অধ্যায় ১২ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
এক মুহূর্তের জন্য, আমি মারা গিয়েছিলাম।
কিংবা আমি ভেবেছিলাম, আমি মারা গিয়েছিলাম।
তারপরই টের পেলাম, আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি, কানে প্রতিধ্বনি তুলছে গুলির শব্দটা, শিপলু আর সামাদ একসাথে কথা বলে উঠে মহা শোরগোল তুলেছে, আর আমার কানের পাশ দিয়ে শিষ কাটার যে শব্দটা পেয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই একটা বুলেট। না, মরিনি আমি, মফিজ দারোগার গুলি আমাকে মিস করেছে কয়েক ইঞ্চির জন্য।
“স্যরি! আমি স্যরি!” মফিজ দারোগা ভাঙা গলায় চেঁচাচ্ছে। তারপরই আমার দিকে এগিয়ে এলো সে। “জামশেদসাহেব! আপনার লাগেনি তো? কোনো ক্ষতি হয়নি তো?”
আমি তাকিয়ে আছি মফিজ দারোগার মুখের দিকে। অল্প আলোয় যা বুঝলাম, লোকটার কালোপনা মুখে উদ্বেগ আর অনুশোচনার ছাপ, যেন নিজের ভুলে মাথা চাপড়ানোর অবস্থা তার। লোকটার এই অভিব্যক্তি কতটা সত্যি? কি চলছে ওই মোটা খুলিটার ভেতরে? তাকে দুই পয়সাও দাম দেইনি আমি, সেটা ঠিক, তাই বলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করবে সে? আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “না, কিছু হয়নি আমার।” রাইফেল মাটিতে নামিয়ে ভর দিলাম সেটার ওপরে। হঠাৎ বড় ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার কাঁধে হাত দিলো মফিজ দারোগা। “মাথাটা খুব গরম হয়া ছিলোসাহেব! মাফ করে দিবেন! সবসময় ভয়ে ছিলাম পিশাচটা কখন সামনোত আইসে! হটাৎ যখন সামনোত সিদ্দিকের লাশটা দেইখলাম, আঙুলের চাপ পড়িয়া গুলিটা বাইর হয়া গেল। কি কয়া যে ক্ষমা চাবো আপনার কাছে, লজ্জায়…”
“ক্ষমা চাইতে হবে না আর, যান!” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। “যা করার তো করেই ফেলেছেন! মাথাটাই উড়িয়ে দিতেন আরেকটু হলে আমার, বেয়াক্কেল লোক কোথাকার!” রাগে গলা কাঁপছে আমার। “এই বকরির ঘিলুওয়ালা লোককে পুলিশ বানিয়েছে কে, সেটাই এখন দেখার বিষয়! যান তো এখন, সরেন মুখের সামনে থেকে! সরেন বললাম!”
মুখ কালো করে আমার সামনে থেকে সরে গেল মফিজ দারোগা।
সামাদ বসে পড়ে চেক করে দেখছে সিদ্দিকের দেহাবশেষ। “কি অবস্থা?” জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
“এই রকম ইনজুরি নিয়ে ও বেঁচে থাকলে সেটা নিয়ে লন্ডনের কোনো মেডিকেল জার্নালে আর্টিকেল লিখে বিখ্যাত হয়ে যেতাম,” বিড়বিড়িয়ে বললো সামাদ। হাত গুটিয়ে এনেছে লাশটা থেকে।
“এখানে থেকে আর লাভ নেই,” শিপলু বললো। “জিনিসটা আশেপাশে আছে কিনা কে জানে। আমাদের গ্রামে ফিরে গিয়ে লোকজসহ আবার আসাটাই ভালো হবে। মফিজসাহেব!”
মফিজ দারোগার ঘোর এখনো কাটেনি। “উঁহ?” আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জবাব দিল সে, চোখ সরাতে পারছে না সিদ্দিকের লাশটা থেকে। তার হাটুতে এক ফোঁটা রক্তের দাগ, নিচু হয়ে মোছার চেষ্টা করলো সেটা।
“আপনি থানায় চলে যান। আইনগত যত ব্যাপারস্যপার আছে সেরে ফেলুন।” শিপলু চশমা অ্যাডজাস্ট করতে করতে বললো।
“ঠিক… ঠিক বলছেন।” মফিজ দারোগা বললো, যেন মাথায় অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা চলছে তার।
“আমরা একসাথে ফিরি, চলুন, “ সামাদ বললো। “সেটাই বেটার।”
এই কথায় রাজি হয়ে গেলাম সবাই সাথে সাথে। মরা ভুট্টা খেতের মাঝখানে বিভৎস একটা লাশের সাথে আর এক মুহূর্ত থাকারও ইচ্ছা নেই কারো।
সিদ্দিকের ছেঁড়াখোঁড়া লাশটা পেছনে ফেলে রেখে তড়িঘড়ি করে আবার জগদানন্দপুর গ্রামের দিকে রওনা দিলাম আমরা।
রাইফেল কাঁধে আমি সবার সামনে। চিন্তার ঝড় চলছে মাথায়। মফিজ দারোগা আমার ওপর গুলি চালালো কনে? ভুল করে? এমন ভুল মানুষ করে? নাকি ইচ্ছে করে? সেটাই বা হবে কেন?
আবার যদি ইচ্ছে করেই হয়, তবে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মিস করলো কেন?
অনেক সময় মানুষ স্বপ্নের মাঝেই বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছে। সে-রাতে তেমনটাই হলো আমার। একেই মনে হয় বলে লুসিড ড্রিমিং। আমি একটা কুয়াশাঘেরা জায়গায়। চারদিকে ঘন কুয়াশা। এত ঘন কুয়াশা আমি কোনোদিন দেখিনি।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এবার হাটতে শুরু করলাম। আমার চারপাশে কুয়াশাগুলো পাক খেয়ে খেয়ে সরে যাচ্ছে। পথ করে দিচ্ছে আমাকে।
আমি ভাবলাম, কুয়াশাটা সরে যাক। ভাবতে না ভাবতে সেটা সরেও গেল।
তবে পুরোটা না। আমার সামনে করিডোরের মত একটা জায়গা বানিয়ে সরে গেল ওটা। যেন মোজেসের সামনে সরে যাওয়া ভূমধ্যসাগর। নাকি লোহিত সাগর?
করিডোরের শেষে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। কাঠের দরজা।
আমি দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা চেনা চেনা লাগছে আমার। একটা তুচ্ছ দরজা কারো চেনা চেনা লাগার কথা নয়। আমার কাছে লাগছে।
আমি দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতলটা ধরতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিলাম। আমি এর আগেও এই দরজার সামনে দাঁড়িয়েছি। আমি জানি গোটা ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে। আর আমি এটাও জানি যে আমি স্বপ্ন দেখছি।
আমি কি এই স্বপ্নটা থেকে জেগে উঠতে পারি না? ওই দরজার ভেতরে কি আমাকে ঢুকতেই হবে?
আমি নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। ডান-হাত দিয়ে বাম হাতে। ব্যথাও পেলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। জেগে উঠলাম না আমি। স্বপ্ন দেখছি।
জেগে ওঠার একমাত্র উপায় হচ্ছে ওই দরজার ভেতরে গিয়ে পরিস্থিতিটা মোকাবেলা করা।
আমি হাতলটা ঘুরিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে দরজাটা খুলে ঢুকলাম এসি রুমটার ভেতরে।
ধানমন্ডি থানার ও.সি. বিশাল ডেস্কটার পেছনে বসে একটা ফাইল খুলে কয়েকটা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন তিনি। হাসিটা আসল না, মেকি। “জামশেদ রহমান খান।” ডেস্কের উল্টোদিকের একটা চেয়ার দেখালেন তিনি। “বসো।”
আমি তার সামনে বসতে চাই না। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাই। আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কিন্তু তার বদলে ‘৮৯-র হাল ফ্যাশনে কাটা নিজের ঝাঁকড়া চুলে হাত বোলালাম আমি। আরেক হাতে একটা অদরকারি ঝাঁকুনি দিলাম গায়ের কালো চামড়ার জ্যাকেটে। ঝাঁঝের সাথে বললাম, “আমাকে আপনি করে বলবেন।”
ওসির মুখের হাসিটা একটু ছোট হলো, সেভাবেই থাকলো এক সেকেন্ড, তারপর ফিরে গেল আবার আগের সাইজে। “অবশ্যই বলবো, মিস্টার জামশেদ রহমান খান। আপনি বসুন। পিলিজ।”
আমি ইচ্ছে করে বেশি শব্দ করে চেয়ারটা টান দিয়ে ঠ্যাং ফাঁক করে বসলাম। হাবেভাবে চরম বিরক্তির ছাপ।
অনেক সময় নিয়ে ফাইলের কাগজপত্রগুলো সাজালেন ওসি। ফাইলটা বন্ধ করে দু-হাতের আঙুল একটা আরেকটার ফাঁকে ঢুকিয়ে তার নিচে চাপা দিলেন ফাইলটা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, “তো, আপনার কমনওয়েলথের প্রস্তুতি কেমন যাচ্ছে?”
“ভালোই।” ভারি গলায় বললাম আমি।
“সোনা জেতার আশা করছেন এবারো নিশ্চয়ই।” ওসি মজলিশি ঢঙে বললেন।
চরম বিরক্তির সাথে মুখ বাঁকালাম আমি। “হ্যা-হ্যা-হ্যা। আশা করছি। আর আমি এটাও আশা করছি, আপনি আমার কমনওয়েলথের প্রস্তুতি শোনার জন্য আমাকে থানায় ডেকে আনেনি।”
“না-না-না, তা কেন হবে?” ওসিসাহেব আহত স্বরে বললেন।
“তাহলে যা বলার-”
“আপনার কমনওয়েলথে যাওয়া হচ্ছে না।” মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বললেন ওসি।
কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। “মানে?”
“কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন আপনার ফিজিক্যাল টেস্ট করেছিল। মনে আছে?”
“হ্যা,” বিড়বিড় করে বললাম আমি, একটু একটু বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াচ্ছে।
“সেখানে আপনার ব্লাড আর ইউরিন টেস্ট করা হয়েছিল, মনে আছে?”
“উমম…হ্যা।”
“টেস্টে আপনার ব্লাডে…” ফাইল খুলে একটা কাগজ দেখতে লাগলেন ওসি, “হেরোইন, কোকেনসহ আরো কিছু রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ তো ছিলোই, সাথে ছিলো…’ কাগজ থেকে পড়ছেন তিনি, পারফর্ম্যান্স এনহ্যান্সিং ড্রাগস, অ্যাম্ফেটামিন, মেথ…
কি লিখছে…মেথঅ্যাম্ফেটামিন, এফেড্রিনসহ…” ফাইল বন্ধ করলেন তিনি, মুখ থেকে উধাও হয়েছে হাসিটা। “ড্রাগের ব্যাপারে অনেক কড়াকড়ি শুরু হয়েছে দুনিয়া জুড়ে। কমনওয়েলথের আগে সব দেশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে খুব কড়কড়ি করে ডোপ টেস্ট করতে। সে-টেস্টেই এতসব ধরা পড়েছে। কি ভেবেছিলেন, এসব কেউ জানবে না?”
আমি কাঁপছি। আমার হাত কাঁপছে। কয়েক ঢোক অ্যালকোহল পেটে যাবার আগে কাঁপুনি থামবে না-কোনো একটা ড্রাগের বিচ্ছিরি সাইড ইফেক্ট এটা। সাফের আগে এই সমস্যা ছিলো না। এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে আমি খসখসে গলায় বললাম, “এতে পুলিশের ইনভল্ভমেন্ট কেন?”
“কারণ শুটিং ফেডারেশনের লোক আপনাকে ভালোভাবেই চেনে। ওখানকার কতজনকে ধরে কতবার পিটিয়েছেন আপনি, মনে পড়ে? এক স্টাফের তো হাতই ভেঙে দিয়েছিলেন একবার। ওরা ঠিক লোককে দিয়েই অ্যাপ্রোচ করেছে, আমি বলবো!” পাথরের মত শক্ত মুখে বললেন ওসি। “আর আপনার বাবারও সম্মতি নেয়া হয়েছে এই ব্যাপারে। তিনিই আমাকে বলেছেন আপনাকে এখানে ডাকতে।”
আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি ওসির দিকে। চোখের আগুনে ভস্ম করার চেষ্টা করছি লোকটাকে।
“ডোপপাপি জামশেদ.” দাঁত কেলিয়ে বললেন ওসি। “কেমন শোনাবে কালকের পেপারের হেডলাইন-সাফ গেমসে সোনাজয়ির ড্রাগ কেলেংকারি! ডোপপাপি জামশেদ!”
আমার হাতের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার মেজাজটাও। আমি যদি এই মুহূর্তে বেরিয়ে না যাই-
আমি জানি এর পরের মুহূর্তে আমি কি করেছিলাম, আজ থেকে চার বছর আগে, উনিশশো উননব্বই সালে, ও.সি.র রুমে। ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম চেয়ারটা উল্টে দিয়ে, গটগট করে হেটে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তারপর গায়ের জোরে দরজাটা খুলে।
ভেবেছিলাম স্বপ্নেও এমনটা হবে, কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে খুলে গেল ঘরের দরজাটা।
আমার বাবা আব্বাস রহমান খান ঢুকলেন ভেতরে। পুরোদস্তুর স্যুট-টাই পরনে। “বাবা!” আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চোয়াল ঝুলে পড়েছে।
“তুমি যা দেখছো তার কিছুই বাস্তব না, জামশেদ।” পকেটে হাত পুরে শান্ত কন্ঠে বললেন বাবা। আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
“আমি জানি, বাবা,” হতভম্ব আমি বললাম, “আমি স্বপ্ন দেখছি। এ-সবই স্রেফ স্বপ্ন।”
“তা তো বটেই,” বললেন বাবা, “শুধু সেটা না, আমি এটার কথাও বলছি।”
“এটা?” বোকার মতো বললাম আমি।
“এটা,” বললেন বাবা, জাদুকরের ভঙ্গিতে দুটো হাত ছড়িয়ে দিলেন দু-দিকে। আমি চারপাশে তাকালাম। সবকিছু বদলে গেছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি খালিভিটাতে। জঙ্গলের উল্টোদিকে, ভুট্টাখেতের পাশে, শুকিয়ে যাওয়া ধানখেতের মাঝখানে।
“চোখের সামনে যা দেখছো, সেটাকে হুট করে সত্য বলে ধরে নেবে না,” বাবা বললেন। “ইলিউশন বড় মারাত্মক জিনিস।”
আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমি জানি উনি এরপরে কি বলবেন। “আসল নকল বিচার করবে,” বিড়বিড় করে বললাম আমি।
“আসল নকল বিচার করবে,” বললেন বাবা।
আর তারপরই ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।
সারা সকাল আর দুপুরটা খুব একঘেয়ে কাটলো। আমি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আমার হান্টিং রাইফেল তিনটে পরিস্কার করলাম, আর বাকি সময়টা রবার্ট লুডলামের একটা উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিলাম। শিপলু ওর নোটস নিয়ে স্টোরি দাঁড়া করাতে ব্যস্ত। সামাদ দুপুরের খাবারের আগপর্যন্ত বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে রইলো, মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করা ছাড়া। ওর সবসময়ের গম্ভির মুখটা আরো কালো হয়ে রইলো পুরোটা সময়।
দুপুরের খাবারটা আমরা শেষ করলাম প্রায় কোনো কথাবার্তা আদান-প্রদান না করেই। কেবল শিপলু একবার বললো যে ও চায় আমি একবার বিকেলবেলা রাইফেল সমেত খালিভিটা আর জঙ্গলের আশপাশটা ঘুরে আসি, জাস্ট রুটিন চেক হিসেবে। রাজি হয়ে গেলাম।
খাওয়াদাওয়ার পরে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ভেবেছিলাম শুলেই ঘুম আসবে কিন্তু দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না কেন যেন। বহুক্ষণ শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলাম, কাজ হলো না। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ নির্দিষ্ট একটা সময়ে বুঝে যায় যে আর গড়িয়ে লাভ নেই, এবার বিছানা ছেড়ে ওঠার পালা। আমার ক্ষেত্রে এই রিয়েলাইজেশনটা এলো প্রায় এক ঘন্টা পরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম বিরক্ত আমি। শিপলুর বিছানার দিকে ঘুরে দেখলাম, ঘুমে অচেতন ও বেচারা। চশমা ছাড়া অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে।
প্যান্ট পরে নিয়ে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলাম। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। বাজারের দিকে যাবো।
গাঁয়ের ফাঁকা রাস্তায় ঝাঁ ঝাঁ রোদ। খানিকদূর গিয়ে মনে হলো, বের না হলেই ভালো করতাম। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছি। আর পেছনে ফিরলাম না।
বাজারের চেহারা কালকের থেকে একেবারেই ভিন্ন। কাল ছিল বাজার, অনেক লোকজন এসেছিল, আর আজ এই কড়া রোদের সদ্য বিকেলে এক-দুটো লোকের দেখা পাওয়াই কঠিন। একবার সন্দেহ হলো চায়ের দোকানটা আদৌ খোলা আছে কিনা।
আছে। আনসার আলী কাউন্টারের পেছনে বসে ঘুমে ঢুলছে। আমার সাড়া শব্দ পেয়ে চট করে উঠে দাঁড়ালো হাসিমুখে। লজ্জিত মুখে বললো, “আরে শিকারিসাহেব যে! আইসেন। চা বসে দেই নাই এখনো, দুপুরের খাওয়া খায়া আসি কেবল দোকান খুললাম, বোঝনেন…” বলতে বলতে কেতলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
আমি কিছু না বলে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। কাজ নেই, কাজেই আনসার আলীর কাছ থেকে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে টানতে লাগলাম। আনসার আলী চা তুলে দিল। আমি নিজের ভাবনা ব্যস্ত, কিন্তু আনসার আলী আমার চা নিয়ে খুবই কনসার্নড, একটু পর পর কেবল বলছে, “এই তো হয়া গেছে। আর এক মিনিট।” যদিও আমি তাকে কোনো তাগাদা দিচ্ছি না।
আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতেই ধাঁ করে একটা নতুন আইডিয়া মাথায় এল আমার। আচ্ছা, যদি—
ঠিক এমনি সময় গুলির শব্দটা কানে এল।
টাশশ। টাশশ।
পর পর দু’বার
এক মুহূর্ত বোকার মত তাকালাম আমি এদিক-ওদিক। মাথায় কিছুই আসছে না।
তারপরই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম এক ছুটে। গুলির শব্দ কোনদিক থেকে আসছে, বুঝতে পারছি। বাংলোর দিক থেকে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন, কি কারণে-
গ্রামের রাস্তায় ছুটে বেরিয়ে এলাম আমি। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। যতদূর চোখ যায়, কিছু দেখলাম না।
ভরা বিকেলে গ্রামের রাস্তায় হয়তো এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার কাছে সেটা মনে হলো না। থমথম করছে যেন চারদিক। অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করলাম আমি। আর তারপরই, অনেক দূরে থাকতেই চোখে পড়লো জিনিসটা। শহরের দিকে যে রাস্তাটা গেছে, তার পাশে। আমি ছুটতে শুরু করলাম ওদিকে।
আমাদের গাড়িটা। রাস্তার পাশের খাদে পড়ে আছে ওটা। বাজারের দিকে আসার চেষ্টা করছিল ওটা, তারপর বাজার ক্রস করে নিশ্চয়ই যেতো শহরের দিকে…
আমি হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে থামলাম ওটার পাশে।
দেখে মনে হচ্ছে, কেউ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে গিয়েছিল গাড়িসমেত। কিংবা তাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করা হয়েছিল।
আমি হড়বড়িয়ে রাস্তা থেকে নেমে পড়লাম গাড়িটার পাশে।
গাড়িটার প্যাসেঞ্জার ডোর খোলা। ভেতরে কেউ নেই। খালি খানিকটা রক্ত আর কাঁচ পড়ে আছে সিটের ওপরে। আমার হার্টটা রেসের ঘোড়ার মত ছুটছে এখন। আমি ড্রাইভিং ডোরটার দিকে তাকালাম। গুলির চিহ্ন!
কেস স্টাডি : ‘রিগর মর্টিস
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই কেস ইনভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
সাবজেক্টের নাম ডা: মো: আলতাফুর রহমান (নাহিদ), এম.বি.বি.এস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)। বয়স আনুমানিক বিয়াল্লিশ বছর।
ঘটনাটা লিপিবদ্ধ করেছি ডাক্তারসাহেবের বাড়িতে বসেই, আগস্টের এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়। বাইরে তখন ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি। মোমবাতির আবছা আলোয় ডাক্তারসাহেবের স্টাডি রুমটাকে রহস্যময় লাগছে। আড়চোখে একবার চেয়ে নিলাম ঘরটার অন্ধকার এক কোণে ঝোলানো আস্ত কঙ্কালটার দিকে। চা’টা শেষ করে সোফায় হেলান দিয়ে ছাদের দিকে আনমনে তাকিয়ে শুরু করলেন ডাক্তার। এখানে পুরো ব্যাপারটা হুবহু তার জবানবন্দিতেই তুলে দিচ্ছি।…
আমার প্রথম কর্মস্থল… হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা তখন হব-হব করছে। পনের বছর আগের কথা। হাসপাতালটা যে-শহরে, সেটা তখনো ততটা সরগরম হয়ে ওঠেনি, শহরতলি-শহরতলি গন্ধ তখনো তার গায়ে। সন্ধ্যের পরে শহরের আর সব জায়গার মত ফাঁকা হয়ে আসছে বিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটার প্রাঙ্গন, বহির্বিভাগটা বন্ধ, এদিক-সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে কেবল হাটাহাটি করছে জনাকয়েক মানুষ।
বিশাল হাসপাতালটার অবয়ব কেবল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে সন্ধ্যার ছায়ার মাঝে। ওটার দিকে আনমনে চাইলাম আমি। জানি না কেন, বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠলো হঠাৎ। পাত্তা দিলাম না অবশ্য। বিশাল জার্নি করে এসেছি, রেস্ট দরকার। সোজা চলে গেলাম জুনিয়র আবাসিক ডাক্তারদের ডর্মিটরিতে।
পরেরদিন সাতসকালে কাজে যোগ দিলাম। ডিরেক্টরসাহেবকে গিয়ে নাম বলতেই বললেন, “ডা. আলতাফুর রহমান? ওয়ার্ড নং তিনশো আট। প্রফেসর রফিকের আন্ডারে। চারতলায় উঠে যান।”
হাত দিয়ে অ্যাপ্রনের বোতাম সোজা করতে করতে সিঁড়ির দিকে চললাম। ডাক্তার হবার পরে অ্যাপ্রন সবসময় না পরলেও চলে, কিন্তু আমার অভ্যাসটা যায়নি।
হাটতে হাটতে খেয়াল করলাম, হাসপাতালটা বানানো হয়েছে পুরনো ভবনের সাথে নতুন ভবন জুড়ে দিয়ে। আমার ওয়ার্ডটা পড়েছে পুরনো ভবনেই।
বাংলাদেশের হাসপাতাল যেমন হয় আরকি। ব্লিচিং পাউডার, ঘাম আর বমির একটা মিশ্র গন্ধ বাতাসে, স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, করিডোরের দু-পাশেই মেঝেতে শুয়ে আছে রোগি, নাহয় রোগির আত্মীয় স্বজন। কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে টিফিন বাটি খুলে খেতে বসেছে। ভারি গুমোট বাতাসে ভেসে বেড়ানো দুর্গন্ধে যোগ হয়েছে একটা নতুন মাত্রা।
চারতলায় উঠে এলাম। সার্জারি ওয়ার্ড। এখানেই আমার ডিউটি।
এইখানে একটা কথা বলে রাখি। চারতলায় পা দেবার সাথে সাথেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। পা যেন চলতে চাইছে না, শিরদাঁড়ায় একটা শীতল অনুভূতি। গোটা ওয়ার্ডের বাতাস যেন থমথম করছে। দিনের বেলাতেও কেমন আলো আঁধারী পুরো জায়গাটা। ওয়ার্ডের ভেতরে যন্ত্রণায় কঁকাচ্ছে কয়েকজন রোগি। করিডোরে পড়ে থাকা এক রোগির পায়ের হলদেটে ব্যান্ডেজের ওপরে ভনভন করছে কয়েকেটা মাছি। অসুস্থতার গন্ধ চারপাশে।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। অ্যামপুটেড পা নিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকা একটা শুকনো বাচ্চা ঘোরলাগা চোখে আমাকে অনুসরণ করছে। মরফিনের ফল মনে হয়।
এক নার্সের সাথে কথা বলে জানলাম, প্রফেসর রফিক অপারেশন থিয়েটারে, গ্যাস্ট্রো জোজুনোস্টমির অপারেশন করছেন একটা। তার সাথে কথা বলার আগে ডিউটি বুঝে পাবার আশা নেই, কাজেই আমি সময় কাটানোর জন্য অ্যাপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পায়চারি শুরু করলাম আস্তে ধীরে।
হাসপাতালের যে কোনো ওয়ার্ডের পরিবেশ যে কোনো নন-মেডিকেল পারসনের কাছে ডিজগাস্টিং মনে হবে। হলদে আলো, বমি আর ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ, অসুস্থ মানুষজন শুয়ে আছে, কারো পায়ের ঘা পচে গেছে, কারো পেটে অবিশ্বাস্য রকম বড় সেলাই, এইমাত্র কেউ মরে গেল। কিন্তু একজন ডাক্তার বা মেডিকেল স্টুডেন্টের কাছে ওয়ার্ডের চাইতে বড় বন্ধু আর কেউ না। ওয়ার্ডে হাটাহাটি করলেও জ্ঞান বাড়ে। আমার মেডিকেলের পেডিয়াট্রিকসের প্রফেসর বলেছিলেন, “ওয়ার্ডে বই না আনলেও চলে। যে দুইশো জন পেশেন্ট দেখছো, এরা সবাই একেকটা বই। এদের কাছ থেকে যত শিখতে পারবে, ততটা আমিও শেখাতে পারবো না।”
স্যারের কথা বেদবাক্য হিসেবে নিয়েছিলাম এবং ফল পেয়েছিলাম ছাত্রজীবনে। যতটা সম্ভব সময় কাটাতাম ওয়ার্ডে। রোগি ইক্সামিন করতাম। এমবিবিএস পাশ করার পরেও অভ্যাসটা যায়নি। ইনটেস্টিনিয়াল পারফোরেশনের কারণে পেট ফুলে ঢোল হওয়া এক পেশেন্টের দিকে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বিষম একটা ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ার অবস্থা হলো।
কোনোমতে সামলে নিয়ে সোজা হতে হতেই শুনলাম, “স্যরি স্যরি স্যরি! আই অ্যাম সো স্যরি! ব্যথা পেয়েছেন?”
ভালো করে তাকিয়ে দেখি এক রোগামত অ্যাপ্রন পরা ছেলে অপ্রস্তুত চোখে তাকিয়ে আছে। ঘাড়ের ওপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলে আছে একটা স্টেথোস্কোপ, যে কোনো সময়ে খসে পড়ে যেতে পারে। মাথায় এলোমেলো চুল, চশমায় ঢাকা ঘুমহীন লালচে চোখ। ইন্টার্নি ডাক্তার হবে নিশ্চয়ই। “আপনার ব্যথা লাগেনি তো?” আবার বললো সে।
“না, না, আমি ঠিক আছি।” আমি আশ্বস্ত করলাম ছেলেটাকে।
“মাফ করবেন! আজকে ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার আসেনি, তার ওপর কালকে ছিলো অ্যাডমিশন, নতুন নতুন রোগি এসেছে, আর সব কাজ চেপেছে আমার মাথায়, কাল সন্ধ্যা থেকে ডিউটি করছি…” হরবড়িয়ে বলে যেতে থাকে সে। আমি হেসে আশ্বস্ত করি, ইটস ওকে, আমি নিজেও ইন্টার্নি থাকা অবস্থায় প্রায়ই এরকম অবস্থায় পড়তাম।
“ওহ আচ্ছা! আপনিই বোধহয় নতুন রেসিডেন্ট ডক্টর?” হাত বাড়িয়ে দেয় তরুণ ডাক্তার। “আমি ডক্টর প্রতুল। এ-বার এমবিবিএস পাশ করেছি, সার্জারি ওয়ার্ডে এসেছি দু-সপ্তাহ হলো।”
ইউনিটের হেড রফিক স্যারের আসতে দেরি হবে, কাজেই সে সময়টা বসে না থেকে প্রতুলকে রোগি দেখায় হেল্প করলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হলো প্রতুলের সাথে। বেশ চমৎকার আর ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। প্লেস করেছে সব প্রফেশনাল এক্সামেই। প্রতুলের সাথে খাতির হয়ে যেতে সময় লাগলো না আমার। ইন্টার্নি ডক্টরদের হাজারো জিজ্ঞাসা, সেসব প্রশ্নের উত্তর দিলাম খুশিমনেই
ওয়ার্ডে প্রথম দিনটা ভালোই কাটলো। প্রফেসর রফিক খুব কড়া মানুষ, কিন্তু ডিউটি ঠিকমত করলে নাকি তার মতো ভালো আর নেই। শুরুতেই একগাদা রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন শুনিয়ে দিলেন আমাকে। আমি অবশ্য ঘাবড়ালাম না। নিজের মেডিকেলে ডিউটি করার সময় থেকেই পরিশ্রমের অভ্যাস আছে আমার।
প্রথম দিনে আমার ডিউটি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। প্রতুল লাঞ্চের সময়ই চলে গিয়েছিল, আমি বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ও ঢুকলো ঢুলতে ঢুলতে। “নাইট ডিউটি আছে ভাই,” চিঁ চিঁ করে বললো ও। “পর পর দুইদিন নাইট ডিউটি দিয়েছেন রফিক স্যার! আর আমি এদিকে ঘুমে চোখ খোলা রাখতে পারছি না, কি জ্বালা!”
আমি হেসে ওকে স্বান্ত্বনা-টান্ত্বনা দিয়ে চলে এলাম আবাসিক ডক্টরদের ডর্মিটরিতে। রাতের খাওয়া সেরে নিলাম তাড়াতাড়ি। ঘড়িতে দেখি কেবল সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি শোয়ার অভ্যেস নেই-হলে থাকার সময় তো রাত বারোটার আগে শত চেষ্টাতেও চোখের পাতা এক করতে পারতাম না।
বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ফুরফুরে বাতাস। চমৎকার আবহাওয়া। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে হাটতে ডর্মিটরির গেটের কাছে চলে এলাম। বুড়োমত এক দারোয়ান লাঠিহাতে পাহারা দিচ্ছিলো। গল্প জুড়ে দিলাম তার সাথে। নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে যদি একটু আরামে থাকতে চান তাহলে সবার আগে সেখানকার কর্মচারিদের সাথে খাতির জমাতে হয়-এটা রুল নাম্বার ওয়ান।
দারোয়ান মতি মিয়া দেখলাম হাসপাতালের নাড়ির খবর রাখে। আমি কোন ওয়ার্ডে আছি সেটা শুনেই বলে উঠলো, “ও আপনে ডাক্তার শহীদ সাবের বদলে আইছেন। বুঝতে পারছি।”
“ও, আমার পোস্টে আগে ডক্টর শহীদ ছিলেন? তিনি কি প্রমোশন পেয়ে চলে গেছেন?”
“উঁহু,” গম্ভিরভাবে মাথা নাড়লো মতি মিয়া। “উনি আছিলেন বেশিদিন হয় নাই। মাসখানেক হইবো। তারপর তাড়াহুড়া কইরা বদলি হইয়া চইলা গেলেন।”
“তাড়াহুড়া করে কেন? কাজের চাপের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম। মনে মনে বললাম, যে লোক স্ট্রেসের সাথে কুলিয়ে নিতে পারে না, সার্জারি তার জন্য না।
“না,” মুখচোখ গম্ভির করে রহস্যমাখা গলায় বললো মতি মিয়া 1
“তাহলে?” জিজ্ঞেস করলাম সাথে সাথে।
আমার কৌতূহল বুঝতে পেরেছে মতি মিয়া। বল এখন তার কোর্টে। ভাঁজ পড়া মুখটা আরো গম্ভির করে ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে, নিরবতাটা আরো গভির করো আমার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলতে চাইছে। শেষে যখন আমি অধৈর্য হয়ে ওকে তাগাদা দেবার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছি তখন সে বলে উঠলো, “সেইটাই তো হইলো গিয়া আপনের রহস্য।”
রহস্যটা কি, সেটা শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি বটে, কিন্তু ঠিক করলাম আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। দেখি মতি মিয়া কতক্ষণ পরে নিজে থেকে বলে।
যা ভেবেছিলাম তাই হলো। আমি আর কিছু জানতে চাইছি না দেখে মতি মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে কিছুক্ষণ, তারপর বলেই ফেললো, “উনি খুব ভয় পাইছিলেন।”
“ভয় পাইছিলেন?”
“হ।” বলে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো বুড়ো গল্পবাজ দারোয়ান।
“কিসের ভয়? এলাকার গুন্ডা-মাস্তানের ভয়?
“নাহ।” যেন কোনো আগ্রহই নেই এমন ভঙ্গিতে বললো মতি মিয়া। “গুন্ডা- পান্ডা তো হইলো এই জগতের জিনিস। ওনার ভয়ের জিনিস আছিল আলাদা জগতের।”
বুঝলাম গল্পটা কোন খাতে বয়ে নেবার চেষ্টা করছে মতি মিয়া। হালকা স্বরে বললাম, “ডর্মিটরিতে তাহলে ভুত আছে?”
“নাহ। এইখানে কই পাইবেন।” গলা নামিয়ে নেয় মতি মিয়া তারপর, “উনি ভয় পাইছিলেন হাসপাতালে। আপনে যে ওয়ার্ডে এখন, সে ওয়ার্ডে।”
“ওয়ার্ডে?” আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। “ঝেড়ে কাশো তো মতি মিয়া গোটা গল্পটা বলো।”
মতি মিয়া যা বললো তার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে, ডাক্তার শহীদের একদিন নাইট ডিউটি ছিলো ওয়ার্ডে। ডিউটি স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে সে—চোখ খুলে দেখে, গোটা ওয়ার্ডে এক অপার্থিব আবছা আলো। লাইট-ফ্যান সব বন্ধ। সে বাদে আর কোনো মেডিকেল পার্সন গোটা ওয়ার্ডে নেই। ব্যাপার কি সেটা দেখার জন্য বাইরে বের হতে গিয়ে দেখে সব দরজা জানালা বন্ধ, বেরোনোর কোনো উপায় নেই। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জেগে ওঠার পরে একটা রোগিকে পরীক্ষা করে দেখে, সে রোগি বেঁচে নেই, চোখ উল্টে মরে পড়ে আছে। আরেকটা রোগিকে পরীক্ষা করে দেখে, সে-ও পটল তুলেছে। একে একে দেখা গেল সব রোগিই মরে কাঠ হয়ে আছে কোনো অজানা কারণে। ঠিক এমন সময় কোনো একটা কিছু দেখে প্রচন্ড ভয় পায় সে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এক ওয়ার্ড বয় এসে জাগিয়ে তোলে তাকে-ডাক্তার শহীদ চোখ খুলে দেখে সব স্বাভাবিক, ওয়ার্ডের রোগিরাও বেঁচে বর্তে আছে বহাল তবিয়তে। এর পরও অবশ্য ডিউটি চালিয়ে যায় সে। কিন্তু পর পর তিনদিন একই তরিকায় ভয় পাবার পরে আর থাকা সম্ভব হয়নি তার, বলা যায় ডিরেক্টরসাহেবের হাতে পায়ে ধরে বদলি হয়ে যায় আরেকটা অপেক্ষাকৃত বাজে হাসপাতালে।
“ইন্টারেস্টিং,” বললাম আমি থুতনি ডলতে ডলতে। মনে মনে অবশ্য ভাবছি ডাক্তার শহীদ দিনে কয় ছিলিম গাঁজা টানতো, বা কয় বোতল বাংলা সাবাড় করতো। নিরস গলায় বললাম, “কি দেখে ভয় পেতো, সেটা বলেনি?”
“না, সেইটা কয় নাই,” মতি মিয়ার গলায় স্পষ্ট হতাশা। “তয় যাওয়ার আগে আমারে কয়া গেছিলো, তিনি এমন একটা কাজ করছিলো যেটা তার করা উচিত হয় নাই।”
“সেই কাজটা কি সেটা বলছিলেন?”
মতি মিয়া বলতে পারলো না। আরো কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে মতি মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, শুয়ে পড়বো এবার। কাল লম্বা ডিউটি আছে।
চলে আসবো, এমন সময় মতি মিয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “সাব, একটু সাবধানে থাইকেন হাসপাতালে। বহুদিন আছি আমি এইখানে, বহুত কিছু শুনছি—এই হাসপাতাল ভালা না।”
পরের দিন সকালে ওয়ার্ডে গিয়েই দেখি প্রতুল এক রোগির বেডের কাছে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে কিসব বলছে। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য কাছে এগিয়ে গেলাম।
“পাগলামি করবেন না তো!” প্রতুল ধমকের ভঙ্গিতে বলছে এক রোগিকে। “অপারেশন না করলে আপনি মরে যেতে পারেন, এটা বারবার বলার পরেও বুঝতে চাচ্ছেন না কেন?”
রোগির বাম পায়ে দগদগে গ্যাংগ্রিন। গন্ধে কাছে যাওয়াই কঠিন। মধ্যবয়ষ্ক লোকটা তবু চিঁ চিঁ করে বলছে, “অপারেশন তো করবেন বুঝলাম। কিন্তু সেই অপারেশনে যদি আমার পা আগের মতো ভালা হইয়া যাইতো, তাইলে এক কতা ছিল, কিন্তু ডাক্তার সাব, আপনে তো আমার গোটা পাওটাই কাইটা ফেলনের কথা বলতেছেন…”
রোগি বোকামি করছে অবশ্যই। পায়ের যে অবস্থা, আজকের মধ্যে অ্যামপুটেশন না করলে তাকে বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে রোগির সাথে হালকা কাউন্সেলিং করতে হয়। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রতুলের সাথে মিলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে-লোক কিছুতেই রাজি না, পা সে কাটবেই না। গাঁয়ের মোড়ল বা নেতা টাইপের কিছু ছিল বোধহয় সে, গোঁয়ার গোবিন্দ।
অন্য রাস্তা ধরলাম। রোগির অ্যাটেনডেন্টকে ডেকে আনলাম তার মেয়ে। মেয়েকে খানিকক্ষণ বোঝানোর পরে সরে এলাম। এবারে কাজ দেবার কথা।
দূর থেকে দেখছি, বাবা-মেয়ের মাঝে আবেগের খেলা চলছে। মেয়ে কান্নাজড়িত স্বরে কি যেন বললো লোকটাকে অনেকক্ষণ, কয়েক ফোঁটা চোখের জলও খরচ হলো, শেষে দেখলাম গ্যাংগ্রিনের রোগি কাঁদো কাঁদো চেহারায় মেয়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছে। এর খানিক বাদে মেয়ে আমাদের কাছে এসে বললো, তার বাবা আমাদেরকে ডেকেছে, কিছু বলতে চায়। খুশিমনে এগিয়ে গেলাম। মেয়ে অবশ্য আমাদের সাথে এলো না।
রোগির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। “আমার মেয়েরে কি বুঝাইছেন জানি না,” হলদে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো সে, “কিন্তু সে পাগল হইয়া গেছে আমার পা কাটনের লাইগা। পাগলি মাইয়া আমার, আপনারা উল্টাপাল্টা যা বুঝাইছেন তাই বুঝছে। বাপের পাও কার্টনের কথা কইতেছে! ঠিকাছে, পা আমি কাটামু। আপনে অপারেশনের জোগাড়যন্ত্র করেন। কিন্তু ডাক্তার সাব, কাজটা কিন্তু আপনে ভালো করলেন না। আমার পা এমনেই ঠিক হইয়া যাইতো। আপনে হুদাই আমার ভালো পা-টা কাটাইতেছেন।”
চলে আসার আগে শুনলাম রোগি আবার বললো, “কাজটা ভালো করলেন না, ডাক্তার সাব।”
লাঞ্চের সময় হাসপাতালের বাইরের পে-ফোন বুথে এসে ঢুকলাম। নিজেকে বোকাবোকা লাগছে, কিন্তু তবুও বহু কষ্টে জোগাড় করা একটা নাম্বার ঘোরালাম স্লটে কার্ড সেঁধিয়ে।
লং ডিসটেন্স কল, বহুক্ষণ লাগলো লাইন পেতে। যাকে চাচ্ছি তাকে পেতে সময় লাগলো আরো। পেলাম অবশ্য শেষতক। “ডাক্তার শহীদ বলছেন?” ওপ্রান্তে
হ্যালো শোনার পর বললাম।
“জি। আপনি…”
“আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার জায়গায় এসেছি অমুক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, তমুক ওয়ার্ডে। আপনার ব্যাপারে…”
“খুব সাবধান,” ঠান্ডা গলায় ওপাশের কন্ঠটা বললো। “ওয়ার্ডে খুব সাবধানে কাজ করবেন।”
থতমত খেয়ে বললাম, “মানে…”
“কোনো রোগি যদি কোনোকিছু করতে মানা করে, সেটা করবেন না। আপনার কাজটা যত দরকারিই হোক না কেন। আর তারপরও যদি করে ফেলেন, আর যদি…’
লাইনে খড়খড় শব্দ। ওপ্রান্তের কথা কিছু শোনা যাচ্ছে না। আমি আর্লি এইটটিজের কথা বলছি, ওখন এ-সব সমস্যা খুবই কমন ছিলো। “হ্যালো, হ্যালো’ করলাম।
আবার শোনা গেল ডাক্তার শহীদের কন্ঠ। “তাহলে হসপিটাল ছেড়ে চলে আসবেন। যে করেই হোক। না হলে কিন্তু আপনার বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। খুব সাবধানে থাকবেন, ওখানে আমি যা দেখেছি সেটা ব্যাখ্যার অতীত।”
লাইনে বিপ বিপ শব্দ। লাইন কেটে গেছে।
ফোন করতে আসার আগে নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো। আর ফোন করে ফেরার সময় নিজেকে মনে হলো মহা বোকা।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো আমার।
রাতের ডিউটি করছিলাম। ডিউটি স্টেশনে বসে ডেস্কে কখন মাথা ঠেকে গেছিলো, আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। এমনটা হয়েই থাকে রাতের ডিউটিতে—কারণ রাতে গোটা ওয়ার্ড চুপচাপ থাকে, রোগিরা ঘুমায়। ডাক্তারও তো মানুষ, তারও ঘুম আসে।
কিন্তু আসল ব্যাপার সেটা না।
গোটা ওয়ার্ডে চোখ বোলাচ্ছি অবাক হয়ে। কারেন্ট গেছে নাকি? কোনো লাইট জ্বলছে না কেন? ফ্যানগুলোও তো বন্ধ। পুরো ওয়ার্ডে কবরের নিস্তব্ধতা। আমি নিজের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি।
এদিক ওদিক তাকালাম। চারপাশে একধরণের আবছা আলো, হালকা বেগুনী রঙের। যেন ডিম লাইট জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডে তো কোনো ডিম লাইট নেই। ওয়ার্ডের বাতিও কখনো নেভানো হয় না-রাতেও না। তো আলোটা আসছে কোথা থেকে?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য গলা উঁচিয়ে একটা ওয়ার্ড বয়কে ডাক দিলাম। “এই মনসুর! মনসুর!”
কোনো সাড়া নেই।
আমার ঘুম ততক্ষণে পুরোপুরি কেটে গেছে। ডেস্কের পেছন থেকে বেরিয়ে এলাম। পা চালিয়ে হেটে গেলাম ওয়ার্ডের দরজা পর্যন্ত। বন্ধ ওটা। কোনোভাবেই খুলতে পারলাম না। ওয়ার্ডের জানালাগুলো কখনোই লাগানো হয় না। এখন সেগুলোও বন্ধ দেখছি
মেরুদন্ড বেয়ে কুলকুল করে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার।
ঝট করে ঘুরলাম। সবচেয়ে কাছে যে রোগিটা আছে তার বিছানার পাশে গিয়ে রেডিয়াল পালস দেখার জন্য হাত চেপে ধরলাম।
হাতটা বরফের মত ঠান্ডা, কাঠের মত শক্ত। পালসের নামগন্ধও নেই। মরিয়া আমি তবু পকেট থেকে টর্চ বার করে রোগির চোখে আলো ফেললাম। মরা ছাগলের মত ঘোলাটে চোখে কোনো পিউপিলারি রিফ্লেক্স নেই। লোকটা বহু আগেই মরে গেছে।
পাগলের মতো আরেকটা রোগি পরীক্ষা করলাম আমি। মরা। তারপর আরো দুটো। মরা। মরা।
গভির রাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে আটকা পড়েছি আমি। পঞ্চাশটা ডেডবডির সাথে।
ডাক্তার শহীদের সাবধানবাণী মনে পড়লো আমার।
আর সাথে সাথেই একটা শব্দ কানে এলো আমার।
থপ থপ থপ। থপ।
আমি মাথা ঘোরালাম। যা দেখলাম সেটা জীবনে ভুলবো না।
একটা…
একটা জিনিস হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে।
জিনিসটার একটা ধড় আছে-ইংরেজিতে টরসো বলে যাকে-তার সাথে সেলাই করে লাগানো দুটো হাত, আর দুটো পা। মাথা নেই। পা আর হাতের জয়েন্টেও সেলাই। ধড়টার পেটে-পিঠে অসংখ্য সেলাইয়ের দাগ, যেন অজস্র সার্জারির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
নরক থেকে উঠে আসা জিনিসটা হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমি নড়তেও ভুলে গেছি—গোটা শরীর অবশ। একটা পেশি নাড়ানোরও ক্ষমতা নেই আমার।
জিনিসটা আমার কাছে এসে থামলো। কাটা গলাটা উঠছে এখন আমার দিকে সোজা হচ্ছে জিনিসটা, দু-পায়ে দাঁড়াচ্ছে। হাত পা গুলো শুঁয়োপোকার মত এঁকেবেঁকে উঠছে ওটার প্রত্যেকটা নড়চড়ার সাথে সাথে। একটা নাড়িওল্টানো পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
জিনিসটা এখন সোজা হয়েছে। মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে এখন ওটা দু’পায়ে ভর দিয়ে।
ওটার মাথা নেই, কাজেই মুখ নেই। কিন্তু আমি পরিস্কার শুনলাম ওটা কথা
বলছে। কথা বলছে আমার সাথে।
“আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি।” একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছে ওটা। আমি কোনোমতে চোখ নামিয়ে জিনিসটার একটা পায়ের দিকে তাকালাম। পচা, গ্যাংগ্রিন ধরা একটা পা। এই পা আমি চিনি। প্রফেসরসাহেব আজকে বিকেলে এই পা-টা কেটে বাদ দিয়েছেন অনিচ্ছুক এক রোগির থেকে। আমি অপারেশনের সময় ছিলাম।
রোগিকে নিমরাজি করেছিলাম আমিই।
ডাক্তার শহীদের সাবধানবাণী মনে পড়লো-কোনো রোগি যদি কোনোকিছু করতে মানা করে, সেটা করবেন না।
“কালকে মাথা চাই। কালকে মাথা দিবি। আমাকে মাথা দিবি। আমাকে মাথা দে। আমাকে মাথা দে। আমাকে মাথা দে দে দে দে দে…”
জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের বেডেই। ভোরের দিকে এক ওয়ার্ডবয় আমাকে মেঝেতে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিল।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালাম। জানি, এজন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক জবাবদিহিতা করতে হবে আমাকে, অনেক শো-কজ করতে হবে-কিন্তু আমি পরোয়া করি না। আগে জানটা বাঁচাই। আর কখনো ওই হাসপাতালে ফেরত যাইনি আমি।
ডা. আলতাফুর রহমান নাহিদ থামলেন। কপালে হালকা ঘাম তার।
“তাহলে ওই জিনিসটা-” বলতে শুরু করলাম আমি, কিন্তু ড. আলতাফ থামিয়ে দিলেন আমাকে।
“আমার কাহিনী এখনো শেষ হয়নি,” ভারি গলায় বললেন ডাক্তারসাহেব। “আমি চলে আসার তিনদিন পরে সংবাদপত্রে একটা খবর দেখি-সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নিহত।
আমি কোনো কথা না বলে ডাক্তারসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
“নিহতের নাম প্রতুল কুমার রায়। অ্যাক্সিডেন্টে ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।”
আমি এবারও কিছু বললাম না।
“খোঁজ নিয়ে শুনেছিলাম, মর্গে প্রতুলের লাশের দুই টুকরোই আনা হয়েছিল বটে, কিন্তু দাহ করার সময় চিতায় ছিলো শুধু ধড়টা। প্রতুলের মাথাটা মর্গ থেকে হারিয়ে যায়।”