শৈশবের নদী

শৈশবের নদী 

১৭৯৭। ডিসেম্বরের শীতের সকাল। 

রজব হুসেন জং হিসাব করে দেখেন যে, আজ ২৭ ডিসেম্বর। হিজরি ১২১২ সন। রজব মাসের ৮ তারিখ। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে তারিখটা দেখে নিয়ে মাথায় রাখেন। খাতায় প্রতিদিনের তারিখ লিখে রাখা তাঁর অভ্যাস। মনে করেন তারিখের হিসাব লিখে রাখলে সময়ের গরমিল হয় না। এভাবে পুরো বছরের তারিখ লিখে খাতা ভরে ফেলেন তিনি, তারপর যত্ন করে সেটা রেখে দেন। শহরের লোকেরা কখনো পুরনো তারিখ খুঁজতে আসে তাঁর কাছে, কখনো তারিখের হিসাবে গোলমাল হলে তাঁর কাছে সমাধান পায়। এমন কি তারিখ নিয়ে গোলমাল বাঁধলে তার সালিশও মিটিয়ে দেন রজব জং। লোকে মনে করে তিনি একজন ভীষণ জ্ঞানী লোক। কেউ কেউ বলে, মজার লোক। তাদের মতে তারিখ নিয়ে এত পাগলামি করার কী আছে! তারপরও সবাই তাঁকে মান্য করে। এ নিয়ে রজব জংয়ের ভেতরে গর্ববোধ আছে। অহংকারের ঝাঁঝটা বেশি জাহির করেন চার স্ত্রীর উপরে। এটি তাঁর আর এক ধরনের অভ্যাস। 

রজব হুসেন আগ্রা শহরের পুরনো বাসিন্দা। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। তাঁর ধারণায় দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে থাকার সময়টিই আগ্রা শহরের সবচেয়ে উত্তম সময়। এটিই কবিতা লেখার সময়। আগ্রা শহর নিজেই কবিতা হয়ে ওঠে এ সময়ে। যেন পাঠ করা যায় শহরের সবটুকু। বলতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসার রঙ নেই তো কী হয়েছে, ভালোবাসার কবি আছে। কবির কণ্ঠস্বর আছে। শোনো তার শব্দরাজি। ডুবে যাও ভালোবাসার রঙের নদীতে। সোনালি আকাশে। ভালোবাসার সবুজ দেখো কেমন পল্লবিত হয় বৃক্ষে শস্যের রঙের দেখো কত আভা। ভালোবাসাকে চিনতে শেখো হে প্রিয় শহরবাসী। রজব হুসেন জংয়ের অভিপ্সা ধ্বনিত হয় যমুনায়, তাজমহলে। তোমরা কবিকে ভালোবাসো হে আগ্রাবাসী। 

আসলে এ সময়ে রজব হুসেন যমুনা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেতে ভালোবাসেন। মনে করেন, আহ কী অসাধারণ নদী, তাজমহলের ছায়া বুকে ধরে রাখে। এ নদীই কবির নদী, প্রেমের নদী ভালোবাসার গভীর জলের স্রোতের নদী। একদিন এই নদীর ধারে বড় হবে একজন কবি। তার কবিতা বেঁচে থাকবে শতাব্দী জুড়ে। নিজেকেই প্রশ্ন করেন রজব হুসেন, কেন এমন ভাবনা মনে আসে তাঁর? এর কি কোনো সূত্র আছে? নাকি নেহায়েতই কবির ভাবনা? কবি দেখতে চান এক কবি থেকে অন্য কবিতে সময়ের বয়ে যাওয়া। সময় তো নদীর মতো বয়। কবির কাছে সময়ই নদী। 

প্রতিদিনের মতো আজও হাঁটতে বেরিয়েছেন রজব জং। কুয়াশা তেমন নেই। পাতলা আবরণের মতো নীলাভ কুয়াশা যমুনার ওপর ছড়িয়ে আছে। কানটুপিতে মাথা ঢেকে, লম্বা আচকান পরে শীতের সকালে বের হতে হয়। পোশাকের এই বাহুল্য পছন্দ হয় না বলে হাঁটার জন্য গ্রীষ্ম শরৎ-হেমন্ত ঋতুই পছন্দ তাঁর। শীতের সকালে কখনো দিনের প্রথম আলো কুয়াশায় আড়াল হয়ে যায়। তখন অনুভব তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে না। এটাও তাঁর অপছন্দের আর একটি কারণ। তিনি জানেন নদী এবং দিনের প্রথম আলো দেখা তাঁর কাছে দিন শুরুর শর্ত। ঝড়-বৃষ্টি বা অন্য কোনো বড় ধরনের পারিবারিক ঝামেলা না থাকলে ভোরবেলা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এসে থমকে দাঁড়ান রজব। আজ কুয়াশা অনেকটা কেটে গেছে। দিনের প্রথম আলোয় চারদিক ভরে আছে। প্রতিদিন তো দিনের শুরুটা এমন করে দেখা হয় না। আজকের শুরুটা অন্যরকম লাগছে। ঠিকই বুঝে যান যে নদীর প্রবাহে বাড়তি শব্দ যোগ হয়েছে। তরঙ্গের গায়ে মাতাল আবেগ—আনন্দ এবং উৎফুল্ল হয়ে ওঠার ঘটনা ঘটছে। মনে হয় শীতের তীব্রতা কেটে গেছে। এখন উষ্ণ হওয়ার সময়। রজব হুসেন জং চারদিকে তাকিয়ে ভাবেন, হলো কী? যমুনার পাড় ধরে ভোরের মায়াবী আলোয় হাঁটাহাঁটি করার কত দিন তো পার করেছেন কিন্তু তরঙ্গের এমন প্রিয় ধ্বনি কখনো পাননি! আজ হলো কী? 

দু’পা এগিয়ে পাড়ের খুব কাছে এসে বলেন, নদী উত্তরটা দাও! 

নদীর তরঙ্গ সহস্র কণ্ঠস্বর হয়ে বলে, আজ ছেলেটির জন্ম হবে।

ছেলেটির জন্ম হবে! 

আজই রাতে। 

বড় হয়ে কী হবে সেই ছেলে? 

কবি। বড় কবি। 

কবি! চিৎকার করে ওঠেন রজব হুসেন জং। 

দু’হাত প্রসারিত করে বলেন, আজ তাজমহলের কাছে গিয়ে বলব, আজই সেই রাত যখন একজন কবির জন্ম হবে। শোনো আগ্রাবাসী এই শহরে আজ একজন কবির জন্ম হবে। কবির জন্ম একটি বড় ঘটনা। কবির জন্মে আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে শহর। কবির জন্ম হলে মানুষের নিশ্বাস ফুলের সৌরভে ভরে যায়। ওহ, আর কী ভাববেন রজব জং? নাকি ঘরে ফিরে লিখবেন একটি নতুন কবিতা। 

দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকেন রজব জং। ভাবতে থাকেন কার ঘরে সন্তানের জন্মের অপেক্ষায় আছে একজন নারী? কে সে? কে এমন পুণ্যবতী নারী? কার গর্ভ এমন ঐশ্বর্যে পূর্ণ? ওহ্, আনন্দ, আনন্দ! থমকে দাঁড়ান রজব জং। চারদিকে তাকান। নিজের স্মরণশক্তিকে তীক্ষ্ণ করে খুঁড়ে ফেলেন স্মৃতির ভূমি। কিন্তু না, কারো নাম মনে আসে না। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কারো ঘরে তো এমন খবর নেই। বন্ধু-বান্ধবও না। দূরের কেউ কি? যার খবর রজব জং রাখেন না। কিংবা যাদের খবর তাঁর কাছে এসে পৌঁছায় না? শহরজুড়ে কত লোক। কয়জনের খবরই বা তিনি রাখতে পারেন? ক্ষণিকের জন্য মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। ভাবেন, সেই মানুষটি যদি তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতো, আমিই সেই শিশুর পিতা। আমার ঘরে যার আজ জন্ম হবে। আপনার আনন্দ আমাকে মোহিত করেছে। আপনি আমার সন্তানকে দোয়া করুন, এই শহরের হে সর্বোত্তম মানুষ। রজব জংয়ের বুক ভরে যায়। বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে এলে নিশ্বাস টানেন। পরক্ষণে আবার মন খারাপ হয়। ভাবেন, খবর পাওয়া হবে যদি এই শহরের কেউ হয়। কিন্তু দূরের কেউ হলে আর খবরটি পাওয়া হবে না। দাঁড়িয়ে পড়েন রজব জং। ভাবেন, আসলে তিনি নিজের মনের প্রতিধ্বনি শুনতে পান নদীর তরঙ্গে। এমন একটি অভ্যাস দাঁড়িয়েছে নিজের ভেতরে। তাঁর স্বপ্নের ভেতরে একজন কবির জন্ম তাঁর কাছে সত্যি হয়। আজ রাতে নিশ্চয়ই তাঁর নতুন কিছু লেখা হবে। পাখির পালকের কলমটি দোয়াতের কালিতে চুবিয়ে ভরে ফেলবেন সাদা কাগজের পৃষ্ঠা। 

রোদ উঠেছে। ঝলমল করছে চারদিক। মানুষজন বেরিয়ে এসেছে শহরের রাস্তায়। রজব জংয়ের মনে হয় শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। হাতজোড়া আচকানের পকেটে ঢুকিয়েও কাজ হচ্ছে না। হাঁটুতেও শীতের কাঁপুনি। তাড়াতাড়ি হেঁটে বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করেন। তাঁর চতুর্থ স্ত্রী ভাঙা কড়াইতে ধানের তুষের ওপর কাঠকয়লা জ্বালিয়ে রাখে। বাড়ি ফিরে হাত-পা সেঁকে নিলে বেশ আরাম লাগে। তারপর গরম পানি দিয়ে গোসল করলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায়। 

উৎফুল্ল হতে চাইলেও হঠাৎ করে উৎফুল্ল হতে পারেন না। ভাবেন কার ঘরে শিশুটি জন্মাবে? চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফিরতে থাকেন। পথে দেখা হয় টাঙ্গাওয়ালা ইসমাঈলের সঙ্গে। 

ওস্তাদজী আপনার তরীয়ত কি ঠিক নাই? 

চমকে ওঠেন রজব জং। বলেন, কেন, কেন একথা বলছ? আমার তবীয়ত ঠিক আছে। বিলকুল ঠিক আছে। 

তাহলে কী ভাবছেন? মনে হচ্ছে আপনি গভীর চিন্তায় আছেন? 

হ্যাঁ, ভাবছি। গভীর কিছু ভাবছি। ভাবতে ভাবতে বাড়ি যাচ্ছি। আজ রাতে একটি বাচ্চার জন্ম হবে। 

হা হা করে হাসে ইসমাঈল। হাসতে হাসতে বলে, আমার ঘরে আটটা বাচ্চা জন্মালো, আবার মরেও গেল। আমি টাঙ্গাওয়ালা টাঙ্গাই চালিয়ে যাচ্ছি। আর একটি বাচ্চা জন্মাবে বলে আপনি অস্থির হয়ে গেলেন ওস্তাদজী। 

বিষয়টি তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না ইসমাঈল। 

টাঙ্গায় উঠে বসুন। আমি আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। 

তুমি কখনো দেখেছ যে হাঁটতে বের হলে আমি টাঙ্গায় করে বাড়িতে ফিরি? 

ইসমাঈল লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকিয়ে বলে, না তা দেখি নি। এই আগ্ৰা শহরে আপনার মতো একজনও নেই যে ঝড়-বৃষ্টি ছাড়া হাঁটতে বের হয় না। 

রজব জং খুশি হয়ে বলেন, ঠিক কথা বলেছ। এ জন্যই যমুনা নদী আমাকে এত ভালোবাসে! হা হা হাসিতে নড়ে ওঠে তাঁর শরীর। সাদা চুল এলোমেলো হয়ে যায়। ইসমাঈল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ওস্তাদজী। এখনো আপনার আর একটি শাদি করার বয়স আছে। তওবা, তওবা। কী যে বলো। ধর্ম মতে চারটি বিয়ে আমি করতে পারি। এর বেশি আমি করতে চাই না। 

শরম পাবেন না ওস্তাদজী। এটা কোনো খারাপ কথা নয়। 

রজব জং আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকেন। দেখা হয় খাজা মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনিও কবি। মুশায়রা মাতিয়ে রাখতে পারেন। ভোরবেলা হাঁটতে বের হন। তবে নিয়মিত নয়। যখন ইচ্ছে হয় তখন গজল গাইতে গাইতে পথে হাঁটেন। আজও সেভাবে গুনগুন করতে করতে যাচ্ছিলেন। রজবকে দেখে একগাল হেসে থমকে দাঁড়ান। 

কেমন আছ দোস্ত? রজবকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলতে থাকেন, ভোরবেলা বেরিয়েই মনে হচ্ছে চারদিকে সুবাতাস বইছে। তোমার কি মনে হচ্ছে না যে বাতাসে বাড়তি খুশবু আছে? শ্বাস টান, জোরে জোরে শ্বাস টেনে দেখ। 

রজব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, তোমার হয়েছে কী? আমার?

হ্যাঁ, আমার কী যেন হয়েছে। আমি বাতাসের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে। 

কী বলছে আগ্রা শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া? 

বলছে, আজ রাতে এই শহরে একটি বাচ্চার জন্ম হবে।

বাহ্ বা, বাহ্ বা মারহাবা দোস্ত খাজা মোয়াজ্জেম। 

তোমার খুশির উচ্ছ্বাস দেখে আমার খুবই ভালো লাগছে কবি রজব জং। আমি দেখতে পাচ্ছি আগ্রা শহর জুড়ে খুশির আভা। মানুষজন বেশ সুখে আছে। তোমার কি তাই মনে হচ্ছে? 

তোমার উচ্ছ্বাসের কথা বলো? তুমি কোনো টান অনুভব করছো? যে টান শুধু কবির বুকের মধ্যে থাকে? 

আমাকে যমুনা নদী একটি বাচ্চার জন্মের কথা শুনিয়েছে। বলেছে ও আজ রাতেই আসছে। 

বাহ্ বা, মারহাবা। 

খাজা মোয়াজ্জেম উচ্ছ্বাসে উৎফুল্ল হয়ে রজব জংকে আলিঙ্গন করেন। যেন কতকালের পুরনো এই শহরে তাজমহল নির্মাণের পরে আর একটি কালজয়ী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আবার দু’জনে যে যার পথে হাঁটতে শুরু করেন। 

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভিস্তিওয়ালা বলে, হুজুর, আপনার বাড়িতে আজকে দুই ভিস্তি পানি বেশি দিয়েছি। 

কেন দুই ভিত্তি পানি বেশি লাগবে? বেগম সাহেবারা দিতে বলেছে? 

ছোট বেগম সাহেবা দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আজ আপনার গোসল করতে বেশি পানি লাগবে। আজ আপনি পানিতে ভিজে মনের আনন্দ- 

মনের আনন্দ প্রকাশ করব? তুমি তাই বলতে চাচ্ছো? 

হ্যাঁ, তাই তো বললেন ছোট বেগম সাহেবা। 

আচ্ছা যাও। ছোট বেগম সাহেবা তোমার সঙ্গে একটু বেশি কথা বলেছে। এটা ঠিক হয় নি। 

গোস্তাফী মাফ করবেন হুজুর। আমার মনে হয়েছে আপনার বাড়িতে কোনো খুশির খবর আছে। 

ভিস্তিওয়ালা তাহিরুল্লা খানিকটা চলে যেতেই রজব জং তাকে আবার ডাকেন। ও কাছে এসে দাঁড়াতেই বলেন, তোমার মশকে আর পানি আছে? 

না হুজুর। আমি মশক উজাড় করে সবটুকু ঢেলে দিয়েছি। আজ পানি ঢালতে আমি অনেক খুশি ছিলাম। 

খুশি? কেন? 

জানি না। বলতে পারবো না, কিন্তু মনে হয় আমার যদি দুটো পাখা গজাতো তাহলে পাখির মতো শহরের উপর দিয়ে উড়তাম। আনন্দে গান গাইতাম। আমরা ছোট মানুষ হুজুর, আমাদের কি আনন্দ করার সাধ্য আছে! 

রজব জং আচকানের পকেট হাতড়ে ওকে দুটো তামার মুদ্রা দিতে গেলে ও দু’পা পিছিয়ে বলে, আমার খুশি মুদ্রা দিয়ে বিক্রি হবে না হুজুর। এ খুশি আল্লাহতায়ালার নিয়ামত। যাই। 

রজব জং অবাক হন না। তাহিরুল্লার আচরণ থেকেই তিনি বুঝে যান যে, আজ আগ্রা শহরে খুশির জোয়ার বইছে। তাঁর বেশ ভালোই লাগে। ধীরে সুস্থে গাম্ভীর্য সহকারে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রথমেই দেখা হয় দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে। নিজের ঘর থেকে একগাদা কাপড় নিয়ে বের হয়েছে। বোঝা যায় কাপড় ধোয়ার জন্য চৌবাচ্চার ধারে যাচ্ছে। কারণ ভিস্তিওয়ালা পানি দিয়ে গেছে। রজব জংকে দেখে দাঁড়ায়। 

আপনার কিছু লাগবে? আমি কাপড় ধোয়ার কাজে যাচ্ছি। কোনো কাজে ডাকলে আসতে পারবো না। কোনো কাজ থাকলে এখনই বলুন। 

না, তোমার সঙ্গে আমার কোনো কাজ নাই। তুমি তোমার কাজে যাও। ও হ্যাঁ, শোনো। নাস্তা তৈরি হয়েছে? 

