শোক গাথা

শোক গাথা

অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।

উলটো দিকের নতুন ওঠা ফ্ল্যাট থেকে জরি বসানো শাড়ি ঝুলছে। ব্যালকনিতে চার-পাঁচ রকম বয়াম। আচার নিশ্চই। শিয়োর অবাঙালি। মেট্রোরেলটা চালু হবার পর এধারে অসম্ভব বেড়ে গেছে ফ্ল্যাটের দাম। যারা কিনছে, বেশির ভাগই অবাঙালি। মোবাইল সবজিওলাটির চাকাওলা ভ্যানে কুমড়ে-টুমড়োর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে টিল্ডলা পুদিনাপাতা, অসময়ের টমেটো, আর কী অবলীলায় সবজিওলাটি লাউকে বলছে লোউকি।

একটা বাস আসছে। যাব তো দমদম স্টেশন। এখান থেকে তিনটে মাত্র স্টপ। বাসে ছ’ মিনিট এক টাকা ভাড়া অটোয় দেড় টাকা। পাশের দাড়িয়ে আছে নির্মলেন্দু মিত্র নাকি মৈত্র? ব্লক বি-র, বাসে উঠল না। গা থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে ওডিকোলনের। কদিন আগে কাগজের সাপ্লিমেন্টারিতে ‘নারীর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠুন’-এ ছিল গায়ে ওডিকোলন দিন। এরপর থেকেই কি ওডিকোলনের প্রকোপ হয়েছে?

আর একজন এল। সাফারি স্যুট পরা। ইশ, এই গরমে সাফারি স্যুট? মুখে পান। অবাঙালি শিয়োর। লোকটা পানের পিকটা ফেলে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার ভেরি স্যাড। অটো এসে গেল। ড্রাইভারের বাঁ পাশে একটা ছোট সিটে সেট হয়ে গেলাম। ন’টা বত্রিশ এর মেট্রো ধরব। ওই সাফারি পরা লোকটা স্যাড বলল কেন? কীসের স্যাড? অংশুর ব্যাপার? পরশু দিন বিকেলে অংশুর মাথায় একটা বল লেগেছিল। অংশুরা তো খেলে না, খেলা দেখে। টিভিতে, ভিসিপি তে। মাঝে মাঝে লাইভ। কাছেই একটা বস্তি মতো আছে, ওদের ছেলেরা সামনের একটা ছোট জায়গায় খেলে। অংশু সেই খেলা দেখে লাইভ। পরশু দিন হলিডে ছিল, আমি বাড়িতেই। বিকেলে ব্যালকনিতে বসে জাস্ট দেখছিল। একবার বলল, বাবা, একটা বাইনোকুলার কিনে দেবে? বললাম, ও কে। বলটা অংশুর কপালে লাগে। আর একটু হলেই চশমায় লাগতে পারত। প্লাস থ্রি, মোটা কাচ, লেগে গেলে চোখটার কিছু হয়ে যেতে পারত। সন্ধের সময় এস বি আর এ-র সেক্রেটারিকে ব্যাপারটা বললাম। এস বি আর এ মানে সুরবিহার রেসিড্যান্স অ্যাসেসিয়েশন।

এই এলাকাটা ছিল ডোবা কচুরিপানা সমন্বিত। সুর ফ্যামিলিরা ছিল এই জমির মালিক। নাম ছিল সুরের মাঠ। এই মাঠ ভরতি হয়ে ফ্ল্যাট উঠতে লাগল একের পর এক। ফ্ল্যাটের মালিকরা অ্যাসোসিয়েশন বানাল। সুরের মাঠের নাম চেঞ্জ করে সুরবিহার করা হল। এই নামটা আমার মাথা থেকেই এসেছিল। অবন্তিকা সোম, ব্যাংক ম্যানেজার, বলেছিলেন, কী সুইট।

একটা সরকারি আন্ডারটেকিং-এর পিআরও-র কাজ করে আমার সাহিত্যচর্চা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আগে লিখতাম-টিখতাম। সেই সুবাদেই হয়তো আমাকে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন-এর কালচারাল সেক্রেটারি করে দিয়েছে। সুরবিহার সার্বজনীন দুর্গাপূজার স্যুভেনির-এর এডিটারও আমি৷ এস বি আর এ-কে বলেছিলাম খেলাটা বন্ধ করে দিতে হবে। কিছুদিন আগে অবন্তিকা ম্যাডামের কাচের শার্সি ভেঙেছে। আজ অংশুর চোখটা একটুর জন্য বেঁচে গেছে। এদের খেলাটা একটা নুইসেন্স। খেলার সময় ওরা শ্ল্যাংও বলে মাঝে মাঝে। কমিশনারকে ব্যাপারটা জানানো উচিত। তো, সেক্রেটারি বলেছিল, একটা পিটিশন ড্রাফট করুন।

সাফারি স্যুট যে স্যাড, ভেরি স্যাড বলল, এটা কি সেই রেফারেনস্‌-এ? কিন্তু অংশুর তো কিছু হয়নি তেমন। তা হলে গুজব ছড়িয়েছে। চোখটার কিছু হতে পারত—হয়তো এটারই শাখাপ্রশাখা বেরিয়েছে। এই তো, ক’দিন আগে সুধীর বোস হঠাৎ ঘামতে থাকেন। অজ্ঞান হয়ে যান। ডাক্তার কাঞ্জিলাল তখন ঘরেই ছিলেন। ওকে ডেকে আনা হয়েছিল। প্রেশার খুব ফল করেছিল সুধীরবাবুর। ওঁর স্ত্রী ডাক্তার কাঞ্জিলালকে জানিয়েছিলেন ব্যাংকে দশ হাজার টাকা শর্ট হয়েছে গতকাল। সুধীরবাবু হচ্ছে হেড ক্যাশিয়ার।

গত পরশু ব্রয়লার কিনতে গিয়েছিলাম। জিন্‌স পরা বি এস সি পাশ দোকানদার বলল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? আপনাদের পাড়ার সুধীরবাবু, উনি নাকি সাসপেন্ড হয়ে গেছেন। আমি বললাম, কই, না তো? কে বলল আপনাকে? ছেলেটা বলল শুনছিলাম। অনেকদিন আসছেন না তো, ইট মে বি এ রিউমার, কাঁধটা একটু স্র্যাগ করল ছেলেটা। ছেলেটা নাকি ক্লাস এইট পর্যন্ত সেন্ট মেরিস ইস্কুলে পড়েছিল।

আজ বিকেলে মেঘ মেঘ। অফিস থেকে ফিরবার পথে একটা হুইস্কির নিপ নিলাম। তিনতলার রজতটা বেশ ফিট, ব্যাচেলর। সন্ধের সময় ও কি থাকবে? ও, হ্যা। আজ তো থাকবে। আজ সন্ধ্যায় স্টার এ মিস ওয়ার্লড কনটেস্ট, লাইভ। জমবে। চিলি চিকেন করলে হয়। এটা আমি ভালই পারি। চিলি চিকেনটা বানিয়ে অঞ্জনাকে বলব, চাউ করো, ততক্ষণে রজতকে একটু চিকেন টেস্ট করিয়ে আসি। আসলে ঘরে এখন আর খাই না। বউ খ্যাচ খ্যাচ করে। বলে অংশু বোঝে সব। আরে, বোঝে তো বোঝে। কিছু অন্যায় করছি নাকি আমি। একটু ব্রয়লার এর দোকানে গেলাম। জিন্‌স পরা দোকানদারটি বললে, স্যাড, ভেরি স্যাড, তাই না?

কী স্যাড বলুন তো…

ওই মৃত্যুটা?

কোন মৃত্যুটা?

জানেন না? গতকাল রাত্রের কেস।

না জানি না তো।

তুহিনদা মারা গেলেন জানেন না? এই বলে আটশো গ্রাম চিকেন প্যাক করে আমার হাতে দিল ছেলেটি।

জাস্ট এক বছর আগে বিয়ে করেছিল তুহিনদা।

বিয়াল্লিশ টাকা দিন।

স্যাড, ভেরি স্যাড। চল্লিশ নাও।

সরি। ফট্টি টুই দেবেন। এমনিতেই আমি কম রাখি। স্ট্রোক হয়েছিল। বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়স, লাইফে কী আছে বলুন।

সুরবিহারে ঢুকতেই একটা কদমগাছ। ওখানে একজন বিহারি ছেলে ইস্ত্রি-টিস্ত্রি করে। অনিলদা আর একজন ওখানে দাড়িয়ে নিচু স্বরে কথাবার্তা বলছে। আমার হাতে পলিথিন ঝুলছে। অনিলদা বলল, দেখুন মানুষের জীবন কী রকম কচুপাতায় জল। লাইফের কোনও দাম নেই। এই যে আদিত্য, এই মাত্র তুহিনবাবুর জামাপ্যান্ট ইস্ত্রি করল। কে পরবে বলুন?

আদিত্য বলল, হামারা তো ডিউটি করনেহি হোগা, হ্যায় না? আজ সাম মে লিয়ে যাবে বলেছিল।

অনিলদা বলল, আগামী রোববার আমাদের এস বি আর এ-র পক্ষ থেকে কমুনিটি হল-এ একটা কনডোলেন্‌স ডেকেছি। আপনাকে বলতে হবে।

আমি মৃদু মাথা নাড়ি, চলে আসি। কদম ডালে ঝোলানো ক্যারাটে স্কুলের ফেস্টুনের উপর বসে আছে একটা কাক, মুখে কোল্ড ড্রিংক্‌স এর পলিথিনের স্ট্র, বাসা বাঁধবে। শোনা গেল অনিলদাকে লোকটা বলছে, মাল ছেড়ে দিতে হয় এখনই ছাড়ুন, শ’ওয়ালেস আর রিলায়েন্‌স উঠে গেছে। ম্যাগনাম ফ্যাগনাম আর উঠবে না। ও গড। ওরা শেয়ার নিয়ে কথা বলছিল। বাড়ি যাচ্ছি। ঐক্যনীড়ের দোতলা থেকে পপ আসছে। ডালডার গন্ধ আসছে। ওটাই কি সফারি স্যুটের ফ্ল্যাট? আমাদের ফ্ল্যাটের একতলা থেকে সমবেত আবৃত্তি ‘প্রিয়াকে আমার পেয়েছি আবার ভরেছে কোল দে দোল দোল…’। আবৃত্তিকার কমল বিশ্বাস থাকেন এখানে, রেডিয়োতে খবর পড়েন। দরজায় পেতলের অক্ষরে লেখা কমল বিশ্বাস (আকাশবাণী) কবি বলেই ডাকে সবাই। আজ ওর ক্লাস। সব ঠিকঠাক। আমার ফ্ল্যাটের কলিংবেল এ কোয়েল পাখি। অঞ্জনা মুখে সর-বেসন মেখে রয়েছে। নাথিং অফিসিয়াল অ্যাবাউট ইট। আমি বললাম, তুহিনবাবু কে গো? তুহিনবাবু?

অঞ্জনা ওর ডান হাতের আঙুলগুলো ফাঁক করে হাতটা আমার সামনে ধরল। দেহভাষা থেকে বোঝা গেল বলছি, পরে বলছি। তার মানে সর-বেসনের সঙ্গে আরও কিছু আছে, যা মুখে মাখা হলে কিছুক্ষণ কথাটাও বলা যায় না। আমি হাত মুখ ধুলাম, জামা-প্যান্টের বদলে পাজামা-গেঞ্জি পরলাম, বগলে পাউডার দিলাম, ইতিমধ্যে বোধহয় অঞ্জনার মাস্ক ধোয়ার সময় হল। ও বেসিনে মুখ ধুলো…

জানো খুব স্যাড।

আমি বললাম, হ্যাঁ, স্যাড তো, কিন্তু তুহিনবাবু কে? অঞ্জনা বলল, সামনের সপ্তপর্ণীর দোতলায় না তিন তলায় থাকেন, সরি, থাকতেন।

কেমন দেখতে?

চেনো না? বাঃ, ফ্ল্যাট অ্যাসোসিয়েশন করো, …

মানে ঠিক বুঝতে পারছি না, কেমন দেখতে বলো তো…

আমি কী করে বলব? আমি কি সবাইকে চিনি?

আমি বললাম, কোন ফ্ল্যাটটা? পুবের জানালার দিকে যাই। পর্দা সরাই, ক্যাকটাসের টবটা একটু সাইড করি। বললাম, অঞ্জনা, কোন ফ্ল্যাটটা গো? অঞ্জনা কাছে এল। গোলাপের গন্ধ। মুখের ওই মাস্কে গোলাপ জলও ছিল। বলল, ওই তো, ওই বাড়িটার পিছন দিকের ফ্ল্যাটটা, দোতলায় না তিনতলায় ঠিক জানি না। ওদের ফ্ল্যাটেরই পাঁচতলায় তোমার ওই অবন্তিকা সোম থাকে। এবার বুঝলে?

যাঃ এমন বলছ যেন আমি অবন্তিকার ফ্ল্যাটে ফ্লার্ট করতে যাই।

যাওয়া না যাওয়ার কথা তো হয়নি, ফাস্ট ওর রেফারেনস্‌টা দিলাম তুহিনবাবুকে চেনাবার জন্য। কিন্তু ঠাকুরঘরে কে, আমি কলা খাইনি এই হল তোমার অবস্থা।

হাঃ, ফালতু বোকো না। কী হয়েছিল গো?

কার কী হয়েছিল।

তুহিনবাবুর।

জয়ন্তী এসেছিল সকালে। ওর কাছেই শুনলাম কাল সন্ধের সময় তুহিনবাবুর একবার বমি হয়েছিল। বিকেলে নাকি কচুরি আর এঁচোড়ের চপ খেয়েছিলেন, ভাবলেন, তাতেই অম্বল হয়ে গেছে। একটু পর বুক ব্যথা, অ্যান্টাসিড খেলেন, কিছুক্ষণ পর বুক ব্যথা বেড়ে গেল, ডাক্তার ডাকতে গেল। রবিবারের বাজার, ম্যাকসিমাম ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ, তারপর যেন কোন ডাক্তারকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল। ডাক্তার এসে বলল শেষ।

তখন ক’টা?

রাত আটটা নাগাদ।

ঝিন্দের বন্দি হচ্ছিল ডি ডি সেভেনে তখন।

চিকেন কাটছ কেন?

চিলি চিকেন করব।

রান্না আছে তো। ডিমের তরকারি।

থাক না, করি একটু।

তারপর রজতকে একটু দিতে যাবে, তাই না?

সবই তো বোঝো, হে হে। ডেড বডি আজ গেল?

হিন্দু সৎকার সমিতির গাড়ি দেখেছিলাম এখানে ঢুকছে, তখন অংশুকে স্কুলে দিয়ে ফিরছি।

কাচের বাক্সের ভিতরে কে ছিল দ্যাখোনি?

না, বললাম তো, গাড়িটা ঢুকতে দেখেছি।

লোকটা কে বলো তো?

আশ্চর্য, আমি কী করে বলব। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির দূরত্ব একশো ফুটও নয়। ও বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হলে এ বাড়িতে গন্ধ আসার কথা। লোকটা কী রকম একা একা মরে গেল।

ই সি জি-টা করিয়ো মাঝে মাঝে।

কেন? আমার হার্ট তো ও কে।

তবু মাঝে মাঝে চেক আপ করা ভাল। ভয় করে, একা থাকি আমরা।

একটু আসছি। তুহিনবাবুকে নিয়ে একটা স্টোরি করতে হবে। খবরের কাগজের ভাষা বলে ফেললাম। ওকে নিয়ে একটা রাইট আপ করতে হবে। একটু রজতকে জিজ্ঞাসা করে আসি ও লোকটাকে চেনে কি না। অ্যাঁ?

ছুতোর দরকার নেই। বেশি দেরি কোরো না। সারাদিন একা থাকি।

রজত দিব্বি আছে। বারমুডা আর গেঞ্জি পরা। দুটো খালি চায়ের কাপ, বিছানায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় এর ক্যাসেট। তার মানে ওই মেয়েটা এসেছিল, রজতের বান্ধবী। ও এসব শুনতে ভালবাসে, ওর জন্যই রজত কয়েকটা কিনে রেখেছে। রজত নচিকেতার ফ্যান। আমি বললাম, ভাল কাটল? রজত বলল, ধুস দাঁত ব্যথা। গালে টাচ করতে দিল না। আমি চিলি চিকিনের বাটিটা আর চ্যাপটা বোতলটা টেবিলে রাখলাম। বললাম, শুধু গালের ওপর নির্ভর করলেই চলবে? রজত বলল না কিছু, একটু হাসল, বোঝাতে চাইল যে এরকম নির্ভরতা ওর নেই।

আমি জানি গ্লাস কোথায় থাকে। দুটো নিলাম। বরফ নিলাম। বললাম, বেশি নয়, ছোট করে। রজত বলল, একেই বলে টেলিপ্যাথি। চিয়ার্স। চিকেনটা তোমারই করা মনে হচ্ছে, কী করে বুঝলাম বলো তো, তুমি গোল গোলমরিচ দাও। পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই চিলি চিকেনে গোলমরিচ ইউজ করো, ভালই লাগে কিন্তু…

আমি বলি স্যাড, ভেরি স্যাড, রজত বলল, কেন, স্যাড কেন? ব্ল্যাক পিপারের সঙ্গে স্যাডনেস এর কী সম্পর্ক?

আমি বললাম, কালকের কেসটা জানো না? উইদাউট এনি নোটিস মারা গেলেন আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের একজন মেম্বার।

কে?

তুহিন। তুহিনবাবু। তুহিন কী? মানে সারনেইমটা জানো রজত?

কোথায় থাকেন?

সপ্তপর্ণীতে।

তুহিনবাবু? কীরকম দেখতে?

সেটাই তো তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।

না দেখলে ঠিক চিনতে পারব না।…

আই মিন দেখলে চিনতে পারতাম। আসলে এই সুরের মাঠে দশটা অ্যাপার্টমেন্ট দুশোটা ফ্ল্যাট। সবাইকে চেনা সম্ভব?

দুশোটা ফ্ল্যাট, মানে দুশোটা ফ্যামিলি আমরা গায়ে গায়ে লেগে আছি। বউ যখন বলে একা একা থাকি, তখন এই পয়েন্টটা বলা যায়। ভাল পয়েন্ট। বলা হয়নি কখনও।

—ডেড বডি আছে?

আজ সকালে পোড়ানো হয়ে গেছে। তুমি জানো না কিছু?

না তো, আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। আসলে আজ সকাল থেকেই বাড়িতে। কাজে বেরোইনি। খুব ঘুমিয়েছি। লক্ষ্মীর মা এসেছিল সকালে, কিছু বলেনি তো, আসলে ঘুমোচ্ছিলাম বলেই বোধহয় কিছু বলেনি। কী হয়েছিল?

হার্ট অ্যাটাক। কাল সন্ধের সময়।

আমি তখন সেলস ম্যানেজারের বাড়িতে। নতুন প্রোডাকটার সেলস টারগেট এক্সিড করেছে বলে পার্টি দিয়েছিল। অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছি। একটুখানি সকালে হ্যাং ছিল বলে শুয়েই ছিলাম।

কোনও লাভ হল না। আমি রজতের ফ্ল্যাট থেকে নেমে যাই। তুহিনবাবু সম্পর্কে আমাকে কিছু লিখতে হবে। প্রথমেই আমাকে জানতে হবে তুহিনবাবুর পুরোনাম। আমি সপ্তপর্ণীতে যাই। গেট এর সামনে একটি কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে একটা কুকুরের চেন ধরে দাড়িয়ে আছে। ওকে কি জিজ্ঞাসা করব? নাকি সোজা ম্যাডামের কাছে চলে যাব? অবন্তিকা সোম। সারেন্ডার করব। উনি নিশ্চয়ই তুহিনবাবুকে চেনেন। ওর ফ্ল্যাটে বার দুয়েক গিয়েছি। কখনওই একা নয়। অনিলদা ছিল। উনি সবার সঙ্গেই বেশ ইনটিমেটলি কথা বলেন। আমার প্রতি কোনও স্পেশাল ইয়ে আছে, তা না। তবে মাঝে মাঝে নটি লুক দেন। বেশ লাগে। ফট্টি-নট্টি। যাই? ফ্রাংকলি বলি কী প্রবলেমে পড়েছি। যাব? কিন্তু একটু যে মালের গন্ধ আছে মুখে। মাল খেয়ে কোনও মহিলার ফ্ল্যাটে… উনি আবার একা থাকেন। বড় ব্যাকডেটেড আছি। কী আর ভাববেন। সপ্তপর্ণীতে ঢুকে যাই। সিঁড়ির তলায় লেটারবক্স সবার নাম আছে। তুহিনবাবুর পদবি এই লেটার বক্স থেকেই পাওয়া যেতে পারে। এটা মনে আসেনি কেন এতক্ষণ? দেখলাম টি করচৌধুরি একজন আছেন, …থ্রি বি-তে। টি মজুমদার আছেন একজন, ফ্ল্যাট নম্বর টু সি থ্রি বি-তে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না তুহিনবাবু। করচৌধুরি নাকি মজুমদার। তবে এই দুটোর মধ্যে একটা। সিঁড়ি দিয়ে উঠি। দোতলার সি ফ্ল্যাটের দরজায় নেমপ্লেট তপন মজুমদার। বাঃ এই তো পেয়ে গেলাম। তা হলে তুহিনবাবু করচৌধুরি। তিনতলায় তিনটে ফ্ল্যাটেই নেমপ্লেট আছে শুধু বি-তেই নেই। একটা ব্যাপার জানা গেল, শোক সভায় বলা যাবে— তুহিনবাবু খুবই প্রচারবিমুখ ছিলেন, তার ফ্ল্যাটে নামের ফলকটুকুই লাগাননি কখনও। পাঁচতলায় ম্যাডামের ফ্ল্যাটে বেল বাজতেই কুকুর ডেকে ওঠে। দরজা খুলে ম্যাডাম উচ্ছাসে হাসেন। আরে, আপনি, আসুন। পর্দা দুলছে। ম্যাক্সির ঝালর হাতা উড়ছে। আমি বলি, দখিন দুয়ার খোলা। ম্যাডাম বললেন, এসো হে এসো হে। একটু বেশি হয়ে গেল নাকি? আমি বলি, আপনার সাউথটা ওপেন তো, ওই জন্য খুব হাওয়া, আর এই জন্য আপনি বেশ খুশিতে থাকেন। ম্যাডাম বললেন, শুধু সাউথ ওপেন হলেই হয় না, মনটাও ওপেন। বলেই—আলনা থেকে একটা ওড়না নিয়ে নিজের ম্যাক্সির উপর চাপিয়ে দিলেন। যতই ইয়ে হও, মধ্যবিত্ত। বেশ হাওয়া আসছে। ম্যাডামের ওড়নাটা উড়ছে। আমি দখিন দুয়ার খোলা গানটা জানি। শেষের দিকে আছে তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিও। গাইতে ইচ্ছে হল। কী সাহস, অ্যালকোহলের এফেক্ট? … এখন এসেছি একটা সিরিয়াস ব্যাপারে। আমি গম্ভীর হই। বলি ভেরি স্যাড।

অবন্তিকা বলল, তুহিনবাবুর ব্যাপারটা বলছেন তো?

হুঁ, ওই জন্যই আপনার কাছে আসা। আমি আজই শুনলাম। তুহিনবাবু মানে তুহিন করচৌধুরি তো?

রাইট।

কোথায় কাজ করতেন?

ব্যাংকে।

কোন ব্যাংকে।

সেটা ঠিক… ইউ বি আই না যেন …

কেমন দেখতে বলুন তো? আমি না ঠিক মনে করতে পারছি না।

কেমন দেখতে কী করে বলি। শ্যামলা রং, সাড়ে পাঁচ ফিট হাইট, পাতলা চুল…

আমিও তো তাই। এভারেজ বাঙালিই তো তাই। শ্যামলা রং, সাড়ে পাঁচ ফিট। কোনও স্পেশালিটি?

গোঁপ নেই।

সে তো আমারও নেই।

চশমা আছে।

সে তো আমারও আছে। কোনও মার্ক অফ আইডেন্টিফিকেশন…

যেমন এ মোল অ্যাট দি রাইট ব্যাক, এ ব্ল্যাক স্পট ইন দি লেফট থাই, এসব তো? আমি কী করে জানব?

না না সেসব বলছি না, মুখে কোনও স্পেশাল ব্যাপার, যেমন থাকে না, মুখে বসন্তের দাগ টাগ…

এ জেনারেশনে কারুর মুখে বসন্তের দাগ নেই। আমাদের বাবাদের জেনারেশনে ছিল। দেশ থেকে স্মল পক্স উঠে গেছে।

এজন্য ম্যাডামকে ভাল লাগে, খুব ইনটেলিজেন্ট কথাবার্তা বলেন।

বলি, চুল টুল কাটার মধ্যে কোনও ইয়ে আছে? মিঠুন ছাঁট, বচ্চন ছাঁট, সঞ্জয় দত্ত…

না না, ওরকম নয়, জাস্ট আপনার মতোই ছাঁট। তবে চুলটা একটু কপালের দিকে এলিয়ে পড়ত।

সে তো আমারও পড়ে। আচ্ছা, থুতনিতে ছোট একটা জড়ুল ছিল কি?

ছিল বোধহয়। বাট নট শিয়োর। খুব কাছ থেকে দেখিনি। অ্যাকাচুয়ালি, আজ সকালেই ডেড বডিটার যত কাছ থেকে দেখেছি, জীবিত অবস্থায়, তত কাছ থেকে তুহিনবাবুকে দেখিনি কোনও দিন। আজ সকালে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে অনিলদা মালা দিয়েছিলেন, আমরাও ছিলাম সঙ্গে। তবে বেশি কাছে যাইনি৷ ডেড বডি আমি ঠিক সহ্য করতে পারি না। একটা কোয়েশ্চন, হোয়াই জডুল?

আমি ওই জড়ুলটার উপর কেনও স্ট্রেস দিচ্ছি কেন জানেন, লোকটাকে বুঝতে সুবিধে হত। ক’দিন আগে অটোর জন্য লাইন দিয়েছি, একটা লোক দেখি বে-লাইনে ঢুকে পড়ছে। আমি চ্যাঁচ্যামিচি করলাম। খুব ঝগড়া হল। উনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার অটোতেই উঠলেন। উঠে বললেন, এত ঝগড়া করছেন কেন? এক পাড়ায় থাকি আমরা, কোথায় একটু ব্যাক করবেন… আমি বললাম, এক পাড়া? সরি, চিনতে পারিনি, কোন বাড়িতে, উনি বলেছিলেন সপ্তপর্ণীতে। ওঁর চুলটা কপালের দিকে এলিয়ে পড়েছিল, থুতনিতে একটা ছোট্ট জড়ুল ছিল।

জড়ুল ছিল কি না কনফার্ম করে দিচ্ছি। ওর স্ত্রী তো নেই। বার্নিং ঘাট থেকেই সোজা বাপের বাড়ি চলে গেছে শুনলাম। বার্নিং ঘাটে আমি যেতে পারিনি। রাত্রে আমার ফ্ল্যাট থেকেই ওদের রিলেটিভদের খবর দেয়া হয়েছে। …আপনার প্রবলেমটা কী বলুন তো?

কনডোলেন্স মিটিং এ আমাকে বলতে হবে।

তাতে জড়ুলটা কি খুব জরুরি?

আপনি বুঝতে পারছেন না ম্যাডাম, আমি তো লোকটাকেই আইডেন্টিফাই করতে পারছি না। এজন্যই আপনার হেল্প চেয়েছিলাম। এটা কাউকে বলবেন না আবার, ম্যাটার অফ সেম। দু-আড়াই বছর একসাথে থেকেও…।

এবার অন্য একটা বুদ্ধি আসে আমার মাথায়। আমি পরদিন কদমতলায় আদিত্যর কাছে যাই। আদিত্যকে গিয়ে বলি, বাবা আদিত্য, আমাকে ওই জামাপ্যান্টটা একটু দেখাও না, ওই তুহিনবাবুর জামাপ্যান্ট, যা তুমি ইস্ত্রি করে রেখেছ।

কী হোবে?

একবার দেখতাম, চোখের দেখা।

আদিত্য বার করে দেখাল। একটা বিস্কুট রং-এ ফুলপ্যান্ট, আর মেরুনের মধ্যে সাদা ডোরাকাটা হাওয়াই শার্ট। মেরুনের মধ্যে সাদা ডোরা… কী আশ্চর্য, এই লোকটার সঙ্গেই সেদিন অটোর লাইনে ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়ার মধ্যে উনি একবার বলেছিলেন ‘লাইনেই তো ছিলাম বাবা’। ওকি শঙ্খ ঘোষের কবিতার বইটা পড়েছিল? সেদিনের ওই ঝগড়ার ঘটনাটা কী রকম ডাইমেনশন পেয়ে গেল। আচ্ছা আদিত্য, তুহিনবাবুর থুতনিতে কি একটা জড়ুল ছিল?

জডুল ক্যা চিজ?

একটা আঁচিল টাইপের। আঁচিল জানতা হ্যায়? একটা ফুসকুড়ির মতো। ফুসকুড়ি সমঝা? এই যে এইখানে একটা ছোট্ট ইয়ে।

মাস্‌সা হোতে পারে। লেকিন আপ ওহি সেলুন সে পুছ লিজিয়ে…। ভাল কথা বলেছ আদিত্য। আমাদের সুরের মাঠে ঢুকতে গেলে মোড়ের মাথায় একটা ছোট্ট সেলুন আছে। ভিড় কম হয় বলে অনেকেই এখানেই চুলকাটার কাজটা সেরে নেয়। আমিই তো তাই করি। যে চুল কাটে তার নাম তিমির। চুল কাটতে কাটতে দেশের সমস্যার কথা বলে। ওর কথা শুনে কখনও মনে হয়েছে ও পাঁড় সি পি এম। কখনও মনে হয়েছে পিওর বি জে পি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তিমির ওই যে তুহিনবাবু নামে এক ভদ্রলোক মারা গেলেন, তোমার কাস্টমার?

ও বলল, না।

ঠিক আছে। এতেই হবে। আজই লিখে ফেলব কাল ভোরবেলা বেরুতে হবে। দুর্গাপুর গোয়া থেকে কয়েকজন এক্সপার্ট আসছে ওদের চামচেগিরি করতে হবে ক’দিন। ঘরে ফিরে দেখি এক ভদ্রলোক বসে আছেন, বেশ বয়স্ক। আমায় দেখেই ভদ্রলোকটি বললেন, কী, চিনতে পারছ না বুঝি? চিনবি কী কইরা? যাওন আসন না থাকলে আপন মানুষও পর হয়।

আমি অবাক তাকিয়ে থাকলে তিনি বলেন আমি তর জ্যাঠা। তর দাদু অম্বিকাচরণ আর আমার দাদু ভবানীপদ আপন মামাতো-পিসতুতো ভাই। আমাদের গ্রাম ক্ষীরপাই, আর তগর গ্রাম ময়নাচক। নদীর এই পার আর ওই পার। নদী সাঁতার দিয়া মাঝনদীতে তর বাবা আর আমার বাবা আলাপ করত, তগ সব কাজ-পার্বনে আমরা ছিলাম, আমাগর সব কাজ-পার্বনে তোরা। পার্টিশনের পর একই সঙ্গে কলোনিতে। তগ ঘর, আমাগোর ঘর পাশাপাশি। তগ বাড়ি ডাইনের লংকার ফোড়নে আমরা কাশতাম। আচ্ছা বাই দি বাই, তর পাছায় কি দাগটা আছে? কাঁটা ভরতি বাবলা গাছের ডালের উপর বইস্যা পড়ছিলি। কী রক্ত। তোর চিক্কোইর এ ছুইট্যা আসলাম। আমি টাইন্যা বাইর করলাম কাঁটা, কিন্তু একটা কাঁটা ভাইঙ্গা গেল ভিতরে। জগবন্ধু ডাক্তার, এম এল এফ, অপারেশন কইরা বাইর করল কাটা। সব মনে পড়ে।

যাউক গা। তারপর কী হইল জানো?

আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই বলতে থাকলেন, তর বাবার ট্রান্সফার হইল বহরমপুর। তর বয়স তখন চাইর কিম্বা পাঁচ। সবাই চইলা গেল বহরমপুর। আমি ভাবলাম একটা প্লট ক্যান বেহুদা পইড়া থাকে, আমার শ্যালকরে থাকতে দিলাম। অফকোর্স তোমার বাবার পারমিশন নিয়া। আনফুরচুনেটলি সে প্লটটা ছাড়ল না। তার কাছ থিকা কিছু টাকা চাইয়া তোমার বাবারে দিতে গেলাম। সে রিফিউজ করল। এরপর তোমার বাবা অভিমানে আমার ঘরে আর পা দেয় নাই। আমিও কিন্তু আমার শ্যালকেরে ক্ষমা দিই নাই। আমার শ্যালকের সঙ্গে আমার কোনও বাক্যালাপ নাই আজ অবধি। সে যাউক গা। তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পাইছি মৃত্যুর এক মাস পর। বহরমপুর গেছিলাম। তোমার মা, তোমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা হইল। তোমার ঠিকানা সেইখানেই পাইলাম।

এবার শুন তোর কাছে আসনের মূল কারণ। একবার তুই কই একবার তুমি কই মাথার ঠিক নাই।

আপনি তুই বলুন। আমি বলি।

শুন। আমার মাইয়ার বিয়া। একটাই মাইয়া। নাউ সি ইজ থার্টি টু। লেকচারার। এই যে চিঠি। পথ নির্দেশ আছে। টালির বাড়ি অখন দোতলা। আর শুন, আমার শ্যালকরে আমি নিমন্ত্ৰন্ন করি নাই। আমাগোর ফ্যামিলির যে-কোনও কাজে তোগো ফ্যামিলির সবাই আসত, অ্যান্ড ভাইসা ভার্সা। আমার ছেলের বিয়ার সময় নিমন্ত্রণ করছিলাম, বাই লেটার, আসে নাই, তর বিয়ার সময় উই ওয়ার নট ইনফরর্মড।… আগামী রবিবার সকাল সকাল চলে যাবি। ক্যাটারার ফ্যাটারার করি নাই। নিজেরাই পরিবেশন করব। ইউ মাস্ট কাম।

আগামী রবিবার, এই রে, একটা কনডোলেন্স মিটিং আছে।

কনডোলেন্স কার?

খুবই নিকট লোকের। নেক্সট ডোর নেবার।

ওরা চলে গেলে আমি নেক্সট ডোর নেবারের শোক কথা লেখার জন্য ভাবতে বসি। আজই শেষ করে ফেলতে হবে। পরে আর হবে না। কাল ভোরেই দুর্গাপুর যেতে হবে।

রবিবার রাত সাড়ে সাতটায় টাইম করা হয়েছে। শোক সভার একটা নোটিস কম্পিউটারে ছেপে দুশোটা কপি করিয়ে নিয়েছিলেন অনিলদা, এবং সব অ্যাপার্টমেন্টগুলির লেটার বক্স এ ফেলে দিয়েছিলেন। অনিলদা খুব এক্‌টিভ। তবে একটা ছোট্ট ভুল ছিল। সভার এস এ বি এইচ এ টাইপে সামান্য ভুলে এস এ কে এইচ এ হয়ে গেছে। ফলে উচ্চারণটা শোক সখা হয়ে গেছে। আগে কারুর চোখে পড়েনি। টি ভি-তে বাংলা সিনেমা আটটা অব্দি চলে বলেই সাড়ে আটটা করা হয়েছে।

আমি পৌনে আটটায় কম্যুনিটি হলে চলে যাই। অনিলদা এসে গেছে। আর দু-এক জন, অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা। অবন্তিকা সোম এল। বেশ ভাল পারফিউম। বলল, কী হল তুহিনবাবুর ছবি কোথায়? অনিলদা বলল, জোগাড় করতে পারিনি। তুহিনবাবুর ওয়াইফ এখনও বাপের বাড়ি থেকে ফেরেনি। বোধহয় শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ চুকিয়ে ফিরবে। একটা সাদা কাগজে কালো বর্ডার, ওখানে লেখা অকালপ্রয়াত ৺তুহিন করচৌধুরির স্মৃতিতে। ওই কাগজটা একা বোর্ডে সেট করে রজনীগন্ধার মালা দেয়া হয়েছে। কায়েকটা ধূপকাঠি। আমার খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং পাজামা। পকেটে শোক কথা।

একজন দু’জন করে আসতে লাগলেন। আটটা দশে তিরিশ জন মতো হল। অনিলদা বললেন, এবার শুরু করা যাক। ভাবগম্ভীর পরিবেশ। অনিলদা গম্ভীর গলায় যা বলছেন তা আমার ভাবনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তা হলে আমি যাকে তুহিনবাবু ডেকেছি ঠিকই আছে।

অনিলদার পরই আমি। আমি কাগজটা বার করে পড়তে থাকি।

সুরবিহারের আবাসিকবৃন্দ, আজ আমরা মিলিত হয়েছি কোনও সমস্যা আলোচনা করবার জন্য নয়, কোনও প্রতিবাদ সংগঠিত করার জন্য নয়, আমরা মিলিত হয়েছি বিয়োগ ব্যথায়। আমরা স্বজন হারিয়েছি, আমরা কাতর, আমরা আমাদের বিষাদ বিনিময় করব।

কেউ অমর নয় পৃথিবীতে। সবাইকেই একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু ব্যথা তখনই বাজে, যখন কেউ অকালে চলে যায়।

আবাসিকদের মুখ দেখলাম। সবাই সায় দিচ্ছে, আসলে এই সব বাক্যগুলি আমার কিংবা অনিলদার শোক সভাতেও বেশ মানিয়ে যেত।

তুহিনবাবুর সঙ্গে আমার আড়াই বছরের পরিচয়। এর মধ্যে কথাবার্তা খুব বেশি হয়নি, তবে তার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন। ভিতরে ভিতরে তিনি ছিলেন কবি। তার একটা কবি মন ছিল। শঙ্খবাবুর কবিতা ছিল জীবনযাপনে। তার পরিচয় আমি পেয়েছি।

ঠিক এইসময় ঢুকলেন তুহিনবাবু। না, তুহিনবাবু নয়, যাকে তুহিনবাবু ভেবেছি এইক’টা দিন। মেরুনের উপর সাদা ডোরাকাটা স্ট্রাইপ। থুতনিতে একটা ছোট্ট জড়ুল। এর সঙ্গেই সেদিন অটোর লাইনে।

আমি কাগজটা ভাঁজ করে ফেলি। বলি আর কিছু বলার নেই। হঠাৎ ঘেমে যাই। বসে পড়ি। জানালার ঠিক পাশেই বসে আছে তুহিনবাবু। মেরুনের উপর সাদা ডোরা। আদিত্যর কাছে এই জামা দেখেছি। তুহিনবাবুর জামা।

ওই ছেলেটি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, উই হ্যাভ রাইটলি অবজারভ্‌ড। তুহিনবাবু কবি ছিলেন। আমরা কেউ জানতাম না। এই দেখুন। একটা সান্ধ্য পত্রিকা মেলে ধরল সে। ‘আজকের কাগজ’। তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছোট করে বেরিয়েছে তরুণ কবির জীবনাবসান। এ সময়ের অন্যতম তরুণ কবি তুহিন করচৌধুরি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র বত্রিশ। তিনি সোপান ও দিশারী পুরস্কার পেয়েছিলেন।

মেরুন থেকে সাদা ডোরাগুলি বেরিয়ে এসে আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই, পা টলছে।

এক সঙ্গে হাজার হাজার গজ কাপড় তৈরি হয় হাজার হাজার গজ ডোরাকাটা মেরুন। আমি পাশের মেরুন জামাকে বলি, উঠি দাদা, একটু শরীর খারাপ লাগছে।

ঘরে যাই, চিঠিটা খুলি। চিঠির কোনায় হলুদের ফোঁটা।

যথাবিহিত সম্মানপূর্বক নিবেদনমিদং মহাশয় ফরিদপুর জিলার ক্ষীরপাই গ্রামের ৺অম্বিকাচরণ সরকারের জ্যেষ্ঠপুত্র মনোরঞ্জন সরকারের একমাত্র কন্যা…

হারিয়ে যাওয়া গ্রামনাম জড়িয়ে রেখেছে এখনও।

আমি বললাম, অঞ্জনা, তুমি কি যাবে ওই বিয়েবাড়িতে, ওই যে ভদ্রলোকরা এসেছিলেন…

এখন?

কাছেই, ট্যাক্সি পেলে পনেরো কুড়ি মিনিট।

উঠল বাই, কটক যাই। আগে তো বলতে হয়। না, যাব না।

আমি যাব।

আমি পোশাক পালটাব। পাঞ্জাবি বার করি। ধুতিও। পা-জামাটা খুলি। অঞ্জনাকে ডাকি, আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি, বলি অঞ্জনা, অঞ্জনা, প্লিজ দ্যাখো তো আমার এখানে কিছু দাগ আছে কি। না…

অঞ্জনা বলে, ধুৎ, কী করছ এসব। কিচ্ছু নেই, প্লেন। একদম মসৃণ।

তা হলে আমি?

শারদ বর্তমান, ১৯৯৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *