শেষ – ৯

শিহাব বললো, “আমি তোমার গল্পটা ঠিক বুঝে উঠছি না। তুমি সবকিছুই বলছো আবার কিছুই বলছো না।”

হাসান বিস্মিত হয়ে বললো, “কীরকম?”

“তোমার সাথে নিতুর বিয়ে হলো কেমন করে? দুবছর আগে সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তোমাদের কি ডিভোর্স হয়েছে?”

হাসান বললো, “এই প্রশ্নের আগে আরও একটা প্রশ্ন আসে। নিতুর সাথে রুদ্রের বিয়ে হলে পরে খুলনায় সে পালিয়ে এসেছে কেন? যে মুহূর্তে আমরা দুজন নদীর কিনারায় রূপসার ঘোলা জলে এক লক্ষীপেঁচার ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করছি, তখন রুদ্র কোথায়? তাদের কি ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?”

হাসান চুপ করে থাকে। তার গল্পের চরিত্রগুলো ভাগ হয়ে ছোটো ছোটো গলির ভেতরে মিশে গেছে। তাদের আলাদা আলাদা জীবন, কিন্তু সবাই একটা জায়গায় এসে মিলিত হয়। সেখান থেকে সবাই আবার আলাদা হয়ে যায়।

হাসান বললো, “সেদিন রূপসা নদী থেকে ফিরে আসার সময় নিতুর কাছে একটা ফোন আসে। মুহূর্তেই তার মুখটা কেমন শুকনো হয়ে গেল। ফোন রাখার পর জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে?”

নিতু বললো, “আমাকে একটা ট্রেনের টিকেট যোগাড় করে দিবেন?”

“কোথায় যাবেন আপনি?”

“ঢাকা। কাল সকালেই।”

“আপনি বাসায় ফিরে যাচ্ছেন তাহলে?”

নিতু কথার জবাব না দিয়ে তিশাকে ফোন করে।

“হ্যালো তিশা, রুবা আন্টি কি দেশে এসেছেন?”

ফোনের ওপাশ থেকে তিশা কী বলছে সেটা জানি না। তবে হঠাৎ করে নিতু চোখ ভর্তি জল নিয়ে বললো, “আমি চলে আসছি।”

জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে?”

নিতু কথার জবাব না দিয়ে বললো, “পারবেন তো?”

“কী?”

“ট্রেনের টিকেট।”

আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখের অগণিত জলের সমাবেশ আমাকে নবজাত করে। একটা কবিতা লেখার সময় সঠিক শব্দের সন্ধানে যেরকম কাঠখড় পোহাতে হয়, তেমন একটা নিরেট থমথমে মুহূর্ত।

পরদিন সকাল নয়টা। খুলনা জংশন রেলওয়ে স্টেশন। নিতু জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, “সামনেই আমাদের ভুল স্টেশন। দেখবেন দিনের আলোয় সব কেমন ফ্যাকাশে লাগে।”

ট্রেন ছেড়ে দিলো। নিতু কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকে জানালায়। রোদ পড়েছে।

আমি বললাম, “সেবার একটা বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে আমরা বসে ছিলাম।” নিতু বললো, “আপনি ঢাকায় যাচ্ছেন কেন?”

আমি বললাম, “অফিসের কাজ প্রায় শেষ। দুদিন আগে ফিরে যাচ্ছি।” হাসানকে থামিয়ে দিয়ে শিহাব বললো, “কিন্তু তুমি তো অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলে।”

সেটা তাকে মিথ্যা বলেছিলাম।’

শিহাব জিজ্ঞাসা করে, “তারপর? একটু যদি সংক্ষেপে বল।”

“আমরা ট্রেনে উল্টো দিকের বগিতে বসেছিলাম। যাচ্ছি সামনে, তাকিয়ে আছি পেছনে। নিতুকে জিজ্ঞাস করলাম, “হঠাৎ ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন কেন?”

নিতু বললো, “বাবা চলে গেছেন।”

“কোথায়?”

“রুবা আন্টির কাছে।”

“রুবা আন্টি দেশে ফিরেছেন?”

“তাই তো বললো।”

“কিন্তু এখানে আপনার কী করার আছে? আলাদা থাকার জন্যই তো ডিভোর্স হয়েছে।”

নিতু চুপ করে থাকে। সম্ভবত তার কী করার আছে সেটা সে জানে না। জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার রাগটা কার উপর?”

