শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি
ছোট বেলায় আমাদের পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের পার্থক্য শেখানো হয়েছিল : পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা যেখানে মানুষ শোষণ করে মানুষ, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল তার সম্পূর্ণ উলটো। দীর্ঘ দিন পরে বুঝতে পারছি যে, সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদ বিপরীতার্থক নয়; এরা হচ্ছে একে অপরের প্রতিবিম্ব। “মানুষ শোষণ করে মানুষ” বাক্যটি উল্টালে দাঁড়ায় “মানুষ করে শোষণ মানুষ”। প্রকৃত পরিস্থিতির এতে কোন হেরফের হয় না। সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের অবয়বে যত তফাতই থাকুক না কেন, এদের নির্যাস কিন্তু অভিন্ন।
যেখানেই লিখিত ইতিহাস পাওয়া গেছে, সেখানেই রয়েছে মানুষের উপর মানুষের শোষণের সুস্পষ্ট নিদর্শন। কার্ল মার্কস অবশ্য এ মত সমর্থন করতেন না। তিনি মনে করতেন যে, মানুষের ইতিহাস শোষণ নিয়ে শুরু হয়নি, সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ বাস করেছে আদিম সাম্যবাদী সমাজে। কিন্তু প্রদোষ লগ্নের ইতিহাস প্রধানত অনুমান-নির্ভর, এ পর্যায়ের ইতিহাসের যথেষ্ট প্রত্যক্ষ উপাদান নেই। ঐতিহাসিক যুগের লিখিত সূত্র রয়েছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের এ ধরনের কোন উপাদান নেই। প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম সাম্যবাদ তাই যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। একজন দার্শনিক ইতিহাসকে তুলনা করেছেন একটি অসম্পূর্ণ পুঁথির সাথে যার প্রথম পর্বের পাতাগুলি হারিয়ে গেছে আর শেষ পাতাগুলো এখনও লেখা হয়নি। আদিম সাম্যবাদের সত্যতা নির্ধারণ করতে হলে ইতিহাসের পুঁথির হারানো পাতাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত সে সব পাতা খুঁজে পাওয়া না যাবে ততদিন আদিম যুগের সমাজ ব্যবস্থার রূপ সম্পর্কে বিতর্কের নিরসন সম্ভব হবে না।
ইতিহাস নামক পুঁথির পাতা যে পর্যায় থেকে পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই শোনা যাচ্ছে শোষণ ও বঞ্চনার নিষ্করুণ আর্তনাদ। উদাহরণস্বরূপ সাড়ে চার হাজার বছর আগে রচিত এক মিশরীয় কবির ফরিয়াদ নীচে তুলে ধরছি[১]।
“To whom do I speak today?
Brothers are evil,
Friends of today are not of love.
To whom do I speak today?
Hearts are thievish,
Every man seizes his neighbour’s goods.
To whom do I speak today?
The gentle man perishes
The bold-faced goes everywhere. …
To whom do I speak today?
When a man should arouse wrath by his evil conduct
He stirs all men to mirth, although his iniquity is wicked.’
(“আমি আজ কাকে বলবো? ভাইয়েরা মন্দ।
আজকের বন্ধুদের হৃদয়ে প্রেম নেই।
আমি আজ কাকে বলবো?
মানুষের হৃদয় তস্করসুলভ।
প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের মাল গ্রাস করছে।
আমি আজ কাকে বলবো?
সজ্জনেরা লোপ পাচ্ছে।
নির্লজ্জরা সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমি আজ কাকে বলবো?
কেউ তার কুআচরণে অন্যের ক্রোধের উদ্রেক করলে
সবাই হাসছে যদিও এই অন্যায় আচরণ আক্রোশপূর্ণ।”)
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চীন দেশে বাস করতেন প্রখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস। তাঁর জীবনীকারগণ চীনে রাষ্ট্রের শোষণের বিস্তারিত বর্ণনা রেখে গেছেন। কথিত আছে যে, তাঁর নিজের প্রদেশে রাজনৈতিক অশান্তি দেখা দিলে কনফুসিয়াস দুর্গম পর্বতসংকুল পথ অতিক্রম করে অন্য প্রদেশে যাত্রা করেন। পথে তিনি দেখতে পান যে, একজন মহিলা একটি কবরের পাশে বসে কাঁদছে। কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্য জে—লুকে মহিলার কান্নার কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পাঠালেন। মহিলাটি জানায় যে, তার শ্বশুরকে বাঘে খেয়েছে, তার স্বামী বাঘের হাতে নিহত হয়েছে এবং তার ছেলেরও একই ভাবে মৃত্যু হয়েছে। কনফুসিয়াস মহিলাটিকে প্রশ্ন করলেন, তিনি কেন এত বিপজ্জনক পরিবেশে বাস করছেন। মহিলা জবাব দিলেন যে, এখানে বিপদ থাকলেও অত্যাচারী শাসক নেই। উত্তর শুনে কনফুসিয়াস তাঁর শিষ্যদের বলেন, “বৎসগণ, মনে রেখো, অত্যাচারী সরকার বাঘের চেয়েও হিংস্র।”
কনফুসিয়াস ভয় করতেন অত্যাচারী শাসকদের। ভারতীয় দার্শনিকদের মতে অত্যাচারী শাসকদের চেয়েও বিপজ্জনক হল নৈরাজ্য। ভারতীয় দার্শনিকরা নৈরাজ্যকে আখ্যায়িত করেন “মাৎস্যন্যায়” যার অর্থ হল মাছের মত। মাছের জগতে বড় মাছ ছোট মাছকে খায়। নৈরাজ্য দেখা দিলে বড়লোকরা ছোটদের সম্পত্তি গ্রাস করে। এর ফলে নৈরাজ্যে শোষণ হয় সবচেয়ে প্রকট। রামায়ণে তাই নৃপতিবিহীন জনপদকে জলবিহীন নদী, তৃণবিহীন বন, এবং রাখালবিহীন গবাদিপশুর পালের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মহাভারতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে : প্রথমে বেছে নেবে রাজা, তারপর পছন্দ করবে স্ত্রী, আর সবশেষে আহরণ করবে সম্পদ। কেননা নৈরাজ্য প্রতিহত করার জন্য উপযুক্ত রাজা না থাকলে স্ত্রী এবং সম্পত্তি কোনটাই রক্ষা করা যাবে না।
শাসক থাকুন আর নাই থাকুন, শাসক ভালোই হোন আর মন্দই হোন – মানুষের উপর মানুষের শোষণ সব অবস্থাতেই ছিল অব্যাহত। মানুষের ইতিহাস তাই শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের ইতিহাস। কৃষিপ্রধান সমাজে এ বিদ্রোহ কৃষক বিদ্রোহের রূপ নেয়। শোষিত মানুষ বার বার শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কোন কোন দেশে এ সব বিদ্রোহের বিস্তারিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও এ ইতিহাস হারিয়ে গেছে। অতি অল্প সংখ্যক দেশের ইতিহাসে কৃষক বিদ্রোহের অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য চিত্র পাওয়া যায়। জাপানের ইতিহাসে কৃষক বিদ্রোহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ঐতিহাসিক ডেভিড এস ল্যান্ডিসের হিসাব অনুসারে ১৫৯০ হতে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ২৭৭ বছরে জাপানে প্রায় তিন হাজার কৃষক বিদ্রোহ হয়।° বছরে গড়ে প্রায় এগারটি কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। কিন্তু এ ধরনের বিদ্রোহ জাপানের সামাজিক কাঠামোর কোন মৌলিক পরিবর্তন করতে পারেনি। এ সব বিদ্রোহ ছিল ইতিহাসের স্ফুলিঙ্গ। উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়াই ছিল এদের নিয়তি। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ বিপ্লবের দাবানল সৃষ্টি করেনি।
শোষণের কানাগলিতে আবদ্ধ মানুষ অন্ধ আক্রোশে ফুঁসেছে, কিন্তু কোথাও আশার আলো দেখতে পায়নি। ধর্ম প্রচারকগণ এবং স্বপ্নরাজ্যের প্রবক্তা দার্শনিকগণ মানুষকে শোষণ ব্যবস্থা অবসানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা যুক্তি-তর্ক দিয়ে শোষণ ব্যবস্থা অবলুপ্তির ঐতিহাসিক অনিবার্যতা প্রমাণ করতে পারেননি। মার্কস কল্পনা-বিলাসী দার্শনিক ছিলেন না। শ্রেণী সংগ্রামে শোষিতের বিজয়ের অবশ্যম্ভাবিতা তিনিই প্রথম প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তি হল তাঁর চারটি অনুমান। প্রথমত, মার্কস মনে করতেন যে, শোষিত মানুষ সকল সমাজব্যবস্থাকেই ঘৃণা করেছে কিন্তু পুঁজিবাদের প্রতি সর্বহারাদের যে ধরনের ঘৃণা দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ঘৃণা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এর কারণ হল, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা হতে শোষিত মানুষ বিচ্ছিন্ন; পুঁজিবাদের আগে যে সব উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল তাতে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা (alienation) ঘটেনি। তাঁর মতে প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা শুধু উৎপাদনের উপকরণ ছিল না, সমাজ ব্যবস্থায় তাদের একটি নিজস্ব সত্তা ও ভূমিকা ছিল। প্রাক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের সকল যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করত শ্রমিকরা, যদিও সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকরা যন্ত্রের মালিক ছিল না। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করে মালিক। শ্রমিক শুধু মজুরি পায়, উৎপাদিত পণ্যে তার কোন অধিকার নেই। আর্থিক দিক হতে বঞ্চিত ও মানসিক ভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বহারা শ্রেণীর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাছে কোন দায় নেই। তাই বঞ্চিত মানুষেরা এ ব্যবস্থা উৎখাত করার জন্য এগিয়ে আসবে।
দ্বিতীয়ত, মার্কস মনে করতেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি সর্বহারাদের ঘৃণা ক্রমেই বাড়বে। এর কারণ হল শ্রমিক শ্রেণীসমূহের ক্রমবর্ধমান দুর্দশায়নের (Law of immiserization of the working classes) বিধি। মার্কসের মতে নিরন্তর কারিগরী পরিবর্তনের ফলে শ্রমিকদের চাহিদা ক্রমাগত কমবে। বেকার সমস্যা এর ফলে প্রকটতর হবে। শ্রমিকদের মজুরির হার কমতে থাকবে। পক্ষান্তরে বিরামহীন প্রতিযোগিতায় মুনাফার হারও কমে আসবে। এর ফলে শ্রমিকদের উপর শোষণের মাত্রা বাড়তে থাকবে। কাজেই শ্রমিকদের পক্ষে এ শোষণ ব্যবস্থা রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না।
তৃতীয়ত, শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে পল্লী অঞ্চল হতে উৎপাটিত ছিন্নমূল মানুষেরা ভিড় জমিয়েছে শহরের কারখানাসমূহে। অতীতে সর্বহারারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বহারা শ্রেণী অতি ক্ষুদ্র অঞ্চলে জমায়েত হয়। তাই তাদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
চতুর্থত, শুধু শোষণের মাত্রা বাড়লেই শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেবে না। শোষিতদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত না করা হলে সমাজ ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনই ঘটবে না। মার্কসের আশাবাদের একটি কারণ হল কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যুদয়। তাঁর মতে কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের পথিকৃত হিসাবে কাজ করবে। সুতরাং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে না।
বিংশ শতাব্দীর এক পর্যায়ে মনে হয়েছে যে, কোন কোন ক্ষেত্রে বিচ্যুতি দেখা দিলেও, ইতিহাসের মূলধারা মার্কসের অভিক্ষেপিত পথ ধরেই এগুচ্ছে। মার্কস মনে করতেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লব ঘটবে শিল্পোন্নত দেশে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয় শিল্প ক্ষেত্রে অনুন্নত পূর্ব ইউরোপে ও পূর্ব এশিয়াতে। তবু বিংশ শতাব্দীতে কয়েক দশক ধরে মনে হয়েছে যে পূর্ব দিগন্ত সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনায় লাল হয়ে উঠেছে। সমাজতন্ত্রের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে এশিয়াতে, ল্যাতিন আমেরিকাতে এবং আফ্রিকাতে।
বিংশ শতাব্দীতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল মহাকাব্যের ব্যাপ্তি ও গভীরতা নিয়ে; দুর্ভাগ্যক্রমে এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে প্রহসনে। জনৈক রসিক জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্রবীভবন লক্ষ্য করে বলেছেন যে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল পুরুষালি বিপ্লব রূপে আর শেষ হয়েছে মেয়েলি বিপ্লবে। পুরুষালি বিপ্লব হল কঠিন, কঠোর ও শোণিতাক্ত। এ ধরনের বিপ্লব সম্পর্কেই মাও সে তুং বলেছেন[৫]:
Revolution is not a dinner party, nor an essay, nor a painting, nor a piece of embroidery, it cannot be advanced softly, gradually, carefully, considerately, respectfully, politely, plainly and modestly. (বিপ্লব কোন ভোজন উৎসব নয়, কোন রচনা নয়, চিত্রকর্ম নয় অথবা নকশি কাঁথার কারুকাজ নয়, তাই বিপ্লবকে কোমলভাবে, ক্রমান্বয়ে, সতর্কতার সাথে, সুবিবেচনার সাথে, সম্মানের সাথে, মার্জিতভাবে, সহজভাবে এবং বিনয়ের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।)
পুরুষালি বিপ্লবের মত মেয়েলি বিপ্লবেও সমাজ ব্যবস্থাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু মেয়েলি বিপ্লব মাও সে তুং-এর বিপ্লবের সংজ্ঞার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরু। এ বিপ্লবে রক্তপাত ঘটে না। তবু মেয়েলি বিপ্লবে জার্মানি, রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে নির্দেশ অর্থনীতি ভোজবাজির মত হারিয়ে গেল। বার্লিনে এ ধরনের বিপ্লবের সাথে সাথে পূর্ব বার্লিনের মহিলারা মনের সুখে পশ্চিম বার্লিনে বাজার করতে ভিড় জমালেন। যে বিপ্লবে বাজার করার সুযোগ বাড়ে (বাজার করার জন্য মহিলাদের দুর্বলতার কথা কে না জানে!) তাকে মেয়েলি বিপ্লব বলাই বোধ হয় অধিকতর শোভনীয়।
বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতার আলোকে মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণীর পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ফরাসীদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তারা কখনও তাদের নিজেদের কোন দুর্বলতা স্বীকার করে নেয় না; সব সময়েই ব্যর্থতা বাইরের কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। মার্কসীয় পণ্ডিতগণ ফরাসীদের মত। মার্কসীয় তাত্ত্বিকরা শিল্পোন্নত দেশসমূহে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য মার্কসীয় তত্ত্বের কোন ত্রুটিই স্বীকার করে নেয়নি। প্রথমে বলা হত যে, শিল্পোন্নত দেশসমূহ সাম্রাজ্য স্থাপন করে তাদের দেশে বিপ্লব ঠেকিয়ে রেখেছে। যখন সাম্রাজ্যবাদ অবলুপ্ত হল তখন সকল দোষ চাপানো হল নব্য সাম্রাজ্যবাদ এবং পোষক-মক্কেল (patron-client) সম্পর্কের ভিত্তিতে শোষণের উপর।
মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে কোন দেশেই সর্বহারা শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। মার্কসের অনুমান ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সকল সর্বহারা মানুষ শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত হবে। মার্কস মনে করতেন যে, সকল শোষিত মানুষই হচ্ছে সমজাতীয় (homogeneous), এদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কাজেই এদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা মোটেই দুরূহ নয়। এ ধারণা সত্য নয়। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে শুধু সামাজিক একক-বন্ধন (mono-sociality) দেখা যায়। একটি হাতি শুধুমাত্র একটি পালের সদস্য, একটি পাখি শুধুমাত্র একটি ঝাঁকের অংশ। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের সমাজে রয়েছে বহুবিধ-বন্ধন (multisociality)। পল্লী অঞ্চল হতে উৎপাটিত একজন ছিন্নমূল মানুষ শুধু কারখানার শ্রমিক নয়, তার ধর্মীয় সত্তা রয়েছে, তার ভাষাগত সত্তা রয়েছে, তার আঞ্চলিক সত্তা রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা নানা ভাষায় কথা বলে। একই ভাষাভাষীদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন থাকে। আবার শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মের বিভিন্নতা থাকে। একই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে। কাজেই শ্রমিকরা ভিন্ন ভিন্ন উপাসনালয়ে যায়। তাই শ্রমিকদের সামাজিক বন্ধনে পার্থক্য ঘটে। সকল শ্রমিক সমজাতীয় নয়, এরা বহুজাতীয়। বহুজাতীয় জনগোষ্ঠীর সংগঠন সহজ নয়। এদের মধ্যে তাই দেখা দেয় নানাবিধ অন্তর্দ্বন্দ্ব। ভাষার ভিন্নতার জন্য বিহারী-বাঙ্গালী শ্রমিকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ধর্মের ভিন্নতার জন্য হিন্দু মুসলমান শ্রমিকরা একে অপরকে হামলা করে। এমনকি জেলার ভিন্নতার জন্য, অথবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিন্নতার (যথা শিয়া/সুন্নী) জন্য হানাহানি দেখা দেয়। তাই শোষিত শ্রেণী সম্মিলিতভাবে শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই না করে নিজেরাই অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কস অনুমান করেছিলেন যে, অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত শ্রেণীর কাছে শোষণই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কাজেই অন্য সকল সামাজিক সত্তা সর্বহারাদের শ্রেণী চেতনায় হারিয়ে যাবে। কিন্তু মার্কসের এ অনুমান মোটেও সঠিক নয়। দীর্ঘদিনের সমাজতান্ত্রিক নিরীক্ষার পর আজও সার্বিয়ার শ্রমিক শ্রেণী বসনিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর উপর আক্রমণ সমর্থন করছে। সোভিয়েত রাশিয়া অথবা চীনে ধৰ্মীয় বা আঞ্চলিক জাতীয় চেতনা কোনটাই হারিয়ে যায়নি।
মানুষের সামাজিক জীবন অত্যন্ত জটিল ও বর্ণাঢ্য। কোন সমাজবিজ্ঞানীর পক্ষেই সমাজের সকল উপাদান তুলে ধরা সম্ভব হয় না। তাই তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় উপাদানের মধ্যে পার্থক্য করতে হয়। প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানীই তার নিজের মতে যা প্রয়োজনীয় তার ভিত্তিতে তত্ত্ব রচনা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অপ্রয়োজনীয় উপাদান বলে যা বাদ দেওয়া হয় তা মোটেও অপ্রয়োজনীয় নয়। তার ফলে সামাজিক তত্ত্ব বাস্তবের অতি-সরলীকরণ হয়ে দাঁড়ায়। মার্কস সমাজে মাত্র দুটি শ্রেণীর অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন : শোষক ও শোষিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকল শ্রেণীকেই দুটি শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। মার্কসীয় তত্ত্বে তাই অন্তর্বর্তী (intermediate) শ্রেণীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দক্ষ কারিগর শ্রেণী (artisans), ক্ষুদ্র নিয়োগকারী (employer) পাতি বুর্জোয়া, কারখানাতে তত্ত্বাবধানকারী ব্যবস্থাপক এবং পেশাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মার্কস মনে করতেন যে, শ্রেণী সংগ্রামের মেরুকরণের প্রক্রিয়াতে অন্তর্বর্তী শ্রেণীসমূহ শোষক বা শোষিত শ্রেণীর মধ্যে আত্তীভূত হয়ে যাবে, এদের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে অন্তবর্তী শ্রেণী মুছে যায়নি, ইতিহাসের প্রক্রিয়াতে আরও শক্তিশালী হয়েছে। মার্কস অনুমান করেছিলেন যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতে বেশিরভাগ কর্মসংস্থান হবে প্রক্রিয়াজাত শিল্পে মজুরিভিত্তিক কাজে। কিন্তু প্রক্রিয়াজাত শিল্পে মোট শ্রমিকদের সিংহভাগ কখনও নিয়োজিত হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ষাটের দশকে প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের (দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যার ভিত্তিতে) হিস্সা ছিল ৩৬ শতাংশ। এই হিস্সা বর্তমানে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৯৮ সালের জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, ১৯৯০ সালে শিল্পোন্নত দেশসমূহে (OECD) মাত্র ৩০ শতাংশ শ্রমিক শিল্পে কাজ করে, ৬০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করে সেবা খাতে আর মাত্র ১০ শতাংশ কাজ করে কৃষি খাতে।[৭] সেবা খাতে যারা কাজ করে তাদের বেশির ভাগই স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত অথবা ক্ষুদ্র নিয়োগকারীর সাথে কাজ করছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী শ্রেণী শিল্পোন্নত দেশসমূহে সর্বহারা শ্রেণীর চেয়েও আকারে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই শিল্পোন্নত দেশসমূহে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮৫ হতে ১৯৯৫ –এই দশকে শিল্পোন্নত দেশসমূহে মোট শ্রমশক্তিতে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যার অনুপাত ৪২ শতাংশ থেকে ৩৬ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে।
এ ধরনের প্রবণতা শুধু শিল্পোন্নত দেশসমূহেই সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রবণতা বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশেও সুস্পষ্ট। বাংলাদেশে ১৯৯৫-৯৬ সালের শ্রমশক্তি সমীক্ষা হতে দেখা যাচ্ছে যে, মোট কর্মরত ব্যক্তিদের মাত্র ১৫.৫ শতাংশ শিল্প ও যোগাযোগ খাতে নিযুক্ত। বাংলাদেশের কারখানার মোট শ্রমিকের চেয়ে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৯৮—৯৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট জাতীয় উৎপাদের মাত্র ১১.২ শতাংশ শিল্প খাত হতে আসে, আর সেবা খাতে উদ্ভূত হয় প্রায় ৪৭.২ শতাংশ। কাজেই এ সমাজে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যেও শ্রমিক শ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হল আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। এ ধরনের সমাজে মার্কসীয় বিশ্লেষণ অনুসারে সর্বহারাদের বিপ্লব অনিবার্য হওয়ার পক্ষে কোন অমোঘ যুক্তি নেই।
মার্কসের চিন্তার জগৎ শুধু কারখানা মালিকদের শোষণ নিয়ে আচ্ছন্ন ছিল। তাই তিনি শুধু গরীবদের উপর ধনীদের শোষণ নিয়েই লিখেছেন। কিন্তু দরিদ্ররা সকলে সমশ্রেণীর নয়। তার ফলে দরিদ্ররাও দরিদ্রদের শোষণ করে। বড় ধনী শোষণ করে ছোট ধনীদের, ছোট ধনীরা শোষণ করে মাঝারি দরিদ্রদের আর মাঝারি দরিদ্ররা শোষণ করে হত-দরিদ্রদের। বাস্তব জীবনে শোষণের স্তর দুটি নয়, শোষণের অনেক স্তর। শুধু একটি মাত্র স্তরে শোষক আর শোষিত জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত নয়, স্তরে স্তরে শোষক আর শোষিতের সংঘর্ষ চলছে। এক স্তরে যিনি শোষক, পরবর্তী স্তরে তিনিই শোষিত। কাজেই সর্বহারার শ্রেণীচেতনা ঘনীভূত হতে পারে না। বাংলাদেশে তাই শ্রমিক শ্রেণী ভূমি সংস্কারের বিরোধিতা করে। মার্কসের তত্ত্ব অনুসারে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত শ্রমিক সর্বহারা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; প্রকৃতপক্ষে এরা বিশেষ সুবিধাভোগী সামাজিক গোষ্ঠী। কৃষি অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তুলনায় আনুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের আয় অনেক বেশি। এর ফলে এদের অনেকের পক্ষেই মজুরির টাকা জমিয়ে গ্রামে ভূসম্পত্তি কেনা সম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে ডক্টর কামাল সিদ্দিকী ও তাঁর সহকর্মীদের ঢাকা শহরের আনুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সমীক্ষার তথ্যাদি স্মরণ করা যেতে পারে। ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের শতকরা ৮০ ভাগের গ্রামে ভিটা ও জমি রয়েছে। যাদের জমি রয়েছে এদের গড় জমির পরিমাণ হল ১.৩ একর। এদের বেশির ভাগই গ্রামে ভাগচাষী অথবা ভূমিহীন শ্রমিকদের দিয়ে জমি চাষ করায়, এরা প্রত্যেকে গ্রাম থেকে (১৯৮৮ সালের বাজার মূল্যে) গড়ে বছরে চার হাজার টাকা আয় করে। আনুষ্ঠানিক খাতের অধিকাংশ শ্রমিকই হল গ্রামাঞ্চলে অনুপস্থিত ভূস্বামী। শহরে তারা মালিকদের বিপক্ষে শ্লোগান দিলেও গ্রামে এদের অবস্থান ভাগচাষী ও ভূমিহীন শ্রমিকদের বিপক্ষে। এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থাতে সর্বহারার চেতনা দানা বেঁধে উঠতে পারে না।
শুধু শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে সরলীকৃত ব্যাখ্যাই মার্কসবাদের একমাত্র দুর্বলতা নয়। মার্কস কারিগরী পরিবর্তনের সুফল সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। কারিগরী পরিবর্তনের ফলে শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান দুর্দশায়ন শুরু হয়নি—শুরু হয়েছে ক্রমবর্ধমান স্বাচ্ছন্দ্য। উপরন্তু কার্ল মার্কস ধরেই নিয়েছিলেন যে, পুঁজিবাদ কোন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। বিভিন্ন সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে পুঁজিবাদের অনেক দুর্বলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করা হয়েছে। কল্যাণ-রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তার জাল সম্প্রসারিত করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নেতারা শুরু করেননি, করেছেন বিসমার্কের মত রক্ষণশীল নেতারা।
আগামী দিনের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীই সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের স্বর্ণ-যুগ রূপে চিহ্নিত হবে। আর কোন শতাব্দীতেই এত দীর্ঘদিন ধরে এত ব্যাপক পরিসরে সমাজতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি। তবু শতাব্দীর শেষে সমাজতন্ত্র নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারেনি। ইতিহাসে সকল আদর্শবাদ ও ধর্মের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে কমিউনিজমের কপালেও তাই ঘটল। অর্থনৈতিক তত্ত্বের ঐতিহাসিক স্কট গর্ডন যথার্থই বলেছেন যে, যখনই কোন আদর্শ বা ধর্ম সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উপনীত হয় তখনই তার মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী প্রবণতা দেখা দেয়।o এ ধরনের আদর্শগত ডিগবাজির প্রবণতার ফলে বিশ্বজনীন ভালবাসার নামে মৌলবাদী খ্রীষ্টানরা ভিন্ন মতাবলম্বীদের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে; ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চরম সমর্থক রোমান্টিক মতবাদ ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্রীয় একনায়কত্বের সমর্থনে; নাস্তিক শাক্য মুনি ভগবান বুদ্ধে পরিণত হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের অবলুপ্তির অভীষ্টে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরাই গড়ে তুলেছিল সবচেয়ে শক্তিশালী সমগ্রতাবাদী (totalitarian) রাষ্ট্র। সর্বহারা শ্রেণীর পুরোধা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা একটি নতুন শোষক শ্রেণী রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিংশ শতাব্দীতে শোষণ বন্ধ হয়নি। একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের উপর মানুষের শোষণ হয়ত বন্ধ হবে না। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, বিংশ শতাব্দীতে যে সব বিপ্লবী পুরানো পৃথিবীকে পরিবর্তন করার জন্য মরণপণ সাধনা করেছেন তাঁরা কি সকলেই ভুল করেছেন? আমি কিন্তু মনে করি না যে, তাঁরা আদৌ কোন ভুল করেছেন। শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী চেতনা জন্ম দেয় মহত্তম মানবিক মূল্যবোধের। যে দিন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেমে যাবে সে দিন বুঝতে হবে যে, মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে। একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ্ যথার্থই বলতেন, যৌবনে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তাদের হৃদয় নেই; বেশি বয়সে যারা রক্ষণশীল হয় না তাদের মগজ নেই। পৃথিবীতে যতদিন হৃদয়বান লোক থাকবে ততদিন সমাজতন্ত্রের আদর্শও মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে।
বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, কোন বিপ্লবই চিরস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারেনি। অথচ সংস্কারমূলক ব্যবস্থার ফলে শোষিতদের জীবনে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, শোষণের অবলুপ্তির জন্য কি বিপ্লবের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে, না বিবর্তনের ফলে শোষণ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে? বিবর্তনবাদীরা মনে করে যে, শোষণ ব্যবস্থা অনুৎপাদনশীল। সমাজে অসাম্য দূর হলে ব্যষ্টিক পর্যায়ে যেমন সুফল দেখা দেবে, সামষ্টিক পর্যায়েও তেমনি অগ্রগতি দেখা যাবে। কাজেই পুঁজিবাদের স্বার্থেই শোষণের তীব্রতা কমে আসবে। মজুরির হার বাড়লে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এবং তার ফলে কর্মক্ষমতা বাড়বে। শ্রমিকরা শিক্ষিত হলে তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতীয়ত, সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন হলে দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। ভোগ্যপণ্যের বিক্রয় বাড়লে দেশে উৎপাদন বাড়বে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু সংস্কারপন্থী এ চিন্তাধারার তিনটি সুস্পষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষার সম্প্রসারণের সাথে সাথে আর্থিক বৈষম্য মোটেও কমছে না। একজন অর্থনীতিবিদ্ যথার্থই বলেছেন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে রূপকথার এলিসের আজব দেশের নিয়মাবলী প্রযোজ্য।” আজব দেশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলে দৌড়াতে হয়। আর্থিক অসাম্য একই পর্যায়ে রাখতে হলেও সব সময়েই সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, অন্যথায় অসাম্য বাড়তেই থাকবে। সমাজে সকলকে একই স্তরের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন রাষ্ট্রে নানা পর্যায়ের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে তাই আয়ের বৈষম্য বাড়ছে।
দ্বিতীয়ত, বাইরে থেকে আঘাত না এলে যারা শোষণের সুফল ভোগ করে তারা প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনে রাজি হবে না। ভারতের বর্ণ প্রথা এর একটি উদাহরণ। হাজার হাজার বছরে এর পরিবর্তন হয়নি। গৃহযুদ্ধ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দাস প্রথা উচ্ছেদ সম্ভব হত না।
তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে কখনও শোষণ দূর হবে না। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক রয়েছে। এদের সমঝোতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজ পরিচালিত হয়। ধরা যাক একটি দেশে দুইটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক শোষণ সম্পূর্ণ দূর করতে চায়। আরেকটি দল ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমাজতান্ত্রিক দল অন্য দলের ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য সমাজতন্ত্রের দাবি নিয়ে আপোষ করবে এবং ধর্মতান্ত্রিক দলের কোন কোন দাবি গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে ধর্মতান্ত্রিক দল ধর্মের ক্ষেত্রে কিছু কিছু আপোষ করবে এবং সমাজতন্ত্রের কিছু শ্লোগান গ্রহণ করবে। এর ফলে কোন দলই তার আদর্শ পুরাপুরি বাস্তবায়ন করবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে আপোষ ও সমঝোতার ফলে শোষণ কখনও দূর হবে না।
মার্কসবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়লেও শোষণ যতদিন থাকবে ততদিন বিপ্লবী চেতনার দীপ জ্বলতেই থাকবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের স্বপ্ন অবাস্তব হলেও মানুষ অতীতে এ স্বপ্ন দেখেছে, বর্তমানে দেখছে এবং ভবিষ্যতেও দেখবে। অর্থনৈতিক চিন্তার ঐতিহাসিক স্কট গর্ডন যথার্থই লিখেছেন[১১]:
Empires rise and fall; races and nations flourish and then disappear, preachers of new doctrines are crucified or burnt at the stake, heretical books are destroyed, but basic ideas never die. The culture absorbs them, like an organism digesting the nutriment essential to its existence, and the elements reappear, time and again, in new forms.
(সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন হয়, নরগোষ্ঠী ও জাতিসমূহ সমৃদ্ধি লাভ করে ও অবলুপ্ত হয়, নতুন মতবাদের প্রচারকদের ক্রুশবিদ্ধ করে অথবা খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়, প্রচলিত মতবিরোধী গ্রন্থ পোড়ানো হয়, কিন্তু মৌল ধারণা কখনও মরে না। সংস্কৃতি এ ধরনের মৌল ধারণা শুষে নেয় যেমন করে উদ্ভিদ তার বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক পুষ্টি গ্রহণ করে, মৌল উপাদানসমূহ বার বার নতুন আকারে ফিরে আসে।)
অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ একটি মৌল ধারণা। কমিউনিজমের আতঙ্ক অপসৃত হলেও সাম্যের দাবি থামবে না। নতুন নতুন রূপে অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেবে। কমিউনিজম মরে গেলেও নতুন করে সমাজতন্ত্রকে আবিষ্কার করতে হবে। জ্ঞানের সাধনা সম্পর্কে ইরানের একজন কবি যা বলেছেন মানুষে মানুষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্পর্কেও একই বক্তব্য প্রযোজ্য :
রাহ রাঙা বা খাস্তাগি য়ে বাহ নিস্ত
ইশক হম রাহ আস্ত ও হাম খোদমনজিল আস্ত।
(যারা এ পথে চলে তারা কখনও ক্লান্তি জানে না – কারণ এ পথ একই সঙ্গে পথ ও গন্তব্য)।
.
তথ্যসূত্র
১. Durant, Will, Our Oriental Heritage (New York: Simon and Schuster, 1963), p. 195
২. Basham, A. L., The Wonder That Was India (New York: Grove Press, Inc., 1954), p. 86
৩. Landes, David S., The Wealth and Poverty of Nations (New York: W. W. Norton and Company, 1998), p. 361
৪. Blaug, Mark, Economic Theory in Retrospect (Cambridge: Cambridge University Press, 1996), pp. 259-260
৫. Webster’s Compact Dictionary of Quotations (Springfield: Merriam Webster, 1992), p. 287
৬. Gordon, Scott, The History and Philosophy of Social Science (London: Routledge, 1993), p. 272
৭. UNDP, Human Development Report (New York: Oxford University Press), p. 191
৮. Siddiqui, Kamal, et. al, Social Formation in Dhaka City (Dhaka: University Press Ltd., 1990), p. 213
৯. Gordon, Scott, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫৭
১০. Thurow, Lester, The Future of Capitalism (London, Nicholas Brealey, 1996), p. 245
১১. Gordon, Scott, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৭