অধ্যায় ১১ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কবে অমাবশ্যা, কবে পূর্ণিমা—এসবের খবর আমি কখনোই রাখতাম না। কিন্তু সেদিন রাতে বাংলোর বাইরে বেরিয়েই মনে হলো, আজ অমাবশ্যা। আকাশের দিকে একবার তাকানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। একটা ছোট্ট চাঁদ আছে বটে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদম শেষ। কালই নিশ্চয়ই অমাবশ্যা।
কালিগোলা অন্ধকার চারপাশে, সেটা ফুঁড়ে যাবার বৃথা চেষ্টা করছে আমাদের চারটে টর্চের আলো। আমিই সবার সামনে। রাইফেলটা আপাতত ঝুলিয়ে রেখেছি কাঁধে।
বাংলোর চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে মুশকিলে পড়ে গেলাম। কোনদিকে কি-কিছু বুঝতে পারছি না। এই গ্রামে এসেছি মাত্র একদিন হলো-এর মাঝে রাস্তাঘাট চিনেছি যৎসামান্য, আর এখন তো ঘুটঘুটে আঁধার।
মাথা ঘুরিয়ে মফিজ দারোগাকে জিজ্ঞেস করতে যাবো, তার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো সে, “এই দিকে। এই দিকে আসেন। আমার পেছনে।” সরে জায়গা করে দিলাম আমি তাকে সামনে যাবার।
তার পরের দশ মিনিটে শুধুই মফিজ দারোগার ছুটে চলা, আর তার পেছন পেছন আমরা। কাজটা মোটেই সহজ নয়। মফিজ দারোগা দশাসই শরীর নিয়ে হড়বড়িয়ে ছুটছে, আর তার পেছন পেছন এবড়োথেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে আমরা তিনজন।
শিপলুকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, “কোনো শেয়াল মানুষকে কামড়ে টেনে নিয়ে যেতে পারে না!”
যখন কেবল ভাবতে শুরু করেছি এই দৌড় কোনোদিন শেষ হবে কিনা, এমন সময় চোখে পড়লো দূরে হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন গ্রামবাসি। কি করবে বুঝতে না পেরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, চোখে মুখে তীব্র আতঙ্কের ছাপ। আমাদের দলবলকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরলো লোকগুলোর।
হ্যারিকেন ওয়ালাকে চিনতে পারলাম, আজকে চায়ের দোকানে পরিচয় হওয়া ইদরিস আলী। “এইদিকত্!” আমরা কাছাকাছি যেতেই উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সে। “এই দিকে দিয়ায় নিয়া গেইছে জঙ্গলের দিক!”
“শিওর তো?” আমি বলে উঠলাম। একশোভাগ নিশ্চিত হবার আগে জঙ্গলের দিকে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই এই নিশুতি রাতে।
“হ হ!” সজোরে মাথা ঝাঁকালো ইদরিস আলী। “সিদ্দিক পায়খানা কইরবার বাইর হছিলো, বাড়ির পেছনোত কেবল গেইছে, আর নাই ধরি ফেলাইছে! সিদ্দিক কেবল একটা চিল্লান দিবার পারছে। সেটা শুনিয়া সিদ্দিকের বউ চিল্লানি শুরু করছে, তার পর হামরা ঘর থাকি বাইর হছি। হারিকেনখ্যান নিয়া কেবল দৌড় দিছি, আন্ধারের মধ্যত কোনোমতে দেখনু কি বা অ্যাখান জিনিস, বাঘের মতন বড়, খয়ের জর্দার মতন অং. সিদ্দিকের গলা কামড়ে ধরিয়া…” আর বলতে পারে না ইদরিস আলী, ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ বের হয় না ভয়ে বিবশ গলা থেকে।
ইদরিস আলীরা যেদিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সেদিকে টর্চের আলো ফেললাম আমি, আর সাথে সাথে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার পিঠ দিয়ে। জঙ্গলের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে আমরা। একটু পরেই ঝোপঝাড় শুরু, সেগুলো পেরিয়ে নিরেট অন্ধকারে ছাওয়া জঙ্গলটা। ইদরিস আলীরা কেন আর না এগিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে এতক্ষণ যাবত ভয়ে কাঁপছে, সেটা বোঝা হয়ে গেল আমার।
জঙ্গলে ঢুকতে বাধ্য হবার আগে মরিয়া আমি শেষ একটা চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম। “আপনারা শিওর তো, জঙ্গলের দিকে গেছে? জঙ্গলের পাশের ভুট্টার খেতটাতে নিয়ে যায়নি তো, যেটাকে আপনারা খালিভিটা বলেন?”
ভয়ার্ত গ্রামবাসি অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে। ইদরিস আলীর পেছনের মুখচেনা একজন বলে, “হামরা তো আন্ধারের মধ্যত অত বুঝবার পারি নাই বাহে। এই জায়গা পর্যন্ত আসিয়াই আমরা শ্যাষ।”
“এইখান থাকি দুই জাগাতেই যাওয়া যাইতে পারে,” মফিজ দারোগা কপালের ঘাম মুছে বললো।
“পারে, কিন্তু যদি সেটা জঙ্গলের ভেতরে হয়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই,” শীতল গলায় বললাম আমি।
“তার মানে?” হুংকার দিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। এতক্ষণ বোধহয় ভয়ের কারণেই আসল রূপটা চুপসে গিয়েছিল লোকটার, এখন ধীরে ধীরে আসল মফিজ দারোগা ফিরে আসছে।
“মানে হচ্ছে, এই রাতে ওই জঙ্গলে ঢোকা সম্ভব নয়, কারণ—” ঠান্ডা গলায় থেমে থেমে বলতে শুরু করলাম আমি।
“আপনাক এইখানে আনা হইছে কেন!” আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীব্র ঘৃণায় চোখ বোলালো মফিজ দারোগা। “আপনার যে কাজ সেইটা আপনাক করাই লাগবে! জঙ্গলে যাবেন না মানে! একশো বার যাইতে হইবে!”
“না জেনে উজবুকের মত কথা বলবেন না!” দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলাম আমি, রাগে জ্বলে যাচ্ছে গা। “এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে জঙ্গলে ঢুকে নিজের প্রাণটা খোয়াবো নাকি? পৃথিবীর কোনো শিকারিই এই পরিস্থিতিতে ওখানে যাবে না। আর আমি যদি এখন যাইও, সাথে করে আপনাদের সবাইকে নিয়ে যেতে হবে, কারণ বেশি লোক না থাকলে জানোয়ারটা ভয় পাবে না। আর তখন সেই আঁধারে কি থেকে কি হয়ে যাবে বলা তো যায় না-হয়তো দেখা গেল আমাদেরই কারো খুলি উড়িয়ে দিলাম ভুলে, হয়তো আপনারই!”
মফিজ দারোগার চেহারা তীব্র রাগ আর ঘৃণায় যেন কুৎসিত একটা মুখোশের আকার ধারণ করেছে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, ঠোঁটদুটো পেছনে সরে গিয়ে হলদেটে দাঁত আর কালচে মাড়ি বেরিয়ে এসেছে। এক সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হলো লোকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়েই পড়বে কিনা। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিলো সে। জানতাম এমনই হবে। বুদ্ধিমান লোক সে জানে আমার কথাই এই মুহূর্তে শুনতে হবে তাকে।
“সবাই মাথা ঠান্ডা রাখেন! মাথা ঠান্ডা!” একটা হাত সামনে তুলে আমার আর মফিজ দারোগার মুখের দিকে চাইলো শিপলু
“মাটিতে ট্রেইল দেখলেই তো হয়-” সামাদ বলে উঠলো, “ওনারাই তো বললো, ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে গেছে, মাটিতে দাগ পড়তে বাধ্য।”
এই সহজ কথাটা মাথায় আসেনি কেন আমার? ডিনারের পরে দুই পেগ গিলেছি বলেই?
“সামাদ ঠিক বলেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললাম আমি। কাউকে কিছু বলতে হলো না, সবাই সরে দাঁড়ালো, আর সব ক’টা টর্চের আলো গিয়ে পড়লো মাটির দিকে।
আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানটায় আমাদের পায়ের ছাপ ছাড়া অন্য কিছু পাবার আশা করাটা বাতুলতা। কয়েক পা এগিয়েই অবশ্য পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। পথের ধারের মিহি ধুলোর ওপরে বড় কিছু টেনে নিয়ে যাবার দাগ। লালচে দাগও দেখা যাচ্ছে, রক্তের ফোঁটা পড়েছিল ওখানটায়, শুষে নিয়েছে ধুলো। সবকিছু যেন সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের দেখার জন্যই। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো আমার, ভয়ে নয়, উত্তেজনায় নয়, অন্য কোনো কারণে।
ট্রেইলটার ওপরে আলো ফেলে কয়েকফুট যেতেই বুঝতে পারলাম কোনদিকে গেছে ওটা। জঙ্গলের দিকে নয়, জঙ্গলের সামনের পতিত ভুট্টাজমিটায়, খালিভিটা বলে যেটাকে। একাত্তরের বধ্যভূমি।
“জলদি!” বললাম আমি, নতুন উৎসাহে এগিয়ে চললাম সামনে। আমার পেছনে বাকি তিনজন। গ্রামবাসিরা আর এগোনোর সাহস পায়নি, দাঁড়িয়ে আছে ওখানেই।
আরো কিছুদূর যাবার পরেই কিন্তু ট্রেইলটা হারিয়ে ফেললাম। একটা পরিত্যাক্ত ধানখেতে, বলা ভালো ধানখেতের ধ্বংসস্তূপের মাঝে এসে ঢুকেছে ওটা। এখানে খানিকটা জায়গায় ধানের চারা লাগিয়েছিল হয়তো গ্রামের ভূমিহীন কোনো বাসিন্দা, সে গাছ বড় হয়ে তাতে ধান এসেছিলো, পেকেওছিলো, কিন্তু কেটে নিয়ে যাওয়া আর হয়নি রহস্যময় জানোয়ারের ভয়ে। এখন বাকি আছে শুধু শুকিয়ে দমকা হাওয়ায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া হাটু সমান উঁচু ধানখেত।
বাঁকাচোরা মরা ধানগাছগুলোর মাঝ দিয়ে কোনোকিছু গেছে কিনা বলা মুশকিল, তবু একটা জায়গায় আলো ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা, “এইদিকটা দেখেন তো! একটু অন্যরকম লাগতেছে!”
এগিয়ে গিয়ে আলো ফেললাম আমি। হ্যা, এইদিক দিয়ে ভারি কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিশ্চিত, আর রক্তের দাগও আছে একটা। ধন্যি বটে মফিজ দারোগার চোখ। আরেকবার আমার কলজেটা লাফিয়ে উঠলো-আর সেটা ভয়ের কারণে নয়।
একবার ট্রেইল খুঁজে পাবার পরে আর এগিয়ে যেতে সমস্যা হলো না। সামনে আলো ফেলে দেখলাম, ধানখেত পেরিয়ে সামনের মরা ভুট্টার খেতের মাঝে ঢুকেছে ট্রেইলটা। যেদিক দিয়ে ঢুকেছে সেদিকে বিশাল এক ফাঁক। কপালে ঠান্ডা ঘাম ফুটলো আমার। ভুট্টা গাছগুলো ছয়-সাত ফুট উঁচু। ওগুলোর মাঝে ঢোকা আর জঙ্গলের মাঝে ঢোকার মাঝে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
আমি ভুট্টার খেতে ঢোকার আগ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘুরলাম পেছনে।
শিপলু প্রফেশনাল স্টাইলে কাঁধের কাছে ধরে আছে টর্চটা, ওর চশমার দুই কাঁচ যেন ফসফরাসের মত জ্বলছে। সামাদের গম্ভির মুখ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই ওর মনের ভেতর কি চলছে। মফিজ দারোগা দরদর করে ঘামছে। হোলস্টারে হাত দিলো সে, বের করে আনলো রিভলভারটা। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো আমার।
“ওয়েল, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো,” বিড়বিড় করলাম আমি। “একটা বন্দুকের চাইতে দুটো ভালো। আমিই সামনে থাকবো। মফিজসাহেব আমার বামে থাকবেন, পেছনে না, পাশে। শিপলু, সামাদ, তোরা দু-পাশে চোখ রাখবি।”
আমার টর্চটা নিভিয়ে ফেললাম, রাইফেলটা তুলে নিলাম কাঁধে। আমার বামে মফিজ দারোগা, এক হাতে টর্চ, আরেক হাতে রিভলভার।
ঢুকে পড়লাম ভুট্টাখেতের ভেতরে।
সাথে সাথেই প্রবল অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করলাম।
আমি নিজে প্রায় ছয়ফুট লম্বা, কিন্তু ভুট্টাগাছগুলো আরো এককাঠি সরেস। যেদিকে চোখ চালাচ্ছি, সেদিকেই সারি সারি শুকনো ভুট্টাগাছ। সেগুলোর ভেতর দিয়ে টর্চের আলো গিয়ে হাজারটা ছায়া নাচানাচি করছে পেছন দিকে, কোনটা একটা নির্দোষ মরা ভুট্টাগাছের ছায়া আর কোনটা রক্তলোভি একটা পিশাচ, বলা কঠিন। ভুট্টাগাছগুলো বহু আগেই কেটে ফেলার কথা, কিন্তু পিশাচের উপদ্রব শুরুর পরে এ- মুখো আর হয়নি কেউ। শুকনো ভুট্টাগাছগুলোকে দেখাচ্ছে মিশরের ফিতে খোলা মমির মত। ভুট্টাগুলো পেকে দানা খসে পড়েছে, দানাবিহীন ভুট্টার কঙ্কালগুলো যেন এই অভিশপ্ত গ্রামের উপযুক্ত মুখপাত্র।
অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছি আমরা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভুট্টাগাছগুলোর মাঝের ফাঁকটা তেমন বড় না, পাশাপাশি দু-জন চলাই কঠিন। আমাকে আর মফিজ দারোগাকে প্রায় গা ঘেঁষে হাটতে হচ্ছে।
আর কয়েক পা যাবার পরেই তীব্র এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। হতভম্ব আমি থমকে দাঁড়াতেই আরেক ঝলক হাওয়া। থামলো না ওটা, বইতেই থাকলো আমার হাঁড়-মাংস কাঁপিয়ে দিয়ে।
“কি ব্যাপার? থামলি কেন?” আমার পেছন থেকে বলে উঠলো শিপলু।
“বাতাসটা টের পাচ্ছিস না?” আমি কোনোমতে দাঁতের খটখটানি থামিয়ে জবাব দিলাম।
এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো শিপলু, যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে, তার পরেই একটু অনিশ্চিতভাবে বললো, “হ-হ্যা।”
আমি মুখ ঘোরালাম সামনে। ঠান্ডায় দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে আমার, হাত জমে আসছে। কিন্তু আমি আর টু শব্দটাও করলাম না এটা নিয়ে।
আর দু-পা এগোনোর পরপরই শুনতে পেলাম ফিসফিসানির শব্দ। যেন দূরে, বহু দূরে ফিসফিস করছে কেউ, আর আমার কানে আবছাভাবে আসছে সেটা।
ঢোক গিললাম আমি। সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন-জঙ্গলের মাঝে যা যা অনুভব করেছিলাম, সব যেন ফিরে আসছে।
সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে ট্রেইলটা, টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে থেমে গেলাম আমি। দুটোর যে কোনোটাতে যেতে পারে সিদ্দিককে টেনে নিয়ে যাওয়া জানোয়ারটা।
“এখন?” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো মফিজ দারোগা।
“মাটিতে আলো ফেলুন,” বললাম আমি, ঠান্ডার চোটে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে।
মাটির দিকে ঘুরে গেল সব ক’টা টর্চ। সবখানে ছড়িয়ে আছে ভুট্টার ঝরে পড়া শুকনো পাতা আর বাকল। সেগুলোর ওপর বিশেষ কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। না রক্তের দাগ, না অন্যকিছু।
“দু-দিকই চেক করতে হবে,” বললাম আমি, রাইফেলটা নামিয়ে রাখলাম আমার পায়ের সাথে হেলান দিয়ে। তার বদলে পকেট থেকে বের করে আনলাম চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা। কাঁপা হাতে ছিপি খুললাম। আগে হাতের কাঁপুনি থামাতে হবে আমার, নইলে বিপদে পড়বো চারজনই। সিদ্দিকের কথা ভাবছি না, তাকে এর মাঝেই ফেলে দিয়েছি খরচের খাতায়।
আমি বড় দুই ঢোক হুইস্কি গেলার সময় আগুনে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো মফিজ দারোগা। কিন্তু কিছু বলার সাহস হলো না তার, সম্ভবত পরিস্থিতির কারণেই। সামাদ কিছু বললো না, কমনওয়েলথের বাছাইয়ের সময় আমি কেমন সময়ের মাঝ দিয়ে গেছি, সেটা ওর দেখা আছে।
ফ্লাস্কটা পকেটে পুরে রাইফেলটা তুলে নিলাম আমি আবার। শরীর গরম হয়েছে খানিকটা, হাতের কাঁপুনি কমতে শুরু করেছে। কেবল ফিসফিসানিটা একই রকম আছে। বরং বাড়ছে।
“দুটো দলে ভাগ হয়ে যাই আমরা। শিপলু, আয় আমার সাথে। দারোগাসাহেব, আপনি সামাদের সাথে যান। দুই দলেই একটা করে বন্দুক থাকলো তা হলে,” বললাম আমি, কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বামের ট্রেইলটা ধরে এগিয়ে গেলাম।
আমার পেছনেই রইলো শিপলু। ওর ভারি শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনোকিছু শোনা যাচ্ছে না।
“আমি রাইফেলটা কোনদিকে তাক করে রাখি সেটা লক্ষ্য রাখ।” ফিসফিস করে বললাম আমি আমার নিজের কানের ফিসফিসানি ছাপিয়ে। “টর্চের আলো সেইদিকে ফেলবি।”
“গট ইট,” বিড়বিড়িয়ে বললো শিপলু।
যত যা-ই বলুক, শিপলু কিন্তু টর্চের আলো সোজা রাখতে পারছে না। আমার কাঁধের পাশ দিয়ে দিয়ে গিয়ে নাচানাচি করছে আলোর বীমটা সামনে, ভুট্টার গাছগুলোর মাঝের আলো-আঁধারী বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঠান্ডা লাগছে আমার। খুব ঠান্ডা লাগছে।
যতই সামনে এগোচ্ছি, ফিসফিসানির শব্দটা বাড়ছে। এইমাত্র তার সাথে যোগ দিলো একটা ভনভনানির শব্দ। যেন অনেকগুলো মাছি উড়ছে কোনো পচা লাশকে ঘিরে।
সামনে অনেকটা জায়গা যেন ফাঁকা, আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি আমি। হয় ওখানে একটা গণকবর আছে, ভুট্টাগাছ লাগানো হয়নি, না-হয় ভুট্টাগাছগুলো মাটিতে পড়ে গেছে কোনো কারণে। আর ওদিকেই নিয়ে চলেছে আমদেরকে ট্রেইলটা।
আমার দুইকানে ফিসফিসানিটা বাড়তে বাড়তে এখন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে, কিন্তু তার মাঝেও খচমচ শব্দ শুনলাম একটা।
কিসের শব্দ ওটা?
কেউ হাটছে ভুট্টাগাছগুলোর মাঝ দিয়ে?
নাকি শিকারের হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে আনছে একটা পিশাচ?
এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি ফাঁকা জায়গাটার দিকে। এখন খুব অল্প অংশই দেখতে পাচ্ছি জায়গাটার, ট্রেইলটা শেষ হয়ে ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে হাজির হবার আগে এর বেশি চোখে পড়বে না।
“আলোটা স্থির রাখবি,” শিপলুকে বললাম আমি। নাকি নিজেকেই বললাম নিজের হাত সোজা রাখতে? প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মত ঠান্ডা হাওয়া হু-হু করে আসছে সামনের দিক থেকে।
আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আর এক পা এগোলেই এসে পড়বো ফাঁকা জায়গাটায়। ফিসফিসানিটা একটা আকার পাচ্ছে যেন এখন। কি যেন বলতে চাচ্ছে। কি যেন বোঝাতে চাচ্ছে।
একটা ভুট্টা গাছ সামনে ঝুঁকে ছিলো, সেটা রাইফেলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সাবধানে সামনে বাড়লাম আমি। শিপলু ঠিক আমার পেছনেই, টর্চের আলো ফেললো ও সামনে।
ভুট্টাগাছগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গাটা বিশ ফুট বাই বিশ ফুট হবে। শিপলুর টর্চের আলো সেটার অন্ধকার দূর করতে পারছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে যে জিনিসটার ওপর টর্চের আলো পড়েছে, সেটা ছাড়া আর কোনো কিছু দেখার নেই ওখানটায়।
সিদ্দিকের সাথে আজকেই দেখা হয়েছে। চায়ের দোকানে আজকেই কথা হয়েছে তার ব্যাপারে, কিভাবে পাশের গ্রামের বাতেনের বউকে বাচ্চাসহ ভাগিয়ে এনেছিল সে। মনে পড়ছে, তার সৎ ছেলে পিশাচের হাতে মরার ব্যাপারে যখন তার বউয়ের সাথে কথা বলার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন কিভাবে চোখ সরু করে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলো সরু গোঁফওয়ালা কালো লোকটা।
এখনো সেই চোখগুলো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, কিন্তু সেই চোখে এখন তীব্র আতঙ্কের ছাপ, যেন নিজের মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখেছিল সে মরার আগমুহূর্তে।
সিদ্দিক পড়ে আছে খোলা জায়গাটার মাঝে, হাত-পা ছড়ানো, রক্তে মাখামাখি পুরো শরীর। পরনে লুঙ্গি নেই, খুলে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই টেনে আনার সময়। গলা আর কাঁধ ছিন্নভিন্ন। একই অবস্থা দু-পায়ের মাঝের জায়গাটার-কেউ যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে লোকটার পুরুষাঙ্গ, গোড়া থেকে।
লাশটার পাশে দাঁড়ালাম আমি, একবার চিন্তা করলাম লোকটার পালস চেক করবো কি না, কিন্তু স্থির হয়ে থাকা খোলা চোখগুলো…
একটা খচমচ শব্দে চোখ তুললাম আমি, ভুট্টা গাছ মাড়িয়ে কেউ আসছে এদিকেই। টর্চের আলো। মফিজ দারোগা আর সামাদের ট্রেইলটাও এখানেই এসে ঠেকেছে দেখছি।
আমি মুখ খুলে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম, পারলাম না, তার আগেই আমার মুখের ওপর গর্জে উঠলো মফিজ দারোগার রিভলভার।