অধ্যায় ১৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
আমার বাম কাঁধটা যে মুহূর্তে মফিজ দারোগার সোলার প্লেক্সাসে লাগলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছে সে। আমার কানের পাশে প্রচন্ড শব্দে ফুটলো দিকভ্রষ্ট গুলিটা।
পরের মুহূর্তেই মফিজ দারোগাকে নিয়ে মাটিতে পড়লাম আমি।
মাথা তুলেই সবার আগে মফিজ দারোগার ডান হাতটা চেপে ধরলাম আমার বাম হাত দিয়ে, ওই হাতেই আছে ওর পিস্তলটা। কোনোমতে নিজের হাটুর ওপরে ভর দিয়ে সোজা হয়েই শরীরের সমস্ত শক্তিতে দুটো ঘঁষি হাঁকালাম মফিজ দারোগার চোয়ালে।
আমার প্রচন্ড গুঁতোয় আগেই বুকের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গিয়েছিল মফিজ দারোগার, আর এখন পর পর দুটো ঘুঁষির ধাক্কা সামলাতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে সে। তৃতীয় ঘুষিটা ছোঁড়ার আগে এক সেকেন্ডের দ্বিধায় বাতাসে দুলছিল আমার হাতটা। খপ করে সেটা ধরে ফেললো মফিজ দারোগা, হ্যাচকা টানে কাছে এনে ফেললো আমাকে, তারপরেই আমার নাকের ওপর একটা জোরালো টুশ।
চোখে অন্ধকার দেখছিলাম আমি-কিন্তু সেটা এতটা না যে দেখবো না দারোগা আমার মাথার দিকে তাক করছে তার ছাড়িয়ে নেয়া পিস্তলটা। পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছিলাম, তার আগ মুহূর্তে কোনোমতে বামহাতের এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে দিলাম পিস্তলটা।
মফিজ দারোগার টুশটা ভালোই কাহিল করেছে আমাকে, সন্দেহ নেই। উল্টে পড়েছি আমি পেছন দিকে, মাথাটাকে মনে হচ্ছে তুলোর মত হাল্কা। নাক ভেঙে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আমার, টের পাচ্ছি সেটা। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাববার সময় নেই এখন। বহু কষ্টে মাথাটা তুললাম আমি, দেখলাম মফিজ দারোগা হাঁচড়ে পাঁচড়ে সোজা হবার চেষ্টা করছে, ফুট দশেক দূরে ছিটকে পড়া পিস্তলটার দিকে তার চোখ। ওটার দিকে ছুটতে পারি আমিও-কিন্তু দেরি হয়ে যাবে, মফিজ দারোগা পৌঁছে যাবে আগেই।
ঝট করে পেছনের দিকে মাথা ঘোরালাম। ওই তো আমার রাইফেলটা! মরিয়া আমি চার হাত পায়ে ভর দিয়ে সামনে ছুঁড়ে দিলাম নিজের শরীরটা। ভাগ্য ভালো ছিলো রাইফেলের ওপরেই পড়লো হাতটা।
বসে-বসেই রাইফেলটা তুলে নিলাম আমি, একই সাথে শরীরের ওপরের অংশটাতে ঘোরাচ্ছি সামনের দিকে। রাইফেলের বাটটা কাঁধে ঠেকানো শেষ আমার।
মফিজ দারোগা তখনো হামাগুড়ি দিয়ে পিস্তলটার দিকে এগোতে ব্যস্ত। আমার বোল্ট টানার শব্দে মাথাটা পেছনে ফেরালো সে। দুই চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি।
রাইফেলের স্কোপের মাঝে পেয়ে গেছি দারোগার মাথাটা। ধীরে-সুস্থে সেটাকে আরো অ্যাডজাস্ট করে নিলাম আমি।
একটা হাত তুললো মফিজ দারোগা। “জামশেদ”
মফিজ দারোগার বাকি কথাটা শোনা হলো না আমার, কারণ ততক্ষণে ট্রিগার টেনে দিয়েছি আমি।
মফিজ দারোগার হাতটা তোলা অবস্থাতেই থেকে গেল-চোয়ালের অর্ধেকটা আর একটা কানসহ মাথার বামদিকটা স্রেফ উড়ে গেল তার ঘিলু আর খুলি-চামড়াসহ।
কাজ শেষ। ফেলে দিলাম রাইফেলটা-বলা ভালো আমার হাত থেকে পড়ে গেল ওটা। হাটুর ওপর ভর দিয়ে বসে আমি, যেভাবে নিল-ডাউন হয়ে থাকে ক্লাশের দুষ্ট ছাত্ররা, ল্যাগব্যাগ করে হাত দুটো ঝুলছে আমার শরীরের দু’পাশে। মাথাটা যেন ঘাড় ছেড়ে আকাশে ভেসে যেতে চাচ্ছে, এতই হালকা লাগছে ওটা। কাঠফাটা রোদ, তবু আঁধার দেখছি চোখে। বুঝতে পারছি জ্ঞান হারাতে চলেছি আমি, কাটা কলাগাছের মত মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছি মাটির ওপর
বন্ধু আর শত্রুর লাশ দু’পাশে নিয়ে খনিকক্ষণ বেহুঁশ হয়ে থেকে বাস্তবতা থেকে পালাতে পারলে ভালই লাগতো আমার, কিন্তু হঠাৎ বুঝতে পারলাম সেটা সম্ভব না এই মুহূর্তে। বহু দূরে একটা হইচইয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। একদল লোক উত্তেজিতভাবে কথা বলছে যেন কোথায়।
ডিহাইড্রেশন আর মারের চোটে মাথাটা গুলিয়ে না থাকলে শোনার সাথে সাথেই বুঝতাম কিসের গোলমাল ওদিকে।
গ্রামবাসি!
অভিশপ্ত জগদানন্দপুরের লোকজন বুঝতে পেরেছে-সেটা যেভাবেই হোক—তাদের ডার্ক নাইট মফিজ দারোগা সফল হতে পারেনি, কোনো একটা ভজঘট বাধিয়ে ফেলেছে।
রাইফেলের শব্দের পর আর কোনো শব্দ হয়নি। শেষ আওয়াজটা পিস্তলের হলে গ্রামের লোকজন বুঝতো শহুরে শত্রু নিকেষ হয়েছে। রাইফেলের আওয়াজে ওরা বুঝে গেছে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
আর কোনো সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে এদিকেই ছুটে আসছে সবাই।
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। বিপদের গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পেরে ধাঁ করে হুঁশে ফিরলাম আমি। হার্টবিট বেড়ে গেছে, ব্রেনে রক্ত পৌঁছাচ্ছে, কাজেই অজ্ঞান হবার ভয় আর নেই আপাতত। কিন্তু মাথা ঘোরাটা গেল না। পরোয়া করলাম না অবশ্য। টেনে হিঁচড়ে নিজেকে খাড়া করালাম নিল-ডাউন অবস্থা থেকে। মাথায় চিন্তা চলছে ঝড়ের বেগে। গ্রামবাসির হাতে ধরা পড়া যাবে না কোনোমতেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেবার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ আছে এই গ্রামের লোকদের-ওদের হাতে ধরা পড়লে…শিউরে উঠলাম আমি। ওদের ডার্ক নাইটের মাথা ফাটা তরমুজ বানিয়ে দিয়েছি আমি, ওরা চাইবে কড়ায় গন্ডায় সেটার শোধ তুলতে। অ্যাংরি মব খুব খারাপ জিনিস। বেনিতো মুসোলিনির পরিণতি মনে পড়লো আমার। নিজের প্রিয় শহর মিলানে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার লাশ, মানুষ আবার সেটার দিকে ঝাঁটা, থুথু আর ঢিল মেরেছে ইচ্ছেমত। গা হিম হয়ে গেল আমার, ওরা যে আমার সাথেও তেমনটা করবে না সেটা কোনো কেতাবে লেখা নেই।
মফিজ দারোগার লাশের কয়েক ফুট সামনে পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে চোখ গেল আমার। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, নিজের ব্রেনে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়াটাই বেস্ট পলিসি।
গ্রামবাসির উত্তেজিত হইচই আরো অনেকটা এগিয়ে এসেছে। হাতে মোটেই সময় নেই। আমি ঠিক করে ফেলেছি কি করবো। এই জীবনে নিজের কাছে নিজে আমি হেরে গেছি বহুবার কিন্তু অন্য কারো কাছে হারিনি কখনো। আজও হারবো না।
লম্বা দু-পায়ে এগিয়ে গিয়ে মফিজ দারোগার রিভলভারটা তুলে নিলাম আমি। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ডান কানের সামনে ব্যারেলটা ঠেকিয়ে টেনে দিলাম ট্রিগারটা।
খটাস।
খালি চেম্বারে বাড়ি খেয়েছে হ্যামারের মাথা।
মাথা থেকে সরিয়ে সামনে এনে এক মুহূর্ত বোকার মত তাকিয়ে রইলাম হাতে ধরা রিভলভারটার দিকে। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম তারপর সেটা।
সুইসাইডের চেষ্টা ঝোঁকের মাথায় করিনি, বুঝেশুনেই করেছি। কিন্তু কি আর করা, ওই যে লোকে বলে, কপালে লেখা নেই।
এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, ঈশ্বর সেকেন্ড চান্স দিচ্ছেন আমাকে। পরের মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে দূর করলাম আজগুবি ভাবনাটা। কখনো এসব বিশ্বাস
করিনি, আজও করবো না। তার বদলে রাইফেলটা হাতে তুলে নিলাম। না, মরার আগে যতটাকে সম্ভব নিয়ে মরবো তত্ত্বতে চলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ভুট্টাখেতের ওইদিকটা একদম জঙ্গলের কাছ পর্যন্ত চলে গেছে—ওটা ধরে জঙ্গলে গিয়ে লুকানো যেতে পারে। তার পরের স্টেপ জঙ্গলে বসেই ভাবা যাবে নাহয়।
জানি হাতে সময় নেই, প্রতিটা মুহূর্তই মূল্যবান, কাছিয়ে আসছে গ্ৰামভৰ্তি ফ্যানাটিক লোকজন, তবু একটু পিছিয়ে গিয়ে শিপলুর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না আমি। যেভাবে ভুট্টাগাছের দঙ্গলের মাঝে গিয়ে পড়েছিল শিপলু, সেভাবেই পড়ে আছে। বুকের ওপরটা রক্তে মাখামাখি। প্রাণহীন চোখ দুটো খোলা। আমার দেখা সবচেয়ে একসেন্ট্রিক আর প্রাণচঞ্চল ছেলেটা মারা গেছে!
আর দেখার কিছু নেই। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছোটা শুরু করলাম আমি জঙ্গলটা কোনদিকে সেটা আন্দাজ করে। রাইফেল একহাতে। মাথা ঘোরার ব্যাপারটা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছি একধারে।
সামাদের কথা ভুলিনি আমি। কিন্তু ওর খোঁজ করার সময় একেবারে নেই আমার। গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টার সময় সামাদই ছিলো ড্রাইভারের সিটে, ড্রাইভার ডোর ফুটো করা গুলিটা ওর শরীরই ফুঁড়ে গেছে। তাছাড়া একটু আগে সামাদের কথা জিজ্ঞেস করার সময় শিপলু যেভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো, তাতেই নিশ্চিত, খবর ভালো না। সামাদ এখনো না মরে থাকলে আর বেশিক্ষণ টিকবেও না।
দৌড়াচ্ছি আমি, কিন্তু এক সেকেন্ডর জন্য বুকের গভিরে কোথায় যেন চিনচিন করে উঠলো আমার। তিনকুলে ওই একটা—
কোনোকিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়লাম আমি। রাইফেল ছিটকে গেছে দূরে, দুই হাঁটু আর কনুইতেও চোট পেয়েছি জবরদস্ত। কোনোমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে মাথা ঘুরিয়েই দেখতে পেলাম কিসের সাথে ঠোক্কর খেয়েছিলাম।
সামাদের শক্ত হতে শুরু করা লাশ। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ফ্যাকাশে মুখের কোণে ভনভন করছে একটা মাছি।
যা ভেবেছিলাম তাই গাড়িতে বসে খাওয়া গুলিটাই ফ্যাটাল হয়েছিল সামাদের জন্য। হয়তো মফিজ আর শিপলুর সাথে এখানে কোনোমতে এসেই বেঘোরে মারা পড়েছে ও।
এই দুনিয়ায় আমার সর্বশেষ আত্মীয়ের লাশটা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে পারতাম ইচ্ছে করলে। কিন্তু তাতে আমার বংশের প্রদীপ নেভার চান্সটাই প্রবল হবে কেবল-কারণ হই হট্টগোলের শব্দেই বোঝা যাচ্ছে উত্তেজিত গ্রামবাসির দল খালিভিটার খুব কাছে এসে গেছে। এখন ইমোশনের সময় নয়। কাজেই রাইফেলটা তুলে নিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিলাম আবার।
এক মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেল আমার গেস ভুল ছিল না, ঠিক দিকেই যাচ্ছি। ভুট্টাগাছের ফাঁকের ভেতর দিয়ে ঝোপজঙ্গলের সূচনা দেখা যাচ্ছে। তার পরেই আঁধারে ছাওয়া জঙ্গল।
দেড় মিনিটের মাঝে জঙ্গলের ভেতরে চলে এলাম আমি। সূর্য ঢলে পড়েনি এখনো। আগামি দুই ঘন্টায় পড়বেও না। কিন্তু বনের ভেতরে এরই মধ্যে নামতে শুরু করেছে সূচীভেদ্য অন্ধকার। আর এই অন্ধকারেই আমাকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে পালানোর সুযোগের অপেক্ষায়।
*
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিশ্চয়ই। হঠাৎ ভেঙে গেল চটকা।
ঝট করে চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে নিলাম আমি। খাড়া হয়ে গেছে কান। কোনো শব্দ পেলাম না যদিও।
জঙ্গলের বেশ অনেকটা ভেতরে ঢুকে বড়সড় একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ছড়ানো শেকড়ের ওপর বসে পড়েছিলাম। গাছটার গোড়ার আশপাশে বেশ ঝোপঝাড়ের মতন ছিল, তার মাঝে বসলে বাইরে থেকে দেখা যাবে না-এই ভরসায় চুজ করেছিলাম। পিঠ আর মাথা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে রাত নামার অপেক্ষা করতে করতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল, টেরই পাইনি।
কিন্তু এখন ঘুম ভাঙলো কি জন্যে?
গ্রামবাসি প্রতিহিংসার নেশায় তাদের ট্যাবু ভুলে জঙ্গলের ভেতরেও চলে এসেছে নাকি?
কম সময় পেরোয়নি। সন্ধে তো পুরোদমে নেমেছেই—রাতই বলা যায় রীতিমত এখন। আঁধারের মাঝেই চোখ সরু করে দেখার চেষ্টা করছিলাম কোনোমতে, আর তখনই ঘাড়ের কাছে শীতল স্পর্শটা পেলাম আবার।
আমার ঘাড় ছেড়ে এখন কাঁধে নামছে শীতল স্রোতটা। আলসে, ধীর নড়াচড়া ওটার। কোথাও যাবার তাড়া নেই যেন।
দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছি আমি। একেবারে নট-নড়নচড়ন। না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছি জিনিসটা কি।
জিনিসটা আমার কাঁধ-পিঠ ছেড়ে উরুর ওপরে, আর তারপর মাটিতে নামলো মিনিট দেড়েক খরচ করে—যদিও আমার কাছে সময়টা মনে হলো অনন্তকালের মত।
আমার কোলের ওপর দিয়ে শেষ সুড়সুড়িটা চলে যাবার পরও এক মিনিট কাঠ হয়ে বসে রইলাম আমি।
সাপ।
কি সাপ, সেটা বুঝতে পারিনি আঁধারে, কিন্তু আকারে অন্তত ফুট ছয়েক হবে ওটা, নিশ্চিত। সুন্দরবনে গিয়ে জীবনের প্রথম সাপ দেখি আমি। বেশ দূর থেকে দেখা, তবু গা কাঠ হয়ে গিয়েছিল আমার, পুরো শরীর ঘিনঘিন করছিল ঘৃণায়। সামাদ পরে বলেছিল, সাপকে ভয় পাওয়ার মন্ত্র মানুষের ডিএনএ-তেই লেখা আছে। সাপকে না ভয় পাওয়াটাই প্রতিবন্ধির লক্ষণ। আজ হাড়ে হাড়ে বুঝলাম কথাটার সত্যতা। বুকের খাঁচায় ধপাধপ বাড়ি মারছে হৃৎপিন্ডটা, সাথে ঠান্ডা ঘামও ছুটে গেছে আমার।
সামাদের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। শিপলুর হাসিমুখও মনের পর্দায় ভেসে উঠলো, ঠোঁটের কোণে ঝুলছে মার্লবোরো। ওরা আর নেই!
মাথা ঝাড়া দিয়ে ওসব ইমোশনাল চিন্তাভাবনা জোর করে তাড়ালাম আমি। নিজেকে বাঁচাই আগে। আপনে বাঁচলে বাপের নাম। আর তাছাড়া আমি না বাঁচলে এই গ্রামে কি হয়েছে—সেটা কেউ কোনোদিন জানবে না। সাত-সাতজন মানুষ মরেছে মোটমাট। ব্যাপারটা বড় সহজ নয়। বোমা মজিদ হত্যা মামলা? কেয়ার করি না। ওটা পরে দেখা যাবে। এই গ্রামে যে কান্ড হয়েছে তার তুলনায় ও-ব্যাপারটা বলতে গেলে ছেলেখেলা।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চাইলাম-কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আজ নিশ্চিত অমাবশ্যা। ঘোর অমাবশ্যা।
পকেটে হাত দিয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরলো। টর্চটা আছে! তাড়াতাড়ি বের করে সুইচ টিপে দেখলাম, জ্বলছে। মফিজ দারোগার সাথে দাপাদাপিতে তাহলে ভাঙেনি বাল্ব।
জ্বালিয়েই অবশ্য সাথে সাথে নিভিয়ে ফেললাম টর্চটা। আলো দেখিয়ে গ্রামভর্তি ফ্যানাটিক লোকজনকে টেনে আনার কোনো খায়েশ নেই আমার। তাদের ডার্ক নাইটকে খুন করা এই আমার টর্চের আলো জঙ্গলের ভেতরে জ্বলতে দেখলে রাগের মাথায় বাপ-দাদার সংস্কার ভেঙে এই জঙ্গলে ছুটে চলে আসা আশ্চর্য নয় ফ্যানাটিকগুলোর জন্য। যদিও জঙ্গলের এতটা ভেতরে যদি আমি তিন ব্যাটারির ছোট টর্চের বদলে ফ্লেয়ার জ্বালাই তবুও তাদের দেখতে পাবার কথা নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
রাইফেলটা কাঁধে ফেলে চরম উৎসাহে পা ফেলতে গিয়ে থমকে গেলাম আমি। সাপের থেকে দূরে পালানোর উৎসাহে খুব তো উঠে পড়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন যাবোটা কোন দিকে?
মফিজ দারোগার খুলি ওড়ানোর পরে জঙ্গলে এসে ঢুকেছি। তখন লক্ষ্য ছিলো একটাই—জঙ্গলের আরো ভেতরে ঢোকা, নিজেকে আরো আড়াল করে ফেলা। তারপর বসেছি গাছের নিচে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে সাপ পেরোনোর পরে জাগলাম। ততক্ষণে দিক-বিদিক জ্ঞান হারিয়েছি ভালোভাবেই।
এখন?
যাবো কোনদিকে?
মাথার ভেতর দ্রুত কিছু হিসেব নিকেশ করার চেষ্টা করলাম আমি। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেছি এদিক দিয়ে, আর খালিভিটাটা ওদিকে, আর নদীটা জঙ্গলটাকে বেষ্টন করে গেছে দুইদিক থেকে, আর ওইদিকটায় নদীর একপাশে জঙ্গল আর একপাশে শ্মশান। শ্মশানের দিকে যাওয়াটাই বেস্ট শট। আমি যদি এখন এদিকে মুখ করে থাকি, তাহলে মনে হয় শ্মশানটা ওদিকে….
হাল ছেড়ে দিলাম আমি। যা ভাবছি সবই স্রেফ আন্দাজ। দিনের আলো থাকলে নাহয় একটা কথা ছিলো। এখন এই আঁধারে ঠিক দিকে যাওয়ার আশা করাটা বাতুলতা।
তাহলে কি করবো? দাঁড়িয়েই থাকবো স্রেফ? রাত পোয়ানোর অপেক্ষা করবো?
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কালিগোলা অন্ধকারটা যেন বাড়তে বাড়তে গ্রাস করার চেষ্টা করছে আমাকে, নিস্তব্ধতা প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে স্নায়ুতে, ঘাড়ের কাছটা এমন শিরশির করছে যেন এক্ষুণি ড্রাকুলা দাঁত বসিয়ে দেবে সেখানটায়, বা কেউ বড়বড় নখওয়ালা হাত দিয়ে খামচে ধরবে। নাহ, এভাবে এখানে থাকাটা কোনোমতেই সম্ভব না। এমনিতেই যে প্রচন্ড মানসিক চাপের ওপর দিয়ে যাচ্ছি, তার ওপর আবার এই জঙ্গলে সারা রাত থাকতে হলে সকালে আমি বাইরে বেরিয়ে আসবো বন্ধ উন্মাদ হয়ে, জন্মদিনের পোশাক পরে হাসতে হাসতে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ছিঁড়তে। গ্রামের লোককে আর কিছু করতে হবে না।
যা হয় হবে ভেবে হাঁটতে শুরু করে দিলাম আন্দাজে, নদীতীরের শ্মশানটা কোনদিকে হবে সেদিকে।
কাজটা সহজ নয়। কেন সহজ নয় সেটার পক্ষে ঝুড়ি ঝুড়ি যুক্তি দেখাতে পারি আমি। চোখে না দেখলে মানুষ যে কতটা অসহায় একটা প্রাণী, সেটা আজ পষ্ট হলো আমার কাছে। গাছের শেকড়ে হোঁচট খাচ্ছি বারবার, ডালপালার বাড়ি লাগছে গালেমুখে, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি সহজেই। মাথা ঘোরার ব্যাপারটা কাটেনি।
গলা শুকিয়ে কাঠ। পানি খাওয়া হয়নি বহুক্ষণ। সাথেও নেই পানির ক্যান্টিন। আরেকটা তরল আছে অবশ্য। চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা বের করে ওটার ভেতরে যতটুকু অ্যালকোহল ছিলো, পুরোটা ঢেলে দিলাম গলায়।
আরেকটু যাবার পরে বুঝলাম, টর্চ না জ্বেলে উপায় নেই। এভাবে চলা সম্ভব না আর। জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে আছি, বাইরে আলো যাবার সম্ভাবনা খুব কম। রাইফেলের স্ট্র্যাপটা কাঁধে আরেকটু জুত করে বসিয়ে নিয়ে পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বাললাম।
তিন পা যাবার পরে শুরু হলো ব্যাপারটা।
প্রথমে পাত্তা দিলাম না ওটাকে। তারপরে যখন বাড়লো, আরো বাড়লো, তখন স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, কানের কাছে ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছি একটা।
আর একটা মৃদু ভন ভন শব্দ। যেন মাছি উড়ছে কোনো পচা লাশকে ঘিরে।
এতক্ষণ ভ্যাপসা গরম টের পাচ্ছিলাম, আর এবার এক ঝলক কনকনে ঠান্ডা
হাওয়া বয়ে গেল আমার গায়ের ওপর দিয়ে। এর আগে দু-বার এমনটা হয়েছিল। দু- বারই ওই তথাকথিত পিশাচের কাছাকাছি গিয়েছিলাম আমি।
এবারও কি …..
পিশাচ বলতে কিছু নেই, জানি আমি। জীবনে কখনো কোনো অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত জিনিসে বিশ্বাস করিনি আমি, শিপলুর সাথে কয়েকটা প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন করার পরও। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সত্যি ভীষণ গোলমেলে।
ভীষণ গোলমেলে।
আমি সামনে এগিয়ে চলছি এক পা দু-পা করে। টর্চের আলোটা নড়ছে হাটার সাথে তাল মিলিয়ে। সেই সাথে বাড়ছে ফিসফিসানি। আর ঠান্ডা। আর ভনভন।
আমার মাথার মধ্যে দু-রকম চিন্তা চলছে। আমার মগজের একটা অংশ বলছে এই গ্রামে কোনো পিশাচ নেই। যে চারটা খুন হয়েছে সেগুলো মানুষেরই করা। দুটো ক্রাইম, আর দুটো এক্সিকিউশন। মগজের আরেকটা অংশ বলছে, তাহলে বিশাল যে জিনিসটার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি, সেটা কি? জঙ্গলের কিনারায় একবার। জঙ্গলের ভেতরে ভাঙা মন্দিরটায় একবার। আর সিদ্দিকের সাজানো লাশের কাছেও নিশ্চয়ই ঘুরতে এসেছিল ওটা, সেজন্যই….
কানের কাছে ফিসফিসানিটা বাড়তে বাড়তে একটা প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ গর্জনে পরিণত হয়েছে।
আমার মাথা ঘিরে ভনভন করছে যেন অনেকগুলো অদৃশ্য নীলমাছি।
সামনের দিক থেকে বরফ-ছোঁয়া দমকা হাওয়া আসছে থেকে থেকে।
আমার টর্চের আলোর সামনে হঠাৎ ভেসে উঠলো বিশাল কাঠামোটা। শ্যাওলা পড়া ইঁটের দেয়াল। ওপর থেকে নেমে এসেছে অশ্বত্থর শেকড়। বনের ভেতরে কয়েকশো বছর ধরে পড়ে থাকা অজানা মন্দিরটার সামনে হাজির হয়েছি আমি আবার। কানের কাছে ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো যেন পাগল হয়ে গেল সাথে সাথে। যেন কিছু বলতে চায় ওরা আমাকে, কিন্তু পারছে না, কারণ ওদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।
আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ওই তো মুখ ব্যদান করে থাকা অন্ধকার ফটকটা। ওটার থেকেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া আসছে হু-হু করে।
ওটাই ওই বিশাল জিনিসটার ডেরা।
আমি রাইফেলটা তুলে কাঁধে ঠেকালাম। ডানহাতে থাকলো রাইফেলটা, আর বামহাতে টর্চ। বামহাতের কব্জির ওপরে রাইফেলের ব্যারেল। ঠান্ডায় রীতিমত গা শিউরে উঠছে আমার। ফিসফিসানিটার মাঝে যেন কয়েকটা শব্দ আলাদা করে শুনতে পাচ্ছি-কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল।
আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। হয় এসপার, নয় ওসপার। ওই জিনিসটাকে এড়িয়ে যাবো না আমি। ফয়সালা হবে মুখোমুখি।
ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে।
ফিসফিসানির শব্দটা বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের গর্জনে পরিণত হয়েছে ততক্ষণে। আমার নাক-মুখ থেকে বেরোনো নিঃশ্বাস জমে ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।
আমি এগিয়ে চললাম।
প্রথমেই এসে পড়েছি সেই বড় ঘরটাতে। গোটা ঘরটাতে ঝোপজঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। কানার চোখের মত তাকিয়ে আছে দুটো ভাঙা জানালা। চারপাশে একবার মাত্র টর্চের আলো বুলিয়ে নিয়ে ঘরটার ওই মাথার দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি গতবারে ঢুকে মন্দিরটার যে লে-আউট দেখেছিলাম সেটা মনে পড়ছে স্পষ্টভাবে।
হু হু করে মাঘের শৈত্যপ্রবাহের মত ঠান্ডা হাওয়া আসছে কালো ফোকরের মত দরজাটা থেকে। ভক করে একটা পচা গন্ধ নাকে লাগতে নাক কুঁচকে ফেললাম আমি।
দরজাটা আমাকে নিয়ে এসেছে একটা করিডোরের মত জায়গায়। দু-পাশে কয়েকটা পরিত্যক্ত ঘরের মতো আছে। আমি টর্চটা রাইফেলের সাথে ঠেকিয়ে দ্রুত আলো ফেললাম একটার ভেতরে।
ফাঁকা।
এই মুহূর্তে পেছনের ঘরটার দরজা ঠিক আমার পিঠের কাছে। মনে পড়তেই শিরশিরিয়ে উঠলো ঘাড়ের কাছটা। গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাঁই করে ঘুরলাম আমি, আলো ফেললাম ঠিক পেছনের ঘরটায়। একটা কালো মূর্তি ধাঁ করে ভেসে উঠলো টর্চের হলদেটে আলোর সামনে। আমার বুকের ভেতরে হৃৎপিন্ডটা এত জোরে লাফিয়ে উঠলো যে রীতিমত ব্যথা লাগলো আমার।
রাইফেলের ট্রিগার টানতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। কালো মূর্তিটা আক্ষরিক অর্থেই একটা কালো মূর্তি ছাড়া আদপে কিছু নয়। শ্যাওলা পড়ে-টড়ে অবস্থা খারাপ, চেনার যোগ্য নয়।
টর্চের আলো আবার সামনে ঘুরিয়ে নিলাম আমি। বাকি ঘরদুটো চেক করতে গিয়ে থমকে গেলাম। আমার দুই কানে ফিসফিসানি আর ভনভনানির শব্দ বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের গর্জনের মত প্রবল আকার ধারণ করেছে-কিন্তু সেগুলো ছাপিয়েও একটা গরগর শব্দ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি আমি।
ওটা সামনে থেকে আসছে।
আমার মাংস ভেদ করে হাড়ে কামড় বসাচ্ছে কনকনে ঠান্ডাটা। মুখের সামনে জমে কুয়াশা হয়ে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। কানের পাশে ফিসফিস করতে থাকা কন্ঠগুলো যেন পাগল হয়ে গেছে। প্রতি পদক্ষেপে যেন স্পষ্ট হচ্ছে ওগুলো, ওরা কি বলতে চাচ্ছে সেটা যেন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি আমি।
আমি এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম সামনে।
হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, তবু সোজা করে ধরে আছি রাইফেলটা। টর্চটা ওটার সাথে ঠেকানো। টর্চটা যা দেখবে, রাইফেলের মুখ সেদিকেই ফেরানো থাকবে।
গরগর শব্দটা আরো জোরালো হচ্ছে।
আমি করিডোরের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছলাম।
বড় ঘরটার কোণায় দাঁড়িয়ে এখন আমি। আর কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দেবে প্রবল ফিসফিসানির শব্দ। সেই সাথে মাছি ওড়ার মত ভনভন। না, ভুল বললাম। ফিসফিস নয়। কারণ কণ্ঠগুলো কি বলতে চাইছে, সেটা বুঝতে পারছি আমি।
পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।
আমি টর্চের আলো সোজা ফেললাম ঘরটার মাঝখানে।
কন্ঠগুলো কয়েকটা শব্দই ঘুরেফিরে বলছে। টর্চের আলোয় চকচকিয়ে উঠলো ভাঁটার মতো দুটো চোখ। শ্বাপদের চোখ।
বিশাল জন্তুটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। লালচে খয়েরি রং ওটার, আকারে একটা পূর্ণবয়ষ্ক বাঘের মতো বড়। মুখের চামড়া সরানো ওটার, কালচে মাঢ়ি আর ঝকঝকে ধারালো দাঁত দেখা যাচ্ছে পরিস্কার। জিনিসটার সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকত্ব ওটার মাথাটা। একটা শেয়ালের শরীরের বেজির মাথা বসিয়ে দিলে যেমন দেখাবে, ঠিক তেমন দেখাচ্ছে ওটাকে। আর চোখ-ওহ, ওটার চোখ! না, ওগুলো কেমন অশুভ আর কুৎসিত, সেটার কোনো বর্ণনা দেবার চেষ্টা করবো না আমি, কারণ কোনো শব্দই ব্যাখা করতে পারবে না কেমন বিশ্রী আর অশুভ আর ঘৃণ্য ওগুলো।
আমি জানি ওটা আর এক সেকেন্ড পরেই আমার ওপরে লাফ দেবে। ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো কি বলছে সেটা পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি আমি। রাইফেলের স্কোপটা ফেললাম শ্বাপদটার দুই চোখের ঠিক মাঝখানে।
একটা কথাই বারবার বলছে কণ্ঠগুলো।
আসল নকল বিচার করো। আসল নকল বিচার করো।
আমি ট্রিগারের ওপর আঙুলের চাপ বাড়ালাম।
আসল নকল বিচার করো।
আসল নকল বিচার করো।
আসল নকল বিচার করো।
শ্বাপদটা নড়ে ওঠার আগেই ফায়ার করলাম আমি।
দোজখের মত জ্বলতে থাকা চোখগুলোর আভা নিভে গেল সাথে সাথেই।
বুলজ আই! ঠিক দুই চোখের মাঝখানে লেগেছে আমার গুলি।
বিশাল প্রাণীটা একটা শব্দ করারও সুযোগ পেল না। স্রেফ ঢলে পড়লো যেখানে ছিলো, সেখানেই।
আসল নকল বিচার করো।
আমি রাইফেলটা নামিয়ে নিলাম ক্লান্তভাবে
কি হলো? স্বরগুলো থামছে না কেন? আরো বরং জোরালো হচ্ছে কেন সেগুলো? ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে আসছে কেন আমার?
