শোক সংবাদ

শোক সংবাদ

দেশবিশ্রুত ব্যবহারজাবী স্যর এস. এন. গুপ্টা মৃত্যুশয্যায়; সারা দেশে একটা উৎকণ্ঠা পড়িয়া গিয়াছে। এই বয়সে ডবল নিউমোনিয়া, আশা তো একেবারেই নাই। ডাক্তারদের এখন আর বিশেষ কাজ নাই, ‘আর কতক্ষণ’ শুধু এই লইয়াই তাঁহাদের মধ্যে বচসা চলিতেছে। স্যর শচীনের ক্রোড়পতি মক্কেল দৌলতরাম গিরিধারী, মাড়োয়ারী-মহলের শ্রেষ্ঠ ডাক্তার রায়সাহেব গৌরহরি বসাককে অষ্টপ্রহর মোতায়েন করিয়া দিয়াছেন। রায়সাহেব সব লক্ষণ মিলাইয়া বলিয়াছেন ভোর পাঁচটার পর যদি রোগী বাঁচিয়া থাকে তো বুঝিবেন, তাঁহার চল্লিশ বৎসরের সমস্ত চিকিৎসাই বৃথা গিয়াছে।

‘সত্য-প্রকাশে’র সম্পাদক হলধরবাবু নিজের আপিসের চেয়ারটিতে বসিয়া এক- একবার উদ্বিগ্নভাবে ঘড়ির প্রতি চাহিতেছেন, এবং এক-একবার টেলিফোনের মাউথপীসটা মুখে লাগাইয়া প্রশ্ন করিতেছেন, “কি খবর, সিদুবাবু? আর কতক্ষণ মশাই?”

ব্যাপারটা এই।—মৃত্যুর খবরটা সর্বপ্রথম বাজারে বাহির করিয়া ‘সত্য প্রকাশ’ কিছু করিয়া লইবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। অতিরিক্ত লোক নিযুক্ত করিয়া সমস্ত রাত ধরিয়া স্যর শচীন্দ্রর সুদীর্ঘ জীবনী এবং ততোধিক দীর্ঘ মৃত্যুবিবরণী কম্পোজ করা হইয়াছে—মায় ব্লক সমেত কাগজের অন্যান্য পত্র ছাপা হইয়া গিয়াছে, এখন মৃত্যুসংবাদটি পাইলেই এ সেটটাও চড়াইয়া দেওয়া হয়, হকাররাও প্রস্তুত হইয়া আছে, উঠিবামাত্রই ইংরেজি বাংলা আর সব কাগজের পূর্বেই যেন ‘সত্য-প্রকাশে’র মারফৎ সমগ্র কলিকাতা এই জমকালো মৃত্যু সংবাদটি পায়।

হলধরবাবু সবাইকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন, “রায়বাহাদুর গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তীর মরার সুবিধেটা আমরা শুধু গড়িমসি করে হেলায় নষ্ট করেছি; এবারে সে লোকসানটুকু পর্যন্ত তুলে নিতে হবে। এমন জাঁদলে মৃত্যু তো আর দেশে এবেলা-ওবেলা ঘটছে না, একটা সুযোগ গেল তো আবার হাঁ করে বসে থাকা।”

তাই নিজেও সমস্ত রাত জাগিয়া উদ্যোগী হইয়া রহিয়াছেন।

গুপ্টা সাহেবের বাড়ির পাশেই একটি ডিসপেনসারির টেলিফোন-যন্ত্রটি ‘সত্য-প্রকাশ সমস্ত রাতের জন্য ভাড়া করি লইয়াছে। যন্ত্রটির সামনে স্টাফের একজন না-একজন লোক বসিয়াই আছে। ঘটনাটি ঘটা কি খবরটি আপিসে পৌঁছাইয়া দেওয়া—সঙ্গে সঙ্গে ছাপা শুরু এবং হলধরবাবুর ভাষায় বলিতে গেলে—”কাক কোকিল টের পাওয়ার আগেই ‘সত্য-প্ৰকাশে’র হৈ হৈ রৈ রৈ করে বাজার ছেয়ে ফেলা, দেখি কে এগোয় আমাদের সামনে এবার।”

মোটা কালো বর্ডার দেওয়া এক ইঞ্চিটাক পরিমাণ টাইপের বিজ্ঞাপনপত্রী ছাপা হইয়া গিয়াছে—

বিনামেঘে বজ্রপাত—দেশব্যাপী হাহাকার—দেশবিখ্যাত মহাকর্মী এস. এন. গুপ্টা বার-এট ল’র বৈকুণ্ঠযাত্রা—তাঁহার দুর্ভেদ্য রহস্যজনক উইল— ‘সত্যপ্রকাশের তিন পৃষ্ঠাব্যাপী শোকাঞ্জলি—লউন—পড়ুন—জাতীয় শোকে অশ্রুর তর্পণ করুন!!

রাত্রি একটা হইতে সহকারী সম্পাদক সিদ্ধেশ্বরবাবুই ওদিককার টেলিফোনে বসিয়া আছেন; এখন সাড়ে তিনটা কি চারটা হইবে। সমস্ত লোককে খুব সকাল সকাল আসিতে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘুম হইতে জাগিয়া সমস্ত দিন আর রাত প্রায় এগারটা পর্যন্ত— গুপ্টা সাহেবের জীবনী ও ‘মরনী’ লেখা, প্রুফ দেখা, এই সবে কাটিয়াছে। তারপর দুই ঘণ্টার মধ্যে আহারাদি ও নিদ্রা সারিয়া বসিয়াছেন। চায়ের চাড়া দিয়া ঘুম আটকাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু সে কি মানে? আমেজে ঢুলিতে ঢুলিতে প্রায় যন্ত্রটি মাথায় লাগ লাগ হইয়াছে, এমন সময় কির-কির-ক্রিং-ক্রিং করিয়া আওয়াজ হইল।

সিদুবাবু চকিত হইয়া উঠিয়া আড়ামোড়া ভাঙিতে ভাঙিতে বলিলেন, “আঃ, লোকটা এ রকম ধুকপুকুনির মধ্যে ফেলে আর কত জ্বালাবে?”

টেলিফোন ধরিলেন, “হ্যাল্লো?”

“আর কত দেরি মশাই? পনেরটি হাজার কপি ছাপতে হবে, সে খোঁজ রাখেন? এদিকে রাত যে ফুরিয়ে এল।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু উত্তর করিলেন, “কি করি বলুন? এখনও রয়েছে যে টিকে। ঠেঙিয়ে তো মারতে পারি না। মাঝে একটু বাইরে গিয়েছিলাম, হঠাৎ কান্না উঠল। এসে তাড়াতাড়ি টেলিফোনটি ধরতে যাব—হঠাৎ সব একেবারে চুপচাপ। এরা যেন দিব্যি এক খেলা পেয়ে গেছে!”

“তাই বটে, আর আমাদের এদিকে প্রাণ যায়। তাহলে একটা টাল গেছে বলুন? আমি তো বলি—দিই না চড়িয়ে, আর টিকবে না; আমাদের ছাপা হতে হতে সাবড়ে যাবে।”

“আর একটু দেখুন, একেবারে দৈব ব্যাপার কিনা, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।”

“দুর্দৈব! এরকম তীর্থের কাকের মতো আশায় আশায় বসে থাকা চাড্ডিখানি কথা মশাই?”

“নয়ই তো, কিন্তু কে শুনছে বলুন?”

“এ যেন সেই মাখন ভটচাযের গঙ্গাযাত্রার মতন হল। বুড়ো সাতটি দিন মাঘের শীতে গঙ্গার ধারে বসিয়ে রেখেছিল মশাই, না পারি ফিরতে, না পারি

“থামুন থামুন! ঐঃ, আবার কান্না উঠিল!”

“সত্যি নাকি? জয়সিদ্ধিদাতা—তাহলে দিই চড়িয়ে?”

সিদুবাবু ত্বরিতভাবে বলিলেন, “একটু সবুর করুন, দেখে আসি আসল কি মেকী।–” বলিয়া রিসিভারটা রাখিয়া বাহির হইয়া গেলেন। একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া দীর্ঘ সুরে নিরুৎসাহ ভাবে ডাকিলেন, “হ্যাল্লো।”

“কি সংবাদ?”

“নাঃ, ভুয়ো। মুসৌরি থেকে এক মেয়ে এইমাত্র এসে পৌঁছল। ‘বাবা গো! কোথায় গেলে গো!’ করতে করতে হুড়মুড়িয়ে ওপরে উঠে গেল। সব সময় ন্যাকামি সইতে পারি না মশাই, ঐ তো বাবা জলজ্যান্ত রয়েছে রে বাপু!”

“আর এরকম ছিঁচকাঁদুনে কটি মেয়ে বাইরে রয়েছে খোঁজ নিলেন? যত্তো সব!—”

খুট খুট করিয়া দুই-তিনটা বিরতির আওয়াজ হইল। সিদুবাবুও রিসিভারটা টাঙাইয়া রাখিলেন। তারপর ডাকিলেন, “দাদা! দাদা!”

দাদা বলিতে ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার বাবু। এই ঘরটিতেই এক কোণে ক্যাম্প- খাটে নিদ্রিত আছেন। ভালমানুষ গোবেচারি-গোছের লোক, একটু বয়স হইয়াছে। কাজে অত্যন্ত নারাজ, গল্পে খুব দড়। কখনও হুঁকা আর চায়ে অ্যালেন না। এইসব মজলিসী গুণের সমাবেশে সরকারি ‘দাদা’ হইয়া বসিয়াছেন।

আরও ছয়-সাতবার ডাকাডাকির পর জড়িতকণ্ঠে উত্তর দিলেন, “এই যে জেগে রয়েছি। যমের দোরে ধন্না দেওয়া এখনও শেষ হল না? কি খবর ওদিকে?”

“খবর সেই একঘেয়ে—মাঝে মাঝে শুধু দ্যায়লা হচ্ছে। আমি তো আর ঠায় বসে থাকতে পারছি না দাদা, চোখ জুড়ে আসছে!”

“এক এক কাপ হয়ে যাক না, ক্ষতি কি?”

“সেই জন্যেই তো আপনাকে কষ্ট দেওয়া; আর স্পিরিট আছে?”

“না। কেন, বোতলে তো অনেকখানি ছিল, কি হল?”

“এর মধ্যে যে চারবার স্টোভ জ্বালা হয়ে গেছে। আর বোতলগুলোর একটা দোষ লক্ষ্য করেছেন? যতক্ষণ বেশ সাবধানে বাপু-বাছা বলে আস্তে আস্তে ঢালবার চেষ্টা করবেন, ততক্ষণ কিছুতেই পড়বে না। তখন ভয়ানক রাগ ধরে—ধরে কিনা বলুন না?—স্পিরিট তো ছিল অনেকখানিই, এখন বোতলটা একেবারে খালি।”

“তাহলে? দোকানের স্টক খালি।” বলেই দিয়েছিলাম; কাল না আনলে—”

“তবেই তো! এক কাজ করব না হয়?”

“কি শুনি?”

“মনে করছি একটু না হয় বাসাতেই চলে যাই। চা খাওয়াকে চা খাওয়াও হবে, একটু বেড়ানোও হবে। রাত্তিরটুকুর জন্যে তাহলে এক রকম নিশ্চিন্দি।”

ইহার মানে এই যে, দাদাকে গিয়া টেলিফোন ধরিতে হইবে। তাই দাদা কোন উত্তর দিলেন না।

সিদ্ধেশ্বরবাবু বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, “আর এই ফ্লাস্কটাও নিয়ে যাচ্ছি, আপনার জন্যেও কাপ দুয়েক নিয়ে আসা যাবে’খন।”

“হ্যাঁ, ঘাড়ে করে আবার চা বয়ে আনা! আর দু কাপ কি হবে? সে বলতে গেলে তো

ওতে চার কাপ এঁটে যায়, তাই বলে কি চার কাপ ভরে নিয়ে আসতে হবে? মোদ্দা শিগগির আসা চাই, ঘুমকাতুরে লোক, জানই তো।”

“এই আধঘণ্টা লাগবে, তার বেশি নয়। অত বড় একটা ভাবনা লেগে রয়েছে, বুঝলেন না?”

“ভাবনা একটুখানি? বলে, যার বিয়ে তার চাড় নেই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নেই। আর কেন? সরে পড় না বাবু। তিন দিন থেকে একটানা শ্বাস টেনে যাচ্ছিস, কি আরাম পাচ্ছিস ওতে? একটা শখ নাকি?”

“সে কথা কে বলে বলুন?”

“তা আধঘণ্টা কোনো রকমে চোখ-কান বুজে রয়েছি—মোদ্দা ঐ কথা, দেরি যেন না হয়।”—বলিয়া দাদা বিছানা ছাড়িয়া উঠিলেন।

“চোখ-কান একটু সজাগ হয়েই বুজবেন তাহলে দাদা, আমি বলছিলাম, একটা বই-টই কি কাগজ-টাগজ নিয়ে বসুন না হয়।”

“আরে না না; অত হালকা নয়। একটি ছিলিমের ওয়াস্তা, সেই যোগাড়ই হচ্ছে, দেখ না। নাও, বেরিয়ে পড়।”

দাদা তামাক সাজিলেন। কলিকার আগুনে টোকা দিতে দিতে নিজের মনে বিড়বিড় করিতে লাগিলেন, “দিলে না বাঁচতে—নিশ্বেসে নিশ্বেসে মেরে ফেললে,—আ হা হা! তোর শোক-সংবাদের নিকুচি করেছে!”

হুঁকার মুখটি মুছিয়া সাদরে মুখ লাগাইবেন এমন সময় শব্দ হইল,—কির কির ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং—”

“তা জানি; বামুনের কপাল কিনা!”—বলিয়া হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া রিসিভারটি তুলিয়া লইলেন, ডাকিলেন, “হ্যাল্লো!”

“কি খবর, আছেন না গেছেন?”

“না গেছেন, বোধ হয় আধঘণ্টাটাক—”

অত্যন্ত বিস্ময়ের কণ্ঠে উত্তর হইল, “আধঘণ্টা! অথচ আমায় বলেন নি? আধঘণ্টা—কতটা কাজ—”

“নাঃ, আধঘণ্টা হয় নি এখনও; গেছেন তো এই মাত্র। বলছিলাম, আধ—”

শেষ হইবার পূর্বেই উত্তর হইল, “তাই বলুন। সময়ের আন্দাজটা যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি? গলাটা ভারি ভারি ঠেকছে!”

দাদা যে কখনও ঘুমান, এটা বাহিরে স্বীকার করিতে চান না। বলিলেন, “নাঃ, এই তো আমরা দিব্যি গল্প করছিলাম—একটা সঙ্গী পেলে কি ঘুম আসে।”

সহাস্যে উত্তর হইল, “তা বটে। আপনার সাথীটি খুব গল্পপ্রিয়, না?” দাদা এদিকে মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “আমারও ওপরে যান।”

উত্তরস্বরূপ তারযোগে আবার একটু হাসি ভাসিয়া আসিল। প্রশ্ন হইল, “যাক, তাহলে কখন ও সুমতিটা হল?”

দাদা আবার হাসিয়া বলিলেন, “সুমতি হওয়াই বটে, যা অবস্থা হয়ে এসেছিল মশাই! মানুষের শরীর তো, কতটা সয় বলুন? সেই এক ঠায় এক ভাবে—”

“তা বৈকি; যাক, আর বাজে কথায় সময় নষ্ট করবার ফুরসত নেই; কখন আসছেন তাহলে?”

“ঐ যে গোড়াতেই বললাম, আর জোর আধঘণ্টাটাক লাগবে।”

“হ্যাঁ, সেই কথাই ভালো। আর যা যা সব জ্ঞাতব্য বিষয় আছে, একটু জেনে নিয়ে আসাই ভালো, আবার যেন যেতে না হয়। বড্ড ভিড় কাজের এদিকে।”

দাদা ভাবিলেন, জ্ঞাতব্য বিষয় আবার কিরে বাবা! আছে বোধ হয় কিছু, মরুক গে।

“তাহলে নির্ভাবনায় দিলাম চড়িয়ে, কতক্ষণ সাজা পড়ে রয়েছে!”

কথাটা দাদার একটু যেন কি রকম বোধ হইল একবার; তখনই গনগনে কলিকাটির পানে দৃষ্টি পড়ায় রিসিভারটি টাঙাইয়া দিতে দিতে নিজের মনেই বলিলেন, “ওদিকেও তাহলে দেখছি, তাওয়াদার কলকে-গড়গড়ার ব্যবস্থা। যাক, আমার গরিবের এই-ই মেওয়া।”—বলিয়া হুঁকাটি তুলিয়া লইলেন।

.

ওদিকে প্রেসের কাজ সতেজে আরম্ভ হইয়া গেল। আর সব তৈয়ারই ছিল, শুধু মৃত্যুর সময়ের জন্য যেটুকু স্পেস খালি রাখা হইয়াছিল, সেটুকুতেই টাইপ বসাইয়া দেওয়া হইল। কালো বর্ডার এবং ললাটে বড় বড় টাইপের আর্তনাদ লইয়া কাগজগুলো একে একে প্রেস হইতে আছাড় খাইয়া পড়িতে লাগিল, তাহার সারাংশেরও সারাংশ এইরূপ—”

“বাংলায় হাহাকার। পরলোকে স্যর এস. এন. গুপ্তা! বাংলার ভাগ্যাকাশ হইতে আরেকটি নক্ষত্র খসিল। বঙ্গজননীর অঙ্গ শূন্য হইল; মার নয়নাশ্রুর বন্যায় আবার প্রলয়ের প্লাবন নামিল। সন্তানহারা অভাগিনী মা আমার, আজ কি বলিয়া তোকে সান্ত্বনা দিব? কোথায় পাব সান্ত্বনার স্নিগ্ধবাণী? সান্ত্বনা তো দিতে চাই, কিন্তু আজ শোকজীর্ণ লেখনী দিয়া যে প্রবলধারে অশ্রুর ধারাই নামিয়া আসিতেছে। এই নিদারুণ শোকে জড়ও প্রাণবন্ত হইয়া উঠিয়াছে, আবার প্রাণ জড়বৎ নিশ্চল।

বাংলার সুসন্তান, লক্ষ্মীর দুলাল, বাণীর বরপুত্র, কুবেরের কীর্তিস্তম্ভ, কর্মে অক্লান্ত, বাগ্মিতায় বার্ক, করুণায় দাতাকর্ণ, সত্যে যুধিষ্ঠির, দেশবিশ্রুত ব্যবহারজীবী স্যর শচীন্দ্রনাথ গুপ্টা আর ইহজগতে নাই। গতকল্য বুধবার রাত্রি চারি ঘটিকার সময় সমস্ত দেশকে হাহাকারে নিমগ্ন করিয়া এবং আত্মীয়স্বজনের বক্ষে শেল হানিয়া স্যর শচীন্দ্র ইহলোক হইতে বিদায় হইয়াছেন। হায়, কি কঠিন কর্তব্য আমাদের! দুই মাসও অতীত হয় নাই, বাংলার ঘরে ঘরে আমাদের স্বনামধন্য রায়বাহাদুর গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তীর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছাইয়া দিতে হইয়াছিল। দেশবাসীর কপোলে সেই অশ্রুধারা শুকাইবার পূর্বেই আবার এই মর্মভেদী দুঃসংবাদ। স্যর শচীন্দ্র কয়েকদিন হইতে জ্বরাক্রান্ত হইয়া শয্যাশায়ী ছিলেন; হঠাৎ বিগত সোমবার রাত্রি প্রথম প্রহর হইতেই নিউমোনিয়ার লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। শহরের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকগণ সমবেত হন। মহাসমারোহে চিকিৎসা-যজ্ঞ আরব্ধ হয়। হায়, কে জানিত সে মহাযজ্ঞে যে হোমানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, তাহা এই মহাপ্রাণের আহুতি না লইয়া নিৰ্বাপিত হইবে না? চিকিৎসাসাগর মথিত হইল; কিন্তু হে বৈরাগী, তোমার অঞ্জলি সুধার পরিবর্তে গরলেই পূর্ণ হইবে, তাহা কে জানিত?…

নিউমোনিয়ার সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমরা অতিমাত্র উদ্বিগ্ন হইয়া স্যর শচীন্দ্রের ভবনে উপস্থিত হই। বাংলা সংবাদপত্রের মধ্যে ‘সত্যপ্রকাশেরই সত্যনিষ্ঠায় অগাধ বিশ্বাস থাকায় বরাবরই এই পুরুষসিংহের কৃপাকটাক্ষ লাভ করিয়া আসিতেছে। এ কয় দিবস পাঠকবর্গকে প্রতিদিনের অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়াছিলাম। বড় আশা ছিল, অচিরেই আরোগ্যের শুভ সংবাদ দিয়া দেশবাসীর অশান্ত চিত্তে শান্তির সুধাসিঞ্চনে সমর্থ হইব। কিন্তু হায়, কালস্য কুটিলা গতি—আমাদের সে আশা সমূলেই নির্মূল হইল।…

ইহার পরে সংক্ষিপ্ত জীবনী। জীবন সম্বন্ধে প্রকৃত খবর জানিবার কোনো রকম সুবিধা হয় নাই বলিয়া এই অংশে, সব কৃতী পুরুষের বেলাই মোটামুটি খাটে, এমন কতকগুলি ভাসা-ভাসা কথার অবতারণা করা হইয়াছে। গুপ্টা সাহেবের শৈশবাবস্থার কয়েকটি রোমাঞ্চকর উদাহরণ দিয়া বাল্যে গুরুভক্তি, কৈশোরে জ্ঞানতৃষ্ণা, যৌবনে দেশাত্মবোধের উন্মেষ, প্রৌঢ়ত্বে ত্যাগমহিমা এবং অবশেষে বার্ধক্যে এই সমস্ত গুণরাজি একটা সহজ পরিণতি লাভ করিয়া কেমন ঈশ্বরানুমুখী ভক্তিতে পরিণত হইয়াছিল, তাহা অতি নিপুণতার সহিত বিশদভাবে দেখানো হইয়াছে। তথ্যের দৈন্য ভাষার সমৃদ্ধিতে সম্পূর্ণরূপে চাপা পড়িয়া গিয়াছে।

সর্বশেষে আছে—

আজ ভারত একজন অক্লান্ত কর্মী এবং অকপট সেবক হারাইল—বঙ্গভূমি তাহার শ্রেষ্ঠ নিধি হারাইল—আর ‘সত্য-প্ৰকাশ’?—‘সত্য-প্ৰকাশ’ যাহা হারাইল, তাহা আর ফিরিয়া পাইবে না। আজ সমস্ত দেশ শোকে মুহ্যমান, কে তাহাকে সান্ত্বনা দিবে? আমরা তাঁহার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে আন্তরিক সমবেদনা জানাইতেছি। ঈশ্বর তাঁহাদের এই গুরু শোকভার বহন করিবার শক্তি দান করুন।

স্যর শচীন্দ্রের বিশাল সম্পত্তি সম্বন্ধে উইল এখনও রহস্যাবৃতই আছে।”

বেলা ছয়টা বাজিবার পূর্বেই ছাপার কাজ শেষ হইয়া গেল। আপিসের বাহিরে দলে দলে হকাররা আসিয়া অপেক্ষা করিতেছে; অন্য লোকদেরও ভিড় ভয়ানক। হাতে হাতে অনেক কাগজ বিক্রয় হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে কলিকাতার এ পল্লীটাতে মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া গেল। দুই-একজন, যাহাদের প্রকৃত সংবাদ জানা আছে বলিয়া বিশ্বাস ছিল, সন্দেহ প্রকাশ করিতে গিয়া এমন টিটকিরির ঝাপটা খাইল যে, তাহাদের আর মুখব্যাদান করিতে হইল না।

হকাররা অন্যদিনের ডবল, তিনগুণ কাগজ লইয়া নিজ নিজ এলাকার পানে ছুটিল। দেখিতে দেখিতে বেলা সাতটার মধ্যে সারা কলিকাতা শহরে বেশ ভালো করিয়া দুঃসংবাদটা ছড়াইয়া পড়িল।

ততক্ষণে অন্য দুই-একখানা ইংরাজি বাংলা মর্নিং পেপারও আসরে নামিয়াছে।

.

বেলা ছয়টা হইলে সিদ্ধেশ্বরবাবু হাতে থার্মোফ্লাস্কটা ঝুলাইয়া ডিসপেন্সারিতে প্রবেশ করিলেন। টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বলিলেন, “এই চা। তারপর খবর কি?”

“হল তোমার আধঘণ্টা? খবর ভালো নয়, বুঝি এ যাত্রাটা টিকেই গেল।” সিদ্ধেশ্বরবাবু একটু লজ্জিত হইয়া বলিলেন, “না না, বেঁচে যান সেই ভালো, অত বড় লোকটা। বেড়ানোটুকুতে উল্টো উৎপত্তি হল দাদা; সারারাত ঘুম হয় নি, তার ওপর শেষ রাত্তিরের মিঠে হাওয়া, বাড়ি পৌঁছুতে চোখের পাতা পাথরের মতো ভারি হয়ে এল। বিছানায় এলিয়ে পড়ে বললাম, নাও, শিগগির পাঁচ কাপ চা, এক্ষুনি বেরুতে হবে।—ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। আপনার ভাদ্দরবউও আর প্রাণ ধরে তুলে দিতে পারে নি—হাজার হোক, মেয়েছেলের জাত তো; দেড়টি ঘণ্টা কোথা দিয়ে যে কেটে গেল! তারপর হঠাৎ সহসা এই সর্বনেশে—ক্রিং ক্রিং ক্রিং।”

সেখানেও টেলিফোন আছে নাকি?”

“টেলিফোন নয়। আপনার ভাদ্দরবউ চা তোয়ের করছে, বাসনের ঠোকাঠুকি; চুড়ির আওয়াজ। তাতে তো ঘুমই আসে মশাই। কিন্তু ন্যাবা হলে সবই হলদে দেখে কিনা; আমার কানে বাজল, ক্রিং ক্রিং ক্রিং। মনে যে একটা ভয়ঙ্কর ধুকপুকুনি রয়েছে এদিকে, বুঝলেন না কথাটা? তখন একটু রাগও হল, কাজের সামনে পতিভক্তি-টক্তি বুঝি না বাবা, একটা বুড়ো লোককে জাগিয়ে সেখানে বসিয়ে এসেছি। একটু বকাবকি হয়ে গেল; মেয়েছেলে, সহজে হটতে চায় না, জানেনই তো।…তারপরে, এদিকে আপিসের খবর কি? ডাক-টাক পড়েছিল?”

“গোড়ায় প্রায় তুমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পড়েছিল। লোকটি বেশ রসিক হে। অনেকক্ষণ কথা চলল, তারপর সাজা তামাক পুড়ে যাচ্ছে বলে বন্ধ করলেন। ভালো কথা, বাড়িতে কোনো জ্ঞাতব্য বিষয় জানতে গিয়েছিলে নাকি? জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম কি না, তুমি আধঘণ্টার মধ্যে ফিরবে; তাইতে বললেন, জ্ঞাতব্য বিষয় সব জেনেশুনে আসাই ভালো! যাক, সে ভেতরকার কথা আমার শোনবার দরকার নেই; তবে কথাটা ভালো বুঝলাম না।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু একবার ওপর দিকে চাহিয়া একটু ভাবিয়া বলিলেন, “কই, জ্ঞাতব্য আর কি? এক তো এই জ্ঞাতব্যের ফেরে পড়েছি! দাঁড়ান, দেখি কি ব্যাপারটা।”

“হুঁ বুঝুন একবার, আমি ততক্ষণ হয়ে আসি।”

দাদা বাহির হইয়া গেলেন।

সিদ্ধেশ্বরবাবু মাউথপিসটা তুলিয়া লইয়া ডাকিলেন—”৪০০৯ বড়বাজার।”

এক্সচেঞ্জ হইতে জবাব আসিল—”এনগেজড।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু টেবিলের উপর একটু তবলা বাজাইলেন, ফ্লাক্সের দিকে চাহিয়া দাদা চার কাপই একা সাবাড় করিয়া দিবে, কি একটু আক্কেল করিবে, চিন্তা করিলেন; তারপর আবার যন্ত্রটা উঠাইয়া লইলেন।

কনেক্‌শন পাওয়া গেল; মন্থরভাবে ডাকিলেন, “হ্যাল্লো! আমি সিদ্ধেশ্বর। কি খবর? কি করবেন স্থির করলেন? এদিকে এখনও—”

“খবর তো খুব ভালো; পনের হাজার কপির মধ্যে হদ্দ হাজার দুয়েক পড়ে আছে— রেকর্ড ডিমান্ড। আপনার ফুরসত হল? এ ঝোঁকে আবার কত ছাপতে হবে একটা পরামর্শ করতে হবে যে। আর নতুন মালমশলা কি পেলেন? আধঘণ্টার জায়গায় তো দুঘণ্টা হয়ে গেল; খাঁটি খবরের যোগাড়ে আছেন বলে আর রিং-আপও করি নি।”

কথাগুলো সিদ্বেশ্বরবাবুর কানে যেন খাপছাড়া বোধ হইল। চিন্তিত ভাবে ভ্ৰূদ্বয় কুঞ্চিত করিয়া কহিলেন, “কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারছি না, আর একটু স্পষ্ট করে—”

“আর টেলিফোনে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে না, আপনি চলে আসুন। টেলিফোনে বকে বকে সারা হয়ে গেছি। এই এক্ষুনি তিনটে লোকের সঙ্গে তো প্রায় ঝগড়া হয়ে গেল। বলে, আপনারা ঠিক জানেন? বেশ ভালো করে খবর নিয়েছেন? খবরটা কনফারম করিয়ে নিয়েছেন যে, তিনি মারা গেছেন? বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ মশাই, আমাদের নিজের লোক— স্বয়ং সাবএডিটার প্রায় শিয়রে বসে, না মারা গেলে তিনি উঠতেই পারেন না—”

শেষ করিবার পূর্বেই হলধরবাবুর কানে চিৎকারের স্বরে বিস্মিত আওয়াজ হইল, “সে কি!”

হলধরবাবু একটু থামিয়া গেলেন; তাহার পর ভীতকণ্ঠে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি মানে?”

“সে কি মানে—তিনি মারা গেছেন আপনাকে কে বললে?”

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ, পরে উত্তর আসিল, “আপনার কি রাত জেগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে সিধুবাবু? তখন সময় নিয়েও একটা গোলমেলে কথা বললেন—একবার বললেন, আধঘণ্টাটাক হবে; শুধরে বললেন, এক্ষুনি। এখন আবার বলছেন, আপনি খবর দেন নি!”

“সময় নিয়ে তো কোনো কথাই হয় নি আপনার সঙ্গে!”

দাদা আসিয়া প্রবেশ করিলেন, বলিলেন, “আমার সঙ্গে একটু হয়েছিল বৈকি; তোমায় বললাম না? জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সুমতিটা হল? তোমার বাড়ি যাওয়ার সুমতিটা আর কি। আমি বললাম—”

সিদ্ধেশ্বরবাবু মাউথপিসটা মুখ হইতে একটু সরাইয়া বলিলেন, “আচ্ছা, কি কি কথা হয়েছিল, এক এক করে বলুন তো, বোধহয় সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

দাদা তাঁহাদের মধ্যে কথাবার্তা যেমন হইয়াছিল, বিবৃত করিয়া যাইতে লাগিলেন। ওদিকে টেবিলে রাখা মাউথপিসটার ভিতর ঝলকে আগুনের মতো বাহির হইতে লাগিল, “কথা কন না কেন? জেরবার! শিগগির চলে আসুন! সর্বনাশ!— ড্যামেজ!—সব জেলে…”

সিদ্ধেশ্বরবাবু প্রায় পাগলেরই মতো হইয়া গিয়াছিলেন; সব কথা শেষ হইবার পূর্বেই বলিয়া উঠিলেন, “এর একটা কথাও যে আমার সম্বন্ধে নয় দাদা। উনি যে বরাবরই রোগীর সম্বন্ধে কথাবার্তা হচ্ছে এই বুঝে গেছেন। আগেই কেন বলে দিলেন না যে, আমি কথা কইছি না। গেল, সব গেল!”

হন্তদন্ত হইয়া বাহিরের পানে চাহিলেন। দাদা পিছনে পিছনে যাইতে যাইতে প্রশ্ন করিলেন, “তবে যে বললেন, সাজা রয়েছে, নিশ্চিন্দি হয়ে চড়িয়ে দেওয়া যাক?”

‘সাজা যা রয়েছে, তা কল্কে নয়, ম্যাটার—অর্থাৎ সেট-করা টাইপ প্রেসে চড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন। রসিকতা করতে গিয়েই যে সর্বনাশটি করে বসেছেন সব!”

ফুটপাতে গিয়া ডাকিলেন, “এই ট্যাক্সি, জলদি।” হঠাৎ একটা কথা মনে আসিল, সঙ্গে সঙ্গে একটু আশা।

গুপ্টা সাহেবের বাড়ির দিকে প্রায় ছুটিলেন একরকম। সামনেই একজন ডাক্তার দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন, “আর কত দেরি বুঝছেন?”

কথাটা নিজের কানেই বেয়াড়া শুনাইল। ডাক্তার একবার মুখের দিকে চাহিয়া আশান্বিত-ভাবেই বলিলেন, “না, একটা বেশ ফেবারেবল টার্ন নিয়েছে, এযাত্রা বোধ হয় বেঁচেই গেলেন।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু মুখের ভাবটা আর দেখিতে না দিয়া সরাসরি মোটরে গিয়া উঠিলেন। ঠিক সেই সময় বগলে একতাড়া কাগজ লইয়া একটা বাচ্চা হিন্দুস্থানী চলন্ত ট্রাম হইতে টুপ করিয়া লাফাইয়া পড়িয়া ট্যাক্সির দরজার কাছে হাঁকিল, “সত্য-প্ৰকাশ লিন বাবু। সব্বনেশে খবোর, স্যার শচীন্দর!—”

সিদ্ধেশ্বরবাবু ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়া বলিলেন, “হাঁকাও ফুল স্পীডে।”

.

সন্ধ্যা উতরাইয়া গিয়াছে। হলধরবাবু, সিদ্ধেশ্বরবাবু, আর দুই-একজন কেরানী আপিসে বিষণ্ণভাবে বসিয়া আছেন. ক্বচিৎ দুই-একটা কথাবার্তা হইতেছে; সিদ্ধেশ্বরবাবুর হাতে একটি কলম আছে, মাঝে মাঝে ঝুঁকিয়া একখানি কাগজে কি লিখিতেছেন।

দিনটা যেন একটা দুরন্ত ঝড়ের মধ্য দিয়া কাটিয়া গিয়াছে। সারা শহরে ‘সত্য- প্রকাশের একার খবর আর ওদিকে ইংরাজি বাংলা সমস্ত কাগজের খবর, দুইটি বিরুদ্ধ খবরের মধ্যে দারুণ সংঘর্ষ বাধিয়া গিয়াছিল। আপিসের বাহিরে কান পাতা যায় না, ইতরভদ্র মিশ্রিত জনতার অবিমিশ্র গালাগালি। কান লইয়া ভিতরে বসিয়া থাকাও নিরাপদ নয়, টেলিফোনটা অবিচ্ছিন্ন-ভাবে ক্রিং ক্রিং করিয়া সমস্ত দিন যেন ‘যুদ্ধং দেহি যুদ্ধং দেহি’ হাঁকিয়া গিয়াছে; যদি বা অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরিয়া রিসিভারটা তুলিয়া হইল তো কেবল উৎকট বিদ্রূপ, কদর্য হিন্দি ভাষা, কিংবা তীব্র হুমকির উদগার!

তাহা ছাড়া চিঠি যে কত আসিয়াছে, তাহার আর লেখাজোখা নাই। তাহার মধ্যে দুইখানি বিশেষ উল্লেখযোগ্য; একখানি স্বয়ং গুপ্টা সাহেবের বাড়ি হইতে, উকিলের সংযত ভাষায় প্রশ্ন, “দেখানো হউক, কেন অন্তত পনরো হাজার টাকার ড্যামেজ সুট ‘সত্য- প্রকাশের বিরুদ্ধে আনা হইবে না।”

আর একখানির নীচে, গুপ্টা সাহেবকে দেখিতেছেন, এমন কয়েকজন বিশিষ্ট ডাক্তারের নামসহি। তাহাতে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর ভাষায় জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে :

“সত্য-প্রকাশে’র সোমবার ১৩ই অক্টোবর ১৯২৮-এর টাউন এডিশনে রোগশয্যাগত ইহলোকবাসী স্যর শচীন্দ্রনাথ গুপ্টার মৃত্যুবিবরণে পত্রসংখ্যা দুইয়ের ষষ্ঠ প্যারায়, “কে জানিত যে মহাযজ্ঞে যে হোমানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, তাহা এই মহাপ্রাণের আহুতি না লইয়া নির্বাপিত হইবে না”, আবার পত্রসংখ্যা তিনের দ্বিতীয় প্যারায়, “চিকিৎসা-সাগর মথিত হইল, কিন্তু হে বৈরাগী, তোমার অঞ্জলি সুধার পরিবর্তে গরলেই পূর্ণ হইবে, তাহা কে জানিত?”—এইরূপ যে লেখা হইয়াছে, ইহার প্রকৃত অর্থ কি? এই দুই বাক্যের দ্বারা নিম্নস্বাক্ষরকারী চিকিৎসকদিগের পেশা এবং আত্মসম্মানে যে গুরুতর আঘাত করা হয় নাই, প্রয়োজন হইলে উক্ত ‘সত্য-প্রকাশে’র এডিটার এবং প্রিন্টার বিচারালয়ে এরূপ সপ্ৰমাণ করিতে রাজী আছেন কিনা, ইত্যাদি।

এই দুইখানা চিঠি লইয়া গুপ্টা সাহেবের বাড়িতে গিয়া ধন্না দেওয়া, ডাক্তারদের বাড়ি বাড়ি গিয়া হাজিরা দেওয়া—এই করিয়া সমস্ত দিনটা পালা করিয়া এডিটার, সাব-এডিটার আর প্রিন্টারের কাটিয়াছে। কাগজ বিক্রয়ের লাভ ট্যাক্সি-ভাড়ায় একপ্রকার নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত দিন টানা-পোড়েনের ফল এক জায়গায় একটু পাওয়া গিয়াছে, গুপ্টা সাহেবের অবস্থার একটু পরিবর্তনে তাঁহাদের মনটা অনেকটা প্রসন্ন থাকার দরুনই এটুকু সম্ভব হইয়াছে। তাঁহারা রোগীর কল্যাণকামনায় ক্ষমা করিতে রাজী আছেন, যদি অদ্যকার কাগজে সুদীর্ঘ অ্যাপলজি চাওয়া হয় এবং অঙ্গীকার করা হয় যে, ‘সত্য-প্ৰকাশ’ কখনও কোন ব্যক্তির মৃতুসংবাদ প্রকাশ করিবে না, অন্তত ঘটনার পরে এক মাস না যাওয়া পর্যন্ত; ইচ্ছা হয় তাহার পরে করিতে পারে।

ডাক্তাররা এখনও রাগিয়া আছেন।

হলধরবাবু মনের ভাবটা আর চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না; অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিলেন, “তাও যদি আজকের সকাল কিংবা দুপুর নাগাদ মরে যেত তো অনেকটা সামলে নেওয়া যেত।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু কাগজ হইতে কলমটা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “হ্যাঁ মরবে! মরতে ওর বয়ে গেছে! ডাক্তার গৌরহরি বসাক বলেছে, যদি এযাত্রা না বাঁচে তো ডিগ্রী ছেড়ে দোব!” হলধরবাবু ঝাঁজিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আরে ছেড়ে দাও ওটার কথা; ও-ই না বলেছিল, পাঁচটার পরে না মরলে, ওর চল্লিশ বছরের চিকিৎসাই বৃথা? ওরাই তো এই কাণ্ডটা বাধালে! যত সব বোগাস! এক্তিয়ার থাকলে আমিই তো ওর ডিগ্রী কেড়ে নিতাম আজই।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু আরও দুই-তিন লাইন লিখিয়া লেখাটি সমাপ্ত করিলেন। কাগজটা তুলিয়া বলিলেন, “এই হল, শুনুন—”

“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, গতকাল ‘সত্যপ্রকাশে স্যর শচীন্দ্র গুপ্টার যে মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল তাহা সম্পূর্ণ ভুল।”

হলধরবাবু একটু ভ্রুকুঞ্চিত করিলেন, কোথায় যেন একটু খটকা লাগিতেছে, তাহার পর বলিলেন, “বেশ তো হয়েছে। হ্যাঁ, তার পর?”

“এ সংসারে দুর্নিরীক্ষ্য একটি জীবাণু দ্বারাও মহাপ্রলয়ের সৃষ্টি হয়; সুতরাং কেমন করিয়া একটি অতি তুচ্ছ কারণে ভ্রমাত্মক সংবাদটি মুদ্রিত হইয়া প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে, সে বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা না করিলেও আশা করি পাঠকবর্গ আমাদের মার্জনা করিবেন। সর্বাপেক্ষা অধিক মার্জনার প্রয়োজন স্যর এস. এন. গুপ্টার আত্মীয়স্বজনের নিকট, যাঁহাদের এ সংবাদটি সকলের চেয়ে রূঢ়ভাবে আঘাত করিয়াছে। সান্ত্বনার কথা যে, তাঁহারা বরাবরই খবরটা ভুল জানিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিয়াছিলেন।

“কল্য প্রত্যূষ হইতে রোগ আরোগ্যের দিকে চলিয়াছে এবং আমাদের বিশেষ সংবাদদাতার মারফৎ জানা গেল যে, সমস্ত দিন অপ্রতিহতভাবে উপশান্ত হইয়া আসিয়াছে।”

কেরানী বামাচরণবাবু সিদ্ধেশ্বরবাবুর পানে মুখ তুলিয়া একটু চাহিলেন। সিদ্ধেশ্বরবাবু একটু মুচকি হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ, বিশেষ সংবাদদাতা ওদিকে পা বাড়ালে হয় একবার! তার ঠ্যাঙের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করে ছাড়বে।”

সকলে হাসিয়া উঠিলেন।

সিদ্ধেশ্বরবাবু আবার পড়িতে লাগিলেন—

“চিকিৎসার জন্য যেরূপ ধন্বন্তরীদের সমাবেশ হইয়াছে, তাহাতে—”

হলধরবাবু শঙ্কিতভাবে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “না না, ও ধন্বন্তরী-ফন্বন্তরী কাটুন, ভাববে ঠাট্টা করছে; ঐ নিয়ে আবার এক লম্বা চিঠি এসে হাজির হবে’খন।”

সিদ্ধেশ্বরবাবু কথাটা কাটিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি লেখা যায়? বিচক্ষণ চিকিৎসক?”

হলধরবাবু মুখটা কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “দি—ন লিখে। বিচক্ষণ না হাতী!”

তাহাই লেখা হইল। পড়া চলিল—

চিকিৎসার জন্য যেরূপ বিচক্ষণ চিকিৎসকদিগের সমাবেশ হইতেছে, তাহাতে আমরা বরাবরই এইরূপ আশু উপশমের আশা করিয়া আসিতেছি এবং পাঠকবর্গকেও সেইরূপ ভরসা দিয়া আসিতেছি। ভগবান আমাদের আশা এবং সেই আশার দ্বারা প্রণোদিত ভবিষ্যদ্বাণী যে সফল করিলেন, ইহাই আমাদের পরম সৌভাগ্য। চিকিৎসকেরা সমবেতকণ্ঠে ঘোষণা করিতেছেন যে, অদ্য দ্বিপ্রহর পর্যন্ত রোগী সম্পূর্ণরূপে সর্ববিধ বিপদের গণ্ডির বাহিরে যাইয়া পড়িবেন।”

বামাচরণবাবু বলিলেন, “মানে?”

“মানে, যাকে বলে ডেঞ্জার জোন পেরিয়ে যাওয়া আর কি।”

“ও! ওর আবার একটা উল্টো মানেও হতে পারে কিনা, তাই বলছিলাম।” হলধরবাবু বলিলেন, “না যখন বেঁচেই গেল, কেউ অত টেনে মানে করতে যাবে না। নিন পড়ন।”

“সুতরাং, এ বিষয়ে আর চিন্তার কিছুই নাই। কারণ তাঁহাদের এই বাণীকে আমরা বেদবাণীর মতোই অভ্রান্ত এবং অমোঘ বলিয়া মনে করি।

“আজ এই মহাপুরুষকে অকাল মৃত্যুর হাত হইতে ফিরিয়া পাওয়ায় আমরা যে স্বর্গীয় আনন্দ উপলব্ধি করিতেছি, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি, আমাদের সে ক্ষমতা নাই। যিনি আমাদের এই হতভাগ্য দেশের প্রতি এই চরম কৃপা প্রকাশ করিলেন, সেই পরম কারুণিক ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা যে, তিনি স্যর শচীন্দ্রনাথ গুপ্টাকে এই নবজীবনের সহিত সুদীর্ঘ পরমায়ু দান করিয়া তাঁহার কল্যাণব্রতকে আরও সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তুলুন।”

বামাচরণবাবু বলিলেন, “বেশ হয়েছে। ডাক্তারগুলোকেও তো খুব আকাশে তুলে দেওয়া হল।”

হলধরবাবু বলিলেন, “হল না? এখন সেখান থেকে ওদের এক একটিকে ধরে কেউ আছাড় দিতে পারে তো গায়ের ঝাল মেটে।”

.

কাগজ বাহির হইল।

আজও অসম্ভব কাটতি। লোকে সঠিক খবরের চেয়ে কৌতুকেরই বেশি প্রিয়, ‘সত্য-প্রকাশ” আজ আবার কি লেখে দেখিবার জন্য উদ্‌গ্রীব হইয়াছিল। আজও সকাল সকাল কাগজ বাহির করিয়া দেওয়া হইয়াছে। অতি অল্প সময়েই, অন্য কোনো কাগজ বাহির হইবার পূর্বেই ‘সত্য-প্রকাশ’ স্যর শচীনের ‘নবজীবনে’র সংবাদ ও ‘পরমায়ু’-বৃদ্ধির প্রার্থনা লইয়া শহরে বেশ ছড়াইয়া পড়িল।

তাহার পর যথাসময়ে দুই-একখানি করিয়া ইংরাজি বাংলা দৈনিক বাহির হইল। “স্টপ প্রেস” স্তম্ভে সংক্ষিপ্তভাবে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের খবর লেখা আছে—

মঙ্গলবার ১৪ই অক্টোবর

অদ্য সকাল ছয় ঘটিকার সময় প্রসিদ্ধ ব্যবহারজাবী ও দেশসেবক স্যর এস. এন. গুপ্টা, বার-এট-ল’র নিউমোনিয়া রোগে মৃত্যু হইয়াছে। স্যর শচীন্দ্র আট দিন হইল সামান্যভাবে জ্বরাক্রান্ত হন; ক্রমে জ্বর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং তিনদিন হইল নিউমোনিয়ায় পরিণত হয়। আক্রমণ এইরূপ সাংঘাতিক হয় যে, চিকিৎসকগণ বরাবরই আশাশূন্য ছিলেন। রোগ অতি অল্পকালের মধ্যে ডবল নিউমোনিয়ায় দাঁড়ায় এবং মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স ৬৭ বৎসর হইয়াছিল।

.

সমস্ত দিন মহানগরীর মুখখানি বিষাদে মলিন হইয়া রহিল। ‘সত্যপ্রকাশ’ কিন্তু তাহারই মধ্যে কোথায় বরাবর একটু কৌতুকের হাসি ফুটাইয়া রাখিল,—বাদলা মেঘের কোলে অস্পষ্ট রামধনুর মতো।

.

দুপুর হইয়া গিয়াছে। অস্নাত এবং অভুক্ত হলধরবাবু, সিদ্ধেশ্বরবাবু, বামাচরণবাবু এবং কয়েকজন কম্পোজিটার বিষণ্ণভাবে আপিসে বসিয়া আছেন। কদাচিৎ দুই-একটা কথাবার্তা হইতেছে।

সিদ্ধেশ্বরবাবু বলিলেন, “না হয় একটা অতিরিক্ত সংখ্যা তাড়াতাড়ি বের করে দেওয়া যাক না। পাঁচটা পর্যন্ত তো বেশই ছিল, হঠাৎ এরকম ডিগবাজি খেয়ে বসবে, কে জানত?” হলধরবাবু বিরক্তভাবে বলিলেন, “বসে বসে ঐ করি আর কি? লোকটা সে-ই গেল, তবে আমাদের সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার করে গেল কেন বল দিকিন?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *