট-ন’ বছর আগে থেকেই করছি। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই নীতিতে চলেছি। কোথায় কোন গ্রামের শ্মশানে ভুত থাকে, কোথায় একটা অভিশপ্ত পোড়ো বাড়ি আছে, কোথায় একটা মেয়ের ওপর জ্বিনের আছর পড়েছে—চেক আউট করেছি সবই।”
“সবই জানি, দোস্ত। অনেকবার বলেছিস এসব আমাকে,” শান্ত গলায় বললাম আমি।
“তাহলেই বোঝ। শুনলে হাসবি, বাট আমি মনে করি অকাল্ট বিষয়ে এই দেশে আমি একজন অথরিটি। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের অন্ধকার জগতে যেসব জিনিস বাস করে, তাদের আচার আচরণ খুব ভালোভাবেই শেখা হয়ে গেছে আমার। ভেবে দেখ, সামাদ কিভাবে ডাক্তারি পাশ করেছে? প্রথমে রোগের ব্যাপারে বিশদ জেনেছে, তারপর না রোগের দাওয়াই শিখেছে! আমার ব্যাপারটাও ঠিক ও-রকম। আগে স্রেফ অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যপার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। এখন সেগুলোর প্রতিকার করতে পারি আমি-আমার বিশ্বাস।” বুকে দু-হাত বেঁধে শ্রাগ করলো শিপলু।
প্যারানরমাল ব্যাপার নিয়ে আমার মনটা বরাবরই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দোলে, কাজেই কথাটা একটু ঘোরানোর জন্যই বললাম, “রংপুরে আগেও এসেছিস মনে হয়? সব চিনিস দেখি।”
“কয়েকবার এসেছি,” শিপলু বললো। “এখানে এসেছিলাম এক তান্ত্রিকের খোঁজে। জানিসই তো, যেখানে যত ওঝা, তান্ত্রিক, জ্বিন তাড়ানো হুজুরের খোঁজ পেয়েছি, সবার পিছনেই ঘুরেছি। আর শিখেছিও প্রচুর। এই রংপুরেই এক শ্মশানে এক তান্ত্রিকের সাথে যে কত রাত কাটিয়েছি! সে লোক প্রেতচর্চা করতো, আর আমি…”
দরজার পর্দাটা নড়ে উঠলো হঠাৎ। ও-দিকে তাকিয়ে দেখি দুই পর্দার মাঝখান থেকে ছোট্ট একটা সুন্দর মুখ তাকিয়ে আছে। বাচ্চা একটা মেয়ে, বয়স সাত-আটের বেশি হবে না। পিচ্চি-পাচ্চা ডিল করার অভ্যাস আমার একদম নেই, ওটা শিপলুর ডিপার্টমেন্ট। আমার চেহারা দেখে বাচ্চাটা বেশি ভরসা পায়নি স্বভাবতই, শিপলু হেসে কাছে ডাকার পরে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। একটা ফ্রক পরনে, মাথার চুলে বেণী। চোখের নিচে কালি ওর, যেন কয়েকদিন যাবত ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত। এগিয়ে এসে বড় মানুষের মত গম্ভিরভাবে শিপলুর উল্টোদিকের বেতের সোফাটায় বসলো।
শিপলু মেয়েটার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলেও লাভ হলো না, ও কেবল বড় বড় কালো চোখ মেলে চেয়ে থাকলো, জবাব দিলো না। কে জানে বাচ্চাটাকে সারাদিন এই ভুতুড়ে বাসার ভেতর আটকে থাকতে হয় কিনা। সেক্ষেত্রে বেচারির মানসিক বিকাশের কোনো সুযোগ নেই।
আলতাফসাহেব ঘরে ঢুকলেন আরো দুই মিনিট পরে। ঘামছেন কুলকুল করে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাসার ভেতরের দিকেও তাকালেন দুই-তিনবার। অবাক হলাম আমি। আমাদের দেখে লোকটার মাঝে যে সাহস ফিরেছিলো, সেটা ইতোমধ্যেই একেবারে নেই হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কেন? শিপলুর চেহারা দেখে বুঝলাম ও-ও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা।
“বিন্তির সাথে কথা বলছেন? বেশ, বেশ,” একটা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাঁপা গলায় বললো লোকটা। “মেয়েটার মা যে কোথায় গেল! কে জানি, পাশের বাসায় বেড়াতে-টেড়াতে গেছে বুঝি। মহিলা মানুষ, হে-হে।”
আমি আর শিপলু মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম। বাসায় ঢোকার সময় লোকটা বউকে ডেকে আমাদের আসার কথা জানাচ্ছিল, তার মানে বিন্তির মা তখন বাসাতেই ছিলেন। এই মিনিট দুই-তিনের মাঝে আবার যাবেন কোথায় তিনি? বেরোতে হলে তো বসার ঘরটা পেরিয়েই বাইরে যেতে হবে। আর পাশের বাসা? এই বাসার আধ মাইলের মধ্যে কোনো বাসা আছে বলে তো দেখিনি আসার সময়।
“আচ্ছা, তাহলে কাজের কথায় আসা যাক, ভাই,” একটা বেতের সোফায় প্রায় ধসে পড়ে বসে বললেন আলতাফসাহেব। লোকটার মুখ এই মুহূর্তে কাগজের মতো সাদা। “আমার মেয়ে… বিন্তি। ওর কিছু সমস্যার কথা চিঠিতে লিখেছিলাম।”
“হ্যা,” স্বাভাবিক গলায় বললো শিপলু। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি চশমার ঝকঝকে কাঁচের আড়ালে ওর চোখদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে ভদ্রলোকের প্রত্যেকটা নড়াচড়া।
“বেশ কয়েকমাস যাবত ও রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে,” আলতাফসাহেব বললেন।
“সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। সব বাচ্চাই লাইফের কোনো না কোনো স্টেজে স্বপ্নের মাঝে কন্সট্যান্টলি ভয় পায়। ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চারা। প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি তাদের বোঝাতে চায় যে…”
“আমি স্বপ্ন দেখি না তো।” রিনরিনে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো।
ঝট করে সবাই তাকালাম বিন্তির দিকে। এতক্ষণ শিপলুর এত চেষ্টাতেও কোনো কথা না বলা মেয়েটা এবার নিজে কথা বলে উঠেছে।
“তো তুমি ভয় পাও কেন, মা?” আদুরে স্বরে প্রশ্ন করলো শিপলু
বড়বড় কালো চোখগুলো নামিয়ে নিলো মেয়েটা। নিজের বেণীর একটা প্রান্ত নার্ভাসভাবে নাড়াচাড়া করছে হাতে। “আমাকে ভয় দেখায়। আমাকে জাগায়ে তোলে তারপর ভয় দেখায়। আমি ভয় পাই।”
“রাতের বেলা? কে ভয় দেখায়, মা?” শিপলুর প্রশ্ন।
“ওইযে কালো লোকটা। লাল লাল চোখ। মাথায় চুল নাই। ছাদ পর্যন্ত লম্বা।” বিন্তির সরল স্বীকারোক্তি
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার। শিপলু পর্যন্ত থমকে গেছে। আলতাফসাহেব দু-হাতে রুমালটা মুখের কাছে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছেন, বারবার ফিরে তাকাচ্ছেন ঘরের দরজার দিকে। ঝোপজঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট এই বাড়িটাকে যেন হঠাৎ অন্ধকার কোনো জগৎ গ্রাস করতে শুরু করেছে।
“সেই বিচ্ছিরি লোকটা তোমাকে ভয় দেখায়?” সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলো শিপলু।
“না।” শিপলুর দিকে চোখ তুলে তাকালো বিন্তি। “সে লোকটা ভয় দেখায় না। আমার বন্ধু হইতে চায়। আমার সাথে খেলতে চায়। কিন্তু তার চেহারা দেখে আমি ভয় পাই। আমি আম্মুকে বলি আমি তাদের সাথে শুব কিন্তু আম্মু শুইতে দেয় না। তখন লোকটা আসে। আমার রুমের কাঠের আলমারিটা থেকে বের হয়।”
আমি থ হয়ে তাকিয়ে আছি ছোট্ট মেয়েটার দিকে।
শিপলুর চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেছে। “এইটুকুন মেয়েকে আপনারা একা একটা ঘরে থাকতে দেন?”
“আ-আসলে ওটা ওর মায়ের আইডিয়া,” হড়বড়িয়ে বলে উঠলেন আলতাফসাহেব, দরদরিয়ে ঘাম নামছে তার কাগজের মত সাদা মুখটা বেয়ে। “ব- বলে, মেয়েতো অনেক বড় হয়েছে, এখন আলাদা ঘরে—”
“হ্যা, বেশ বড়ই তো হয়েছে, আট বছর বয়স, এই বয়সে আমি কলেজে যেতাম!” ব্যাঙ্গের সুরে বলে উঠলো শিপলু। “ওর মা’কেও দেখার খুব শখ হচ্ছে, কেমন মা তার মেয়েকে—”
“উনি তো আমার আসল আম্মু না,” সহজ গলায় বলে উঠলো বিন্তি। “আমার আসল আম্মু আ-কা-শে চলে গেছে। তারপর নতুন আম্মু আসছে। নতুন আম্মু একদম পচা।”
শিপলুর অনেককিছু বোঝা হয়ে গেছে, আমারও। থমথম করছে শিপলুর মুখটা, ওকে এত রাগতে দেখিনি কখনো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও আলতাফসাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে তীব্রদৃষ্টিতে। “অলৌকিক না? যত্তসব! যা শুনলাম তাতেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা সৎ মায়ের কাছে কেমন অবহেলা আর অনাদরে আছে। আপনারও কোনো মাথাব্যথা নেই সেটা নিয়ে-নইলে মেয়েটা রাতে ভয় পাওয়া নিয়ে এরকম গল্প বানাতো না! পুলিশের গুঁতো খেলেই আবার মা-মা করে কোলে তুলে নেবেন বেচারিকে, সন্দেহ নেই! তবে তার আগে আপনার বউকে ডাকুন। মহিয়সী নারীকে দুয়েক কথা না শুনিয়ে বিদায় নিচ্ছি না আমি এ বাড়ি থেকে।”
আলতাফসাহেব হড়বড়িয়ে বলে উঠলেন, “বিশ্বাস করেন ভাই, বিশ্বাস করেন-আমি সারাদিন অফিসে থাকি. বিন্তি ওর মায়ের সাথে থাকে…আমি জানবো কি করে ওর কেয়ার ঠিকমতো হচ্ছে কিনা…সালেহা তো ওর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে না আমার সামনে কত আদর করে, কত কিছু…”
“ও-সবই লোক দেখানো!” অধৈর্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লো শিপলু। “আপনার চোখে ধুলো দেবার জন্য। কিছু মনে করবেন না ভাই, আমার তো মনে হয় একটা বানর মাথায় পরচুলা পরে মানুষ সেজে এলেও সেটা ধরতে পারবেন না আপনি, বরং তাকে খাতির করে চা খেতে বসাবেন!”
দরদরিয়ে ঘামতে থাকা আলতাফসাহেব আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, শিপলু ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত তুলে থামিয়ে দিলো তাকে। “ফ্যাচফ্যাচ করবেন না। এখান থেকে বেরিয়ে চাইল্ড নেগলিজেন্সের অভিযোগ করবো আমি পুলিশের কাছে। এখানকার সদর থানার ওসির সাথে ভালো খাতির আছে আমার, রংপুর এলেই একসাথে বসে চা-বিড়ি খাই। তারপর আবার চল্লিশ কিলো দূরের এক গ্রামে যেতে হবে। আপনার বউকে ডাকেন, যান, আমাদের সময় নাই।”
লোকটার চেহারা এতক্ষণ নিউজপ্রিন্টের মতো ছিলো, এবারে হয়ে গেল হোয়াইটপ্রিন্ট। “ওর মা, সালেহা তো, মানে, ইয়ে, মানে পাশের বাসায়…”
“মিথ্যা বলছেন। আমরা বাসায় ঢোকার সময় আপনি বিন্তির মা-বিন্তির মা বলে ডাকডাকি করছিলেন। যান, তাকে বাড়ির ভেতর থেকে ডেকে আনেন, নইলে আমিই যাচ্ছি।” ঠান্ডা গলায় বললো শিপলু। তাকিয়ে আছে আলতাফসাহেবের চোখে।
সেই দৃষ্টি দেখে হাটু কাঁপতে শুরু করলো আলতাফসাহেবের। আমি অবাক হলাম ভীষণ। লোকটা দরজা খোলার সময়ও কেমন স্বাভাবিক ছিলো, তারপর বাসার ভেতরে যাবার পর এমন কি হলো যে ভয়ে মারা যাচ্ছে সে?
বিন্তির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিলাম একবার। হতভাগিনি মেয়েটা চোখ বিস্ফোরিত করে সবকিছু দেখছে। দুনিয়ার সব সুষমা যেন ছোট্ট মুখটায়
“বিশ্বাস করুন,” ধরা গলায় বললেন আলতাফসাহেব, “আপনারা আসার আগের মুহূর্তেও বিন্তির মা’কে দেখেছি। আমরা একসাথে টিভি দেখছিলাম। দরজা খুলে দেবার পর ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি…” কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে আলতাফসাহেবের, “নেই! গায়েব!”
চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে আলতাফসাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। তারপর একবার বিন্তির দিকে তাকালো ও। “জামশেদ! তাড়াতাড়ি আয়!” বলে ছুটলো তারপরই বাড়ির ভেতরের দিকে। আমি কোনো কথা না বলে ওর পিছু নিলাম।
প্রথম যে ঘরটায় এসে ঢুকলাম, সেটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিপলু থমকে দাঁড়িয়েছে, আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ওর গায়ে। সামলে ওঠার পরপরই খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। গোটা রুমটা বরফের মত ঠান্ডা।
“টেল-টেল সাইন!” বিড়বিড়িয়ে উঠলো শিপলু। “পিচ্চিটার গল্প নেহাত গল্প নয় বোঝা যাচ্ছে!”
“লাইটের সুইচটা কোথায়?” বললাম আমি। হাঁপাচ্ছি।
“লাইট কাজ করবে না এখন।” শান্ত গলায় বললো শিপলু। “দাঁড়া!” এক সেকেন্ড পরেই শিপলুর পকেট টর্চলাইটটা জ্বলে উঠলো
পেছনে নড়াচড়া টের পেলাম। আলতাফসাহেব আর বিন্তি এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের পেছনে।
“আলতাফসাহেব!” শিপলুও টের পেয়েছে ওদের উপস্থিতি, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো না ও। টর্চের আলো ফেলে জরিপ করছে সবকিছু। ঘরটা বেডরুম কাম লিভিংরুম বলে মনে হলো। “আপনার ওয়াইফকে শেষ কোথায় দেখেছেন? এই রুমেই?”
“হুম।” ভয়ে প্রায় বুজে আসা গলায় জবাব দিলেন ভদ্রলোক।
যে দরজা দিয়ে এই রুমে ঢুকেছি, সেটা ছাড়াও আরো দুটো দরজা দেখতে পাচ্ছি রুমে। “এই দরজাটা কিসের?” হাতের ডানের দরজাটা দেখিয়ে বললো শিপলু।
“ডাইনিং রুম…ডাইনিং রুম!” কোনোমতে বললেন আলতাফসাহেব। ভদ্রলোককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে আমার নিজের হৃৎপিন্ডটাও। ঠান্ডাটা চামড়া-মাংস ভেদ করে হাঁড়ে কামড় বসাচ্ছে একেবারে।
ডাইনিং রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল শিপলু পায়ে পায়ে। আমি ওর ঠিক পেছনেই।
ডাইনিং রুমের দরজা দিয়ে ভেতরে আরো ফেললো শিপলু। ভেতরে যেন পরতে পরতে সাজানো ঘন অন্ধকার, টর্চের ক্ষীণ আলো সেটাকে ভেদ করতে পারছে কমই। সবকিছু দেখাচ্ছে কালো কালো ছায়ার মতো। স্নায়ু ওপর প্রচন্ড চাপ বসাচ্ছে।
ঘরের কোণে লম্বা একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। শিপলু ঝট করে আলো ফেললো ওটার ওপরে। নাহ, স্রেফ ফ্রিজ একটা। ডাইনিং টেবিলের নিচে আলো ফেললো, নেই কিছু ওখানে।
“যা ঘটার সব বিন্তির ঘরেই ঘটছে। ওখানে যাবার আগে শিওর হয়ে নিলাম,” আমাকে শোনানোর জন্য নয়, স্রেফ আপন মনেই বললো শিপলু। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এগোলো অন্যদিকের ঘরটায়। বিন্তির ঘর ওটা। আমাদের পেছনে বিন্তি আর ওর বাবা।
খোলা একটা ডিপ ফ্রিজের মত হু-হু করে হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস বেরোচ্ছে বিন্তির শোবার ঘর থেকে। গায়ে কাঁটা দিলো আমার। দু-হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা পাবার চেষ্টা করলাম খানিকটা।
শিপলুর নাক থেকে বেরোনো নিশ্বাস ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে টর্চের আলোর সামনে। ও এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে নিকষ আঁধারে ছাওয়া রুমটার দিকে। দরজাটার মুখে দাঁড়ালো, আলো ফেললো ভেতরে।
টর্চটার আলো বেশি নয়, কিন্তু তাতেই যা দেখার দেখে নিয়েছি আমরা।
রুমটা বেশি বড় নয়, দশ ফিট বাই দশের বেশি হবে না। তারই মধ্যে চাপাচাপি করে ঢোকানো হয়েছে একটা ছোট্ট খাট, একটা পড়ার টেবিল আর একটা কাঠের আলমারি। আলমারিটার দরজা খোলা। রুমের মাঝখানে ছোট একটা ফাঁকা জায়গা।
সেখানে খড়ের পুতুলের মত জবুথুবু হয়ে পড়ে আছে শাড়ি পরা এক মহিলা। আর তার ওপর চার হাত পায়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে বিন্তির বন্ধু।
জিনিসটার বর্ণনা কিভাবে দেব জানা নেই। মানুষের মতই দেখতে, কিন্তু চামড়ার রং কালচে ধাতব নীল, মাথায় কোনো চুল নেই, লম্বা-লম্বা হাত পা পাটকাঠির মত সরু।
আমাদের সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকালো জিনিসটা।
কানের কাছে একটানা সাইরেনের মত বাজছে আলতাফসাহেব আর বিস্তির আতঙ্কিত চিৎকার।
চোখদুটো একদম গোল জিনিসটার, টকটকে লাল রং সেগুলোর। নাকের জায়গায় দুটো গর্ত। মুখের ভেতরে বড়বড় দাঁত, রক্তে মাখামাখি। বিন্তির সৎ মায়ের গলা থেকে রক্ত খাচ্ছিলো ওটা
শিপলু আছে সবার সামনে, কিন্তু জিনিসটা যেন সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকেই
হাত পা ভাঁজ করলো নারকীয় জিনিসটা, যেন ঝাঁপ দেবে এখনই।
আমি নড়তে পারছি না। সোজা আমার দিকে ঝাঁপ দিলো ওটা।
আমার শুধু এটুকুই মনে আছে—গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি আমি, শরীরের প্রত্যেকটা পেশিতে খিঁচুনী, সারা গা ঘেমে নেয়ে গেছে, গলার ভেতরটা শুকনো খটখটে। হাত নড়াতে পারছি না, বজ্রমুষ্ঠিতে সেগুলো ধরে আছে কে যেন। নিজের শরীরটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা ফিরে পাবার কোনো উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না। নিজের চেঁচানোর শব্দে কান ঝালাপালা আমার, কিন্তু সেই শব্দ ছাপিয়েও শুনতে পাচ্ছি অন্য কারো চিৎকার। কন্ঠটা কার, কি বলছে, জানি না আমি, কিন্তু আবছাভাবে টের পাচ্ছি কন্ঠটা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিছু। কি হচ্ছে এসব? কোথায় আমি? চারপাশে এত অন্ধকার কেন? আমার চোখ কি অন্ধ হয়ে গেছে? কিভাবে? ওই জিনিসটা…ওহ, ওই কুৎসিত, ভয়ানক জিনিসটা!
তারপর হঠাৎ করেই সবকিছু স্বাভাবিক। আমার চেঁচানি থেমে গেছে, হাতে- পায়ে আর খিঁচুনি নেই। টের পাচ্ছি, আমার দুই হাতের কব্জি জোর করে ধরে আছে কেউ। ডান পাশে তাকালাম। শিপলু। শিপলু ধরে আছে আমাকে, ভয়ের ছাপ ওর চোখেমুখে, চোখ পিটপিট করে দেখছে আমাকে। আমার পাশেই বসে আছে ও। আমরা দু-জনই বসে আছি একটা ঝরঝরে গাড়ির ব্যাক সিটে।
সামনে তাকালাম। ড্রাইভারের সিটে সামাদ। রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে উদ্বিগ্ন চেহারায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
অন্ধকার ফুঁড়ে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে গাড়িটা। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি হুশহাশ করে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে।
গাড়িতে কিভাবে এলাম আমি? একটু আগেই না ওই অভিশপ্ত বাড়িটায়…
“দুঃস্বপ্ন দেখছিলি তুই,” বললো শিপলু। “ঘুমের মাঝে হঠাৎ চেঁচাতে চেঁচাতে হাত-পা ছোঁড়া শুরু করলি। যাতে আঘাত না পাস সেজন্যে তোকে ধরে ছিলাম।” আমার হাতদুটো ছেড়ে দিলো ও।
আমি কোলের ওপর টেনে নিলাম হাতদুটো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা দুঃস্বপ্ন এত ভিভিড হয়? লুসিড ড্রিমিংয়ের কেবল নামই শুনেছিলাম এতদিন, আজকে দেখলাম প্রথম। তাই বলে এত রিয়েলিস্টিক! বাসাটার ভেতরের আটপৌরে গন্ধটাও যেন এখনো আমার নাকে লেগে আছে!
“আর কতক্ষণ পরে গ্রামটায় পৌঁছাবো?” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলাম।
“ঘন্টাখানেক।”
“নাম যেন কি গ্রামটার?”
“জগদানন্দপুর।”
“সত্যিই যাচ্ছি তাহলে? না গেলে কি চলতো না?” বিড়বিড়িয়ে বললাম আমি।
গাড়ির ভেতরের আবছা আলোতে দেখতে পাচ্ছি, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। “কি হলো?” আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো জিজ্ঞাসাটা।
“সকালে ঢাকা ছেড়ে আসার আগে একটা খবর পেয়েছিলাম। তোকে বলা হয়নি। বলা ভালো তোকে বলতে চাইনি ওই সময়ে।” প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো শিপলু। ওর চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে ড্যাশবোর্ডের আলো।
আমি তাকিয়ে আছি। শুনছি।
“বোমা মজিদ হাসপাতালে নেবার পথে মারা গেছে।
কেস স্টাডি : ‘পাঁচ তলা
[শিপলুর সবচাইতে বিখ্যাত কেস স্টাডির মধ্যে এটা একটা। বরবরের মত মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল এটাও। মূল ঘটনার পরে অতিলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানান ব্যাখ্যা দিয়েছিল শিপলু-সেসব বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো।]
হাসপাতালের কেবিন ফ্লোরে উঠে একটু খুঁজতেই ৫০৮ নম্বর কেবিনটা পেয়ে গেলাম। ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই নিজে থেকে দরজা খুলে গেল ওটার। তরুণ এক ডিউটি ডাক্তার বেরিয়ে এলেন হাতের স্টেথোস্কোপটা ঘাড়ের ওপর রাখতে রাখতে। সন্ধ্যের রাউন্ড সারলেন নিশ্চয়ই। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ডাক্তার, আমি থামালাম ওনাকে। “এক্সকিউজ মি!”
“বলুন।” ডাক্তার বললেন, হাবেভাবে ব্যস্ততার ছাপ।
“এই কেবিনে নোভা (ছদ্মনাম) নামের একটা মেয়ে অ্যাডমিটেড না?” জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তারকে।
“হ্যা,” জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বললেন ডাক্তার।
“ওর অবস্থা কেমন দেখলেন?”
“মেন্টালি আনস্টেবল।” অনেক চিন্তাভাবনা করে জবাব দিলেন ডাক্তার।
“গোটা সমস্যাটাই কি মানসিক? তার সাথে শারীরিক কোনো সমস্যা যোগ হয়ে…”
“গায়ে তো হাতই দিতে দিচ্ছে না ভাই। কিভাবে বলি?” একটু হাসার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। নিজে থেকেই বললেন, “আমরা মেন্টাল হসপিটালে রেফার করে দিচ্ছি। সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। হ্যালুসিনেশনের হিস্ট্রি আছে। মনোম্যানিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। সেদিন থেকেই খালি একটাই কথা, হালচাল পত্রিকার শিপলু ভাইকে ডেকে দেন। তার নাকি একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা শিপলুকে না বলে সে কোথাও যাবে না।”
কথাবার্তার মাঝেই কেবিনের দরজা খুলে গেল আবার। বছর পঁয়তাল্লিশের এক ভদ্রমহিলা উদ্বিগ্ন চেহারায় বেরিয়ে এসে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই কি হালচাল পত্রিকার …”
“জি, আমিই।” বিনীত ভঙ্গিতে বললাম।
“তাড়াতাড়ি ভেতরে চলুন। ডাক্তাররা ওকে অনেক আগেই মেন্টাল হসপিটালে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমার মেয়ে যাবে না, আপনাকে গল্প না শুনিয়ে কোথাও যাবে না! কি যে হলো আমার মেয়েটার, সোনার টুকরো মেয়ে…” ধরা গলায় আরো অনেককিছু বলতে থাকেন ভদ্রমহিলা, আমি ধৈর্য ধরে শুনতে থাকি। তরুণ ডাক্তার অদ্ভুত চোখে আমাকে একবার জরিপ করে কেটে পড়লেন।
ভদ্রমহিলা শান্ত হয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
বেডের ওপরে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে পনের-ষোল বছর বয়সের একটা মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। চোখের কোলে কালি, মাথার চুল এলোমেলো। আমাকে দেখেই চোখ চকচকিয়ে উঠলো কিশোরির। “আপনিই বুঝি! ও আল্লা আপনি দেখি আমি যেমন কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেরকমই দেখতে!”
মেয়ের মা অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আকেবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে বুঝলাম এহেন স্বাভাবিক আচরণ গত কয়েকদিনের মাঝে ও করেনি।
চওড়া হাসি দিলাম একটা। “ভালোই হলো! প্রথম দেখাতেই যদি তোমাকে হতাশ করতাম, নোভা, তাহলে তো আমার একটা ফ্যান কমে যেত—”
“মোটেই না!” হাত নেড়ে ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো নোভা। “আপনার সব লেখা আমি পড়েছি! আপনি যদি এত হ্যান্ডসাম না হতেন তবুও আমি-”
পরের পনের মিনিটে নোভার সাথে গল্প করলাম পুরনো ইনভেস্টিগেশনগুলো নিয়ে-কোনটা আমার নিজের ফেভারিট, কোনটা করতে গিয়ে আমি নিজেই ভয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম, এসব। আমি যখন ভাবছি ওর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলবো কিভাবে, তখন হঠাৎই বলতে শুরু করলো ও।
বাইরে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আনছে, আর আমি ব্লিচিং পাউডারের গন্ধে ভরা হাসপাতালের কেবিনে বসে শুনছি আমার জীবনে শোনা সবচে’ ভয়ংকর ঘটনার একটা।
শিপলু ভাইয়া, আমরা শহরেই থাকি। আমি (বিখ্যাত গার্লস স্কুলের নাম বললো) স্কুলে পড়ি। এবার এস.এস.সি. দেবো। আমরা থাকি (দক্ষিণ ঢাকার একটা কলোনির নাম বললো) কলোনিতে। আমার এক্সপেরিয়েন্সটা এই কলোনিকে নিয়েই।
দেখেছেন মনে হয়, কলোনির বাসাগুলো একেবারে গায়ে গায়ে ঘেঁষা নয়। একটু ডিসটেন্স থাকে। আমরা যে বিল্ডিংটায় থাকি, সেটা আবার এককাঠি বাড়া। কলোনির সবচেয়ে কোণার দিকে ওটা। আশপাশটা ঝোপঝাড়ে ভরা। জায়গাটা দিনের বেলাও একেবারে নিজ্ঝুম থাকে।
আমাদের বিল্ডিংটা পাঁচতলা। ওটার চারতলায় আমরা থাকি। পাঁচ তলায় কেউ থাকে না। কেন থাকে না, সেটা আমার কাছে রহস্য। অন্যসব বিল্ডিংয়ে যখন ঠাসাঠাসি অবস্থা, তখন এটার গোটা একটা তলা ফাঁকা কেন?
আমি সময় পেলেই ছাদে যাই। ভালো লাগে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যখনই পাঁচ তলায় পৌঁছাই, তখন ল্যান্ডিংয়ে পেরোনোর সময় চোখে পড়ে দুইপাশে দুটো ফ্ল্যাটের কাঠের দরজা—দুটোতেই তালা মারা। তালার ওপরে ধুলো জমেছে। দেখলেই কেন যেন গা ছমছমিয়ে ওঠে।
আমি আবার ভুতের গল্পের পোকা, জানেন? বাংলায় মনে হয় এমন কোনো ভুতের গল্প লেখা হয়নি যেটা আমি পড়িনি! ভিডিওর দোকানে যত ভুতের ছবি আসে সব আমার দেখা চাই-আম্মু খুব রাগ করে যদিও। হালচাল পত্রিকায় আপনার ইনভেস্টিগেশন বেরোনো শুরু হবার পর হলো কি, আমাদের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলা নিয়ে আগ্রহ আরো বাড়লো আমার। ঢাকা শহরে এইরকম গা ছমছমে ভুতুড়ে জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, জানেনই তো!
আমরা নিচের তলাতেই থাকি। চার তলাতে। রাত গভির হলে নানারকম শব্দ শুনতে পাই, পাঁচ তলা থেকে আসে। মনে হয় কে যেন পা টেনে হাটছে। একদিন পরিস্কার শুনলাম একটা গোঙানির শব্দ। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না এসব।
ওই দুটো ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না কেন, খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি। কেউ ঠিকঠাক বলতে পারেনি। তবে কলোনির গার্ড মনসুর চাচা বলে, কয়েক বছর আগে ওইদুটো ফ্ল্যাটের একটাতে নাকি কে একজন সুইসাইড করেছিল। তারপর থেকে গোটা পাঁচ তলায় কেউ থাকে না। কেউ নাকি থাকতে পারে না। কেন থাকতে পারে না, সেটা অবশ্য মনসুর চাচা বলতে পারলো না।
কাজেই সেদিন বিকেলে ছাদে যাবার সময় যখন দেখলাম একটা ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা, তখন ধড়াস করে উঠলো বুকটা
বেশ অবাক হয়ে ল্যান্ডিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। তালাটা গায়েব। এক-দুইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে দরজার পাল্লাটা। যতদূর দেখা যাচ্ছে, ভেতরটা বেশ অন্ধকার।
কৌতুহলে মরে যাবার মত অবস্থা আমার তখন! পাঁচ তলায় কি আছে, সেটা দেখার শখ আমার বহুদিনের। আজকে না চাইতেই সেই শখ মিটে যাবার সুযোগ এসেছে। ভেবে দেখলাম, এই সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না।
কিন্তু ফট করে একটা অচেনা জায়গায় তো ঢুকেও পড়া যায় না! আম্মু যদি জানতে পারে, রেগে আগুন হয়ে যাবে। তাছাড়া, তালাটা নিশ্চয়ই আপনা থেকে খোলেনি। কেউ না কেউ খুলেছে। কিন্তু কে? কলোনির কারো কাছে এটার চাবি নেই, জানি, আমি অনেক খোঁজ নিয়ে দেখেছি। নতুন কোনো ফ্যামিলি এসেছে ওঠার জন্য? উঁহু, হতেই পারে না, নতুন কেউ আসলে সেটা আগে থেকেই জানতে পারতাম।
তাহলে কে?
অল্প ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। “এই যে, কেউ শুনছেন?” ফাঁকটার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম ভয়ে ভয়ে।
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আরো দু-বার ডাক দিলাম। বেশি জোরে ডাকার সাহস পাচ্ছি না অবশ্য আম্মু শুনে ফেলার ভয়ে। নিচের তলাতেই আমরা থাকি তো।
এবারও কেউ সাড়া দিল না।
আমার বেশ ভয়-ভয় লাগছে, কিন্তু আজকে পাঁচতলার ভেতরটা দেখার সুযোগ পেয়েছি, এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়! একটু এগিয়ে গিয়ে দরজাটার ওপরে হাত রাখলাম। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। একটা ঢোক গিলে দরজাটায় ঠেলা দিলাম কাঁপা হাতে।
মরচে ধরা কব্জায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে অনেকটা খুলে গেল দরজাটা। বহুদিনের পুরনো বাতাসে বদ্ধ জায়গার গন্ধ। ভেতরটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমি চোখ পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখা গেলা না কিছুই।
গল্পের বইতে কি পড়েছি, সেটা মনে পড়লো। আমি এতক্ষণ আলোতে ছিলাম, তাই অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ যদি অন্ধকারে থাকি তাহলে আঁধারের সাথে মানিয়ে নেবে চোখ, তখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পারবো। আর দ্বিধা থাকলো না। চট করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
ভেতরটায় অন্ধকার-বেশ অন্ধকার কিন্তু তবু যেন হালকা হালকা দেখা যায়। যতদূর বুঝলাম মাঝারি সাইজের একটা ঘরের ভেতরে আছি। ঘরের ওই কোণায় লম্বাটে কি যেন একটা আছে। বিছানা সম্ভবত।
আমি আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য আস্তে আস্তে রুমের প্রায় মাঝামাঝি হাজির হয়েছি, এমন সময় ঘটনাটা ঘটলো। পরিষ্কার টের পেলাম আমার পেছনে দরজাটা দড়াম করে লেগে গেল। নিজে থেকে।
এক মুহূর্ত বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম-তার পরই লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লাম দরজাটার ওপরে। পাগলের মত হাতড়াচ্ছি কোনো হাতল বা সেই জাতীয় কিছু ধরার জন্য-কিন্তু তেমন কিছু নেই দরজাটার গায়ে।
মরিয়া হয়ে ধাক্কাতে শুরু করলাম দরজাটা, লাথি মারতে শুরু করলাম। চেঁচাচ্ছি ফুসফুস ফাটিয়ে। “কে আছেন! শুনছেন! কে আছেন! আমি এখানে! আমি এখানে! বাঁচাও! বাঁচাও!”
ঝাড়া মিনিট পাঁচেক এমনটা করার পর মাথায় ঢুকলো কেউ আমাকে আসলে শুনতে পাচ্ছে না। কেন শুনতে পাচ্ছে না জানি না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না, এটা নিশ্চিত। নিচের তলাতেই আমাদের বাসা। বাসায় আম্মু আছে। যেভাবে ট্যাড়া পেটাচ্ছি, আম্মুর পরিষ্কার শুনতে পাবার কথা। কিন্তু পাচ্ছে না।
আর দরজা ধাক্কিয়েও লাভ নেই। এই দরজা ভেতরের দিকে খোলে, বাইরের দিকে না। আর বাইরের দিকে খুললেও ওটা ভাঙার মত শক্তি আমার নেই। ইতোমধ্যেই হাত-পা ব্যথা হয়ে গেছে।
জোরে একটা শ্বাস নিলাম আমি। খুব অদ্ভুত কিছু হচ্ছে এখানে। সাহস হারালে চলবে না আমার।
ঘুরে দাঁড়ালাম। চোখ এখনো মানিয়ে নেয়নি অন্ধকারের সাথে। তবে হালকা একটু আলো আসছে যেন কোথায় থেকে। ভালো করে দেখে বুঝলাম, বন্ধ একটা জানালা আছে ওদিকের দেয়ালে। পেরেক দিয়ে তক্তা মেরে দিয়ে বন্ধ করা। তবে ওটার ফাঁক ফোকর দিয়ে হালকা আলো আসছে, অন্ধকারে কোনোমতে দেখার জন্য যথেষ্ট।
ঘরের ওই দিকে একটা লম্বাটে জিনিসের কথা বলেছিলাম খানিক আগে। এখন ওটা আরো পরিষ্কার হয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, একটা খাটই বটে ওটা। আর ওটার ওপরে কিছু একটা শুয়ে আছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে আমার। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মানুষের মত একটা আকৃতি।
রাস্তায় আসতে যেতে যেরকম নোংরা কিছু দেখলে আমরা চোখ ফেরাতে পারি না, সে-রকম অবস্থা হয়েছে আমার। চোখ ফেরাতে পারছি না লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা আকৃতিটার দিকে।
শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানলো আতঙ্ক। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম কালচে আকৃতিটার দিকে। সাদাটে একটা বিছানা অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। তার ওপরে শুয়ে আছে কালচে অবয়বটা
এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি আমি, আর ধীরে ধীরে অবয়বটার বিকৃত রূপ আরো ভালোভাবে দেখতে পারছি। শেষে আর থাকতে না পেরে একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম জিনিসটার। যাতে চেঁচিয়ে না উঠি, সেজন্যে একটা হাত চাপা দিয়ে রেখেছি মুখের ওপর
জিনিসটা দেখতে মানুষের মত। শুয়ে আছে লম্বা হয়ে। গর্তে বসা চোখ বন্ধ। যেন ঘুমাচ্ছে। জিনিসটা অনেক লম্বা। সাত আট ফুট হবে। গায়ের রং ছাইয়ের মতো। মাথায় কোনো চুল নেই। ভুরুও নেই। যেন ক্যান্সারের রোগি। হাত পা লিকলিকে কাঠির মতো সরু। পাঁজরের হাঁড় স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। সারা গায়ে কোনো কাপড় নেই। জিনিসটার নাকের ফুটো বড় বড়। দাঁতের ওপর থেকে ঠোঁট সরে আছে। বড় বড় দাঁত দেখা যাচ্ছে।
মানুষের মত দেখতে ওই জিনিসটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, বলতে পারি না। হয়তো কয়েক সেকেন্ড, হয়তো বা কয়েক ঘন্টা। শেষে একসময় ঘোর কাটলো। তীব্র আতঙ্কে মাথা গুলিয়ে আসছে।
এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম জিনিসটার কাছ থেকে। ভয় হচ্ছে, এখনি জেগে উঠবে ওটা, আর ভয়ংকর কিছু করবে আমার সাথে।
মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছি বটে আমি, কিন্তু ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে। তাহলে যদি আবার জিনিসটা জেগে ওঠে? কিন্তু আমি যখন একটু আগে দরজা ধাক্কাধাক্কি করলাম, তখন জিনিসটা জাগেনি কেন? ওটা কি মরে গেছে?
পিছিয়ে আসতে আসতে আমার পিঠের সাথে লাগলো কাঠের দরজাটা। যতদূর সম্ভব কম শব্দ করে ওটা খোলার চেষ্টা করলাম আবার। পারলাম না। হ্যান্ডেল ছাড়া দরজা কখনো খোলা যায়?
এই সময় চোখে পড়লো, ঘরের উল্টো দিকের দেয়ালেও একটা দরজা আছে। দরজাটা সম্ভবত পাশের ঘরে যাবার। পা টিপে টিপে ওটার দিকে এগোলাম। বিছানায় শুয়ে থাকা ওই জিনিসটার সাথে একই ঘরে আর বেশিক্ষণ থাকতে হলে পাগল হয়ে যেতাম আমি!
এই দরজাটায় হাত দিতেই খুলে গেল। আগের ঘরটার সমান আকারের
আরেকটা ঘরে হাজির হয়েছি আমি। ঘরটায় কোনো দরজা নাই। কোনো জানালা নাই। কোথাও কিছু নেই, শিপলু ভাইয়া, তবু কেমন একটা ধূসর হালকা আলো সারা ঘরে। কেবল কোণাগুলোয় অন্ধকার।
গোটা ঘরটা খালি। কেবল ছাদে একটা ফ্যান ঝুলছে। ফ্যানটার কেবল দুইটা পাখা। আরেকটা নাই। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা হচ্ছে ফ্যানটার সাথে একটা দড়ি ঝুলছে। দড়িটার শেষ মাথায় একটা ফাঁস।
যেন কেউ ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়েছে দুই ব্লেডওয়ালা ফ্যানটা থেকে।
আর সেটার ঠিক নিচেই মেঝের ওপর একটা কাঠের চেয়ার।
গোটা ঘরটার মধ্যে এমন অশুভ, এমন নারকীয় একটা কিছু ছিল, শিপলু ভাইয়া, যে আমি পারলে তখনই দৌড়ে পালিয়ে আসতাম ওখান থেকে। কিন্তু আর যাবার জায়গা কই? এই ঘরটার পরে আর কোনো ঘর নেই। আগের ঘরটায় ফেরত যাওয়া সম্ভব না। ওই জিনিসটার সাথে এক ঘরে আবার থাকতে হলে মরে যাবো।
দেয়ালের সাথে ঘেঁষে এলাম আমি। ইচ্ছে করছে একটা কোণায় বসে পড়ে ফিটাল পজিশনে গুটিশুটি মেরে থাকতে। সেটাই করতাম, কিন্তু তখনই চোখে পড়লো ওদেরকে। ঘরটায় কোণায় কোণায় অন্ধকার বলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি।
ওরা সংখ্যায় চারজন। মেঝেয় বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে পা গুটিয়ে হাটুর মাঝে মুখ গুটিয়ে বসে আছে। আমার সাড়া পেয়ে মুখ তুললো সবাই একসাথে। ভাইয়া, ওদের ওই চেহারা আমি জীবনে ভুলবো না। ওদের গায়ের রং মড়ার মত ফ্যাকাসে। ওদের সবার মাথা ন্যাড়া, মুখের জায়গায় গোল একটা ফুটো, চোখ নেই, চোখের জায়গায় কেবল চামড়া। ওদের সারা গায়ে কোনো কাপড় নেই।
আমি জানি না সারি বেঁধে ঘরের কোণায় বসে থাকা ওই নগ্ন জিনিসগুলো কি ছিল। আমি চেঁচানোর চেষ্টা করলাম, পারলাম না, মুখ হাঁ করেছি কিন্তু কোনো শব্দ হচ্ছে না।
জিনিসগুলো আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে, কিন্তু আমি জানি ওরা আমাকে দেখতে পারছে না, কারণ ওদের চোখ নেই। কিন্তু ওদের চামড়ার চোখের দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে যেন আমাকে ছুরির মত ফুঁড়ছে ওদের চোখের চাহনি।
আমি কোনো শব্দ করতে পারার আগেই ওরা সবাই এক সুরে মেয়েলী গলায় বলে উঠলো, “কে? কে? কে?”
বলতেই থাকলো। একঘেয়ে সুরে বলতেই থাকলো। বলতেই থাকলো। আমি কানের ওপর দু-হাত চেপে ধরলাম। তবু শোনা যাচ্ছে ওদের আর্তনাদ। ওদের স্বর ততক্ষণে গোঙানীতে পরিণত হয়েছে। খানিক বাদে গোঙানি থামিয়ে ওরা একসাথে বলে উঠলো, “কেন এসেছো? কেন এসেছো? কেন এসেছো?” বলতেই থাকলো। বলতেই থাকলো।
ওরা আর কিছুক্ষণ ওভাবে বলতে থাকলে আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যেতাম, তখনই পেছনের ঘরটা থেকে একটা জান্তব ঘড়ঘড়ানির শব্দ পেলাম।
সাথে সাথেই সুর পাল্টে গেল মেঝের কোণায় বসে থাকা জিনিসগুলোর। জড়ানো গলায় বলে উঠলো, “ওটা উঠেছে। ওটা ওটা ওটা ওটা উঠেছে। ওটা আসছে। ওটা আসছে। ওটা আঙ আঙ আঙ আঙ আঙ…”
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম—টের পাচ্ছি, ভয়ের চোটে মরে যাবো যে কোনো সময়ে। এসব কি হচ্ছে? পাঁচ তলার একটা পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে এসব কি? ওই ঘর থেকে কি আসছে? আর এই ঘরে মেঝের কোণায় বসে থাকা এই জিনিসগুলো কি?
পেছনের ঘরটা থেকে একটা থপথপ শব্দ আসা শুরু হলো। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের অন্য কোণায় সরে গেলাম।
অন্য ঘরের থপথপ শব্দটা এগিয়ে আসছে। শিপলু ভাইয়া, তখন মেঝেতে বসে থাকা ওই জিনিসগুলো মুখ লম্বা করে এক ধরণের শব্দ করা শুরু করলো। জিনিসগুলোর চোয়াল লম্বা হয়ে বুকের সাথে লেগে গেছে, মুখের হাঁ-টা এক হাত বড় হয়ে আছে। ওই শব্দটা কি রকম ছিলো সেটা আপনি না শুনলে বুঝবেন না। যেন পৃথিবীর বাইরের অন্ধকার একটা জগৎ থেকে আসছে এটা। পৃথিবীর কোনো মানুষ এমন শব্দ কল্পনাও করতে পারে না।
হঠাৎ শব্দ করা থামিয়ে দিলো জিনিসগুলো। আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলতে থাকলো, “চেয়ারে ওঠো। চেয়ারে ওঠো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ওটার হাত থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পঙঙঙঙঙঙ….”
আবার শুরু হলো সেই গা রি রি করা শব্দ। আমি থ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি পুরো ব্যাপারটা, কাঁদতে কাঁদতে। ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে বলছে!
ঠিক এই সময়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ছাদ পর্যন্ত লম্বা জিনিসটা। ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে ওটা আমাকে ধরতে। ছাইয়ের মতো গায়ের রঙ। টকটকে লাল কামুক চোখ। নগ্ন। কাঠির মতো লিকলিকে হাত পা। পাঁজর বেরোনো শরীর। দু- পায়ের মাঝখানের জিনিসটা বিশাল।
মেঝেতে বসা জিনিসগুলো আবার ভাষা ফিরে পেলো। “ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। নাহলে ওটা তোমার সাথে খুব খারাপ করবে। খুব খারাপ করবে। খুব খারাপ করবে। খুব খুব খঁ খ খ খ খঁ …”
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম মেঝের কোণায় বসে থাকা জিনিসগুলো মিথ্যে বলছে না। ওটার হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ঘরটা থেকে বের হবার কোনো রাস্তা নেই। আমার হাতে কেবল একটাই উপায় আছে।
লম্বা জিনিসটা ওটার ল্যাগবেগে হাত পা নেড়ে নেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে আমি লাফিয়ে চেয়ারটার ওপরে উঠে পড়লাম। এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে ফাঁসটা পরে নিলাম গলায়।
মেঝের কোণার জিনিসগুলো মুখটা কুকুরের মত লম্বা করে গঁ গঁ গঁ গঁ করে চলছে।
লম্বা জিনিসটা ততক্ষণে আমার একেবারে সামনে চলে এসেছে। হাঁড়সর্বস্ব একটা বরফশীতল লম্বা হাত বাড়িয়ে দিলো ওটা, আমার একটা বুক খামচে ধরলো। ওটার নারকীয় মুখটা ঠিক আমার মুখের সামনে।
আমি মরিয়া হয়ে পায়ের নিচ থেকে ধাক্কা দিয়ে চেয়ারটা সরিয়ে দিলাম।
টের পেলাম আমার গলার ওপর ভীষণভাবে এঁটে বসছে দড়িটা।
তারপর এই হাসপাতালে জেগে উঠলাম। আমি নাকি সিঁড়ির ওপরে পড়ে ছিলাম, আম্মু খুঁজে পেয়েছিল। পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের বাইরে।
নোভার গল্প শেষ হবার পরে বেশিক্ষণ থাকলাম না, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম একটা কিছু ছুতো দেখিয়ে। এতবড় মানসিক শক পাওয়া বাচ্চা মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিলো-কিন্তু কিছু করার ছিলো না, ওই ঘরে আর থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না আমার।
নোভা দেখতে পাচ্ছিলো না, নোভার মা-ও না-কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখছিলাম, নোভার বিছানার নিচে অন্ধকারে বসে আছে ওর বলা সেই মেঝের কোণায় বসে থাকা কুৎসিত জিনিসগুলোর একটা, ফিসফিস করে বলছিলো, “ও আবার আসবে। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জানালা দিয়ে আঙ আঙ আঙ আঙ আঙ…”