অধ্যায় ৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
“মানুষ সর্বভুক প্রাণী, জানিস তো,” বারের কাউন্টারের ওপর কনুই রাখা শিপলুর, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে একটা বিয়ারের বোতলের গলা, পেন্ডুলামের মত করে দোলাচ্ছে ওটাকে।
“হুঁ,” বললাম আমি, মার্টিনির গ্লাসটা ঠোঁট পর্যন্ত তুললাম, কিন্তু চুমুক দিলাম না, ওটার কানার ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। ওর হালচাল বোঝার চেষ্টা করছি। শিপলুর ঘাড়ের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওপাশে বসা সামাদকে। স্কচের গ্লাস নিয়ে বসে আড়চোখে এক সুন্দরিকে দেখার চেষ্টা করছে।
“মানুষের সহজাত খাবারের মাঝে কি কি আছে, জানিস?” বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। ওর চোখের মণি স্থির, চকচক আর ছলছল করছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি মাত্র সাড়ে তিন পার্সেন্ট অ্যালকোহলিক বেভারেজ খেয়ে একটা মানুষ কতটা মাতাল হতে পারে। আমার মাঝে জবাব দেবার কোনো লক্ষণ না পেয়ে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলো ও, “শষ্য, ফলমূল, মাংস, মদ।”
শেষের জিনিসটার উল্লেখ সত্যিই নৃবিজ্ঞানের বইতে আছে না ওর পেটের ভেতরে থাকা একই বস্তু ওকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে, সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই আবার মুখ খুলেছে শিপলু। “নাউ নোটিশ, আমি কিন্তু শাক সবজির কথা বলিনি। হ্যা, গুড হেলথের জন্য এটা খাওয়া দরকার যদিও, কিন্তু আমাদের শরীরে কোনো শাক হজমকারি এনজাইম নেই। দ্যাটস দ্য ট্রুথ। আর অন্যদিকে আমিষ, মানে মাংস হজমের কত রকম এনজাইম আছে জানিস? পেপসিন, ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিন…বাকিগুলোর নাম মনে পড়ছে না। এগুলো কেন আছে? মাংস হজমের জন্য। যাতে আমরা অন্য প্রাণী ধরে খাই সেজন্য। সো, আসলে ভেজিটারিয়ানরা যেমন দাবি করে, তাদের ডায়েটই সেরা, এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম, সেই ধারণা ভুল। আরে, তাদের পেটের ভেতরের এনজাইমই তাদের কথাকে সাপোর্ট করে না। ঠিক কিনা?” বলে ঘাড় ঘুরিযে লাল চোখে তাকালো ওর অন্যপাশের টুলে বসা রিফাতের দিকে। ভাবখানা এমন, রিফাতই যেন কোনো ভেজিটারিয়ান।
বেচারা রিফাত ভুঁড়ি ঝুলিয়ে আরামে মদ খাচ্ছিলো, শিপলুর এমন আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল। আমার দিকে চাইলো করুণ দৃষ্টিতে। আমি শ্রাগ করে চোখ সরিয়ে নিয়ে মার্টিনির গ্লাসে চুমুক দিলাম।
শিপলু বিয়ারের বোতল হাতে নেয়ায় আমার চেয়ে বেশি অবাক অবশ্য কেউ হয়নি। এসেছিলাম রিফাতদের বারে। নতুন খুলেছে রিফাতের বাপ। সপ্তাহের মাঝখানে সাধারণত এভাবে ড্রিঙ্ক করি না আমি, কিন্তু রিফাতের ইনভাইটেশন ফেলতে পারলাম না। বাসা থেকে বেরোবার জন্য রেডি হচ্ছিলাম, শিপলু এসে হাজির। অবাক হইনি অবশ্য। সেইদিনের পর নিয়মিতই হুটহাট আমার বাসায় আসছে শিপলু, নানান বিষয় নিয়ে গল্প ফাঁদছে, তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাশেদের দিকে। রাশেদ নাকি আমার ওপর হিট নেবার জন্য ফুললি রেডি। এ নিয়ে আগে কোনো কনফিউশন থেকে থাকলেও এখন নাকি ও পুরোপুরি শিওর। সুযোগ পেলেই নাকি আমার ওপর অ্যাটাক করবে রাশেদ। ওকে বকবক করতে দিয়েছি আমি, বাধা দেইনি। সন্দেহ নেই অযথা চিন্তা করছে শিপলু। রাশেদ একটা পাকা বানচোদ বটে, কিন্তু সে হুট করে একদম জানে মেরে ফেলার জন্য আমার ওপর অ্যাটাক করবে, তা-ও আবার আইরিনের মত একটা মাগির সম্মান রক্ষার্থে, সেটা আমার বিশ্বাস হয়নি। আর তাছাড়া ব্যাপারটা আমার জন্য একটু বিব্রতকরও বটে। কেউ কখনো এভাবে কেয়ার নেয়নি আমার। বাবাও অনেকটা উদাসিন ছিলেন আমাকে নিয়ে। শিপলু ছেলেটা আসলেই মাত্র এই দেড় দুই বছরে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড হয়ে গেছে আমার অজান্তেই।