নিতু বললো, “অনেক বছর আগে বাবা-মা দুজনেই রুবা আন্টির সাথে অন্যায় করেছিল। একজন তার বান্ধবী, অন্যজন প্রেমিক। কিন্তু সেটা অতীত। সেটার জন্য অন্য একটা অন্যায়কে আমি সমর্থন করি না।”

বাইরে স্টেশনের রাস্তা, এই গ্রাম এই মফস্বল, খালি জমিনে টেপ টেনিসের টুর্নামেন্ট, দুপুরের কাক, বিষণ্ন পুকুর, নির্জন গোরস্থান, একটা দুটো শান্ত প্ল্যাটফর্ম পেছনে ফেলে আমাদের ট্রেন ছুটে চলে যাচ্ছে। নিতু খুলনায় আসার পথে তার পাশের সিটে যে অপরিচিত মানুষটা বসে ছিল, ফিরে যাচ্ছে সেই মানুষটাকে সাথে করে নিয়ে।

আমি বললাম, “কথা হয়েছে বাবার সাথে?”

নিতু না সূচক মাথা নেড়ে বললো, “বাবা চলে গেছেন রুবা আন্টির কাছে। সংসারটা আর নেই কোথাও।”

আমি বললাম, “রুদ্র? রুদ্র কোথায়?”

নিতু চুপ করে থাকে। কিন্তু এই প্রশ্নটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। সেদিন তাদের বিয়ে হলে নিতু এখানে কেন? নিতুর সাথে পরিচয় হবার পর তিনটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমটি রুদ্রের চিঠির মধ্য দিয়ে এক প্রেমিকের আগমন। দ্বিতীয়টি, মগবাজার কাজী অফিসে সেই প্রেমিকের সাথে বিয়ে। আর তৃতীয় সত্যটা আমি জানি না, রুদ্র কোথায়!

নিতু সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে। ট্রেনের রেডিওতে বেজে চলেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ব্যাকুল মনের ভেতরে স্পৃহা জাগে, একটা সুন্দর স্বপ্নকে বর্ণনা করতে গেলে স্বপ্নের ভেতরে যে রুঢ় বাস্তবতা এসে বিরক্ত করে, সেটাকে আপন করে নিতে হয়।

“কবে তুমি গেয়েছিলে, আঁখির পানে চেয়েছিলে
ভুলে গিয়েছি।
শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে ওই নয়নের তারা।
তুমি কোন কাননের ফুল কোন গগনের তারা।”

রবীন্দ্রনাথ ভালো করেই জানতেন, মানুষের আবেগ অনুভূতি কোথায় গিয়ে শেষ হয়। জীবন সায়াহ্নে এসে বলেছিলেন, “আমাকে ভুলতে পার, আমার গান ভুলবে কী করে?”

আসলেই তো! গানের অক্ষর মনের ভেতরে লেপ্টে থাকে বিভীষিকাময় রাতে কিংবা যান্ত্রিক কংক্রিটের দেয়ালে।

বললাম, “কাটলেট খাবেন?”

নিতু কোনো জবাব দিলো না। বোধ হয় সে ঘুমিয়ে গেছে। সে কী স্বপ্ন দেখছে? আমার তার স্বপ্নটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। দুজন মানুষ যদি ঘুমের ঘোরে একই সময়ে একই স্বপ্ন দেখতে পেত, তখন স্বপ্নের ভেতরে দ্বন্দ্ব বাঁধলে সেটা কার নিয়ন্ত্রণে থাকতো?

বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ, ফসলের জমিন, মসজিদ, খোলা জানালায় উন্মুক্ত সংসার অতিক্রম করে আমরা তখন প্রায় ঢাকার কাছাকাছি। ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছি এই ব্যাপারটা আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিল। শরীর ঘুমিয়ে যাবার আগে যদি কেউ কেউ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেয়, তখন মস্তিস্কের ভেতর থেকে এরকম একটা ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়। এর নাম হিপনিক জার্ক।

বললাম, “আমরা প্রায় চলে এসেছি। কিছু খাবেন আপনি?”

নিতু চোখ মিটমিট করে বললো, “সব তো শেষ হয়ে গেছে।”

আমি শক্ত করে বললাম, “আপনি শেষ না হলে কিছুই শেষ হবে না।”

“আমি খাবারের কথা বলছি। এইসময় ট্রেনে থাকে না কিছু।”

আমি প্যাকেট থেকে একটা ঠান্ডা কাটলেট আর দুই পিস চিকেন বের করে দিলাম।

“চা খাবেন?”

“চিনি কম করে দিতে বলবেন।”

ট্রেনের শেষ এক ঘণ্টা হয় সব থেকে দীর্ঘতম এক ঘন্টা। কিন্তু আমি সময়টাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। মুহূর্তের সৃষ্টি সময়ের হাত ধরে। অথচ দুটো কত ভিন্ন স্বভাবের। সময় বয়ে চলে; আর মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে।

মানুষও ঠিক তাই। যেতে যেতে কিছু পথ বয়ে বেড়ায় আর কিছু পথ দাঁড়িয়ে থাকে। শত বছর আগে জিবরান বলে গেছেন, “মানুষই পথ, আবার মানুষই পথিক।”

বললাম, “রাতে ঘুম হয়নি?”

“না।”

“খুব আনন্দে আর খুব কষ্টে মানুষ ঘুমাতে পারে না।”

“তাহলে কী করা উচিত?”

“খুব সহজ। আনন্দ এবং দুঃখ সংক্রামক। কাউকে আনন্দের কথা বললে আনন্দ হয় দ্বিগুণ। আর দুঃখের কথা বললে দুঃখটা দুভাগ হয়ে যায়।”

“এই সমীকরণ কোথা থেকে পেয়েছেন?”

“ভেবে বের করেছি। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। আমাদের হরমোনের…”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিতু বললো, “জ্ঞানের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।”

আমি বললাম, “আপনি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?”

“কষ্ট তৈরি করতে নিশ্চয়ই কিছু কাঁচামাল লাগে। কেউ নিজেকে এমনি এমনি কষ্ট দেয় না”

.

আমরা প্রায় চলে এসেছি। সন্ধ্যার একটু আগে আমরা তখন ঢাকা বিমান- বন্দর রেল স্টেশনে। মনে হলো এটা একটা ট্রেনের দীর্ঘতম গল্প। যে গল্প শুরু হয়েছিল একটা ভুল স্টেশন দিয়ে। আর শেষ হয়েছে এই নিরেট থমথমে সন্ধায়।

আমি বললাম, “একটা ব্যাপার জিজ্ঞাসা করা হয়নি।”

“কী?”

“আপনি ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন কেন?”

নিতু বললো, “আমি হারাতে চেয়েছিলাম” তারপর একটু যেন চিন্তা করে বললো, “নিজেকে খোঁজার জন্য।”

“নিজেকে খোঁজার জন্য হারাতে হয় নাকি?”

“আমরা মানুষকে বিচার করি তার কনশাস মাইন্ডের কর্মকাণ্ডে। কিন্তু সেটা মানুষের ছায়া।”

“তাহলে মানুষটা কোথায়?”

“একজন মানুষ প্রতিদিন প্রায় বারো থেকে ষাট হাজার চিন্তা অবচেতন মনে করে।”

“অবচেতন মনে চিন্তাগুলো আসে কোথা থেকে?”

“চিন্তা করতে ভাষার দরকার হয়। কার্ল মার্কস মানুষকে নিয়ে দারুণ একটা ব্যাখ্যা করেছেন। বাবুই পাখি শত শত বছর ধরে একই কায়দায় বাসা বাঁধে। কোথাও তার পরিবর্তন নেই। কিন্তু মানুষ? এখানেই তার অলংকার।

ট্রেন থেকে নেমে নিতুকে একটা সিএনজি ঠিক করে দিলাম। বললাম, “চলুন আপনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেই।”

নিতু বললো, “আমি একা যেতে পারব।”

আমার মন খারাপ হলো। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, পথেরও একটা নির্লিপ্ত চাহনি থাকে।

নিতু বললো, “আপনার বাসা কোথায়?”

আমি বললাম, “আপনার বাসা থেকে একটু সামনেই, মহাখালী।”

“আমার বাসা কোথায় সেটা আপনি কীভাবে জানেন?”

“কতবারই তো বললেন বনানীর বাসার কথা।’

আমাদের সিএনজি বনানীর রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। বাইরে থেকে বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। আমি বললাম, “যখন দরকার হবে, আমাকে জানাবেন।”

নিতু মৃদু হেসে বললো, “দরকার না হলে?”

“দরকার না হলেও জানাবেন।”

খানিকক্ষণ আমরা দুজন চুপ করে ছিলাম। আমাদের নীরব কথোপকথনে কেবল আমি একাই ছিলাম কি না সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। ফেলে আসা একটা শহর ছেড়ে একসময় নিতুর বাসার সামনে এসে সিএনজি থামে।

নিতু জিজ্ঞাসা করে, “আপনি যাবেন কী করে?”

“এই সিএনজি নিয়েই চলে যাবো।”

“বাসায় কে থাকেন?”

“মেজো মামা।“

“আর কেউ না?”

“জি না।”

বাসায় ফেরার পথে মাঝরাস্তায় সিএনজি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মন খারাপের কারণ নির্দিষ্ট করতে না পারলেও এইটুকু বুঝেছি, এই দুঃখটা আমার কাছে একেবারেই নতুন।

কবি আরণ্যক বসুর কবিতার মতো।

“আসলে কথারা সব বিলুপ্ত পাখির ঠোঁটে শিলালিপি হয়ে আছে
আসলে কথারা সব নিঃশেষে মুছে গেছে আলোকবর্ষ দূরে
তারাহীন নীল অন্ধকারে
আসলে কথারা এসে ফিরে চলে গেছে সেই
মটরশুঁটির ক্ষেতে, সবুজে সবুজে।”

অনেকটা পথ হেঁটে রাত দশটায় বাসায় ফিরি। দরজা খুলে দেয় রহমত। রহমতের বয়স উনিশ। তার একমাত্র কাজ মামার সাথে থাকা। একেতো বয়স হয়েছে। তার উপর প্যারালাইজড। বেশিরভাগ সময় বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে থাকেন। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি সারাদিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন?”

মামা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, “আকাশ দেখি।’

“আকাশ?”

“হু।”

“আকাশ দেখে শেষ করতে পারবেন?”

“কক্ষনো না।”

“তাহলে সারাক্ষণ তাকিয়ে কী দেখেন?”

“দূর থেকে সব নক্ষত্রকে একই রকম দেখায়, অথচ কাছে গেলে দুটো আলাদা জগত।”

“মানুষের মতো?”

মামা হেসে বললেন “মানুষ আরও জটিল।”

“কীরকম?”

“দুটো মানুষের মাঝখানে একটা সেতু থাকে। আমরা হয়তো সেতুর দূরত্ব কমাতে পারব, কিন্তু সেতুর অস্তিত্ব বাতিল করতে পারব না।”

.

একদিন রাস্তার ধারে দেখা মেজো মামির সাথে। মামির সাথে সেই অফিসের কলিগ। ভদ্রলোকের নাম ইমতিয়াজ। যিনি প্রায় সময় আমাদের বাসায় এসে মামার সাথে গল্প করতেন। দেশের খবর কী, ব্যবসা বাণিজ্য কেমন যাচ্ছে এইসব হালকা কথা বার্তার এক পর্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন “মানুষ চেনা বড়ো শক্ত কাজ।”

আমাদের দূরত্ব এমন ছিল, আমি জানতাম মামি আমাকে দেখতে পাবেন। আমাকে দেখে আগ বাড়িয়ে কথা বলে কি না, সেই ইতস্তত মুহূর্তের দায়ভার মামির উপর ছেড়ে দিয়ে চোখ সরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মামি ডাক দিলেন “হাসান!”

মামিকে দেখে চমকে উঠেছি এরকম একটা মুখ করে বললাম, “আপনি? এদিকে কোথায়?”

মামি বললেন, “চেহারার এ অবস্থা কেন?” শুকনো হাসি দিয়ে বললাম, “কাজের চাপ প্রচুর।”

আমাকে কোলে-পিঠে বড়ো করেছে এই মানুষটা। দু-পা শক্ত করে যতটুকুই আজ দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে এই মানুষটার ত্যাগ আছে। সেই সব বিকেল ভর্তি ভালোবাসা কোনো ফিরতি ধন্যবাদের আশা না করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। গড়গড়া কুলি করে অযু করা কিংবা ফুলের মতো গোল্লা করে জুতার ফিতা বাঁধা, এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনের ঋণ আমার তার কাছ থেকে পাওয়া।

ইমতিয়াজ আংকেল বললেন, “অফিস কি আগেরটাই?”

আমি মাথা নাড়ালাম, “জি।”

আগে প্রায় আসতেন আমাদের বাসায়। বিয়ের পর সেদিনই প্ৰথম দেখা। সেটা কতখানি অপ্রত্যাশিত, কতখানি হবার কথা ছিল জানি না। শুধু জানতাম একদিন সবাইকে তার হিসেব দিতে হয়। বাইরে থেকে দেখতে গেলে একরকম, কিন্তু ভেতরে অন্য আরেকটা সত্যের মানে থাকে। জিবরান খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন, “যে বাঁশি তোমার আত্মাকে প্রশাসিত করে তা কি সেই বাঁশ নয় যাকে ছুরি দিয়ে ছিদ্র করা হয়েছে?”

মামি বললেন, “বিয়ে করেছো?”

“করলে তো জানতেন।” বলেই একটু চিন্তা করলাম আমি। কেমন করে জানবেন? ডিভোর্স হবার পর থেকে মামির সাথে আমাদের পরিবারের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।

হঠাৎ মেজো মামা অসুস্থ হয়ে পড়লে একদিন শুধু এসেছিলেন মামি। হসপিটালে নেবার পর ডাক্তার বললেন, “বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

মামাকে কিছু বুঝতে না দিলেও কীভাবে যেন মামা আঁচ করেছিলেন। বললেন, কেবিন বদলাতে চান।

“এখানে কোনো সমস্যা?”

“জানালা নেই।”

“জানালা দিয়ে কী করবেন?”

“এই শেষ যাত্রায় একটু আকাশ দেখে যাই।”

আমি হেসে বললাম, “শেষ যাত্রা না ছাই। মামিকে একটা খবর দিবো?”

মামা নিষেধ করলেও কোথায় যেন একটা ভয় করছিল। মামিকে ফোন করে খবর দেই। পরদিন সকালে হসপিটালে যখন এলেন, মামার কাছে আসেননি। কেবিনের বাইরে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন যতটা দেখা যায়, অন্ধকারের ভেতর থেকে অধিক গাঢ় অন্ধকার।

এরকম একটা অস্থিরতার ভেতরেও জীবনের একটা মৌলিক চাহিদা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মানুষ যখন হারায়, সম্পর্কগুলোর কী হয় তখন? মানুষ হারায়। সম্পর্কও কি হারায়?

সেদিন পথের ধারে ইমতিয়াজ আংকেলকে তার কথাটা ফেরত দিয়ে বললাম, “মানুষ চেনা বড়ো শক্ত কাজ। কথাটা আসলে সত্য না, মানুষ চেনা খুব সহজ।”

তিনি ভ্রু কুচকে বললেন, “মানুষ চেনা খুব সহজ?”

“হুম, এর জন্য মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে। অবিশ্বাসী দুজন মানুষ কেউ কাউকে জানতে পারে না।”

মামি ইতস্তত হয়ে বললেন, “কোথায় যাচ্ছিলে?”

“ডাক্তারের রিপোর্ট নিতে। মামার শরীর ভালো না।”

“কী হয়েছে আবার?”

“ডান পাশের হাতেও সমস্যা হচ্ছে।”

পড়ন্ত রোদে জীবনের অদ্ভুত এক সমীকরণে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজন। কারো প্রতি আমার কোনো অধিকার নেই তবু এই যে অভিমান, সেটা হয়তবা আমার ইচ্ছা শক্তির ফসল। কারো ন্যায় অন্যায় নির্ধারণ করে দেবার আমি কেউ না, কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে এই যে অভিমান বুকে পুষে রাখি, সেটা আমার একান্ত নিজের।

ইমতিয়াজ আংকেল একটু সামনে গিয়ে একটা সিএনজি দাঁড় করালেন।

মামি বললেন, “একদিন আসব আমি।”

আমি বললাম, “বাসা বদলেছে।”

“আর কী কী বদলেছে?”

“হুইল চেয়ার। বারান্দার আকাশ।”

মামি অবাক হয়ে বললেন, “বারান্দার আকাশ?”

“হুম, মামা প্রায় সময় বারান্দায় বসে আকাশ দেখেন। জিজ্ঞাসা করলে বলেন, “দেখতে একই রকম অথচ দুটো আলাদা জগৎ।”

মামি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রইলেন। কেন অসহায় বোধ করছেন সেটা অবশ্য আমার কাছে পরিষ্কার না। যে অন্যায় করে না সে অন্যকে দোষারোপ করে হালকা হতে পারে। কিন্তু আপনি যখন কাউকে দোষারোপ করতে পারছেন না আবার একই সাথে কষ্ট পাচ্ছেন, এটা আরও বেশি কষ্টের।

অথবা এসবই মুহূর্তের একটা বিভ্রম। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পেছন থেকে একটা স্মৃতি এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অতীতে। নিমিষেই চলে যাওয়া অসংখ্য পালতোলা সারি সারি নৌকার কাছে, যেখানে অপেক্ষমাণ মুহূর্তরা ঘাপটি মেরে থাকে।

তারপর আবার হাঁটার সময় রাস্তায়, সেই সব মুহূর্ত অতীত থেকে সারি সারি অতীত পেছনে ফেলে এসেই কদম ফেলতে হয় পায়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *