শ্বাপদ সনে – ১৬

অধ্যায় ১৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে

শিপলু!

আমার পাঁচফুট সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, যার চোখের বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমা আমার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ঝকঝক করছে, যার ঠোটের এককোণে হাসি আর আরেক কোণে জ্বলন্ত সিগারেট, যার এক হাত পকেটে পোরা আর আরেক হাতে একটা দা—সে শিপলুই বটে।

আমার ভাঙা নাক দপদপ করছে, আমার মাথা ঘুরছে, আমার দুই কানে অসংখ্য কন্ঠ উন্মত্তের মত চেঁচাচ্ছে ‘আসল নকল বিচার করো আসল নকল বিচার করো আসল নকল বিচার করো-কিন্তু তবু, এই অবস্থাতেও আমার মগজ সকল হিসেব একসাথে কষে ফেললো মুহূর্তেই, দুয়ে দুয়ে চার মেলানো হয়ে গেল নিমেষেই। যত খটকা ছিলো সব দূর হয়ে গেছে, যত লুজ এন্ডস ছিলো সব জোড়া লেগে গেছে। সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার এখন আমার সামনে।

আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম, “শিপলু।” যেন বলার জন্যই বলা। যেন কয়েক ঘন্টা আগে গুলি খেয়ে বুক ঝাঁঝরা হয়ে মরতে দেখা বন্ধুর বেঁচে উঠে জঙ্গলের মাঝের এক ভাঙা মন্দিরে আমার সামনে হাতে দা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখাটা বড়ই স্বাভাবিক।

অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে শিপলুর মুখটা। চুলে আর গায়ে লেগে আছে ভুট্টার শুকনো পাতা আর খড়কুটো। যেন একটা বেওয়ারিশ মড়া হঠাৎ জীবন ফিরে পেয়ে চলে এসেছে।

“জামশেদ,” খুব জরুরি গলায় বললো শিপলু, ওর ঠোঁটের কোণে নাচছে মার্লবোরোটা, “তুই কি জানিস ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করার পর সেটা বিশ সেকেন্ড পর্যন্ত সচেতন থাকে? কি মনে হয়, ওই বিশ সেকেন্ড ওটার ব্রেনের মধ্যে কি চিন্তা চলতে থাকে?”

ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলু!

“চোখের সামনে থেকে টর্চটা সরা।” অধৈর্য গলায় বললো শিপলু, তারপরেই আবার জুড়ে দিল, “কি মনে হয়, মফিজ দারোগার গুলিটা আমার হার্ট ফুঁড়ে যাবার সময় আমার মগজে কি চিন্তা চলছিল? হা-হা-হা!”

আমি এবারও কিছু বললাম না। সোজা তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। টর্চটাও সরাইনি। ওটার আলোয় ফসফরাসের মত জ্বলছে শিপলুর চশমার কাঁচ, সেটা ছাপিয়ে ওর চোখগুলো দেখার চেষ্টা করছি আমি। রাইফেলটা সোজা তাক করা শিপলুর বুকের দিকে। বাতাসে রক্তের গন্ধ।

“কি হলো? কথা বলছিস না কেন? চুপ মেরে গেলি যে আমাকে দেখে?” যেন খুব অবাক হয়েছে, এমনভাবে বললো শিপলু। তারপরই যেন খুব দরকারি কিছু মনে পড়লো ওর। “ওহ আচ্ছা আচ্ছা, তুই মনে হয় আশা করছিস সামাদও মরা থেকে বেঁচে হেটে চলে আসবে আমার মত? না হে ভাই! সেটি হচ্ছে না। ও বেচারার তো আমার মত অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো না! কি আর–”

“অলৌকিক ক্ষমতা না ছাই!” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। মাথাটা দপদপিয়ে উঠলো আমার, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম অনেক কষ্টে। “শোন, তোর অতিপ্রাকৃত হোকাস পোকাসে কোনোদিন তেমন একটা বিশ্বাস ছিল না আমার। আর আজ তো নিশ্চিত হলাম-”

আস্তে করে দুই হাত দু-দিকে ছড়িয়ে দিলো শিপলু। “আমার দিকে তাকা। লুক অ্যাট মি, জামশেদ, লুক অ্যাট মি! আমি মরে গেছিলাম- তুই নিজের চোখে দেখেছিস! আর আমি এখন তোর সামনে দাঁড়িয়ে! আর কোনো প্রমাণের দরকার আছে তোর? মৃত্যুকে জয় করেছি আমি! জিশু যা করেছিল সেটা করে দেখিয়েছি আমি, শিপলু!