তো শিপলুকেও নিতে হলো রিফাতদের নতুন বার চেখে দেখতে। আমি বেশি গিলবো না ঠিক করেছিলাম, কাজেই দুয়েকটা মার্টিনির পাত্র নিয়ে চুকচুক করছিলাম আর রিফাতের বকবকানি শুনছিলাম, কেমন হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করে বারটা সাজিয়েছে সে, কিভাবে হ্যান্ড-পিক করেছে ওয়াইনের প্রত্যেকটা ব্র্যান্ড, কিভাবে ইনটেরিয়র ডিজাইন করেছে সেরা ডিজাইনার দিয়ে, তা নিয়ে। আমি টাম্বলারে পিচ্চি চুমুক দিতে দিতে মনে মনে বলছিলাম, ভাই রিফাত, তুমি যদি বোতলগুলো নিজেই খেয়ে ফেলার লোভটা সামলাতে পারো তাহলেই দোকান চলবে, নয়তো তোমার সাধের বারের দামি উড প্যানেলিং বেচেও লোকসান আটকাতে পারবে না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে কাউন্টারে আমার পাশে একটা টুলে বসে আমারই মত করে এক হাতের কনুইয়ে কাউন্টারে হেলান দিয়ে বসে তুড়ি দিয়ে একজন বারটেন্ডারকে ডেকে একটা বিয়ারের অর্ডার দিলো শিপলু। দারুণ অবাক হয়েছিলাম এখন শিপলুর কানের পোকা নড়ানো বকবকানি শুনে বুঝতে পারছি ওকে গিলতে দেয়াটা ভুলই হয়েছে।
“আর, যেটা বলছিলাম, মদ।” বক বক করেই চলেছে শিপলু। এটাও মানুষের আদি খাদ্য। মানুষ নানান মিষ্টি ফলমূল খেতো আদ্যিকাল থেকেই। সবসময় কি সেগুলো টাটকা পাওয়া যেতো? না, যেতো না। অনেক সময় গাছতলায় পচা ফল পড়ে থাকতো। শর্করা পচে কি হয়? অ্যালকোহল। মানুষের সেই থেকে অ্যালকোহল খাওয়া শুরু। মানুষ যখন থেকে ধান, গম বা বার্লির মত শষ্য জ্বাল দিয়ে খাওয়া শুরু করলো, তখন দেখলো সেগুলোকে জ্বাল দিয়ে পানিসহ দুয়েক রাত রেখে দিলে….”
শিপলুর বাক্যবাণ থেকে বাঁচতেই টুলের ওপর ঘুরে বসলাম আমি, বারটার ইতিউতি চোখ বোলাচ্ছি। বেশ বানিয়েছে বটে রিফাত, একেবারে পশ্চিমা কোনো পানশালার মতই। বাপের হোটেল-ব্যবসায়ি ব্রেন পেয়েছে বোধহয় ব্যাটা। বেশ সাজিয়েছে। বেশ বড় রুমটার এদিক-সেদিক ছড়ানো অনেকগুলো টেবিল। মৃদু নীলাভ লাইটিংয়ের কারণে রুমের আনাচে কানাচে ছোপ ছোপ অন্ধকার আর আলো আঁধারের খেলা। হালকা মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে লুকোনো স্পিকার থেকে। লোকজন চুপচাপ ড্রিঙ্ক করছে, ড্রেসকোড মেইনটেইন করতে হয়েছে সবাইকে, উচ্চবিত্ত ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা বাইরের দশাসই গার্ড, গ্লাসের টুংটাং আর রুমের এদিক ওদিক থেকে মাঝে মাঝে হাসির শব্দ পাচ্ছি….
মার্টিনির গ্লাসটা অন্যমনস্কভাবে ঠোঁটের কাছে আবার তুলতে গিয়েই থমকে গেলাম আমি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আমার কান, নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে, শরীরের সব কটা পেশি টান টান, প্রতিটা স্নায়ু সজাগ। বুকের মাঝে বাড়ি মারছে হৃৎপিন্ডটা। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সাবধান করে দিচ্ছে আমাকে, বলছে, কোনোখানে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, সাবধান হও।
গোটা রুমটার এদিকওদিক চোখ বোলাতে লাগলাম আমি। সবকিছু স্বাভাবিক ঠেকছে। কিন্তু আমি জানি কিছু একটা অস্বাভাবিক। আমি জানি এখনই কিছু একটা ঘটবে। বাবা বলতো, অলওয়েজ ফলো ইয়োর গাট ইন্সটিংকটস।
গোটা রুমের এদিকওদিক চোখ চলছে আমার। মার্টিনির গ্লাসটা রয়ে গেছে ঠোটের কাছেই। এক কান দিয়ে শুনছি, শিপলু বকে চলেছে, “তুই কি জানিস, হাম্বুরাবি আইনের একটা ধারা অনুসারে, বিয়ারে পানি মেশানোর শাস্তি মৃত্যুদন্ড?”
সবাই ড্রিংক করছে, কথা বলছে, হাসছে। কেউ তাকাচ্ছে না আমার দিকে। সবকিছু স্বাভাবিক। রিফাত টুলে বসে ঢুলছে। শিপলু ওর বিয়ারের বোতলের ভেতরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। বারটেন্ডারের মাথার ওপরের আলোটা পড়ে চমকাচ্ছে শিপলুর চশমার কাঁচ।
আমার হার্টবিট কমে আসছে। ফলস অ্যালার্ম। আমার গাট ইন্সটিংকট এবারে কাজে দেয়নি মনে হচ্ছে। আসলে শিপলুর ছোঁয়াচে সাবধানতা রোগ আমাকেও ধরেছে। আর কিছু না।
আর এটা ভাবতে না ভাবতেই আমার পাশে ট্রে নিয়ে যেতে থাকা এক ওয়েটার আমার পাশের লোকটার পায়ে বেধে হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের ওপর পড়ে তিন- চারটা গেলাসের মদে আমাকে একদম ভিজিয়ে দিল।
ওয়েটার মেঝেতে পড়ে থেকে বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি ভাবছি আমার ইন্সটিংকট তাহলে একেবারে ভুল ছিল না, পকেট থেকে রুমালটা বের করছি. আর এদিকে শিপলু খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো, “হাম্বুরাবি আইনে মাটিতে ফেলে বিয়ার নষ্ট করার শাস্তি না জানি কি!”
ওয়েটারকে কড়া করে একটা ধমক দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলাম আমি জানি দোষটা ওয়েটারের নয়, এত লোকজনের মাঝে কারো পায়ে বেধে পড়ে যাওয়াটা ঠেকানো কঠিন, তবুও ইচ্ছে করছিলো থাপড়িয়ে কান লাল করে দেই ব্যাটার। আমার দামি স্যুটটা কেবল আজই প্রথম পরলাম, আর তাতেই এই কান্ড। এখন নেও ঠেলা। শালাকে কয়েকটা লাথি মারতে পারলে গায়ের রাগটা যেতো। কিন্তু হাজার হলেও রিফাতের কর্মচারি। ওর সামনে ওরই কর্মচারিকে মারাটা রিফাতের স্ট্যাটাসকে ক্ষুন্ন করবে। রাগটা গিলে ফেলতে হয়েছে তাই।
ভেজা রুমালটা দিয়ে ঘাড় ঘষতে ঘষতে ওয়াশরুমের দিকে এগোচ্ছি আমি, এমন সময় মেল ডিভিশন থেকে বেরোতে দেখলাম বোমা মজিদকে। স্রেফ স্বাভাবিকভাবে হেটে বেরিয়ে চলে গেল একদিকে। আমাকে দেখতে পেয়েছে, এমন ভাব করলো না।
কুচকুচে কালো, তেল চকচকে চেহারা বোমা মজিদের। মাথার ছোট করে ছাঁটা চুল আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির দৈর্ঘ্য সমান। লাল চোখে খুনির দৃষ্টি। চেহারার এই হালের জন্যই বোধহয় গায়ের ধূসর স্যুটটা একদম বেমানান লাগছে ব্যাটাকে।
আমি থেমে পড়েছি আমার জায়গাতেই। হার্টবিট বেড়ে গেছে আবার। বোমা মজিদ এখানে? কি করছে সে? আমি যেদিন এখানে এলাম, সেদিনই তাকে এইখানে হাজির হতে হবে কেন? রিফাতই বা তাকে এখানে ঢুকতে দিয়েছে কেন? অবশ্য রিফাত তো আর আমার আর রাশেদের মাঝে চলতে থাকা টানাপোড়েনের ব্যাপারটা জানে না। ওরই বা দোষ কি।
তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় আর ঘাড়ে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলাম আমি। পেপার টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে বিশাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের ওপর চোখ পড়লো আমার। ব্যাকব্রাশ করা কুচকুচে কালো চুল, সযত্নে ছাঁটা গোঁফের দুটো কোণা নেমে এসেছে নিচের দিকে, উদ্বেগ মাখা চোখের কোলে হালকা কালির ছাপ। কপালের ওপরের দিকে, হেয়ার লাইনের কাছে একটা ক্রসের মতো কালো দাগ। আমার বিখ্যাত ‘স্কার জন্ম থেকেই আছে। জন্মদাগ। কুঁচকে আছে ভুরু জোড়া। আমি কি ভয় পেয়েছি? জোর করে নিজেকে বলতে পারি, না। কিন্তু শিপলুর কথাই ঠিক-রাশেদ আর তার সাগরেদরা সবাই খুনে উন্মাদ, তাদের থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল। অযথা একগুঁয়েমি করার মানে হয় না। আর আজ এইখানে বোমা মজিদের উপস্থিতি কাকতালিয়ের চাইতেও বেশি কিছু।
জোর পায়ে ফিরে এলাম কাউন্টারের কাছে। শিপলু আরেক বোতল বিয়ার নিয়ে বসেছে। সামাদ একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়ার চেষ্টা করছে অল্প আলোর মাঝে রিফাত একটা ওয়েটারের কানে কানে কি যেন বলছে। ওকে জড়াতে চাই না এসবের মাঝে, তাই চোখের ইশারায় শিপলুকে একপাশে ডেকে নিলাম। না চাইতে হাজির হয়ে গেল সামাদও।
“কি ব্যাপার?” ঠোটে সিগারেট ঝুলিয়ে বললো শিপলু। ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে সাড়ে তিন পার্সেন্ট অ্যালকোহলের কেরামতি।
“বোমা মজিদ। এখানে।” সংক্ষেপে বললাম আমি।
সাথে সাথে শখের নেশা ছুটে গেল শিপলুর। “এখানে?” আমার কথার প্রতিধ্বনি করলো ও। “কোথায়? আমাদের আশপাশে আছে এখন?”
