শোভা সেন : বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের হেলেনে ভাইগেল

শোভা সেন
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের হেলেনে ভাইগেল

পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, ব্যক্তি জীবনের দুর্যোগ (স্বামীর উপর্যপুরি গ্রেপ্তার ও কারাবাস), থিয়েটার দলে ভাঙন ও বিতর্ক যাঁকে দমাতে পারেনি, রাজনীতির পটপরিবর্তন ও অস্থির সময় একজন দায়বদ্ধ শিল্পী হিসাবে যাঁর বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি, সেই শোভা সেনের জন্ম ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৩ সালে ঢাকায় মামার বাড়িতে। বাবা ডা. নৃপেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন উত্তর কলকাতার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। শিক্ষা শুরু বীণাপাণী পর্দা হাইস্কুলে এবং তারপর বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক। স্কুলজীবন থেকেই অভিনয়ে হাতেখড়ি—পরে বেথুন কলেজে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ রক্ষা’ নাটক দিয়ে নিয়মিত অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৩৯ সালে শ্রীমতী সেন যখন বেথুন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। ১৯৪২ সালে তার বিবাহ হয় বাবা-মার পছন্দ করা বছর দশেকের বড়ো দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে। সেই সময় মহাযুদ্ধের লেলিহান আগুনের গ্রাসে মানুষের জীবন ছারখার। কালোবাজার, দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব, মড়কের করাল ছায়া। অন্যদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক, কলকাতায় জাপানি বোমার আতঙ্কের সঙ্গে ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘের উদ্যোগে এবং কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বাবধানে জনযুদ্ধের প্রচার। এই অগ্নিঝরা টালমাটাল সময়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তরফে ১৯৪৪ সালে ‘নবান্ন’ নাটকের ঐতিহাসিক প্রযোজনা দিয়ে শ্রীমতী শোভা সেনের প্রকৃত অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল।

বিবাহিত জীবনের শুরুতে তিনি প্রথম স্বামীর বামপন্থী মনোভাবের জন্য কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও গণনাট্যসংঘের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। নবান্ন নাটক করতে গিয়ে শ্রীমতী সেন প্রথম নাট্যশিক্ষকরূপে পান বিজন ভট্টাচার্য এবং শম্ভু মিত্রকে। ভারতীয় থিয়েটারের এই দুই পুরোধার শিক্ষায় তার অভিনেত্রী জীবন শুরু থেকেই ছিল যথেষ্ট পরিণত। বিশ্বযুদ্ধ থামার পর ১৯৪৬ সালে যখন সারা ভারতের সংগ্রামী শ্রমিকদের রেল ও ডাক ধর্মঘটের সাফল্য, বোম্বাইতে তখন ইতিহাস খ্যাত নৌবিদ্রোহের আপোশহীন লড়াইয়ের ধাক্কায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কেঁপে উঠেছে। তখন নোয়াখালি, বিহারের সঙ্গে কলকাতার রাজপথও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে রক্তস্নাত, মাথার ওপর দেশ বিভাগের অশনিসংকেত, কারফিউ ও মিলিটারি বুটের কর্কশ পদধ্বনির মধ্যে শ্রীমতী শোভা সেন পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। তারপর ৪৭ সালে স্বাধীনতা এল এবং ৪৮ সালের শুরুতে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে গান্ধীহত্যা এবং কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হল।

পঞ্চাশের দশকের শুরুতে আইপিটি এ-র তরফে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে উৎপল দত্তের পরিচালনায় শ্রীমতী সেন অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর ১৯৫১ সালে শেকসপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের নির্বাচিত দৃশ্যাবলিতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তখনও প্রকৃত অর্থে গুরুলাভ হয়নি। ইতিমধ্যে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে শোভা সেনের চলচ্চিত্রজীবন শুরু হল। একের পর এক পরিবর্তন, ‘বামুনের মেয়ে’ এবং ১৯৫১ সালে ‘বাবলা’ ছায়াছবিতে বিভিন্ন ভূমিকায় রূপদান করে তিনি এই নতুন শিল্পমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৫২ সালে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাড়া জাগানো ‘নাগরিক’ ছবিতে শোভা সেনের অভিনয় এক স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু পথের পাঁচালী’র আগে নির্মিত এই ছবি সঠিক সময়ে মুক্তি পায়নি। বাংলা মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী প্রভাদেবীর স্নেহধন্যা শোভা সেন বাংলা বাণিজ্যিক ছায়াছবিতে এই সময় বিপুল সাফল্য পেয়েছিলেন।

১৯৫৪ সাল থেকেই শ্রীমতী সেনের পেশাগত জীবনে এক নতুন পর্ব শুরু হল, যা পরবর্তী সময়ে তার ব্যক্তিজীবনেও অনেক ওলোটপালট ঘটিয়ে দেয়। এই সময়ে উৎপল দত্তের ডাকে বাংলায় শেকসপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি লিটল্‌ থিয়েটারে যোগ দিলেন। এক আন্তর্জাতিক মানের পরিচালক ও শিক্ষকের কাছে শ্রীমতী শোভা সেন প্রশিক্ষণ পেতে শুরু করলেন। একে একে রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন ও তপতী’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদৌল্লা’, মাইকেলের ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, বাংলা তর্জমায় গোর্কির নীচের মহল’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে শ্রীমতী সেন বাংলা থিয়েটারের একজন প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রীতে পরিণত হন। পাশাপাশি, ওই ১৯৫৪ সালেই ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ও ‘মরণের পরে’, ১৯৫৬ সালে ‘ত্রিযামা’ ও ‘শিল্পী’ ছবিতে অংশগ্রহণ। ১৯৫৭ সালে ‘পথে হলো দেরী’ ও ‘অভয়ের বিয়ে’ ইত্যাদি উত্তম-সুচিত্রা জুটির স্বর্ণযুগের জনপ্রিয় বাণিজ্যিক ছবিতেও তার ভূমিকা নগণ্য নয়।

শোভা সেনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্মরণে বিস্মরণে—নবান্ন থেকে লাল দুর্গ’-এর ভূমিকায় উৎপল দত্ত নানা প্রসঙ্গের মধ্যে দুটি প্রধান কথা লিখেছেন। প্রথমত, প্রায়ই অভিনেত্রী শোভা সেনের ভূমিকার তলায় চাপা পড়ে যায় তাঁর অসামান্য সাংগঠনিক শক্তির অবদান। উৎপল লিখেছেন— ‘শিল্পী ও সংগঠনকে যেন একটা অলিখিত বিরোধ আমাদের নাট্যশালাকে বারম্বার জর্জরিত করেছে। যিনি শিল্পী, তার যেন হিসেবি হতে নেই। পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে চলার বাধ্যবাধকতা নেই, এমনকী শৃঙ্খলা মেনে চলারও প্রয়োজন নেই—এই কুসংস্কারে পীড়িত হয়েছে বাংলা নাট্যশালা। পরে তিনি লিখেছেন যে, এলটিজি বা পিএলটি-র স্থিতি ও বিকাশের পিছনে সংগঠকরূপে শ্রীমতী সেনের বিশেষ অবদান স্বীকার করতে হবে। তাঁর ভাষায়— মঞ্চের ওপর তার যে খ্যাতি গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে নাট্য আন্দোলনের সফল সম্পাদক হিসেবে তার যশের দাবি কম নয়।

দ্বিতীয়ত, শ্রীমতী সেনের সাহস, মনের জোর, বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে অবিচল কঠোর, স্থিরপ্রতিজ্ঞ থাকার ক্ষমতা। উৎপল দত্ত লিখেছেন—‘স্টার থিয়েটারের সামনে দুঃস্বপ্নের নগরী’র ওপর আক্রমণের সময় সশস্ত্র গুণ্ডারাও শ্রীমতী সেনের সামনে এসে অস্ত্র নামিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। এ আমার স্বচক্ষে দেখা।’

১৯৫৯ সালের ৩ জুলাই থেকে এলটিজি মিনার্ভায় নাটক প্রযোজনা শুরু করে। প্রথম দিন অভিনীত হয়েছিল মধুসুদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটি। তারপর ওই বছরের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর উৎপল দত্ত রচিত ও পরিচালিত ‘অঙ্গার’ নাটক মঞ্চস্থ হল। সৃষ্টি হল এক ইতিহাস। মিনার্ভা তথা উৎপল দত্তের নাট্যজীবনে এই প্রযোজনা নিশ্চিতভাবে এক ক্রোশফলক। শোভা সেনের ব্যক্তি জীবনেও এই সময়ে দারুণ টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত। একদিকে স্বামীর সন্দেহ ও নির্যাতন, মদ্যপান করে এসে শারীরিক অত্যাচার। অন্যদিকে রুগ্ন শিশুপুত্রকে বাপের কোপের থেকে রক্ষা করে স্বাভাবিক জীবন ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। এরই মধ্যে শোভা সেনকে নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য অবস্থায় রেখে স্বামীর গৃহত্যাগ। উৎপল দত্ত সেই সময়ে বাধ্য হয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের তিনতলার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর্থিক সংকট তখন তুঙ্গে। কিন্তু সমস্তরকম প্রতিবন্ধকতা ও অপপ্রচারের মুখে তুড়ি মেরে ‘অঙ্গারে’র বিজয়রথ তখন অপ্রতিহত। অবশেষে যাবতীয় ব্যক্তিগত মানসিক যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে শ্রীমতী সেন ১৯৬১ সালে দেবপ্রসাদ সেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করেন। তারপর গুরুরূপে যাঁকে স্বীকার করেছিলেন, নিজের চেয়ে বয়সে ছোটো সেই প্রতিভাশালী নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। এই ঘটনা তার অভিনেত্রী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শ্রীমতী সেনের এই অসীম সাহসী পদক্ষেপ বুঝিয়ে দেয় তার ব্যতিক্রমী চরিত্রকে।

অবশ্য অতীতেও ব্যক্তিগত জীবনে বারংবার শোভা সেন এই ধরনের মানসিক নিপীড়ন ও যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছেন। ৫০-এর দশকের শুরুতে তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তাঁর ছিল আন্তরিক মধুর স্নেহের সম্পর্ক। এই সম্ভাবনাময়, সৃজনশীল পরিচালক তখন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে শ্ৰীমতী সেনের সহযোদ্ধা। প্রায় একই সঙ্গে ওঁরা বিখ্যাত ‘নাগরিক’ ছবিটি বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ভ্রাতৃপ্রতিম ঋত্বিককে কেন্দ্র করেও প্রাক্তন স্বামীর ছিল অযথা সন্দেহ, হীনমন্যতাবোধ এবং দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন।

মিনার্ভায় ‘অঙ্গার’ নাটকের অভাবনীয় সাফল্যের পর ‘ফেরারী ফৌজে’ বঙ্গবাসী দেবী, ‘তিতাস একটি নদীর নামে’ বাসন্তী, ‘কল্লোলে’ কৃষ্ণাবাঈ, ‘অজেয় ভিয়েতনামে’ কিম, ‘মানুষের অধিকারে’ নাটকে মিসেস লিবোভিক্স, ‘প্রফেসর ম্যামলকে’ এলেন ম্যামলক এবং লেনিনের ডাকে আকুলিনা প্রমুখ। চরিত্রে জীবন্ত রূপদান করে শোভা সেন এক অনন্য- সাধারণ প্রতিভাশালী অভিনেত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে ‘কল্লোল’ নাটককে ঘিরে দেশে যে অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের ঢেউ প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার শিবির দু-টিকে ভাগ করে ফেলে, নাট্য আন্দোলনের ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ তথা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিহিংসামূলক নীচতা যেভাবে নগ্ন হয়ে পড়ে দেশে তার কোনো নজির নেই। নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্ত গ্রেপ্তার হয়ে ৭ মাস কারাগারে দিন কাটান। তখন পুরোভাগে থেকে এই সমস্ত প্রতিকূলতা ও সংকটের মোকাবিলা করতে হয় এই তেজস্বী বীরাঙ্গনাকে।

আবার থিয়েটার দলে ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভেতরে গোলযোগ ও ষড়যন্ত্র এবং বহিরাগত চাপে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গৌরবময় নাট্যসংস্থা এলটিজি বিলুপ্ত হয়। কিন্তু অনতিবিলম্বে ১৯৭১ সালে পিপলস্ লিটল থিয়েটারের অভ্যুদয়ের পর উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক মঞ্চস্থ করে বাংলা থিয়েটারের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন। ক্রমে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বসুন্ধরা, ‘সূর্য শিকারে’ উর্মিলা, ‘মহাবিদ্রোহে’ কস্তুরী, ‘স্তালিন-১৯৩৪’ নাটকে স্তালিনা, ‘মালোপাড়ার মা’তে তহমিনা বিবি, ‘একলা চলো রে’-তে যোগমায়া, ‘হিম্মতবাঈ’-এর হিম্মত, ‘নীল সাদা লালে’ মাদাম বুনো, ‘লাল দুর্গে’ মারিনা প্রভৃতি চরিত্রে অভিনয় করে শোভা সেন বাংলা মঞ্চে এক কিংবদন্তি মহীয়সী প্রয়োগ-শিল্পীতে পরিণত হন।

বিশ্বের নাট্যজগতের প্রবাদপুরুষ বোর্টোল্ট ব্রেখট যেমন জীবন সঙ্গিনী হেলেনে ভাইগেলকে দিয়ে ‘মাদার কুরাজে’র কুরাজ চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন, তেমনি উৎপল দত্ত লিখিত ‘হিম্মতবাঈ’-এ শোভা সেন একাত্ম হয়ে যান। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে সমানতালে অংশগ্রহণের সঙ্গে উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘মা’ ছবিতে তার যে অভিনয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছিল তার তুলনা মেলা ভার।

এই ৩৪ বছরের দীর্ঘ অভিযাত্রাপথে ‘অনিশ্চিতের পক্ষপাতী’ (শোভাকে : স্বপ্নবিলাসীর কবিতা— উৎপল দত্ত) শ্ৰীমতী সেনের হাতে গণনাট্যের যে মশাল দীপ্যমান, তার আলোয় নিঃসন্দেহে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস আলোকিত হয়ে থাকবে। ভাবীকালের গবেষকরা নিশ্চয় তা নিয়ে চর্চা ও অনুসন্ধান করবেন। সাম্প্রতিককালে সারা বিশ্বে এ এক বেনজির, বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমরা যথার্থভাবে তার মূল্যায়ন করতে পারিনি। তার মধ্যে ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, রাজ্য সরকারের দীনবন্ধু পুরস্কার এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দিয়ে তাকে সম্মান জানিয়েছে।

সারাজীবন ধরেই থিয়েটারের কাজে শোভা সেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। সাবেক জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেক প্রজাতন্ত্র হাঙ্গেরি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালিসহ পশ্চিম ইউরোপের নানা রাষ্ট্র, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও জাপানে বিস্তৃত এই সফর। তিনি লিখেছেন যে এখানেও সৃজনশীল আনন্দের সঙ্গে ‘ভ্রমণসঙ্গী উৎপল’–এই সফরগুলিকে সমৃদ্ধ করেছিল। এর মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী জার্মানিতে ব্রেখটের বাসভবন দর্শন এবং ব্রেখটের স্ত্রী পৃথিবীখ্যাত অভিনেত্রী হেলেনে ভাইগেলের আকর্ষণীয় রান্নাঘরটি তার মনে বিশেষ দাগ কাটে। খাদ্যরসিক স্বামী ব্রেখটের রসনাতৃপ্তির জন্য হেলেনে ভাইগেলের এই বিশাল আয়োজন তাকে মুগ্ধ করেছিল।

২০০২ সালে ‘ক্ষমা করবো না’ নাটকে সফিয়া ফুয়েন্টেসের চরিত্রে তার অভিনয়ের কলাকৌশল আমাদের মনমুগ্ধ করে রাখে। ২০০৬ সালে বাংলা নাটকের ইতিহাসে নারী অভিনেত্রীদের জীবন অবলম্বনে রচিত ‘নটী’ নাটকেও শোভা সেন ছিলেন মুখ্য আকর্ষণ। ২০০৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ১৫০ বছর উপলক্ষ্যে উৎপল দত্ত রচিত ‘মহাবিদ্রোহ’ নাটকেও তিনি মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শ্রীমতী সেন এক সময় ছিলেন নিরলস, নিয়মিত লেখিকা। তার লেখা ‘স্মরণে বিস্মরণে-নবান্ন থেকে লাল দুর্গ’–৫০ বছরের বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল, উত্তাল সময়ের দলিল—যা একই সঙ্গে আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে গণদেবতার মহিমান্বিত ছবি। পরবর্তী গ্রন্থ—‘ওঁরা, আমরা, এরা’—অগ্রজা, সমকালীন ও অনুজা অভিনেত্রীদের জীবন ও কর্মধারা নিয়ে মানবিক ও শৈল্পিক দৃষ্টিতে এক অনবদ্য জীবনচরিত রচনা করেছেন তিনি।

পরিশেষে বলতে চাই, শোভা সেনের অপাতকঠিন, স্পষ্টবাক, কড়া, রূঢ়ভাষী, প্রবল দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের আড়ালে যে বিশাল স্নেহময়ী আধার আছে তার সন্ধান সকলে পাননি। কারণ, সারাজীবন উৎপল দত্তের রাজনৈতিক মতাদর্শে অবিচল থেকে তিনি নিজেকে এক শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিষ্ঠাবান, দক্ষ সৈনিকরূপে গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে তিনি চূড়ান্ত অনমনীয় ও আপোশহীন। থিয়েটার বা যেকোনো সৃজনশীল কাজে শৃঙ্খলাহীনতা আদর্শহীনতা, প্রবঞ্চনা ও ধাপ্পা তার দু-চক্ষের বিষ। কিন্তু অকৃত্রিম, খাঁটি, স্বচ্ছ, সৎ চেহারার সামনে তিনি মাতৃসমা, মমতাময়ী, স্নেহশীলা—কোমলহৃদয় রমণী।

শোভা সেনের মতো প্রেমিকা আমি দেখিনি। তার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সমস্ত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, সমস্ত চিন্তার উৎস সেই অগ্নিগর্ভ প্রতিভাশালী উৎপল দত্ত। তাঁর বিশ্রাম নেই। ক্লান্তি নেই। বয়স তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। তাঁর একাকিত্ব নেই। হতাশা তাকে পর্যুদস্ত করতে পারে না। কারণ—তার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা পরিষ্কার। উৎপল দত্তের মহান, সমৃদ্ধশালী উত্তরাধিকার বহন ও সংরক্ষণ।

-২০১৭ সালে ‘আশ্চর্যময়ী’ গ্রন্থে প্রকাশিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *