অধ্যায় ১৩ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
আমি শান্তভাবে চিন্তা করতে পারছি না কিছু।
মাথার মধ্যে তিনটা প্রশ্ন ঘুরছে কেবল-কে? কাকে? কেন?
কে গুলি করেছে? কাকে গুলি করেছে? কেন গুলি করেছে?
দিশেহারার মত ব্যাক সিটটা চেক করলাম আমি। কেউ নেই ওখানটায়।
ড্রাইভিং ডোরের পাশের মাটির দিকে তাকালাম আমি। ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন ওখানটায়।
আর পড়ে আছে কয়েক ফোঁটা রক্ত।
আমার মাথা কাজ করছে না। পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে আমার হৃৎপিন্ড।
আগে আমাকে বুঝতে হবে এখানে ঠিক কি হয়েছিল।
একটা সম্ভাবনা হচ্ছে, কেউ এই গাড়িটাতে করে শহরের দিকে যাচ্ছিলো-যে কারণেই হোক—তারপরে জানোয়ারটা অ্যাটাক করে গাড়িটার ওপরে। গাড়ির যাত্রি গুলি ছোঁড়ে। সে গুলি যে জায়গামত লাগেনি, সেটা ড্রাইভিং ডোরের গায়ে গুলির চিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভুললে চলবে না যে শিপলুর একটা পিস্তল আছে। সেক্ষেত্রে এদিকের রাস্তায় একটা লোকও না থাকার ব্যাখ্যা মেলে। জানোয়ারটাকে দিনে দুপুরে দেখার পরে সবাই দুয়ারে খিল দিয়ে ঘরের ভেতরে বসে কাঁপছে।
আরেকটা সম্ভাবনা হচ্ছে… কালকে যে সন্দেহটা উঁকি দিয়েছিল আমার মাথায়। আমি আর ভাবতে পারলাম না। এক দৌড়ে চলে এলাম বাংলোয়। দম ফুরিয়ে এসেছে, তবু কাহিল ফুসফুস নিয়েই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম- “শিপলু! সামাদ!”
কোনো সাড়া নেই।
সাড়া পাবার আশাও করিনি অবশ্য। কেয়ারটেকারেও কোনো হদিস পেলাম না। পরের দেড় মিনিটের মধ্যে বাংলোর প্রত্যেকটা ঘর চেক করা শেষে খাটের নিচ থেকে একটানে বের করলাম রাইফেল রাখার লাগেজটা। প্রিয় অ্যান্টিক মার্লিন রাইফেলটা আর মুঠোভর্তি কার্ট্রিজ নিয়ে নিলাম নিমেষের মাঝেই।
তারপর এক দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাংলোটা থেকে। ঘরদরজা খোলাই পড়ে রইলো।
আই ডোন্ট কেয়ার।
আমার সন্দেহ সত্যি হলে এই বাংলোতে ফেরত আসতে হবে না আর আমাকে কোনোদিন।
ছুটতে শুরু করলাম জঙ্গলের দিকে যাওয়া রাস্তাটা ধরে। জানি, ও-দিকে যাওয়াটা একদম বৃথা হতে পারে, আমার গোটা সন্দেহটাই হয়তো আকাশ কুসুম কল্পনা, কিন্তু তবুও ওদিকে যাওয়াটা দরকার। তাছাড়া আমার প্রথম সন্দেহটা সত্যি হলে শিকারকে টেনে নিয়ে গেছে জানোয়ারটা ওদিকেই।
জানোয়ারটা বলবো? নাকি পিশাচটা?
শরতের কড়া সোনালি রোদের বিকেল। অভিশপ্ত এক গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে ছুটছি আমি রাইফেল হাতে। আশপাশে যতদূর চোখ যায়, জনমনিষ্যির কোনো সাড়া নেই। ঘামছি আমি, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। নিস্তব্ধ রাস্তায় থপথপ শব্দ তুলছে আমার পা।
হঠাৎ মনে হতে থাকে. এ-সবের কিছুই বাস্তব না। ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন এটা হাহ। সেটা হলে তো বেঁচেই যেতাম।
ওই তো চোখে পড়ছে জঙ্গল। আর খালিভিটা। ভুট্টাখেত আর একাত্তরের বধ্যভূমির মিশেল।
আমি হঠাৎ বুঝে গেলাম আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি না। কারণ আমি যে পৈশাচিক বিপদে পড়েছি, তেমনটা স্বপ্নেও সম্ভব না। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। হাঁপাচ্ছি। আমাকে ওই ভুট্টা খেতে ঢুকতে হবে।
জানি, পিশাচটা জঙ্গলে থাকে, কিন্তু যত জন মানুষ মারা গেছে, সবার লাশ পাওয়া গেছে ভুট্টা খেতে, বা ধানখেতে। কাজেই ভুট্টাখেতেই আগে ঢুকতে হবে আমাকে। কথাটা ভাবতেই শিরশির করে উঠলো আমার পিঠের মাঝখানটা। পাক দিয়ে উঠলো পাকস্থলি।
পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালাম পরিত্যক্ত ধানখেতটার কাছে। কখনো-না-কাটা শুকনো ধানখেতটা পেরোলেই সামনে ভুট্টার খেত। ধানখেতের মাঝখানে কোনোকিছু নাড়াচাড়া করছে। একটা কাক। বিশাল একটা দাঁড়কাক।
শিপলু দুই চোখে কাক দেখতে পারে না। বিশেষ করে দাঁড়কাক। ওরা নাকি যত দুঃসংবাদ বয়ে আনে।
আমি আরেক পা এগোতেই উড়াল দিলো দাঁড়কাকটা। রাইফেল উঁচিয়ে ধীরে ধীরে পেরিয়ে এলাম ধানখেতটা। মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে তীব্র রোদ। আমার হাত কাঁপছে। আমি পকেটে হাত দিয়ে চ্যাপ্টা ফ্লাস্কটা বের করে আনলাম। ছিপি খুলে মুখের ওপর উপুড় করে ধরলাম ওটা।
পেটে চালান করে দিলাম অনেকটা অ্যালকোহল। জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল ওটা পাকস্থলিতে।
আর কাঁপবে না আমার হাত। আমি রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরলাম আবার। তারপর পা দিলাম ভুট্টা খেতের ভেতরে। এদিক দিয়ে কোনোকিছু গেছে মনে হচ্ছে।
মাথার ওপরে কাকের ডাক শুনতে পেলাম আমি।
কাকটা ডাকতে ডাকতে আমার মাথার এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে ওটার ডানা ঝাপটানোর শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেলাম।
“কা! কা! কা!”
চোখের ওপরের কোণা দিয়ে লম্বাটে একটা কালচে ঝলক দেখলাম শুধু। কাকটা।
কি কাক ওটা? জানতে ইচ্ছা করছে। সাধারণ পাতিকাক? না গম্ভির, রাজকীয় র্যাভেন? দাঁড়কাক? জানতে ইচ্ছা করছে কেন যেন।
মাথাটা সম্ভবত কাজ করছে না আমার। হয়, এমনটা হয় অনেকসময়। বিশেষ করে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে। যেমন এখন। হাত কিন্তু ঠিকই কাজ করছে আমার। রাইফেলের ব্যারেলটা কাঁপছে না।
কাকটা বিদায় নেবার পরে চারপাশটা আবার নিরব। ঠিক যেন মিউট করা একটা সিনেমা।
একটুও বাতাস নেই। চারপাশের ভুট্টা গাছগুলোর একটাও কাঁপছে না।
আমার চারপাশ ঘিরে একদম স্থির ভুট্টা গাছগুলো।
দরদরিয়ে ঘামছি আমি। নিজের মাথায় আর মুখে হাত বোলালাম। আমার সারা মুখ ঘামে ভেজা। যত্ন করে রাখা গোঁফজোড়া আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতে ঠেকলো। মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ করছে সূর্যটা। তীব্র রোদ। কিন্তু এই মরা ভূট্টা ক্ষেতের গাছগুলোর মাঝে তবুও ছায়া-ছায়া অন্ধকার।
দরদর করে ঘামছি।
রুমাল বের করে ঘাম মুছবো কি? না, ঝুঁকিটা নেয়া ঠিক হবে না। বন্দুকে হাত রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠেকছে আমার কাছে। রাইফেল নামানো যাবে না। এদিক-ওদিকে তাকিয়ে নিলাম একবার। কোনদিকে যাবো, বুঝতে পারছি না। পথ হারিয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। অনিশ্চিতভাবে সামনে বাড়লাম এক পা। প্রচন্ড রোদ মাথার ওপরে। মাথার মগজ ফোটানোর মত গরম রোদ। চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত রোদ। সামনের একটুখানি জায়গার ভুট্টাগাছ দু-দিকে সরে আছে যেন খানিকটা।
পায়ে চলার পথ? কার? মানুষের, না অন্যকিছুর? মানুষের, না…তবে সন্দেহ নেই, এই পথে যাওয়া আসা করে কোনোকিছু।
আরেকটু সামনে এগোলাম। পায়ের নিচে মচমচ করছে ভুট্টার শুকনো পাতা। অসহ্য নিরবতার মাঝে সেটাই বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।
হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম হঠাৎ। যা হয় হবে, আমি এদিক দিয়েই যাবো।
বন্দুকের বাট কাঁধে ঠেকিয়ে নিয়েছি। আমার ভরসা এখন একটাই, আমার গোল্ডমেডেল-জেতা নির্ভুল নিশানা।
দশ পা গিয়েই থমকে গেলাম। আরেকটা পায়ের শব্দ কানে এসেছে। কেউ এদিকেই আসছে। আমি তৈরি। কাঁধে রাইফেল।
এতক্ষণ গরমে ঘামছিলাম আমি, এবারে হাড় কাঁপানো একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। কানের কাছে শুরু হলো ফিস ফিস আওয়াজ। আর সেই সাথে হালকা একটা ভন ভন শব্দ, যেন পচা কোনোকিছুর ওপর ঘুরছে মাছির ঝাঁক। I একেকটা সেকেন্ডকে একেকটা ঘন্টার মতো লাগছে।
পায়ের শব্দটা কাছিয়ে আসছে। বাড়তে বাড়তে সেটা যেন গির্জার ঘন্টার মতো জোরালো হয়ে আমার কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে জিনিসটা।