জবাব দিলাম না আমি। রাইফেলও নামালাম না। শান্ত গলায় বললাম, “তোর জোচ্চুরি আর দুই নম্বরির তালিকা করতে গেলে এই মরা থেকে বেঁচে ফেরাটা স্রেফ আরেকটা এন্ট্রি মাত্র।

হাসছে শিপলু। দুই হাত দোলাচ্ছে সামনে পেছনে। ডান হাতে ধরা একটা দা। ঠোঁটের কোণের সিগারেটটা পুড়ে প্রায় শেষ।

দেশের এককোণার এই পান্ডববর্জিত গাঁয়ের দু’শ বছর ধরে পরিত্যক্ত এক জঙ্গলের ভেতরের মন্দিরে আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার সেই বন্ধুর সামনে, যাকে তিন ঘন্টা আগে নিজ চোখে মরতে দেখেছি। গোটা ব্যাপারটা হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্নের মত লাগতে থাকে আমার কাছে।

“দাটা কেন তোর হাতে, শিপলু?” চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।

“আরে হাতে কিছু একটা না নিয়ে জঙ্গলে আসা যায় নাকি!” হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে শিপলু, যেন আমরা শ্যাওলা-ওঠা স্যাঁতসেঁতে এই মন্দিরের ভেতরে নেই, আছি আমাদের বাসার ড্রয়িংরুমে, আড্ডা দিচ্ছি। “আর এই গ্রামের জঙ্গলের যে ছিরি! একা-একা এখানে আসাটা মোটেই উচিত হয়নি তোর, জামশেদ। জান ফিরে পাবার পরে আমি তোর সামনে বেমক্কা হাজির হইনি ভয় পাবি বলে। ভুট্টাখেতে একটা দা খুঁজে পেলাম বোধহয় এটা দিয়েই মফিজ দারোগা সিদ্দিকের দফারফা করেছিল…”

“কথা,” শিপলুর গলা ছাপিয়ে জোরে বলে উঠলাম আমি

শিপলু থেমে গেছে, এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি কি বলছি সেটা মাথায় ঢুকছে না ওর।

“কথা,” আবার বললাম আমি, টর্চ আর রাইফেল এখনো তাক করা সোজা শিপলুর দিকে। “কথা দিয়েই তো আমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিলি দেড় বছর ধরে। শুধু আমাকে কেন? মাসিক হালচালের লক্ষ লক্ষ পাঠককেও! তোর সাথে পরিচয় ছিল, এমন সবাইকেই বোকা বানিয়েছিস তুই-তোর আসল রূপটা দেখতে দিসনি!”

“তুই যত যা-ই বলিস,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো শিপলু, “আমি জানি আমিই ঠিক। কোনো ভুল করিনি আমি। তুই জানিস আমি মহাশক্তি লাভের কতটা কাছে চলে এসেছি? আমি-”

“মহাশক্তি লাভ!” মাটিতে থুথু ফেলে চোখ সরু করে বললাম আমি। “তাহলে নিজেকে এটাই বুঝিয়েছে তোর বিগড়ে যাওয়া মগজ! হেমায়েতপুরে-”

“মূর্খ!” আহত বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠলো শিপলু। “তোর জানা নেই আমার ক্ষমতা কত, আমি কতটা করার সামর্থ্য রাখি! তোর জানা নেই কতগুলো ধাপ পেরিয়ে আজকের শক্তি আমি পেয়েছি! এতদিন আমার সাথে ঘুরেও বুঝতে পারলি না, এই জগতের বাইরেও আরেকটা অন্ধকার জগৎ আছে? এতদিনেও কি তুই সেই মহাশক্তিধরের শক্তির আঁচ পেলি না, যার উপাসনা আমি করি?”

থ হয়ে শিপলুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ভেবেছিলাম ওর হাঁড়ির খবর জেনে গেছি-কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি যে…

“আমার প্রত্যেকটা ইনভেস্টিগেশন শুধু মাসিক পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্য নয়, জামশেদ!” শিপলুর চশমার কাঁচ ভেদ করে দেখতে পাচ্ছি আমি, নরকের আগুনের মত লকলকিয়ে জ্বলছে ওর দুই চোখ। “প্রতিটা ইনভেস্টিগেশন ছিল আমার উপাসনার একেকটা ধাপ। প্রত্যেকটা ঘটনার খুঁটিনাটি জানার মাধ্যমে তার শক্তির স্বরূপ জানতে পেরেছি আমি, তাঁর হাতের কাজ নিজ চোখে দেখতে পেরেছি!”

“তিনি?” দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি অবশ ঠোঁটে। “তুই বোঝাতে চাচ্ছিস….”

“হ্যা,” সাপের মত হিসহিসিয়ে উঠলো শিপলু, “তোরা যাঁকে শয়তান বলিস, তারই উপাসনা করি আমি!”

হঠাৎ নিজের হাতদুটো বড় দুর্বল লাগলো আমার, যেন রাইফেল আর টর্চটা এখনি খসে পড়বে মাটিতে।

“দেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের শ্মাশানে এক শয়তান-উপাসক তান্ত্রিকের সাথে সাধনা করতে গিয়ে প্রথম তার দেখা পাই আমি। তিনি এক, অদ্বিতীয়, কিন্তু তিনি সদাবিরাজমান, অন্তর্যামি, মহাশক্তিমান! ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা একমাত্র তিনিই রাখেন। আর তাকে যে পাবে, অন্য যেকোনো মরণশীলের চাইতে বেশি ক্ষমতাধর হবে সে! অমর তো হবেই!” নিশ্বাসের সাথে হিসহিসিয়ে শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে শিপলুর মুখ দিয়ে, ঠোঁটের কোণে ফেনা, দুই চোখে যেন নরকের আগুন। ওই এক মুহূর্তের জন্য ওকে শয়তানের পুজারি না, স্বয়ং শয়তানের মত লাগলো আমার।

“আর নিজেকে এটা বুঝিয়েই সারা দেশে কতগুলো আজগুবি কেসের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছিস তুই? শয়তানের আরো কাছাকাছি যাবার জন্য?” কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম আমি।

“হ্যা,” বললো শিপলু। চেহারার সাথে সাথে স্বরও পাল্টে গেছে ওর, পশুর মত গরগর শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। “কিন্তু এখনও একটা দরকারি ধাপ বাকি আছে। আর সে জন্যই তোর সাথে বন্ধুত্বের অভিনয়টা দরকার ছিলো, জামশেদ।’

“নরবলি,” কোনমতে শব্দটা গলা দিয়ে বেরোলো আমার।

“হ্যা,” চেনার অযোগ্য ঘড়ঘড়ানিতে পাল্টে যাচ্ছে শিপলুর কণ্ঠ, চোখদুটো জ্বলছে ঠিক আমার পেছনে মরে পড়ে থাকা পিশাচটার মতো। “নরবলি। আর সেটা যে কোনো জায়গায় হলে চলবে না, যে কাউকে বলি দিলে চলবে না। বলি দিতে হবে অমাবশ্যার রাতে, শয়তানের মন্দিরে-ঠিক যেমন আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তেমন কোনোখানে।”

এই অভিশপ্ত মন্দিরটা তাহলে একটা পরিত্যক্ত শয়তানের মন্দির!

“মন্দিরটা খুঁজে পেতে সারা দেশ চষে বেড়াতে হয়েছে আমাকে,” বলেই চলেছে শয়তানের পুজারি, “অবশেষে পেলাম এই গ্রামের জঙ্গলে! আর প্রভু আমার পক্ষে ছিলেন বলেই, তার অশুভ অপবিত্র হাতের কারসাজিতেই এই গ্রামে চলছিল আরেক নাটক—যেটার মূল হোতা ছিল মফিজ দারোগা। যেটা তুই জেনে গেছিস এতক্ষণে।”

আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার! মফিজের সাথে হাত মিলিয়েছিল শিপলু আগেই, যেবারে মন্দির খুঁজতে এই গ্রামে এসেছিল, তখনই।

“গ্রামের বাংলোটা আছে না?” শয়তানের পুজারি শিপলুর ঘড়ঘড়ে স্বর ক্রমেই চেনা আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, “সেটা আসলে বাংলো না, কোনোকালে ছিল না-ওটা ছিলো মফিজ দারোগার বাপের বাড়ি। গল্পটা শুনিসনি-এক প্রফেসর একাত্তরে এসেছিল এখানে আশ্রয় নিতে, তার পেছন পেছন মিলিটারি নিয়ে এসেছিল এক তরুণ রাজাকার? ওই প্রফেসর ছিলো মফিজ দারোগার বাবা! ওদের ফ্যামিলির একমাত্র সারভাইভিং মেম্বার ছিলো মফিজ দারোগা! সাধে কি আর ওর মাথা বিগড়েছে? আমি-”

“তুই মফিজ দারোগাকে বোঝালি যে আমিই ওই রাজাকারের ছেলে, আর তুই আমাকে এনে দিতে পারবি ওর নাগালের মধ্যে,” ফিসফিসিয়ে বললাম তাকে। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে।

“হ্যা,” ঘড়ঘড়ে গলায় বললো শিপলু। “বাকি থাকলো তোকে সত্যি সত্যি এখানে আনা। রাশেদকে চটালাম তোর নামে, বোমা মজিদকে লাগালাম তোর পেছনে-তোর ওপর আমার এতটুকু বিশ্বাস ছিলো, ও তোর সাথে লাগতে আসলে তুই ওকে খুন করবি-তোকে খুনের আসামি বানালাম। তোকে এই গ্রামে নিয়ে আসার রাস্তা অনেকটা পরিস্কার হলো। বাকি থাকলো সবচেয়ে বড় সমস্যাটা তুই নিজে। তুই সুস্থমস্তিষ্কে কখনো এই গ্রামে আসতি না, দুনিয়া উল্টে গেলেও।”

“আর সেই জন্যে আমার ওপর ড্রাগস প্রয়োগ করলি তুই,” বললাম আমি অনেকটা যেন নিজেকেই। শিপলু আর না বললেও চলবে, বাকিটা বোঝা হয়ে গেছে আমার ভালোভাবেই।

“হ্যা! কাজটা সহজ, কারণ তুই হেভি ড্রিংকার! এমন ড্রাগ আমাকে চুজ করতে হয়েছে যাতে তোর শরীর ঠিক থাকে, তুই নিজ ইচ্ছায় আমার সাথে আসিস, কিন্তু তোর বিচারবুদ্ধি যেন গুলিয়ে যায়! সুতরাং? তোর মদের সাথে খানিকটা এলএসডি, আর প্রাচীন একটা হ্যালুসিনোজেনিক ভেষজ-ম্যানড্রেক! প্রথম ডোজ তোর ওপর দিলাম থার্সডে নাইট ডিলাইটের পার্টিতে! তোর বাবা মরার পর তোর মাথায় এমনিতেই গোলমাল, সেজন্য জাদুর মত কাজ করলো ড্রাগটা। তার পরে কি কি করিয়ে নিয়েছি আমি তোকে ওই হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ দিয়ে, সেটা তোর জানা আছে!”

হ্যা, আমার জানা আছে। আমার ভাল জানা আছে। রংপুর আসার পথে বিশাল অ্যামনেশিয়া। অদ্ভুতুড়ে সব স্বপ্ন। জঙ্গলে ঢোকার পরে প্রবল অডিও-ভিজুয়াল- সেনসরি হ্যালুসিনেশন, কারণ হাত কাঁপা থামাতে প্রত্যেকবারই বড় ডোজে অ্যালকোহল নিয়েছিলাম, সেই সাথে মেশানো ড্রাগও। আর সেজন্যই….

“সাধারণ একটা শেয়ালকে তোর কাছে লাগছিল বিশাল, হিংস্র পিশাচের মত, “ ঘড়ঘড়িয়ে বললো শিপলু। চেহারাই বদলে গেছে ওর এখন। প্রভু শয়তানের সাথে বোধহয় আর কোনো তফাত নেই ওর চেহারার এখন।

“কিন্তু আমি কেন?” দুর্বল গলায় প্রশ্ন করলাম। “কেন আমাকেই বলি দিতে হবে তোর?”

“কারণ তোর সবকিছু মিলে যায়,” পৈশাচিক একটা হাসি মুখে ঝুলছে শিপলুর।

“নিউমোরলজি দিয়ে বিচার করে দেখেছি আমি, অ্যাস্ট্রোলজি দিয়েও। তোর জন্ম তারিখ, লগ্ন, রাশি, জাতকের চরিত্র, সবকিছু মিলে যায়—এমন বলিই চান আমার প্রভু! আর বিশেষ করে ওটা!” আমার কপালের জন্মদাগটার দিকে দেখালো শিপলু। “সাথে তোর কপালের জন্মদাগ!”

“তার মানে পত্রিকায় আমার ছবি দেখে আমাকে খুঁজে পেয়েছিস তুই!”

“হ্যা!” উন্মত্তের মত হেসে উঠেই থেমে গেল শিপলু। “ড্রাগ কেলেংকারি করলি যখন, তখন পেপার-পত্রিকা ভেসে যাচ্ছিলো তোর ছবি দিয়ে, তখনই আমি একটা ছবিতে দেখি তোর কপালের জন্মদাগটা। তখনই বুঝতে পারি, আমার প্রভুর কাছে উৎসর্গ করার জন্য তোর চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ এই দেশেই নেই!”

“কিন্তু সব ভজকট করে দিতে শুরু করেছিল মফিজ দারোগা, তাই না?” তেতো গলায় বললাম আমি।

“হ্যা! তোকে মারতে চায় ও নিজেই! কথার জালে ফেলে দমিয়ে রেখেছিলাম বটে বেশ কিছুটা সময়, কিন্তু তুই যখন বিকেলে হাটে গেছিস তখন সে মেজাজ হারিয়ে বাংলোতেই অ্যাটাক করে বসলো তোকে মারতে! বাকিটা তো তুই জানিস-গাড়িতে করে পালাতে যাচ্ছিলাম, গুলি করলো মফিজ দারোগা, সামাদের পেট ফুঁড়ে চলে গেল সেটা, গাড়ি কাত, মফিজ দারোগা আমাদেরকে খালিভিটায় নিয়ে গেল কারণ সে জানতো তুই আমাদের খোঁজে আসবিই-”

“তারপরে আমি গেলাম, ছোট্ট একটু নাটকও হলো, আর তারপরে আমরা এখানে।” তীব্র ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলাম আমি। থুথু ফেললাম মাটিতে।

“হ্যা।” হাসার চেষ্টা করলো শিপলু, নারকীয় সেই হাসি দেখে ঘৃণায় গা রি-রি করে উঠলো আমার। “মফিজ দারোগা আমাকে মেরে ফেললো, কিন্তু মহান শয়তানের দয়া আছে আমার ওপরে, আমি মৃত্যু থেকে বেঁচে চলে এসেছি তোকে প্রভুর বেদিতে বলি দিতে!” দা ধরা হাতটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে ওর।

আসল নকল বিচার করো। আমার কানে কাছে আবার বলে উঠলো কেউ। আমি মুচকি হাসলাম। এখন আমি জানি, ওটা কোনো অশরীরি আত্মার কন্ঠ নয়, বরং আমার নিজের অবচেতন মন আমাকে পুরোটা সময় সাবধান করতে চাইছিল, তুমি চোখের সামনে যা দেখছো সেটা সত্য না, মায়া, হ্যালুসিনেশন। তুমি কোনটা আসল আর কোনটা নকল সেটা আলাদা করতে শেখো-আসল নকল বিচার করো। সন্দেহ নেই খালেকুজ্জামান স্যারের প্রলাপ থেকেই কথাটা ক্যাচ করেছে আমার ব্রেন।

“আসল নকল বিচার করতে শিখেছি আমি, শিপলু।” মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বললাম।

শিপলুর পৈশাচিক চেহারাটা বিভ্রান্ত দেখালো এক মুহূর্তের জন্য। “কি বললি?”

“আমি যদি বলি, মফিজ দারোগার রিভলভারের সবগুলো গুলি আসল ছিলো না?” আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম।

শিপলু টকটকে লাল চোখদুটো বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ফেনা বেরোনো মুখে কোনো কথা নেই।

“আমি যদি বলি, আমার রাইফেলের সবগুলো গুলি আসল নয়?” সোজাসুজি শিপলুর জান্তব চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আছি এখন।

এবারও রা নেই ওর মুখে। থুতনি গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। লাল চোখদুটোয় অপরিসীম ঘৃণা।

“গুলিগুলো বদলে দিয়েছিল কে? তুই, নরকের কীট কোথাকার!” গর্জে উঠলাম আমি। “ব্ল্যাঙ্ক কাট্রিজ ভরে দিয়েছিলি আমার আর মফিজ দারোগার বন্দুকে। কিন্তু সবগুলো না—দুয়েকটা আসল গুলিও রেখে দিয়েছিলি! কি জন্য? তোর কল্পিত প্রভু বোধহয় শত্রুর কাছ থেকে সব সুযোগ কেড়ে নেওয়ার পক্ষে না, তাই না?”

লাল টকটকে চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা যদি সম্মতির লক্ষণ হয় তাহলে শিপলু হ্যা-ই বলছে বটে।

“আর যে দুই-একটা আসল বুলেট রেখে দিয়েছিলি, তারই একটা আমার ভাই সামাদের জীবনটা কেড়ে নিয়েছে, ম্যানিয়াক কোথাকার!” রাগে কাঁপছে আমার গলা। “আমার রাইফেলের একটা আসল বুলেট মফিজ দারোগার শয়তানি শেষ করে দিয়েছে। ব্ল্যাঙ্কগুলো অযথা ফায়ার করেছি শেয়ালকে পিশাচ ভেবে!”

কাঁপতে কাঁপতে মুখ খুললো শিপলু। লাল চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে ওর-মুখটা বদলে গেছে ঘৃণার মুখোশে। “কিন্তু আমি…”

“মরা থেকে বেঁচে ফিরেছিস, তাই তো?” খেঁকিয়ে উঠলাম। “মফিজ দারোগার ওই বুলেটটাও ছিলো ব্ল্যাঙ্ক! আর রক্ত?” শিপলুর শার্টের সামনে বুকে শুকনো লাল দাগটার দিকে টর্চের আলো নাচালাম আমি। “তোর এফডিসিতে খুব আনাগোনা, সেটা ভুলেছি ভেবেছিস? গুলি খাওয়ার নকল ইফেক্ট কি করে দেখাতে হয় সেটা শিখেছিস ওখানেই, দরকারি কিটস আর রঙও জোগাড় করেছিস! গোটা ব্যাপারটাই স্রেফ চিপ পার্লার ট্রিকস!”

চোখ দিয়ে আগুন বের করার চেষ্টা করছে যেন শিপলু, ভষ্ম করার চেষ্টা করছে আমাকে। শিউরে উঠলাম আমি-উন্মাদটার মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে, মুখের চামড়া কুকুরের মত সরে গিয়ে মাঢ়িসহ দাঁত দেখা যাচ্ছে সবগুলো, লাল টকটকে চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে গোল দুটো অঙ্গারের টুকরোর মত।

“আর তোর কেস স্টাডিগুলো,” প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছি আমি এখন, “সেগুলোর কথা শুনতে চাস? তোর ধারণা, যেগুলো তোকে তোর প্রভু শয়তানের আরো কাছাকাছি নিয়ে গেছে? সেগুলোরও আসল ব্যাখ্যা আমার জানা আছে, শিপলু! শোন তাহলে!” আমাকে কথার নেশায় পেয়ে বসেছে। “তোর কয়েকটা ফেমাস কেসের কথা বলি। যেমন ‘অ্যানজাইনা।’ যে ছেলেটার কথা তুই বলেছিলি, তার আসলে হার্ট ডিজিজ ছিলো। জন্মগত! সিগারেট খেতে শেখার পরে সেটা বেড়ে গেছিলো। স্বয়ং মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখাটা জাস্ট একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হবার সময়ের হ্যালুসিনেশন!”

শিপলুকে রিয়্যাক্ট করারও টাইম দিলাম না। বললাম, “আর “পাঁচ তলা!” অসহায় মেয়েটা পাঁচ তলাতে কারো রেপের শিকার হয়েছিল সম্ভবত তার রিলেটিভ কারো কাছে-তারপর তার মস্তিষ্ক তাকে বুঝিয়েছে যে রেপের ব্যাপারটা আসল না, সে আসলে অতিপ্রাকৃত কোনো জীবের খপ্পরে পড়েছিল! সিভিয়ার ট্রমার পেশেন্টদের ক্ষেত্রে এসব হয়। মেয়েটা সুইসাইডাল হয়ে উঠেছিল ওই ট্রমার কারণেই। আর….হ্যা, ‘তদন্তম্! বেচারা ফাহিম ছিল তোর প্রথম খুন, না? পুলিশ তোকে ধরতে পারেনি, কারণ ফেঁসে যেতে পারিস এরকম কোনো কু রাখিসনি তুই, ওই বয়সেও বড্ড চালু ছিলি, শয়তানের বাচ্চা শিপলু! কেন মেরেছিলি বেচারাকে? আর একটা, ‘রিগর মর্টিস!’ ডাক্তার নাহিদ দায়িত্বে অবহেলা করে একটা পেশেন্টকে মেরে ফেলার পর ওই হাসপাতাল থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কাটা অঙ্গ জোড়া লাগিয়ে তৈরি হওয়া পিশাচ স্রেফ একটা বোগাস ছেলে ভোলানো গল্প! আরো একটা ফেমাস কেস তোর… চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন!’ তোর প্রাক্তন মেসের রুমমেট চাকরি বাকরি হারিয়ে পাগল হবার পরে তোকে যে প্রলাপ শুনিয়েছিলো সেটা মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখে মাসিক হালচালে ছাপিয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে বোকা বানিয়েছিস, তাই না?”

শিপলুর মুখের চওড়া হাসিটা একেবারে নেই হয়ে গেছে। মাথাটা নিচু করে ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। যে চশমার চকচকানি ওকে অসাধারণ করে তুলেছিল, সেটা গায়েব। ফ্রেমের ওপর দিয়ে কেবল দেখা যাচ্ছে ওর শীতল কালো চোখ।

“এই এক্সপ্লেনেশনগুলো আমাকে দিয়েছিল সামাদ…আমার ভাই,” গলা কেঁপে গেল আমার বলতে গিয়ে। “আর এগুলোর ওপর বেজ করেই তো নিজেকে অকাল্ট সায়েন্সের গুরু ভেবে নিয়েছিলি তুই, না? অলৌকিক বিষয়ের সবজান্তা! হাহ! যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, সেটা আবার বিজ্ঞান হয় কি করে? সুস্থ মাথার যে কেউ বুঝবে এটা-তুই বুঝিসনি-বরং নিজের তৈরি করা ইলিউশনে নিজেই ডুবেছিলি তুই, নিজেই নিজেকে ধোঁকা দিয়েছিস। কারণ কি, জানিস?” এক মুহূর্ত থামলাম আমি, “কারণ তুই একটা সাইকোপ্যাথ, শিপলু! তোর রক্তেই আছে খুনের নেশা!”

দম নিলাম লম্বা করে। “অনেক শয়তানি করেছিস তুই, শয়তানের বাচ্চা, ধীরে ধীরে শান্ত সুরে বললাম আমি। “কিন্তু ভুলিস না-পাপের সাজা এই দুনিয়াতেই পেতে হয়।” কথাগুলো খেলো। ফাঁকা বুলি। আসলে গোটা ব্যাপারটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি আমি ঘোলা মাথা নিয়েই।

আমার সাতফুট সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাইকো শিপলু। হাতে একটা ধারালো দা-ওটা দিয়ে কোপালে একটা হাত আলগা হয়ে আসবে যে কারো। আমার কাঁধে অবশ্য রাইফেল আছে, কিন্তু চেম্বারে যে বুলেটটা আছে সেটা আসল না শিপলুর দেয়া ব্ল্যাঙ্ক, বোঝার উপায় নেই।

আর শিপলু আমার ওপরে ঝাঁপানোর আগে আমি একটা গুলি করারই সুযোগ পাবো।

শিপলুও সেটা জানে। গনগনে লাল চোখে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও, মুখে ধীরে ধীরে ফুটছে একটা শয়তানি হাসি।

“চালা গুলি,” চেনার অযোগ্য ঘড়ঘড়ে জান্তব স্বরে বলে উঠলো শিপলু, “তোর বুলেটগুলোর মাঝে মোট তিনটে আছে আসল, আর বাকিগুলো ব্ল্যাঙ্ক! এর মাঝে দুটো খরচ করে ফেলেছিস তুই….”

আমার বুকের মাঝে দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন। ঠিকই বলছে শিপলু।

একটা গুলিতে মফিজ দারোগার খুলি উড়িয়ে দিয়েছি আমি।

আরেক গুলিতে আমার পেছনের শেয়ালটা পটল তুলেছে।

কিন্তু আরো কয়েকটা গুলিও তো করেছি আমি!

জঙ্গলের ধারে একবার।

জঙ্গলের ভেতরে শয়তানের মন্দিরে প্রথমবার ঢুকে একবার।

সে-দু’বার শেয়ালের গায়ে গুলি লাগেনি। সেগুলো কি সত্যিই ব্ল্যাঙ্ক ছিলো, নাকি সেগুলোর মাঝে একটা রিয়েল বুলেটও ছিলো? আমিই মিস করেছি? আমার কাছে কি এখন সব ব্ল্যাঙ্ক?

চেম্বারে এখন একটাই বুলেট আছে। একটা গুলি করারই সুযোগ আছে আমার। সেটা যদি ব্ল্যাঙ্ক হয়ে থাকে, তাহলে আর এক সেকেন্ডও সময় পাবো না আমি, গর্দানটা যাবে শিপলুর দা-য়ের কোপে।

যা কিছু বললাম, সব ভাবনা আমার মাথায় খেলে গেল এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মাঝেই, কারণ অতটা সময়ই আমি পেয়েছিলাম শিপলু ওর দাঁতগুলো খিঁচিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় গর্জে উঠে দা-টা দু-হাতে ওপরে তুলে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে।

আপনা-আপনিই ট্রিগারে চাপ পড়লো আমার আঙুলের।

শিপলু জোম্বির মতো ছুটে আসছে আমার দিকে-সোজা ওর বুকের ওপর ফুটলো রাইফেলের গুলি।

কিছুই হলো না!

ব্ল্যাঙ্ক!

মরিয়া হয়ে রাইফেল-টর্চ সব ফেলে বাঁ হাতটা তুলতে না তুলতেই শিপলুর কোপটা এসে পড়লো আমার কাঁধের ওপরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *