শৌখিন বাবা ও তাঁর বন্ধুবান্ধব
বাবা খুব শৌখিন ছিলেন। পোশাক-আশাক সবসময়ই থাকত ধোপদুরস্ত, পাট ভাঙ্গা। বিশেষ শখ ছিল পাদুকার ব্যাপারে। মায়ের কাছে শুনেছি যে প্রথমদিকে বিশ জোড়া জুতা ছিল। আমরাও বারো তেরো জোড়া দেখেছি। দপ্তর থেকে বাড়িতে ফিরে নাশতা খেয়েই অফিসার্স ক্লাবে ছুটতেন টেনিস খেলার জন্য। তখন পরনে থাকত পাজামা আর সাদা শার্ট, পায়ে কেডস জুতা। ক্লাবে যেতেন সাইকেলে চড়ে। সাইকেলে উঠতেন পেছন দিক থেকে। পেছনের চাকার পাশ দিয়ে বের করা একটু অংশে পা রেখে খানিকটা ঠেলে নিয়ে গিয়ে লাফ দিয়ে আসনে বসতেন। তারপর প্যাডেলে পা রেখে চালিয়ে যেতেন। আজকাল কেউ ওভাবে সাইকেলে ওঠে না। সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফিরে নামাজ পড়েই আবার ক্লাবে যেতেন ঘণ্টাখানেকের জন্য। এবার তাস খেলতে। তখন পরনে নতুন পাজামা-শার্ট আর পায়ে পাম্পসু। বাবা প্রায়ই বলতেন যে আমরা অনেকে পোশাকের দিকে মনোযোগ দিলেও প্রায়ই পদযুগলের প্রতি অবহেলা দেখাই। এটা ঠিক নয়।
পিরোজপুরে বাবার দু’জন বন্ধুর কথা আমার বেশ মনে আছে। তার একটা কারণ এই যে তাঁদের সঙ্গে পরবর্তী জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেছিল দু’জনই আজ প্রয়াত। একজন ছিলেন বাবারই সার্ভিসের লোক। পিরোজপুর মহকুমার দ্বিতীয় অফিসার ছিলেন তখন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারের সচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বাবার চাইতে বয়সে একটু ছোট, অত্যন্ত হাসিখুশি, প্রাণ- ঐশ্বর্যে ভরপুর, সবসময়ই প্রয়োজনের চাইতে উঁচু গলায় কথা বলতেন। ভালো টেনিস খেলতেন। ছেলের মতো স্নেহ করতেন আমাকে। আমি খালু ডাকতাম। তিনি ছিলেন মাহতাব উদ্দীন সরকার। উত্তরবঙ্গের লোক। কথা বলার সময় আঞ্চলিক টান লুকোবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করতেন না। প্রচুর পান খেতেন তিনি। আমি যখন চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগে চাকরি করি তখন তিনি ছিলেন আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তা। আমি টাঙ্গাইলে মহকুমা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন-শেষে পদোন্নতি লাভ করে কুমিল্লায় যোগ দিই জেলা কন্ট্রোলাররূপে। আমার আজও মনে আছে বছর দুয়েক সেখানে কাজ করার পর একবার ঢাকায় এসে খালুর বাসায় যখন দেখা করতে যাই তখন খালাম্মা আমার সামনেই তাঁকে লক্ষ করে বলেছিলেন, হ্যাঁগো, ছেলেটাকে আর কতদিন মফস্বলে ফেলে রাখবে? ওকে ঢাকায় বদলি করে আনা যায় না? খালু স্ত্রীর কথার উত্তরে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তখন। কিন্তু এর মাস ছয়েকের মধ্যেই আমি ঢাকায় বদলির হুকুম পাই। একই সঙ্গে আরো কয়েকজন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলির আদেশ পান। আমার চাকরির বার্ষিক রিপোর্টগুলো প্রথম থেকেই ছিল খুব ভালো। ফরিদপুর, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল এবং সর্বশেষ কুমিল্লা : সর্বত্রই আমি দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পাল করেছি, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছি সাহস ও তৎপরতার সঙ্গে। তাই আমাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী শহর ঢাকায় বদলি করার ব্যাপারে খালুকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তিনি আজ বেঁচে নেই কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে ওই পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র আজও অটুট আছে। বাংলাদেশের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় ফসিহউদ্দিন মাহতাব এবং আমার অবস্থান বেশ কাছাকাছি। তাঁর স্ত্রী ডাক্তার হাজেরা মাহতাব দীর্ঘদিন ধরে আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যাপারে আন্তরিকভাবে নির্দেশ পরামর্শ ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছেন। ফসিহউদ্দিনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নাজমুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী। বিগত কয়েক বছর ধরে আমি লোকপ্রশাসন বিভাগের একটি পত্রের সঙ্গে বিভাগের বাইরের পেপারসেটার ও একজামিনার হিসেবে অধ্যাপিকা নাজমুন্নেসা মাহতাবের সঙ্গে কাজ করে আসছি
বাবার আরেকজন বন্ধুর কথা উল্লেখ করেছিলাম। তিনি ছিলেন মহকুমা মেডিক্যাল অফিসার। ভারি সুদর্শন ছিলেন। সুন্দর স্বাস্থ্য। চমৎকার একজোড়া সযতুলালিত পুরু গোঁফ তাঁর চেহারায় বিশেষ ব্যক্তিত্বের ছাপ এনে দিয়েছিল। সূক্ষ্ম রসজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁকেও আমি খালু বলতাম, তাঁর স্ত্রীকে খালাম্মা। আমাদের এই তিন পরিবারের মধ্যে একটা ভারি সুন্দর সৌহার্দ্যের সম্পর্ক দেখে এসেছি আমি, আমার সেই ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার পর অবধি। তিন স্ত্রীর মধ্যে যেমন তিন স্বামীর মধ্যেও তেমনি। বাবার এই তৃতীয় বন্ধু ছিলেন ডক্টর আমীন। আমি যখন ১৯৪৭ সালে টাঙ্গাইলে মহকুমা কন্ট্রোলার তিনি তখন ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন। ময়মনসিংহে আমি যখন সরকারি কাজে গেছি, মাঝে মাঝে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, তখন একাধিকবার তাঁর বাসায় উঠেছি। খালু ও খালাম্মার কাছ থেকে সেসব সময় যে যত্ন ও স্নেহ আদর পেয়েছি তার কথা আমাদের চিরকাল মনে থাকবে। এই খালুও আজ বেঁচে নেই। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় তাঁর বড় ছেলে ব্যাংকার রুহুল আমীনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আমার চাইতে বয়সে ছোট ছিল। সেও কয়েক বছর গুলশানে এক অবিশ্বাস্য মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিল সেই রাতে।
পিরোজপুরে উচ্চতর সরকারি মহলে বাবা, মাহতাব সরকার ও ডক্টর আমীনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল সর্বজনবিদিত। তিনজন কিন্তু বাইরের দিক দিয়ে ছিলেন ভিন্নরকম দেখতে! আলাপচারিতার ভঙ্গির দিক থেকেও তিনজন ছিলেন তিন রকম আঙ্গিকের অনুসারী। পিরোজপুর অফিসার্স ক্লাবে একবার নাট্যাভিনয় হয়। তাঁকে সকাল-সন্ধ্যায় কয়েকদিন ধরে দেখলাম নিজের বাড়ির টানা বারান্দায় পায়চারি করতে করতে নাটকের সংলাপ মুখস্থ করছেন। তিনি অভিনয় করেছিলেন আলমগীর চরিত্রে। ডাক্তার খালুও অভিনয়ে অংশ নিয়েছিলেন। খুব সম্ভব তিনি হয়েছিলেন সাজাহান। মাহতাব খালু অভিনয়ের আগের দিন বাবার কাছ থেকে তাঁর একট ভারী নীলচে সবুজ রঙের ড্রেসিংগাউন ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন, মঞ্চে একটা দৃশ্যে তিনি সেটা পরবেন। ওই ড্রেসিংগাউনে কোমরবন্ধটা ছিল অনেকটা মোটা পাকানো জাহাজের দড়ির মতো। কোনো কোনো স্মৃতি অকারণে মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে থাকে তার রহস্য বোঝা দায়। সেই ড্রেসিংগাউনটা যেন আমি আজও চোখের সামনে দেখতে পাই।
পিরোজপুর স্কুলে যে আড়াই বছর পড়েছিলাম সেটাই আমার বাড়ির বাইরে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা। তার আগে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলের পাঠক্রম অনুসরণ করে বাড়িতেই পড়াশোনা করেছি। তবে শুধু স্কুলের পাঠ্যসূচী নয়, তার বাইরেও অনেক কিছু পড়তে হয়েছে, শিখতে হয়েছে, বিদ্যাশিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অসামান্য প্রতিভার অধিকারী আমার পিতৃদেবের কাছ থেকে। তাঁর সাহায্যে ও নিপুণ নির্দেশে। অনেক সময়ই তিনি শেখাতেন একেবারে হাতে-কলমে এবং আজ যাকে আমরাও অডিও ভিস্যুয়াল বলি সেই প্রক্রিয়ায়।