শ্বাপদ সনে – ৩

অধ্যায় ৩ – জামশেদের জবানবন্দিতে

সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে আয়না রাখা কেন? পাগলেরা এসে মুখ দেখবে বলে?

কোনো জুৎসই জবাব খুঁজে পেলাম না, আর তাতে আরো খিঁচড়ে গেল মেজাজটা। আয়নায় আমার প্রতিফলনটার ভুরুদুটো কুঁচকে আছে, দেখতে পাচ্ছি। আয়নার ওপাশের আমির ব্যাকব্রাশ করা চুল, শক্ত চোয়াল, তাতে দু-দিনের না কামানো দাড়ি, পরিপাটি করে ছাঁটা গোঁফ। চোখের নিচে হালকা কালির ছাপ। বেশ কষ্ট করে ভুরু স্বাভাবিক করলাম আমি

চেম্বারে ঢোকার আগে সামাদ কি বলেছিলো, মনে পড়লো। ডঃ শামসুর রহমান, এম.বি.বি.এস, বি.সি.এস (স্বাস্থ্য), এফ.সি.পি.এস. এর চেম্বারের হাতলটা ধরে ঘোরানোর আগে চরম ইতস্তত করে আমার দিকে চেয়ে ও বলেছিলো, “অ্যা…জামশেদ ভাই, শামসুর স্যার কিন্তু নিজেও একটু ইয়ে। উনি…মানে…ওনার সাথে নিউট্রালি বিহেভ করলেই বোধহয় ভালো হয়। ট্রাস্ট মি, হি ইজ আ ভেরি গুড ডক্টর।”

কাজেই আমার মিলিটারি মেজাজটা স্বাভাবিক রাখা উচিত নিজের স্বার্থেই। সামাদ এমনভাবে রিকমেন্ড করলো, না এসে আর পারলাম না। ওর মতে দেশের সেরা সাইকিয়াট্রিস্ট নাকি এই লোক। চেম্বার দেখে সেরকম পসার বোঝা গেল না অবশ্য। আর এই টেকো মাথার হাড়গিলে ডাক্তারের চেহারা দেখলেও সেরকম ভক্তি হয় না। সামাদটা আবারও ডোবাবে মনে হচ্ছে।

পাশের দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। টেবিলের ও-মাথায় ডাক্তার, এই মাথায় আমি আর সামাদ। আমার হিস্ট্রি শোনা শেষ ডাক্তারের, খেজুরে আলাপ জুড়েছে এখন সামাদের সাথে। লোকটা সামাদের টিচার ছিলো, কাজেই গল্পের অভাব নেই। তাছাড়া বাইরেও কোনো রোগি নেই, আমরাই সারাদিনে এই লোকের একমাত্র রোগি নাকি কে জানে।

“আপনি কি কোনো ড্রাগস ইউজ করেন?” হঠাৎ গল্প থামিয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন যে চমকে উঠলাম।

“না,” ঠান্ডা গলায় বললাম। “অ্যাজ আই হ্যাভ টোল্ড ইউ বিফোর, আই হ্যাভ অ্যা ড্রিঙ্কিং প্রবলেম। বাট নো ড্রাগস। নেভার।”

মোটা চশমার আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন ডাক্তার, এবার চোখ নামিয়ে খসখস করে একটা খাতার পাতায় লিখতে শুরু করলেন। কোনো প্যাডে না, একটা ইউনিভার্সিটি খাতার পাতায়।

লেখা শেষ করে খাতার পাতাটা খুব যত্ন করে ভাঁজ করলেন ডাক্তারসাহেব, তারপর ফড়াৎ করে ছিঁড়ে ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। বাহ। যেমন ডাক্তার, তেমনি তার প্রেসক্রিপশন।

“আমার…প্রবলেমটা কি?” কাগজটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলাম।

“মোস্ট লাইকলি এক্সপ্লেনেশন হচ্ছে ড্রাগস,” বোতলের তলার মত মোটা চশমার কারণে ফুটবল বনা চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ডাক্তার। “কিছু ড্রাগস আছে যেগুলো হ্যালুসিনেশন ঘটায়। কয়েকটা রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু আপনি যেহেতু সেটা নাকচ করে দিচ্ছেন, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। চাইল্ডহুড ট্রমার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম, বাট আপনিই তো বললেন আপনার মায়ের মৃত্যুর কথা আপনার মনে নেই, আর সেটা নিশ্চই আপনার মনোজগতে প্রভাবও বিস্তার করতে পারেনি…”

“চাইল্ডহুড ট্রমা, হু,” নিচু গলায় বিড়বিড় করে বললাম আমি। “কোনো কিছু এক্সপ্লেন না করতে পারলেই তো আপনারা চাইল্ডহুড ট্রমা ঢুকিয়ে দেন।”

“…তাহলে, আপনার বাবার মধ্যেই আপনি আপনার বাবা-মা দু-জনকেই খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আপনার বাবাও আপনাকে বেশি সময় দিতে পারেননি, সেটা তো বোঝাই যায়, যেহেতু আপনার বাবার নাম আব্বাস রহমান খান।” আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি ডাক্তারের, গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছেন তিনি। লোকটার স্বর পাতলা, কাজেই গুরুত্ব কম, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কি একটা কর্তৃত্বের ভাব আছে, মন দিয়ে কথা না শুনে উপায় থাকে না। “কলম্বোতে গাড়ি দুর্ঘটনায় আপনার বাবা মারা গেলেন। তার মৃত্যুর সময় আপনি কাছেও থাকতে পারলেন না। সেই কলম্বোতেই আপনি আবার সাফ গেমসে সোনা জিতেছিলেন পাঁচ বছর আগে।”

একটু বিরতি নিলেন ডাঃ শামসুর। মোটা চশমার আড়ালে ডাক্তারের চোখ পিটপিট করতে দেখলাম। এক হাতের আঙুলের ভেতর আরেক হাতের আঙুল গলিয়ে থুতনির নিচে রাখলেন তিনি। “আপনার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক দুটো ঘটনার অ্যামালগামেশন করে দুঃস্বপ্নটা তৈরি করলো।”

“আর হ্যালুসিনেশন?” আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো।

“নো আইডিয়া।” বলে আমার মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন পাগলের ডাক্তার।

কয়েকটা অস্বস্তিকর সেকেন্ড কাটার পরে উঠে দাঁড়ালাম আমি। “তো…যেসব ড্রাগস প্রেসক্রাইব করলেন…

“স্রেফ ঘুমের ঔষধ। জামশেদসাহেব, আপনার স্নায়ু উত্তেজিত। কোথাও থেকে ঘুরে আসুন। বেড়িয়ে আসুন। ভালো লাগবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা কথায় কথায় হাওয়া বদল করতেন, তার সুফলও পেতেন। ঢাকা থেকে দূরে দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে আসলে বোধহয় সবারই ভালো হবে। গ্রামের বাসা আছে না? সেখান থেকে ঘুরে আসুন।”

কোনো জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার জন্ম ঢাকায়, আর সারা জীবন ঢাকাতেই কাটিয়েছি। ঢাকার বাইরে যাইনি কখনো, গ্রাম কাকে বলে কখনো চোখে দেখিনি, দেখার ইচ্ছেও নেই।

চেম্বারের দরজার হাতল ধরে ঘুরিয়েছি কেবল, পেছনে আবার মুখ খুললেন ডাক্তার শামসুল। “তাতে আপনার ঘোরটাও কাটবে আশা করি। আয়নার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, সেটা আমার এক পুরনো রোগির কথা মনে করিয়ে দিল। কত বোঝালাম, সে লোক কিছুই শুনলো না। শেষ যেবার খোঁজ নিয়েছিলাম, শুনেছিলাম হেমায়েতপুরে নাকি সিট পেয়েছিল বেচারা। সেখানেও যা ভিড় আজকাল।”

বিকেলে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি আইরিনের সাথে। বেইলি রোড

বড় একটা পেস্ট্রি নিয়ে বসেছে আইরিন। চামচে করে একটা-একটা টুকরো মুখে পুরে কথা বলছে ও। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলার বদভ্যাস আছে এই মেয়ের গত আধা ঘন্টা যাবত শুনতে হলো ওর বান্ধবি সিনথিয়া নিউইয়র্কের এক সুপারশপে গিয়ে কি বোকামি করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। পাঞ্চলাইনটা বলার পরে খিখিল করে হাসলো, আমিও হাসার ভান করলাম যথাসাধ্য।

“সো, কোম্পানি নিয়ে খুব বিজি আজকাল?” খানিকক্ষণ চুপ থাকার পরে হালকা চালে প্রশ্ন করলো আইরিন।

আমার সামনে একটা কফির মগ। সেটার হ্যান্ডেল নিয়ে নাড়াচাড়া করছি কিছুক্ষণ যাবৎ, চুমুক দেয়া আর হচ্ছে না। আইরিনের প্রশ্ন শুনে নাড়ানাড়ি থামিয়ে হাত নামিয়ে কোলের ওপরে রাখলাম। চোখ তুলে তাকালাম আইরিনের দিক। বেশ কায়দা করে বাঁধা সোজা কালো চুল, ডিমের মত মুখ, ফর্সা রং, কিশোরির মত চিবুক। আইরিনকে যে ভালো করে চেনা না সে প্রথম দেখায় ওকে লাজুক এক কিশোরি ছাড়া আর কিছু মনে করবে না। ওকে হাঁড়ে হাঁড়ে চিনতে হলে ওর সাথে তিনবছর ধরে প্রেম করতে হবে। আমার মত।

“ইয়েস, কাইন্ড অফ। একটা এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির এত কাজ, জানা ছিল না। আমার তো ধারণা ছিল বাবার কাজটা খুব সোজা, হা-হা-হা।” কাষ্ঠ হেসে বললাম।

খিলখিল করে হেসে উঠলো আইরিনও। “হি হি হি। বাট আমার জামশেদ রহমান খান বলে কথা! কোনো কাজই তো কঠিন না তোমার কাছে! ইন ফ্যাক্ট, একটা কোম্পানি চালানোও তোমার কাছে এত সহজ যে, সারাদিন বাসায় বসেই করে ফেলো!”

আমার কাষ্ঠ হাসি ততক্ষণে প্রস্তর হাসিতে পরিণত হয়েছে। আইরিন কিন্তু তখনো একইভাবে হাসছে। ওর বাপকে মন্ত্রি বানিয়েছে কে? মেয়েই তো তার চেয়ে বেশি সেয়ানা।

“দেখো জামশেদ,” হঠাৎ ভোল পাল্টে ফেললো মেয়েটা, চোখে উদ্বেগ নিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে আমার হাতটা ছুঁলো ও, “ড্যাডি আমার বিয়ের চিন্তা করছে। সেদিন আকারে-ইঙ্গিতে আমার কাছ থেকেও জানতে চাইছিলেন আমি বিয়ের জন্য রেডি কি না।”

“তুমি কি বললে?” নিরাসক্ত গলায় জানতে চাইলাম।

“আমিও আকার ইঙ্গিতে তোমার কথা জানালাম। দেখো জামশেদ, আমি শিওর, ড্যাডি তোমাকে অনেক লাইক করেন। তোমার বাবার সাথে ওনার খুব খাতির ছিলো। তোমার বাবার ব্যাপারে সবসময় ভালো বলতে শুনেছি ড্যাডিকে। বাট…..”

কফির মগের হ্যান্ডেলে একটা মাছি বসেছে। সেটা সামনের পা দুটো একসাথে ঘষতে শুরু করেছে, যেন খেতে শুরু করার আগে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে নিচ্ছে। “বাট?” সেদিক থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে আইরিনের কথারই প্রতিধ্বনি করলাম,

“বাট কিছু না।” চোখ ঘুরিয়ে বললো সে। ঠোঁট এখনো ফোলানো। কথায় কথায় ওর ঠোট ফোলানোর কারণ আছে বটে। ওর নিচের ঠোঁটের ডান দিকে একটা তিল।

“তোমার বাবা বলেছে আমি একটা অ্যালকোহলিক, ইরেসপন্সিবল, সো তোমার উচিত পছন্দ চেঞ্জ করা। তাই না?” সহজ গলায় বললাম আমি।

“জামশেদ!” পার্লারে গিয়ে অতি যত্নে স্মোকি শেড দেয়া চোখদুটো বড় বড় করে বললো আইরিন।

“আর এটাও নিশ্চয় বলেছেন, আমার মত বেয়াদব ছেলে উনি জীবনে দুটো দেখেননি।”

“স্টপ ইট!”

“আমার বদমেজাজের কথা তো বলেছেনই। আমি কবে কখন কার মাথা ফাটিয়েছি, হাত ভেঙেছি, কোন বিশিষ্ট কোটিপতি ভদ্রলোকের সাথে বেয়াদবি করেছি, কোন এমপির ব্যাটাকে দিনে দুপুরে রাস্তায় ন্যাংটা করেছি-সব নিশ্চই শুনিয়েছেন তোমাকে?”

“জামশেদ, আই ক্যান নট বিলিভ”

“সবচেয়ে বড় কথা, তোমাদের মাঝে এই কনভার্সেশনটা হয়ইনি। তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে নিয়ে একটা কথাও বলেননি।” ঠান্ডা গলায় বোমাটা ছাড়লাম।

আইরিন একদম চুপ, ঠোঁট যেন সুপার গ্লু দিয়ে মেরে দেয়া, টানা টানা চোখদুটো এখন রসগোল্লা।

“রাশেদ ইদানিং তোমার পিছনে আবার ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। বোঝাতে চাইছে, এখনো কত ভালোবাসে তোমাকে, তোমাকে ফিরে না পেলে আর বাঁচবে না। আর সেটায় কাজও দিচ্ছে বেশ। এতটাই কাজে দিচ্ছে, তুমি সেটায় এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছো যে তোমার এখন আমাকে ডেকে বসিয়ে বিয়ের কথা শুনিয়ে নিশ্চিত করতে হচ্ছে, আমি তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো।” ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে গেলাম।

আইরিন এখনো কিছু বলতে পারেনি, আগের মতই মোমের পুতুল বনে তাকিয়ে আছে।

আমি মগের হ্যান্ডেলের দিকে তাকালাম। মাছিটা উড়ে গেছে। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললাম। “দেখো আইরিন, আমি অতকিছু ভেবে প্রেম করিনি যে, তোমার বাবা মন্ত্রি, তার ব্যাংক ব্যালেন্স এত, তার পাওয়ার অনেক, তার ঢাকায় এতগুলা বাসা। আগে তোমার কার কার সাথে রিলেশন ছিলো সেগুলোও কনসিডার করিনি। তোমাকে ভালো লেগেছিলো-ব্যস, এতটুকুই এনাফ। এখন মনে হচ্ছে, ভুলই করেছি।”

“হাউ ডেয়ার ইউ—” চোখমুখ শক্ত করে বলতে শুরু করলো আইরিন।

“শাট আপ।” চাপা গলায় বললাম আমি।

“আই ক্যান্ট বিলিভ…”

“শাট-আপ। রাশেদের মত একটা থার্ড গ্রেডের রাস্কেলের সাথে যার প্রেম ছিলো, তাকে আমি ভালোবাসতে পারলাম কিভাবে, এটাই তো একটা বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। ওকে তুমি ভুলে গেলেও একটা কথা ছিলো-বাস্টার্ডটা এখন বিভিন্ন মেয়ের সর্বনাশ করে হাঁপিয়ে উঠে আবার তোমাকে ফেরত চাইছে-আই গেস তোমার মত ভালো পুসি সে আর কোথাও পায়নি, তাই—” কথা থামাতে বাধ্য হলাম আমি, কারণ পানির গ্লাসটা আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে আইরিন। সেটা আমার গায়ে লাগেনি অবশ্য, আমার কাঁধের পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু পানির ঝাপটাটা ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে।

আইরিন উঠে দাঁড়িয়েছে। চেহারা থেকে লাবণ্যের শেষ ছোঁয়াটাও মুছে গেছে ওর, রাগের চোটে যেন একটা কুৎসিত মুখোশে পাল্টে গেছে ওর মুখটা। কিছু বলার চেষ্টা করছে, পারছে না।

আমি বসেই রইলাম, একইভাবে। গা থেকে পানি মোছারও চেষ্টা করলাম না। চেয়ে আছি আইরিনের দিকে। “কান্ট বিলিভ আই হ্যাভ ডেটেড অ্যা টোটাল বিচ দিস লং।” শীতল, নিচু গলায় বললাম আমি।

মানুষের চোখ দিয়ে আগুন বের হবার সিস্টেম থাকলে আইরিনের চোখের আগুনে এতক্ষণ ভষ্ম হয়ে যেতাম আমি। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে রইলো মেয়েটা, কিন্তু আমাকে যে এভাবে দমানো যাবে না সেটা বুঝতে সময় লাগলো না ওর। রেস্তোরাঁ ভরা সবার বিস্মিত চোখের সামনে গটগট করে হেটে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে বলে গেল, “এর জন্যে পস্তাতে হবে তোমাকে, জামশেদ।”

তখন গায়েই লাগাইনি কথাটা, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।

বাসা ফেরার সময় খেয়াল করলাম, আমার গাড়ির পেছন পেছন আসছে একটা পুরনো খয়েরি মিতসুবিসি। আইরিনের সাথে দেখা করতে আসার সময়ও এই গাড়িটাকেই আমার পিছু পিছু আসতে দেখেছিলাম মনে হয়। কি জানি। ডাজন্ট ম্যাটার।

যদি তক্ষুণি সাবধান হতাম, কে জানে, আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটার মুখোমুখি হয়তো আর হতেই হতো না।

কেস স্টাডি : ‘অ্যানজাইনা

[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইসভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো।]

দুই মাস আগে মাসিক হালচালের ঠিকানায় এসে পৌঁছেছিল একটা চিঠি। ‘বরাবর’ এর নিচে আমার নাম লেখা কাঁপা কাঁপা হাতে। খুললাম। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন শুরু করার পর থেকে আমার ঠিকানায় বহু আজেবাজে চিঠি আসে বটে, কিন্তু অথেনটিকগুলো চিনতে ভুল হয় না আমার চোখ পেকে গেছে। এই চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম, চিঠির প্রেরক যা যা লিখেছে তার সবই সত্যি।

চিঠিটা লিখেছে কলেজ পড়য়া এক ছেলে বছর ষোল বয়স। মফস্বলে বাড়ি। ঢাকায় আসা সম্ভব নয়, তার শরীর অসম্ভব খারাপ। কেন খারাপ তার কারণ লেখা আছে দু-তিন লাইনে। সেই দু’তিন লাইনে যা লেখা সেটা পড়ে আমার আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। সে-দিন রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দিলাম সেই মফস্বল শহরের দিকে। সঙ্গত কারণেই সেই ঠিকানা এখানে লিখছি না।

ছেলেটার নাম, ধরুন, জয়। জয়ের সাথে দেখা করার কথা ছিলো ওদের শহরের এক বিখ্যাত কলেজের শহীদ মিনারে। ঠিক সময়েই হাজির থাকলাম জায়গামত।

দারুণ সুন্দর ক্যাম্পাস। শহীদ মিনারের বেদীতে বসে আছি। চমৎকার আবহাওয়া। গত কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টির পর ঝকঝক করছে আকাশটা। বিকেলের সোনালি রোদটায় আরমদায়ক উষ্ণতা।

কলেজ ছুটি দিয়ে দিয়েছে। শহীদ মিনারের সামনের রাস্তাটা দিয়ে শত শত ছেলেমেয়েকে বাইরের গেটের দিকে যেতে দেখলাম। খালি একজনের গতিপথ এই ফাঁকা শহীদ মিনারের দিকে।

সন্দেহ নেই এটাই জয়। রোগা, লম্বা একটা ছেলে, গায়ের রঙ শ্যামলা, মাথায় অবিন্যস্ত চুল। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটা সুস্থ নয়। কোটরে ঢোকা চোখের নিচে কালি, মুখ শুকনো, হাত দুটো অস্বাভাবিকভাবে বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। হাটার ভঙ্গিটা আড়ষ্ট। সবচেয়ে চোখে লাগে ছেলেটার একেবারে নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট।

সোজা আমার সামনে এসে থামলো সে। মাথা নামিয়ে নিচু এতক্ষণ, এবারে মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে। “আপনিই?”

“হ্যা, আমিই।” হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। “বসো। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো না।”

“আপনি আমার অনেক সিনিয়র হবেন।” ক্লাস্তভাবে বসতে বসতে বললো জয়। “শুরুতেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ভাই। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। ঢাকা থেকে ডেকে এনেছি দুইশো মাইল দূরে।”

“চিঠিতে যা লিখেছিলে সেটা যদি বিস্তারিত বলতে পারো তাহলে সেটাকে আর কষ্ট মনে করবো না আমি।” ডেমোক্র্যাটিক পদ্ধতিতে জবাব দিলাম।

“অবশ্যই। অবশ্যই।” মাথার চুল খামচে ধরে নিচু গলায় বললো জয়। “আপনি বোধহয় ভাবছেন, আমি চিঠিতে লিখেছি আমার শরীর খুব খারাপ, এখন আবার আমি কলেজে কি করছি। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি আপনার সাথে কথা বলার জন্যই কলেজে এসেছি আজকে। আপনাকে বাসায় নিতে পারিনি, সরি, আমার ফ্যামিলি একটু কনজারভেটিভ ধরণের। কলেজে আসার জন্য আম্মুকে মিথ্যে বলেছি, আজকে শরীরটা অনেক ভালো লাগছে।” হঠাৎ চোখ তুলে সোজা আমার চোখে তাকালো জয়। “মিথ্যে বলেছি। আজকে আমার শরীর আরো খারাপ। দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। আমি জানি আমি বাঁচবো না। আমি শুধু চাই মরার আগে কেউ আমার কাহিনীটা জেনে যাক।”

আমি কিছুই বললাম না। একটা সিগারেট বের করেছি কেবল পকেট থেকে, চোখে পড়ার সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠলো জয় ভয়ার্ত গলায়। “না-না! প্লিজ না! প্লিজ না!”

আমি অবাক চোখে তাকাতেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “কিছু মনে করবেন না। পুরো কাহিনী শুনলে আমার ওপরে আর রাগ করতে পারবেন না।”

এবার জয় শুরু করলো ওর আসল কাহিনী। পুরোটা ওর ভাষায়ই তুলে দিলাম : বৃষ্টি আমার অনেক ভাল্লাগে সেটা ঠিক-কিন্তু সে বৃষ্টি হতে হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সকালের বৃষ্টি খুব ভাল্লাগে, দিনটা শুরু হয় একটা স্বর্গিয় অনুভূতি নিয়ে। দুপুরের বৃষ্টিও খারাপ না, আম্মুর কাছে ঘ্যানঘ্যান করে ভুনা খিচুড়ি বানিয়ে নিয়ে সেটা গপগপ করে খেতে বড্ড মজা। বিকেলের বৃষ্টিটা হাতে কোনো প্রিয় কবিতার বই নিয়ে জানালার পাশে বসে ভাবনার জগতে হারিয়ে যাবার জন্য পারফেক্ট। আর রাতের বৃষ্টি-সে আর না-ই বা বললাম। আব্বু আমাকে রাত জাগতে দেন না, ফজরের নামাজের তাড়ার জন্য, সেজন্য বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকি মূর্তির মতো। এক ঘন্টা-দু’ ঘন্টা-অনেক ঘন্টা। অসাধারণ একটা অনুভূতি হয়, একেবারে স্বর্গীয়। তারপর একসময় আস্তে আস্তে জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে যে ঘুমটা হয়, সেটার দাম লাখ টাকাও না, কোটি টাকা।

আসলে সব সময়ের বৃষ্টিই আমার ভাল্লাগে খালি সন্ধ্যার বৃষ্টিটা বাদে। কারণ তখনই আমি বাইরে আড্ডা দিতে যাই। আর এই আড্ডাটা আমার জন্য খুবই দরকারি!

সেদিন বিকেল বেলাটা রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কাটলো স্বপ্নের মত। একেবারে আদর্শ শ্রাবণের বৃষ্টি। আকাশে গুড়গুড় নেই, কেবল ঘন ধূসর মেঘের পাক খাওয়া, আর তা থেকে টানা ক্যাটস অ্যান্ড ডগস বর্ষণ। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বাড়ি টিনশেড। টিনের চালে বৃষ্টির একটা আলাদা শব্দ আছে-নেশা ধরে যায়। যে শোনেনি, সে বুঝবে না কতটা রোমান্টিক এই কলতান।

অবশ্য বিকেল গড়িয়ে যত সন্ধ্যা হতে লাগলো, আমার কবি কবি ভাব উবে যেতে লাগলো ততই। এ-রুম ও রুম ঘুরে সময় কাটালাম খানিকক্ষণ আগে। মনে মনে বললাম, আজকে তো অনেক বৃষ্টি হলো, এবার একটু থামুক! এখনই সব বৃষ্টি হয়ে গেলে বাকি রাতটা কি হবে? বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি, যেন অমনটা করলেই বৃষ্টি কমে যাবে জাদুর মত।

ছয়টা পেরোলো, আমি ততক্ষণে বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছি। মেজাজ খাপ্পা হতে শুরু করেছে। কয়েকবার বিড়বিড় করে ব-বর্গীয় কয়েকটা গালি দিলাম। কাকে, জানি না।

সোয়া ছয়টার দিকে আম্মু চা এনে দিলেন। সেটা খেয়ে অবস্থা আরো খারাপ হলো। হাত কচলাতে কচলাতে অস্থির হয়ে হাটাহাটি করছি এ-ঘর ও-ঘর।

সাড়ে ছয়টার দিকে পাগল হতে আর বাকি থাকলো আমার। বৃষ্টি কমেনি একটুও। এই ধরণের বৃষ্টি একবার শুরু হলে একইভাবে পড়তে থাকে ছয়-সাত ঘন্টা। আমার কাকুতি-মিনতিতে সেটা কমার কোনো কারণ নেই

বারবার কেবল মনে হচ্ছে, এতক্ষণে তারার চায়ের দোকানে এসে পড়েছে হয়তো আমার আড্ডার বাকি সবাই। এত বৃষ্টিতে কি কেউ আসবে? অবশ্যই আসবে! আড্ডার কোনো এক সদস্যের বলা একটা কথা মনে পড়লো : ভাত না খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু …

নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, আজ না গেলে হয় না? আবার নিজেই নিজের ওপর গর্জে উঠলাম, না, হয় না! সারা দিনে এই একটাই আনন্দের উপলক্ষ্য আমার। সেটা থেকেও যদি নিজেকে বঞ্চিত করি, তাহলে লাইফে থাকলোটা কি? তাছাড়া আড্ডায় গেলে শুভ আর সিবাতের সাথে দেখা হবে। ওদের সাথে ব্যাচে টিউশনিতে পড়ি আমি। আজ টিউশনিতে যাইনি, ওদের সাথে দেখা হলে আজকে স্যার কি পড়া দিয়েছেন সেটা জানতে পারতাম। অবশ্য এটা যে একটা ছল মাত্র, কুযুক্তি, সেটা জানা আছে আমার।

পৌনে সাতটার দিকে আর পরলাম না। জানালার গ্রিলে ঝোলানো ছাতাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে প্যান্ট গোটানো শুরু করলাম। বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়বো।

যা হবার তাই হলো। আম্মু এসে আমার কান্ডকীর্তি দেখে অবাক হয়ে বললেন, “কি ব্যাপার, বাবু, কই যাও?”

“একটু শুভর বাসায় যেতে হবে।” মিথ্যে বললাম। “আজকে শাহজাহান স্যারের প্রাইভেট মিস করেছি। কী যে পড়া দিলেন, কে জানে! সামনে আবার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল—” বলতে বলতে ফট করে ছাতা মেলে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। বেশি কথা বলতে চাই না আম্মুর সাথে, তাহলে বেশি মিথ্যে বলতে হবে। বেশি অপরাধবোধের ঝক্কি।

বাইরে বেরিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। শ্রাবণের টানা বৃষ্টি, সাথে হিমেল বাতাস। ছাতার ওপরে পটপট করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দটার তো কোনো তুলনাই নেই। আর তাছাড়া আমি সত্যিই তারার দোকানের আড্ডায় যাচ্ছি। মনটা ফুরফুরে হবারই কথা।

একে তো প্রায় সাতটা বেজে গেছে, তার ওপর মেঘে ঢাকা আকাশ। চারদিকে বেশ অন্ধকার। আমাদের বাসার বাইরের সরু রাস্তাটায় আলো ছড়াচ্ছে কেবল একটা টিমটিমে হলদে বাল্ব, ইলেকট্রিসিটি পোল থেকে।

ছাতা আমার মাথা বাঁচাচ্ছে বটে, কিন্তু প্যান্টের নিচের দিকটা ভিজে শেষ এরই মধ্যে। বৃষ্টির ফোঁটা পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে লাফিয়ে ওঠার সাথে সাথে কাদা ছিটিয়ে দিচ্ছে পায়ের পাতা আর প্যান্টে। বিরক্ত হয়ে গলির পাশের পুরনো শ্যাওলা পড়া পাঁচিলটার ওপরে পা তুলে দিয়ে কোনোমতে ভারসাম্য রেখে প্যান্টের নিচটা গুটিয়ে নিলাম।

সারা গলিজুড়ে কাদা। প্যাঁচ প্যাঁচ করে এগিয়ে চললাম অন্ধকার হাতড়ে, মাথার ওপরে ছাতাটা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। একটা টর্চলাইট নিয়ে আসা উচিত ছিলো, ভুল হয়ে গেছে।

মেইন রোডে উঠে এলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে মেইন রোডটা আমাদের পাড়ার গলিটার চেয়েও আঁধার। গলিতে তা-ও একটা লাইট আছে, এখানে কিচ্ছু নেই। অন্যান্য দিন অবশ্য রাত নামার পরও হুশহাশ করে একের পর এক ট্রাক আর বাস যায় রাস্তাটা দিয়ে, সেগুলোর হেডলাইটের আলোয় পথ চিনতে অসুবিধা হয় না। আজ রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা যতদূর চোখ যায় তাকিয়েও কোনো গাড়িঘোড়ার দেখা পেলাম না। ঘুটঘুটে অন্ধকার সবদিকে, কেবল রাস্তার পাশের গাছগুলোর আউটলাইন কোনোমতে বোঝা যায়।

আমি রাস্তার ওপরে উঠে এলাম। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটলেও এখন কোনো সমস্যা হবে না। একটু ভয় ভয় লাগছিল এই নির্জন পরিবেশে, সেটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করলাম ‘এই মুহূর্তে আমিই এই রাস্তার রাজা’ ভেবে।

কালকের আড্ডার একটা টপিক মনে পড়লো। রুবেল হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলছিল, “কি কও জয়! এই এলাকারই ঘটনা, আর তুমি শোনো নাই?”

আমি আমতা আমতা করছি, শুভ নাকমুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে হেসে উঠলো। “সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে যা হয়। এলাকায় একটা লাশ পাওয়া গেল তা-ও জানো না!”

“আমাদের বাড়ির কাছেই সকালে পাওয়া গেছে লাশটা,” স্বভাবসুলভ নিচু গলায় বললো সিবাত, “রাস্তার পাশের নিচু জমিতে। বিএডিসি খামারের পাশে। ওখানটা কেমন নির্জন, জানিসই তো।”

“খুন নাকি?” আগ্রহি গলায় বললাম।

“হ-হ-হইতে পারে,” সৌরভ বললো। “লো-লোকটাকে চিনবা। রিকশা চালাইতো। বাস্তুহারার বস্তিতে থাকতো। রাস্তার পাশে পড়ে ছিলো, মুখ হাঁ, চেহারা দেখে মনে হয় যেন খুব ভয় পাইছিল মরার আগে। সারা শরীর নীল। দুই আঙুলের ফাঁকে আবার একটা সিগারেট ছিলো। সেটা পুড়ে শেষ হয়া আঙুলও পুড়ে গেছিলো। ভয়ানক অবস্থা!”

“কিভাবে মরছে? কোপের দাগ আছে গায়ে?”

“না! কোনো দাগ নাই!” শুভ বলে। “এমনকি গলায় আঙুলের দাগও নাই। তবু মরে কাঠ!” বলতে গিয়ে নিজেই শিউরে ওঠে শুভ।

বাস্তবে ফিরলাম। বেশ ভয় ভয় লাগছে। বৃষ্টির বিরাম নেই। বেশ কয়েক পা এগিয়ে থমকে গেলাম আতঙ্কে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ। শেকলের শব্দ। শেকলের শব্দ তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেউ! আতঙ্কে জমে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি আমি।

আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা লম্বা কালো ছায়া। অন্ধকারে কেবল আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি ওটার অবয়ব। মূর্তিটা একেবারে আমার কাছে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত বুঝলাম না কি ওটা।

এক বুড়ো, প্রাগৈতিহাসিক এক সাইকেলে চড়ে এগিয়ে চলছে হাটার চেয়েও ধীর গতিতে। জ্যাম ধরা সাইকেলের চেন থেকে আসছে ঘড়ঘড়ানির শব্দটা।

বুড়ো আমাকে পেরিয়ে যাওয়ার পরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম ওখানেই। নিজেকে একদম বোকা বোকা লাগছে। এতটা ভয় পাওয়া উচিত হয়নি। ধুর।

বুকের ভেতরে হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে পাগলের মত। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম, লাভ হলো না। হার্টবিট কমলো না, রীতিমত ব্যথা করছে বুকটা।

বাকি রাস্তাটা তেমন একটা সমস্যা হলো না অবশ্য। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দশ-পনেরো মিনিট পরে হাজির হলাম পার্কের মোড়ে।

পার্কের মোড় একটা তেমাথা। তিন রাস্তা যেখানে এক হয়েছে সেখানে একটা তিনকোণা বাঁধানো পার্কের মতো আছে। সেটা ঘিরে বেশ অনেকগুলো দোকানপাট। পার্কের মোড়ের কাছেই একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। কাজেই জায়গাটা ছাত্রদের ভিড়ে জমজমাট থাকে রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত।

কিন্তু আজ সর্বসাকল্যে তিন চারজন লোক দেখা যাচ্ছে গোটা এলাকায়। দু- জনের মাথায় ছাতা, আর বাকিজন এইমাত্র দৌড়ে একটা ইটালিয়ান হোটেলের ছাপড়ার তলায় আশ্রয় নিলো।

দমে গেলাম একটু। তারার দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু উৎসাহটা নেই হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে আজ আমার আড্ডার কেউ হাজির নেই।

তারার দোকান স্রেফ একটা বাঁশের তৈরি চায়ের দোকান ছাড়া কিছু না। ভেতরে বেশ অনেকটা জায়গা আছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা হচ্ছে পেছনের একটা বেঞ্চ—যেটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না। এলাকার নতুন সিগারেট খেতে শেখা ছেলেদের কাছে জায়গাটা স্বর্গসম।

তারার দোকানে ঢুকে টপটপিয়ে পানি পড়তে থাকা ছাতাটা গুটিয়ে নিলাম কেউ চোখ চলছে সারা দোকানে। গোটা দোকান লোকে বোঝাই-কেউ বসে, দাঁড়িয়ে। কেউ লেবু চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট টানছে আয়েশ করে। আর বাকি সবাই আসলে দোকানে ঢুকেছে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে।

এদের মাঝে আমার আড্ডার কেউ নেই। লম্বু শুভ, খাটো শুভ, মাইদুল, সৌরভ, রুবেল বা সিবাত-কেউ না। হুদাই এসেছি।

অবশ্য আড্ডার আয়োজন হয় যেই উদ্দেশ্যে, সেটা আমি একাই করতে পারি এখনো।

দোকানে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই ভালোমত। লোকজনের চিপা-চাপা দিয়ে দোকানের সামনের দিকে ছোকরা মালিক তারাজুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারা তুমুল উৎসাহে চারটা কাপে চা ঢালতে ব্যস্ত।

“ওই, তারা?”

“কন।” তারা চায়ের কাপে কাটা লেবু ঢালতে ঢালতে বলে।

“শুকনা চ্যাংরাটা আসছিল? খাটোটা?”

“না” মাথা নাড়ে তারা।

“চশমা পরা খাটোটা আসছিল?”

“হু, রুবেল আসছিল। চলি গেল একটু আগে।”

রাগে দাঁত কড়মড় করলাম। আমি আসার আগেই চলে গেছে শালা!

মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে নিলাম একবার। লম্বু শুভর বড় ভাই বসে আছেন ওদিকটায়, সিগারেট টানছেন। ওদিকে পিঠ দিয়ে তারাকে নিচু গলায় বললাম, “দুইটা গোল্ডলিফ দাও।”

সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এতক্ষণে বোধহয় বুঝতে পেরেছেন এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোর এত তাড়া কেন আমার। নতুন সিগারেট খেতে শিখেছি কলেজে উঠে-না খেয়ে একটা দিনও থাকতে পারি না। সম্ভব হলে সারাটা দিনই সিগারেট টানি।

ছাতা মাথায় আর বুক পকেটে সিগারেট নিয়ে তাড়াতাড়ি হাটছি তারার দোকান থেকে দূরে। লম্বু শুভর বড় ভাই কেমন করে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। ওনার সামনে সিগারেট খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না।

বেশ অনেকদূরে আসার পরে হুঁশ হলো। সিগারেট এনেছি, কিন্তু আগুন নেই সাথে। ম্যাচ বা লাইটার, কিছুই না। পিস্তল ছাড়া গুলি নিয়ে ঘোরার মত অবস্থা।

এত ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে, এত কাদা পানি ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত এই! রাগে নিজের চুল নিজেই ছেঁড়ার মত অবস্থা হলো আমার।

মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে আমি, ঘুটঘুটে অন্ধকারে। আশেপাশে কোনো দোকানও নেই যে সিগারেট জ্বালিয়ে নেব। তারার দোকানে আবার ফেরাও সম্ভব না।

এই সময় একটা জিনিস দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরলো আমার। একটা ছোট্ট লাল আগুনের ফুলকি, বাড়ছে কমছে। ওটা একটা সিগারেটের আগুন, আমি নিশ্চিত।

রাস্তা থেকে বেশ দূরে অবশ্য ওটা, বিএডিসি খামারের পাশের গলিতে। গা-টা একটু শিরশিরিয়ে উঠলো আমার, কালকে ওখানেই পাওয়া গিয়েছিল লাশটা। কিন্তু তোয়াক্কা করি না-শরীরের প্রত্যেকটা কোষ চেঁচিয়ে নিকোটিন চাইছে।

কাদা-পানি ছপছপিয়ে ছুটলাম সিগারেটের আগুনটার দিকে। যতই এগোচ্ছি ততই একটা ছাতা মাথায় লোকের অবয়ব পরিস্কার হচ্ছে। আমার দিকে পাশ দিয়ে আছে লোকটা।

হঠাৎ বেশ অনেকটা ঠান্ডা লেগে উঠলো আমার। ওটা কিছু না, ছাতা থাকার পরও বেশ খানিকটা ভিজেছি। ওজন্যই বোধহয় শীত শীত লাগছে।

লোকটার একদম কাছে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো বলে উঠলাম, “ভাই, আগুনটা একটু দিবেন? সিগারেটটা জ্বাআআ-

লোকটা ঘুরেছে আমার দিকে, আর আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে।

এত অন্ধকারে কিছুই স্পষ্টভাবে দেখার কথা না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি লোকটার মাথায় কোনো চুল নেই, কোঁচকানো কালচে চামড়ায় ঢাকা পুরো খুলিটা। চোখে কোনো মণি নেই—জ্বলছে ওগুলো নীলচে আভায়। নাক আর মুখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত।

“সিগারেট,” ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলো পিশাচটা। “এই সিগারেটই তোদের শেষ করলো। নির্বোধ মানবজাতি-এত কিছুর পরও শিখলি না তোরা!”

আমার হাটু ভাঁজ হয়ে আসছে, হাত থেকে খসে পড়ছে ছাতা। মুখ হাঁ করে আছি আমি, কিন্তু কোনো শব্দ বের করতে পারছি না। হাত পা অসাড়।

“আরেকটা শিকার পেলাম। আরেকটা সিগারেটখেকোর আত্মা!” বলতে বলতে পিশাচটা আমার দিকে একটা ঠান্ডা নীলচে হাত বাড়িয়ে দিলো।

হাতটা আমার বুকে এসে ঠেকেছে। স্পষ্ট টের পেলাম আমার আত্মাটা বুকের ভেতরে ধড়ফড় করে উঠেছে—বেরিয়ে আসতে চাইছে ওটা। সমস্ত জীবনীশক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে আমার, ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত পা।

আমি টের পাচ্ছি পিশাচটার নাকি আজরাইল বলবো- হাতটা আমার বুকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে মাখনের ভেতর গরম ছুরি ঢোকানোর মত করে। আমার হৃৎপিন্ডের কাছাকাছি চলে আসছে ওটা।

আমি হাটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেছি মাটিতে। কিন্তু আজরাইলের হাতটা আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেনি বরং আরো গভিরে বসে যাচ্ছে ওটা। আমি টের পেলাম বরফের মতো শীতল আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরছে আমার হৃৎপিন্ডটাকে। এ ব্যথা কল্পনার বাইরে। পার্থিব কোনো মানুষ এই নারকীয় যন্ত্রণার কথা কল্পনাও করতে পারে না।

মরণের আগ মুহূর্তে শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে কোনোমতে কয়েকটা কথা উগরে দিলাম আমি-”খাবো না। আর কোনোদিন খাবো না।”

“কি বললি?” ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলো মৃত্যুদূত।

“আর কখনো খাবো না। আল্লাহর কসম। আর কখনো সিগারেট খাবো না। কখনো না,” আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম।

চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কেবল পাগলের মত বলেই যাচ্ছি, “আর খাবো না। আর কখনো খাবো না। দয়া করুন। আরেকটা সুযোগ দিন।”

আমার জান কবচের আগ মুহূর্তে শুনলাম, “একটা মাত্র সুযোগ। মনে থাকে যেন।”

আমার হার্টের ওপর থেকে বরফ-শীতল সাঁড়াশিটা সরে গেছে। আমার গায়ের ওপরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।

একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে। শেষ সুযোগ।

আমি কাদায় পড়ে থেকে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। নড়ার শক্তি নেই। রাত দশটায় দু-জন পথচারি উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিল আমাকে।

*

কাহিনী শেষ। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে জয়। ছায়া ঘনাচ্ছে চারপাশে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দ্রুত।

“বেঁচে গেছি আমি, শিপলু ভাই,” শুকনো কাঁপা গলায় বললো জয়। “কিন্তু কতদিনের জন্য? কতদিন সিগারেটের নেশা থেকে দূরে থাকতে পারবো আমি? এই নেশার কি কোনো শেষ আছে?”

জয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি যখন, রীতিমত রাত নেমে এসেছে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে পরপর চারটা সিগারেট ধরাতে হলো আমাকে গল্পটা হজম করার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *