“শ্বশুরবাড়ি নয়— ক্লাব হাউস” – বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
কি হল দোলা, এই-রে, এতদিনের জিনিসটাকে তুমি ভেঙ্গে ফেললে।
ভাঙ্গিনি, ফেলে দিয়েছি।
ফেলে দিয়েছ?
হ্যাঁ–রং চটা ভাঙ্গা একটা ফুলদানি, এটা আবার কেউ রাখে নাকি।
কি বলছো কি, জানো-ওটা আমার ঠাকুরদার আমলের ফুলদানি, এই ধরনের ফুলদানি আর পাবে।
দ্যাখো কিংশুক, সেই পৃথিবীটা আজ বদলে গেছে। কম্পুউটার আর ইন্টারনেটের যুগে, এর কোন মূল্য নেই। তাই এই ধরনের কিছু দেখলেই আমি ফেলে দেবো।
অফিস যাবার সময় তোমার সঙ্গে তর্ক করবোনা, এর উত্তর ফিরে এসে দেবো। একটু তাড়া আছে, ব্রেকফাস্টটা নিয়ে এস।
মাইনেতো পাও, ছহাজার, এর জন্যে এত তাড়া কিসের। আমার বাবা কত মাইনে পান জানো।
কিংশুক একটু রেগে গিয়ে বললো, জানবার প্রয়োজন নেই।
অফিস থেকে ফিরে দোলাকে দেখতে না পেয়ে কিংশুক মা-কে জিজ্ঞেস করলো, মা–দোলা কোথায়?
মা–একটু অঙ্গভঙ্গি করে বললো, দুলতে, দুলতে একটা ঘোড়ার সঙ্গে দুপুরে বেরিয়েছে।
কিংশুক বললো, সোজাভাবে কোন কথা বলতে পারনা।
না—পারিনা। যা—তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
পাশেই ছিলেন কিংশুকের বাবা। বললেন, দুপুরে ওর এক বয়ফ্রেন্ড এসেছিল। আমি সবেমাত্র খেয়েদেয়ে কাগজটা পড়ছি। বউমা আমায় এসে বললো, একটু মিষ্টি আর গরম কিছু নিয়ে আসুনতো, আমার এক গেস্ট এসেছে। বললাম, দুপুরেতো গরম কিছু পাওয়া যাবেনা, আর মিষ্টির দোকানও বেশ দূরে। তাছাড়া যা রোদ আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। এর কিছুক্ষণ পরই বউমা সেই বয়ফ্রেন্ডেজ্ঞ সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
রাত আটটা। দোলা ঘরে ঢুকেই, কতকগুলো প্যাকেট খাটের ওপর রেখে বললো, আজকের দিনটা যা কেটেছে না, ফ্যানটাস্টিক। বহুদিন পর অরিন্দমের সঙ্গে দেখা হল, মোটা মাইনের চাকরি, দ্যাখো কত জিনিষ প্রেজেন্ট করেছে।
কিংশুক একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, কিছু বাড়তি জিনিষ পেলে তোমরা খুশি হও জানি, কিন্তু এর বিনিময়ে বয়ফ্রেন্ডকে নিশ্চয়ই তুমি কিছু দিয়েছ।
আমি আবার কি দেবো।
কেন তোমার সান্নিধ্য। সারাদিন ধরে সেটাতো দিয়েছ?
হ্যাঁ—দিয়েছি। দুজনে হাত ধরে ঘুরেছি, কেনাকাটা করেছি। তোমার কুৎসিত ইঙ্গিতটা তোমার মুখেই মানায় কারণ–কনজারভেটিভ বাবা-মায়েরইতো তুমি ফসল তাই তোমার মনটাও নোংরা।
মুখ সামলে কথা বলবে।
কেন মারবে নাকি? তোমার মত কাপুরুষরাতো সত্যি কথা হজম করতে না পেরে মেয়েদের গায়েও হাত দেয়। আসলে কি জান একটুতেই তোমরা জেলাস। বন্ধুত্ব মানে দৈহিক কোন ব্যাপারই যে নয়, এই মানসিকতা তোমাদের নেই। তোমরা মনে করো, তোমাদের মত। আমরা তোমাদের এই কুৎসিত মনটাকে ঘৃণা করি।
কিংশুক বললো,—এতই যদি ঘৃণা, তাহলে অভিসার শেষ করে, এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঢুকলে কেন?
যতসব রাবিশ সেকেলে কথা। অভিসার, আশ্রয়, কি বলতে চাইছ তুমি?
মানে একটাই। সেটা হল, তোমার স্বামীর এবং শ্বশুরবাড়ির যে একটা মান, মর্যাদা আছে সেটা তুমি ভুলে গেছ।
একটু মুচকি হেসে দোলা বললো, স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, মান, মর্যাদা। পুরোনো পৃথিবীর লোকের মত কথা বলোনা। পৃথিবীটা এখন অনেক দূরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। তাই এই গতিশীল পৃথিবীতে আমাদের ব্যাপারটাকে গেট টুগেদার বলতে পারো আর শ্বশুরবাড়ি নয়। আমি মনে করি এটা ক্লাব হাউস। আর মান, মৰ্য্যাদা, যেমন ক্লাব তেমন মর্যাদা।
তার মানে?
দ্যাখো কিংশুক, তুমি যদি মনে করে থাক যে, এই মুরগির খোপের মত একটা ঘরে তোমার মত একজন কনজারভেটিভের সঙ্গে চিরকাল থাকবে, সেটা তোমার একেবারেই ভুল ধারণা। সময়ের স্মৃর্তি মেটাতে দেহের সম্পর্কটার প্রয়োজন কিন্তু তুমি মনে করোনা যে, এই খোপের মধ্যে, তুমি আমায় একটা সন্তান উপহার দিয়ে আমাকে আটকে রাখবে। সেই বিপদটা যাতে না আসে তার জন্যে আমার ডাক্তার বন্ধুদের প্রেসক্রিপসান মত পিলও আমি খাই। অতএব গেট টুগেদার ছাড়া তোমার সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। আর তোমাকেতো আগেই বলেছি যে, তোমার এই বাড়িটাকে আমি ক্লাব হাউস মনে করি।
তার মানে, আমাদের বিয়ে, রেজেস্ট্রারি এর কি কোন মূল্য নেই?
না। ক্লাবে ঢুকতে গেলে ফর্ম ফিলাপ করতে হয়, তাই ফর্ম সই করে মেম্বারশিপ নিয়েছি। এই ক্লাব ভাল না লাগলে অন্য ক্লাবে মেম্বারশিপ নেবো। আসলে আমি এনজয় করতে চাই। তোমার স্বামীত্বের অধিকার ইত্যাদির আজ আর কোন মূল্য নেই।
কি বলছ তুমি, তাহলে মাথায় সিঁদুর?
ওটা ক্লাবের আইডেন্টিটি। অন্যভাবে ভাবলে এটাকে সাময়িক নিরাপত্তাও ভাবতে পার। কিছু মনে করোনা কিংশুক, তোমায় ভাল লেগেছে বলেই সবকিছু বিসর্জন দেব। এখানে সব কিছুই সেকেলে, প্যান্ট, গেঞ্জি বা শালোয়ার কামিজ পরে বেরোই তখনও ওই বুড়ো, বুড়ি দুটো এমনভাবে ঝুলবুল করে দেখে যে, মনে হয়, এরা অন্য গ্রহের কেউ।
দোলা এবারে তুমি সীমানার বাইরে চলে যাচ্ছ।
একান্ত নিরুপায় হলেই মানুষ সীমানার বাইরে যায়। সময়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের চলতেই হবে কিন্তু তোমার এখানে সেই মান্ধাতা আমলের রুচি, সংস্কার আর পরিবেশ।
কেন তুমিতো এর আগেই এই পরিবেশকে দেখেছ।
হ্যাঁ দেখেছি। তখন তোমার ভাল লাগার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। কিন্তু আজ সেই ভাললাগাটা হারিয়ে গেছে।
কিংশুক এবারে একটু নরম গলায় বললো, তাহলে এখন তুমি কি করতে চাও?
কিছুই না। আচ্ছা কিংশুক তুমি কি একবারও ভেবে দেখেছ যে, তুমি অফিস যাবার পর আমার সময়টা কি ভাবে কাটবে। বাড়িতে একটা টি.ভি. তাও বাবার ঘরে। আমি কি তাদের সঙ্গে বসে গলায় আঁচল দিয়ে ঠাকুর দেবতার বই দেখবো। আমারও তো ইচ্ছে করে টি.ভির প্রোগামগুলো দেখতে। মা-কে বলেছি একটা টি.ভি. পাঠিয়ে দিতে। আমারও বাবা মায়ের বয়স হয়েছে কই তারাতো কনজারভেটিভ নন। বাবা বলেন যুগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে। নইলে হোঁচট খাবে।
কিংশুক ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে ভালবাসে তাই না রেগে গিয়ে, দোলার সমস্ত কথা ও অভিযোগ শোনার পর বললো, দ্যাখো দোলা, পুরোনো ঘরে আমার জন্ম আর পুরোনোকে ঘিরেই আমার শিক্ষা-দীক্ষা ও বেড়ে ওঠা। তাই তোমার কথাগুলোর যুক্তি থাকলেও আমার কথাগুলো যে অযুক্তির নয় সেটাও তোমায় জেনে নিতে হবে। তোমার শিক্ষাও অনেক কিন্তু সেই শিক্ষার মর্যাদার কথা মনে নেই বলেই তুমি আমার বাবা, মা-কে বুড়ো, বুড়ি ইত্যাদি বলে নিজেকেই ছোট করেছ, বিয়েটাকে তুমি যদি ক্লাবের এ্যাডমিশান এবং শ্বশুরবাড়ি ক্লাবহাউস বলল, তাতে এই মানে দাঁড়ায় যে, তুমি তোমার ভোগের জন্যে বিভিন্ন ক্লাব হাউসের মেম্বারশিপ নিয়ে নিজেকে আজকের গতিশীল পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চাও। তুমি কি জানো এর শেষ কোথায়? না না বলতে দাও। এর একটাই মানে হল, তোমার অস্তিত্বকে তুমি নিজেই ধ্বংস করতে চাও। কিন্তু তুমি জানোনা যে, তোমার এই গতিশীল পৃথিবীটা যখন তোমার কাছে থেমে যাবে, তখন তুমি কোথায় দাঁড়াবে।
দোলা বললো, কেন আমিও থেমে যাব। চলার যেমন গতি থাকে ঠিক আমারও বিকল্প আছে।
কিংশুক বললো, তখন তো তুমি আর এই তোমাকে খুঁজে পাবে না।
দ্যাখো কিংশুক তারা এই মিষ্টি কথাগুলো আমাকে বিধলেও আমার গড়ে ওঠাকে আমিই বা কি করে অস্বীকার করবো। আমি জন্মেছি প্রাচুর্যের মধ্যে তাই তোমার এই পরিবেশটাকে আমার অসহ্য লাগে বলেই, তোমাকে আমি সহ্য করতে পারি না।
দ্যাখো দোলা, লোক হাসিয়েতো লাভ নেই। আমরা দুজনেই দুজনের পরিবেশকে আঁকড়ে থেকে শুধুই দাম্পত্য কলহকে বাড়িয়ে তুলবো। তার চেয়ে তুমি তোমার মত থাক আর আমিও চাই থাকতে।
ও—তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে-পথ দ্যাখো। কাপুরুষ এবং অমানুষেরা তাই বলে।
স্টপ ইট। তুমিতো গেট টুগেদারে বিশ্বাসী তাই তোমার পথেই তোমাকে যাবার অনুমতি দিলাম। আমি কাপুরুষ বা অমানুষ নই বলেই তোমার নোংরা মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারলাম না।
ভোরের সূর্য ওঠার আগে দোলা গুছিয়ে ফেললো তার জামা কাপড়, ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে, ট্যাক্সিতে তুলে দেবার সময় কিংশুক বললো-বেস্ট অফ লাক।