শোণিতে সুমধুর সজ্জা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
দৃশ্যগুলো প্রথমে গাঢ় তারপর সবুজ, শেষে জলের মতো হালকা। পাতলা কুয়াশার পর্দা ঠেলে কেউ এগিয়ে আসছে যেন। সে স্পষ্ট দেখেছে, শেডের নীচে একা অঞ্জন দাঁড়িয়ে। রোগামতো মুখ, চুল উসকো খুসকো। কতদিন জামাপ্যান্ট পাল্টায়নি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে গভীর দুঃখ। জলের মতো হালকা আবছা সেই দৃশ্য অতিক্রম করতেই সে ভেবেছিল চিৎকার করে ডাকবে— অঞ্জন তুমি—আবার!
কিন্তু গাড়িটা বেশ দূরে এসে গেছে। খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল সুজয়। সে কিছু বলতে পারল না। ক্রমে দৃশ্যটা ফের জলের মতো হাল্কা, তারপর গাঢ় এক অন্ধকারে ডুবে গেল। আলো আঁধারে সাঁতার কেটে গাড়িটা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে কেমন ভয় ধরে গেল তার। সে অঞ্জনকে কোথাও না কোথাও এ-ভাবে দেখে ফেললে ভয়ে আর রাতে ঘুমোতে পারে না। বার বার মনে হয় নীচে কেউ ডাকছে, তান্না আমি। আমি অঞ্জন। সিঁড়ির মুখে সহসা অন্ধকারে ডুবে গেল তান্না। সুজয় তখন চেঁচিয়ে বলল, অনিল, অনিল। সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে দে।
কেউ সাড়া দিল না। তান্না অন্ধকারে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য সরে গেলে তান্না চিৎকার করছে, অমা তুমি কোথায়। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ভয় করছে। এটা তান্নার মাঝে মাঝে হয়। বিয়ের পর পর সে এমনটা আরও ক’বার দেখেছে। অন্ধকারে সহসা তান্না কী দেখতে পায় যেন। ঘরে সেজন্য সুজয়কে সব সময় রাতে জিরো পাওয়ারের বালব জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
না অনিল, না অমিয়, কেউ সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে না। সুইচ টিপে দিচ্ছে না। নীচের সুইচটা খারাপ। ওপরের সুইচে হাত না দিলে কিছু হয় না। তান্নার ভেতরেও বুঝি আছে এমন সব সুইচ। অন্ধকার দেখলে বিগড়ে যায়। একেবারে তান্না ওকে এখন জড়িয়ে ধরেছে। —কী হল! সুজয় ঠিক তুমি তো। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন! সারা বিকেল ওরা গাড়ি নিয়ে ঘুরেছে। ছুটির দিনে সুজয় তান্নাকে নিয়ে কোথাও কোথাও চলে যায়। আজ সারা বিকেল সন্ধ্যা শহরেই ছিল। কখনও নদীর পাড়ে, কখনও দুর্গের পাশে অথবা সবুজ র্যামকে খুজে বেপার্টে হেঁটে গেছে। তান্না ভারী খুশি। ছুটির সন্ধেটা শুধু সে আর সুজয়। দামি হোটেলের খাবার দু’জন মুখোমুখি বসে খেয়েছে। কত সব রঙ বেরঙের আলো, দূরে ব্যান্ড বাজছিল। তান্নার কোনও দুঃখ ছিল না। সুজয় ডাকল ফের, অমল! সে তারপর বুঝতে পারল, বেশ রাত হয়েছে। কেউ জেগে নাও থাকতে পারে। তান্নার হাত ধরে বলল, এস। কোনও ভয় নেই। তান্না বলল, আলোটা জ্বলবে না সুজয়?
—বোধ হয় জ্বলবে না।
—সুইচটা ঠিক করিয়ে নাও না কেন?
—কাল ঠিক হয়ে যাবে। এস।
অন্ধকারে সিঁড়ি ধরে উঠছিল। তান্নার মনে হচ্ছিল ঠিক অন্ধকারে কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে হাত চেপে বলবে, তান্না কোথায় যাচ্ছ! কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। এস। অন্ধকারে কেউ বুঝি ওর হাত চেপে ধরবে। সুজয় টেরও পাবে না, আর একটা হাত অন্ধকারে কেউ ধরে রেখেছে। ওকে ওপরে উঠতে দিচ্ছে না।
—কী হল! উঠছ না কেন?
—উঠছি তো। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
—হাত ধর।
প্রায় সুজয়কে সাপটে ধরেছে তান্না। খুব দ্রুত শ্বাস পড়ছে। সুজয় বুঝতে পারছে, আবার সেই অন্ধকারের ভয় তান্নাকে আক্রমণ করছে। সংসারের ওপর এভাবে একটা বিতৃষ্ণা—অনিল, অমলকে দিয়ে সংসারে কিছু হয় না। ক’দিন থেকে বলেছে, একজন মিস্ত্রি ডেকে এনে সুইচটা ঠিক করে নিতে। সংসারে এমন কী অসুবিধা একটা সুইচ খারাপ থাকলে, বোধ হয় আদৌ গুরুত্ব দেয় না, অন্ধকার বাড়ির কোথাও না কোথাও থাকবেই। তাকে সব সময় সরিয়ে রাখা যায় না। কাজের লোকটা সংসারের সব কাজ করেই শেষ করতে পারে না। বাইরের কাজ দিলে, আর ফিরতে চায় না। সে ভেবেছিল, সামান্য কাজটুকু ঠিক অমিয় অথবা অনিলকে দিয়ে হয়ে যাবে। যখন করা গেল না, অফিস ফেরত সে-ই কোনও লোককে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। এ-ভাবে ওদের ওপর ভরসা করা ঠিক না। তখনই মনে হল, তান্না চিৎকার করে উঠেছে, সুজয় কেউ আমাকে ছুঁয়ে দিল।
সুজয় ধমকে উঠল, বাজে কথা বলবে না। ওঠো। প্রায় ওকে টেনে ওপরে তুলতেই সুজয় কেমন অবাক হয়ে গেল—তান্নার মুখে ভূত দেখে আঁতকে ওঠার মতো ছাপ। দর দর করে ঘামছে। শীতের রাত, এবং বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। হাত পা বরফের মতো ঠাণ্ডা তান্নার অথচ মুখে কপালে ঘাম। এবং চোখ কেমন নিষ্প্রাণ। সে ডাকল, এই কি হয়েছে! পাশের ঘরে বাবা থাকেন। বোধ হয় সে বাবাকে চিৎকার করে ডাকত, কিন্তু এমন সে আরও দেখেছে। তান্নার শরীরে কোথাও কোনও সুইচ বিগড়ে গেছে আবার। সে বলল, তান্না, কী দেখছ। তান্না জবাব দিল না। সিঁড়ির মুখে অন্ধকারটা নেমে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে আছে তান্না। সুজয় চিৎকার করে ডাকল, অমিয়। অমিয়। করিডরের শেষ ঘরটায় থাকে অমিয়, অনিল। ঠিক মাঝখানের ঘরটা তার। করিডরের এ-পাশে, বাথরুম রান্নাঘর। এবং পরে বসবার ঘর। বসবার ঘরে কাজের লোকটা থাকে। দরজা হাট করে খোলা। সে লোকটাই প্রথমে হুট করে উঠে বলল, বড়দা ডাকছেন।
—সিঁড়ির আলোটা কে নিভিয়েছে?
—আলো তো জ্বালাই ছিল।
সুজয় এবার নিজেই সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে বলল, দ্যাখো কিছু নেই। এস।
কাজের লোকটা বলল, গেট দিয়ে কেউ বুঝি ঢুকে পড়েছিল!
—চুপ কর। সুজয় এবারে তান্নাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল। বেশ ক’বছর ভাল ছিল। আবার এতদিন পর— তার মনে হল, এই সংসার তাকে বিনাশ করার মতলবে আছে। একটা কথা কেউ শোনে না। একবার ভেবেছিল, আলাদা ফ্ল্যাট নেবে—কিন্তু তান্নাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। সেও বুঝেছিল, বাড়িতে তবু সবাই আছে। বাবা মা। মা কিছুদিন হল বেনারসে গেছে ছোট-মামার কাছে। সঙ্গে ছোট বোন কনি। বাড়িতে, বাবা, সে, অমিয়, অনিল কাজের লোকটা—এবং বাবা আছেন বলেই তান্নার যেন অনেকটা ভয় কম! বাবা ঘরের দরজা না খুলেই বললেন, এত রাত হল তোদের? বাবা কি তবে ঘুমোয়নি। নীচে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সে ডাকাডাকি করেছে—কেউ টের পায়নি! সে বলল, সিঁড়ির আলোটা কে নিভিয়ে দিয়েছে।
—কে দেবে!
—এসে তো দেখলাম নেভানো।
—ওটা তবে অবিনাশের কাজ।
—অবিনাশ তো বলছে, সে জ্বেলেই রেখেছে।
—অমিয়কে জিজ্ঞেস কর!
সুজয় আর দাঁড়াল না। রাতে সামান্য একটা আলো কে নিভিয়েছে এ-নিয়ে তোলপাড় করা কেমন হাস্যকর ব্যাপার। সে চেপে গেল। অবিনাশকে বলল, আমরা খাচ্ছি না। গেট বন্ধ করে দাও। গ্যারেজে দ্যাখো সব ঠিক লক্ করা আছে কি না। এবং ঘরে এসে যখন দেখল, তান্না চুপচাপ বসে আছে, সে ডাকল, এই তান্না, কী হয়েছে তোমার?
—কী হবে!
—চুপচাপ বসে আছ। জামাকাপড় ছাড়বে না?
—ছাড়ছি। তুমি বাথরুমে যাবে তো যাও।
সে অবিনাশকে ডেকে বলল, ড্রয়ারটা খোল। অবিনাশ ড্রয়ার খুললে বলল, দ্যাখো কিছু চিঠিপত্র আছে। ওগুলো এক্ষুনি ফাইল করে রাখো। সকালে সময় পাবে না। বলে সে বাথরুমে ঢুকে গেল। অবিনাশ সব চিঠিগুলো টেনে নামাচ্ছে। এবং মেঝের কার্পেটে বসে চিঠিগুলো এক এক করে ডেট অনুযায়ী সাজাল। তান্না সবই বুঝতে পারছে, সুজয় অবিনাশকে ঘরে রেখে গেল—পাছে কোনও অতর্কিত ভয়ে সে চিৎকার করে ওঠে। একজন কেউ কাছে থাকলে সে ভয় পাবে না। সে কেমন নিজেই এবার শিশুর মতো বলল, অবিনাশ তুমি সত্যি আলোটা নিভাওনি?
—না বউদিমণি।
—তা হলে কে নেভাল।
সিঁড়ির আলোটা কে নেভাতে পারে, না কেউ জ্বালেইনি! অমিয় অনিলকে পর্যন্ত ডেকে তুলেছে তান্না। এবং সিঁড়ির এই অন্ধকার এক ভারী রহস্যময় ব্যাপার। তান্নাকে ভীষণ দুঃখী এবং কাতর দেখাচ্ছে। সুজয় বাথরুম থেকে ফিরে বুঝল, তান্নার ভেতরে সিঁড়ির আলোটা এখন ভয় দেখাচ্ছে। অনেক দিন আগের একটা ভয়। সামান্য ঘটনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, এবং প্রায় ধমকের সুরে বলল, কী যে তোমরা! এই অনিল যা তো। অমিয় এত তোদের ঘুম। ডেকেও সাড়া পাওয়া যায় না। অমিয় অনিল একঘরে শোয়। ওদের ঘরটা শেষদিকে বলে শুনতে নাও পারে। রাত যে বেশ হয়েছে, এবং এত রাতে সে কখনও সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কোনও দিন কাউকে ডেকেছে কি না মনে করতে পারছে না। অবিনাশ এবং অমিয়রা চলে গেল। তান্নাকে তবু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। সে বলল, শুয়ে পড়ছি।
তান্না বলল, শোও।
—তুমি কি জেগে থাকবে ভাবছ?
—দরজা জানালা বন্ধ করে শোব।
ভেতরের দিকে দরজা কখনও বন্ধ করে না তান্না। সবই অন্যদিনের মতো, সুজয় শুয়ে একটা হাই তুলল পর্যন্ত। সে জানে যত বেশি সে দুর্বল হয়ে পড়বে, তান্না তত ঘাবড়ে যাবে। এবং ওদের দুটো খাট। মাঝখানে বাতিদান, কোনও কোনও রাতে ঘুম না এলে রাত জেগে বই পড়ার অভ্যাস সুজয়ের। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সে বই পড়ে। পাশের খাটে তান্না ঘুমোয়। এবং তান্না শুলেই ঘুম চলে আসে। আর যা হয়, বেশ রাতে যখন কখনও সে উঠে পড়ে, আলো জ্বালে, দেখতে পায় তান্না শুয়ে আছে, সায়া শাড়ি ঠিক নেই। এক অবিরাম সুখ খেলা করে বেড়াচ্ছে শরীরে। তখন তান্নার মুখে একটা গোপন দুঃখ আছে সে বুঝতে পারে।
নাইলনের মশারি। সবই সুজয় দেখতে পাচ্ছে। যদিও সে ঘুমের ভান করে আছে, তবু দেখতে পায়, তান্না দরজা জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। খাটের তলা ভাল করে দেখে নিচ্ছে। শোবার আগে আয়নায় দাঁড়িয়ে সে চুল সুন্দর করে বাঁধে। মুখে সামান্য পাউডার, এবং শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সে কিছু দামি আতর ছড়িয়ে দেয়। সারা ঘরে একটা মায়াবী নীল আলো জ্বেলে দিলে তান্নাকে ভারী পবিত্র লাগে। অথচ আজ তান্না কিছুই করল না। পেছন ফিরে কী দেখল! কেমন একটা সংশয়। সুজয় বাচ্চা ছেলের মতো হাঁটু মুড়ে শুয়ে আছে। সে বুঝতেই দিচ্ছে না ঘুমোয়নি। তান্নাকে সে লক্ষ করে যাচ্ছে—বিয়ের পর মাঝে মাঝে সে দেখেছে, তান্না কেমন কোনও কোনও দিন পাগলের মতো সহসা বলত, সুজয় তুমি কোথায় যাচ্ছ? সুজয় অবাক হত। অফিসে যাচ্ছে, অথচ তান্না কেমন অবাক হয়ে যেত, যেন প্রথম সে অফিসে কাউকে না জানিয়ে যাচ্ছে। তান্না ভারী দুঃখী মুখ করে বলত, তুমি যাবে না। তুমি যাবে না সুজয়। তোমার কিছু হবে। কেউ আমার অনিষ্ট করতে চাইছে।
সুজয় বলত, কী বাজে বকছ। কোনও কোনও দিন একা সুজয়কে কিছুতেই বের হতে দিত না। আমি যাব তোমার সঙ্গে। প্রথম প্রথম সুজয়ের মনে হয়েছিল মজা করছে তান্না, তারপর ভেবেছিল, ছেলেমানুষি, কিন্তু সে অনেকদিন পর বুঝলে, একটা অকারণ ভয় তাকে কষ্ট দিচ্ছে। সে কতভাবে যে চেষ্টা করেছে। ওর মা বাবা দুর্গাপুরে। বড় বাংলো বাড়ি, একটা বড় রাস্তা চলে গেছে, দু’পাশে সব সাহেবসুবোদের সুন্দর সুন্দর কটেজ। সবুজ ঘাসে যে মেয়ে চুপচাপ কোনও বিকেলে বসে আকাশ দেখত, চুলে থাকত যার লাল পলাশ, এবং যার একমাত্র সুখ কোনও বিদেশি পপ সঙ্গীতে, তার ভেতরে কী আছে এমন গোপন কষ্ট—যা সে এতদিনেও ধরতে পারেনি। তান্না আলমারি খুলে শাড়িটা আবার বের করেছে। পুরোনো, কেউ হয়তো শাড়িটা বিয়ের আগে তাকে দিয়েছে। শাড়িটা কখনও কখনও সে পরে থাকে। শাড়িটা যে আর দশটা শাড়ির চেয়ে আলাদা ধীরে ধীরে সুজয় এটা ধরতে পেরেছে। কখনও কখনও কিছু ভাল না লাগলে তান্না রাতে এই শাড়ি পরে শুয়ে থাকে। সাদা সিল্কের ওপর বাদামি লেসের কাজ। আট দশ বছরে খুব পুরোনো হয়ে গেছে। গোপনে বোধ হয় তান্না শাড়িটা রিপু করে থাকে মাঝে মাঝে। ভয় পেলে এটা সে দেখেছে, শাড়ি পড়ে তান্না একা খাটে চুপচাপ শুয়ে থাকে। সারারাত ঘুমোয় না বোধ হয়। সে কখনও তখন ওর কাছে যেতে পারে না। সহবাসের নামে তান্না আঁতকে ওঠে। এবং এ-সব এত ব্যক্তিগত ব্যাপার যে আজ পর্যন্ত কাউকে এমন একটা অস্বাভাবিক আচরণের কথা সে বলতে পারেনি। এবং সকালে এত স্বাভাবিক যে মনেই হয় না, রাতে তান্না কিছু বিসদৃশ আচরণ করেছে। সুজয় আবার ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবার চেষ্টা করত। সে বুঝতে পারত এই নিয়ে কিছু বললে, তান্নাকে টরচার করা হবে। এবং সময়ে সব নিরাময় হয়ে যাবে এমনই চেয়েছিল সুজয়।
তখনই প্রায় উলঙ্গ হয়ে গেছে তান্না। শরীরে সায়া শাড়ি কিচ্ছু নেই। সে কপট নাক ডাকতেই তান্না নিজের ঐশ্বর্য দেখতে দেখতে কেমন বিমুগ্ধ। বোধ হয় তান্নার একটা আশ্চর্য পৃথিবী আছে। সে সেখানে চলে গেলে, সব ভয় তার দূর হয়ে যায়। তান্না কত পুরোনো একটা ব্রেসিয়ার মাথার ভেতরে গলিয়ে দিচ্ছে, কত পুরোনো একটা পেটিকোট পরেছে এবং সেই পুরোনো সাদা সিল্কের শাড়িটা পরে চুলের খোপায় খুঁজে দিল সুন্দর মতো লালরঙের প্লাসটিকের পলাশ। এবং বড় ধীরে চলাফেরা করছে। ভারী সন্তর্পণে। যেন সে গোপনে অভিসারে যাচ্ছে। দরজা জানালা বন্ধ। নীল আলো জ্বলছে। এবং এই শীতেও সে পাখা খুলে দিয়েছে সামান্য।
এ-সব হলেই সুজয়ের যে কী হয়ে যায়! সে শুয়ে থাকতে পারে না। মনে হয় যুবতী মনের ভেতরে রেখে দিয়েছে বড় এক পদ্মদিঘি। পাড়ে পাড়ে তখন কেউ বুঝি হেঁটে বেড়ায়। অথবা মনে হয়, নিদারুণ এই সময়, ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হয়—মেয়েটা বোঝে না একটা ক্ষিপ্ত বাঘের মতো মশারির নীচে শুয়ে আছে কেউ।
সে মশারির নীচে চলে গেলেই উঠে পড়ল সুজয়। যত দ্রুত সম্ভব সে প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে গেল পাঁচিলটা। তারপর থাবা উচিয়ে বুকের কাছে বসে পড়ল, তান্না প্রায় আর্তনাদের মতো চিৎকার করে উঠল, না না সুজয়। আমি পারব না। আমি মরে যাব। এই সব চিৎকার চেঁচামেচিতে সবাই জেগে যেতে পারে। বুকের কাছে পুরে ফেলল প্রায় হালকা শরীরটাকে। বলল, কেন কেন তুমি মাঝে মাঝে আমাকে এ-ভাবে ভয় দেখাও তান্না। তান্না ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছু বলছে না। সে বলতে পারছে না, আমি কেন এ-ভাবে দেখে ফেলি তাকে। মানুষের ভিড়ে, কোনও জনহীন স্টেশনে অথবা গাড়িতে যেতে সে সহসা হাত তুলে আমাকে ডাকে।—এই যে তান্না, বা রে দেখতে পাচ্ছ না! তোমার সঙ্গে লোকটা কে! এক আশ্চর্য বিকেলে, কোনো পাহাড়ি উপত্যকাতে বসে আছে তান্না। দূরে কোনও নির্জন জলপ্রপাতের শব্দ। সে নুয়ে ঘাস ছিঁড়ছে। আর সেই দামাল এক যুবক, পৃথিবীর সব সুখ যে সহজেই সব মানুষকে এনে দেবে বলে চলে গেল, ফিরে এল না—যে বলেছিল, তান্না তুমি আছ বলে মানুষের জন্য তাবৎ সুখ আনতে চলে যাচ্ছি, ফিরে আসব রাজার মতো। তুমি কিন্তু অপেক্ষা করবে তান্না।
—কেউ যদি এসে নিয়ে যায়।
—তাকে খুঁজে বেড়াব তান্না।
—যদি না পাও?
—ঠিক পেয়ে যাব। পেয়ে গেলে তাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না।
তান্না বলতে পারত, মাঝে মাঝে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়েনি। একা থাকতে দাও। সে তা না বলে শুধু বলল, শরীরটা ভাল নেই সুজয়। আমাকে সামান্য সময় একা থাকতে দাও। ঘুমোতে দাও। ঘুমোতে পারলে সকালে ঠিক ভাল হয়ে যাব। কোনও আর আমার দুঃখ থাকবে না। আর এ-ভাবে বোধ হয় কখনও কখনও একজন মানুষের ভেতর মরীচিকার মতো অন্য মানুষের বসবাস গড়ে ওঠে। নড়ে উঠলে দুঃখটা টের পাওয়া যায়। দুঃখটা মানুষের বেঁচে থাকার ভারী অবলম্বন।
৩০.১১.১৯৭৫
লেখক পরিচিতি
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়: ১ মার্চ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলার রাইনাদিতে জন্ম। বহরমপুরের অবসর পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘কার্ডিফের রাজপথ’(১৯৫৮)। গম্বুজের হাতে স্পর্শ, অলৌকিক জলযান, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, ঈশ্বরের বাগান প্রভৃতি। বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৯৮-এ পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। ২০০১-এ অকাদেমি পুরস্কার।