শোভাবাজারের শাইলক
শোভাবাজারের শাইলক, এই নামেই তাকে সবাই চিনত। চিনত নয়, এখনও তাই চেনে। আর যতদিন বেঁচে থাকবে সে, ততদিনই চিনবে।
কারণ, এই নামটাই তার আসল পরিচয়। তার চরিত্রের ভিতর এবং বাইরের, সবটুকু মিলিয়েই, এই সার্থক নামটা লোকে তাকে দিয়েছে। লোকেরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই দিয়েছে।
কারণ তারা দেখেছে, শেকসপিয়রের নাটকের চরিত্র ইহুদি শাইলক যেমন তার খাতকের দেহের মাংস দাবি করেছিল পাওনা টাকার জন্য, আমাদের শোভাবাজারের শাইলকের চরিত্রে সেই নিষ্ঠুরতাই বর্তমান। যদিও পাওনা টাকার জন্যে সে খাতকের মাংস আর দাবি করতে পারে না, কেন না, যুগটা বদলে গিয়েছে, তবু এটা ঠিক যে, পাওনা টাকার বদলে টাকা না পেলে মাংসতেও সে নারাজ নয়।
শোভাবাজারে অবশ্য একে আপনারা বড় একটা দেখতে পাবেন না। সেখানে কোনও একটি কানাগলির সুড়ঙ্গের মধ্যে মান্ধাতা আমলের মস্তবড় রাক্ষুসে বাড়িতে সে রাত্রিবাস করে শুধু। যে বাড়িটার ঘরগুলি এখন অজস্র অন্ধ-গহ্বর বলে মনে হয়, আর সব তছনছ করা উচ্ছৃঙ্খলতার মতো যার গায়ে বট অশ্বত্থেরা মাথা তুলেছে, একই পায়রারা বংশ পরম্পরা যার খিলানে-কোটরে জন্ম-মৃত্যুর লীলা-খেলা করে।
কিন্তু যেহেতু সে শোভাবাজারের বাসিন্দা, সেই-হেতু তাকে শোভাবাজারের শাইলক বলা হয়। যদিও শোভাবাজারের সে আদি বাসিন্দা নয় এবং তার আদি যে কোথায়, সে বিষয়েও সঠিক কোনও সংবাদ কেউ জানে না। তবু শোভাবাজারের সবাই তাকে চেনে। আর চেনেও অনেকদিন থেকেই ; যখন সে বাঁক কাঁধে করে গঙ্গার জল সরবরাহ করত বাড়িতে বাড়িতে।
তখন এ অঞ্চলের প্রায় সব বিধবা এবং বুড়ি সধবা-গিন্নিরাই তাকে চিনতেন, বিশেষ, যাঁরা ঠাকুরঘরের বাইরের জগতকে চিনতেন না। আর যেটুকু চিনতেন, সেটুকু গঙ্গাজলের ছিটে-দেওয়া চৌহুদ্দিটাকেই চিনতেন।
তখন তাঁদের মুখে একটি কথা শোনা যেত প্রায়ই, এই মুখপোড়া ঘটে, ছি-চরণের পাঁকগুলো ধুয়ে বাড়ি ঢুকতে তোর কী হয় রে, অ্যাঁ?
এই ঘটে থেকে তার একটা পুরো নাম আবিষ্কার করা যদিও খুবই মুশকিল, তবু আমার মনে হয়, তার নাম ঘটোৎকচ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, এখন যেখানে সে চাকরি করে সেখানে, অবিশ্বাস্য হলেও তার নাম লেখা আছে, রাবণ হালদার। এই নাম এবং পদবি, দুটি জিনিসই অবশ্য খুব গোলমেলে। এই জন্যেই গোলমেলে যে, সে নিজেকে পোদ জাতের লোক বলে পরিচয় দেয়, যাদের আর যাই হোক, বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের হালদার পদবিটা হওয়া অস্বাভাবিক। আর নাম? সে বিষয়ে সবাইকেই এই ভেবেই নীরব থাকতে হয়, পৃথিবীতে কত বিচিত্র নাম-ই না আছে!
কিন্তু বেছে বেছে, আমাদের শোভাবাজারের শাইলকেরই কি এই নামটা রাখা হয়েছিল? কী বিচিত্র!
চাকরির কথাটা বলে নেওয়া দরকার। কেন না, প্রশ্ন উঠতে পারে, সুদখোরের আবার চাকরি কীসের? চাকরি একটা সে করে, সেটা তাকে তার আসল ব্যবসায়ে অনেক এগিয়ে দিয়েছে।
কাছকাছি একটি হাই-স্কুলের সে বেয়ারা। গঙ্গাজলের পুণ্যব্যবসা করতে করতেই এই চাকরিটা সে কোনও এক কালে পেয়েছিল। সেটা এখন কোন এক কালেই পৌঁছেছে এই জন্য যে, পঁচিশ বছরের ওপর সে এই স্কুলে আছে। ইতিমধ্যে তিনবার প্রধান শিক্ষক বদল হয়েছে। অনেক নতুন শিক্ষক এসেছেন, পুরনো শিক্ষক গেছেন। মারাও কিছু কম যাননি।
তার আগে সে গঙ্গাজল দিত বাড়ি বাড়ি। আর সেই গঙ্গাজলের পুণ্যের ব্যবসার সময়েই সে প্রথম একজনকে ধার দেয়।
সেটাও খুব অদ্ভুত ব্যাপার, অন্তত শাইলক-জীবনের প্রথম অঙ্কুরোদগম কাহিনীটা জানা যায়।
সে যে বাড়িটায় তখনও ছিল, এখনও আছে, সেখানে অনেকেই তার মতো। নানা ফিকিরেই তাদের পেট চলত।
শাইলকের, হ্যাঁ শাইলক বলাই ভাল ; শাইলকের হাতে সেদিন একটি মাত্র টাকা আছে, সেটা ভাঙিয়ে তাকে খেতে হবে।
ওই বাড়ির পরিচিত একজন তার কাছে একটা টাকা ধার চেয়েছিল। কিন্তু টাকা মাত্র একটি। দেওয়া যায় না। তা ছাড়া টাকা দেবার কোনও ইচ্ছাই তার ছিল না।
লোকটা তবুও বিরক্ত করছিল কারণ, তার একটু নেশা ভাং-এর ব্যাপার ছিল। লোকটা প্রায় পায়ে পড়ে বলেছিল, চার পয়সাটা বেশি হয়, কিন্তু রাত পোহালেই টাকার সঙ্গে পুরো দুটি পয়সা সুদ দেবে।
কথাটা তার মনে ধরেছিল এবং মনে মনে ভয় থাকলেও টাকাটা দিয়েছিল সে তাকে। যদিও রাত্রে সে তার জন্য উপোস করেছিল, তবু দেখতে চেয়েছিল, পুরো টাকাটার সঙ্গে তার আরও দুটি পয়সা আসে কি না।
এসেছিল। পুরো এক ইঞ্চি ডায়ামেটারের রাজা-মার্কা তামার নতুন দুটি পয়সাই পেয়েছিল সে। সেই দিনটা এবং পয়সা দুটি যে কত বড় ঐতিহাসিক ব্যাপার, সেদিন সেটা বোঝা যায়নি। কেউ জানেও না।
শাইলকের বাড়ি কোথায়, আছে কে কে, বিয়ে থা হয়েছিল কি না, ছেলেমেয়ে আছে কি না, এসব প্রশ্ন শাইলকের জীবনে মৌন সমুদ্রের মতোই নীরব। সেখানে কোনওদিন বুড়বুড়ি কাটার মতো একটি দুর্বোধ্য শব্দও শোনা যায়নি।
তার এখনকার পরিচিতদের ধারণা, লোকটা আবহমান কাল ধরেই এক রকম দেখতে। রোগা নয়, মোটা নয়, পেটা-পেটা গড়নের একটি শক্ত কালো মানুষ, বয়সের যার গাছপাথর নেই। বয়স পঞ্চাশ হতে পারে, পঁয়ষট্টি হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়! টাকা নেই, ধূসর বর্ণের ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা চুল, যার কখনও যেন বাড় নেই, পরিবর্তন নেই। মোটা স্ফীত নাক, ছোট চোখের ওপরে মোটা লোমশ ভ্রূ-জোড়া হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যেন। সেই একই মার্কিন কাপড়ের হাফসার্ট আর আট হাত মিলের ধুতি কোঁচা দিয়ে পরা। পায়ে সে কোনও দিনই জুতো দেয়নি। নেশার মধ্যে শুধু চা।
স্কুলের অধিকাংশ মাস্টারমশাই তাকে খাতির করেন। মনে মনে রাগ এবং ঘৃণা থাকলেও, ভয়ও করেন। কারণ, তাঁদের মাসের শেষ থেকে নয়, গোড়া থেকেই ধার দেবার লোক এই শাইলক। তাঁদেরই বেয়ারা।
কবে থেকে তার শাইলক নাম হয়েছে, সেটাও এখন অতীত কালের ঘটনা। সবাই তাকে ওই নামেই ডাকে। সে কিছু মনে করে না।
কেবল হেডমাস্টারমশাই তাকে রাবণ বলে ডাকেন। শাইলকের নিজেরও ওই নামটা মনে থাকে, তাই জবাব দিতে ভুল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। হেডমাস্টার রাবণ বলেন এই জন্যে যে, অন্তত শাইলক তাহলে তাঁকে খাতির করবে। আর বোধহয় সেই জন্যেই, শত প্রয়োজনেও, তিনি কখনও শাইলকের কাছে ধার করেন না।
শাইলক মাস্টারমশাইদের সব সময়েই প্রায় ধমকে কথা বলে। সে অধিকার তার আছে এবং তার ধমকটা সবাই মেনেও নিয়েছেন।
যেমন, বাংলার মাস্টার হরেনবাবু হয়তো ক্লাসে না গিয়ে তখনও বিড়িতে সুখ টান দিচ্ছেন, ঘণ্টা বেজে গিয়েছে পাঁচ মিনিটের ওপর।
শাইলক বলে উঠল কই হরেনবাবু, বিড়ি তো অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছেন, এদিকে এইটের বাঁদরগুলি যে লঙ্কাকাণ্ড করেছে। তাড়াতাড়ি যান।
হরেনবাবুর রাগ হবার কথা। হেডমাস্টার কিছু বলছেন না। আর বেয়ারা এসে হুকুম করবে? কিন্তু হরেনবাবু রাগ করবেন কেমন করে? আসল দূরের কথা, এ মাসের সুদটা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি এখনও।
কিংবা, ইংরেজির মাস্টার অনিলবাবুকে ডেকে শাইলক হয়তো বলল, ও অনিলবাবু শুনুন, কোঁচাটা যে মাটিতে লুটোচ্ছে মশাই। ওই করেই কাপড় ছেড়েন, আর মাসে মাসে ধার করে তাই কাপড় কিনতে হয়।
অনিলবাবুর মনের অবস্থা বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।
কিন্তু তিনি শাইলকের একজন খাতক।
এসব তো খুবই ভাল কথা। এর চেয়ে অনেক খারাপ খারাপ কথা সে বলে। অঙ্কের মাস্টারমশাই রামকৃষ্ণবাবুকে তো রীতিমতো অঙ্কই শিক্ষা দিয়ে দেয় সে অনেক সময়। বলে, দেনার হিসেবে এত ভুল করেন, রামকেষ্টবাবু, ছাত্রদের আপনি যা পড়াবেন তা আমার জানা আছে। যাক, ভুল করুন আর যা-ই করুন, আমার দুটাকা তেরো আনা এক পয়সা সুদটা দিয়ে তারপরে যা খুশি তাই করুন গে।
.
প্রায় অধিকাংশ মাস্টারের ওপরেই তার খবরদারি চলে, হেডমাস্টারকে ছাড়া। তিনি শাইলকের কাছে ঋণ করেন না।
তবু মাস্টারমশাইদের ওপর খবরদারি করে, সকলের সঙ্গে সমান সমান কথা বলে, এমন একটা পর্যায়ে এসে পড়েছে যে, মনে হয় স্কুলে ওর ওপর কেউ নেই। আর যা খুশি তাই করতে ও বলতে পারে।
এই তো গত মাসে স্কুলের ইনস্পেক্টর এলেন। শাইলক তো অনেক মাস্টারমশাইকেই সেদিন ধমকালে। তারপর ইনস্পেক্টর যখন এলেন, শাইলক আগে বেড়ে পরিচয় করিয়ে দিল। এই যে, ইনিই আমাদের হেডমাস্টারমশাই। ইনস্পেক্টর নমস্কার করলে, হেডমাস্টারও। কিন্তু রাগে হেডমাস্টার মশাই-এর গা জ্বলতে লাগল। তখন কিছু বলতেও পারলেন না।
শুধু তাই নয়, শাইলক সব মাস্টাররেরই পরিচয় করিয়ে দিলে। ইনি অঙ্কের মাস্টারমশাই রামকৃষ্ণবাবু, ইনি বাংলার..ইত্যাদি।
সবশেষে, এই কুদর্শন, উঁচু করে কাপড় পরা, হাফসার্ট গায়ে, খোঁচা খোঁচা চুল শাইলককে ইনস্পেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয়টা তো দিলেন না?
শাইলক খুব গম্ভীর ভাবেই জবাব দিলে, আমি এ স্কুলের বেয়ারা।
ইনস্পেক্টর অবাক হয়ে তাকালে হেডমাস্টারের দিকে। হেডমাস্টারের মুখ তখন লাল। খালি বললেন, রাবণ, তুমি বাইরে গিয়ে বসো।
শাইলক বাইরে গিয়ে বসল।
ইনস্পেক্টর চলে যাবার পর হেডমাস্টার তো প্রায় মারতেই যান শাইলককে, গেট আউট, এখুনি বেরিয়ে যাও তুমি স্কুল থেকে।
অপরাধটা যে গুরুতর হয়েছে, সেটা বুঝতে পেরে, নরম করেই জবাব দিলে শাইলক, আলাপ করিয়ে দিলে যে অপরাধ হয়, তা জানতুম না। ঠিক আছে, আর এ রকম হবে না কোনও দিন।
এমন কিছু হাতে পায়ে ধরে বলেনি শাইলক, কিন্তু ওইটুকু বলাই তার পক্ষে যথেষ্ট।
শুধু সেইদিনটিই কোনও মাস্টারমশাইকে আর সারাদিন সে ধমকায়নি।
.
কিন্তু, এ জায়গাটা শাইলকের আসল ব্যবসার স্থান নয়। সেটা অন্যত্র এবং সেইখানেই তাকে সবচেয়ে ভাল করে চেনে সবাই। আর সেখানে কেউ মাস্টারমশায়ও নয়। সকলেই নিচু শ্রেণীর লোক।
তাই, স্কুলের শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে, দারোয়ানের ওপর সব ভার দিয়ে সে গিয়ে বসে খালধারের সেই চায়ের দোকানটায়।
সেখানে তার একটি নির্দিষ্ট আসন আছে। চায়ের গেলাস নিয়ে সেখানে বসে, তার মোটা ভ্রূর তলায় প্রায় ঢাকা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থাকে পশ্চিমাকাশের দিকে।
জায়গাটা সে ইচ্ছে করেই ওখানে বেছে নিয়েছে। কারণ, পশ্চিমদিকটা অনেকখানি খোলা, আর গঙ্গাকে দেখা যায়। গঙ্গার ওপার পর্যন্ত। সেখানে বসে বসে সে সূর্যাস্ত দেখে।
না, কোনও বিশ্বরহস্যের অনির্বচনীয়তাকে প্রত্যক্ষ করার জন্য এই সূর্যাস্ত দেখা নয়। তার খাতকের দলেরা দেনা মেটাতে আসবে এবং সূর্যাস্ত হলেই সুদ এক পয়সা করে বেড়ে যাবে।
তার এই আসল খাতকেরা সকলেই বাজারের ফড়ে। আশে পাশে অনেকগুলি বাজারের ফড়েরাই তার দেনাদার। যারা টাকা পিছু প্রতিদিন এক পয়সা করে সুদ দেয়।
সন্ধ্যাবেলা টাকা নেবে, পরদিন সূর্যাস্তের আগেই সুদসহ টাকা শোধ না হলেই আবার সুদ। ঘড়ি ধরে এখানে কারবার চলে না। গঙ্গার ওপারে, গাছের আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়া মানেই দিন শেষ। অতএব এক টাকার শোধ আর এক টাকা এক পয়সা নয়, দু পয়সা।
ফড়েরা অধিকাংশই রাত্রে পাড়াগাঁয়ের দিকে, দূর গ্রামের হাটে তরিতরকারি কিনতে যায় পাইকারি দরে। তখনই তাদের টাকার প্রয়োজন হয়। পরদিন বাজারের বিক্রিবাটা শেষে লাভ লোকসানের বরাত দেখে তারা।
যারা শাইলকের কাছে ঋণী, তারাও বেলা চারটে থেকেই আকাশের দিকে তাকাতে থাকে। একবার সূর্য পাটে গেলেই হয়, দশ টাকার সুদ পাঁচ আনা দিতে হবে।
অবশ্য এর মধ্যে কতকগুলি ফাঁক আছে। যথা, খাতকের ভিড় হয়েছে, সকলের সঙ্গে হিসেব মিটমাট করতে করতেই সূর্যাস্ত হয়ে গেল। যারা তখনও বাকি, তাদের বাড়তি সুদ দিতে হবে না, কারণ তারা সূর্যাস্তের আগেই এসেছে। এসেছে কি না সেটা অবশ্য লক্ষ রাখে সে।
বেলা দুটোর আগে ব্যাংকে চেক জমা দেবার মতো। এটা শাইলক ওখান থেকে শিখেছে। এইসব খাতকদের মধ্যে মেয়ে-পুরুষ সব রকমই আছে। আর শাইলকের ব্যবহার সকলের সঙ্গেই সমান।
তাই সে বেলা চারটার সময় এসে, খালধারের চায়ের দোকানে বসে। কোলের ওপরে থাকে তার সেই ময়লা মোটা খাতা, আর সুতো দিয়ে বাঁধা পেন্সিল। যে পেন্সিলের শিসটা তার লেখার চেয়ে, জিভে ঠেকিয়ে ঠেকিয়েই বেশি ক্ষয়েছে।
খাতা খুলে প্রত্যেকের হিসেব দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। লেখাগুলি তার নিজেরই এবং সেগুলি সে নিজে ছাড়া কেউ পড়তে পারে না। হিসেবের পাশে নানারকম সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলিও সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।
প্রত্যেকটি পয়সা সে গুনে নেয়, থু থু দিয়ে খাতার পাতা উলটে বকেয়া সুদের হিসেব দেখে নেয়। আর ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকায়।
আকাশের দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে, খাতকের দিকে তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরে। কে কে আসেনি এখনও? মনে থাকে ঠিক। অভ্যাস হয়ে গেছে।
রেহাই বলে কোনও কথা নেই। মাফ বলে শব্দটা নেই শাইলকের অভিধানে।
যদি কেউ বলে, দেখো শালিক খুড়ো—
সেটাও আবার একটা কথা। তাই এইসব খাতকেরা তাকে শালিক বলেই ডাকে। শাইলক কথাটার মানে তারা জানে না। কিন্তু শব্দটা শুনে শুনে, শাইলক তাদের ধারণায় ও উচ্চারণে শালিক হয়ে গেছে।
তাতে শাইলক কিছু মনে করে না।
যদি কেউ বলে, শালিক খুড়ো আজকে যদি একটু মাফ করে দাও, অবিশ্যি কালই দিয়ে দেব, তবে আজকের রাতটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে বাঁচি।
–তোমার খেয়ে বাঁচার জন্য আমি টাকা দিইনে।
তা বটে। সূর্যাস্তের পরমুহূর্তে এসে হাতে-পায়ে ধরেও ডবল সুদ থেকে কেউ রেহাই পায় না। দৈবাৎ কারুর বাড়িতে যদি কেউ মারা যাবার জন্যও না আসতে পারে, তাকেও ছেড়ে দিতে দেখা যায়নি শাইলককে। মৃত খাতকের পয়সাও সে আদায় করে ছাড়ে। অবশ্য মৃত্যুর পর প্রতিদিনের বাড়তি সুদটা শাইলক আর ধরে না। একবার পাঁচি ফড়েনি দুটি আস্ত ফুলকপি দিয়েছিল শাইলককে। পাঁচির দেনাটা একটু বেশি ছিল। সুদটাও বেশি। এবং আসতে রাত হয়েছিল। তাই বোধ হয় পাঁচির ফুলকপির উপহার। ফুলকপি নিলেও সুদের একটি আধলাও ছাড়েনি সে।
মৃত্যু শোক দুর্ঘটনা, কোনও কিছুই এই শোভাবাজারের শাইলককে কোনওদিন টলাতে পারেনি। সূর্যাস্ত দেখতে ভুল করেনি সে কোনও কারণেই কোনওদিন এবং সূর্যাস্তের পর হিসেবের কড়ি একটিও ছাড়েনি।
যারা তার খাতক, তাদের কোনও উপায় নেই তার কাছে না এসে। কেন না প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাবার মতো লোক পাওয়া বড় কঠিন। তাও আবার ভাল লোক। কিন্তু মনে-প্রাণে সবাই তাকে ঘৃণা করে। পয়সার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তার মৃত্যু কামনা করে সবাই। এবং সকলের দৃঢ় বিশ্বাস, নোকটা মরলে, শকুনে ছিঁড়ে খাবে তাকে। আর খুব সম্ভবত লোকটা গলায় রক্ত-উঠেই মরবে।
তার সেই মৃত-চেহারাটা ভাবতেও অনেকের ভাল লাগে বোধ হয়।
এ-হেন শোভাবাজারের শাইলক এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল।
হাতিবাগান বাজারের তরকারিউলি বিধবা সুখদার বয়স বছর বিয়াল্লিশ হবে। দেখতে সে তেমন ভাল নয়, তবে এ বয়সেও তার দেহের বাঁধুনিটা ছিল ভালই। মুখখানি মোটামুটি যদিও, তবু একটা চটক ছিল! রাস্তা দিয়ে গেলে একবার তাকিয়ে দেখবে সবাই তাকে।
শাইলকের সে খাতক। যদি বা কোনওদিন সুখদা ভ্রূ নাচিয়ে থাকে শাইলকের দিকে চেয়ে, একটু বেশি হেসে-টেসেও থাকে, তাতে কোনওদিনই তার কিছু যায় আসেনি। এবং সে সব দেখেও একটি আধলাও মাফ করেনি।
সুখদা একদিন তার ষোলো বছরের মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল সঙ্গে। আর সুখদা সেইদিন লক্ষ করে দেখেছিল, শালিক তার মেয়ে ময়নাকে বারে বারেই দেখছে।
ময়না বয়সে ষোলোই বটে। কিন্তু একটু বড়সড়ো হয়ে পড়েছে। যে পাড়ায় তারা থাকে, সেটাও ভাল নয়। মেয়েটিকে নিয়ে নানান দুর্ভাবনা সুখদার। শিস্ দেওয়া, গান গাওয়া তো অষ্টপ্রহর আছেই। মেয়েকে কাছে কাছে নিয়ে না ঘুরলে, এক মুহূর্ত সে স্থির থাকতে পারে না। এক মিনিট কারুর দিকে বেশি তাকিয়ে থাকলে, ময়নাকে চিমটি কেটে তার সংবিৎ ফেরায় সুখদা : ওদিকে কী দেখছিস?
ময়না সুখদার গলার কাঁটা। কিন্তু বিয়ে দেবার যোগ্যতা নেই সুখদার।
কথাটা শাইলকেরও অজানা নেই।
কিন্তু, শালিকের দৃষ্টি দেখে সুখদার মনে বিচিত্র ইচ্ছা জেগেছে। শাইলককে জামাই করলে মন্দ হয় না। রূপকথার মতোই যার টাকার আণ্ডিল, তাকে বাঁধবার তবু একটি রাস্তা আছে তার। বয়স? টাকার কাছে কিছু নয় ওটা। পুরুষের আবার বয়স!
একদিন সে বলেই বসল, মেয়েটাকে আর ঘরে রাখতে পাচ্ছিনে শালিক-দা।
শাইলক বললে, বে দাও।
–টাকা?
কত টাকা?
সুখদার বুকের মধ্যে বুঝি কাঁপছিল। এরকম জিজ্ঞেস করার মানে? বিনা সুদে তাকে ধার দেবে নাকি?
সুখদা বলল, তা, একটা বে থা দিতে গেলে আজকালকার দিনে পাঁচশো তো লাগেই।
হুঁ।
কথার ফাঁকে একবার সূর্যাস্ত দেখে বলল শাইলক, মেয়ের বে দিতে চাও? ওই ময়নার? ছেলে দেখেছ?
দেখা ছিল সত্যি। ভাল পাত্র, শিয়ালদহ বাজারে বেশ ভাল দরের দোকানদার। কিন্তু শাইলক যে তাকে ছলনা করছে না, তার প্রমাণ কী? সুখদা কি বোঝে না, ছেলে সে নিজেই হতে চায়। তবু একবার চাবকে দেখতে আপত্তি কীসের?
বলল, দেখেছি।
–ভাল?
-খুব ভাল।
–হুঁ। মেয়েটি তোমার ভাল সুখদা। দেখতেও ভাল। মেয়েটিকে আমার ভাল লেগেছে।
কেমন ভাল। সেইটিই জানতে চায় সুখদা। বলল, সে তোমার দেখবার চোখ শালিক-দা।
হুঁ। মেয়েটি তোমার সুখী হোক, এটা আমি চাই সুখদা।
কারুর সুখ চায় শাইলক?
শাইলক হঠাৎ বলল, টাকা তোমাকে দেব সুখদা।
–এত টাকা ধার, শুধব কেমন করে শালিক-দা?
শাইলক পশ্চিমাকাশের দিকে তাকাল। ভ্রূ-দুটি তার উঠে গেছে, চোখ দুটি শান্ত আর বড় দেখাচ্ছে। গম্ভীর গলায় বলল, ধার নয়। তোমার মেয়ের বের জন্যে দেব। পাঁচশো টাকা দেব। ছেলেকে পাকা দেখে বের দিন ঠিক করো। এই জৈষ্ঠেতেই লাগাও।
সুখদা হাঁ করে তাকিয়েছিল শাইলকের দিকে।
শাইলক বলল, তোমার আজকের টাকা আর সুদটা দাও।
সুখদা টাকা আর সুদ দিয়ে বলল, ময়নার বের কথাটা মিছিমিছি নয় তো শালিক-দা?
শাইলকের মুখটা ভীষণ দেখাল। ঝেঁজে উঠে বলল, মিছে কথা কোনও দিন বলতে শুনেছ শালিককে?
সুখদা ব্যবস্থা করলে মেয়ের বিয়ের। দিন ঠিক হল।
পাঁচশো টাকা নিজের হাতে রেখে, শাইলক প্রতিদিন সুখদার দরকার অনুযায়ী টাকা দিতে লাগল।
কেউ সুখদাকে ভয় দেখাতে লাগল। কেউ কেউ খারাপ কথাও বলতে কসুর করল না। আর সেই কলঙ্কের হাত থেকে মা-মেয়ে, কেউই বাদ গেল না।
তবু, মেয়েমানুষ পাওয়াটা এমন আর কী কঠিন ব্যাপার ছিল শাইলকের পক্ষে? কিন্তু পাঁচ পাঁচশো টাকা?
শাইলকের দিকে সবাই অবাক চোখে তাকাতে লাগল।
তারপরে এল সেই বিয়ের দিন। পাঁচশোর সব টাকাই শাইলক দিয়ে দিলে সুখদাকে।
বিয়ে হল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সুখদা তার চেনাশোনা অনেক ফড়েকেই নিমন্ত্রণ করেছে। আর তারা সকলেই শাইলকের খাতক।
বিস্ময় ও সন্দেহের নানারকম ভ্রূকুটি চারদিকে। শাইলককে ঘিরেই। শুধু সুখদা আর ময়নার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
সকলের সঙ্গে বসে খেল শাইলক। তারপর একখানি সিল্কের শাড়ি বের করে দিল ময়নাকে। বললে, নাও মা।
সুখদা কেঁদেই ফেললে। ময়না নমস্কার করল।
যাবার আগে, সুখদাকে আড়ালে ডেকে শাইলক বলল, তিনদিন ধরে তোমার বকেয়া সুদ বাকি রয়েছে কিন্তু, সেই সাড়ে সাত টাকার, মনে আছে?
অবাক হয়ে সুখদা বলল, হ্যাঁ।
–দেরি করছ কেন? সুদ রোজ বাড়ছে। কাল দিয়ে দিয়ো।
লোকটা কিছু ভোলে না ; যে পাঁচশো টাকা দিয়ে সুখদার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়, সেই লোক সাড়ে সাত টাকার সাড়ে সাত আনা সুদের তাগাদা দিতে ভোলে না।
শাইলক বেরিয়ে যাবার পরেই, কয়েকজন ফড়েও বেরিয়ে গেল।
তারপর সুখদার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, অন্ধকার খালের ধারে, একটি পুলের তলায়, হঠাৎ কারা যেন আক্রমণ করল শাইলককে। প্রচণ্ডভাবে মারল তারা লোকটাকে, আর শুধু এইটুকু শোনা গেল, শালা এতদিনে বুঝেছি, তুমি মাগির পেছনে টাকা খাটাও, গরিবের টাকা মারো।
পরদিন কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল ঝড়ের বেগেই যে, শাইলককে নাকি কারা মেরেছে।
স্কুলের মাস্টারমশাইরা দেখলেন। শাইলকের ফোলা কাটা ক্ষত বিক্ষত মুখ। সে মরেনি। তাঁরা হাসলেন ঠোঁট টিপে।
সেদিন খালের ধারে চায়ের দোকানে তার খাতকের দলও বিশেষ নজরেই তাকিয়ে দেখল তার দিকে।
কিন্তু শাইলকের ব্যবহারে কোনও তফাত দেখা গেল না। কেবল জনা পাঁচেক ফড়েকে সে বলল, দ্যাখ, সংসারে পাপ এখনও আছে। তোরা এখনও মুক্তি পাবিনে, আমারও মুক্তি নেই।
এছাড়া আর কিছু সে বলেনি।
.
তারপরে পাঁচ বছর কেটে গেল, সেই একই লোক রয়ে গেছে শাইলক। কোনও পরিবর্তন হয়নি তার।
শুধু সুখদা এবং সকলের কাছেই, ময়নার বিয়ে দেওয়াটা শাইলকের জীবনের মৌনসমুদ্রে কয়েকটি দুর্বোধ্য বুদবুদের মতোই রয়ে গেল। তবু এক বুদবুদ উঠেছিল।