হ্যাঁ, রুটি আর কাবাব বানানো হয়েছে। বাকি হালুয়া, শরবত ওইসব তো আছেই। আরো কিছু থাকতে পারে। খাবার-দাবারের ব্যাপারটা তো বড় বাজী দেখেন। 

বহুৎ আচ্ছা। ভীষণ খিদে পেয়েছে। নাশতাটা ভালো না হলে আজ বাড়ি তোলপাড় করে ফেলবো। 

পারবেন না। 

পারবো না? কেন? 

আপনার চেহারা খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। এমন চেহারায় কারো রাগ মানায় না। আপনি রাগতেও পারবেন না। 

আয়শা আর দাঁড়ায় না। রজব জং তার হনহন করে হেঁটে যাওয়া দেখেন। নিজের ঘরে যান। আচকান খুলে আলনায় ঝুলিয়ে রাখেন। তারপর কান টুপিটা বিছানার ওপর রেখে জুতো খোলার জন্য বসেন। কয়লার মালশা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে চতুর্থ স্ত্রী। পায়ের কাছে নামিয়ে রাখে মালশা। বলে, আপনার পা কি আমি কয়লার ওপরে ধরব? 

ধরো। হিমে পা কুঁকড়ে গেছে। 

বুশরা প্রথমে বাম পা, পরে ডান পা আলতো করে আগুনের ওপর ধরে। এভাবে অদল-বদল করে পা সেঁকার কাজ শেষ হয়। তারপর একটি উঁচু টুলের ওপর লোহার আংটা রেখে মালশা বসিয়ে দিলে রজব জং নিজেই হাত সেঁকে নেন। তারপর বুশরার দিকে তাকিয়ে বলেন, হয়ে গেছে। নিয়ে যাও। গোসলের পানি গরম করা হয়েছে? 

হয়েছে। আমি মশকে পানি দিতে বলছি। 

বুশরা মালশা নিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই রজব জং বেশ আয়েশী ঢঙে প্রতাপশালীর ভাষায় জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমাকে কি খুব ভালোবাসো বিবি? 

বুশরা উত্তর দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে। 

তুমি কথা বলছ না কেন? কবির সামনে কথা বলতে সাহস লাগে না। কথা বলা যায়। বলো, বুশরা বিবি, বলো। 

ভালোবাসা কী তা তো আমি জানি না। বিয়ের পর থেকে দেখতে পাচ্ছি এই বাড়িটা একটা গোয়াল ঘর। এখানে চারটা বিবি খুঁটিতে বাঁধা আছে। আপনার সেবার জন্য তারা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। 

মালশা নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায় বুশরা। রজব জং প্রথমে ভুরু কুঁকচান, তারপর তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন বুশরার কথা। নিজেকেই বলেন, স্ত্রীলোকের কথা শোনা পাপ। ওরা গুনাহগার বান্দা। ওদেরকে মাফ করে দেয়াই উচিত কাজ। আল্লাহ খুশি হবেন। 

প্রথম স্ত্রী জোহরা খাবারের আয়োজন নিজেই দেখে। রান্নাও নিজের হাতে করে। দস্তরখানা বিছিয়ে নানা ধরনের হালুয়া, শরবত এবং রুটি-কাবাব সাজিয়ে অপেক্ষা করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। তৃতীয় স্ত্রী বিন্দা তার লুঙ্গি-গামছা-তেলের শিশি নিয়ে চৌবাচ্চার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রজব জং গোসলের জন্য আঙ্গিনায় নামলেও বুশরার কথাগুলো মনে মনে নাড়াচাড়া করেন। বুশরা বয়সে তার পঁয়ত্রিশ বছরের ছোট। মুখ বেশি চলে— শয়তান মেয়েলোক, রজব জং বিড়বিড় করে গালি দেন। দূর থেকে বিন্দাকে দেখেও মেজাজ ঈষৎ গরম হয়। এই মেয়েলোকটিও কম নয়। যে রাতে ওকে ঘরে ডাকেন সে রাতে ওর প্রথম কথা, আর কোথাও জায়গা না পেয়ে আমাকে ডেকেছেন বুঝি? অন্য বউদের কি মাসিক হয়েছে? মাসিক বিষয়টি বিন্দাই চালু করেছে। বাকিরা এটা নিয়ে রসিকতা করে। রজব জং জানেন তার ওপর রাগ ঝাড়ার জন্য বুশরার ঘনঘন মাসিক হয়। যাহোক। আগে গোসল শেষ হোক। রজব জং আবার স্ত্রীদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। নিজেকে শাসন করে বলেন, মেয়েলোকদের মাথায় রাখা ঠিক না। 

গোসলের জায়গায় পৌঁছালে বিন্দা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, আপনি কিছু চিন্তা করছেন মনে হয়? 

করতেই পারি। তাতে তোমার কী? 

আপনি আমার স্বামী। আপনার জন্য আমার চিন্তা হয়। 

ভালো কথা বলছ দেখি। 

আপনার চুলে তেল দিয়ে দেব? 

দাও। তেল দেয়ার সময় বসতে হবে বলে একটি টুল রাখা আছে। রজব জং টুলে বসেন। তার ঘন সাদা চুলের ভেতর হাত ঢুকে যায় বিন্দার। বেশ আরাম লাগে। বিন্দা তার চাইতে প্রায় পঁচিশ বছরের ছোট। শারীরিক গঠন দারুণ। স্বাস্থ্য ভালো। বিছানায় ক্ষিপ্র। উপভোগের আনন্দ ওর কাছ থেকে বেশি পাওয়া যায়। রজব জং এই মুহূর্তে তেল মাখার আনন্দ উপভোগ করেন। আশেপাশে বাড়ির লোকজন কাজ করছে। ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে- নইলে বিন্দাকে নিয়ে— না থাক। রজব জং নিজেকে সামলান। বিন্দা হাসির মৃদু শব্দ করে বলে, আজ কি কবিতা লিখবেন? 

হ্যাঁ। যমুনা নদীকে নিয়ে লিখবো। যমুনা নদীর কাছ থেকে বার্তা পেয়েছি।

নদী আবার বার্তা পাঠাতে পারে নাকি? যতসব আজগুবী কথা।

হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে বিন্দা। 

হাসির শব্দ বেড়ে গেলে তিনি চিৎকার করে বলেন, খামোশ! চুপ। ক্রোধে ধমক দেন রজব হুসেন জং। মেয়েলোকের এমন হাসি শুনলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বিন্দা অকস্মাৎ চুপ করে যায় ঠিকই, কিন্তু ওর শরীর দুলছে, তার মানে ভেতরে ভেতরে হাসির দমক আছে। এটুকু বুঝেও রজব জং গোসলের জন্য গায়ে পানি ঢালেন। পানি শরীরকে স্নিগ্ধ করে দেয়। ফলে তার রাগ কমে আসে। গোসল শেষ হলে বিন্দা গামছা এগিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবে, বুড়োটার গায়ের রঙ এখনো ভীষণ টকটকে। বয়সের কামড় পড়েনি। গায়ের চামড়া কুচকেছে মাত্র। বিছানাতেও বেশ শক্ত। ভাবতেই বিন্দা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়। স্বামীকে পায়জামাটা সময় মতো এগিয়ে দেয়া হয় না। রজব জং ধমক দিয়ে বলেন, কী হলো? কিসের ভাবনা? 

আপনার কথা ভাবছি। আপনি খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু আপনার দিকে তাকিয়েই থাকি। চোখের পলক যেন পড়তে চায় না। 

পায়জামা পরতে পরতে হাসেন রজব জং। সে হাসি ছাড়িয়ে যায় পুরো বাড়িতে। বাকি তিন স্ত্রী যে যেখানে ছিল হাসির শব্দ কান পেতে শোনে এবং ভুরু কুঁচকে বিন্দার দিকে তাকায়। বিন্দা এমন কী কথা বলল যে স্বামী নামের প্রভুটি এমন জোরে জোরে হাসছে? ওদের হিংসা হয়। হিংসায় ওদের বুক পুড়ে যায়। তারপরও এ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী কখনো কোনো কারণে স্ত্রীদের মধ্যে কলহ হবে না। প্রত্যেকে যার যার ঘরে নীরবে দিন কাটাবে। রজব জং বাড়িতে না থাকলেও মেয়েলোকের উচ্চকণ্ঠ এ বাড়িতে নিষিদ্ধ। তাই জোহরা, আয়শা, বিন্দা এবং বুশরা হাসির ধ্বনিতে গর্জনের আলামত পায়। ওরা স্তব্ধ হয়ে থাকে। 

ওদের বিমূঢ় হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে রজব জং ঘাড় বাঁকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রভুত্বের আনন্দ উপভোগ করেন। ভেতরে প্রবল শ্লাঘার অনুভব। নিজের ঘরে ঢুকে ছোট আয়নার সামনে বসেন। অনেকক্ষণ ধরে চুলে সিঁথি কাটেন। মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে দু’পাশে চুল ছড়িয়ে দেন। বুশরা এভাবে সিঁথি কাটা পছন্দ করে। মাঝে মাঝে নিজেও সিঁথি করে দেয়, কিন্তু আজ ওর মেজাজ খারাপ। ওকে না ডাকাই ভালো, হুকুম দিয়ে এসব কাজ হয় না। রজব জং গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে নাস্তা খেতে আসেন। 

জোহরাকে বলেন, তোমাদের সঙ্গে আমার কথা আছে। ওদের সবাইকে ডাকো। জোহরা কাজের লোককে হুকুম না দিয়ে নিজেই উঠে গিয়ে তিন সতীনকে ডেকে আনে। প্রত্যেকে এসে দস্তরখানার সামনে বসে। 

আয়শার জিজ্ঞাসা, আমাদেরকে ডেকেছেন? 

রজব জংয়ের মুখে কাবাব আর রুটি। ধীরে সুস্থে চিবুচ্ছেন। তাই হাত উঁচু করে ইশারায় বলেন, বোস। স্ত্রীদের বসিয়ে রেখে বেশ অনেকক্ষণ ধরে রুটি- কাবাব চিবিয়ে শেষ করেন। বুশরা বলে, আপনার দাঁতে কি ব্যথা আছে? গোশত চিবাতে কষ্ট হয়? 

খামোশ। বেশি কথা বলবে না। 

আমরা আপনার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছি। 

তার দরকার নেই। আমার স্বাস্থ্যের জন্য বদরুদ্দিন হেকিম আছে। প্রয়োজনীয় দাওয়াই সে-ই দেয়। তোমাদের মনে থাকা উচিত। হেকিম ছাড়া স্বাস্থ্যের ভালোমন্দ আর কে বুঝবে? আমি নিজেও বুঝি। বুঝি বলেই তো আমার স্বাস্থ্য এমন টানটান। 

কেউ কথা বলে না। রজব জং একবাটি বুটের ডালের হালুয়া খান। জোহরা ভাবে, বুড়োটা খাওয়ার যম। যৌবনকালে যেমন খেতো এখনো তেমন চালিয়ে যাচ্ছেন। হজমও হয়। পেট খারাপ হতে দেখা যায় না। হালুয়া শেষ করে এক গ্লাস কিশমিশ-শরবত খেয়ে বলেন, তোমাদের কাছে একটা খবর জানতে চাই। কারণ তোমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন বাড়ির অন্দরমহলে যাও। 

কী খবর বলুন? 

আজ রাতে বাচ্চা হবে এমন কোনো গর্ভবতী নারীর খবর কি তোমাদের কাছে আছে? 

চারজনই চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবে। তারপর বিন্দার ঠোঁটে মৃদু হাসি ভেসে ওঠে। জোহরা মাথা নেড়ে বলে, আমার জানামতে তেমন কেউ নাই। আমার বয়স হয়েছে। আমি যাদের কাছে যাই তদের কারোই গর্ভ হওয়ার বয়স নাই। সবার মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। 

ও আচ্ছা। রজব জং মাথা নেড়ে আয়শার দিকে তাকান। আয়শা ভুরু কুঁচকে বলে, আমি দুজনকে জানি। কিন্তু দুজনের কারোই আজ রাতে বাচ্চা হবে না। এখনো তিন চার মাস দেরি আছে। 

হুঁ। রজব জং বিন্দার দিকে তাকানোর আগেই বুশরা তড়বড় করে তিক্ত কণ্ঠে বলে, আমি কারো গর্ভের খবর রাখি না। গর্ভবর্তী কারো দিকে তাকাতে আমার গা রি-রি করে। 

কেন, তুমি মা হতে পারো নি বলে? 

বিন্দা ঠেস দিয়ে কথা বলে। আমিও তো মা হতে পারিনি। তাই বলে আমি অন্যের গর্ভকে হিংসা করি না। ওটা গুণাহর কাজ। 

রজব জংয়ের ঠোঁটে তখন শরবতের গ্লাস। জোহরা ও আয়শার ঠোঁটে মৃদু হাসি। ওদের দিকে তাকিয়ে বুশরা হিংস্র কণ্ঠে বলে, আপনাদের হাসি দেখে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। আগ্রা শহরে কার কার পেট বেধেছে সেইসব হিসেব আমাদের রাখতে হবে নাকি? আমাদের আর কোনো কাজ নাই। 

খামোশ! রজব জং দস্তরখানার ওপর ঠক করে গ্লাস রাখেন। বুশরার দিকে তর্জনী তুলে বলে, তুমি এখন যাও। 

বুশরা উঠতে দেরি করলে চিৎকার করে বলেন, যাও বলছি, যাও এক্ষুণি।

বুশরা চলে গেলে রজব জং বিন্দার দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার কাছে কোনো খবর আছে? 

আছে। আমার বান্ধবী, আবদুল্লাহ বেগ খাঁয়ের স্ত্রী আমাকে বলেছে, দু’একদিনের মধ্যে ওর প্রসব হতে পারে। বলেছে যে কোনো সময় ব্যথা উঠতে পারে। 

রজব জং খুশিতে মাথা নেড়ে বলে, আবদুল্লাহকে আমি চিনি। ও তো খাজা গোলাম হুসেন খাঁর মেয়েকে বিয়ে করেছে। গোলাম হুসেন আগ্রার অভিজাতদের একজন। আবদুল্লাহকে ঘরজামাই করেছে গোলাম হুসেন খাঁ বেশ কথা। বাচ্চাটি নানার বাড়িতে জন্ম নেবে। 

আজ রাতে আমার বান্ধবীর প্রসব নাও হতে পারে। 

হতেও পারে। সবই খোদাতালার ইচ্ছা। তিনিই জানেন তিনি কী করবেন। আজ একটি পবিত্র রাত। 

আপনার কাছে মনে হচ্ছে কেন আজ পবিত্র রাত? 

মনে হওয়ার কারণ আছে। এখনই বলবো না। তোমরা সব সময় কবির মনের কথা বুঝবে না। কবির মনে স্বপ্ন থাকে, নতুন চিন্তা থাকে। কবি নদীর যে কথা বুঝতে পারে, সাধারণ মানুষ তা পারে না। কবি ফুলের যে শোভা দেখতে পায় সাধারণ মানুষ তা পায় না। 

বিন্দা হেসে বলে, তাহলে কবিই কি সবার উঁচুতে? আর কেউ নাই? মানুষের চিন্তার কি শেষ আছে? মানুষের উচ্চতা মাপার সাধ্য মানুষের আছে? 

রজব জং গরম চোখে তাকান বিন্দার দিকে। 

আমার খাওয়া শেষ হয়েছে। তোমরা এখন যাও। 

রজব জং নিজের ঘরে ঢুকে লেখার টেবিলে বসেন। যমুনা নদীকে নিয়ে কবিতা লিখে নিজের খাতার পৃষ্ঠা ভরান। তুমিই আমার প্রেমিকা যমুনা। তুমিই একের ভেতর অনেক। নতুন নতুনরূপে অপরূপ হয়ে ভরে দাও আমার হৃদয়। তুমিই সত্যি প্রিয় নদী। তুমিই তুমি। 

কয়েকটি কবিতা লেখার পর অস্থির হয়ে ওঠেন রজব জং। কবিতায় মন বসে না। ঘরে পায়চারী করেন। এক সময় বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। ভাবেন, আবদুল্লাহ বেগ খাঁয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসবেন। যদিও লোকটি চাকরি করে। কবিতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাতে কী, লোকটি সজ্জন। ভাবতে ভাবতে রজব জং টাঙ্গায় উঠে গোলাম হুসেনের বাড়িতে আসেন। 

বেশ বড় বাড়ি। বিশাল গেট। দারোয়ান তাকে দেখে সালাম দেয়। রজব জং মৃদু হেসে সালামের জবাব দিয়ে বলেন, তোমার হুজুর বাড়িতে আছে? 

হুজুর দিল্লি গিয়েছেন। 

হুজুরের জামাই কোথায়? আবদুল্লাহ বেগ? 

তিনি আলোয়ারে। দু’একদিনের মধ্যে আসবেন। হুজুরও দু’একদিনের মধ্যে চলে আসবেন। আপনার শরীর ভালো তো জনাব? 

খোদার মেহেরবানি। ভালোই আছি। 

শীতটা খুব জাঁকিয়ে পড়েছে। 

রজব জং ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। সামনে টাঙ্গা ডেকে উঠে পড়েন। বাড়ি ফিরে চুপচাপ বসে থাকেন। ভাবেন দুপুরের ঘুমটি গেল। সকালে নদীর যে কণ্ঠস্বর তার মাথায় ভর করেছে সে উত্তেজনা তাঁকে প্রবলভাবে সক্রিয় রেখেছে। দুপুরের খাওয়াও ঠিক মতো হলো না। বিকেল হওয়ার আগেই বিন্দাকে বললেন, তোমার বান্ধবীর খবর আনতে যাও। 

খবর! খুশির খবর হলে আমি কি উপহার পাব? 

কী চাও? কী পেলে তুমি খুশি হবে? 

বাব্বা, আমার খুশির এত দাম! আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। বিন্দা শব্দ করে হাসে। 

এত জোরে হাসার কিছু হয় নি। তুমি কী চাও তা আমায় বলো। 

জরি বসানো ঘাঘরা চাই। আমি ময়ূরের মতো পেখম তুলে এই বাড়িতে ঘুরে বেড়াবো। সেই দৃশ্য দেখে আপনি একটি নতুন কবিতা লিখবেন। 

নতুন কবিতা? হ্যাঁ, ভালোবাসার কবিতা লিখবো। 

বাহ, বেশ মজা। তাহলে নতুন কবিতার জন্য আমি আর একটি ঘাঘরা কি পেতে পারি? 

না, সেটা তুমি পেতে পারো না। কবিতার জন্য ঘাঘরা চাইলে কবিতার অসম্মান হয়। 

বেশ চাইবো না। খুশির খবরের জন্য পাব না? 

পাবে। 

জরি বসানো ঘাঘরা কিন্তু। 

বেশ তাই দেবো। 

বিন্দার খুশির খবর শুনে অন্যদের মুখ কালো হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলে না। শুধু বাঁকা চোখে দেখে যে বিন্দা অনেকক্ষণ ধরে সেজেগুজে বাড়িতে ডেকে আনা টাঙ্গায় উঠে বান্ধবীর বাড়িতে যায়। রজব জং টাঙ্গাওয়ালাকে হুকুম দিয়েছে যে বিন্দা যতক্ষণ ওই বাড়িতে থাকবে সে ততক্ষণ অপেক্ষা করবে। অন্য কোনো যাত্রী বহন করতে পারবে না। বিন্দার জন্য এটিও একটি বড় সম্মান। ফলে সতীনদের বুক আরেক দফা পুড়তে থাকে। 

সন্ধ্যার পরে উৎফুল্ল চিত্তে ফিরে আসে বিন্দা। বলে, আপনার ধারণাই বোধহয় সত্যি হবে। প্রসব ব্যথা উঠেছে আমার বান্ধবীর। মনে হয় আজ রাতেই বাচ্চাটি হয়ে যাবে। 

তোমার কি ওর কাছে থাকার দরকার ছিল? 

না, না ওদের অনেক আয়োজন আছে। ওদের মেয়ের প্রথম বাচ্চা হবে। ধাত্রী মা আনা হয়েছে তিনজন। আত্মীয়স্বজন তো আছেই। অভিজাত পরিবারের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। নিজের ঘরে যেতে যেতে বলে, আমার উপহারের কথা আপনার মনে থাকে যেন। 

রজব জং উত্তর দেন না। স্ত্রীদের এত বায়না তার খুব অপছন্দ। মাঝে মাঝে মেজাজ বিগড়ে যায়। তবে আজ একটি সুখবরের অপেক্ষায় আছেন বলে তাঁর ভেতরে ক্রোধ জন্মায় না। রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার চিন্তা করেন। একই সঙ্গে ভাবেন, আজ বিছানায় বিন্দাকে চাই। বিন্দাকে ঘরে ডেকে সে কথা বলতেই বিন্দা আনন্দে মাথা নেড়ে সায় দেয়। 

রাতের খাবার ভাড়াতাড়ি খেয়ে নিও। 

তাড়াতাড়ি তো খেতে পারব না। জোহরা বাজীর নিয়ম সবাইকে এক সঙ্গে খেতে হবে। 

আমার হুকুম- 

হুকুমে কাজ হবে না। তাহলে রান্নাঘরে তালা পড়বে। আপনি কারো গলা শুনবেন না, কিন্তু নীরব যুদ্ধ চলবে। তার চেয়ে ভালো আমি রাতে খাব না। বলব, শরীর খারাপ, খেতে ভালো লাগছে না। আমি ঘুমুতে গেলাম। 

তোমার খিদে পাবে না? 

পাবে তো। পেলে আর কী করব। সহ্য করে থাকবো। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, আপনার বয়সটা যদি আর একটু কম হতো। তাহলে বিছানা যমুনা নদী হয়ে যেত। দুজনে সাঁতার দিয়ে পার হয়ে যেতাম। এখন যুৎ লাগে না। 

স্বামীর কাছ থেকে কোনো কটু কথা শোনার আগেই ও দ্রুতপায়ে সরে পড়ে। রজব জং মন খারাপ করেন। তারপর রাগ ঝেড়ে নিয়ে ভাবেন, মেয়েলোকেরা বুঝতে পারে না যে কোন কথায় খসমের মন খুশি থাকবে, কোন কথায় থাকবেন না। মেয়েলোকদের খসম ছাড়া আর গতি কী। তারপর আবার বড় কথা। বড় কথা ওদের মানায় না। ওরা সন্তান পয়দা করবে বংশ রক্ষার জন্য। ওদের দায়িত্ব ওইটুকুই। ওরা রান্না করবে। সবার থালায় ভাত দেবে- স্বামী এবং সন্তানকে। রান্নাঘরে থাকা ওদের দায়িত্ব। বড় কথা ওদের মুখে শোভা পায় না। যারা বলে তারা বেতমীজ মেয়েলোক। এই জীবনটা ওদের নিয়েই কাটাতে হলো। আসলে উচিত ছিল তালাক দিয়ে এক একটিকে বাপের বাড়িতে ফেরত পাঠানো। তিনি তা করেন নি। শহরের সম্মানিত সজ্জন ব্যক্তি বলে করেননি। কিন্তু মেয়েলোকেরা এসব কিছু অনেক সময় বুঝতে পারে না।

গজগজ করেন রজব হুসেন জং। তবে রাতটা দারুণ কাটে। নিজের ভেতরে নতুন শক্তি অনুভব করেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই হাঁটার জন্য বেরিয়ে পড়েন। আজও যমুনার প্রবাহে খুশির ধ্বনি শুনতে পান তিনি। সূর্য ওঠার আগেই হাঁটতে হাঁটতে খাজা গোলাম হুসেনের বাড়ির সামনে দিয়ে একটি চক্কর দেন। দ্বিতীয় চক্কর দেয়ার সময় দারোয়ানের সামনে পড়েন। ও একগাল হেসে বলে, কেমন আছেন হুজুর? হাঁটতে বেরিয়েছেন বুঝি? 

হ্যাঁ, তাই তো। আমি তো রোজই হাঁটি’। তোমাদের কি খবর? বাড়িতে ভালো আছে সবাই? 

হ্যাঁ, সবাই ভালো আছেন। আমাদের জন্য খুশির খবর হয়েছে হুজুর। আমাদের হুজুর নানা হয়েছেন। পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। মা আর ছেলে ভালো আছে বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, আমরা যেন সব অতিথিদের খবরটি দেই। একটু পরে আমার কাছে এক ডালা মিষ্টি পাঠানো হবে অতিথিদের জন্য। হুজুর আপনি যদি একটু বসতেন? 

না, না, আমি এখন আর বসবো না। তবে খবর শুনে খুবই খুশি হয়েছি। দোয়া করি বাচ্চা যেন সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। আবদুল্লাহ বেগ খাঁ ভাগ্যবান ব্যক্তি। ও আলোয়ার থেকে এলে আমি ওর সঙ্গে দেখা করবো। আচ্ছা যাই। 

সেলাম হুজুর। 

ফিরতে ফিরতে রজব জংয়ের মনে হয় আজ তাঁর ইচ্ছে করছে পায়ে হেঁটে আগ্রা শহর প্রদক্ষিণ করতে। ঘরে ঘরে গিয়ে বলতে হবে, শিশুটির জন্ম হয়েছে। ও কবিতার দুনিয়া জয় করবে। ও সময়কে অতিক্রম করবে। ওর কবিতা শতাব্দী অতিক্রম করবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে। হাঃ, আগ্রাবাসী আমাদের আগ্রা টিকে থাকবে আগামী দিনের কবির কবিতায়। তোমরা তাঁর জন্য জয়ধ্বনি করো। 

.

ছেলেটির নাম রাখা হয় মির্জা নওশা নজমুদদৌলা দবীরুল মুল্ক আসাদুল্লাহ খাঁ বাহাদুর নিজামে জং। আদর করে সবাই মির্জা নওশা বলে ডাকে। 

ধুমধাম করে আকিকা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে খাজা গুলাম হুসেন। নিমন্ত্রিত হয় রজব জংয়ের পরিবার। বিন্দা ঘোষণা দিয়েছে নতুন ঘাঘরা ছাড়া অনুষ্ঠানে যাবে না সে। অন্য তিনজনও ঘোষণা দেয়, বিন্দা অনুষ্ঠানে নতুন ঘাঘরা পরে যাবে, আর আমরা পুরনোটা পরব তা হবে না। 

বিন্দা আঙুল উঁচিয়ে বলে, আমি একটি খুশির খবর এনে দিয়েছি বলে আমি উপহার হিসেবে একটি ঘাঘরা পাব। তোমরা তো তা পাবে না। 

উপহার পাও আর যা পাও, আকিকা অনুষ্ঠানে তুমি নতুন ঘাঘরা পরে যেতে পারবে না। 

বিন্দা রজব জংয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। 

আমার উপহার দিবেন না? 

দেব। কিন্তু কখন দেব আমি কিন্তু তোমাকে তা বলিনি। আমার সময় সুযোগ মতো দেব। যখন খুশি তখন দেব। তোমার সময়মতো দেবো না। এটা তোমাকে মনে রাখতে হবে। 

আপনি কিন্তু কবির মতো কথা বললেন না। আমার সঙ্গে চালাকি করলেন।

কী, এতবড় কথা। 

তাহলে কি দিবেন না? 

রজব হুসেন জং বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর চেঁচিয়ে বলেন, মেয়েলোকদের প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠে। এ জন্য মেয়েলোকদের পায়ের নিচে রাখতে হয়। 

এভাবে কথা বলবেন না। আপনি কী- 

তুমি আমাকে শিক্ষা দিচ্ছো? যাও এখান থেকে, যাও যাও বলছি। 

চলে যায় বিন্দা। বাড়ি থমথম করে। কাজের লোকেরা যে যার মতো নীরবে কাজ করে। কারো মুখে কথা নেই। আকিকা অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুশায়রার আয়োজন করেছে গোলাম হুসেন। তার জন্য অনেকগুলো কবিতা লিখতে হবে। গুলাম হুসেন বলেছেন, আপনাকে আমি সবার উপরে দেখতে চাই। পারবেন তো? তীয়ত ঠিক আছে তো? এখন তো বয়সটাই শত্রু। হা-হা করে হেসে কথাগুলো বলেছিলেন গুলাম হুসেন। তার বয়সও কম নয়। রজব জংয়ের কাছাকাছি হবে। দু’এক বছর ছোট হলেও হতে পারে। রজব জং আরাম কেদারায় বসে মাথাটা এলিয়ে দেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। বাড়ির প্রাচীরের ওপরে লতিয়ে আছে ফুলের লতা। গোলাপি ফুলে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। আহ, জীবনটা ভীষণ সুখেই কেটেছে। দুঃখ তাঁকে ঘায়েল করতে পারে না। আরাম কেদারায় দু’চোখ বুজে রেখে সময় উপভোগ করেন রজব জং। বুঝতে পারেন তাঁর ভেতরটা তৈরি হচ্ছে। আজ রাতে লিখতে পারবেন। রজব জং চোখ বুজেই থাকেন। মনে মনে বলেন, খোদা মেহেরবান। সে রাতে খেয়েদেয়ে ঘরে আর কোনো স্ত্রীকে ডাকার ইচ্ছে হয় না। আজ রাত তাঁর একার। এভাবে কোনো কোনো রাতে কবিতা তাঁকে একা করে ফেলে। তখন এক অদ্ভুত সময় তাঁকে ঘিরে রাখে— যেন অন্ধকারই আপন, অন্ধকারই দুনিয়া। অন্ধকারই আলো তাঁর কাছে। আলো-অন্ধকারে উল্টাপাল্টা এ সময়ই তাঁর ভেতরে জ্বলে-নেভে। বাতাসে মোমের শিখা নড়লে অন্ধকারের আঁকিবুকি তৈরি হয় কাগজের ওপর- তাঁর পাখির পালকের কলম দ্রুত চলে। কলম কালির দোয়াতের মধ্যে ডোবে আর ওঠে। এমন দুনিয়াই তো নিজে গড়েছে একজন কবি। খোদাতালার মেহেরবানি যে আমার জ্ঞানীগুণীরা বলেন, এ সময়ের সবচেয়ে বড় কবি রজব জং। আগ্রার মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছেন। এসব কথা শুনলে জীবন ধন্য হয়ে যায়। রজব জং রাতের আকাশে নিজের চেহারা দেখতে পান। 

আকিকা অনুষ্ঠানের রাতে মুশায়রায় মাতিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় আবদুল্লাহ বেগ খাঁয়ের হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি ভাগ্যবান পিতা। ছেলেটি একটা কিছু হবে। বড় কিছু। ইতিহাসে ওর নাম থাকবে। 

আপনি দোয়া করুন ওস্তাদজী। পুত্রটিকে যেন আমি বড় কাজের যোগ্য করে তুলতে পারি। আমি নিজে একজন সৈনিক। আমার ছেলেও সে রকম কিছু হবে বলে মনে করি। আমি চাই ও হিন্দুস্তানের সম্রাট হবে। 

সম্রাট! রজব জং বিস্ময়ে একজন নতুন পিতার স্বপ্নের কথা শোনেন। 

অবাক হচ্ছেন কেন ওস্তাদজী? সৈনিকের ছেলে লড়াই করে ক্ষমতা দখল করবে। লড়াই ছাড়া সৈনিকের তেজ থাকে না। তেজ না থাকলে রক্ত গরম থাকে না। একটি দেশের জন্য সৈনিকই সবচেয়ে বড় শক্তি। 

আমার তা মনে হয় না। রজব জং শীতল কণ্ঠে বলেন। 

আপনার কী মনে হয়? 

আমার মনে হয় দেশের জন্য কবিই সবচেয়ে বড় শক্তি কবি! হা-হা করে হাসে আবদুল্লাহ বেগ খাঁ। 

রজব জং কিছুটা রাগত স্বরে বলে, হেসো না আবদুল্লাহ, কবিই মানুষকে ভালোবাসা শেখায়। কবিই দেশকে ভালোবাসতে বলে। কবি ছাড়া মানুষের আত্মার মুক্তি নাই। সৈনিক চেনে রক্ত। কবি চেনে হৃদয়। কোনটা উত্তম আবদুল্লাহ? 

দুটোই। আবদুল্লাহ বেগ খাঁকে একটুখানি চিন্তিত দেখায়। তারপর বলে, মানুষের সবটুকুই মানুষের জন্য প্রয়োজন। এখানে উত্তম বা নিচ বলে কিছু নেই। তবে সৈনিকের জীবন অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। আমি আপনাকে আমাদের পূর্বপুরুষের হিন্দুস্তানে আসার কাহিনী শোনাবো। 

তোমার কথায় আমি খুশি হয়েছি আবদুল্লাহ। তুমি তো বেশ ভাবুক লোক। শুধুই সৈনিক নও। 

এবার হা-হা করে হাসেন রজব জং। আবদুল্লাহ ঈষৎ অবাক হয়ে বলে, আমার কিছু ভুল হলে মাফ করবেন ওস্তাদজী। 

না, কিছু ভুল হয়নি। তুমি তোমার পরিবারের কথা বলো। আমি জানি তোমার পূর্বপুরুষরা তুর্কী। 

আমার পূর্বপুরুষরা ঐবক জাতির তুর্কী ছিলেন। 

ঐবক শব্দটি বুঝিয়ে বলো! কবি মানুষ তো শব্দের অর্থ না জানলে জানতে খুব ইচ্ছা করে। 

ঐবক তুর্কী শব্দ। ‘আয়’ এবং ‘বক’ শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে ঐবক। তুর্কী ভাষায় ‘আয়’ শব্দের অর্থ চাঁদ এবং ‘বক’ শব্দের অর্থ পূর্ণ। পুরো মানেটি হলো —শ্ৰেষ্ঠ পুণ্যাত্মা।’ 

বাহ্ বেশ সুন্দর ব্যাখ্যা। 

আমি দাদাদের কাছে জেনেছি যখন ইরান ও তুরানে কিয়ানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন তুরানীদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অনেকদিন পর্যন্ত তুর্কীরা শাসন ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত থেকে বঞ্চিত থাকে। তবে একটা দারুণ কথা কি জানেন ওস্তাদজী, তুর্কীরা কিন্তু কখনো তলোয়ার হাত ছাড়া করেনি। 

তলোয়ার তো শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। রজব জং মাথা নাড়িয়ে সায় দেন। 

প্রাচীনকাল থেকেই তুর্কীদের মধ্যে একটি রীতি চালু ছিল। যেমন পিতা যে সম্পত্তি রেখে যেতেন তার থেকে পুত্র তলোয়ার ছাড়া অন্যকিছু পেতো না। পুরো সম্পত্তি এবং ঘরবাড়ি সব মেয়েরা পেতো। 

বাহবা, তাই বলো। রজব জং আবদুল্লাহর কাহিনী শোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

সে জন্যই বলছিলাম আমার ছেলে তো পিতার তলোয়ার পাবে। তলোয়ার দিয়ে জয় করবে হিন্দুস্থান। 

আবার ধ্বনিত হয় আবদুল্লাহর ঘর ফাটানো হাসি। হাসে রজব জংও। তলোয়ারের গল্পে সে নিজেও খুব উৎফুল্ল বোধ করে বলে, তারপর কী হলো? 

ইতিহাস তো অনেক লম্বা ওস্তাদজী। দীর্ঘ সময় পরে ইসলামের যুগে ওই তলোয়ারের বদৌলতে তুর্কীদের ভাগ্য আবার ফেরে। সলজুকী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কয়েকশ বছর ধরে তারা ইরান, তুরান, শাস ও রোম, এক কথায় কুচক এশিয়া শাসন করে। এক যুগ পরে সলজুকী শাসনের শেষ হলে সেই বংশের সন্তানেরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদের মধ্যে ছিলেন তুরসম খাঁ, ধনী পুত্রদের একজন। তিনি সমরকন্দে বাস করতে থাকেন। এই তুরসম খায়ের সন্তানদের একজন ছিলেন আমার দাদার বাবা। তিনি সমরকন্দ থেকে হিন্দুস্তানে আসেন। তুর্কীস্তানের এলাকার প্রধান শহর ছিল সমরকন্দ। এলাকাটি ছিল তুর্কীস্তানের জৈহুন নদীর ওপারে। একটি বড় কাফেলা সমরকন্দ থেকে হিন্দুস্তানে এমনভাবে আসতে থাকে যে তখন যে কেউ মনে করতে পারবে একটি নদী বুঝি নিচের দিকে বয়ে যাচ্ছে। 

বাহ্, তুমি দেখছি কবির মতো কথা বলছ আবদুল্লাহ। আমার তো মনে হয় তোমার ছেলে কবিও হতে পারে। 

কবি। আবদুল্লাহর ভুরু কুঁচকে যায়। 

রজব জং সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলেন, হ্যাঁ আবদুল্লাহ কবি, কবি। কবিই তামাম দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধন। কবিই তো পারে মানুষের হৃদয়ে ঢুকতে। 

ওস্তাদজী আমি সেই জন্য আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি প্রতিদিন যমুনা নদীর পাড়ে হাঁটতে যান। আপনাকে দেখতে পাই তাজমহলের সামনে বসে থাকতে। আপনাকে দেখতে পাই আগ্রার সাধারণ মানুষের সঙ্গে গল্প করতে। আপনিই তো আগ্রার যোগ্য বাসিন্দা। তবে আমার ছেলে কবি হবে কিনা কে জানে। 

হতেও তো পারে। আল্লাহ মেহেরবান। 

হ্যাঁ, হতেও পারে। আবদুল্লাহও একই ভঙ্গিতে বলে। তার সন্তানের জন্মের পরে আগ্রার একজন বয়সী কবির এমন উচ্ছ্বাস তাকে অভিভূত করে। আবদুল্লাহর মনে হয় রজব জংয়ের চেহারায় আলোর আভা। যেন আকাশের একটি তারা নেমে এসেছে তার কপালে। সেখান থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আগ্রা। একমাত্র খোদাতালাই তো এমন আভায় ভরিয়ে দিতে পারে মানুষের জীবন। সত্যি কি তার ছেলে এমন গৌরবের অধিকারী হবে? আবদুল্লাহ দ্বিধায়-দ্বন্দ্বে শিহরিত হয়। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বলে, আমার বাবার ভাষা ছিল তুর্কী। তিনি হিন্দুস্তানের ভাষা বুঝতে পারতেন না। তবে আমার বাবা খুব বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। কাজেও পারদর্শী ছিলেন। সে যুগে শাহ আলমের দরবারের জুলফিকারদৌলা মীর্জা নজক খাঁয়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। প্রতিপত্তি দেখাতেও কম যেত না। তিনি আমার বাবাকে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি দিয়েছিলেন। পরে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেন। বাবাকে পহাসুর পরগনাটিও দিয়েছিলেন। আমি বড় হলে লক্ষ্ণৌ যাই। সেখানে আমি নবাব আসাফুদ্দৌলার কাছে চাকরি পাই। কয়েক মাস পরে আমাকে ওখান থেকে হায়দরাবাদে পাঠানো হয়। ওখানে আমি তিনশ ঘোড়ার অধিনায়কের পদে চাকরি করি। বেশ ছিলাম। টগবগে ঘোড়াগুলো আমাকে যে কেমন করে দিত বলতে পারবো না। ওগুলোর কপালে ছিল রাজটিকা। ওদের ক্ষুরে ছিল সঙ্গীতের ধ্বনি। ওস্তাদজী ওই প্রাণীগুলো আমাকে চিত্তের স্বাধীনতা দিতো। কল্পনার গতি দিত। আমার ফৌজী জীবনের যে সময় আমি ওখানে কাটিয়েছিলাম আমার মুগ্ধতার শেষ ছিল না। এ জন্য আমি খোদাতালার কাছে শুকরিয়া জানাই। তিনি আমাকে বেঁচে থাকার বৈচিত্র্যের স্বাদ দিয়েছিলেন। ওস্তাদজী ঘোড়া যে মানুষকে অন্যরকম করে দিতে পারে আমি তখন তা বুঝেছিলাম। 

সেই চাকরি ছেড়ে চলে এলে যে? 

ষড়যন্ত্র। ফৌজী জীবনের ষড়যন্ত্র খুব কঠিন ওস্তাদজী। কেউ যদি আর একজনকে ডিঙিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতে চায় তাহলে সেসব কলহ করে টিকে থাকা কঠিন হয়। আমিও সেই রকম কলহে টিকতে পারিনি। চাকরি হারিয়ে আগ্রায় চলে যাই আসি। 

তোমার শ্বশুরও তো বেশ জাঁদরেল ফৌজী অফিসার। আমি অবশ্য তাকে অনেক আগে থেকে চিনি। তোমার ব্যাপারে তিনি তো কিছু করতে পারতেন। 

আবদুল্লাহ মাথা নাড়ে। এর দ্বারা শ্বশুর সম্পর্কে তার মনোভাবের কিছুই বোঝা যায় না। বলে, আমি এখন আলোয়ারে ভালোই আছি। রাজা বখতার সিং আমাকে আমার মনমতো চাকরি দেন নি। তবে আমি মনে করি একদিন আমার এই অবস্থা কেটে যাবে। আমি উঁচু জায়গায় উঠতে পারব। শ্বশুরের সাহায্য দরকার হবে না। আপনারও কি তেমন মনে হয় না যে মানুষই তার চেষ্টায় নিজের জায়গা তৈরি করতে পারে? অন্যের সাহায্যের খুব একটা দরকার হয় না? 

হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। নিজের চেষ্টাই প্রথম কাজ। আমাদের নবীজী ভিক্ষুকের হাতে কুঠার তুলে দিয়েছিলেন। 

আমার বিশ্বাস আমি ভবিষ্যতে বড় একজন ফৌজী অফিসার হবো। যদি আল্লাহতালা আমার ভাগ্যে তেমনটি লিখে থাকেন। আমার জন্য দোয়া করবেন ওস্তাদজী। 

আল্লাহ তোমার সহায় হোন আবদুল্লাহ। তুমি আলোয়ারে কবে ফিরছ? 

সাতদিন পরে যাব। আমার ছেলেকে আমি এখনো ঠিকমতো কোলে নিতে পারি নি। ওকে কোলে নিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমু দিয়ে তবেই যাব। ছেলের গায়ের উষ্ণতা কী সেটাই তো বুঝি নি ওস্তাদজী। 

মাশআল্লাহ। তোমার ছেলের জন্যও দোয়া করি। তোমার ভাই নসরুল্লাহ কেমন আছে? 

আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছে ওস্তাদজী। 

আজ তাহলে আসি। তোমার শ্বশুরকে আমার সালাম দিও। বড় ভালো লাগলো তোমার কথা শুনে। এটাও আল্লাহর মেহেরবানি, যে সময়টা তোমার সঙ্গে কাটালাম তা আনন্দে ভরে উঠেছিল। বিদায়। 

বিদায় ওস্তাদজী। আপনি যে একটি চমৎকার মুশায়রা উপহার দিয়েছেন সে জন্য আপনাকে শুকরিয়া। 

.

দিনে দিনে বড় হয় ছোট শিশু। 

রজব জংয়ের প্রবল আগ্রহ শিশুটিকে নিয়ে। শিশুটিকে দেখার ইচ্ছা হয় – ওর হাসি দেখতে ইচ্ছে হয়। মসৃণ ত্বকে তেল মাখিয়ে ত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠলে তার মনে হবে এই বুঝি জীবনের অপূর্ব সময়। এই অপূর্ব সময় তার জীবনে হয়েছিল। কিন্তু কোনো পুত্র সন্তান নেই। হঠাৎ করে দুঃখ তাঁকে প্লাবিত করে। পরক্ষণে সেটা আবার কাটিয়ে ওঠেন। নিজেকেই বলেন, অনেক হয়েছে। যে বয়সে পৌঁছছে সে বয়সের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই দুঃখ করা উচিৎ নয়। বরং জন্ম নেয়া শিশুটির কথা ভেবে সময়কে ভরে তোলাই উচিত। বিন্দাকে নতুন ঘাঘরা কিনে দিয়ে তাকে লাগানো হয়েছে বান্ধবীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে বাচ্চাটির খোঁজখবর করার জন্যে। কাজটি বিন্দা ভালোই করছে। যখন এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে নানা কথা বলে তখন রজব জং হাঁ করে শোনেন। 

আজ ও দুই ঝিনুক দুধ ফেলে দিয়েছে। গিলেনি। আমার বান্ধবী তো খুব মন খারাপ করল। বললাম, দুই ঝিনুক দুধ ফেলে দিয়েছে তো কী হয়েছে, যেটুকু খেয়েছে তাতেই ওর পেট ভরে গেছে। তোমার ছেলে, মাশআল্লাহ বেশ সুন্দর হয়ে বড় হচ্ছে। দেখবে তোমার ছেলের জন্য বিবি পছন্দ করতে গিয়ে তোমার মাথা গরম হয়ে যাবে। এত মেয়ের বাবা আসবে যে তুমি ভাবতে পারবে না কাকে ছেড়ে কাকে পছন্দ করবে। আমার কথা শুনলে আমার বান্ধবী খুব মজা পায়। আমি এত সুন্দর ছেলে আগ্রায় দেখিনি। জোয়ান বয়সে ও খুবসুরুত আদমি হবে। 

এমন নানা কথা বিন্দার কাছ থেকে শোনা হয় বলে দিনের অনেকটা সময় বিন্দার সঙ্গে কাটে। বিন্দা বলেও সুন্দর করে। বাচ্চাটির হাত-পা নাড়া, হাসি- কান্না, দুধ-পানি খাওয়া, ঘুমিয়ে থাকা ইত্যাদি নানা কিছুর বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে শোনেন রজব জং। তবে বাড়ির চার নারী বুঝতে পারে না যে অন্যের সন্তান নিয়ে তাদের স্বামীর এত আগ্রহ কেন? রহস্যটা কী? আগ্রায় কত মানুষের সন্তান জন্মায়, নিজেদের আত্মীয়-পরিজনের কত সন্তান জন্মায় কই তাদের নিয়ে তো রজব জংয়ের কোনো মাথাব্যথা নেই, তাহলে এখানে কেন? একদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় জোহরা জিজ্ঞেস করে, পরের ছেলেকে নিয়ে আপনার রহস্য কী? 

রজব জং মৃদু হেসে বলেন, যমুনা নদী। 

যমুনা নদী? নদীর সঙ্গে রহস্যের কী সম্পর্ক? 

নদীই তো বলেছিল, আজ শিশুটির জন্ম হবে। 

আপনার মাথা খারাপ হয়েছে। নদী কি কথা বলে? এমন আজব কথা কে বিশ্বাস করবে? 

কী বললে? 

কথাতো ঠিকই বলছি। নদীর কথা বলে আপনি আমাদের ধোঁকা দিচ্ছেন। আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা এমন কথা শুনে হাসবে। আপনি তো বাচ্চার মাকে কোনো দিন দেখেন নি যে আপনার কোনো টান তৈরি হয়েছে। 

 কী বললে? 

যা বলেছি তা আপনি সবই বুঝতে পারছেন। বলছি, বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

বাড়াবাড়ি? বাড়াবাড়ির তোমরা কী বোঝ? মূর্খ মেয়েলোকের কথাই এমন হয়।

আপনি আমাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না। আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বিন্দা পরের বাড়ি গিয়ে বাচ্চা নিয়ে হ্যাংলামি করে সেটাও আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। 

তোমাদের পছন্দ-অপছন্দের ধার তো আমি ধারি না। জোহরা বিবি তোমাদের বাড়াবাড়ি করার সাহস হলো কেন? 

আমরা মোটেও বাড়াবাড়ি করছি না। 

করছ। চিৎকার করে ওঠেন রজব জং। নাস্তার প্রেট-বাটি-গ্লাস উল্টে ফেলে দিয়ে চলে যান। জোহরা কাজের লোকদের বলে, এগুলো পরিষ্কার কর। 

একটু পরে রজব জং বাইরে চলে যান। তখন প্রথম প্রশ্নটি করে আয়শা।

কী হয়েছে আপা? 

কার ঘরে কোন সন্তান হলো তাকে নিয়ে আমাদের স্বামীর এত খোঁজখবর কেন? বিন্দাই বা এত যাওয়া আসা করবে কেন? আমাদের কি মানইজ্জত নেই। 

বিন্দাও সায় দেয় একই ভঙ্গিতে। বলে, নিজের কোল খালি। সে হিসেব কে রাখে। বান্ধবীর বাচ্চার জন্য এত যাওয়া আসা আর সহ্য হয় না। 

একমাত্র বুশরাই কোনো কথা বলে না। স্বামীর বিরুদ্ধে তিনজনের এমন ক্ষোভ প্রকাশ দেখে ওর ভালোই লাগে। ও সবার ছোট। ওর বঞ্চনা সবচেয়ে বেশি এই পরিবারে। বুড়ো স্বামীর কাছে ওর যৌবনের যতই মূল্য থাক ওর কাছে তো স্বামীর শরীর মূল্যহীন। ওর কোনো আনন্দ নেই। সুতরাং যার সম্পর্কে কথা হচ্ছে তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার ওর নেই। ও অবসন্ন বোধ করে। হাই তোলে। আলোচনায় ওর আগ্রহ নেই দেখে বিন্দা ওকে খোঁচা দিয়ে বলে, তুমি কিছু বলছো না যে? 

আমার বলার কিছু নাই তাই বলছি না। তোমাদের আছে তোমরা বলো।

ও বাবা, তুমি দেখছি বুড়ার দিকে ভিড়েছ। 

বুশরা ঠোঁট উল্টায়। বলে, আমি তোমাদের মতো নিমকহারাম না। বুড়ার রস তোমরা খেয়েছো, আবার কথাও বলছো। আমি তো কিছু পাই নি। কথা বলে আয়ু কমাতে চাই না। 

বাকি তিনজন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের সবার ছোট বুশরা। যৌবন টগবগ করছে। বুড়ার হাত ধরতে ওর ঘেন্না তো হবেই। বুড়াটা ওর প্রতি সুবিচার করে নি। যে অন্যের প্রতি সুবিচার করে না সে কি কবি হতে পারে? প্রথমে বিষয়টি জোহরা ভাবে। তারপরে আয়শাও একই ভাবনা ভাবে এবং সবশেষে বিন্দাও। তখন ও সবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আর আমার বান্ধবীর বাড়িতে যাব না। আমার কি দায় পড়েছে যে পরের ছেলের খোঁজখবর করার? 

জোহরা নরম-সরম মহিলা। মৃদু হেসে বলে, দায় তো তোমার পড়ে নি দায় পড়েছে তোমার স্বামীর। তুমি হুকুম পালন করছ। পালন না করে পারছ না। 

স্বামীর দায় আমার ঘাড়ে চাপবে কেন? আমি আর পারব না। 

পারবে। আয়শা ব্যঙ্গের স্বরে বলে, আর একটা ঘাঘরা পেলে ঠিকই পারবে। কি পারবে না? ঘাঘরা পরে ফুর্তিও তো কম করো নি। 

বিন্দা খানিকটা বিব্রত হয়ে চুপ করে থাকে। 

কথা শুনে বুশরা হি-হি করে হাসে। হাসির শব্দ একটু জোরেই হয়। তারপর নিজে নিজেই বলে, ভাগ্যিস বুড়াটা বাড়িতে নেই। থাকলে এমন করে হাসতে পারতাম না। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। 

জোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এসব কথা ভেবে আমাদের কাজ নেই। আমরা তো স্বাধীন মেয়েমানুষ না। 

আয়শা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, মেয়েমানুষের আবার স্বাধীনতা কি? ওরা যা বলবে সে হুকুম পালন করতে হবে। আমরা ক্রীতদাসী। আমাদের বাড়ির চাকরানিগুলো আমাদের কাছে যেমন আমরাও স্বামীদের কাছে তেমন। 

আবার হি-হি করে হাসে বুশরা। ওর সঙ্গে হাসে অন্যরাও। কেউ জানে না ও কেন হাসছে। আয়শা বলে, এই মেয়েটা একটা পাগলি। এই বিয়েটা ওর মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে। আহা, বেচারা! বুঝতে পারি কত কষ্ট করে ও বেঁচে আছে। 

ঠিকই বলেছেন, পাগলি ছিলাম না। এই বাড়িতে এসে পাগলি হয়েছি। আমি একদিন আরও বড় পাগলি হয়ে যাব। তখন আপনারা আমাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবেন। আগ্রার লোকেরা জানবে কবির বউ পাগলি হয়ে গেছে। 

আহ্ থাম। আয়েশা ধমক দেয়। বুশরা আর কথা বলে না। ওর চোখ ছলছল করে। ও কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে যায়। বাকিরা নির্বাক বসে থাকে। বুশরার কান্নায় ওদের মনে হয় ওদের বুকের ভেতরে একটি করে বুশরা আছে। তবে ওরা ওর মতো যেমন হাসতে পারে না, তেমন কাঁদতেও পারে না। ওদের বুকের ভেতরে পাথরের স্তর পড়া শুরু হয়েছে। একদিন ওদের সুখ-দুঃখ বোধ বলে আর কিছু থাকবে না। 

.

আগ্রায় আর একটি অনুষ্ঠানের জমজমাট আয়োজন শুরু হয়। নবাব ফখরুদ্দৌলা আহম্মদ খাঁয়ের বোনের বিয়ে। বাড়ির সামনে বিশাল সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। গানবাজনা চলছে। রাতদিন সানাই বাজছে। নবাবের বোনের বিয়ে হচ্ছে আবদুল্লার ভাই নসরুল্লা বেগ খাঁয়ের সঙ্গে। রজব জংয়ের বাড়িতে দাওয়াতপত্র নিয়ে আসে আবদুল্লাহ। 

ওস্তাদজী আমার ভাইয়ের বিয়ে। নবাবের বোনের সঙ্গে। 

রজব জং মৃদু হেসে বলে, এখন তো এটা শহরের গল্প। লোকে দেখা হলেই এই একটা কথাই বলে। 

শীত গিয়ে বসন্ত এসেছে ওস্তাদজী। আমার ভাইয়ের জীবনে বসন্তের ফুল ফুটতে যাচ্ছে। আপনি ওকে দোয়া করবেন। 

রজব জং অভিভূত কণ্ঠে বলেন, আবদুল্লাহ তুমি আসলেই একজন কবি তোমার বুকের ভেতরে কবিতার আগুন আছে। তোমার ছেলেও কবিতার আগুন নিয়ে বড় হবে। দেখো আমার কথা ফলবে। 

আপনি বিয়ের অনুষ্ঠানে আসবেন। নবাব প্রচুর খানাপিনার আয়োজন করেছেন। অনেক আনন্দ হবে। রাতভর গানবাজনা হবে। 

আমি আসব আবদুল্লাহ। 

আপনার বিবিদের আনবেন। আমার আব্বাজান মেহমান আনা নেয়ার জন্য শহরের সব টাঙ্গা ভাড়া করেছেন। কারো কোনো অসুবিধা হবে না। 

আমরা তোমার দাওয়াত গ্রহণ করছি আবদুল্লাহ। বিয়ে বাড়িতে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। 

শুকরিয়া। 

আবদুল্লাহ চলে গেলে রজব জং বিবিদের ডেকে দাওয়াতের কথা বলেন। সবার মুখ থমথমে। নতুন কাপড় না দিলে কেউই দাওয়াত রক্ষা করতে যাবে না, এমন মনোভাব নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বিষয়টি বুঝে রজব জং নিজেই বলে, আমি সুফিহানকে খবর দিয়ে দিচ্ছি। ও এসে তোমাদের পোশাক ঠিক করে দেবে। তবে তোমরা তো জানো আমার সর্বোচ্চ খরচের হিসাব সুফিহানের কাছে আছে। কেউ যদি তার বেশি দামের কাপড় চাও তাহলে তার পোশাক বানাবে না সুফিহান। এসব নতুন করে বলার কিছু নাই। ঠিক হ্যায়? 

হ্যাঁ, ঠিক আছে। আপনার হিসেবের মাত্রা আমাদের মনে আছে। আমরা ভুলি না। 

বুশরা বলে, আপনার জন্য নতুন পোশাক বানাবেন না? 

না। আমি রমণী নই যে অনুষ্ঠান দেখলেই নতুন পোশাকের কথা ভাবব। এটা তারাই ভাবে যাদের মধ্যে জ্ঞানের অভাব আছে। যারা কবিতা বোঝে না।

বুশরা স্বামীর কথা উপেক্ষা করে আবারও বলে, একটা নতুন পোশাক পরলে আপনাকেও দুলহার মতো লাগতো। 

খামোশ। রজব জং ধমক দেয়। আজ রাতে তুমি আমার ঘরে থাকবে। তোমার শাস্তি আছে। 

বুশরা মুখে ওড়না চাপা দেয়। ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ও নিজেকে সামলাতে পারছে না। ও ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। 

রজব জং জোহরার দিকে আঙুল তুলে বলে, আমি সন্ধ্যা হলেই রাতের খাবার চাই। 

জোহরা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই কাজের লোকদের ডেকে দস্তরখানা বিছাতে বলে। শুরু হয় খাবারের আয়োজন। এত প্লেট-গ্লাস- বাটি-পিরিচ সাজাতে হয়, আবার গোছাতে হয়— শুধু একজন মানুষের জন্য। জোহরার বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস আসে। তার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুজনেই দিল্লিতে থাকে। আয়শার তিন মেয়ে হয়েছিল, দুটো বাঁচেনি। যেটি বেঁচে আছে সেটি স্বামীর সংসারে আগ্রাতেই থাকে। খুব ভালো নেই মেয়েটি। সংসারে নানা অশান্তির মধ্যে দিন কাটায় তার মেয়ে। আয়শার অনেক দুঃখ। স্বামীর কাছ থেকে মেয়েটির জন্য তেমন কিছু টাকা পয়সা আদায় করতে পারে না। আসলে লোকটি নিজেকে ছাড়া অন্যের কিছু বুঝতে চায় না। জোহরা নিজেও বোঝে যে এই সংসারে তারও কোনো আনন্দ নেই। দিনগুলো ধোঁয়ায় ভরা কাঠকয়লার চুলোয় রাঁধতে দম আটকে আসে। তারপরও তাকে রাঁধতে হবেই। প্রথম বিবির রান্না ছাড়া কাবাব রুটি মুখে ওঠে না রজব জংয়ের। অন্য কেউ রাঁধলে তিনি ঠিকই টের পান। 

সন্ধ্যায় খেয়েদেয়ে খুশি হয়ে যান রজব জং। জোহরার দিকে তাকিয়ে বলেন, বহুত আচ্ছা। জোহরার মুখে কথা ফোটে না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে। হায় আল্লাহ, একটা মানুষকে খুশি করার জন্য কতই না খাটনি। আজ ওকে কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে হয়েছে। কালকে গোশতের শুরুয়া আর মোগলাই পরোটা করতে হবে। এভাবে প্রতি বেলার খাওয়ার হুকুম দিয়ে দেন কবি রজব জং। মানুষটি কী লেখে? যার বুকের ভেতর এত ফাঁকা সেখান থেকে মালমসলা বের হয় কী করে? রাতে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বুক ভেঙে কান্না আসে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে জোহরা। 

পরদিন সকালে যমুনা নদীর ধারে হাঁটতে গেলে রজব জংয়ের মনে হয় আজও নদীর স্রোতে বাড়তি শব্দ আছে। সে শব্দে কান্না আছে— গভীর দুঃখ আছে। রজব জং দাঁড়িয়ে পড়েন। ভাবেন, দুঃখ কোথায়? সামনের দিনে তো আগ্রায় উৎসব। বাদ্যযন্ত্রের শব্দে মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করছে। কবুতর ওড়াচ্ছে। রঙিন কাগজে সাজানো হয়েছে বাড়িঘর। রঙ-বেরঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। মাঞ্জা সুতায় কেটে যাচ্ছে কোনো কোনো ঘুড়ি। এত কিছুর মধ্যে দুঃখ কেন? রজব জং জোরে জোরে হাঁটেন। বসন্তের বাতাস ছুঁয়ে যায় শরীর। শীত ফুরোলে হাঁটার আনন্দ দ্বিগুণ হয়। একগাদা কাপড় গায়ে জড়াতে হয় না। কিন্তু আজকে বসন্তের আমেজ নেই রজব জংয়ের মনে। নদীর কলধ্বনিতে ক্রন্দনের শব্দ তাঁকে কাবু করে ফেলে। মন খারাপ করে ভাবেন, বাড়িতে ফিরে যাবেন। 

ফেরার পথে দেখা হয় টাঙ্গাওয়ালার সঙ্গে। 

ওস্তাদজী আজ আপনার মন খারাপ মনে হচ্ছে? 

তীয়ত ঠিক নেই রে। 

টাঙ্গায় ওঠেন। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। 

সেই ভালো। আজ মনে হচ্ছে হাঁটতেও ভালো লাগছে না। 

রজব জং টাঙ্গায় ওঠেন। হাঁটতে বেরিয়ে টাঙ্গায় বাড়ি ফেরা তাঁর জীবনে কখনো হয় নি। বুকের ভেতর থেকে দুশ্চিন্তা বের করতে পারেন না রজব জং। অস্বস্তি নিয়ে গোসল করেন। বিন্দা বা বুশরা কারো দিকে তাকান না। নাস্তাটাও ঠিক মতো খাওয়া হয় না। কেবলই মনে হয় কিছু একটা ঘটবে। 

নসরুল্লাহ বেগ খাঁয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহর কোলে দেখতে পান তার ছেলেকে। 

আবদুল্লাহ রজব জংকে দেখে বলেন, এই যে আমার মির্জা নওশা। 

তোমার পুত্রকে আমার কোলে একটু দাও। দাদুভাই এসো আমার কোলে।

রজব জং দু’হাত বাড়ালে শিশুটি ঝাঁপিয়ে তার কোলে আসে। আবদুল্লাহ হাসতে হাসতে বলেন, আপনাকে আমার ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে। 

ওর বড় হওয়াটা আমার দেখা হবে না। অতদিন কি আর বাঁচব! কে জানে!

আপনি যদি একশ’ বছর বেঁচে থাকেন তাহলে ওর বড় হওয়া দেখতে পাবেন। হায়াত মউত আল্লার হাতে। আমিই বা ওর কতটুকু দেখতে পাবো, কে জানে! আমার খুব ইচ্ছা ছেলে আমার একজন জাঁদরেল ফৌজি অফিসার হবে। 

রজব মৃদু হেসে বলেন, যাই। মেহমানদের সঙ্গে কথা বলি। বড় ভালো লাগছে শহরের অভিজাতদের মাঝে এসে। বেশ জাঁকজমক অনুষ্ঠান হচ্ছে। 

আবদুল্লাহর কোলে ফিরে যায় মির্জা নওশা। বাড়ি ফিরে বিন্দা হাসতে হাসতে বলে, আমার বান্ধবী আবার গর্ভবতী হয়েছে। 

আবার সন্তান! রজব জং বিন্দার চোখে চোখ ফেলেন। 

হবে না কেন? বড়টির তো এক বছরের বেশি বয়স হলো। তাছাড়া দেখতে দেখতে দিন চলে যায়। বাচ্চাকাচ্চার কি বড় হতে সময় লাগে নাকি 1 

নতুন ঘাঘরায় চমক তুলে বিন্দা ঘরে যায়। রজব জং বিমোহিত হয়ে ভাবেন বিন্দা একটা দারুণ যমুনা নদী। বর্ষার ভরা তরঙ্গে কলধ্বনির উচ্ছ্বাস। কিন্তু আজ বিন্দা নয়, আজ বুশরা। ওর রাগী মেজাজ শরীরকে তীব্র মাদকতায় ভরিয়ে দেয়। সে আনন্দ উপভোগ বিরল ভাগ্য। রজব জং দুই নারীকে নিয়ে কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ান। যৌবন এবং ক্রোধ তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি হয়। 

রজব জং ঘরে পায়চারি করেন। বিছানায় বুশরা আসে নি। বলে দিয়েছে আজ ও পারবে না। ওর মাসিক হয়েছে। খবরটা দিয়ে গেছে আয়শা। বুশরাকে পোষ মানানো কঠিন। রজব জং জানেন। তখন তিনি আয়শার দরজায় মৃদু শব্দ করেন। দরজা খুললে হালকা সুগন্ধী এসে নাকে লাগে রজব জংয়ের। খুবই স্নিগ্ধ লাগছে প্রায় প্রৌঢ় আয়শাকে। হালকা নীল রঙের দোপাট্টা মাথার ওপরে। আয়শা বিস্ময়ে চোখ তুলে বলে, আমাকে কিছু বলবেন? 

আমার ঘরে এসো। 

আমার গর্ভবতী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

আমি তোমাকে বিছানায় চাই। আগ্রায় অনেক নারী আজ রাতে গর্ভবতী হবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এসো। 

হুকুম দিয়ে নিজের ঘরে যান রজব জং। 

মধ্যরাত। নিঃসাড় ঘুমুচ্ছে আয়শা। মেঝেতে গড়াচ্ছে নীল ওড়না। ঘুম আসে না রজব জংয়ের। মধ্যরাতে জীবনের খোঁজখবর করতে গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের জন্য রজব জংয়ের ভীষণ মায়া হয়। ভাবেন, যমুনার প্রবাহ থেকে তিনি নানা অর্থ বুঝে নেন। অর্থটা নিজের ভেতরে তৈরি করেন। এভাবে তাঁর কবিতার স্বরূপ নিজের ভেতরে সঞ্চিত হয়। নিজেকে বেশ বড় মানুষ মনে হয় তখন। কিন্তু তাঁর জীবনকে ঘিরে যে সব নারী জীবনযাপন করছে তিনি কি কোনোদিন তাদের হৃদয়ের কিংবা শরীরের কোনো শব্দ শুনেছেন? প্রবল অস্বস্তিতে রজব জং নিজের লেখার টেবিলে এসে বসেন। পাখির পালকের কলমটি দোয়াতে ডুবিয়ে কাগজের ওপর আঁকিবুকি টানেন। ভরে যায় কাগজের পৃষ্ঠা। সেটা আর আঁকিবুকি থাকে না। কালিতে কালো হয়ে ওঠে কাগজ। কালো হতে থাকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। 

সেদিকে তাকিয়ে নেশা হয় রজব জংয়ের। মনে করতে পারেন এটিও তাঁর শিল্পকর্ম। তিনি নারীর মুখ আঁকার চেষ্টা করেন, পারেন না। পাখি আঁকতে চান, পারেন না। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আয়শার মুখের দিকে তাকান। আজই প্রথম অনুভব করেন ভীষণ দুঃখী চেহারা। দুঃখ যমুনা নদীর মতো বইছে আয়শার মুখে। পরক্ষণে মনে হয় শুধু মুখে নয়, দুঃখ আছে শরীর জুড়ে। আয়শার পুরো শরীর যে এতক্লান্ত, এত সুখহীন তা কোনোদিন মনে হয় নি তাঁর। তাঁর খাতার সাদা পৃষ্ঠায় আঁকা কালো ছোপ তো আয়শার শরীর। এমনই কালো, নিকষ কালো। তবে তাঁর কেন মনে হলো তিনি কোনো নারীর মুখ আঁকতে পারছেন না। চারজন নারী দুঃখের কালো নদীতে ডুবে শিল্পের ছবি হয়ে আছে তাঁর জীবনে। তিনি তো সেখান থেকে মুক্তোই কুড়িয়েছেন সারা জীবন। এই প্রথম নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। 

বাকি রাতটুকু আরাম কেদারায় শুয়ে কাটিয়ে দেন। প্রবল অনুতাপে ভরে থাকে বুক। এই অনুতাপ সিক্ত শরীরটা তিনি আর বিছানায় নিতে চান না। যদি আয়শার শরীরে ছোঁয়া লাগে তবে তা হবে ভীষণ অন্যায়। এই অন্যায় কাজটুকু আজ রাতে তিনি নাই বা করলেন। 

কবি রজব হুসেন জং এই প্রথম নিজের জন্য মমতা অনুভব করেন। 

.

একদিন বিকেল বেলা আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা হয় রজব জংয়ের। আবদুল্লাহ মির্জা নওশাকে নিয়ে যমুনার ধারে ঘুরতে এসেছিলেন। রজব জংকে দেখে এগিয়ে আসেন। 

কেমন আছেন ওস্তাদজী? তবিয়ত ঠিক আছে তো? 

একদম ঠিক নেই। রাতে মাঝে মাঝে জ্বর হয়। বেশ দুর্বল হয়ে গেছি। তুমি কেমন আছ আবদুল্লাহ? 

আমার তবিয়ত ঠিক আছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই। 

কেন, মন খারাপ কেন? আমি তো শুনেছি তুমি আর একটি পুত্র সন্তানের পিতা হয়েছো। 

মুখে হাসি ছড়িয়ে আবদুল্লাহ বলে, হ্যাঁ আমার আর একটি পুত্র হয়েছে। মির্জা নওশার বয়স তো তিন বছরের বেশি হয়ে গেল। ওর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি চাই আমার ছেলে ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করবে। 

ফারসি ভাষায় কেন? উর্দুই তো শিক্ষার যথার্থ ভাষা। 

ফারসি ভাষায় জ্ঞান লাভ করলে আমার ছেলে একজন ভালো ফৌজি অফিসার হবে। 

চুপ করে থাকেন রজব জং। বাচ্চাটি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। দৌড়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে বাবার কাছে। বলছে, ওই পাখিটা ধরে দাও। বাড়িতে নিয়ে ওটা আমি পুষব। 

পাখি না আব্বা, তোমাকে আমি ঘোড়ার বাচ্চা কিনে দেব। তুমি ওটার সঙ্গে খেলবে। 

রজব জং বুঝতে পারেন আবদুল্লাহ মনেপ্রাণে ছেলেকে একজন সৈনিক বানাবে। তুর্কী রক্ত তার শরীরে টগবগ করে। মির্জা নওশা কি একজন সৈনিক হওয়ার জন্য তৈরি হবে? রজব জং দ্বিধায় পড়েন। 

তখন শুনতে পান শিশুকণ্ঠের ধ্বনি, না আব্বা আমি ঘোড়ার বাচ্চা চাই না। আমি পাখি চাই। আমাকে পাখি ধরে দেন। ওই যে কী সুন্দর পাখি। 

ও মাঠের ভেতরে দৌড়ে যায়। 

রজব জং আবদুল্লাহর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, যার এত সুন্দর ছেলে তার মন খারাপ থাকবে কেন? 

ওস্তাদজী, আমি ঠিক করেছি আলোয়ারে আর বেশি দিন থাকব না।

রজব হাসিমুখে বলেন, কেন ছেলেকে আগ্রায় রেখে দূরে থাকতে ভালো লাগছে না? 

না, আসলে তা নয়। আমার ছেলেরা ওদের নানার বাড়িতে খুব যত্নে আছে। আমার বিবি ছেলেদেরকে দু’চোখের আড়াল করে না। আসলে আলোয়ার থেকে চলে আসতে চাইছি অন্য কারণে। রাজা বখতাওর সিংয়ের কাছে মনমতো একটা চাকরি পাব এই আশ্বাসে সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে মনমতো চাকরি দেন নি। যে চাকরি করছি সেটা আমার ভালো লাগছে না। 

এমন হলে তো মন খারাপ হবেই। 

তাই তো ঠিক করেছি ওখান থেকে সব ঝামেলা চুকিয়ে-বুকিয়ে আসব। আগ্রা শহরে একটা কাজ করব। রুটি-রুজি আল্লাহর হাতে। ভাগ্যে যা আছে তা হবে। 

আমারও তাই বিশ্বাস। ভাগ্যে যা আছে তা হবেই। আমাদের কি সাধ্য আছে খোদাতালা যা কপালে লিখেছেন তা উল্টে দেয়ার। তবে এটাও ঠিক খোশ দিলে কাজ করতে না পারলে কাজে মন বসে না। 

তখন মির্জা নওশা এসে হাত ধরে টানাটানি করে বলে, আব্বা বাড়ি যাব। বাড়ি চলেন। আম্মার কাছে যাব। আমার খিদে লেগেছে। 

চলো আব্বাজান। 

আবদুল্লাহ ছেলেকে কোলে তুলে নেন। 

যাই ওস্তাদজী। 

আলোয়ায় করে যাচ্ছ? 

একদিন পরেই যাব। 

ফিরে এসে আমার বাড়িতে এসো। তোমার শ্বশুর ভালো আছে? 

হ্যাঁ, আব্বাজান ভালো আছে। 

চলে যায় আবদুল্লাহ। রজব জং ভাবে, জীবন এমনই। সুস্থির থাকা খুব কঠিন। মনে মনে আবদুল্লাহর জন্য দোয়া করেন। খোদাতালার অসীম দয়া। আবদুল্লাহ ভালো থাকুক। 

একদিন এক বাড়িতে নসরুল্লাহ বেগের সঙ্গে দেখা হয়। সে বেশ বড় চাকরি নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। তার বিবির বড় ভাই তাঁকে একটি সরকারি ফৌজের দলপতির দায়িত্বে নিযুক্ত করে দিয়েছে। বড়ভাইয়ের মতো নসরুল্লাহও রজব জংকে খুব মান্য করে। মুশায়রা রজব জং যেমন জমায়, অন্যরা তেমন জমাতে পারে না। 

ওস্তাদজী কেমন আছেন? তবিয়ত ঠিক আছে তো? 

ভালোই আছি। আবদুল্লাহ কেমন আছে? ও কি আলোয়ার থেকে চলে এসেছে? 

না, রাজা বখতাওর সিং তো আমার ভাইকে আসতে দেয়নি। হঠাৎ করে সিংয়ের রাজ্যের এক ছোট জমিদার বিদ্রোহ করেছে। সেই জমিদারের বিদ্রোহ দমন করার জন্য সৈন্যদল পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে আমার ভাইকেও পাঠানো হয়েছে। অনেকদিন আমার ভাইয়ের কোনো খবর পাই না। আল্লাহ মালুম কেমন যে আছে। 

ওর ছেলেরা ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, ওরা ঠিক আছে। 

মির্জা নওশা কেমন আছে? 

ও তো ওর নানার নয়নমণি। নানার বাড়ির আদরযত্নে দিব্যি আছে, বলেই হাসে নসরুল্লাহ। তারপর আবার বলে, আমার আব্বাজান ওদের কথা খুব ভাবেন। কিন্তু উপায় কী, ভাইয়া আগ্রায় থাকে না দেখে এখানে এনে রাখাও যায় না। সবই খোদাতালার ইচ্ছা। 

রজব জং বিষণ্ণ হয়ে যান। কেন, তা বুঝতে পারেন না। ভাবেন মৃত্যু নিয়ে একটি কবিতা তাঁর মাথায় এসেছে। আজ রাতেই লিখতে পারবেন। রাতে টাঙ্গায় করে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পান আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ফকফক করছে প্রান্তর, নদী, শহরের রাস্তা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়িঘর এবং গাছগাছালি। এত সুন্দর জ্যোৎস্না দেখেও বিষণ্ণতা কাটে না রজব জংয়ের। ভাবেন, মৃত্যুর কবিতাটা তাঁকে লিখতেই হবে। মৃত্যুচিন্তা কখনো তাঁকে এমন করে পেয়ে বসে নি। আজ রাত শুধু তাঁর একার। রজব জং দু’হাতে মুখ ঢাকেন। ভাবেন, পূর্ণিমার চাঁদ দেখবেন না, জ্যোৎস্না-ভাসা প্রান্তরও নয়। বুঝতে পারেন এত কিছু দেখার মধ্যে শান্তি নেই। ক্রমাগত বয়স বাড়ছে। শরীর ভাঙছে। বুশরা ভীষণ জেদি হয়ে উঠেছে। অন্যরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। রজব জং দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখলে টের পান চোখ পানিতে ভরে যাচ্ছে। কেন যে এমন লাগছে তার কোনো ব্যাখ্যা নিজের কাছেও নেই। এক সময় পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মোছেন। 

বাড়ির দরজায় টাঙ্গা থামলে টাঙ্গাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী বেটা? 

মুখলুস বখশ। 

বিবি আছে?

আছে। 

বাচ্চালোগ? 

ছয়টা। বড় বেটির বয়স বারো বছর। শাদী ঠিক করেছি। আপনাকে দাওয়াত দেব হুজুর। আমার বেটির শাদীর মজলিসে আসবেন। আসবেন তো হুজুর? 

জরুর আসব। তুমি দাওয়াত দিও। 

হুজুর আপনার বিবিদের নিয়ে আসবেন। 

রজব জং মাথা নেড়ে সায় দেন। তাতে টাঙ্গাওয়ালা বুঝতে পারে না যে তিনি বিবিদের নিয়ে আসবেন কি আসবেন না। রজব জং আচকানের পকেট থেকে টাকা বের করে ভাড়া চুকিয়ে দেন। বাড়ির দারোয়ান গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় জোহরার মুখোমুখি হন। জোহরা কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি বলে, দস্তরখানা তৈরি আছে। 

আমি আসছি। বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে যান। 

দরজায় দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, আমার তবিয়ত ঠিক নেই। আজ রাতে কিছু খাব না। 

বন্ধ করে দেন দরজা। জোহরা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ওড়নায় চোখের পানি মোছে। এই মানুষটাকে তার বোঝা হলো না। সংসারটাকেও না। মানুষটাকে একথা বললে, সঙ্গে সঙ্গে বলবে, এত কথা জানার দরকার কী। 

সত্যি তো এত কথা জানার দরকার কী! জোহরা কাজের লোকদের ডেকে দস্তরখানা গুটিয়ে ফেলতে বলে। আয়শা এগিয়ে এসে বলে, খাবে না কেন? 

তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস কর। 

অত দায় ঠেকে নি। শুধু রাত দুপুরে দরজা ধাক্কা দিয়ে সেবা করার জন্য ডাকলে তা সহ্য হবে না। 

সহ্য তো হতেই হবে। এত বছরে কি না করে উপায় ছিল আমাদের? আমরা যা করতে বলেছে করেছি। অনুগত দাসীর মতো করেছি। আমি তো মাঝে মাঝে ভাবি আমরা কি স্ত্রী না দাসী? 

চুপ করে থাকে আয়শা। দস্তরখানা উঠে গেলে জোহরা আয়শাকে বলে, চলো আমরা খেয়ে নেই। বেশি রাত করে খেলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। 

হেকিমের কাছ থেকে ওষুধ নিলেই তো হয়। 

ভালো লাগে না। 

কালই আমি হেকিমকে আসার জন্য খবর দেব। 

চারজনে খেতে বসে। কখনো তাদের পছন্দমতো রান্না হয় না। রজব জংয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী রান্না কী হবে তা ঠিক করা হয়। সবার জন্য একই রান্না হয়। বুশরা হাসতে হাসতে বলে, বুড়াটা রান্নার আগে যদি বলতো খাবে না, তাহলে আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো রান্না করতাম। 

সে সুযোগ আমরা খুবই কম পেয়েছি। 

আমাদের ইচ্ছেও হয় নি। 

আসলে বন্দি হয়ে থাকার কারণে আমাদের ইচ্ছেগুলো মরে গেছে।

জোহরা তাড়া দেয়। এত কথা না বলে খাওয়া শেষ কর সবাই। 

আমি খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না। বুশরা উঠে দাঁড়ায়। বিন্দা ওর হাত টেনে ধরে বলে, বস। অল্প করে খাও। না খেয়ে রাত কাটালে আমাদের ইচ্ছাগুলো মুক্তি পাবে না। ওগুলোতো মরেই গেছে। 

ওসব নিয়ে আমি আর ভাবি না। না খাওয়ার ইচ্ছাটাও কি বন্দি? 

বিন্দা ওর প্রশ্নের ধার দিয়ে না গিয়ে বলে, বোস। তুমি বসলে আমাদের খাওয়ার ইচ্ছা জোরদার হবে। 

ওসব তো অন্যের ইচ্ছায় খাওয়া। 

বুশরা বিন্দার হাত ছাড়িয়ে নিজের ঘরে যায়। একটু পরে ওরা শুনতে পায় বুশরা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ধ্বনি ভেসে আসছে মৃদুলয়ে। প্লেটের ওপর একজনের হাত স্তব্ধ হয়ে থাকে, একজন এক লোকমা মুখে দিতে গিয়ে মাঝপথে থামিয়ে রাখে হাত, আর অন্যজন প্লেটের খাবারগুলো এলোমেলো করে পানি ঢেলে দেয়। তিনজন পরস্পরের দিকে তাকায় না। যে যার মতো উঠে যায়। কাজের লোকেরা এসে প্লেট-গ্লাস গোছাতে থাকে। 

তখন ওরা শুনতে পায় তিনজনের ঘর থেকেও কান্নার শব্দ আসছে। সে শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাড়িতে এবং গেট পেরিয়ে চলে যাচ্ছে আগ্রার রাস্তায়। শহরের উপর দিয়ে কিংবা নদীর স্রোতে। বিভিন্ন শ্রেণীর কাজের নারীরা অভিজাত শ্রেণীর নারীদের বুকফাটা আর্তনাদে সঙ্গী হয়ে যায়। ওদের অনুভব তীব্র হয়ে ওঠে এবং সকলেই প্লেট-গ্লাস-বাটি, চামচ-পিরিচ ইত্যাদি তুলে নিয়ে যেতে যেতে ভাবে আহারে, ওদের সঙ্গে আমাদের তফাতটা এই যে ওরা ধনী আর আমরা গরিব। আমাদের ঘরে রোজ রোজ রুটি-কাবাব থাকে না, ওদের ঘরে থাকে, কিন্তু কান্নার শব্দটা একই রকম। এখানে তফাত নেই। আহারে, এই একটা জায়গায় ওরা আর আমরা একই। ওরাও আমাদের মতোই কান্নাকাটি করে। বুকভাঙা কান্না। 

আহারে- বলতে বলতে কাজের নারীরা চলে যায়। খাবারের ঘ্রাণে আজ ওদের ক্ষুধার উদ্রেক হয় না। বুশরার মতো সবচেয়ে ছোট কাজের মেয়ে ইসতা বলে, আজ আমি রাতে কিছু খাব না। রোজ রোজ রুটি আর ডাল খেতে আমার ভালো লাগে না। আমাদের জন্য রোজ রোজ কেন কাবাব থাকে না কিংবা কাচ্চি বিরিয়ানি, গোশতের শুরুয়া? 

আহারে— ছোটটির কথা শুনে বয়সী নারীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বয়সী নারীদের আহারে ধ্বনি উড়ে যায় আগ্রা শহরের উপর দিয়ে। যমুনা তো তাজমহলের ছায়া বুকে ধারণ করে। এইসব নারীর আক্ষেপের ধ্বনি নদীর তরঙ্গে মেশে না। তবু তারা উচ্চারণ করে, আহারে। আজ বেশ রাত পর্যন্ত গল্প করতে করতে রাতের খাবার খায় ওরা। এভাবে খাওয়া শেষ করতে ওদের বেশ ভালো লাগছে। ওরা তো অবসর উপভোগ করতে পারে না। অবসরও ঠিক মতো পায় না। একজন বলে, আজকের রাতটা খুব সুন্দর। 

কেন? অন্যজনের প্রশ্ন। 

এই যে গল্প করতে করতে খেতে পারছি। অন্য রাতে এমন মজা করে খাওয়া হয় না। 

তাড়াতাড়ি শেষ কর। ঘুমাতে হবে না? রাত না পোহাতে আবার কাজে লাগতে হবে। 

এক রাত না ঘুমালে কি হবে? আজ রাতে যে আনন্দ পেলাম তা দিয়ে ঘুমের রেশ পুরে যাবে। ঘুম লাগবে না। 

হি হি করে হাসে সবাই। আবার সতর্ক থাকতে হয়, যেন শব্দ না হয়। ওড়না দিয়ে মুখ চাপতে হয়। তখন ওদের নাকে ফুলের ঘ্রাণ এসে ঢোকে। সবাই চমকে চারদিকে তাকায়। বুঝতে পারে ওদের চারদিকে ফুরফুরে বাতাস বইছে। বাতাস ওদের জন্য ফুলের গন্ধ বয়ে নিয়ে এসেছে। ওরা সবাই বুকভরা বাতাস টেনে বলে, কী সুন্দর রাত। 

.

দুঃসংবাদ বাতাসের বেগে ধায়। 

আবদুল্লাহ বেগ খাঁয়ের মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় আগ্রা শহরে। খবরটা শুনে রজব জং বিড়বিড় করে বলেন, মির্জা নওশা, মির্জা—। পিতা হারিয়ে ছেলেটি কীভাবে বড় হবে এই চিন্তা তাকে ব্যাকুল করে তোলে। 

সকলেই জেনে যায় যে, বখতাওর সিং জমিদারের বিদ্রোহ দমন করার জন্য সৈন্য দল পাঠিয়েছিল। সেই লড়াইয়ে শত্রুর গুলিতে মৃত্যু হয় আবদুল্লাহর। খবরটা পেয়ে বিন্দা তার বান্ধবীর কাছে গিয়েছিল। ফিরে এসে বলে, আগ্রায় একজন নারী বিধবা হলো। 

আরও একটু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, এই শহরের নারীরা হয় সতীনের ঘর করে, নয়তো তারা বিধবা হয়। বিন্দা শব্দ করে কেঁদে উঠলে রজব জং ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ান। বিন্দা জোরে জোরে কাঁদে শুনেও আজ তিনি ধমক দেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বিন্দাকে চোখ মুছতে দেখে রজব জং জিজ্ঞেস করেন, তোমার বান্ধবীর বড় ছেলেটিকে দেখেছ? 

মির্জা নওশাকে? দেখেছি। 

কী করছিল ও? 

অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিল। দূরন্ত ছেলে। কেউ ওকে সামলাতে পারে না। তাছাড়া মৃত্যুর খবর বোঝার মতো বয়স তো ওর নয়। আপনি যে অন্যের ছেলেকে নিয়ে কেন এত ভাবেন তা আমি বুঝি না। 

আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে ও বড় একটা কিছু হবে। 

কী হবে? 

একজন কবি হতে পারে। 

কবি। আপনি কি নিজের ছোটবেলা ভাবছেন? 

রজব জং ওর কথা উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে যান। তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারান। চার স্ত্রীর কেউ কিছু জানতে পারে না। কারণ স্বামী না ডাকলে তারা সে ঘরে ঢোকে না। 

জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখতে পান বিকেলের স্নিগ্ধ আলো ঘরে ছড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। তিনি বিছানায় উঠে বসে থাকেন। হাঁটুর ওপর মাথা রাখেন। কখনো পিছনে দু’হাত ঠেকিয়ে মাথা ঝুলিয়ে দেন। ভাবেন, ছেলেটি খুব দুরন্ত। পিতার মৃত্যু বোঝার বয়স হয় নি। হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে। একদিন মৃত্যু বুঝবে, বেঁচে থাকা বুঝবে। কবিতার পঙ্ক্তিতে উজাড় করবে। নিশ্চুপ বসে থাকতে তাঁর ভালোই লাগছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলে আস্তে আস্তে দিনের আলো কমতে দেখেন। এই দৃশ্য তো প্রকৃতির কবিতা। রজব জং নিজেকে খুব সুখী মানুষ ভাবেন।

.

কয়েকদিন পরে নসরুল্লাহ বেগের সঙ্গে দেখা হয়। ভাইয়ের মৃত্যুতে প্রবলভাবে শোকাহত নসরুল্লাহ। চোখ বসে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দু’হাতে ভেজা চোখ মুছতে থাকেন। 

সবই খোদাতালার ইচ্ছা নসরুল্লাহ। 

নসরুল্লাহ চোখ মুছে বলেন, ভাইয়াকে রাজগড়ে কবর দেয়া হয়েছে। আমরা জিয়ারত করে এসেছি। ভাইয়ার মৃত্যুতে আমার আব্বাজান খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। 

এত বড় শোক, সামলানো কঠিন। আল্লাহ মেহেরবান। বান্দার কি সাধ্য আল্লাহর ইশারা বোঝার। বখতাওর সিং আবদুল্লাহর পরিবারের জন্য কি ব্যবস্থা করেছে? 

পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দুটি গ্রাম দিয়েছে। দুই ছেলের জন্য দৈনিক খরচের ভাতা দিয়েছে। এই ভাতা অনেক দিন ধরে চলবে। 

বহুৎ আচ্ছা। শুকরিয়া। মির্জা নওশা কেমন আছে? 

ওরা দুই ভাই ভালোই আছে। নওশা তো ভীষণ চঞ্চল। দুরন্ত। বেশ বুদ্ধিমানও হয়েছে ছেলেটি। মজার মজার কথা বলে। নানা রকম প্রশ্নও করে। দেখতেও খুব সুন্দর। 

বাহ, খুব ভালো। 

যাই ওস্তাদজী। আপনি ওদের খোঁজ খবর রাখেন এটা আমার খুব ভালো লাগে। এখন একজন ওস্তাদজী রেখে ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। আব্বাজান এসব দেখাশোনা করছেন! 

সালাম দিয়ে চলে যায় নসরুল্লাহ। রজব জং যমুনা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ান। যেন শুনতে পান গালিবের বড় হয়ে ওঠার খবর। এখন শুধু নদীর তরঙ্গ থেকে নয়, আগ্রার চারদিক থেকে শব্দ আসছে, গালিব, গালিব। কোথায় গেলে? এদিকে এসো। যেন মা ডাকছে ছেলেকে। দুরন্ত ছেলেটিকে সামলাতে ব্যস্ত থাকে মা। 

গালিব। গালিব। আবার কে ডাকছে? ছেলেটির দাদা। পিতৃহীন ছেলেটির দিকে খেয়াল রাখতে হয়। পিতার না থাকা ছেলেটিকে নানা পথে নিয়ে যেতে পারে। ছেলেটির জীবনে এটি বড় অশান্ত সময়। দাদার কাছে ছেলেটির অনেক রকম প্রশ্ন থাকে। কোনো প্রশ্ন ঠিক মতো দিতে না পারলে কিংবা প্রশ্নটি ওর মনঃপুত না হলে ও ছুটে বেরিয়ে যায়। বাগানে কিংবা রাস্তায়। বাড়ি ফিরে এসে দাদার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, আপনাকে বাঘে খাবে দাদা। আপনি কি বাঘকে ভয় পান? 

হ্যাঁ, পাই। ভীষণ ভয় পাই। বাঘের হালুম ডাক শুনলে আমার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। তুমি কি তলোয়ার দিয়ে বাঘ মারতে পারবে? 

পারব। আপনি তো আমাকে শিখিয়েছেন দাদা যে আমি তুর্কী বংশের সন্তান এবং সেই বংশের যারা নিজের জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আপনি বলেছেন আমি ঐবক। তুর্কীদের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠত্ব পূর্ণ চাঁদের মতো উজ্জ্বল। 

বাহ, সাবাস। আমি তো তোমাকে শিখিয়েছি যে তুমি সমরকন্দের জমিদার সন্তান। আমি তোমাকে তোমার শ্রেষ্ঠত্বের সবটুকু গল্প বলে যাব। প্রতিদিন একটু একটু করে। 

আপনি তলোয়ারের কথা বলেন দাদু। 

তুর্কীদের নিয়ম অনুযায়ী ঘরবাড়িসহ সম্পত্তি পায় মেয়েরা, আর ছেলেরা পায় তলোয়ার। 

ছেলেটি হেসে দাদার হাত ধরে টেনে বলে, চলেন তাজমহল দেখে আসি। ওখানে অনেক ফুল ফোটে। এত ফুল কেন ওখানে ফোটে দাদা? 

ওগুলো সব ভালোবাসার ফুল। 

ধুত, ভালোবাসার আবার ফুল কি? সব তো গোলাপ। আমি গোলাপ ফুল ভালোবাসি। 

গালিব। গালিব। 

ওর চাচা নসরুল্লাহ ওকে ডাকছে। 

গালিব, ওস্তাদজী এসেছেন, পড়তে এসো। 

হ্যাঁ, আমি তো পড়তে চাই চাচা। আমি আসছি। 

ওস্তাদজী আমি কবিতা লেখা শিখব। আমার লেখা এক একটি রুবাঈ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। 

তুমি কবিতা লিখবে গালিব? হ্যাঁ, লিখব। 

তুমি একটি বীর জাতির বংশধর। তুমি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে একটি তলোয়ার পেয়েছ। 

ওই তলোয়ার আমার কাছে কলম হবে। 

হি-হি, হা-হা করে হাসে গালিব। 

রজব জং আকস্মিক চিন্তায় চমকে চারদিকে তাকান। ভাবেন হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু না, যমুনা নদীর তরঙ্গে আজকে বাড়তি কোনো শব্দ নেই। যমুনার প্রবাহ স্থির। রজব জং খুশি মনে বাড়ি ফেরেন। প্রবীণ কবি বুঝে যান যে ছেলেটি ‘গালিব’ ছদ্মনামে কবিতা লিখবে। ‘গালিব’ মানে বিজয়ী। ও ঠিক বিজয়ী হবে। 

.

শৈশব পেরিয়ে এখন দুরন্ত কৈশোরকাল তাঁর। সবচেয়ে কাছের বন্ধু বংশী। কাছাকাছি বাড়িতে দুজনে থাকেন। দাবা খেলতে খেলতে রাত হয়ে গেলেও সমস্যা নেই। একছুটে বাড়ি চলে যাওয়া যায়। আর মাতো জানেই ছেলে কোথায় আছে। লোক পাঠিয়ে বসিয়ে রাখেন বংশীদের বাড়ির দরজায়। দুই বাড়ির মাঝে আছে দুটি গলি। আর এক গলিতে থাকে বারবণিতা মাছিয়া। দু’বন্ধু প্রায়ই দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে পান আগ্রার চেনাজানা কেউ কেউ সে বাড়িতে আসছেন। সন্ধ্যাবেলায় গানের আসর বসে ওই বাড়িতে। 

একদিন গালিব বংশীকে বলেন, চলো আমরা ওই বাড়িতে গান শুনতে যাই। 

বংশী এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেন, আমাদেরতো ওই বাড়িতে যেতে মানা। 

গালিব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, কেন? 

আমরা যে বড় হইনি। 

গান শোনার জন্য বড় হতে হয়? গালিবের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।

বংশী ঘাড় নাড়িয়ে বলে, হয়। 

গান শোনার জন্য আমি তাড়াতাড়ি বড় হতে চাই। এক লাফে বড় হওয়া যায় না বংশী? 

বংশী সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে, চলো ঘুড়ি ওড়াতে যাই। মাঠে যাব। বাড়ির ছাদে না। 

চলো, চলো। গালিবের উৎসাহিত কণ্ঠ। ঘুড়ি যখন আকাশের কাছাকাছি চলে যায় তখন আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। 

কবিতা! বংশীর দুচোখে বিস্ময়। ওই যে কানহাইয়ালাল আসছে। ওকেও বলবো যে আমাদের মির্জা নওশা কবিতা লিখতে চায়। 

আমি ঘুড়ি নিয়ে কবিতা লিখবো। চলো দৌড়াই। এক দৌড়ে কানাইয়ের হাত ধরে মাঠে যাই। ওর হাতে নাটাই আর ঘুড়ি আছে। 

দু’বন্ধু দৌড়াতে দৌড়াতে পার হয়ে যায় ঘটিয়াওয়ালি নামের বড় বাড়িটি, তারপর শালিমশাহের তাকিয়া, কাশ্মিরিওয়ালা গলি এবং নিজেদের বাড়ি কালেমহল। 

বন্ধুদের সঙ্গে আগ্রার ধূলিকণা, যমুনার ওপর থেকে ভেসে আসা বাতাস, কৈশোরের খেলাধুলার আনন্দ গায়ে মেখে ফুরিয়ে যেতে থাকে শৈশব। একদিন চাচা বললেন, আরও পড়ালেখা শিখতে হবে মির্জা নওশা। এবার নতুন ওস্তাদ দেবো। 

আমি কবিতা লিখবো চাচা? 

কবিতা লিখবে? 

আমার মাথার ভেতরে অনেক ভাবনা ভেসে বেড়ায়। অনেক ছবি দেখতে পাই। আমার স্বপ্নের ভেতরে…। 

হয়েছে থামো। কাল থেকে তোমাকে ফারসি শেখানোর জন্য বাড়িতে ওস্তাদ আসবে। মনে রেখো আগে লেখাপড়া শিখতে হবে। পারস্য থেকে এসেছেন ওস্তাদ আবদুস সামাদ। তিনি তোমাকে ফারসি ভাষা শেখাবেন। 

গালিব খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, চাচাজান আমি পড়ালেখা ঠিকমতো করবো। আপনি দেখবেন আমি একটুও অমনোযোগী হবো না চাচাজান। 

আমি তোমাকে দোয়া করি মির্জা নওশা। 

নসরুল্লাহ তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। 

পরদিন থেকে শুরু হয় ওস্তাদের কাছে পাঠগ্রহণ। ওস্তাদ তাঁদের বাড়িতে থাকেন। তিনি নিয়মিত তাঁকে পাঠদান করেন। এর আগে তাঁকে পাঠদান করতেন আর একজন ওস্তাদ। নতুন ওস্তাদকে প্রথমে ভয় পেলেও গালিব দেখলেন তিনি একজন অমায়িক মানুষ। শুধু বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানই করেন না। সাহিত্যও পড়ান। কবিতা পাঠ করতে শেখান। নিজেও পাঠ করেন। তিনি আরবি ভাষা জানেন। সে ভাষার কথাও গালিব জানতে পারেন। বেশ আনন্দে কেটে যায় ওস্তাদের কাছে শেখার সময়। মনে হয় বুকের ভেতরে উড়ে বেড়ায় পাখি, নাকি প্রজাপতি। ছুঁতে পারেন না, কিন্তু অনুভবে ধরে রাখেন সেসব কিছু। মনে হয় গাছের দিকে তাকালে বুঝতে পারেন যে ফুলটি ডাল থেকে ঝরে যায়নি, কিন্তু তারপরও ফুলটি তাঁর মুঠিতে ধরা পড়েছে। সে ফুলের সৌরভে ভরে গেছে তাঁর শরীর। থমকে যান তিনি। কবিতা কি তাহলে এমনই? 

বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে বলেন, মাঝে মাঝে ওস্তাদজী চলে গেলে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। কোনো কোনো দিন দেখতে পাই সূর্য ডুবে যাচ্ছে। কারো নাটাই থেকে ছুটে গিয়ে ঘুড়ি উড়ছে। এলোমেলোভাবে। বেধে যাবে কোনো গাছের মাথায়, নয়তো পড়বে মাটিতে বা নদীতে। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় কি যেন ধরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ধরতে পারছি না। আমি ঘুড়ি নিয়ে একটি কবিতা লিখবো। দেখবে তোমাদের ভালো লাগবে। 

কানহাইয়ালাল বলেন, কবিতাটি আমাকে দিও। আমি রেখে দেবো। 

ঠিক আছে, তোমাকেই দেবো। চলো, আমরা এখন পায়রার লড়াই দেখে আসি। 

হ্যাঁ, চলো চলো। পায়রার লড়াই দারুণ খেলা। 

যেতে যেতে গালিব বলেন, ঘুড়ি ওড়ানো, দাবা খেলা, পায়রার লড়াই না থাকলে তো সারাক্ষণই বাড়ির সামনের পাথর বাঁধানো অংশে বসে থাকতে হয়। নইল ইউসুফের সঙ্গে খেলতে হয়। শুধু এইটুকু একদমই ভালো লাগে না। 

বন্ধুরা হাঁটতে হাঁটতে বলে, যা করে আনন্দ পাও তাহলে তাই করো।

কানহাইয়া আগ্রহ নিয়ে বলে, কাল খেলতে না এসে ঘুড়িকে নিয়ে কবিতা লেখো। 

আমিও তাই ভেবেছি। ওস্তাদজী ছুটি দিলে আমি কবিতা লিখবো। 

দিন যায়। কয়েকদিন পরে লেখা হলো কবিতা। লিখলেন উর্দু ভাষায়। ঘুড়িকে দিল বলে উল্লেখ করলেন। বন্ধুরা খুশি। সবাই নিজের হাতে কপি করে নিল। বন্ধুদের পকেটে কবিতা থাকে। তিনি উৎসাহী হয়ে উঠলেন। সুযোগ পেলে বড়দেরও কবিতা শোনান। দু-একটি আসরে যাওয়ার সুযোগ হলো। কবিতা শুনে রজব জংয়ের খুশির সীমা নেই। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বড় শায়ের বনেগা। বেশ কাটছে দিন। ওস্তাদ মুহম্মদ সামাদও তাঁর কবিতার প্রশংসা করেন। ঘুড়ির মতো অনেক উঁচুতে ছুটে যায় কল্পনা। মাঝরাতে ছাদে উঠে আকাশ দেখেন। শীতের কুয়াশা গায়ে মাখেন। শিশিরে পা ডোবান আর যমুনার বুকে তাজমহলের ছায়া দেখেন। বুকের ভেতরে গজলের ধ্বনি যমুনার তরঙ্গ হয়। 

মাঝে মাঝে মুশায়রায় কবিতা পড়ার সুযোগ হয়। রজব জংয়ের উৎসাহের অন্ত নেই। তিনি তাঁকে বিভিন্ন আসরে নিয়ে যান। প্রবীণ কবি তাঁকে নানা উপদেশ দেন। অনেক সময় আসর থেকে ফেরার পথে নিজেই তাঁকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তিনি প্রবীণ কবির হাত ধরে টাঙা থেকে নামেন। আনন্দে- উচ্ছ্বাসে হৃদয় ভরে থাকে। কোনোদিন মাকে গিয়ে বলেন, আম্মাজান আজ আমার একটুও ক্ষিদে নেই। পানির তিয়াসও পায়নি। 

কেন এমন লাগছে বেটা? 

কবিতার শ্রোতারা আমাকে বাহ্, বাহ্ বলেছে। অনেকবার মারহাবা বলেছে। 

মা চোখ বড় করে বলেন, মাশাল্লাহ। খোদা মেহেরবান। আমার বাচ্চা বড় কেউ হবে। এখন চলো বেটা দুটো রুটি আর কাবাব খাও। 

মায়ের হাত ধরে তিনি খেতে বসেন। 

একদিন ‘শের-এ-সুখন’-এর আসর থেকে বাড়িতে ফিরলেন। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে ফিরেছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কান্নার রোল শুনতে পেলেন। বংশীধরের হাত চেপে ধরে বললেন, বাড়িতে কান্নাকাটি কেন বংশী? আমার ভয় করছে। 

চলো দেখি। 

সবাই বাড়ির গেটে এসে থমকে দাঁড়ালো। শুনতে পেলেন গালিবের চাচা নসরুল্লাহ বেগ হাতি থেকে পড়ে মারা গেছেন! 

চাচাজান মরে গেছেন? হাউমাউ করে কাঁদলেন গালিব। আব্বাজান নাই, চাচাজান নাই। আমাদেরকে কে দেখবে? 

কালেমহলের পাথরের সিঁড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে বসে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। আজ কেউ তাঁকে খেতে ডাকলো না। তিনি নিজেও ঘুমানোর কথা মনে করলেন না। কেমন করে যেন রাত কেটে গেল। 

চাচাজানের দাফন হয়ে গেল। অনেক আত্মীয়স্বজন এলো বাড়িতে। ফিরোজপুরের ঝিরকা ও লোহারুর নওয়াব আহমদ বখশ খান এলেন। তিনি তাঁর চাচার শ্বশুর। গালিবকে অনেক আদর করলেন। তাঁর পড়ালেখার খোঁজখবর নিলেন। তাঁর প্রথম শিক্ষক মৌলানা মুয়াজ্জম তাঁর প্রশংসা করলেন। এই বয়সেই তিনি কত ভালো ফারসি শিখেছেন সে খবর দিলেন ওস্তাদ মুহম্মদ সামাদ। কবি রজব জং উচ্ছসিত ভাষায় তাঁর গজল লেখার কথা জানালেন। আহমদ বখশ খান খুশি হয়ে বললেন, ওকে আমি দিল্লি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো। একদিন নিশ্চয় ও সম্রাটের দরবারে মুশায়রায় অংশ নিতে পারবে। 

ওস্তাদ আবদুস সামাদ খুশি হয়ে বললেন, ওকে দোয়া করবেন হযরত। ও খুব ভালো ছেলে। 

গালিব কাছে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনলেন। একদিকে চাচাজানের মৃত্যুশোক অন্যদিকে স্বপ্নের ভবিষ্যতের হাতছানি। তিনি বুঝলেন এখন তাঁকে বুঝতে হবে কেমন করে কি করবেন। কোথায় যাবেন, কি হবে তাঁর ঠিকানা } 

একদিন বাড়ি খালি হয়ে গেল। চোখের সামনে জেগে রইলো মায়ের পাংশু বিবর্ণ চেহারা। নানার বাড়িতে দিন কাটে। মামারা যত্ন করেন। দিনগুলো আগের মতো কাটছে। ওস্তাদের কাছে পাঠ নিচ্ছেন। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন, দাবা খেলছেন। কবিতা লিখছেন। যমুনা নদীর ধারে সূর্যাস্ত দেখছেন। 

একদিন মামার কাছে শুনলেন তাঁর বিয়ে ঠিক করেছেন নওয়াব আহমদ বখশ খান। পাত্রী ঠিক হয়েছে তাঁরই ভাই কবি ইলাহি বখশ খানের মেয়ে উমরাও বেগম। 

মামা বললেন, ভালোই হয়েছে। তুমি অভিভাবক পেয়েছো। ওরা তোমাকে দিল্লিতে নিয়ে যাবে। বিয়ের পরে তুমি দিল্লিতে বাস করবে। 

মা বললেন, বেটা তোমার নসীব ভালো। নওয়াব পরিবারে বিয়ে হলে তুমি ভালো থাকবে। তোমার বছরের ভাতা আছে। তা দিয়ে সংসার চলবে। 

গালিব শুকনো মুখে শুধু বললেন, আম্মাজান- 

মা তাঁকে কাছে টেনে আদর করে বললেন, ঘাবড়িয়ো না বেটা।

তিনি সবার সামনে থেকে সরে এলেন। তিনি ঘাবড়াননি। শুধু ভাবলেন, আব্বাজান, চাচাজান যখন নেই, তখন তো একটা কিছু তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হবে। নইলে তিনি ভাসবেন কি করে? নানাজান গুলাম হুসেন খাঁও বেঁচে নেই। চারদিকে প্রবল শূন্যতা। মা আছেন বলে বুকের জোরটুকু শেষ হয়ে যায়নি। আছে ছোট ভাইটি। বোনটি। কতদূরই বা যেতে পারবেন তিনি। মন খারাপ হলে একা একা থাকেন কোথাও কোনো আড়ালে গিয়ে। বন্ধুরাও খুঁজে পায় না তাঁকে। এভাবে তিনি নিজের চারপাশে বৃত্ত তৈরি করেন। একদিন মুরুব্বীরা তাঁর বিয়ের দিন ঠিক করেন। 

আজ গালিবের বিয়ে। 

বিয়ের কথা তাঁকে তেমন উচ্ছল করে না। আত্মীয়স্বজন নানারকম তামাশা করে। তিনি কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। বারবার মনে হয় নানাজান বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো বিয়ে বিষয়ে কিছু জানতে পারতেন। বাবার কথাও খুব মনে হয়। আসলে বাবার চেহারাই তো মনে নেই। কত ছোট বয়সে বাবা তাঁকে ছেড়ে গেলেন। বিয়ের দিনে বাবা নেই, চাচা নেই ভেবে তাঁর খুব কান্না পায়। তিনি বাগানের ফুল গাছের আড়ালে বসে অনেকক্ষণ কাঁদেন। নানা মারা যাওয়ার পরে চাচা ভরণপোষণ করেন। এখন চাচাও নাই। তাঁর বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন চাচার শ্বশুর। বড় মুরুব্বী। ভাবেন, এসব কথা এখন ভেবে লাভ নেই। কিন্তু কান্নাকাটি করে শান্ত হতে না হতেই লোকজন সামনে এসে দাঁড়ায়। 

আপনি এখানে কী করছেন দুলহা? সবাই আপনাকে খুঁজছে। 

আপনারা যান। আমি আসছি। 

আমাদেরকে বলা হয়েছে আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। 

আমি পরে যাব। 

না, এখুনি যেতে হবে। 

আপনারা আমাকে আমার আব্বাজানের জন্য কাঁদতে দিবেন না? 

হকচকিয়ে যায় উপস্থিত লোকেরা। কী বলবে বুঝতে পারে না। তারপর এক পা দুপা করে পিছিয়ে চলে যায়। একটু পরে তাঁর মামা নিজেই আসেন। 

কী হয়েছে মির্জা নওশা? 

চাচাজান আব্বাজান ছাড়া আমার বিয়ে হবে এটা আমি ভাবতে পারছি না। 

যাঁরা মারা যান তাঁরা নেকবান হলে বেহেশতে যান। তোমার আব্বাজান চাচাজান নেকবান মানুষ। তাঁরা তোমাকে দোয়া করবেন। বিয়ে তো হবেই। বিয়ের সব আয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এসো, ঘরে চলো। 

যেতে যেতে মামাকে জিজ্ঞেস করেন গালিব, বিয়ে হলে কি আমার ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে? 

কেন বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি যত খুশি ঘুড়ি ওড়াতে পারবে। আমি তো জানি তুমি রাজা বলবান সিংয়ের সঙ্গে ঘুড়ির প্যাচ লড়তে ভালোবাসো। ওই বাড়ির ছাদে তোমাকে আমি ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছি। 

তিনি শক্ত করে মামার হাতের মুঠি ধরেন। নির্ভরতার জায়গা খুঁজে নেন।

দুপুরবেলা মা বলেন, এই খুশবু পানি দিয়ে তুমি গোসল করবে। 

কেন আম্মাজান? 

আজ তোমার বিয়ে। তোমার শরীর সুগন্ধীতে ভরে থাকবে। তোমার শেরওয়ানি, পাগড়িতে খুশবু মাখিয়ে রাখা হয়েছে। 

তিনি ভীষণ লজ্জা পান। কথা বলতে পারেন না। মা তাঁর গায়ে পানি ঢেলে দেন। তিনি চোখ বুজে পানির খুশবু উপভোগ করেন। ভাবেন, বিয়ে হলে মানুষের একজন সঙ্গী হয়। সেই সঙ্গীর সঙ্গে মানুষ সারা জীবন থাকে 

হয়েছে, গোসল শেষ। এবার গা মুছে ফেল। 

মা তাঁকে নতুন একটা গামছা এগিয়ে দেন। তাঁর গা মোছা হলে নতুন পায়জামা পরতে দেয়া হয় তাঁকে। 

এতকিছু সব নতুন কেন আম্মাজান?

আজ যে তোমার খুশির দিন। 

বিয়ে মানে কি খুশির দিন? 

হ্যাঁ, বেটা। আজ তোমার তেমন দিন। 

খুশির দিন তো নাও হতে পারে আম্মা। দুজনের ঝগড়াঝাটি হতে পারে।

তা তো পারেই। তারপর আবার ঝগড়া মিটমাটও হয়ে যায় বেটা।

যদি না হয়? যদি কেউ কাউকে দেখতে না পারে? তখন কী হবে?

ওহ বেটা, আজকের দিনে এসব কথা ভেবো না। 

তাহলে এসব ভাবনা সারা জীবনের জন্য থাকুক আম্মাজান। 

তাঁর মা এক মুহূর্ত থমকে তাঁর মুখের দিকে তাকান। তারপর মৃদু হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, দোয়া করি তোমার জীবন সুখে- শান্তিতে কাটুক। 

মাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, আম্মাজান সুখ-শান্তি কী? 

বড় হতে হতে একটু একটু বুঝবে। এসব ব্যাপার একদিন দুদিনে বোঝা যায় না। চলো খাবে। তোমার জন্য আজ অনেক কিছু রান্না হয়েছে। 

ইউসুফ খাবে না? ছোটি খানম? 

দুজনেই দস্তরখানার সামনে বসে আছে। একটু পরে চেঁচামেচি শুরু করবে। 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ান গালিব। চুলকে ফাঁপিয়ে আঁচড়াতে তিনি পছন্দ করেন। আর ইউসুফ সুযোগ পেলেই তাঁর চুল এলোমেলো করে দেয়। খেতে খেতে গালিব মাকে বলেন, চাচাশ্বশুর বলেছেন বিয়ের পরে আমি দিল্লিতে থাকব। 

হ্যাঁ, তোমার শ্বশুর খুব বড়লোক। তিনি তো দিল্লিতে থাকেন। তোমাকেও দিল্লিতে থাকতে হবে। 

তখন ইউসুফের সঙ্গে খুব কমই দেখা হবে আমার। আমার ছোট ভাইটির সঙ্গে খেলাধুলাও বন্ধ হয়ে যাবে। 

ইউসুফ সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি আপনার মতো দাবা খেলতে পছন্দ করি না।

তুমি যেটা পছন্দ করো আমি তো সেটাই খেলি। আমি তো না বলি না।

আহ, তোমাদের কথা বন্ধ কর। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না।

দুজনে চুপচাপ খায়। 

.

সন্ধ্যায় দুলহার সাজে সাজানো হয় গালিবকে। 

ছোটভাই ইউসুফ একটু পর পর ওর শেরওয়ানি ধরে টানে, নাগরা জুতা খুলে নিয়ে যায় এবং এক সময় বলে, আমিও বিয়ে করব। আম্মাজান আমাকে নতুন পোশাক দিন। 

হঠাৎ করে গালিবের মনে হয় ইউসুফ বোধহয় পাগলামি করছে। ওকে কেমন এলোমেলো দেখাচ্ছে। পরক্ষণে মনে হয় ধুত বাজে ভাবনা। আজকের দিনে খারাপ চিন্তা করতে নেই। তাঁর ভীষণ ভয় করতে শুরু করে। 

এক সময় মামাকে বলে, মামা বিয়ের পরে যখন বাড়ি ফিরব তখন আমাকে যমুনা নদীর ধারে নিয়ে যাবেন। 

রাতের বেলা যমুনা নদীর ধারে? ওখানে কেন যাবে? 

আমার যেতে ইচ্ছে করছে সে জন্য যাব। তখন আমার সঙ্গে কেউ থাকবে না। আমি একা থাকব। 

পাগলামি করবে কেন মির্জা নওশা। 

এটা পাগলামি নয় মামা। 

অতটুকু ছেলের গম্ভীর কণ্ঠে অলৌকিক কিছু একটা ধ্বনিত হয়। অবাক হয়ে তাকান গালিবের দিকে। বলেন, জীবন খুব কঠিন মির্জা নওশা। আমি বুঝেছি যে তুমি কবিতা লেখার কথা ভাবছো। 

তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি ভয় পাই না। 

তোমাকে জীবিকার চিন্তা করতে হবে। ভাবতে হবে কীভাবে সংসার চালানো যায়। 

যখন করতে হবে তখন করব। এখন আমি যা বলেছি তা হতে হবে। আমি যমুনার তীরে যাব। 

মামা ওকে কিছু না বলে ক্রুদ্ধ হয়ে বাইরে বের হন। টাঙ্গা সাজানো হয়েছে কিনা দেখার জন্য একে-ওকে ডাকেন। তখন রজব জং বরযাত্রী হয়ে যাবার জন্য টাঙ্গা থেকে নামেন। 

কেমন আছেন ওস্তাদজী? 

শরীরটা বেশি ভালো নেই। তারপরও আসতে হয় যে কবি মির্জা নওশার বিয়ে। আমি তো না এসে পারি না। আমার এই জীবনে একজন কবিকে আমার দেখা হলো। 

আমার বোনের ছেলে বায়না ধরেছে যে বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে ওকে একা একা যমুনা নদীর পাড়ে যেতে দিতে হবে। 

তাই নাকি। মারহাবা। বহুৎ খুশির খবর।

খুশির খবর? কী বলছেন আপনি? 

তুমি বুঝতে পার নি, কিন্তু আমি ঠিকই বুঝেছি ওর মনের খবর। তুমি ওকে একা না ছাড়তে চাইলে আমি ওর সঙ্গে থাকতে পারি। 

আপনাদের মনে এমন পাগলামির ভাব কেন ওস্তাদজী তা আমি বুঝতে পারছি না। 

বুঝবে না, বুঝবে না। রজব জংকে অস্থির দেখায়। তোমার টাঙ্গা তো তৈরি দেখছি। বিসমিল্লাহ বলে রওনা কর তোমরা। 

আমি মির্জা নওশকে নিয়ে আসছি। 

রজব জং খুশিতে উচ্ছ্বসিত। এই ছেলেকে তাঁর বোঝা হয়ে গেছে। ও একটা কিছু হবে। ওকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা নেই। ওর জন্মের সময়ে যমুনা নদী তো এই খবরই দিয়েছিল। 

.

যমুনা নদীর পাড়ে গালিব একা।

আজ তাঁর বিয়ের রাত। মানুষজনের খোশগল্পে, দামি আহারে অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। বাকি রাতটুকু তাঁর একার। বন্ধুদেরকেও সঙ্গে রাখেননি। 

তিনি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন। তিনি জানেন তাঁর মামা দূরে লোকলস্কর রেখে দিয়েছে। ওরা মাঠের মধ্যে বসে আছে। তাঁর যখন বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হবে তখন টাঙ্গাওয়ালা তাঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। 

একজন ফৌজী অফিসার হয়ে জীবনকে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়োজিত রাখার ইচ্ছে তাঁর নেই। এই বয়সেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর হয়ে গেছে। 

তিনি দু’হাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলেন, যমুনা নদী, আজ থেকে আমি স্বাধীন। আমার মতো করে আমি বড় হব। যমুনা নদী, তুমি আমার বন্ধু। তোমার পাড়ে পাড়ে ঘুরে আমি শৈশব কাটিয়েছি। নদী, তুমি আমাকে সারা জীবন ভালোবাসা দিও। মানুষের জীবনে নদীর ভালোবাসা খুব দরকার। আমি যেখানেই থাকি না কেন আগ্রা শহরকে ভালোবাসার কথা জানাবে আমার শরীর। এর প্রতিটি ধূলিকণা লেগে থাকবে আমার শরীরে। এই শহরের গাছের ওপর আমার ভালোবাসা বৃষ্টির বিন্দু হয়ে ঝরবে। আজ রাতে তোমাকেই সাক্ষী করছি যমুনা নদী। 

গালিব দু’হাতে চোখের জল মোছেন। 

.

কয়েকদিন পরে তিনি আবার যমুনা নদীর পাড়ে আসেন। বলেন, নদী আমি দিল্লি চলে যাচ্ছি। আমি কবি হব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *