অধ্যায় ১০ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
ভেবে রেখেছিলাম, দুপুরের খাবার সারার পরে দুটো থেকে চারটা পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নেব। কিন্তু বিছানায় গড়গড়িই সার হলো, ঘুম আর ধরে না। শেষে আর না পেরে বারান্দায় এসে পড়লাম। বারান্দায় কাঁচা সোনার মত ঝলমল করছে বিকেলের রোদ, আর তার মাঝে দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছে শিপলু আর সামাদ। গলা নামিয়ে কি নিয়ে যেন গুজগুজ করছিল ওরা, আমাকে দেখে সোজা হলো। আমি পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। মাথাটা ভার ভার হয়ে আছে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
শিপলুর হাতে একটা সিগারেট, সেটায় একটা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো ও। ওর চশমার দুই কাঁচে হলদে আলো পড়ে চমকাচ্ছে। “এমনটা হয় অনেক সময়। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঘুম আসতে চায় না মানুষের।”
“মে বি।” আমজাদ আলীকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিলাম আমি।
“সো, তখন হলোটা কি?” আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো শিপলু। “গেলি… মন্দিরটা চোখে পড়লো, তারপর?”
সকালের ঘটনার পরে জঙ্গল থেকে বের হয়ে ভেতরে কি দেখেছি সেটা নিয়ে বেশি আলোচনা করিনি আমি, ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই ছিল না তখন। সোজা বাংলোতে চলে এসেছিলাম। এখনও যে সেই গা শিরশিরে অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব বেশি খোঁচাখুঁচি করার ইচ্ছে আছে আমার, তা না, কিন্তু না বলাটা খুব বেশি উদ্ভট হয়ে যাবে। কাজেই বললাম যতটুকু পারি, অবশ্যই ফিসফিসানি, ভনভনানি আর ঠান্ডার কথা বাদ দিয়ে।
“গুলি করলি, তা-ও কিছু হলো না?” চকচকে চোখে বললো শিপলু। বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো, এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিল।
“মিস করেছি,সন্দেহ নেই,” দুই হাতের তালু উল্টে বললাম আমি। “ওখানে দারুণ অন্ধকার ছিলো। কেবল শেয়ালটার চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম, আঁধারে জ্বলছিল, আর ওটার দাঁত, আবছাভাবে।”
“ওটার সাইজ বুঝতে পেরেছেন?” খসখসে গলায় প্রশ্ন করলো সামাদ।
মেরুদন্ড দিয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি বয়ে গেল আমার। মন্দিরের ভেতর আবছাভাবে দেখা জানোয়ারটার বিশাল সাইজের কথা মনে পড়ে গেছে। অত চওড়া কাঁধ কোনো শেয়ালের হয় না। কোনো শেয়ালের দুই চোখের মাঝখানে অতটা দূরত্ব থাকে না। নিজেকে যতই ফাঁকি দেবার চেষ্টা করি না কেন, আমি জানি ওটা শেয়াল নয়। আমি জানি না ওটা কি, তবে কোনো শেয়াল নয়। এতটুকু নিশ্চিত
“হ্যা, আবছাভাবে,” ইতঃস্তুত করে বললাম আমি। “বেশ বড় শেয়াল। এত বড় আগে কখনো দেখি নি। বেশ অন্ধকার ছিলো তো ওখানে।”
মুখ দিয়ে পটাপট কয়েকটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লো শিপলু উত্তম কুমারের ভঙ্গিতে। “তো, শেয়াল। র্যাবিস। শেয়ালটা আর কতদিন বাঁচবে মনে হয়, সামাদ?”
“এখনো যে বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্য,” খসখসে গলায় বললো সামাদ। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো।
“তাহলে, শেয়াল শেষ, সোনার বাংলাদেশ,” সিগারেটের নিঃশেষিত গোড়াটা ফেলে দিয়ে মাথার পেছনে দুই হাতের তালু ঠেকিয়ে আরামসে হেলান দিলো শিপলু। “বাকি সময়টা কি করি?” তারপর নিজেই জবাব দিলো হাসিমুখে, “আর কি? গ্রামে একটু ঘুরি, কে কে মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে সে বিষয়ে একটু ডাটা কালেক্ট করি, লেখার খসড়া সাজিয়ে ফেলি, তারপর আরো কিছুদিন ঘুরেটুরে ঢাকায় ফেরত যাই।” মস্ত একটা হাই তুললো ও কথা শেষে
কিন্তু আমি যে ওর মত রিল্যাক্সড হতে পারছি না, কারণ আমি, আমি জঙ্গলে ঢুকেছিলাম, ওই প্রাচীণ মন্দিরে ওই ভয়ংকর জিনিসটার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি জানি ওই জিনিসটা র্যাবিসে মরবে না। আমি জানি এই অভিশপ্ত গ্রামে আমাদের কাজ শেষ হওয়া এখনো অনেক, অনেক বাকি।
“তা আপনারা দু-জনই শুধু এই বাড়িতে থাকতেন?” মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসা শিপলু পান চিবুতে চিবুতে বললো। ওর সামনের পিঁড়িতে আড়ষ্টভাবে বসতে বসতে মাথায় ছেঁড়া আঁচলটা তুলে দিল অমিছার মা। প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বললো, “হ।”
পাঁচটা বাজতে চললো। আমরা এই মুহূর্তে খালিভিটার সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা, সেটায়। যদি এটাকে বাড়ি বলা যায় আরকি। গ্রামের সব বাড়ি জঙ্গল থেকে যথাসম্ভব দূরে কাছাকাছি ঘেঁষে বানানো, কিন্তু এই কুঁড়ে ঘরটা তাদের থেকে অনেকটাই দূরে, জঙ্গলের বেশ কাছাকাছি। বাড়ির হাল দেখে জসীমউদ্দীেেনর আসমানীদের বাড়ির কথা মনে পড়লো। খড়ের তৈরি বাড়িটা এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে রহস্য সমাধানের জন্য শার্লক হোমসকে ভাড়া করা যেতে পারে। বাড়ির আশপাশে অবশ্য বাঁশের কঞ্চি আর শুকনো কলাপাতা দিয়ে আব্রু রক্ষার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটায় এখন বেড়ালের পা পড়লেও ভেঙে যাবে।
“আপনার স্বামি কি করতেন?”
“জমিত্ কামলা খাটতো।”
“এন্তেকাল করলো কবে?”
“অমিছা হওয়ার পরের বছর।”
“তারপর থেকে আপনারা এখানে একাই থাকতেন?”
“হ। হামার তিনকুলত আর কেউ আছিলো না বাবা।”
“অমিছার বিয়ে দেবার কথা তো ভাবতেছিলেন, না খালা?”
“হ। ওপাকের বেণীপুর গেরামের সালাম মিয়ার বেটা আবুলের সাথে বিয়ার কতা হছিলো।”
“অমিছাকে যেদিন…মানে ধরলো আরকি, সেইদিনের ব্যাপারটা একটু বলতেন।”
একইভাবে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চাকে কিভাবে ‘পিচাশ’ নিয়ে গিয়েছিল, সেটা জানতে সিদ্দিকের বাড়িতেও যাওয়া হলো। আমার একটু খটকা লাগছিলো, সবাই সিদ্দিকের বাচ্চা না বলে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চা বলছিলো কেন, কিন্তু সবার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। সিদ্দিকের বউয়ের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বাচ্চাটা ছিল আগের পক্ষের স্বামির। বাচ্চাটাকে হারিয়ে এখন সিদ্দিকের বউ পাগলপ্রায়। সিদ্দিক লোকটাকে অবশ্য খুব সেয়ানা মনে হলো। মিশমিশে কালো রং, শক্তসমর্থ চেহারা, নাকের ওপরে সরু গোঁফ। শিপলু যত না প্রশ্ন করলো, সে করলো তার চাইতে বেশি, আর গোটা সময়টা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে।
বাকি থাকলো আরেক ভিক্টিম-চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে। চেয়ারম্যানসাহেবের বাড়িতেও যাওয়া হলো। গোটা গ্রামের মাঝে এই বাড়ির অবস্থাই সবচেয়ে ভালো, আধা পাকা। চেয়ারম্যানসাহেব অতি বৃদ্ধ, কিন্তু খুব ভালো লোক। আমাদের অনেক যত্ন-আত্তি করালেন, কিন্তু সেসবের বর্ণনা এখানে দেয়া অবান্তর। বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসালেন আমাদের, এখানে এটাই বোধহয় রীতি, তারপর অনেক গল্প করলেন ছেলের ব্যাপারে, শিপলুকে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। ছেলেকে নিয়ে অনেক দুঃখ করলেন, মানুষ করাতে পারেননি তিনি তাকে। অন্য ছেলেরা বড় বড় পাশ দিয়ে শহরে চাকরি করতেছে, আর ছোট ব্যাটাটা কিনা খারাপ সঙ্গে পড়ে নেশা করা, জুয়া খেলা শিখলো! একেবারে উচ্ছন্নে চলে গিয়েছিলো, কারো কথা শুনতো না, জেলেও গিয়েছিল কয়েকবার, মেয়েদেরকে বিরক্ত করতে গিয়ে পিটুনি ও খেয়েছিলো, বাসার সবার সাথে খুব খারাপ আচরণ করতো, অনেক রাতে বাসাতেই ফিরতো না। আর সেজন্যই, খালিভিটাতে ঘুরতে গিয়ে যখন নিখোঁজ হলো, তখন প্রথমে কেউ কিছু সন্দেহই করেনি। আসল ব্যাপারটা টের পাওয়া গেছিলো দুই দিন পরে। সবকিছু বিস্তারিত বলে-টলে বৃদ্ধ চেয়ারম্যান কাঁদতে শুরু করলেন, দীর্ঘ সাদা দাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু।
চলে আসার আগে আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন চেয়ারম্যানসাহেব। “আপনার বাবার নামটা কি, শিকারিসাহেব?” আমি জবাব দেবার পরে তিনি কান্নাভেজা চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। গোটা ব্যাপারটার কোনো মানে বুঝলাম না।
তিন ভিক্টিমের ব্যাপারে তথ্য নেয়া শেষে বাজারের দিকে হাটা দিলো শিপলু। “আজ হাটবার,” বললো ও। “গ্রামের হাটের একটা আলাদা একটা ফ্লেভার আছে। না দেখলে মিস করবি।”
“শুধু হাট দেখবার জন্য আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস না নিশ্চয়ই।”
“আলবত না। গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে। এই কেসের ব্যাপারে তো বটেই, আরো কোনো নতুন কেসের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখবো—কারণ ঢাকায় তো ফিরছি না এত তাড়াতাড়ি।” শিপলুর গলায় উৎসাহের সুর।
“এই কেসটা নিয়ে তো অনেক বড় একটা স্টোরি হবে, তাই না শিপলু ভাই?” সামাদের প্রশ্ন।
“রাইট!” চোখ চকচক করছে শিপলুর। “বড় মানে আক্ষরিক অর্থেই বড়। মাসিক হালচালের ছিয়ানব্বই পেজের মধ্যে বত্রিশ পেজ আমাকে দিতে হবে-সম্পাদক পাগলা হাফেজকে বলে রেখেছি আমি। খুশিতে বগল বাজাচ্ছে পাগলা হাফেজ। গ্রামের ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রত্যেকটা ভিক্টিমের খুঁটিনাটি, ভিক্টিমের পরিবারের সাক্ষাৎকার, সাথে ছবি তো থাকছেই…” গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা দেখালো ও। “মেগা স্টোরি!”
“কিন্তু রহস্যময় জন্তু?” সামাদের প্রশ্ন। “সেটার ব্যাপারে কি লিখবেন?”
“আমরা তো খুব বড় গলায় বলছি ওটা র্যাবিসে আক্রান্ত শেয়াল,” ডিপ্লোম্যাটিক গলায় বললো শিপলু, “কিন্তু দেখো—সেটার সপক্ষে কোনো প্রুফ পেয়েছি কি? এই যে আমাদের জামশেদ সবচেয়ে বেশিবার দেখেছে ওটাকে দু-বার। এমনকি সে -ও কি শিওর ওটা কি? জামশেদ?”
“না,” বলতে বাধ্য হলাম। মন্দিরের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যাওয়ায় এই সোনালি বিকেলও কেমন শিরশির করে উঠলো গা-টা।
“তাহলেই দেখো। তাছাড়া গ্রামেরও কেউ চাক্ষুস দেখেনি ওটাকে। আক্ষরিক অর্থেই রহস্যময় জন্তু ওটা। কাজেই এটা নিয়ে বিরাট কলেবরের একটা প্যারানরমাল কেস স্টাডি হতেই পারে। তিন-তিনটা মানুষ মারা গেছে, কম তো না।”
“সত্যিই, পাগলা হাফেজের সবচেয়ে বড় সম্পদ তুই,” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“তুই কি জানিস,” বললা শিপলু, “পিশাচের ইংরেজি কি? একটা সিনোনিম হচ্ছে ghoul। এটা আবার আরবি শব্দ থেকে এসেছে। আকাশে একটা তারা আছে-অ্যালগল-ওটার নাম এসেছে আরবি ফ্রেজ ‘রা’জ আল ঘুল’ থেকে, যার মানে শয়তানের মাথা। তারাটার আলো বাড়ে কমে, শয়তানের চোখের মত চকচক করে, তাই এমন নাম। আসলে তো ওটা একটা এক্লিপসিং বাইনারি স্টার।”
ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলু।
গ্রামের সবচেয়ে উঁচু আর চওড়া মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা হাটের দিকে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একবার ব্যাকগ্রাউন্ডে মুখ ব্যাদান করে আছে জঙ্গলটা। ওদিকে আর না তাকিয়ে মন দিলাম সামনের দিকে। বিকেলটা একদম মরে এসেছে, তীর্যক সোনালি রোদ বিদায় নিলো এইমাত্র। রাস্তার দু-পাশে ধানের খেত, ফসল পেকে এসেছে, আসছে হেমন্তে ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। খেতগুলো আক্ষরিক অর্থেই দিগন্তবিস্তৃত, বহু বহু দূরে দিগন্তের কাছে নীলচে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে গেছে ওগুলো। পশ্চিমের আকাশে টকটকে লাল রং, সূর্যটাকে পোচ করা ডিমের কুসুমের মত দেখাচ্ছে।
হাটের কাছে পৌঁছে গেলাম। বিশাল একটা ডালপালা ছড়ানো কয়েকশো বছরের পুরনো বটগাছ ঘিরে বসে হাটটা। হাটবারে বেশ সরগরম জায়গাটা, দেখা গেল। বটগাছটার নিচে অস্থায়ি দোকান পেতে বসেছে অনেকে। শাক-সব্জি, মাছের দোকানের পাশাপাশি মহিলাদের শখের চুড়ি-ফিতা, সস্তা ছিটের কাপড়ের দোকানও আছে। টিন-বাঁশ-কাঠের স্থায়ি দোকানগুলো একটু বাইরের দিকে। অনেক লোকজন ঘোরাফেরা করছে, গমগম করছে পুরো জায়গাটা।
হাটুরে লোকজনের মাঝে বেশ ব্যস্ততা দেখলাম, সম্ভবত সন্ধ্যে নামার পরে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়, ইলেকট্রিসিটি তো নেই। সবাই বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে, নিজেদের মাঝে ফিসফাস করছে, আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। গ্রামে শিকারি আসছে—এই খবর জানা ছিলো সবার, এখন চাক্ষুস দেখে কৌতূহল মিটিয়ে নিচ্ছে। সম্পূর্ণ দিগম্বর একটা বাচ্চা আমাদের সামনে এসে মুখে বুড়ো আঙুল পুরে দাঁড়িয়ে রইলো।
পুরো হাটটা চক্কর দিলাম একবার বেশ কৌতূহলের সাথেই। শিপলু ঠিকই বলেছে, ব্যাপারটার একটা আলাদা ফ্লেভার আছে। মনে পড়ে গেল, আমারও তো শেকড় পোঁতা উত্তরবঙ্গের গ্রামেই। আমার দাদাবাড়ি ছিলো জয়পুরহাট জেলাতে। দাদা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। বাবা আর জ্যাঠা অবশ্য খুব কম বয়সেই ঢাকায় চলে এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। জ্যাঠা নানান ব্যবসার ফিকির করতে লাগলেন, আর বাবা পড়াশোনা করতে থাকলেন জ্যাঠার টাকায়। বাবা পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন নানান চাকরির ধান্ধা করলেন, কিছুদিন নাকি শিক্ষকতাও করেছিলেন বগুড়া না রংপুরের কোনো এক কলেজে, কিন্তু স্বাধীনতার পরে তিনিও ঢাকায় চলে এসে ব্যবসায় যোগ দেন জ্যাঠার সাথে। জ্যাঠাই নাকি খাটতেন বেশি। বিয়েও করেছিলেন তিনি বাবার পরে, সামাদ তাই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তার মৃত্যুর ব্যাপারটা খুব দুর্ভাগ্যজনক-চিটাগং বন্দরে ইমপোর্ট মালসামানের তদারক করছিলেন, সেখানে ক্রেন থেকে হঠাৎ একটা কার্গো মাথায় পড়ে সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়। জ্যাঠি খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে নেবার পরে তিনিও পরের দিন কেন যেন মারা যান, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে। জ্যাঠা তার ব্যবসার ভাগ বাবাকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। সামাদ তার পর থেকে আমাদের বাসাতেই মানুষ।
খানিকক্ষন ঘোরাফেরা করে শিপলু বললো, “চল, একটু বসা যাক। ওই যে একটা সুন্দর চায়ের দোকান দেখছি। ওখানে বসলে আশেপাশের চোদ্দো গ্রামের যত খবর মিলবে, চোদ্দো বছর সার্ভে করলেও সেটা পাবি না।”
গ্রামের চায়ের দোকানের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এগুলো অনেকটা হোটেলের মত। বসবার জন্য সারিবাঁধা নড়বড়ে কতগুলো বেঞ্চ আর টেবিল থাকে, মেসিয়ার থাকে, সে-ই ওয়েটার, কাউন্টারও আছে, সেটাতে ক্যাশবাক্সের ওপর একটা হাত রেখে গম্ভিরভাবে বসে থাকে দোকানের মালিক। তার সামনে লাল ঢাকনিওয়ালা কাঁচের বয়ামে সাজানো থাকে বিস্কুট আর টোস্ট। শিপলুর দেখানো চায়ের দোকানটাও সে-রকমই। আমরা এগিয়ে গেলাম সেদিকেই।
আমাদের আসতে দেখেই সাড়া পড়ে গেল দোকানের মালিক আর ভেতরে বসে গল্প করতে থাকা চা-সেবি আট দশজনের মাঝে। মালিকের নাম শুনলাম আনসার আলী, সে বেচারা কিভাবে আমাদের অভ্যর্থনা করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিপুল উৎসাহ-উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে দোকানে গিয়ে বসালো আমাদের, পেছন পেছন ঢুকলো আরো আট-দশজন। তাদের মধ্যে গেরুয়া কাপড় পরা এক চোখ কানা এক বাউলও আছে।
শিপলু থাকতে মজলিস জমতে দেরি লাগে না। এটা অবশ্য ওর একটা ট্রিক। গ্রামের মানুষ বাইরের কারো সামনে মুখ খুলতে চায় না, কিন্তু জড়তা কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। খানিকবাদেই দেখা গেল শিপলু এক হাতে মার্লবোরো আর আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়েছে মুখ দিয়ে, তার সাথে সমানতালে যোগ দিয়েছে গ্রামবাসি। দশ-পনের মিনিটের মাঝে কালামের মেয়ের বিয়ের খবর নিয়ে ফেললো ও, ইদরিস মিয়ার ধানের চিটারোগের প্রতিকার বাতলে দিলো, রহিমের মা’কে রংপুর মেডিকেলে বড় ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলো। চাপে পড়ে আমাকেও সুন্দরবনে বাঘ শিকারের গল্প শোনাতে হলো, সেটা অবশ্য পচাব্দী গাজীর শিকার কাহিনী থেকে মেরে দেয়া। সকালে জঙ্গলের ভেতরের অ্যাডভেঞ্চারও শোনাতে হলো বাধ্য হয়ে।
“বাপরে! তোমরাগুলা এইগলা কি শোনইনেন বাহে!” আমার গল্প শেষ হবার পর চরম বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো ইদরিস আলী। সবার মাঝে তাকেই একটু চালাক চতুর বলে মনে হচ্ছিলো আমার। “তোমারগুলার সাহস আছে বাহে! ওংকা করি জঙ্গলোত ঢুকিয়া…” শিউরে ওঠে সে। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, বাইরের গ্রাম থেকে আসা হাটুরেরা বিদায় নেওয়ায় চারপাশ নিশ্চুপ। আঁধার দূর করছে আমাদের সামনে বসানো একটামাত্র কেরোসিন ল্যাম্পের আলো, সেটাও বাতাসে কাঁপছে তিরতির করে, কালো ধোঁয়ার মোটা ধারা ছাড়ছে ওপরের দিকে। “সেই জিনিসের সামনোত গেছিলেন, ফির বাঁচিয়াও ফেরছেন!” তারপরই সবার মাঝে আলোচনা শুরু হয়ে গেল ‘জিনিস’টা কি, তা নিয়ে। শিপলুও চরম আগ্রহে যোগ দিলো সেই আলোচনায়, এবং আমি আর সামাদ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে দেখলাম শিপলুও ওটাকে একটা ‘পিচাশ’ বলে প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“তোমরা তো হামার চাইতে বয়সোত অনেক ছোটো, বাহে, তোমরাগুলা আর কি দেখছেন!” প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ ভঙ্গিতে সবাইকে ঠান্ডা মেরে দেয় পচা শেখ। লোকটা একেবারে লোলচর্ম বৃদ্ধ, এত বুড়ো মানুষ বাপের জন্মে দেখিনি আমি। তবু খোনা গলার আওয়াজ বাজখাঁই একেবারে। “মোর বয়স একশও বিশ বছর হইছে। বহুত জিনিস দেকচোঁ জেবনে। আঠেরোশো সপ্তানব্বই সালোত যেবার ভূমিকম্প হয়া মাটি ফাটি কই মাছ বাইর হইলো তখন মুই লতিফের বেটা হারুণের সমান। তখন বাঘ আছিল ওই জঙ্গলোত, বাঘ! সে বাঘ গরু ছাগল খাইতো মাজে মদ্যে, কই কখনো তো শুনি নাই মানুষ মাচ্চে! কিন্তুক এই গেরামের ভগ্যত কুফা লাগা শুরু হইলো কুনদিন থাকি, জানেন?”
পরের পাঁচ মিনিটে একনাগাড়ে একটা অদ্ভুত গল্প বলে গেল পচা শেখ, রংপুরিয়া ভাষায়, তার কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। তবু যা বোঝা গেল সেটা হচ্ছে : বহু বহু দিন আগে, ব্রিটিশ আমলে এই গ্রামে এক জটা-জুটোওয়ালা কৌপিন পরা সাধুর আগমন হয়। অন্তত প্রথমে তাকে সবাই সাধুই ভেবেছিলো বটে। কিন্তু সাধুর ঝোলা থেকে জড়িবুটির পাশাপাশি যখন মানুষের খুলি আর হাঁড়গোড় বেরোলো, চোখ কপালে উঠলো তখন সবার। বোঝা গেল লোকটা তান্ত্রিক, এবং খারাপ ধরণের তান্ত্রিক। জঙ্গলের উল্টো দিকে নদীর ধারের শ্মশানে এক অমাবস্যার রাতে দেখা গেল, একটা মড়ার ওপর বসে সাধনা করছে তান্ত্রিক, সামনে অগ্নিকুন্ড। পর পর কয়েক রাতে এই দৃশ্য দেখার পরে গ্রামের মানুষ ঠিক করে, আর না, এইবারে একটা ফয়সালা করতে হয়। সবাই লাঠিসোঁটা আর মশাল হাতে মারতে যায় তাকে। এর পরে ঠিক কি হয়েছিল, কেউ ঠিক মত জানে না, সব চেয়ে প্রচলিত গল্পটা হলো তান্ত্রিক সবার চোখের সামনেই একটা বিশাল নেকড়ে বাঘের মত জিনিসে পাল্টে গিয়ে এক লাফে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। আর তার পর থেকেই এই গ্রামের ভাগ্যে কুফা-মঙ্গা, ম্যালেরিয়া, কলেরা, আর একাত্তরের যুদ্ধে আশপাশের দশটা গ্রামের চাইতে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি। এখন আবার পিশাচের উপদ্রব!
“যুদ্দের সময় তো এক্কেবারে ইবলিছ শয়তানের চোখ পড়ছিলো গেরামের ওপরোত!” উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠে ইদরিস আলী। “এই গেরামের একজন মানুষে কেবল শিক্ষিত আছিল, আলতাফ উদ্দীন গাজীর বেটা বরকত উদ্দীন গাজী। সে রংপুর শহরোত থাকতো, কারমাইকেল কলেজের পোরফেসর আছিল। সে বেচারা আছিল জয় বাংলার ভক্ত। যুদ্ধ যখন শুরু হইলো সে চলি আইলো গেরামোত। কিন্তুক তার পেছনোত পেছনোত আর্মি নিয়া আইলো কারমাইকেলের আরেক মাস্টার, চেংরা বয়স, সে শোহোরের বাচ্চার নাম মুই জানো কিন্তু তার নাম মুখত নেলে মোর মুখ নোংরা হয়া যাইবে। তার পর তো…” অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো সে, বিশেষত আমার মুখের দিকে একটু বেশি সময়ই তাকিয়ে থাকলো, কেন কে জানে।
হঠাৎ চোখে পড়লো, সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকেই, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবাইকে। মনে পড়ে গেল, অনেকক্ষণ যাবত কোনো কথা বলছি না আমি। মজলিসে হাজির হয়ে কথা কম বলার নিয়ম বোধহয় নেই গাঁও-গেরামের কুটুম্বের। কি বলবো, মাথায় আসছে না এই মুহূর্তে, অথচ বলতে তো হবে। পিশাচের কথা তুলে মন্দিরের অভিজ্ঞতা মনে করার কোনো কারণ নেই। গসিপ হলে কেমন হয়? “সিদ্দিকের ব্যাপারটা একটু বলেন তো,” ভেবেচিন্তে বললাম, “যে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চাকে পিশাচ খাইলো, সেই সিদ্দিক। সিদ্দিকের এইটা প্রথম বিয়ে, অথচ, তার বউয়ের দ্বিতীয়, ব্যাপারটা কি?”
“কি আর কইমেন লজ্জার কথা,” অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বললো চা-দোকানের মালিক আনসার আলী। “সিদ্দিকের সাথে ওইপাকের বালাটারি গ্রামের বাতেনের বউয়ের খারাপ সম্পর্ক আছিল। বাতেনের বউয়ের ছইল হইলো, তবু বাতেনের ওপর কোনো মায়া হইলো না, ছইল কোলোত নিয়ায় চলি আইলো সিদ্দিকের কাছে। আর বাতেন বিষ খায়া মরলো।” তার গলা নিচু হয়ে আসে। “সিদ্দিকোক আমরা কেউ দেইখবার পারি না। বাজারোত আসলে আমরা অর কাছে কিছু বেচি না।”
সবাই অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসলো। আমিও পড়লাম ফাঁপরে-নারীঘটিত জিনিস তোলা ঠিক হয়নি দেখছি। সিদ্দিক নামের লম্পটের কারণে গোটা গ্রামকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে।
চালাক চতুর ইদরিস আলী গলা তুললো। “ও শ্যামাদাস বাউল!”
আমাদের সাথেই বসে ছিল গেরুয়া জামা, পাগড়ি আর একতারা ওয়ালা একচোখ কানা শ্যামাদাস বাউল। এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে মুখ খুললো সে, “হু, ইদরিস ভাই!”
“চুপচাপ যে!”
“কি কইম, কন।” লাজুক হাসি হাসে বাউল।
“কি কবা মানে? হামার গেরামোত মেহমান আইলো, আর তোমরাগুলা এলাও গান না শোনেয়া চুপ করি আছেন?”
“কি গান গাইম?” কানা বাউল হাসিমুখে বলে। “বাঘ নিয়া একটা গান বান্ধিছলাম, মনে আছে? ওইটাই শুনাই শিকারিসাহেব আর তেনার বন্ধুদেক?”
“হ হ! ওইটায় ভালো হইবে!” সবাই যেন একটু বেশি উৎসাহের সাথে বলে ওঠে।
বাউলের আশপাশে যারা ছিল তারা সরে জায়গা করে দিলো তাকে। বাউল উঠে দাঁড়ালো, পরনের গেরুয়া কাপড় ঠিকঠাক করলো গম্ভিরভাবে, গায়কের মুডে চলে গেছে সে।
শিপলু সিগারেট টানছে, ল্যাম্পের আলোয় চকচক করছে ওর চশমার কাঁচ, সামাদ আর সব সময়ের মত মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে বাউলের দিকে, গ্রামবাসি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের দোকানের ভেতরে ল্যাম্পের আলো, বাইরে নিকষ কালো রাতের আঁধার। শ্যামাদাস বাউল সেই পরিবেশে সেই অভিশপ্ত প্রাগৈতিহাসিক গ্রামে যে গানটা গেয়েছিলো সেটা কোনোদিন ভুলবো না :
সয়না জ্বালা, তুমি বিনে, চইলাম আমি শ্বাপদ সনে ॥
বন্ধুর স্মৃতি ভুলতে না’রি বনের মাঝে দিনু পাড়ি।
গাছের শাখে পাখি ডাকে দুঃখের কথা কইবো কাকে।
সওয়ার হয়্যা পঙ্খির ডানায় বন্ধুর বাড়ি যাইতে মন চায়।
দোলা লাগে ঝাউয়ের বনে কত কতা ছিল মনে।
প্রকাশি না কইতে পারি চলিয়া গেলাম ঘর ছাড়ি।
বনের মাঝে জোছনোরো বান নামিল য্যান স্বর্গের বাগান।
ব্যাঘ্র সঙ্গি আমার হইলো মনের কতা আমায় কইলো।
পশু-পক্ষি হইলো সাথি সুখেই কাটে দিবা রাতি।
বন্ধুর কথা ভুলবো বলি শ্বাপদ সনে আইলাম চলি।
সয়না জ্বালা, তুমি বিনে চইল্লাম আমি শ্বাপদ সনে ॥
গান শেষ, সবাই বাহবা দিচ্ছে শ্যামাদাস বাউলকে, আমি মানিব্যাগ বের করে একটা একশো টাকার নোট বের করে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় চোখ পড়লো ভিড়ের পেছনে, চায়ের দোকানে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। মফিজ দারোগা। অন্ধকারের সাথে মিশে কতক্ষণ যাবত ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা, জানি না।
সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগা। চোখে শীতল দৃষ্টি। এমন দৃষ্টি আজ সকালেই আরেকবার দেখেছি আমি। জঙ্গলের ভেতরে, মন্দিরে।
দিনটা যদি ওখানেই শেষ হতো, তবু ওটা হতো আমার জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল দিনগুলোর একটা। কিন্তু বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকা কারো মতলব ছিলো আলাদা।
বাংলোয় ফিরে রাতের খাওয়া সারতে সারতে দেরি হয়ে গেল। ক্লান্তি লাগছে না ততটা অত সহজে ক্লান্ত হবার লোক আমি নই, কিন্তু কেমন অদ্ভুত একটা অবসাদ বোধ হচ্ছে। বিছানায় শুয়েছি, শিপলু হারিকেনের আলোয় সারাদিনে জমা করা ওর নোটস সাজাচ্ছিল কোনোমতে, সামাদ বোধহয় পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় বারান্দায় গটগট করে ভারি পায়ের শব্দ, আর তারপরই বাইরের দরজায় দড়ামদড়াম শব্দ। কেউ যেন প্রচন্ড তাড়ায় আছে, এখনই ভেতরে ঢুকতে হবে তাকে।
কেয়ারটেকার আমজাদ আলী আমাদের রুমে এস ভয়ার্ত গলায় বললো, “সাব, কাঁয় জানি আলছে।” যেন দরজার কান ফাটানো শব্দটা আমরা শুনতেই পাই নি।
আমি আর শিপলু মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি, এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো মফিজ দারোগা, “জামশেদসাহেব! তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন!”
আমজাদ আলী দরজা খুলে দিল, আর ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো মফিজ দারোগা। “তাড়াতাড়ি চলেন! আরেকজনক্ ধরছে!”
“মানে?”
“সিদ্দিক! রাইতে পায়খানা করতে বাইর হইছিলো, পিচাশটা ধরছে! টানি নিয়া গেছে জঙ্গলের দিকে! সিদ্দিকের বউয়ের চিল্লানি শুনিয়া মানুষ আমাক খবর দিছে! আমি সোজা এইখানে আসছি! আমার সাথে চলেন,সাহেব, দেখেন এখনো কিছু করা যায় কিনা!”
আমি যেতে চাই না। জঙ্গলের ভেতরে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তার পরে আবার ওটার মুখোমুখি হবার কোনো শখ আমার নেই-কিন্তু কিভাবে এড়াবো মফিজ দারোগার ডাক? গ্রামের মানুষ জানে, আমি তাদেরকে বাঁচানোর জন্যই এসেছি! অন্তত নিজের কভারটা বজায় রাখার জন্য হলেও আমাকে যেতেই হবে—ইচ্ছা যতই না করুক। বলে দিলাম, “আসছি। এক মিনিট সময় দিন-রাইফেলটা বের করতে হবে।”
“আমিও যাবো,” শিপলু বললো। আমি মাথা নেড়ে মেনে নিলাম সেটা। ওর সাথে তর্ক করার কোনো মানে হয় না, ও যাবেই। গভির রাতে পিশাচের পেছনে ছোটার জন্যই ও এই গ্রামে এসেছে।
“ভালো, যত লোক বাড়ে তত ভালো,” বিড়বিড় করে বললো মফিজ দারোগা। লোকটা ভয় পেয়েছে নির্ঘাত, চেহারায় এমনকি কুটিলতার ছাপটাও আর নেই।
“আমিও যাচ্ছি,” সামাদ বললো। নিজের লাগেজের ভেতর থেকে কি যেন বের করছে ও ব্যস্ত হাতে।
“প্রশ্নই আসে না। শুধু শুধু রাত বিরেতে জঙ্গল ঠেঙ্গিয়ে কাজ নেই তোর।” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি।
“জামশেদ ভাই, সিদ্দিককে পাওয়া গেলে তার হয়তো মেডিকেল কেয়ার দরকার হবে,” শান্ত কণ্ঠে বললো সামাদ, ফার্স্ট-এইড বক্সটা হাতে নিয়ে সোজা হলো। “আর আশেপাশে চল্লিশ মাইলের মধ্যে আমিই সম্ভবত একমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার।”
কথা সত্য। আমার রাইফেলও বের করা হয়ে গেছে। বুলেটের থলেটা বেল্টের সাথে লাগিয়েই আর দেরি করলাম না। “চল!” বলে বেরিয়ে পড়লাম রাতের আঁধারে, সম্বল কেবল কয়েকটা টর্চের আলো।
ঢুকে পড়লাম দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর বাস্তবের আরেক অধ্যায়ে।