মাথা না নাড়িয়ে কেবল চোখ ঘুরিয়ে যতদূর সম্ভব আমাদের আশপাশটা জরিপ করে নিলাম আমি। “এখন তো দেখছি না। একটু আগেই ছিল।’
কাঁধ ঝুলিয়ে দিল শিপলু। মুখের শক্ত ভাবটাও কেটে গেল ওর। “ঠিক দেখেছিস তো, এমনও হতে পারে…”
“ক্লিয়ার অ্যাজ ডেলাইট, শিপলু! আমি ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলাম, সেখান থেকে বের হতে দেখলাম ওকে।” চাপা গলায় গর্জে উঠলাম আমি।
সামাদ দুই পকেটে দুটো হাত গুঁজে বলে উঠলো, “এখানে থাকাটা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। জামশেদ ভাই, চলেন বাসায় যাই। অনেক হয়েছে। চলেন।”
আমিও মনে মনে এটাই ভাবছিলাম। বোমা মজিদ নিশ্চই একা আসেনি। ওর চামচারা ছড়িয়ে আছে ওদিক ওদিক। চোখ রাখছে আমার ওপর। এখানে সবার সামনে হয়তো আমার ওপরে কোনো অ্যাটেম্পট নেবার চেষ্টা করবে না ওরা, কিন্তু এখানে আর স্বস্তিতে থাকা সম্ভব নয় আমার জন্য। গোটা পরিবেশটা বিষিয়ে গেছে।
“চল,” চাপা গলায় বললাম আমি, এগোলাম রিফাতের দিকে। ওকে কিছু একটা ছুতো দেখিয়ে বিদায় নিতে সময় লাগলো না।
টেবিলগুলোর মাঝ দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে এগোলাম আমি, আমার পেছনে পেছনে শিপলু আর সামাদ। কোনোদিকে তাকাচ্ছি না। বাইরে চলে এলাম, পার্কিংলটে রাখা আমার গাড়িটার কাছে। সামাদের হাতে গাড়ির চাবি, ও পেছনের দরজাটা খুলে দিলো আমার জন্য। রাত হয়ে যাবে বলে ড্রাইভারকে সাথে নেইনি আজকে, সামাদই ড্রাইভ করছে। গাড়ির পেছনের সিটে বসে হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি। প্রায় একটা বাজে।
চট করে ড্রাইভিং সিটে চলে গেল সামাদ, তার পাশের সিটে শিপলু। সিটে বসেই সবার আগে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টটা খুলে সেটার ভেতরে হাত গলিয়ে দিলো শিপলু। ওখানেই আমার লাইসেন্স করা রিভলভারটা রাখা।
ঘুরে রিভলভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো সে। “জাস্ট ইন কেস,” বিড়বিড় করে বললো ও।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো সামাদ। আর তখনই দ্বিতীয় আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ পেলাম আমি। ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আমাদের থেকে খানিক দূরে পার্ক করা খয়েরি একটা মিতসুবিসির হেডলাইটদুটো জ্বলে উঠেছে। এইমাত্র বন্ধ হয়ে গেল ওটার প্যাসেঞ্জার ডোর। গাড়ির ভেতরে অন্তত জনা চারেকের কালো কালো মাথা দেখা যাচ্ছে।
লক্ষণ ভালো ঠেকছে না।
শিপলু আর সামাদেরও কোনোকিছু চোখ এড়ায়নি। পার্কিংলটের সোডিয়াম ল্যাম্পের আলোয় হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে শিপলুর মুখটা। চশমার কাঁচে হলুদের ঝলকানি। “সামাদ, ড্রাইভ,” মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোর কাটিয়ে বললো ও।
সামাদ ছেলেটার মুখ কম চললেও হাত ভালোই চলে। স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ওর কেরামতিতে আরো অনেকগুলো গাড়ির মধ্য থেকে আমাদের গাড়িটাকে ঠিকই ড্রাইভওয়েতে বের করে আনলো ও মুহূর্তের মাঝে। রিয়ার ভিউ মিররে দেখি, মিতসুবিসিটাও নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে।
রাস্তায় উঠে এলো আমাদের গাড়ি। “আজকে আমার বাড়ি থেকে বেরোনোই উচিত হয়নি,” বিড়বিড় করলাম আমি।
আরো কয়েকটা ‘উচিত হয়নি’ মাথায় এলো আমার। শিপলুর কথা হেসে উড়িয়ে দেয়া উচিত হয়নি। ওর সাবধানবাণীকে পাগলামি ভেবে নাকচ করে দেয়া উচিত হয়নি। ওর সাথে নতুন কেসের ইনভেস্টিগেশনে যাওয়ার প্রস্তাবে সেকেন্ড থট না দিয়ে এক কথায় বাতিল করে দেয়াও উচিত হয়নি। ওর সাথে এই মুহূর্তে দূরের কোনো জেলায় থাকলে সত্যিই একশো একটা ঝামেলা এড়ানো যেত।
রাস্তা ফাঁকা। অন্য কোনো সময় হলে ক্যাসেট প্লেয়ারে ম্যাডোনা বা জ্যাকসনের গান ছেড়ে দিয়ে সিটে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বুজে বাসায় ফেরার অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আজ সে উপায় নেই। খোলা রাস্তায় পড়েই এক্সেলেরেটর দাবিয়ে ধরলো সামাদ, শিপলু আর আমি রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখেছি অন্য গাড়িটার গতিবিধি বোঝার জন্য।
ঝাড়া মিনিট দুয়েক পেছনে কিছুই দেখলাম না। রাতের এই সময়ে রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। পেছনে যে গাড়িগুলো দেখলাম সেগুলোর একটাও সেই খয়েরি মিতসুবিসি না। আমি কেবল শিপলুকে বলতে যাবো যে ব্যাটারা বোধহয় আদৌ বোমা মজিদের দল নয়, গোটা ব্যাপারটাই কাকতালিয়, এমন সময় হুট করে রিয়ার ভিউ মিররে আবির্ভাব খয়েরি মিতসুবিসির। গতি বাড়ছে ওটার। কাছিয়ে আসছে।
সামাদও দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, গতি আরো বাড়িয়ে দিলো ও। ঢোক গিললাম আমি, রিভলবারের হাতলে চেপে বসলো হাতটা। রাতের ফাঁকা মেইন রোডে স্রেফ গতি বাড়িয়ে পার পাওয়া যাবে না, ওদের গাড়িটার ইঞ্জিনও বেশ পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে।
সেই পাওয়ারফুলটা যে কত পাওয়ারফুল, টের পেয়ে গেলাম আধা মাইলের মধ্যে। দুই গাড়ির মাঝে দূরত্ব বাড়ার তো কোনো নামগন্ধই নেই, বরং কমছে। এভাবে চলবে না। শিপলু কয়েকবার পেছনে দেখার পর সামাদকে বলে বসলো, “মেইন রোডে টিকতে পারবো না, ধরে ফেলবে। কোনো চিকন রাস্তা বা গলি-টলি দিয়ে ঢুকিয়ে দাও।”
সামাদকে কেবল বিড়বিড়িয়ে বলতে শুনলাম, “আপনারা দু-জন সিটবেল্ট বেঁধে নিন।”
ধন্যি বটে সামাদের ড্রাইভিং! আরো খানিকদূর একইরকম স্পিডে যাবার পরে হঠাৎ গতি কমিয়ে দিল ও, তারপর বামে আচানক একটা টার্ন নিয়ে ঢুকে পড়লো একটা গলিতে।
অন্ধকার এবড়োথেবড়ো রাস্তা, দু’পাশে ঘিঞ্জি বাড়িঘর। হেডলাইটের আলোতেও আঁধার দূর হতে চাইছে না। রাস্তার খানাখন্দে পড়ে লাফাতে লাফাতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। একটা ময়লা-উপচে-পড়া ডাস্টবিনের পাশে শুয়ে থাকা একটা কুকুর আর এক ভিখিরি অবাক চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাতে না তাকাতেই ওদেরকে বুলেটের বেগে পাশ কাটিয়ে গেলাম আমরা।
পেছনের গাড়িটা এখনো আছে কিনা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতে যাবো, এমন সময় আরেকটা শার্প টার্ন নিয়ে আরেকটা পাতি-গলিতে ঢুকে পড়লো আমাদের গাড়ি। খানিক বাদে আরেকটা টার্ন। আরেক গলিতে আমাদের গাড়ি। ভাগ্যিস কোনো জনপ্রাণী নেই কোনোটাতে, নইলে এতক্ষণে কতজন যে মরতো গাড়িচাপা পড়ে।
ঢাকা শহরেই থেকেছি আজীবন। ঢাকার রাস্তাঘাট সম্বন্ধেও ভালো ধারণা আমার আছে বলে মনে করেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা কোথায় আছি, কোন পাড়ায়, কোন রাস্তায়-কিছুই বুঝতে পারছি না। কারো মুখে কথা নেই। বাঁকের পর বাঁক নিচ্ছে সামাদ, শিপলু আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে, আমি প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছি আমার থার্টি এইট রিভলভারটা নিয়ে-এই রাত একটায় গোটা ব্যাপারটা কেমন সুররিয়েলিস্টিক ঠেকতে থাকে আমার কাছে।
আরেকটা বাঁক ঘুরলো শিপলু। গলিটার শেষ মাথায় হলদেটে আলোর বন্যা দেখা যাচ্ছে, সোডিয়াম ল্যাম্পের আলো। নিশ্চয়ই ওটা কোনো মেইন রোড। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি। মেইন রোডে পড়ার পরে গাড়ি টান দিয়ে বাসায় চলে যেতে সময় লাগবে না। মিতসুবিসিটাকে পেছনে ফেলতে পেরেছি সন্দেহ নেই। সামনের রোডে পড়ার পরে কেউ আমাদেরকে আর আটকাতে পারবে না।
সামাদকে কেবল বলতে যাচ্ছিলাম সার্জনের হাত দিয়ে এত ভালো গাড়িও চালনো যায় সেটা আমি জানতাম না, এমন সময় গলির শেষ মাথায় হলদে আলোর সামনে একটা কালো ছায়া পড়তে দেখলাম। একটা গাড়ি এসে থেমেছে ওখানে, আমাদের রাস্তা আটকানোর জন্য।
ব্রেক কষলো সামাদ। রাস্তার সাথে টায়ারের ঘষা খাওয়ার ক্রিহঁহঁহঁচ শব্দটা কান থেকে মিলিয়ে যাবার আগেই পেছনে আরেকটা গাড়ির শব্দ শুনলাম আমি। ঘাড় না ঘুরিয়েই আমি বলতে পারি গাড়িটা দেখতে কেমন। খয়েরি মিতসুবিসি।
আটকে ফেলা হয়েছে আমাদেরকে। ফাঁদে পড়েছি আমরা।
টায়ারের আর্তনাদের শব্দ শুনে বুঝলাম, আমাদের পেছনে থেমেছে মিতসুবিসিটাও। তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের থেকে গজ বিশেক পেছনে ওটা। থামতে না থামতেই ওটার দরজা খুলে গেছে, চার প্যাসেঞ্জারই একসাথে নামছে গাড়ি থেকে।
আর ভাবার কোনো সময় নেই। গাড়িতে বসে থাকলে কোনো লাভ নেই। পিস্তল আমার হাতেই, গোল্ড মেডেল জেতা শুটার আমিই, যা করার আমাকেই করতে হবে। শিপলু আর সামাদকে “গাড়িতেই থাক,” বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে যাবো, এমন সময় গাড়ির পেছনের কাঁচটা গুঁড়োগুঁড়ো করে দিল একটা বুলেট। তারপরই গাড়ির বডিতে বাউন্স করে ছিটকে যেতে শুনলাম আরো দুটোকে। শস্তা চাইনিজ পিস্তলের গুলি।
আমার শরীরটা অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে গাড়ির দরজা দিয়ে। গাড়ির ভেতরে ফেরত যাবার কোনো চেষ্টা করলাম না আমি, বরং সামনে ঝুঁকিয়ে দিলাম নিেেজকে, মাটির দিকে। আমার দু-হাতের তালু আর কপাল একসাথে মাটিতে লাগার সাথে সাথে পা দুটো শূন্যে তুলে নিলাম আমি, সম্পূর্ণ করলাম ডিগবাজিটা। দরকার ছিলো এটা, কারণ এক সেকেন্ড আগে আমি যেখানে ছিলাম সেখানকার বাতাস এই মাত্র বৃথাই ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল দুটো বুলেট।
একটা ডাস্টবিনের আড়ালে আমাকে নিয়ে এসেছে ডিগবাজিটা। চমৎকার কভার। চোখের পলকে সেফটি ক্যাচটা অফ করেই পিস্তল ধরা হাতটা বাইরে বের করে ফায়ার করলাম আমি। দেখার দরকার পড়লো না, গগনবিদারি একটা আর্তনাদই জানিয়ে দিলো যে আমার গুলিটা মিস করেনি।
ওই পক্ষের গোলাগুলি থেমে গেছে। হতভম্ব হয়ে পড়েছে ওরা কয়েক মুহূর্তের জন্য। এই সুযোগটা ছাড়লাম না আমি, লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম ডাস্টবিনের আড়াল থেকে। পেছনের গাড়িটা থেকে চারজনই বেরিয়ে এসেছিল আমাদের ওপর ওপেন ফায়ার করবে বলে, আর সেটা করতে গিয়ে নিজেদের কভার হারিয়েছে পুরোপুরি। একজন মাটিতে, আমার গুলি খেয়ে কোঁকাচ্ছে। আবছা আলোয় বোমা মজিদের শেপটা চিনতে ভুল হলো না আমার। রিভলভারটা তুলে ফায়ার করলাম আমি। কিন্তু তার আগেই সরে গেছে বোমা মজিদ, ওর পেছনের জন এমনভাবে ছিটকে মাটিতে পড়লো যেন অদৃশ্যমানবের ঘুষি খেয়েছে।
আমার কানের পাশে প্রচন্ড একটা গানফায়ারের শব্দ শুনে আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম আমি। না, কই, কোনো বুলেট আমাকে ফুঁড়ে যায়নি তো! ঝট করে ঘুরে দেখি আমার পাশে চলে এসেছে শিপলু, গাড়ির খোলা দরজাটার কাভার নিয়ে গুলি করছে উল্টোদিকের গাড়িটার দিকে, গলির মাথা আটকে আছে যে গাড়িটা। ওটা থেকে বেরোতে চাওয়া একমাত্র যাত্রিকে মাটিতে উল্টে পড়তে দেখলাম।
আর এক সেকেন্ড সময় পেলেই ধীরে-সুস্থে তাক করে বোমা মজিদের খুলিটা উড়িয়ে দিতে পারতাম আমি, কিন্তু এখনো ওর পাশে রয়ে গেছে একজন, তার ফায়ারের মুখে আবার ডাস্টবিনের আড়ালে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
বোমা মজিদ কিন্তু গুলি করার কোনো চেষ্টা করছে না আমাদেরকে, বরং নিজের গাড়ির ভেতরে শরীরটা অর্ধেক ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। পালের গোদার এই পিছু হটার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না আমি সেই মুহূর্তে। পালানোর চেষ্টা? নাকি গাড়ির ভেতর থেকে কোনোকিছু বের করার চেষ্টা করছে সে?