যা করার, তাই তো করেছি আমি! নিজের ভয়কে মোকাবেলা করেছি, শেষ করেছি শ্বাপদটাকে। ওই তো পড়ে আছে ওটার লাশ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওটার মাথা!
তবু চলে যাচ্ছে না কেন লক্ষণগুলো?
তাহলে কি সমস্যাটা ওই জানোয়ারটার সাথে নয়? সমস্যাটা কি আমার সাথে? আমার মাথা খারাপ হওয়াটা কি ষোলোকলা পূর্ণ করেছে? বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হচ্ছি কি আমি?
হ্যা, হয়তো তাই।
নইলে আমার পেছনে পায়ের শব্দ পাবো কেন আমি?
কেউ যেন হেটে আসছে আমার দিকে। ধীরে-সুস্থে। যেন কোনো তাড়া নেই ওর। পায়ের শব্দটা যেন একেবারে পেছনে এসে গেছে আমার। ধীরে ধীরে ঘুরলাম আমি। টর্চের আলো ফেললাম আগন্তুকের ওপরে।
“হ্যালো, জামশেদ।” বলে উঠলো আগন্তুক।
কেস স্টাডি : চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন’
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইসভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
আমার কিছু কেসের সন্ধান পাই পরিচিতজনের কাছ থেকে। সারাদেশ টো-টো করে ঘুরেছি কয়েক বছর ধরে, নানান জেলায় অনেকের সাথে সখ্যতা হয়েছে এভাবে। একদিন পত্রিকা অফিসে বসে কাজ করছি, এমনি সময় একটা ফোন এল। ফোনটা আমারই জন্য-এসেছে উত্তরবঙ্গের এক জেলা থেকে। নানান কাজে বহুবার ওদিকটায় যেতে হয়েছে আমাকে, একটা মেসে কিছুদিন থাকার সময় এক চাকুরিজীবি ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ফোনটা করেছেন তিনিই। অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছেন ভদ্রলোক-আর সেটা জানানোর জন্যই আমাকে ফোন করা। ফোনে বেশি কিছু বললেন না, কিন্তু যেটুকু বললেন সেটুকু শুনেই ঠিক করে ফেললাম, যাবো। এরকম একটা কেস সরেজমিনে না দেখলে একজন প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটরের ক্যারিয়ারই বৃথা।
ঢাকায় কয়েকদিনের কাজ গুছিয়ে রেখে দুই দিনের মধ্যেই রওনা দিলাম ভদ্রলোক যে জেলায় থাকেন, সেখানে। রাতের বাসে রওনা দিয়েছি, সারারাত জার্নি করে সকালে নামলাম বাস টার্মিনালে। নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। যে ভদ্রলোকের ডাকে এসেছি, তিনি আমাকে রিসিভ করার জন্য এই সাত সকালে এসে বসে আছেন বাস টার্মিনালে।
ভদ্রলোকের নাম জব্বার শিকদার। জব্বারসাহেব আমাকে দেখে বিশাল একটা হাসি দিয়ে হাত মেলানোর জন্য এগিয়ে এলেন, “আরে, শিপলুভাই যে! কতদিন পর দেখা। কষ্ট দিলাম ভাই. কষ্ট দিলাম। কিন্তু কি করবো বলেন-যে সমস্যায় পড়েছি!”
কুশল বিনিময়ের পরই ভদ্রলোক আমাকে তার বাসায় নিয়ে চললেন। একটা রিকশায় চড়ে বসলাম দু-জনে।
মফস্বল শহরের রাস্তায় রিকশা চলছে ঢিমেতালে। সকালের বাতাসে একটা তাজা তাজা গন্ধ। যেতে যেতে অনেক কথা শুনলাম। জব্বারসাহেব আমার চাইতে প্রায় দশ বছরের বড় হলেও মানুষ হিসেবে খুবই মিশুক। আর হাসিখুশি-সব সময় শিশুর মত পবিত্র একটা হাসি লেগেই আছে মুখে। এই কারণেই মেসে থাকতে খাতির ছিল তার সাথে। কয়েক মিনিট কথা বলেই সেই পুরনো জব্বারসাহেবকে খুঁজে পেলাম।
জানালেন, আগের চাকরিটা ছেড়েছেন, এখন বেশ ভালো বেতনের একটা চাকরি পেয়েছেন একটা সওদাগরি কোম্পানিতে। শহরে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছেন প্রায় তিন সপ্তাহ হলো।
“পরিবার এনেছেন?” জানতাম, জব্বারসাহেবের স্ত্রী আর একটা ছোট ছেলে গ্রামের বাসায় থাকে।
“এরই মাঝে আনার ইচ্ছে ছিল, ভাই। চলে আসার জন্য চিঠি প্ৰায় দিয়ে দিয়েছি, এমন সময়ই তো সমস্যা শুরু হলো।” টাক পড়তে থাকা মাথাটা অনিশ্চিতভাবে চুলকাতে চুলকাতে বললেন ছাপোষা মানুষটা। বিড়বিড় করে একবার বললেন, “আমার বাসার ঠিকানা চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন। চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন।”
সমস্যাটা কি, সেটা টেলিফোনে খানিকটা বলেছিলেন জব্বারসাহেব। আমি আর ঘাঁটালাম না। ভাড়াবাসায় গিয়েই সেটা দেখা যাবে। বাকি রাস্তাটা আর তেমন কথা বললাম না তার সাথে ইচ্ছা করেই। জব্বারসাহেব মাথা নিচু করে গম্ভির হয়ে রইলেন, আর আমি একটা মার্লবোরো ধরিয়ে টানতে লাগলাম।
খানিকবাদে মেইন রোড ছেড়ে খড়খড়িয়ে একটা ভাঙাচোরা সরু পাকা রাস্তায় ঢুকে পড়লো রিকশাটা। শহরের আবাসিক এলাকা এটা, দেখলেই বোঝা যায়। নামেও পরিচয়-কেরানিপাড়া, আদর্শপাড়া, মুন্সিপাড়া। মফস্বলের এইসব এলাকায় একটা আলাদা ফ্লেভার থাকে। ছোট ছোট একতলা-দোতলা বাসা, সুন্দর করে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, পাঁচিলের ওপরে কাঁচের ভাঙা টুকরো বসানো। তার ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে গাছের সবুজ পাতা। এক ভদ্রলোক নিজের বাসার গেটে দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে দাঁত ব্রাশ করছেন লুঙ্গি পরে। রাস্তার ওপরে সোনালি রোদ পড়েছে বাঁকা হয়ে।
আরো কয়েকটা লেন তস্য লেন পেরিয়ে একটা সরু গলিতে ঢুকলাম। গলির দু- পাশে দোকানপাটের সারি। মুদি দোকান, স্টেশনারি দোকান, পান-সিগারেটের দোকান, লন্ড্রি, একটা রেস্টুরেন্ট যার সাইনবোর্ডে সমান আকারের একটা খাসি আর একটা মুরগী আঁকা। খাসিটার অসমান চার পায়ের নিচে ‘বনবিহারীলাল লেন’ লেখা দেখে বুঝলাম প্রায় এসে গেছি।
জব্বারসাহেব অবশ্য এই রেস্টুরেন্টটার সামনেই রিকশা থামালেন। বললেন, “বাসায় আমি একাই থাকি ভাই, খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নাই। এই রেস্টুরেন্টেই খাই। আপনাকেও এখানেই খাওয়াচ্ছি, কিছু মনে করবেন না। আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেন, তারপর একবারে ঢুকবো চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনে।”
হাতমুখ ধুয়ে পরাটা আর মুরগির গিলা কলিজি খেতে বসলাম দু-জনে। একটা কথা এর মাঝে না বলে পারলাম না জব্বারসাহেবকে যদিও তিনি কি জবাব দেবেন সেটা জানাই ছিলো। “বাসাটা ছাড়লেই পারেন।”
“সে সামর্থ্য থাকলে কি আর আপনাকে ডেকে আনি, ভাই!” একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জব্বারসাহেব। “বাড়িটার ভাড়া একই মানের অন্য সব বাড়ির চাইতে অর্ধেকেরও কম। এত কম ভাড়ায় এত ভালো বাড়ি তো আজকের বাজারে পাওয়া মহা ভাগ্যের ব্যাপার। কিভাবে ছাড়ি বলেন? সেইজন্যে আগে আপনাকে ডাকলাম ভাই। আপনার কথাই আগে মনে পড়লো। আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেই আগে। আমারও উপকার হবে, আপনারও একটা ইনভেস্টিগেশন হবে। সমস্যা নাই, চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমি ফি দেবো। তবে আপনি যদি বলেন যে ছাড়তে হবে তাহলে কি আর করা…”
মনে মনে বললাম, কবে বুঝবেন, কম বাসার ‘ভালো’ বাড়িতে সব সময় একটা না একটা ঘাপলা থাকে? আমি হাসলাম। “ফি-টি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না রে ভাই। আমি এইসব নিজের শখেই করি। আর পত্রিকা অফিস থেকে যতটুকু পাই সেটা যথেষ্টরও অনেক বেশি। যাতায়াতের খরচও পাই। সে যাকগে, খাওয়া তো শেষ, চলেন ওঠা যাক।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। দেড় মিনিটের মাঝে হাজির হলাম চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের সামনে।
আশপাশের আর দশটা বাড়ির সাথে এটার তেমন পার্থক্য নেই। বাড়িটা বছর পনেরর পুরনো। বাইরের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। বাড়ির বারান্দার সামনে লোক দেখানো এক টুকরো বাগানের মতো আছে, সেটার অবস্থা অবশ্য আগাছা-টাগাছা গজিয়ে নাজেহাল। ছায়া-ছায়া ঠান্ডা বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালাম জব্বারসাহেবের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের লোমগুলো সরসরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আমার। সন্দেহ নেই, বৃথা আসিনি এখানে। এই বাসায় অদ্ভুতুড়ে কোনোকিছু আছে। এই পৃথিবীর বাইরের কোনোকিছু।
কোনো কথা বলছেন না জব্বারসাহেব-একদম চুপচাপ। বারান্দার দরজাটা খুলে বসার ঘরে ঢুকলেন আমাকে নিয়ে। লাইট জ্বাললেন।
প্রথমেই বসার ঘরটা। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এক সেট সস্তা বেতের সোফা আর একটা ঢাকনিবিহীন টেবিল ছাড়া কিছু নেই গোটা ঘরটাতে।
আমি এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলাম ঘরের ঠিক মাঝখানে। ধীরে ধীরে দম নিলাম একটা। তারপর আস্তে আস্তে একটা আঙুল তুললাম সোফাটার দিকে। “এটাও?”
“দেখতে হবে,” বিড়বিড়িয়ে বললেন জব্বারসাহেব। সোফার একটা হাতলের কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলেন মাথা নামিয়ে। “না, এখনো হয়নি এটা। নাম সাইন করে রেখেছিলাম সাইনপেন দিয়ে-সেটা এখনো আছে।”
জব্বারসাহেব আমাকে নিয়ে মেইন বেডরুমে ঢুকলেন। আঙুল দিয়ে দেখালেন খাটটা। “এইটা।” একটা চেয়ার ছিলো ঘরে। সেটা দেখালেন। “এটাও।” তারপর আঙুল তুলে দেখালেন একটা চেয়ার। বেডসাইড টেবিল। টেবিলের ওপরে একটা ছবির ফ্রেম। একটা ফুলদানি। টেবিল ক্লক। তার ওপরে কয়েকটা বই। বলতে গেলে মেইন বেডরুমের সবকিছুই।
“রান্নাঘরে কিছু হাঁড়িপাতিলসহ আরো আনুষঙ্গিক জিনিস কিনে রেখেছিলাম, আপনার ভাবি কয়েকদিন পরে আসবে সেটা ভেবে। সেগুলোও সব…” থমথমে গলায় বললেন জব্বারসাহেব।
বসার ঘরে এসে বসলাম। জব্বারসাহেব চা করে আনলেন রান্নাঘর থেকে। হীটারে এই একটা জিনিসই রান্না করতে শিখেছেন তিনি। চা’টা অবশ্য বেশ ভালো হয়েছে।
“প্রথম কবে বুঝতে পারেন?” চা’য়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম।
“বাসায় ওঠার হপ্তাখানেক পরে,” থুতনি ডলতে ডলতে বললেন জব্বারসাহেব। “একদিন অফিস থেকে বাসায় আসলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে একটা প্রিয় বই টেনে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই খাট থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো। ভাই, বইটা জীবনানন্দের একটা কবিতার বই-আমার এক বন্ধু আমাকে গিফট করেছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় কয়েকটা সৌজন্যমূলক কথা লেখা ছিল-’জব্বারের শুভ জন্মদিনে শফিক’ টাইপের-কিন্তু আমি যে বইটা হাতে ধরে আছি সেটায় কিচ্ছু নেই। প্রথম পাতাটা সাদা।
“বিছানায় খাড়া হয়ে বসে গোটা বইটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। বইটায় আমার কিছু প্রিয় কবিতা ছিল, সেগুলোর কোনো কোনো লাইন আন্ডারলাইন করে রেখেছিলাম। সেসব দাগ বেমালুম গায়েব!
“অর্থ্যাৎ আমার হাতে এখন যে বইটা আছে সেটা আমার বেডসাইড টেবিলের ওপরে সচরাচর যে বইটা থাকতো তার একটা কপি।
“প্রথমেই মনে হলো, এই বইটা কেউ হয়তো মজা করার জন্য এখানে রেখে গেছে আগের বইটা সরিয়ে রেখে। তারপরই বুঝতে পারলাম চিন্তাটা কেমন অবান্তর। বাসায় ফিরে দেখেছি তালা-টালা সবকিছু ঠিকই ছিলো। কে এত ঝামেলা করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে বই রেখে আবার তালা লাগিয়ে রেখে যাবে? প্রশ্নই আসে না। কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পেলাম না আমার এই বইটার কপি কিভাবে চেঞ্জ হয়ে গেল।
“পরের দিন অফিস থেকে এসে আরেকটা বই নিয়ে খুললাম। এই বইটার প্রথম পাতায় আমার নাম লেখা ছিল। হ্যা, এটাতে সেই লেখা আছে ঠিকই কিন্তু বানানটা ভুল! আর বইয়ের ভেতরে যেসব জায়গায় দাগ-টাগ দেয়া ছিলো সেগুলোও সব ভুল জায়গায়।
“আবার কিভাবে যেন আমার একটা বই কপি হয়ে গেছে!
“এরপর টের পেলাম টেবিলক্লকটাও কপি হয়ে গেছে। ক্লকটা পড়ে গিয়ে এক কোণায় দাগ পড়ে গিয়েছিল। সে-দাগ এটায় নেই।
“আর সন্দেহ থাকলো না। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম: আমার অনুপস্থিতিতে আমার জিনিসপত্র সব কিভাবে যেন কপি হয়ে যাচ্ছে। সবগুলোর আসলটা বদলে গিয়ে একটা নকল পড়ে থাকছে ঠিক সেই জায়গায়। তবে সেসব নকল আবার ঠিক- ঠিক নকল না। কিছু না কিছু ভুল আছে সেগুলোতে। কেমন যেন একটা অশুভ ব্যাপারও জড়িয়ে আছে সেগুলোর সাথে।
“নানান জিনিসের ওপর নাম লিখে রেখে পরীক্ষা করে দেখলাম। সবকিছুই কপি হয়ে যাচ্ছে স্রেফ সময়ের ব্যাপার। একদিন বা দুইদিন পরে। কোনো কোনোটা দু’বার তিনবার কপি হয়ে যাচ্ছে। যেমন টেবিল ক্লকটা চারবার কপি হবার পর শেষ যে কপিটা হয়েছে, সেটা অনেকটাই আলাদা আসলটার চাইতে।”
অনেকক্ষণ কথা বলার পর থামলেন জব্বারসাহেব। আমার চা ততক্ষণে শেষ, সিগারেট ধরিয়েছি। অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন জব্বারসাহেব।
“দেখুন ভাই, গোটা ব্যাপারটাতে আমার কোনো সরাসরি সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু…” কথাটা শেষ করলেন না তিনি।
আমি কিছু বললাম না। হ্যা, কোনো সমস্যা হচ্ছে না বটে, কিন্তু আপনি একটা বাসায় একা থাকেন, অফিস সেরে এসে দেখলেন বাসার সবকিছু নকল হয়ে অন্য কিছু একটা হয়ে বসে আছে-চিন্তাটাই মেরুদন্ড দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি বইয়ে দেয়। তারপর একটা জিনিস খেয়াল করলাম,” বলতে বলতে সোফা থেকে উঠলেন জব্বারসাহেব। ছোট যে আরেকটা বেডরুম আছে বাসাটায়, গেস্ট বেডরুম, সেটায় নিয়ে চললেন আমাকে।
“রুমটায় স্রেফ একটা খাট, আর একটা বহু পুরনো পোকায় কাটা ঝুলপড়া কাঠের আলমারি। কালো রঙের। জব্বারসাহেব নিজে আলমারিটার কাছে গেলেন না। আঙুল তুলে আলমারিটা দেখালেন তিনি। কাঁপা গলায় বললেন, “খুলে দেখুন।”
আমি এক পা এগিয়ে গিয়ে একটা পাল্লায় হাত রাখলাম। দম নিলাম একবার আস্তে করে, তারপর ধীরে ধীরে টান দিলাম পাল্লাটাতে। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে খুলে গেল পাল্লাটা।
ওপরের তাকগুলো সব খালি। সবচেয়ে নিচের তাকটাতে কেবল পড়ে আছে কয়েকটা দোমড়ানো মোচড়ানো বইয়ের পাতা, কয়েক টুকরো ভাঙা কাঁচ, একটা কাগজের ফুল, একটা বয়ামের ঢাকনিসহ আরো কিছু ফেলনা জিনিস। জব্বারসাহেবকে কিছু বলতে হলো না। বুঝে গেলাম নিজে থেকেই।
যেসব জিনিস কপি হয়েছে তার টুকরো টাকরা পড়ে আছে এখানে।
“এই আলমারিটা বাড়ি ভাড়া নেবার পর থেকেই আছে,” বিড়বিড়িয়ে বললেন জব্বারসাহেব। “গোটা বাড়ি ফাঁকা ছিলো, কেবল এই ঘরে এই আলমারিটা ছাড়া। জিনিসপত্র সব কপি হতে শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরে একদিন খুটখাট শব্দ হতে শুনলাম এই ঘরে অনেক রাতে। এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখি কেউ নেই। পাল্লা খুলে দেখি এই অবস্থা। এখন পর্যন্ত যা কিছু কপি হয়েছে তার সবকিছুর একটা না একটা টুকরো টাকরা এখানে এসে জমেছে কিভাবে যেন। আমার পরিবার কয়েকেদিন পরে এখানে থাকতে আসবে ভাই, আর এই বাসায়…” ধরা গলায় চুপ করে গেলেন জব্বারসাহেব।
“এইসব কি হচ্ছে ভাই এখানে?” একটু সামলে নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন তিনি।
আমি কিছু বললাম না। জানলে তো জবাব দেব।
পাল্লাটা বন্ধ করার আগে একটা জিনিস চোখে পড়লো আমার। একটা ইঁদুরের লেজ পড়ে আছে। কাটা ইঁদুরের লেজ। জানি না বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো কেন।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।
চোখ মেলার সাথে সাথে সজাগ হয়ে উঠলাম একদম। বহুদিনের অভ্যাসের ফল। উঠে পড়লাম না অবশ্য তখনই।
সারা ঘরে অন্ধকার। চোখে দেখছি না কিছুই। কান খাড়া করলাম। সন্দেহ নেই কোনো শব্দের কারণেই ঘুমটা ভেঙেছে।
সারাটা দিন চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনেই কাটিয়েছি। গোটা ব্যাপারটা সময় নিয়ে তলিয়ে না দেখলে চলবে না। আজ শুক্রবার, জব্বারসাহেবের অফিস ছিলো না। বিকেলে একবার বাইরে গিয়ে থেকেছি দু-জনে ঘন্টাদুয়েক, সময় দিয়েছি চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনকে। ফিরে আসার পর আবিষ্কার করলাম জব্বারসাহেবের আস্ত সোফা সেটটা নকল হয়ে গেছে।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পরে শুয়েছিলাম গেস্টবেডরুমে, আর এখন ঘুম ভেঙে দেখি এই অবস্থা।
চুপচাপ মিনিট দুয়েক শুয়ে থাকার পরও আর কোনো শব্দ পেলাম না। চট করে সোজা হলাম বিছানার ওপরে। নেমে পড়লাম তারপরে। পুরোদস্তুর জামাকাপড় আমার পরনে। অচেনা জায়গায় ঘুমাই এভাবেই।
ঘরের লাইটের সুইচটা কোথায়, শোবার আগে সেটা ভালোভাবে দেখে রেখেছিলাম। হাত চলে গেল সেদিকেই। লাইট জ্বললো না। হয় কারেন্ট নেই, নয়তো অন্যকিছু। পকেটে টর্চ আছেই। বের করে জ্বাললাম। ব্যাটারি বোধহয় কমে গেছে-হলদে আলো ছড়িয়ে পিটপিটিয়ে উঠলো ওটা।
প্রথমেই আলো ফেললাম পুরনো ঝুরঝুরে কালো কাঠের আলমারিটায়। নট- নড়নচড়ন অবস্থায় পড়ে আছে ওটা। খানিকক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে পা টিপে টিপে পাশের রুমের দিকে চললাম।
জব্বারসাহেব শুয়েছেন মেইন বেডরুমে। ওটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করলাম এক মুহূর্ত। নিজেকে বোঝালাম এই বাড়িতে সাধারণ ম্যানারের স্থান নেই। জব্বারসাহেবের কোনো বিপদ হতেও পারে। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেললাম দরজাটা। আলো ফেললাম জব্বারসাহেবের বিছানার ওপর।
কেউ নেই ওখানটায়। বিছানা ফাঁকা।
বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম বাড়ি পড়ছে আমার। রেডিয়ামওয়ালা ঘড়িতে সময় দেখলাম—রাত প্রায় দুটো। এমন সময় কোথায় গেছেন ভদ্রলোক?
ঘুরেই চমকে উঠলাম ভীষণভাবে।
জব্বারসাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সামনে। পরনে লুঙ্গি গেঞ্জি। ঘুমঘুম চোখ। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
“কি ব্যাপার ভাই? এত রাতে?” চোখ ডলে প্রশ্ন করলেন আমাকে।
“কোথায় গেছিলেন?” পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি জবাব না দিয়ে।
“এই তো, বাথরুমে,” বললেন জব্বারসাহেব। আমার চোখের দিকে তাকালেন সরাসরি। “কি ব্যাপার ভাই?” কোনো সমস্যা?”
“না, কিছু না,” বললাম আমি। “কী যেন একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।”
“ও তেমন কিছু না,” বাতাসে হাত নাড়লেন জব্বারসাহেব। “পুরনো বাড়িতে নানা রকম শব্দ হয়েই থাকে। আমি তো রোজ রাতেই শুনি।”
পুরনো বাড়িতে হওয়া যে সব শব্দ শুনে মানুষ “কিছু না’ বলে উড়িয়ে দেয়, সেসব আসলে কিসে করে, সেটা বলে পিলে চমকে দিতে পারতাম জব্বারসাহেবকে। কিন্তু কিছু বললাম না। তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে।
“যান, শুয়ে পড়ুন,” ক্লান্ত গলায় বললেন জব্বারসাহেব। “কালকে কথা হবে। যে হুজুরের কথা বিকেলে বলেছিলেন, তাকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করাবো দরকার হলে।”
আমি তখনো তাকিয়ে আছি তার দিকে। “শব্দটা আমার ঘরেই হচ্ছিলো, এমনটাও হতে পারে।”
জব্বারসাহেবের মুখে স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ। “বললাম তো, হয়তো তেমন কিছুই না। হয়তো ইঁদুরের শব্দ। গোটা বাসা ইঁদুর দিয়ে বোঝাই।”
আমি শান্ত স্বরে বললাম, “চলুন না, একটু দেখে আসি। হতে পারে শব্দটা ওই আলমারি থেকে আসছে।”
“কি জানি ভাই,” বিরক্ত গলায় বললেন জব্বারসাহেব। “না-ও হতে পারে। আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনার দেখার এত শখ যখন, চলেন দেখা যাক।”
এক টুকরো বাঁকাহাসি কি ফুটে উঠেছে জব্বারসাহেবের ঠোঁটের কোণায়? না আমিই ভুল দেখেছি?
আমি আস্তে আস্তে ঘুরলাম। এগোলাম গেস্ট বেডরুমের দিকে। আমার পেছনে জব্বারসাহেব। ঘাড়ের ছোট ছোট চুলগুলো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কেন যেন আমার
গেস্ট বেডরুমের ঘুটঘুটে আঁধারে কোনোমতে দৃষ্টি চলছে আমার টর্চের মিটমিটে হলদে আলোয়। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কাঠের কালো আলমারিটার দিকে।
পাল্লাটায় হাত রাখার আগে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিলাম-আমার ফুট দুয়েক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন জব্বারসাহেব। চোখদুটো চকচক করছে আঁধারে।
পাল্লাটায় হাত দিলাম আমি। টান দিয়ে খুললাম।
ওপরের তাকগুলো খালি। নিচের তাকে একগাদা দোমড়ানো বইয়ের পাতা, ভাঙা কাঁচের টুকরো, একটা কলমের ক্যাপ, এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়, কয়েকটা দেশলাইয়ের কাঠি সহ আরো নানারকম টুকিটাকি জিনিস-আর একটা মানুষের কাটা মাথা।
জব্বারসাহেবের মাথা।
গলার কাছটা যেন অতি সূক্ষ্মভাবে কেটে নেয়া হয়েছে ঘাড় থেকে, তারপর বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কপি হওয়া অন্য সব জিনিসের টুকরোর মতই, জব্বারসাহেবের টুকরো।
কাটা মাথাটার চেহারায় তীব্র আতঙ্কের ছাপ।
ওটা যদি জব্বার সাহেবের মাথা হয়, তাহলে আমার পেছনে এটা কে?
আমার ঘাড়ের পেছনে রক্ত পানি করা গলায় গর্জে উঠলো জব্বার সাহেবের নকল। ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নকলটা। বরফের মত ঠান্ডা আঙুল দিয়ে খামচে ধরলো আমাকে।
মরিয়া হয়ে পেছন দিকে ঘুরিয়ে মারলাম হাতের টর্চটা। ভাগ্য ভালো, খটাস করে লাগলো সেটা নকল জব্বারের কপালে। টর্চের বাল্ব ভেঙে গেছে-ঘুটঘুটে আঁধার নেমে এলো সাথে সাথে কিন্তু টের পেলাম, মাটিতে উল্টে পড়েছে নকল জব্বার।
পাঁই করে ঘুরেই ছুটলাম দরজা আন্দাজ করে।
অন্ধকারে পুরোপুরি ঠিক ছিলো না আন্দাজটা। ডান কাঁধটা ভয়ানকভাবে ঠুকে গেল দরজার চৌকাঠের সাথে। বলতে গেলে ছিটকে পড়লাম করিডোরের ওপর।
সামনে আরেকটা দরজার আবছা অবয়ব। কোনোমতে ছুটে সেটা পেরিয়ে বসার ঘরে হাজির হলাম, হাঁপাচ্ছি। পেছনে একটা গর্জনের শব্দ শুনলাম, নকল জব্বার উঠে দাঁড়াচ্ছে সম্ভবত।
অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে এগোলাম আমি, হাত পড়লো দরজার ওপরে। এই দরজা দিয়ে বেরোতে পারলেই চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন থেকে মুক্তি।
থপথপ করে শব্দ পাচ্ছি পেছনে। নকল জব্বার এগিয়ে আসছে।
ছিটকানিটা খুঁজে পেলাম ভাগ্যের জোরে, খুলেও ফেললাম চট করে। গায়ের জোরে দরজাটায় ধাক্কা দিলাম তারপর।
খুললো না দরজাটা। পাথরের তৈরি যেন, নড়ার কোনো লক্ষণ নেই।
নকল জব্বারের পায়ের শব্দ অনেকটা কাছিয়ে এসেছে।
ধাক্কা দিয়ে লাভ নেই, জানা আছে।
“যেতে দাও আমাকে,” চেঁচিয়ে উঠলাম, “আমি আর কখনো আসবো না। কথা দিচ্ছি!”
দরজা খুললো না।
নকল জব্বার একেবারে পেছনে চলে এসেছে আমার।
ঘোরারও সময় পেলাম না। আমার গলার ওপর এসে পড়লো বরফের মত ঠান্ডা দুটো হাত, চেপে ধরলো সাঁড়াশির মতো।
দম আটকে আসছে আমার। শক্তি শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। জানি, আর কিছুক্ষণ এভাবে কাটলেই মারা পড়বো।
নকল জব্বার পাগলের মত হেসে চলেছে।
চেঁচানো সম্ভব নয় আর। মনে মনে প্রাণপণে বলে উঠলাম, আমাকে যেতে দাও। আমি কখনো কাউকে বলবো না তোমার ব্যাপারে…আর তুমি তো জানোই, আমি কার উপাসনা করি!
জাদুর মতো কাজ হলো। টের পেলাম, কে যেন আমার শরীরটা প্রচন্ড শক্তিতে ছুঁড়ে দিলো। এক সেকেন্ড পরই নিজেকে আবিষ্কার করলাম জনশূণ্য বনবিহারীলাল লেনে, চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের বাইরে। পড়ে আছি মাটিতে।
উঠে দাঁড়ালাম। মানুষ দূরে থাক, চারপাশে একটা কাকপক্ষীও নেই এই নিশুতি রাতে। সব দোকানপাট বন্ধ।
সোজা সামনে হাঁটছি, একবারও তাকালাম না চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের বাড়িটার দিকে।
কিন্তু পরিষ্কার টের পেলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন।