অধ্যায় ১৪ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
শিপলু!
শিপলু এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে!
হতবাক আমি রাইফেল নামিয়ে নিলাম। “শিপলু! তুই এখানে!”
শিপলু দাঁত বের করে হাসছে আমাকে দেখে। আমার প্রশ্নে জবাবে কিছু বললো না অবশ্য। কপালে ঘাম ওর, ঘামছে ও দরদরিয়ে। ওর প্যান্টের হাটুতে মাটির ছাপ।
“কি করছিলি তুই এখানে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি
“এই তো, একটু ইনভেস্টিগেশন,” ইতস্তত করে জবাব দিলো শিপলু। পকেটে হাত দিলো ও, বের করে আনলো একটা মার্লবোরো সিগারেটের প্যাকেট। আরেক পকেট থেকে লাইটার বের করে ধরালো ব্যস্ত হাতে।
কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। হাঁ করে তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। “এই রোদের মধ্যে কিসের ইনভেস্টিগেশন?”
“ওমা, রোদের মধ্যে করবো না তো রাতের বেলা করবো নাকি?” হাসার চেষ্টা করলো শিপলু, কিন্তু হাসিতে প্রাণ নেই। চোখের কোণা দিয়ে বামদিকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে ও।
আর ঘামছে। শিপলুকে এতটা ঘামতে দেখিনি আর কখনো।
শিপলু সিগারেট ধরা হাতটা মুখের কাছে তোলার সময় খেয়াল করলাম, ওর হাত কাঁপছে।
কোনোকিছুতে বিশাল একটা গড়বড় আছে। বিশাল একটা গড়বড় আছে কোনোকিছুতে।
আমি রাইফেলটা শক্ত হাতে চেপে ধরলাম। “শিপলু! কি হচ্ছে এখানে?”
ফ্যাকাশে একটা হাসি হাসলো শিপলু। সিগারেট ধরা হাতটা এতো কাঁপছে যে ছাই ঝরে পড়ছে ওটা থেকে। “কি হচ্ছে আবার?” ধরা গলায় বললো ও।
“সামাদ কই? আমাদের গাড়িটার ওই অবস্থা কেন?” চাবুকের মত শপাং করে প্রশ্ন করলাম আমি।
শিপলুর দিকে সোজা তাকিয়ে আছি আমি। ঠোঁট কাঁপছে ওর, চোখের মেকি স্বাভাবিকত্বটা সরে গিয়ে বেরিয়ে আসছে তীব্র আতঙ্কের ছাপ, মুখ হাঁ হয়ে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে ওর।
আমার বামে একটা খচমচ শব্দ হলো। আমি সেদিকে তাকানোর আগেই ওদিকে ঝট করে মুখ ফিরিয়েছে শিপলু, তার পরেই আমার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও। আমি আর শিপলু একসাথে মাটিতে পড়ার আগেই চারপাশের থমথমে নিস্তব্ধতা খানখান করে গর্জে উঠলো একটা পিস্তল।
কয়েকটা মুহূর্ত আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে রইলো। কোত্থেকে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না।
শুকনো ভুট্টার পাতায় ছাওয়া মাটিতে পড়ে আছি, গায়ের ওপরে শিপলু।
কে গুলি করলো? আমার কি গুলি লেগেছে? বা শিপলুর?
আমার মুখ সোজা আকাশের দিকে ফেরানো-শরতের উজ্জ্বল আকাশের তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। হাত থেকে কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে রাইফেলটা। কতক্ষণ পড়ে ছিলাম জানি না, কেবল টের পেলাম শিপলু উঠছে আমার গায়ের ওপর থেকে, কাউকে বলছে, “প্লিজ, মারবেন না আমাদেরকে। প্লিজ। আমরা কাউকে কিছু বলবো না। বিশ্বাস করুন।”
জবাবে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো কেউ। টিটকিরির হাসি। এই হাসি আমি চিনি।
ধীরে ধীরে মাথাটা ঘোরালাম আমি শিপলু যার সাথে কথা বলছে তার দিকে। আমার ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখে প্রথমে দেখতে পেলাম না কিছু। তারপর চোখটা ভুট্টাখেতের ভেতরের ছায়া-ছায়া আঁধারের সাথে মানিয়ে নেবার পরে ধীরে ধীরে লোকটার অবয়ব ফুটে উঠলো চোখের সামনে।
মফিজ দারোগা!
হাতের পুলিশ রিভলভারটা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মফিজ দারোগা। ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। একবার চোখ নামিয়ে দেখলো আমার দিকে. তারপর আবার তাকালো শিপলুর দিকে।
“প্লিজ,” অনুনয়ের সুরে বললো শিপলু। দু-হাত জোড় করে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগার দিকে। “আমরা ভালোয় ভালোয় চলে যাবো এখান থেকে। কেউ কোনোদিন জানবে না এই গ্রামে কি হয়েছিল।”
“সেটা পরে দেখা যাবে,” মফিজ দারোগা মুখে একটা একপেশে হাসি হেসে বললো। গ্রাম্য পুলিশের ভাবটা চলে গেছে তার হাবভাব থেকে, চোখা একটা ডাঁট চলে এসেছে সেখানে কোথা থেকে। “আগে তোর ডোপ পাপি বন্ধুকে দাঁড়া করা। শিকারি, হাহ! খুন করে খুব তো পালিয়ে এসেছিস ঢাকা থেকে!”
সত্যি বলছি, মফিজ দারোগার প্রথম বাক্যটা শুনে লাফিয়ে তার গায়ের ওপরে পড়ে তার জিহ্বাটা টেনে ছিঁড়ে নেবার প্রস্তুতি নিয়েই নিয়েছিলাম প্রায় আমি তার হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও। ক্লাস এইটে পড়ার সময় এক এম.পি’র ব্যাটা আমাকে ‘জ্যাম শেড’ বলার পরে এক লাথিতে তাকে স্কুলের দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমি এই চিজ। কিন্তু মফিজ দারোগার পরের কথাটা জমিয়ে দিয়েছে আমাকে। নড়তে-চড়তেও ভুলে গেছি।
সেদিন রাতে গোলাগুলির পর সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন আছি বলতে গেলে। খবরের কাগজ বা টিভির নিউজ তো দূরে থাক, একটা টেলিফোনের আওতারও বাইরে এখন আমি। কাজেই সেদিনের শুটআউটের ফল কি, সেটা জানা ছিলো না। এখন জানলাম-আর সেটাও এমন ভয়ানক একটা মুহূর্তে!
“অত অবাক হবার কিছু নেই। ইটস অল ওভার দ্য নিউজ,” ঝাঁঝের সুরে বললো মফিজ দারোগা। “এখন উঠে দাঁড়া। উঠে দাঁড়া বলছি!”
আমি ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখে ঝাপসা দেখছি।
“তোদের বুদ্ধিকে খাটো করে দেখা উচিত হয়নি আমার,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো মফিজ দারোগা শিপলুকে। “ভেবেছিলাম, ঢাকায় থাকিস, তোদের শহুরে বালছাল নিয়েই ব্যস্ত থাকিস-এদিকে ঘিলু বলতে কিছু নাই মাথায়। নাহ, তোদেরকে অতটা বোকা ভাবাটা উচিত হয়নি।” আমার দিকে তাকালো সে নাকের ওপর দিয়ে। “জামশেদের মোটা খুলিতে অবশ্য অত প্যাঁচঘোচ ঢোকেনি।”
খুব কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম আমি। “তুই যা বোঝাতে চাচ্ছিস সেটা কালকেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। কেবল প্রমাণের অভাবে শিওর হতে পারছিলাম না।”
“তাই নাকি?” টিটকিরির হাসি হাসলো মফিজ দারোগা। “কি বোঝাতে চাচ্ছি আমি, ডোপ পাপি জামশেদ?”
“দ্যাট উইল বি গোল্ড মেডেল উইনার জামশেদ,” শীতল গলায় বললাম আমি। মাথা ঘুরছে আমার, তবু নিজের ঝাঁঝটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি, সেটা যতটা না মফিজ দারোগাকে ইনটিমিডেট করতে, তারচে’ বেশি নিজেকে সাহস দিতে।
“কি বোঝাতে চাইছি আমি?” আরো নিচু গলায় বললো মফিজ দারোগা। লোকটার বেসাইজ কালো মুখে একপেশে হাসি লেগে আছে একটা। তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকেই। ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে নামছে তার কপাল বেয়ে।
কখনো-না-কাটা শুকনো ভুট্টা খেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন। মাথার ওপরে তীব্র রোদ। মাথার ঘিলু ফোটানোর মত তীব্র। অসম্ভব নিশ্চুপ চারদিকটা। হঠাৎ একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করলো কোথা থেকে।
“কোনো পিশাচ মারেনি ওই চারজনকে,” বিড়বিড় করে বললাম আমি। “মফিজ দারোগা, তুই মেরেছিস ওদেরকে!”
আমার পাশে দাঁড়ানো শিপলু একবার আমার মুখের দিকে আর আরেকবার মফিজ দারোগার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ও ব্যাপারটা আগে বুঝতে না পারলেও আমাদের বাংলোর ওপর মফিজ দারোগা অ্যাটাক করার পরে গোটা ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে ওর কাছে।
আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলো মফিজ দারোগা, তারপর ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো। হাসি না বলে অট্টহাসি বলা ভালো ওটাকে—ভুঁড়ি দোলানো বিচ্ছিরি অট্টহাসি।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। “কেন ভাবলি এমনটা?”
“ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট ইয়োর মোটিভস,” অস্থিরভাবে বললাম আমি। “তুই-ই যে খুনগুলো করেছিস, ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল আমার অবচেতন মনে।” কথাটা শেষ করেই জিজ্ঞেস করলাম, “সামাদ কোথায়? কি করেছিস ওকে?”
আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি মফিজ দারোগার। “মোট মানুষ মারা গেছে চারজন।” ধীরে ধীরে, শান্তভাবে বললো সে। “প্রথমে গরীব ঘরের মেয়ে অমিছা। বয়স ষোল। পাতা কুড়িয়ে পেট চালাতো। জঙ্গলের কিনারা থেকে খড়ি কুড়িয়ে মানুষের কাছে সেটা বিক্রি করতো। কি মনে হয়, এ-রকম গরীব ঘরের একটা অসহায় মেয়েকে খুন করবো আমি? তোর শহুরে জাজমেন্ট এই বলে?”
“সামাদ কোথায়?” আবার প্রশ্ন করলাম আমি।
“দুই নাম্বার, সিদ্দিকের বউয়ের প্রথম স্বামির বাচ্চাটা।” আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে চলেছে মফিজ দারোগা। “ছয়-সাড়ে ছয় মাস বয়স। নাদুস-নুদুস সুন্দর একটা ছেলে শিশু। কেবল উঠে বসতে শিখেছে। যাকেই দেখতো, ফোকলা মুখে হাসতো তার দিকে তাকিয়ে। কি মনে হয়? একটা নিষ্পাপ বাচ্চার রক্তে কোনো কারণ ছাড়া হাত রাঙাবো আমি?”
“আমি জানি না। তোর দ্বারা সব সম্ভব,” অধৈর্য গলায় বললাম তাকে। “আগে বল, সামাদ কোথায়? সামাদকে কি করেছিস?”
“আগে বল, কে কাকে খুন করেছে, কেন খুন করেছে, তারপর আমি তোকে বলবো কোথায় তোর জ্যাঠাতো ভাই।” মুখে মুচকি একপেশে হাসিটা ধরে রেখে বললো মফিজ দারোগা।
“সামাদ কই!” গায়ের জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। তারপর উন্মত্তের মত ডাকতে শুরু করলাম, “সামাদ! সামাদ!”
“চোপ!” ধমকে উঠলো মফিজ দারোগা। “কথা কানে যায়নি? আগে আমাকে বল কে কাকে মেরেছে, তারপর তোর ভাইয়ের খোঁজ পাবি!”
“সামাদ কোথায়, শিপলু? শিপলুর দিকে তাকিয়ে হিসহিসে স্বরে জানতে চাইলাম আমি। কিন্তু শিপলু স্রেফ বোকার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, অধিক শোকে পাথর, জবাব জোগাচ্ছে না মুখে।
“চোপ!” আমার মুখের ওপর পিস্তল ধরে খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আগে তোর মুখ থেকে শুনতে চাই কে কাকে মেরেছে, তা না-হলে সোজা দোজখে পাঠিয়ে দেবো!”
“ফাইন!” মফিজ দারোগার দিকে পাঁই করে ঘুরে গর্জে উঠলাম আমি। শোনার এতই শখ তোর? শোন তাহলে! পাতাকুড়ুনি মেয়ে অমিছাকে খুন করেছিল চেয়ারম্যানের ছোট ব্যাটা রিপন। ধর্ষণের পর হত্যা। খুনের পর অমিছাকে জঙ্গলের পাশে এমনভাবে কেটেকুটে ফেলে রেখেছিল রিপন, যাতে সবাই মনে করে কাজটা কোনো বন্য জন্তুর। আর এই আইডিয়া সিদ্দিকের মাথাতেও দ্রুত ক্যাচ করে। লম্পট সিদ্দিক অন্যের বউকে ভাগিয়ে এনেছিল বটে, কিন্তু সাথে কাবাব মে হাড্ডি হিসেবে এসে জুটেছিল তার বউয়ের আগের পক্ষের স্বামির একটা দুধের বাচ্চা। কাজেই উটকো ঝামেলা দূর করলো সে নিজের হাতেই। বাচ্চাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে জঙ্গলের পাশে ফেলে রাখলো, আরো পাকাপোক্ত করলো পিশাচের গল্পটা।” চেঁচাচ্ছি আমি, থুথু এসে গেছে মুখে। “আর বাকি দুইটা…
“হ্যা, বাকি দুইটা।” আত্মতৃপ্তির হাসি মফিজ দারোগার মুখে। “চেয়ারম্যানের ব্যাটা রিপন আর সিদ্দিক নিজেই। এই দুটোকে আর কেউ না…”
“তুইই মেরেছিস,” মফিজ দারোগার মুখের কথাটা শেষ করে দিলাম আমি।
“দুইটা কুলাঙ্গারকে দূর করেছি,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো মফিজ দারোগা। “এই দুই শূয়োরের বাচ্চাকে যদি আমি গ্রেপ্তার করতাম, কি হতো তাতে? মামলা চলতো আট-দশ বছর ধরে। বা আরো বেশি। শেষে কোনো এক ঝানু উকিল রাষ্ট্রপক্ষের বোকাচোদা উকিলকে কলা দেখিয়ে প্রমাণ করে দিত ওরা নির্দোষ, কাজটা আসলেই কোনো এক অজানা বন্য জন্তুর! হাহ! কিংবা অভিযোগ প্রমাণিত হলেও জেল হতো পাঁচ ছয় বছর, আর ফাঁসি যদিও বা হতো, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা তো আছেই, খুন করেও হাসতে হাসতে বেকসুর খালাস নিয়ে বেরিয়ে আসতো নরপশু দুটো!” তীব্র ঘৃণায় মাটিতে থুথু ফেললো মফিজ দারোগা। “তার চাইতে যা করার, সেটা নিজ হাতেই করেছি আমি! ওদের বানানো পিশাচের গল্পের ফাঁদে ফেলেছি ওদেরকেই। রিপনকে মেরেছি আগেই। যথাসম্ভব বেশি কষ্ট দিয়ে। তোরা আসার পর মারলাম সিদ্দিককে। ওর পুরুষাঙ্গ যখন খালি হাতে গোড়া থেকে টেনে ছিঁড়ে আনছিলাম, তখন যদি তোরা খালি দেখতি!” মফিজ দারোগার মুখে প্রবল আনন্দের ছাপ। আমি হতভম্ব হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বলে কি!
“গ্রামবাসির সাপোর্ট আছে তাহলে এতে?” প্রশ্ন করলাম আমি, যদিও জানাই আছে জবাবটা।
“ফুল সাপোর্ট,” মফিজ দারোগা বললো। “যা যা বললাম, সবই জানে তারা। এই পান্ডববর্জিত গ্রাম বহুত ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা থ্রেশহোল্ড লিমিট কাটানোর পরে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয় নির্দ্বিধায়। জগদানন্দপুরের মানুষ সেই লিমিট কাটিয়ে এসেছে বহুত আগেই। আমি এই গ্রামেরই ছেলে। পলিটিক্যাল পাওয়ারের জোরে বহুদিন যাবত এই থানাতেই আছি। আমার সব কাজে তাদের ফুল সাপোর্ট আছে। সেজন্যই চেয়ারম্যানের ছেলেকে নিকেশ করার পরও টু শব্দটা করেনি সে। এই কমিউনিটির প্রতি এটা তার দায়িত্ব, আর তাছাড়া সে নিজেও কুলাঙ্গার ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিল—”
“তার মানে কোনো পিশাচ নেই? একেবারেই না?” আমার জিজ্ঞাসা। সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছি মফিজ দারোগার হাতে ধরা অধৈর্য রিভলভারটার দিকে।
“এটা সত্য, গ্রামে কয়েক মাস ধরে রাতের বেলা উৎপাত করছে কি যেন একটা, বেশ কয়েকটা গরু ছাগলও মেরেছে,” অ্যাজ-এ-ম্যাটার-অব-ফ্যাক্ট টাইপ গলায় বলে চলেছে মফিজ দারোগা। “আর সেটা থেকেই অমিছাকে মারার পরে পিশাচের আইডিয়াটা মাথায় আসে চেয়ারম্যানের ব্যাটা রিপনের-”
“আমাকে গুলি করেছিলি কেন?” মফিজ দারোগাকে ছাপিয়ে বলে উঠলাম আমি।
“মাঝে মাঝে নিজের টেম্পার লুজ করি আমি, উইচ ইজ নট গুড,” একটা
ভুরু ওপরে তুলে বললো মফিজ দারোগা। “সেদিন রাতে যখন সিদ্দিকের লাশের পাশে তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তখন হঠাৎ মনে হলো দেই তোকে শেষ করে, পরে সবাইকে বললেই হবে যে পিশাচটাকে মনে করে ভুলে তোকেই গুলি করে দিয়েছি! পরের মুহূর্তেই অবশ্য প্ল্যানটার অনেকগুলো ফাঁক মনে পড়ে গিয়েছিল আমার, কিন্তু ততক্ষণে ট্রিগারে চাপ পড়ে গেছে।” শ্রাগ করে মফিজ দারোগা।
“এক মিনিট!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো শিপলু মফিজ দারোগাকে ছাপিয়ে। একবার আমার দিকে, আরেকবার মফিজ দারোগার দিকে তাকাচ্ছে সে উদভ্রান্তের মত। “আমাদেরকে এসব বলছে কেন ও, শিপলু? কেন শোনাচ্ছে এসব আমাদেরকে?” নিজের কানের ওপর দু-হাত চাপা দিল ও, “ও নিশ্চই মেরে ফেলবে আমাদেরকে! শুনিস না শুনিস না-”
“যা শোনার সব তো শুনেই ফেলেছিস,” মাথা নাড়তে নাড়তে বললো মফিজ দারোগা।
হতবিহ্বল চোখে একবার আমার দিকে, আরেকবার মফিজ দারোগার দিকে তাকালো শিপলু। “না! বিশ্বাস করুন, আমরা কাউকে কিছু বলবো না। আমাদেরকে চলে যেতে দিন, আমি-আমরা কথা দিচ্ছি, আমরা কাউকে কিছু বলবো না! কাউকে না! কেউ জানবে না-
“আচ্ছা?” শয়তানি হাসিটা মুখে ধরে রেখে বললো মফিজ দারোগা। “আর আমি কিভাবে বুঝবো যে তুই সত্য বলছিস? কিভাবে বুঝবো যে তুই শহরে ফিরে গিয়েই আমার কথা চাউর করবি না? তুই তো আবার সাংবাদিক!”
শহরে ফিরে গিয়ে কেন সে কাউকে কিছু বলবে না, তার পক্ষে যুক্তি দেখানোর জন্য মুখ খুলেছিল শিপলু, কিন্তু তার পরেই মফিজ দারোগার কথার মর্মার্থ মাথায় ঢুকলো ওর। মুখটা হা-অবস্থাতেই রয়ে গেল ওর, দুই চোখে ফুটে উঠলো তীব্র আতঙ্কের ছাপ। ০০০০০০০০
আর ঠিক তখনই গর্জে উঠলো মফিজ দারোগার পিস্তল।
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছোঁড়া গুলি। প্রায় ছিটকে পেছনের ভুট্টাগাছগুলোর মাঝে হারিয়ে গেল শিপলু। কেবল পা দুটো দেখা যাচ্ছে ওর, নড়ছে না সেগুলো।
আমার দিকে পিস্তল ঘোরালো মফিজ দারোগা। মুখে বিজয়ের হাসি। আয়রনিটা ধরতে পারলাম আমি-শিপলুকে খুন করার পরের মুহূর্তেই আমাকে শেষ করেনি মফিজ দারোগা কারণ আমি ওর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয় দাঁড়িয়েছিলাম-আমাকে রসিয়ে রসিয়ে মারতে চায় সে।
“এবার তুই,” জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো দারোগা। “তুই কি ভেবেছিলি-”
আমি এমনিতেও গেছি, ওমনিতেও গেছি। কাপুরুষের মত মরার চাইতে চেষ্টা করে মরা ভালো।
কাঁধ নিচু করে মফিজ দারোগার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।