পরের কথাটা মাথায় আসতেই বুঝে গেলাম ব্যাপারটা।
বোমা মজিদ তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করতে চলেছে। এরশাদের আমলে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যত বোমা ফেটেছে তার সিংহভাগের সাপ্লাইদাতা ছিলো বোমা মজিদ। তার মত বোমা বানানোর হাত নাকি আর কারো নেই ঢাকা শহরে। নিজেও অসংখ্য বোমা ফাটিয়েছে ছাত্র সমাজ করার সময়।
গুলি খাওয়ার ভয় নেই হয়ে গেল আমার, এক লাফে বেরিয়ে এলাম ডাস্টবিনের আড়াল থেকে। বোমা মজিদের একমাত্র অক্ষত সঙ্গি নিজের পিস্তল রিলোডে ব্যস্ত। হাটুতে এক গুলি করে শুইয়ে দিলাম তাকে।
এখন খালি বোমা মজিদই বাকি। আবছা আলোয় শরীরের কালো অবয়বটাই কেবল দেখা যাচ্ছে তার। নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। দু-পা ফাঁক করা। দুই হাত শরীরের দু-দিকে, তাতে গোল কিছু ধরা, সে দুটোর সলতে থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকি। ঠিক যেন সদ্য ম্যাচের কাঠি ছোঁয়ানো পটকা।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার কেন যেন, শিরশিরিয়ে উঠলো মেরুদন্ডটা। বোমা মজিদকে নিয়ে শোনা অনেকগুলো গল্প মনে পড়ে গেল একসাথে। কোনো অস্ত্রে নাকি তার ক্ষতি করা যায় না। যতই পেটানো হোক, কোনো ব্যথা নাকি পায় না। তার বিপক্ষ দলের এক ছেলের কাছে শুনেছিলাম, ক্যাম্পাসে শুটআউটের সময় নাকি পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বোমা মজিদের বুকে গুলি করেছিল সে, কিছুই হয়নি। হাকিম চত্বরে বোমাবাজি করতে গিয়ে নাকি বোমা মজিদের হাতেই ফেটেছিল একটা বোমা। কিছুই হয়নি।
আমার থার্টি এইটটা সোজা বোমা মজিদের বুকের দিকে তাক করা, কিন্তু ট্রিগার টানতে পারলাম না কেন যেন, কে যেন জমিয়ে দিয়েছে আমার ট্রিগার ফিঙ্গার। স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ডান-হাতটা ওপরে তুললো বোমা মজিদ, এখনি ছুঁড়ে মারবে বোমাটা।
আমার হাতের ভেতরে যেন আপনা থেকেই গর্জে উঠলো থার্টি এইটটা। বোমা মজিদের গাড়ির উইন্ডশিল্ডে গর্ত তৈরি হলো আরেকটা।
মিস করেছি আমি!
বেসবল ছোঁড়ার ভঙ্গিতে হাতটা ততক্ষণে বাড়িয়ে দিয়েছে বোমা মজিদ। আবছা আঁধারে একটা আলোর রেখা তৈরি করে ছুটে এলো সলতে জ্বালানো বোমাটা।
চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, “জামশেদ-সাবধান!” বলে গাড়ির ভেতরে ঝাঁপ দিয়েছে শিপলু। আমিও নড়তে চাইলাম, পারলাম না। শরীরের সব মাংসপেশীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি যেন। চেয়ে চেয়ে দেখলাম বোমাটা উড়ে এলো, ঠং করে ঠোকর খেল আমার গাড়ির বডির সাথে, মাটিতে পড়লো তারপর। একদম আমার সামনেই। সলতে শেষ হয়ে এসেছে, ফাটবে এখনই।
সামাদের মুখে অনেকবার শুনেছি ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ রেসপন্সের কথা। সেই জিনিস অ্যাক্টিভেটেড হলো আমার মাঝে ধাঁ করে। প্রবল একটা ঝাঁকি দিয়ে সম্বিৎ ফিরলো আমার, কি করছি তা না বুঝেই ডানপায়ের একটা লাথিতে টেপ প্যাঁচানো উঁচুনিচু বলের মত বোমাটাকে রাস্তার পাশের ড্রেনটায় ফেলে দিলাম আমি, তারপর খোলা দরজাটা দিয়ে ঝাঁপ দিলাম নিজের গাড়ির ভেতরে।
আমার হাতের কনুইদুটো সিটের সাথে লাগতে না লাগতেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আমাদের চারপাশে।
প্রচন্ড শব্দে ফেটেছে বোমাটা। শকওয়েভের ধাক্কায় মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেছে আমাদের গাড়ি, সেইসাথে আমিও। গাড়ির অবশিষ্ট গ্লাসগুলো ভেঙে টুকরোগুলো চাকভাঙা মৌমাছির মত ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক। কানে তালা লেগে গেছে আমার, ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে, ভাঙা কাঁচ লেগে কেটে গেছে হাতে-মুখে এখানে ওখানে, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সবটুকু দম-কিন্তু মরিনি। বেঁচে আছি।
বোমাটা ড্রেনে পড়াতেই রক্ষা।
কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করলাম সিটের ওপরে। খচাখচ হাতে ফুটছে কাঁচের টুকরো—চটচটে একটা তরল বিছিয়ে আছে পুরো সিটের ওপরে। আমার সারা গায়েও লেপ্টে আছে সেই জিনিস। রক্ত নাকি! কিন্তু কই, আমার গায়ের কোনোখানে সেরকম মারাত্মকভাবে লেগেছে বলে তো মনে হচ্ছে না! নাকি লেগেছে, টের পাইনি?
ভাবার সময় নেই অত। বোমা মজিদের হাতে আরো একটা বোমা আছে-আমার মাথাজুড়ে কেবল এই একটাই চিন্তা। সামনের সিটের নিচে পড়ে থাকা শিপলু ভাঙা গলায় কি যেন বলে চেঁচিয়েই যাচ্ছে-আমার ঝাঁকি খাওয়া মগজ সেটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারছে না।
থার্টি এইট পিস্তলটা এখনো হাতেই রয়ে গেছে আমার। সেটা তাক করে উঁকি দিলাম আমি গাড়ির পেছনের কাঁচবিহীন জানালা দিয়ে। বোমা মজিদ অন্য বোমাটা ছোঁড়ার জন্য তৈরি-হাতটা ওপরে তুলতে শুরু করেছে। এবারে মিস করবে বলে মনে হচ্ছে না, গাড়ি সহ উড়িয়ে দেবে আমাদের তিনজনকেই। আমাদের জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে কেবল আমার গোল্ড মেডেল জেতা নিশানা।
নাক-মুখ দিয়ে বিরাট একটা নিশ্বাস নিয়ে খালি হওয়া ফুসফুসদুটো ভরিয়ে নিলাম আমি, দু-হাতে ধরলাম পিস্তলটা, স্কোপের সামনে বোমা মজিদকে পাওয়ার সাথে সাথেই টেনে দিলাম ট্রিগার।
একটা ঝাঁকি খেয়ে পেছনে উল্টে পড়লো কুখ্যাত বোমারু বোমা মজিদ। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই লাফ দিয়ে সামনে এগোলো আমাদের গাড়িটা, হুমড়ি খাইয়ে দিল আমাকে।
শিপলুর চেঁচানির মর্মার্থ বুঝলাম এতক্ষণে। চেঁচাচ্ছিল ও সামাদের উদ্দেশ্যে, “সামাদ-ড্রাইভ! ড্রাইভ! ড্রাইভ!” বলে।
গলির মুখ আটকে থাকা গাড়িটা ছিটকে একদিকে সরে গেল আমাদের গাড়ির বাম্পারের ধাক্কা খেয়ে। সামনে রাস্তা ক্লিয়ার, মেইন রোডে উঠে এসেছি আমরা। বেসামালভাবে দুলতে থাকা গাড়িটা সামলানোর জন্য স্টিয়ারিংয়ের ওপর রীতিমত চড়াও হয়ে শক্তহাতে সেটাকে ঘোরাচ্ছে সামাদ। এতক্ষণ নিজের সিটের নিচে
ঢুকে ছিলো ও, তিনজনের মাঝে সবচেয়ে ভালো শেপে আছে ও-ই। গাড়ির নাক সোজা হবার সাথে সাথেই এক্সেলেটর একেবারে মেঝের সাথে দাবিয়ে ধরেছে সামাদ।
আবার আমরা ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছি তীব্ৰ গতিতে।
গাড়ির ভাঙা জানালা, এখানে ওখানে গুলির দাগ, বডির এখানে-ওখানে তুবড়ে যাওয়া আর বাম্পার ভেঙে রাস্তার সাথে ঘষা খাবার ব্যাপারটা না থাকলে বলতে পারতাম, একটু আগের ব্যাপারটা যেন ঘটেইনি।
আমি এখনো সেই চটচটে তরলে মাখামাখি। দু-পা ফাঁক করে সিটে বসে আছি আমি, হাতে এখনো ধরা আছে গুলি প্রায় ফুরোনো থার্টি এইট রিভলভারটা। সিটের ওপরও সেই চটচটে তরলের আস্তর।
গালে হাত বুলিয়ে নাকের সামনে ধরলাম আমি। উৎকট একটা গন্ধ নাকে লাগলো। না, রক্ত নয়, মগজও নয়, তরলটা আসলে ড্রেনের থকথকে ময়লা।
সামনের সিটে স্পিকটি নট হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সামাদ, তার পাশের সিটে বসা শিপলু ইতোমধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। গাড়ি চলছে, আমাদের মুখে কোনো কথা নেই।
আমার মাথায় চলছে চিন্তার ঝড়। ওখানে কতজন মারা গেছে কে জানে। গোটা ব্যাপারটা সামনে বিরাট জট পাকাবে। রাশেদ কি তার অন্য কোনো চামচাকে দিয়ে আমার ওপর আবার অ্যামবুশ করবে? করতেই পারে। রাশেদ কি তার পকেটে থাকা কোনো ওসিকে বিরাট অংকের ঘুষ খাইয়ে এমনভাবে মামলা সাজাবে যে আমিই আসলে বোমা মজিদের ওপর অ্যাটাক করেছি? করতেই পারে। দূরে কোথাও চলে যেতে হবে, তারপর ব্যাপারটা ঠান্ডা হবার সময় দিতে হবে।
অনেক অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললাম আমি। “শিপলু, তোর সেই রহস্যময় প্রাণী না কোথায় দেখা গেছে রে?”
সিগারেটে আরো দুটো টান দেবার পরে মুখ খুললো শিপলু। “রংপুরে।”
অনেক অনেকক্ষণ পরে বললাম, “শিপলু, বাঘের মুখোমুখি হবার আগে একজন গোল্ড মেডেল জেতা শুটারকে সাথে নিস।”