শ্বাপদ সনে – ২

অধ্যায় ২ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে

আমার বাসায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পার্টিটা প্রত্যেকবার প্রায় একইভাবে শুরু হয়।

বৃহস্পতিবার বিকালটা আমি দোতলায় আমার রুমে ঘুমিয়েই কাটাই। উঠি সাড়ে ছয়টার দিকে। আমার বন্ধুবান্ধবের আগমন অবশ্য ছয়টার আগে থেকেই শুরু হয়। কখনো কখনো আমাদের কোম্পানির ম্যানেজারও আসে, পুরো সপ্তাহের কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য। পঞ্চাশোর্ধ আনিসুলসাহেব খুবই ভদ্রলোক বটে, কিন্তু ওনার সামনে বসে ব্যবসায়িক প্যাঁচাল শুনতে ইচ্ছা করে না। বাবার মৃত্যুর পর যে কোম্পানির প্রায় পুরো মালিকানা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে, সেটা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। প্রায় সময়ই ঘুমের অজুহাতে আমি তার সাথে দেখা করি না। আনিসুলসাহেব কাগজপত্র রেখে চলে যান। সেসব আমার আর পড়ে দেখা হয় না। কখনো কখনো অবশ্য আনিসুলসাহেবের সামনে বসতেই হয়। কোনোমতে হ্যা হুঁ করে সময় পার করে দেই। ম্যানেজারের কথা এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। যখন দেখি উনি কোটের কলার ঠিক করছেন তখনই কেবল একটু চনমনে হয়ে উঠি। উনি কোটের কলার ঠিক করার মানে হচ্ছে চলে যাওয়া।

তো, পার্টিতে বেশিরভাগ সময় সবার আগে আসে আরিফ। বাপ বিজনেস আরিফ ম্যাগনেট। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। বাপে যত উন্নতি করছে ব্যবসায়, তত ঝুঁকছে নারী আর মদে। সমস্যা হচ্ছে কয়েক পেগ পেটে পড়ার পরই বিচ্ছিরিভাবে তোতলানো শুরু করে সে। তখন ওর কাছাকাছি থাকলে আপনার চোখেমুখে থুতুর ছিটা পড়বেই। তাছাড়া ব্যাটার হাঁপানি আছে, তবু সিগারেট টানা চাই। একবার তো দম-টম আটকে আমাদেরকে বিপদেই ফেলে দিয়েছিল। সামাদ না থাকলে মহা মুশকিল হতো।

ধীরে ধীরে রিফাত, ফাহাদ চলে আসে এরপরে। রিফাতের বাপের হোটলে বিজনেস। সেই রমরমা। রিফাতকে দেখে অবশ্য বড়লোকের ব্যাটা বলে মনে হবে না আপনার কোনোমতেই। মোটা, কালো, বেঁটে। কুঁতকুঁতে দুই চোখ। শটগ্লাস হাতে নিয়ে যখন হাসে তখন ভুড়িটা কুৎসিতভাবে ওপর-নিচে দুলতে থাকে তার। চট করে রেগে যাবার বদভ্যাস আছে। অবশ্য আমার কাছে এসে ঠান্ডা। আমার বদরাগটা বংশগত। রিফাত একবার আমার সাথে ঘাড়তেড়ামির চেষ্টা করেছিল বটে বিরানব্বই সালের কোনো একসময়, মানে গত বছর। স্রেফ চোখের দৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছি। তাছাড়া এমনিতে আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ না।

ফাহাদেরা পুরান ঢাকার লোক। বেশ কয়েক পুরুষ ধরে ধনী, ওর চাপা ওর কোন পূর্বপুরুষ নাকি সিরাজউদ্দৌলার দরবারে কি যেন ছিলো। চেহারাটা অবশ্য বেশ। টকটকে ফরসা রং, গোলাপি ঠোঁট, চমৎকার হেয়ারলাইন। অবশ্য চেহারা দিয়েই যে সব হয় না, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ফাহাদ। স্কুলে যখন একসাথে পড়তাম, স্যারেরা ‘মাকাল ফল’ আর ‘সুন্দর গাধা’ বলে ডাকতেন ওকে। অবশ্য ফাহাদের তাতে কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। যার বাপের এত টাকা আর ঢাকায় এত জমি তার ক অক্ষর গোমাংস হলেও সমস্যা নেই। নারীপ্রীতি আর নানান বন্ধুর বাসায় পার্টি নিয়ে সুখেই আছে সে, ইন্টার পরীক্ষা পাশ করুক আর না করুক।

এরাই পার্টির নিয়মিত সদস্য। আরো বেশ কয়েকজন থাকে বটে, তবে তারা অনিয়মিত। তারা নিজ ইচ্ছায় আসে যায়। আমি কিছু বলি না।

সামাদও কিন্তু সবসময় হাজির থাকে এই থার্সডে নাইট ডিলাইটে। কোন্ অদ্ভুত কারণে ও কখনো আমার পিছু ছাড়তে চায় না, বের করতে পারিনি। সেই পিচ্চিকাল থেকে আমাদের বাসাতেই মানুষ ও। তখন যেমন সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকতো, মুখে একটা হাত পুরে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখতো, আর ছোট ছোট পায়ে সবসময় আমার পেছনে ঘুরতো, সে স্বভাবের খুব বেশি পরিবর্তন এখনো হয়নি। আমি স্রেফ উপেক্ষা করে যাই ওকে, কিন্তু সামাদ আমার পিছু ছাড়ে না। ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নিও শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু আমাদের বাসা ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বোধহয় সেজন্যই। পার্টিতে অবশ্য খুব বেশি ড্রিঙ্ক করে না সে। কেবল মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো চুমুক দিতে দেখি গ্লাসে।

বাবা বেঁচে থাকতে বাসায় এমন পার্টি দিতে পারতাম কেবল কালে ভদ্রে। উনি বিজনেস ট্রিপে বাইরে কোথাও গেলে। এখন প্রতি সপ্তাহেই চলে এমনটা। আসলে গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন আপনা থেকেই হয়। বাবা মারা যাবার পরে আমার ‘বন্ধুরা’–যদিও কথাটা কতটা যুৎসই হলো জানি না-স্বান্ত্বনা জানাতে আসার পর থেকে কিভাবে কিভাবে সেটা ফি-হপ্তার পার্টিতে গড়ালো সেটা আমিও জানি না।

আজ ড্রয়িরুমে ঢুকলাম একটু দেরি করেই। ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি আমার চোখ থেকে। ঘুমটা হয়তো পরের আধাঘন্টাতেও ভাঙতো না যদি ড্রয়িংরুমের বত্রিশ ইঞ্চি কালার টিভিটা হাই ভলিউমে ছাড়া না থাকতো। আমার বন্ধুরা সবাই এমটিভিতে মিউজিক ভিডিও দেখতে ব্যস্ত। কেবল টিভি নামের এই জিনিসের আমদানি হয়েছে আমাদের বাসায় বছরখানেক হলো।

“আরে, মিস্টার পাংচুয়ালিটি!” আরিফের গায়ের সাথে বিপজ্জনকভাবে ঘেঁষটে থাকা মেয়েটা খিলখিল করে হেসে বললো। জেরিন। মুখে এক কেজি মেক-আপ, ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, চোখের পাতায় রং মাখিয়ে আর কিছু বাদ রাখেনি, চুল আর্টিফিশিয়ালি কার্ল করা, হাতের নখ দুই ইঞ্চি লম্বা লম্বা। আঁটসাঁট টপসের ভি কাট গলা দিয়ে ক্লিভেজ ভালভাবে দৃশ্যমান। ডাইনি কোথাকার।

মাপা একটা হাসিতে সবার ‘হাই-হ্যালো-কিরে দোস্ত সামাল দিয়ে কাউচে আরাম করে বসলাম। জেরিনের উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে আজকের পার্টিটা অন্তত আমার কাছে জমবে না।

সামাদ একবার বলেছিল, “জামশেদ ভাই, আপনার রক্তে বোধহয় অ্যালকোহল বাফার আছে। নইলে এত পেগ খান কিভাবে?” বাফার কি জিনিস জানি না, কিন্তু মুড থাকলে পেগের পর পেগ গিলতে পারি। আমি এ জীবনে অ্যালকোহল খেয়ে কখনো বমি করিনি। মাতাল না হয়ে এগারো পেগ পর্যন্ত গিলতে পারি।

মাল খেতে হলে সবসময় বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে হৈ চৈ করে খেতে হবে, এই তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নই। ব্ল্যাক লেবেলের ছিপি খোলার সময় আমাকে ঘিরে বসে কিসব জিনিস নিয়ে বকবক করছিল ওরা। রিফাত বললো ইউরোপের সব দেশ নাকি এক হয়ে যাচ্ছে, কোনো দেশের আর বর্ডার বলে কিছু থাকবে না। দেশটার নাম নাকি হবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন। ফাহাদ ভুরু নাচিয়ে বললো, মাইকেল জ্যাকসনের ব্যাপারে নাকি হট নিউজ আছে ওর কাছে। জ্যাকসন কোন এক কমবয়সি ছেলেকে যৌন হয়রানি করেছে, এখন কোর্টের বাইরে মিমাংসা করছে সেটার। বুঝলাম ওদের খুবই ইচ্ছা আমিও সেই আলোচনায় যোগ দেই, কিন্তু মুড নেই আমার। একটা গ্লাস কানায় কানায় ভরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় ‘এক্সকিউজ মি বলে রিফাতকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে আলাদা আরেকটা সোফায় গিয়ে বসলাম।

আমার কড়া মেজাজের সাথে পরিচয় আছে ওদের, কেউ আর ঘাঁটালো না আমাকে। তবে সবসময়ই ওদের সাথে এমন আচরণ করি মনে করলে আমার প্রতি অবিচারই করা হবে। আসলে কালকে রাতে ওই বিচ্ছিরি স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কোনোকিছুতে উৎসাহ পাচ্ছি না। সারাদিন বাইরে বের হইনি একবারও। অথচ বেশ ক’জায়গায় যাবার কথা ছিল আমার। সামাদের সাথে অযথাই খারাপ আচরণ করেছি। আইরিন ফোন করেছিল একবার, খানিকক্ষণ হ্যা-হুঁ করে লাইন কেটে দিয়েছি। স্পষ্টতই মন খারাপ করেছে ও . কিন্তু ওসব মেয়েলি ন্যাকামি আমার সাথে অন্তত খাটে না। গা’টা ম্যাজম্যাজ করেছে সারাদিন। খেতে পারিনি কিছুই।

মুখে স্বীকার করি না করি, আমার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ, বুঝতে পারছি। বাবা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার ছ’মাস পরেও তার মৃত্যুর ব্যাপারটা আমার মনে এত চাপ ফেলছে কেন, জানি না। কতজনেরই তো বাবা মারা যায়। ফাহাদকে তো বাপ মরার তিনসপ্তাহ পরেই আবার যে-কে-সেই অবস্থায় ফেরত আসতে দেখেছি। আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না কেন?

আর কালকের স্বপ্নটার মানে কি? মরা মানুষ স্বপ্ন দেখায়, বিশ্বাস করি না আমি। মানুষের স্বপ্নের উৎপত্তি তার নিজের মগজে। তার মানে আমার নিজের মগজের অবস্থা আর যাই হোক শান্ত বলা যায় না। অবশ্য খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকার কোনো কারণও নেই আমার। ব্যবসাপাতি চালাতে হবে, কিন্তু মন টানে না মোটেও। আইরিনের সাথেও এই মুহূর্তে আমার সম্পর্ক সি-স মোডে আছে। এই চড়াই তো এই উত্রাই। আজকে দেখা করার কথা ছিল ওর সাথে, করিনি। বোধহয় বড় একটা ভুলই করেছি। কোটিপতির মেয়েরা কারো অবহেলা পেতে অভ্যস্ত নয়। আইরিনও তার ব্যতিক্রম নয়। একে-ওকে সময় দেয়া হচ্ছে না কয়েকদিন যাবত, তার ওপর ওর এক্স বয়ফ্রেন্ড রাশেদ আমাকে শাসানি দিয়ে রেখেছে…

নিজের চিন্তায় তিনহাত ডুবে না থাকলে আর পাকস্থলিতে দুই তিন পেগ ব্ল্যাক লেবেল না থাকলে হয়তো আরো আগেই টের পেতাম যে পার্টিতে নতুন কেউ যোগ দিয়েছে। নাকের ফুটোদুটো নিজের ধরানো সিগারের ধোঁয়ায় বুঁদ না থাকলে আগন্তুকের ট্রেডমার্ক লাল মার্লবোরোর গন্ধও অনেক আগেই পেয়ে যেতাম। কাজেই শিপলু একেবারে আমার সামনে এসে আমার কাঁধে হাত রাখার আগ পর্যন্ত ওর কোনো সাড়াশব্দই পেলাম না।

চমকে মুখ তুললাম আমি। একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুল, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ ছয়ফুটের সামান্য কম হাইট, গালে আছে-কি-নেই এমন খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মুখে লেগে থাকা রহস্যমাখা হাসি, চোখে বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমা আর দু’ আঙুলের ফাঁকে জ্বলতে থাকা মার্লবোরো-শিপলু হাজির আমার সামনে। আদর্শির শাপুর শিপলু। চমৎকার চেক শার্ট, জিনস আর কেডসে হালের নায়ক সালমান শাহের মতই ঝলমলে লাগছে ওকে।

“ইউ নো, ম্যান, টেলিফোন বলে একটা বস্তু আছে, আর সেটা দিয়ে মানুষকে কল দেয়া যায়?” মুখের হাসিটা এক ডিগ্রি বাড়িয়ে নিয়ে বললো শিপলু। পা ছড়িয়ে বসলো সোফায়।

“আহ…..তোর অফিসের নাম্বারে তো কল দিতেই ভয় লাগে, “ মুচকি হেসে বললাম আমি। “যে-রকম ব্যস্ত মানুষ! ভাবলাম নতুন কোনো প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে আছিস বুঝি—তাই আর জ্বালাইনি।”

কথাটা বলেই শিপলুর চোখের দিকে তাকালাম। কারণ এইমাত্র যা বললাম সেটা ডাহা মিথ্যা। সারাদিন কাউকে কল দেবার মুডে ছিলাম না কোনোভাবেই। আমি দুনিয়ার সেরা মিথ্যাবাদি নই, ড্রাঙ্ক অবস্থায় তো নই-ই। শিপলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধপাস করে আমার পাশে বসলো। মুখের হাসি হেরফের হয়নি, আমার মিথ্যেটা ধরতে পেরেছে কিনা বুঝলাম না।

“আরে না!” সামনের বোতলটার দিকে তাকিয়ে বললো শিপলু। ওর নাকটা একটু কোঁচকাতে দেখলাম। আমি জানি ও ড্রিঙ্ক করে না। “নতুন কোনো কেস হাতে থাকলে তো হতই। নেই। এখন সম্পাদকের ফরমায়েশ মত রিপোর্ট করে বেড়াতে হচ্ছে। পরশু টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম একটা খুনের স্টোরি কভার করার জন্য। একটা দৈনিক পত্রিকার নিউজ। কালকে গেলাম এফডিসি-অমুক নায়িকা নাকি এক পরিচালকের সাথে ঘুমাচ্ছে, সেটা নিয়ে নিউজ করতে। আজকে আবার এফডিসি যাত্রা, সেই নিউজের ফলো-আপ করার মাল-মশলা জোগাড়ের জন্য। আর আগামিকাল…” কথা শেষ করতে পারলো না শিপলু, কারণ হো হো করে হাসতে শুরু করে দিয়েছি আমি। আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে-ও যোগ দিলো হাসিতে।

“তবে যাই বলিস—” থেমে গেল শিপলু, হাতের ফুরিয়ে আসা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেললো, তারপর সময় নিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝুলালো। প্যাকেটটা আবার রাখলো ঠিক ওই পকেটেই। আরেক পকেট থেকে আবার বেরোলো জিপো লাইটার। ক্লিক করে সেটার ঢাকনা খুলে জ্বালিয়ে নিলো সিগারেট। আয়েশ করে দু-বার ধোঁয়া ছেড়ে আগের কথার খেই ধরলো-”সালমান শাহ কিন্তু কাঁপিয়ে দিচ্ছে। প্রথম ছবিতেই এমন হিট! আর এই বয়সেই! এরকমটা চালিয়ে যেতে পারলে এই একটা ছেলেই এফডিসির স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে পারবে।” ভাবখানা এমন, কথার মাঝে সিগারেট ধরাতে যেন দেড় মিনিট ব্যয়ই করেনি ও। আমি অবশ্য পরিচিত ওর এই অভ্যাসের সাথে। সিগারেট খাওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ও। শিপলু আমার দেখা সবচেয়ে বড় চেইন স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে, দিনে কয়টা খায়। “ত্রিশটা,” জবাব দিয়েছিল ও। আমি শিওর কথাটা ডাহা মিথ্যা। আসল সংখ্যাটা চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে হবে।

“সো, সিনেমার নিউজ কভার করার খুব আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তোর, জনাব সাংবাদিক?” আমার খালি হয়ে আসা গ্লাসের ওপর বোতলটা উপুড় করতে করতে বললাম।

“সিনেমার জগতের মাঝে একটা আলাদা ফিল আছে ম্যান,” আমার গেলাসের দিকে তেরছাভাবে তাকালো শিপলু। ওর চশমার কাঁচের ওপর অদ্ভুতভাবে পড়েছে টিউবলাইটের আলো। কাঁচদুটো যেন জ্বলছে, আড়ালে ওর তীক্ষ্ণ চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না। “তোদের এই গোটা সমাজ একপাশে, আর সিনেমাপাড়া আরেক পাশে। তোরা বলবি আমি নায়ক-নায়িকাদের গসিপ লিখে পেট চালাই। নো সমস্যা টু মি। যারা পলিটিক্যাল নিউজ কভার করে তাদের চাইতে ভালো। জনসভার রোদ-ধুলোর মধ্যে নোটবই হাতে ঘোরার চাইতে বা কোনো প্রেস ব্রিফিংয়ে গিয়ে কোনো মন্ত্রির মিথ্যেকথা শোনার চাইতে ভালো।” মুখের ওপর ডান হাতটা রাখলো শিপলু, যেন নিজের মুখ নিজে বন্ধ করতে চাইছে। আসলে ওর তর্জনি আর মধ্যমার ফাঁকে সিগারেট, সেটায় দম দিচ্ছে ও। সাধে কি বলি বিড়ি টানাটাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ব্যাটা। শিপলুর মত শৈল্পিকভাবে সিগারেট খেতে দেখিনি আর কাউকে।

“তোদের সাপ্তাহিক হালচাল সিনেমা নিয়ে এত মাতলো কবে থেকে?” আরেকটা বড় ঢোকে ওয়াইন গিলে বললাম। গলা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল তরলটা।

“কারণ গরম খবর যেখানে আছে সেখানেই সাপ্তাহিক হালচাল,” অন্যমনস্কভাবে বললো শিপলু। “ক্রাইম রিপোর্ট, প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন আর সিনেজগৎ-এই নিয়ে সাপ্তাহিক হালচাল। মাঝখানেরটা অবশ্য একান্তই আমার বদৌলতে যোগ হয়েছে।”

শিপলুর কথা সত্য। সাপ্তাহিক হালচালের অসম্ভব রমরমার পেছনে শিপলুর অবদান সবচেয়ে বেশি। শিপলু ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ঢাকা ভার্সিটি থেকে জার্নালিজম পাশ করার পর ওসব করেই পেট চালাচ্ছে। ফ্রিল্যান্স শব্দটা শুনতে যত সুন্দর, আসল জিনিসটা মোটেই তেমন নয়, শিপলু মাঝে মাঝে বলে। চোদ্দটা পেপার আর ম্যাগাজিনের অফিসে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি। কোথায় কোন ব্যাপারটা থেকে মুখরোচক স্টোরি বানানো যাবে, তার অপেক্ষায় থাকা। কষ্টেসৃষ্টে তার মধ্যেও চালিয়ে নিচ্ছিলো, এর মধ্যে একদিন ওর মাথায় একটা নতুন আইডিয়া গজালো। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন। আধিভৌতিক নানা ঘটনার পেছনের গল্প খোঁজার চেষ্টা করবে ও, তারপর খুঁটিয়ে লিখবে কি কি দেখলো। পুরো ব্যাপারটা স্রেফ গল্পের মত করে বর্ণনা করা হবে। পাঠকের ওপর ভার থাকবে ঘটনাটা অলৌকিক না লৌকিক, সেটা ডিসাইড করার। শিপলুর মেইন চিন্তা ছিল, কোনো পত্রিকার সম্পাদকের কাছে ওর এই আপাত আজগুবি আইডিয়ার পেছনে ব্রিলিয়ান্সটা চোখে পড়বে কিনা।

সাপ্তাহিক হালচালের সম্পাদক হিফজুর রহমান কিন্তু শোনার সাথে সাথে চনমনিয়ে উঠলো। আমি হিফজুর রহমান বলছি, কিন্তু শিপলু বলে, প্রিন্ট মিডিয়ার জগতে সবাই তাকে ‘পাগলা হাফেজ’ নামেই চেনে। লোকটা এক কানের ওপরে একটা সিগারেট গুঁজে রাখে, আরেক কানে আতর মাখানো তুলা। চোখে বোতলের তলার মত ভারি চশমা। ডেস্কে কাগজের স্তুপ, তারই মাঝখানে রাখা একটা নষ্ট

কম্পিউটার। দেশের যেকোনো কোণায় একটা খুন হলেই তার ধারণা, নতুন সিরিয়াল কিলার বের হয়েছে, এটা তার প্রথম খুন। নতুন কোনো রগরগে স্টোরি পেলে নাকি লোকটা হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সারা রুমের মাঝে লাফালাফি শুরু করে। সেই পাগলা হাফেজ রাজি হবার পরে দুই বছর আগে শিপলুর প্রথম কেস স্টাডি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক হালচালের একত্রিশে অক্টোবর, ১৯৯০ সংখ্যায়। বেরোবার সাথে সাথেই যাকে বলে হিট। রমরমা ব্যবসা সাপ্তাহিক হালচালের সেই সংখ্যার। হালচালের ঠিকানায় একগাদা চিঠি, পরের কেস স্টাডি কবে আসবে। শিপলু দ্বিতীয় কেস স্টাডি ছাপালো এক মাস পরের একটা সংখ্যায়। তারপরে আজ পর্যন্ত বেরিয়েই চলছে এক এক করে প্রতি মাসে। শিপলুকেও আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। প্রতি মাসে একটা করে প্যারানরমাল কেস স্টাডি ছাপাচ্ছে, আর সাথে আরো বিভিন্ন পত্রিকার জন্য বিভিন্ন ধরণের নিউজ তো আছেই।

শিপলুর সাথে আমার বন্ধুত্বও কিন্তু গাঢ় হয়েছে ওর এই প্যারানরমাল কেস স্টাডির কারণেই। শিপলুর সাথে বেশ কয়েকবার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়েছি আমি গতবছর-আর তাতে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব যতটা স্ট্রং হয়েছে, ততটা আর কারো সাথেই হয়নি। যেসব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, সেগুলোও একেবারে অদ্ভুতুড়ে, সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাইনি।

ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম, বোতল শেষ। আরে, ব্যাপার কি? এইমাত্র না নিয়ে বসলাম?

এতক্ষণে খেয়াল করলাম, ঝুঁকে বসে আছি নিজের হাটুর ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে। সোজা হয়ে বসলাম আমি। রুমের চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কেন যেন কোনো কিছুই পরিস্কারভাবে দেখতে পারছি না। ঝাপসা লাগছে, যেন আউট অব ফোকাস কোনো ক্যামেরার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে আছি। যতদূর বুঝলাম ফাহাদ আর আরিফ চড়া গলায় কিছু নিয়ে তর্ক করছে, আর রিফাত হাত-পা ছড়িয়ে বসে সেটা শুনছে। সামাদ টিভির রিমোটটা হাতে নিয়ে খুব মনোযোগের সাথে চ্যানেল চেঞ্জ করছে। সমস্যা হচ্ছে প্রত্যেকটা চ্যানেলই ঝিরঝির করছে। কোনো রিসেপশন নেই। কপাল মুছলাম আমি। এত গরম লাগছে কেন? এসিটা কি কাজ করছে না? হাতের দিকে তাকালাম। হাতের তালু ঘামছে। এমনটা তো কখনো হয়নি আমি একজন শ্যুটার। হাতের তালু ঘামে না দেখেই এতদিন ভালো শুটিং করেছি।

“তুই কি জানিস,” হঠাৎ বলে উঠলো শিপলু, “ইংল্যান্ডে যত রাজহাঁস আছে, সবগুলোর মালিক রাণি এলিজাবেথ?”

“না, জানতাম না,” বললাম আমি, তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। ওর হুট করে আজগুবি প্রশ্নের কারণে অবাক হইনি। হঠাৎ হঠাৎ অমন প্রশ্ন করাটা ওর স্বভাব। আসল সমস্যাটা অন্যখানে। শিপলুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারছি, গোটা ব্যাপারটায় কোনো গড়বড় আছে। সোফায় হাত ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানছে শিপলু। ওর চশমার কাঁচে আলো পড়ে এমনভাবে চমকাচ্ছে যেন ফসফরাস মাখানো কাগজ। ওর সামনে টেবিলে অ্যাশট্রে।

“কি হলো? এমনভাবে তাকাচ্ছিস কেন?” শিপলুর প্রশ্ন। ওর গলায় খানিকটা উদ্বেগের ছাপ পেলাম। সামনের অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লো ও।

আমি তাকিয়েই আছি। বুঝতে পারছি, শিপলু আমার সামনে এসে বসার পর থেকে কিছু একটা হয়ে গেছে। আমি ধরতে পারছি না কি সেটা।

“আইরিনের সাথে সবকিছু ঠিকভাবে যাচ্ছে তো দোস্ত?” প্রশ্ন করলো শিপলু। একটু সাবধানির ছাপ পেলাম ওর গলায়। “রাশেদ তোকে ফোনে আর হুমকিধামকি দিচ্ছে না তো? আইরিনের এক্স বয়ফ্রেন্ড?”

“না,” শান্ত গলায় বললাম আমি। টের পেলাম, আমার কপাল গড়িয়ে একটা ঘামের ফোঁটা নামছে

“রাশেদের ব্যাপারে সাবধান,” শিপলু বললো। “তোকে আগেও বলেছি বড়লোকের বখে যাওয়া পোলা। পকেটে একটা থার্টি এইট রিভলভার থাকে সবসময়। কথার আগে গুলি চালায়। ইচি ট্রিগার ফিঙ্গার। ওর বাপে মন্ত্রি না হলে তিনটা খুনের মামলায় ফাঁসি হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে।”

অন্য সময় হলে বাঁকা হাসি হেসে শিপলুকে বলতাম, এমনকিছু বল যা আমি জানি না। কিন্তু এখন মুখ খুললাম না। শিপলুর দিকে তাকিয়ে আছি। ও সিগারেটের ছাই ঝাড়লো আবার। অ্যাশট্রেটার দিকে তাকালাম আমি। প্রায় ভরে এসেছে ওটা, ছাই আর সিগারেটের মোথা দিয়ে। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি খানিকক্ষণ আগে শিপলু এসে বসার সময়ও ওটাকে খালি দেখেছি।

চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। “ওকে গাইজ, আমি রুমে যাচ্ছি, সি ইউ লেটার।” ঘরের দেয়ালের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে কোনোমতে দরজার দিকে এগোলাম। হাটু কাঁপছে আমার, চোখে ঝাপসা দেখছি, মাথাটা পালকের মত হালকা। বুঝতে পারছি, রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা ভয়াবহরকম বেড়ে গেছে আমার। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! বসলামই তো কয়েক মিনিট আগে।

শুনতে পাচ্ছি, পেছন থেকে শিপলু বলছে, “রিল্যাক্স, ম্যান। বস আরো খানিকক্ষণ। রাশেদের সাথে গল্প করে যা।”

হতবাক হয়ে ঘাড় ঘোরালাম। দেখলাম, শিপলুর পাশে কখন যেন এসে বসেছে রাশেদ। সেই বাজে কার্টের দামি স্যুট, সেই আগা চোখা সু পায়ে, সেই চালবাজের মত চেহারা, মুখের পিত্তি জ্বালানো হাসিতে ‘আমার বাপের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে তাই আমিই ঢাকার রাজা’ টাইপের ভাব।

হেলেদুলে উঠে দাঁড়ালো রাশেদ। স্বভাবসিদ্ধ নষ্ট মাইকের মত হেঁড়ে গলায় বললো, “আজকে আইরিনের কাছে গেসলাম। সোজা ওর রুমে। ডায়রেক্ট কইলাম, এইভাবে আর চলতে পারে না আইরিন। তুমি জামশেদের সাথে লাইন মারবা, আবার আমারেও আশা দিয়া ঝুলায়া রাখবা, সেটা হইতে পারে না। ওই হালা জামশেদের আছে কি? বাপে মরছে, অর কোম্পানিতে অখন লালবাতি জ্বলবো। আর এইদিকে আমরা গাজীপুরের খাশ বনেদি ফ্যামিলি, আমার বাপে বিদেশ থাইকা ল পইড়া আইছে, ‘আমাগো বিরাট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি…কইতে না কইতে তোমার আইরিন সব খুইলা টুইলা ল্যাংটা হইয়া আমারে কয়…”

সামনের দিকে লাফ দিলাম আমি, প্রথমে শূয়োরের বাচ্চার গলা টিপে ধরবো, তারপর অন্য হাতটা দিয়ে শকুনের মত চোখদুটো উপড়ে আনবো। কিন্তু কোনো কিছুতে বাধা না পেয়ে সোজা সোফাটার ওপর গিয়ে পড়লাম, তারপর সেটাসহ গড়িয়ে মেঝেতে।

উঠলাম না আর, পড়েই রইলাম ওখানে। মাথা তুলে দেখি, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে আমাকেই। সোফার সাথে সাথে শিপলুও চিৎপটাং। উঠে দাঁড়িয়ে ও একবার তাকালো আমার দিকে, কিছু বললো না। সামাদের দিকে ঘুরে তাকালো অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে

“ওকে, ওকে, এক্সাইটেড হবার কোনো কারণ নেই,” উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়তে ঝাড়তে কর্কশ গলায় বললাম। “আম জাস্ট আ লিটল ড্রাঙ্ক, দ্যাটস ইট।”

“অ্যালকোহল ডাজেন্ট কজ দিস, জামশেদ,” শান্ত গলায় বললো শিপলু। সামাদের দিকে তাকালো তারপর। “জামশেদ যা-ই বলুক, কালকে ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। ওর কি হয়েছে, জানা দরকার। হি ইজ হ্যাভিং হ্যালুসিনেশন। দুঃস্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা সীমিত নেই আর।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *