শ্বাপদ সনে – ১

অধ্যায় ১ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে

সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি ঘামছি।

কলম্বোর এই শ্যুটিং অ্যারিনায় যে খুব বেশি লোক আছে, তা না। মোটমাট সিট হবে দুইশোর মত। তার মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক দর্শকদের দখলে। শখের দর্শক বলতে গেলে নেই। গুটিকতক সাংবাদিক আছে, আর বাকি সবাই আসলে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শুটারদের আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব। উৎসাহ দিতে এসেছে তাদের বন্দুকবাজ বন্ধুকে।

আমি একবার আড়চোখে তাকালাম সামনের সারিতে বসা আমার কোচ খালেকুজ্জামান স্যার আর তার পাশে বসা দুই স্বদেশী শুটার মনির আর সাদেকের দিকে। আমার ফ্রেন্ডস বলতে এই-ই, আর ফ্যামিলির কেউ উপস্থিত নেই। ‘ফ্রেন্ডস’ কথাটাও কতটা যুতসই হলো জানি না। মনির আর সাদেকের চোখেমুখে যেন লেখা আছে, আমি যাতে আমার ফাইনাল শটটায় ভালো না করি। ঘরের শত্রু বিভীষণ। নিজেরা ফাইনালেই উঠতে পারেনি। এখন আমি গোল্ড মেডেলটা না পেলেই তাদের পরাজয়ের ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ পড়ে। আচ্ছা, আগে মেডেলটা জিতে নেই। দেশে ফিরে মজা দেখানো যাবে ছোটলোকের বাচ্চাগুলোকে।

একমাত্র খালেকুজ্জামান স্যারের চোখেই খানিকটা সত্যিকারের উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। বরাবরই তাঁর প্রিয় ছাত্র আমি তার স্পেশাল তদবির না থাকলে কখনো- বিকেএসপিতে-না-যাওয়া, এর আগে মাত্র তিনটি-প্রতিযোগিতায়-অংশ-নেয়া আমি কখনো সাফ গেমসে আজকে এই দশ মিটার এয়ার রাইফেলের ফাইনালে উপস্থিত হতে পারতাম না, বন্দুক হাতে যত ভালোই হই না কেন, তার পরও যতটুকু খটকা ছিলো শুটিং ফেডারেশনের, সেটা দূর হয়ে গেছে আমার বাপের নাম শুনে। জন্মকালা ছাড়া এই দেশে আর কেউ নেই যে সফল শিল্পপতি আব্বাস রহমান খানের নাম শোনেনি।

যাহোক, আমার ওপর অনেক আশা ছিলো খালেকুজ্জামান স্যারের। একজন কোচ হিসেবে ছাত্রকে যতরকম সাহায্য করা যায়, করেছেন। তার প্রত্যাশার দাবানলে ঘি হিসেবে পড়েছে আজকে আমার এই ফাইনালে উঠে আসা। গোল্ড মেডেলটা জিতলেই কেবল যোগ্য গুরুদক্ষিণা দেয়া যাবে খেলাপাগল দরিদ্র মানুষটাকে।

ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকালাম। নিজের স্পটে দাঁড়িয়ে আছি আমি, পরনে স্পেশাল আউটফিট, বুকের একটা কাগজে বড় করে লেখা প্রতিযোগি নাম্বার। হাতে ধরা এয়ার রাইফেলটা স্ট্যান্ডের ওপরে রাখা, জিরিয়ে নেবার সুবিধার জন্য। মাথায় ছাদ-ছাড়া বিশেষ ক্যাপ। ক্যাপ থেকে আমার দুই চোখের পাশে নেমে এসেছে দুটো কাগজের টুকরো। দেখতে কিম্ভুত দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু যখন চোখটা রাইফেলের স্কোপে রাখবো তখন কাগজের টুকরোদুটো উজ্জ্বল আলো থেকে বাঁচাবে আমার চোখ দুটো।

আমার সাথের অন্য সাতজন প্রতিযোগিও চেয়ারে বসে জিরিয়ে নিতে নিতে সরু চোখে আমার প্রতিটা নড়াচড়া দেখছে। পাকিস্তানি মোটা ভুরুওয়ালা দু-জনের জেতার সম্ভাবনা অবশ্য সুদূরপরাহত। তাদের শেষ শট নেবার বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে কোনোরকম মেডেল জেতার চান্স। নেপালের ফাইনালিস্টেরও সেই একই দশা। শ্রীলঙ্কান শুটার পেরেরা শেষ শটের পরে এখন ব্রোঞ্জ পজিশনে আছে, মনে প্রাণে সে দোয়া করছে আমি চরম বাজে করে যেন ওকে রূপাটা পাইয়ে দেই। ভারতীয় শুটার আনন্দ পঞ্চম স্থানে, নির্বিকার তাকিয়ে আছে আমাকে ফুঁড়ে আমার পেছনের কোনো এক জায়গায়। আর এখন আসল খেলাটা চলছে আমার আর আরেক ভারতীয় শুটার লাক্সমানের মধ্যে। নিজের সবগুলো শট শেষ করে প্রথম পজিশনে এখন লাক্সমান, দ্বিতীয় পজিশনে থাকা এই আমি শেষ শটটায় একটু খারাপ করলেই গোল্ড মেডেল নিশ্চিত তারই। খারাপ করার কোনো রাস্তা নেই আমার। ১০.২ এর নিচে করলে হারবো, নতুন রেকর্ডসহ মেডেল পাবে লাক্সমান। তবে আমি ১০.৬ কিংবা তারচেয়ে বেশি করলে আবার নতুন রেকর্ড আমার হবে। সাথে গোল্ড মেডেল তো থাকছেই।

একজন স্নাইপার আর স্পোর্টিং শুটারের শত্রু দুটো-দুটোর উৎপত্তিই তার নিজের দেহে। হার্টবিট আর নিশ্বাস। দুটোই কাঁপিয়ে দেয় রাইফেলের ক্রস-হেয়ার। দম আটকে তো থাকা যায়, কিন্তু হার্টবিট সবসময় কন্ট্রোল করাটা কঠিন। বিশেষত এমন একটা চূড়ান্ত মুহূর্তে, যখন গোল্ড মেডেলের দোরগোড়ায় আমি, যখন বিচারক থেকে দর্শক, সবার চোখ একুশ বছরের এই আমার ওপরে।

যেন কোথাও যাবার তাড়া আছে, এমনি ধুকপুক করছে আমার হৃৎপিন্ডটা। একটা লম্বা শ্বাস নিলাম আমি, ছাড়লাম ধীরে ধীরে। হার্টবিটের কোনো হেরফের ঘটাতে পেরেছি বলে মনে হলো না। অথচ এই শটটা পারফেক্ট হতে হবে। বড় বেশি পারফেক্ট হতে হবে।

ডাক্তারি পড়ুয়া আমার কাজিন সামাদের বলা একটা কথা মনে পড়লো। “হার্টবিট বাড়ে সিমপ্যাথেটিক স্টিমুলেশনের কারণে। হার্টবিট কমায় কে? হয় নাই, প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্টিমুলেশন। এই দুটোর কোনোটার ওপরই আমাদের কন্ট্রোল নেই। জামশেদ ভাই, যখন আপনি শুটিং করবেন, তখন চিন্তা করবেন, ভরপেট খেয়েদেয়ে আপনার সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন, পা সামনের টেবিলের ওপরে, স্টেরিওতে হালকা ভলিউমে জন ডেনভারের গান চলছে, আপনার ঘুম ঘুম লাগছে। কাজে দেবে, দেখবেন।”

কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে সামাদের কথামত কাজ করার চেষ্টা করলা, কিছুই হলো না। লাভের থেকে সামাদের ওপর রাগের চোটে হার্টের নাচানাচি আরো বাড়লো।

ভয়টা কমানোর জন্যই বুঝি কোচের দিকে আরেকবার তাকালাম।। খালেকুজ্জামানের দিকে চোখ না পড়ে পড়লো তার পাশের সিটটার দিকে। সেখানে আমার পিতৃদেব বসে আছেন।

আমার বাবা আব্বাস রহমান খান। আমার কোনো জন্মদিনেই যিনি উপস্থিত থাকতে পারেন না। স্কুলের কোনো প্যারেন্টস ডে’তেই যিনি কখনো উপস্থিত হতে পারেননি। যার ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহের পাঁচ দিনই আমাকে রাতের খাবার একা খেতে হয়। যার এখন ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুরে থাকার কথা। তিনি আজ এই বুক- দুরুদুরু মুহূর্তে উপস্থিত।

আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বাবা যেন খানিকটা বিরক্তই হলেন। চোখের কোণে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো তার, শক্ত চিবুকটা ওঠালেন পাঁচ ডিগ্রি-যার অর্থ, এই দিকে কি দেখছো? সামনে তাকাও। হাতের কাজটা শেষ করো।

আমি পিতৃদেবের আদেশ পালন করলাম। ঝট করে ঘাড়টা সামনে ঘুরিয়ে কাঁধে রাইফেলের বাটটা লাগিয়ে স্কোপের মধ্য দিয়ে টার্গেটের দিকে তাকিয়েই ট্রিগার টানলাম।

রাইফেলটা নামিয়ে আবার তাকালাম টার্গেটের দিকে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই দেখতে পারলাম না। কোথায় ফুটোটা? এয়ার রাইফেলের প্যালেট যখন কাগজের টার্গেটটাকে ফুটো করে, পরিষ্কার একটা গোল ছাপ দেখা যায় তখন। কই সেটা? টার্গেট একেবারে মিস করলো নাকি?

গোটা অ্যারেনা জুড়ে তালির শব্দ শুরু হবার পরপরই ফুটোটা চোখে পড়লো আমার। টার্গেটের একেবারে কেন্দ্রে। একেবারে মাঝখানে তাই চোখে পড়ছিল না এতক্ষণ।

আমি রাইফেল হাতে নিয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে, আর খালেকুজ্জামান স্যার কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

পুরস্কার বিতরণীর সময় লাক্সমানের চেয়ে উঁচুতে দাঁড়ালাম আমিই। শেষ শটে ১০.৯ করে সোনার মেডেলটা আমার গলাতেই ঝুললো। সেই সাথে সাফের নতুন রেকর্ডও ঢুকে গেল পকেটে।

গতবারের চ্যাম্পিয়ন আমার গলায় যখন সোনার মেডেলটা গলিয়ে দিলো, আর আমি যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম, বাবা দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন আস্তে ধীরে। তার কঠিন চেহারায় খানিকটা গর্বের ছোঁয়া যেন। অবশ্য বিরক্তির ভাবটাও কম নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজা জাতীয় সঙ্গিতটাই বোধ হয় এর কারণ। “ট্যাগোর কোনো পোয়েট হলো নাকি? ফকিরের দেশের ফকিরের ভাষা, তার আবার কবি!” আমাদের গাড়ির ড্রাইভার একবার ভুল করে গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গিত দিয়ে ফেলায় বলতে শুনেছিলাম তাকে।

আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পরে বাবা আমাকে ডেকে নিলেন। “ওয়েল ডান। ভাল করবে জানতাম। লেটস সেলিব্রেট। এখান থেকে ফাইভ মিনিটসের ডিসটেন্সে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। কোরাল কিং। ইউ লাইক সি ফুড, রাইট?”

আমি কোনোমতে মাথা নাড়লাম। বাবার মুখ থেকে বের হওয়া প্রথম তিনটে কথা সত্যিই শুনেছি কিনা তা নিয়েই হালকা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছি। পড়াশোনার কারণে বাহবা শোনা হয়নি কখনো। তাছাড়া বাবা আমাকে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছেন, এটা শেষ কবে হয়েছে মনে করতে পারছি না।

বাইরে চলে এলাম। ইভেন্ট শুরু হয়েছে বিকেলে, কখন রাত হয়ে এসেছে, বুঝতেই পারিনি। কলম্বোর রাস্তা এত ফাঁকা কেন, বুঝলাম না। একটা ট্যাক্সি রেডিই ছিল। আমরা চড়ে বসতেই স্টার্ট দিল সেটা। বাবার সাথে কেউ নেই কেন, সেটা মনে এল একবার। বাবাকে কখনো একা কোথাও যেতে দেখিনি। বডিগার্ড সাথে না থাকলেও বাবার ডান হাত জব্বার আঙ্কেল তো থাকবেনই।

ভাবাভাবির বেশি একটা সময় পেলাম না বটে। ট্যাক্সি চলতে চলতেই হঠাৎ ঝুপ করে রাস্তার সব ক’টা বাতি নিভে গেল। দোকানপাট আর বাসাবাড়িরও কোনো বাতি জ্বলছে না। কবরের আঁধার নেমে এলো কলম্বো শহরের ওপরে।

অবাক হয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করছি আমি। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটার ভয়াবহ দিক এক সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারলাম আমি, কেঁপে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। রাস্তার কোনো বাতিরই হেডলাইট অন নেই এখন। আঁধারের মধ্যেই পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে যাচ্ছে আমাদের ট্যাক্সিটা।

আতঙ্কে অসাড় আমি কোনোমতে খামচে ধরলাম ট্যাক্সিওয়ালার কাঁধ স্পিডোমিটারের আলোয় তার অবয়বটা কোনোমতে বোঝা যাচ্ছে। “ড্রাইভার! স্টপ! স্টপ!”

কোনো লাভ হলো না। গাড়ির স্পিড কমে তো নেই-ই, বরং যেন বাঁধাধরা একটা হারে বাড়ছে…যেন ড্রাইভারের অসাড় একটা পা মেঝের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছে অ্যাক্সেলেটরটাকে।

আমি পাগলের মতো ড্রাইভারকে আরেকটা ঝাঁকুনি দিতেই আস্তে করে স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ঢলে পড়লো লোকটা।

থ হয়ে থাকলাম এক মুহূর্ত। মাথা কাজ করছে না। এসব কি হচ্ছে?

বাবার দিকে ফিরলাম আমি, আর সাথে সাথে শীতল একটা শতপদী যেন কিলবিলিয়ে নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। বাবার শরীরটা মিশে গেছে কালিগোলা আঁধারে, কিন্তু তার চোখ দুটো শুধু ফসফরাসের মতো জ্বলছে একটা সবজেটে আভা নিয়ে, রাতের আঁধারে শিকারে বেরোনো কোনো হিংস্র শ্বাপদের মত। সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে চোখদুটো।

সামনের দিকে চাইলাম আমিও। উইন্ডশিন্ডের সামনে নিরেট যে কালো অবয়বটা লাফিয়ে বড় হচ্ছে, সেটাকে একটা গাছ বলে চিনতে পারার সাথে সাথেই প্রচন্ড একটা….

লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি, চেঁচাচ্ছি উন্মত্তের মত। গলা শুকিয়ে কাঠ, খসখস করছে। কতক্ষণ এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চেঁচিয়েছি জানিনা, নির্ঘাত অনেকক্ষণ হবে। কারণ আমার ঘরের বাতিটা জ্বালানো, ঘুমভাঙা চোখে হাজির হয়েছে আমার চাচাতো ভাই সামাদ, আর আমাদের কর্মচারি আক্কাস মিয়া।

“জামশেদ ভাই? আবার ওই একই স্বপ্ন?” এক পা এগিয়ে জানতে চাইলো সামাদ। ঘুমভাঙা চোখে কেমন বোকাবোকা দেখাচ্ছে ব্যাটাকে।

জবাব দিলাম না, দেবার মুড নেই। কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছে বেডসাইড টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম পানির গ্লাসের জন্য।

“মরা মাইনষে অনেক সময় এমনি কইরা স্বপ্ন দেখায়।” শুরু হলো আক্কাস মিয়ার বয়ান। “আপনার আব্বার রূহের শান্তি হয় নাই। উনি আপনারে স্বপ্ন দেখাইয়া কিছু কইতে চান। আমার মনে হয়…

“তোমার কি মনে হয় সেটা এখন শুনতে চাচ্ছি না,” কাটাকাটা স্বরে জবাব দিলাম আমি। আর কবে শিখবে আক্কাস মিয়া? আমাদের জন্মেরও আগ থেকে আমাদের বাসায় কাজ করে। এখনো যদি আমার মুড না বোঝে তাহলে সমস্যা।

আমার ধমকে গভির একটা হতাশার ছাপ পড়লো আক্কাস মিয়ার পাকা দাড়িওয়ালা শুকনো চেহারায়। “তবু ছোটসাব, উনি কি কইতেছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করেন. হাজার হইলেও বাপ, মইরা গেলেও তারে মান্য করন লাগে…” বলতে বলতে রুম ছেড়ে চলে গেল আক্কাস মিয়া।

বেয়াক্কেল বুড়ো কোথাকার!

সামাদ তখনো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আড়চোখে সেটা বুঝতে পেরে ক্ষেপে উঠলাম আমি। কেউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রচন্ড অস্বস্তি হয়, রেগেও যাই ভীষণ। গাধাটাকে এতবার বলার পরও হুঁশ হলো না!

“যা, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়গে,” সামাদকে বললাম। “রাত কম হয়নি।” ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকালাম একবার। তিনটা পেরিয়ে গেছে।

“আমার মনে হয় আপনার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার, জামশেদ ভাই,” শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে চাপিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো সামাদ।

চোখ গরম করে তাকালাম সামাদের দিকে। বেটেখাটো চেহারা, পাঁচ ফুট ছয়ের বেশি হবে না। বংশগুণে ফরসা রংটা পেয়েছে আমাদের। ছলছলে দুটো চোখ, বসে যাওয়া গাল, মেডিকেলের পড়াশোনার চাপে সামনের দিকে পাতলা হয়ে আসা চুল-সব মিলিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালে আমার আপন ছোট জ্যাঠাতো ভাই বলে চিনতে কষ্টই হয় সামাদকে। ওর পরনে ঢিলেঢালা পায়জামা আর গেঞ্জি, শুতে যাবার পোশাক। সন্দেহ নেই আমার চিৎকারে জেগে উঠেই নিচতলা থেকে ছুটে এসেছে সে, সাথে করে নিয়ে এসেছে তার পাশের রুমের আক্কাস মিয়াকে।

“ডাক্তারি পাশ করেছিস বলেই সবসময় আমাকে ডাক্তারি জ্ঞান দিতে হবে তোর, এমন কোনো কথা নেই,” আমার হাতে-পায়ে বিশ্রীভাবে পেঁচিয়ে আছে বেডশিটটা, ওটা ছাড়িয়ে নিতে-নিতে ঠান্ডা গলায় বললাম। মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে আছে আমার, ঘুমটাও গেছে ছুটে।

সামাদ আর আক্কাস মিয়ার সামনে স্বভাবমত গরম দেখালেও ভেতরে ভেতরে কাঁপছে আমার কলজেটা। আবার সেই জঘন্য দুঃস্বপ্ন! বিরামহীন পরপর ক’রাত চললো এমনটা, গোণা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আজকের স্বপ্নটা বাকিগুলোর চেয়ে আলাদা। এত পরিস্কার আর খুঁটিনাটি স্বপ্ন জীবনে কখনো দেখিনি। লুসিড ড্রিম বোধহয় একেই বলে। স্বপ্নের শুরুটা রীতিমত অবাক করে দিয়েছে আমাকে। পাঁচ বছর আগে, ‘৮৮-তে সাফ গেমসে সোনা জেতার মুহূর্তটা এমন বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছিল যে ওটাকে আমার ঘুমন্ত মগজের কারসাজি বলে মনে করার কোনো কারণ ছিল না। অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যাবার ঘটনাটা গত কয়েক রাত ধরেই লাগাতার স্বপ্নে দেখছি, কিন্তু আমার সোনা জেতার মুহূর্তের সাথে হাইব্রিড হয়ে সেটা ফিরে আসলো কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই

আর ঘুমোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই। বিছানায় উঠে বসে বেডসাইড ড্রয়ার খুলে হুইস্কির বোতলটা বের করলাম। চোখের কোণে সামাদের নড়াচড়া ধরা পড়লো আমার। কোনো ডাক্তার মার্কা উপদেশবাণী দেবার সুযোগ দিলাম না বটে ওকে। বোতল খুলে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে শীতল চোখে সামাদের দিকে তাকালাম। “ইউ আর নট মাই ডক্টর। নাউ গো ব্যাক টু ইওর ফাকিং বেড।”

মাথা নিচু করে বিদায় নিলো সামাদ।

রাস্তার দিকের বিশাল জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। হাতে সুরাপাত্র। পাল্লা ফাঁক করে দিতেই বিলিতি ধাঁচের জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া এসে ভরিয়ে দিল ঘরের ভেতরটা। শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাস, আর খালি পেটে পড়া তরল আগুন স্বপ্নের ধকল কাটানোর জন্য এর জবাব নেই। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বাইরের সুনসান রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। গোটা ধানমন্ডি ঘুমে আচ্ছন্ন। গোটা ঢাকা শহর ঘুমিয়ে আছে।

রাস্তার বাতি খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে, তার বাইরে পুরোটাই অন্ধকার। আলোটার চারপাশে ঘোরঘুরি করছে কয়েকটা পোকা। সেদিকে তাকিয়ে হুইস্কির গ্লাসে একের পর এক চুমুক দিয়ে গেলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *