শেষ হাসি
অল্প দু-চারখানি নৌকোর যাতায়াত শুরু হয়েছে সবে। কালীনগরগঞ্জের এটা মরসুম নয়। নতুন ধান ওঠেনি এখনও। আসল কারবার ধানের, তারপরে গোরুভেড়া ছাগল। এই বর্ষার সময়ে সেটাও কম। ভেড়ি বাঁধের গায়ে সারি সারি, রাশি রাশি নৌকো যেন চিত হয়ে পড়ে ঝিমোয় এ সময়ে। হাসনাবাদ থেকে গোসাবা যাতায়াতের পথে যখন কোম্পানির লঞ্চ ঢেউ তুলে দিয়ে যায়, তখন বেকার নৌকোগুলি যেন বড় বিরক্ত হয়ে খানিক দোলে। তারপর জল শান্ত হয়ে যায়, নৌকোগুলি ঝিমোয় আবার। গঞ্জের মানুষগুলিও। কারবার তেজী না থাকলে তাদের দেহ-মনেও মন্দা লাগে। তবুও আজ হাটের দিন। আনাজ তরিতরকারি উঠবে কিছু। আশেপাশে মানুষেরা নিজের বেচা-কেনা করবে।
গঞ্জ থেকে খানিকটা নিরালা দক্ষিণে, নদীতে বিনজাল পাতে ঈশান। কালীনগরের উত্তরে, পশ্চিমপারে আখড়াতলায় মানুষ সে। কিন্তু চিরকালই এগিয়ে এসে জাল পাতে, মাছ ধরে।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। বর্ষার একটু ধরন হয়েছে কয়েকদিন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের পোড়া আকাশ এখন চকচকে নীল। অনেক বৃষ্টি গেছে, গোটা আকাশখানি জলে ধুয়ে ফিরে পেয়েছে আসল রং। সূর্যের আলো পড়লে চোখ রাখা যায় না নীলের এত ঝকমকানি। আকাশের এদিকে ওদিকে আছে। সাদা মেঘের টুকরো। এ মেঘ ভিনদেশি-আসে দূর থেকে, যায় দূরে উধাও হয়ে। যেখান দিয়ে যায়, সেখানকার মনগুলিও যেন কেড়ে নিয়ে যায়। কোথায় যেন ডাক দিয়ে যায়।
বাতাসের গতিক বোঝা যায় না। কখন বাঁধের দুপাড় ধরে গেমোগাছের বনে বাতাস শনশনিয়ে যায়। কখনও যায় থমকে। কে যেন তাকে ধরে রাখে অদূর সমুদ্রের কোলে।
আশেপাশে গ্রামের চিহ্ন কম। অধিকাংশই আবাদ অঞ্চল। যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজের বিস্তার। আর ভেড়িবাঁধের সুদূর প্রহরা। নোনা জলে বুক চেপে আছে দাঁড়িয়ে।
নদীর নাম বেতনি। ইছামতীরই ফালি ফ্যাকড়া। এখানকার লোকেরা বলে পেতনি, পেতনি নদী। রূপে সে ভয়ঙ্করী নয়, কিন্তু অশরীরী মায়াবিনী নানান বেশে, ফিরছে তার ক্ষুধার্ত অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে। রাজত্বটি যেন তার। তার রীতিবিরুদ্ধ অনাচার যে করে, তাকে সে মারে। কখনও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মারে গোটা আবাদের মানুষকে। কখনও একলা পেলে খায় ঘাড় মটকে। তাই গোটা নদীর পাড় জুড়ে বাঁধ। তার নোনা জল একটু চুইয়েও যাতে ঢুকতে না পারে মানুষের আস্তানায়। সে ফসল খায়, আর নিদেন তিন বছরের মতো মাটিকে দিয়ে যায় বন্ধ্যা করে।
এ জল স্পর্শেও ভয়। তাই কেউ পায়ের পাতা ডুবিয়েও দাঁড়ায় না এক দণ্ড। সে তার লকলকে জিভ দিয়ে যেমন খোঁজে বাঁধের ফুটো ফাটল, তেমনি খোঁজে মানুষ। সংসারের সেরা জীব, বড় মিষ্টি যার মাংস। পেলে গরাস ভরে যতটা পাবে, ততটাই নিয়ে যায়। বাকিটুকুতে প্রাণ যদি থাকে, সেটুকু থাকে শুধু বিভীষিকার ঘোরে খাবি খাওয়া।
বাঁকা স্রোতের পাকে পাকে ছোট ছোট ঢেউ চলকানির কোনখানে সেই হিংস্র ভয়াল কামট ওত পেতে আছে কেউ জানে না। সেদিক দিয়ে কুমির রাজকীয়। অন্তত কাছাকাছি এসে সে জানান দেয় একবার। কামট যখন ধরে তখনও টের পাওয়া যায় না, দেখা তো দূরের কথা। তাই সে থাকে মানুষের কাছে কাছে, তার তীক্ষ্ণ করাতের মতো দাঁতে দাঁত চেপে, ধূর্ত চোখের সতর্ক সন্ধানে, চতুর চলাফেরায়।
জোয়ারের জলে ঈশান বিনজাল পাতে আর এদিকে ওদিকে তাকায়। উত্তর-দক্ষিণে নদী, পুবে পশ্চিমে আড় নৌকো। জাল পাতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে, আর তাকায় দূরে অদূরে, যেখানেই জল একটু বেশি চলকায় ঢেউয়ের মাথায়, যেখানেই একটু বেশি শিউরে ওঠে বাতাসে। তীক্ষ্ণ শিকারির চোখে উৎকর্ণ হয়ে কী যেন খোঁজে সারা পেতনির জলের জোয়ারের কলকলানিতে, আর দাঁতে দাঁত চাপে। যেন কামটেরই মতো। কেন? মাছ আসবে জালে, এমন করে তাকাবার কী আছে?
কালো চকচকে শরীর ঈশানের। তলপেটের গভীর খাদ থেকে, চওড়া বুকটা যেন হঠাৎ পাথরের চাংড়ার মতো উঠেছে ঠেলে। শক্ত ঘাড়ের ওপর, চড়ানে এবড়োখেবড়ো পাথুরে মুখ। শ্যাওলা-কালো কামটের মতো ছোট ছোট চোখ দুটির চাউনিতে টের পাওয়া যায় না–কোনদিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় ভেড়ার লোমের মতো কোঁচকানো চুল।
জলের এদিকে ওদিকে দ্যাখে, তারপরে হঠাৎ ব্যাকুল অবাক চোখে ফিরে তাকায় আকাশের দিকে, ভেড়ি বাঁধের সীমানায়। আবার জাল পাতে। বিনজাল, গহিন তলে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ায় নিঃশব্দে। ওপরে ভাসে ছোল, জালের সীমানা চিহ্ন।
গেমো গাছ মাথা কাটে বাতাসে। রাই-মঙ্গলের বুক ভাসিয়ে পেতনিও ফেঁপে ফুলে ওঠে। অস্পষ্ট ভেসে আসে পশ্চিম-পাড় গয়ারমারির মোটরের ভেঁপু। ঈশান থেকে থেকে চমকায়। কী যেন নড়ে উঠল পুবের ওই বাঁকা স্রোতের জলে। আবার ফিরে তাকায় পশ্চিমে। কীসের যেন শব্দ হল ওখানে, পাড় ঘেঁষে। না, কিছু নয়। জোয়ার এসেছে। মাঝে মাঝে বাতাস একটু দুরন্ত হয়ে নাড়া দিয়ে যায়।
ঈশানের সর্পচক্ষু কেমন যেন ধকধক জ্বলে। বাঁশের ফালি পাটাতনের ফাঁক দিয়ে বার করা, ধারালো বর্শার একহাত ফলাটার দিকে তাকায়। ঝকমকে সূতীক্ষ মস্ত বর্শা, ভাদুরে রোদও যেন কেটে খান খান হয়ে যায় তার ধারে। আবার জাল পাতে ঈশান।
পশ্চিম পাড় থেকে আসা একটি নৌকো যায় কাছে ঘেঁষে। গঞ্জে যায়, মোচা, কাঁচকলা আর কেওড়া ভরতি চুপড়ি নিয়ে। কেওড়া এক রকমের টক ফল, অম্বল রান্না হয়। নৌকোটির হালে যে বুড়ো বসেছিল, সে ডেকে বলে, ঈশান নিকি গো?
মুখ না তুলে জবাব দেয় ঈশান, হাঁ।
বুড়ো আবার বলে, গোন তালি তিন দণ্ড আগেই এইসেছে, অ্যাঁ?
ঈশান জাল পাতে আর শুধু শব্দ করে, হুঁ।
গোন বলতে জোয়ার বোঝায়।
এবার একটি মিষ্টি মেয়ে-গলায় ডাক শোনা গেল, অ ঈশানদাদা, ছোট মাছ পেলি আমারে একখানা দেবা?
ঈশান ফিরে তাকায়। সেই অন্ধ মেয়েটা। লোকে বলে কানী। নাম বিমলা থেকে বিমলী। থাকে পশ্চিম-পাড়ে। ভিক্ষে করতে আসে রোজ গঞ্জে। পাড়ে এসে বসে থাকে। যাকে পায়, তাকেই পার করে দিতে বলে। এপারে ওপারে দু পারেই।
চোখের সামনে ছোট থেকে বড় হল মেয়েটা। ছ থেকে আঠারোয় উঠেছে। ছেউটি পেতনির টান ভাটার জলে এসেছে জোয়ার। একটা হাত সরু আর ছোট, কানী বিমলী কেমন যেন মায়াবিনীর মায়া মেখেছে সর্বাঙ্গে। তবে ভিক্ষে করতে বসেও রেহাই নেই। সব সময়েই চেঁচাচ্ছে, আমলো বিষ্টাখেগোর ব্যাটা, গায়ে হাত দ্যায় কোন ঢ্যামনা। তোর মার গায়ে দিতি পারিস না? তারপর ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে কাঁদে। হাটের দিনে একটু দেরি হয়। তখন সন্ধ্যার অন্ধকারের ঝোঁকে, বাঁধের আড়ালে কিংবা গেমো গাছের জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেছে কয়েকবার। যেমন ছাড়া হাঁস-মুরগি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় শেয়ালে। বিমলী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদে অগো মাগো দ্যাখ আমার কী কইরেছে। হেই। ভগমান, ওরে কামটে খায় না গো, হেই ভগমান, আমার কী দিলে গো-গতরে, আমারে শকুনে খায়।
কাঁদে, দাপায়, চুল ছেড়ে, আবার শান্ত হয়। হেসে কথা বলে বেশ লোকের সঙ্গে, ও করালী খুড়ো, যদি দুটো পয়সা দিলা, ত আমারে এটটু উত্তোর বেলে বসাইয়ে দে যাও। খুড়ি ভাল আছে তো? মাল বিকোলে কেমনু? আশেপাশে সব লোকের সঙ্গেই তার ভাব।
ঈশান মুখ ফেরাতে গিয়ে আবার ফিরে তাকায়। যেন চমকে ফিরে তাকায় তার ছোট ছোট সাপ-খপিস চোখে। কী যেন ভাবে কানী বিমলীর দিকে চেয়ে। তারপর বলে গোঙানির সুরে, তা পেলি পরে দেখা যাবেনে।
বিমলী হাসে। গর্তে বসা চোখ দুটির অন্ধকারে পেতনির জলের ঘোলা-নীল আভা যেন চিকমিক করে। পরনে একখানি আট-হাত পুরনো ডুরে শাড়ি। বাতাসে সেটি উড় উড় করে। হাত দিয়ে কাপড় সামলে বলে, দেবা ঈশেনদাদা? তালি আজ নিচ্ছয় কইরে মাছ পাবো।
ঈশান জবাব দেয় না। কিন্তু জাল পাততে পাততে, আড়চোখে তাকায় বিমলীর দিকে। পাথুরে কপাল বেয়ে গাছের শিকড়ের মতো কয়েকটা শির ফুলে ওঠে। তারপর দাঁতে দাঁতে চেপে ফিরে তাকায় জলের দিকে। বিনজাল পাতে পুবে পশ্চিমে ছড়িয়ে। হাল রাখে কোলে, অর্থাৎ পায়ে।
পেতনি নদী হাসে জোয়ারের গরবে।
যে নৌকোটি হাটে গেল, তার হালেবসা বুড়ো একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সনসার বড় তাজ্জব জায়গা। এ ঈশেন কী মানুষ ছেল, আর কী মানুষ হল। হেইসে, গেইয়ে, নেইচে, কুঁদে ঈশেন মাতাইয়ে রাখত সবারে। সকলের সঙ্গে ভাব-ভালবাসা, হাটের দিনে কত নকশা কইরেছে, হেইসে মইরেছে সবাই। জলে জালখানি পেইতে এখনও গঞ্জে এইসে বসে, ত্যাখনো বইসত। এখন মুখে রা কাড়ে না, ত্যাখন কত গল্প-ঝল্প, গাল-গপ্পো। গোন গিয়ে ভাটা পইড়ত, তবু জাল তুইলবার কথা মনে থাকত না।
কানী বিমলীর নিশ্বাস পড়ে। দক্ষিণা বাতাস তার রুক্ষ চুলের গোছা উড়িয়ে দিয়ে যায়। ছোট আর বড় দুটি হাত দিয়ে চুল সামলাতে গেলে, আট হাত কাপড়খানি অকুলান হয়ে পড়ে। বলে, হ্যাঁ, সেই ব্যাপারখানার পরে, না ঠাকুদা?
–হুঁ।
ভেড়ি বাঁধের গায়ে ধাক্কা খেয়ে বাতাস আসে। পেতনির জল ফোলে। শুধু দু জনের কেউই দেখতে পায় না, ঈশান দূর থেকে একনজরে তাকিয়ে আছে বিমলীর দিকে।
বুড়ো আপন মনেই বলে, বড় সোহাগী বউ ছেল সে ঈশেনের। যশোরের মেইয়ে, বউটি বড় দামাল ছেল। সংসারে বাপ-মা নেই, ঈশেনের। বউ একলা ঘরে থাকতে পারে না। বলে, তুমি যাবা মাছ মারতি, আমি বইসে থাকব বাঁধের উপরে। তা তাই করত ঈশেন। বউকে বাঁধে বসাইয়ে রেইখে জাল পাতত। তাপরে বউ নে ঘুইরে বেড়াইত গাঙে গাঙে। সেই নেও কত কথা, হাসি, মস্করা। তাও দুটির কোনও পেত্যায় ছেল না।…তা একদিন দুটিতে কী যেন খুনসুটি ঝগড়া হল, সে পিরিতে খুনসুটি। রাতদিনই হচ্ছে। সেদিন জাল তুইলে লৌকো বাঁধে ভিড়াইয়ে বউকে ডাকল, আয়। বউ বাঁধের উপর দে হাঁটা দিল। বইললে, আজ আখড়াতলা তক হেঁইটে যাব, লৌকোয় ওটব না। ঈশান বইললে, আসবি তো আয়, না হলি সত্যি সত্যি লৌকো ছেইড়ে দেব। বউ ঠোঁট টিপে হেইসে বইললে, দ্যাওগে। ঈশেনও তো সেইরকম। দিলে লৌকো ছেড়ে। একজন বাঁধে, আর একজন জলে। বেলা ত্যাখন যাই যাই করে। পেতনিতে ভাটা পইড়েছে। ঈশেন লগি মারছে। দু জনাই দু জনরে দেখতি পাচ্ছে। তবু ঈশেন বারে বারেই ডাকে, আয় বলতেছি, না হলি আজ তোর কপালে দুঃখু আছে। তা কে শোনে। বউ মাঝে মাঝে গেমো গাছের আড়ালে পড়ে। আবার দেখা দেয় আর টিপে টিপে হাসে। ঈশেনকে খ্যাপায়। তাপরে ঈশেন লৌকো নে সইরে গেল মাঝনদীতে। বইললে, তবে তুই থাক, আমি ওপারে যাচ্ছি। ত্যাখন বউ লেইমে এইল গেমো গাছের আড়াল থেইকে। খিলখিল করে হেইসে ডাক দিল, এইস, নে যাও। দূর যশোরের মেইয়ে। খলবল কইরে নেইমে এইল পেতনির কোমর জলে। জানত কিন্তুক মনে ছেল না বউয়ের, পেতনির জলে পেতনির মায়া আছে। ঈশেনের অবস্থাটা ভাবো। চিৎকার দিলে, আলো সব্বোনাশী, শিগগির ডাঙায় ওঠ, শিগগির। আর উইঠতে হল না। ঈশেন দেখল, বউকে কে টেইনে নে যাচ্ছে জলের তলায়। তাপর আবার ভাইসলো। ত্যাতহ্মোনে হাল মেইরে এইয়েছে ঈশেন। টেইনে তোলো বউকে। দ্যাখে, তল পেটের কাছখান থেইকে একখান উরত-শুদ্ধ পা নেই। যে ছেল জলের তলায়, সে ছেল তককে তককে। নাবালের এই য্যাতত নদী, সবখানে সে হাঁ কইরে আছে। বাগে পেইলে ছাড়ান নেই।…তা কামটের কাটা, পচন ধরে সঙ্গে সঙ্গে। বউটা মইল। তা ঈশেনও হাসি ভুইলে গেল। এখন য্যান কেমন কেমন লাগে। গোনে পাতে বিনজাল, কচাড় জাল টানে পাতে। আর ওই চুপচাপ গাঙে বইসে থাকে, না হলি গঞ্জের বাঁধে। …
ভাদুরে রোদে বিমলীর চোখের গর্ত চিকচিক করে পেতনির ঘোলা-নীল জলের মতো। বড় উদাসিনী দেখায়। যেন চুপি চুপি বলে, হ্যাঁ, চক থাকতিও মানুষ এমন কইরে মরে ঠাকুর্দা। আমি বেইচে থাকি।
দু জনে শুধু দেখতে পায় না, জাল পাতা সাঙ্গ করে, ঈশান দূর থেকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে কানী বিমলীর দিকে। আর সাপ-খপিস চোখ দুটি জ্বলে ধকধক করে। কী যেন আঁচে মনে মনে। তারপর চমকে ফিরে তাকায় জলের দিকে। কী যেন পাক খেয়ে যায় ওই দূর উত্তরের জলে? কীসে যেন ঝটকা দিল দক্ষিণের কোলে? তীক্ষ্ণ ফলা বশটিার দিকে চোখ পড়ে ঈশানের।
না, কিছু নয়। সমুদ্রের জোয়ার আসে পেতনির বুক ফাঁপিয়ে। বাতাসে মাথা কেটে গেমো বন।
ঈশান নৌকোর মুখ ফেরায় গঞ্জের দিকে। কিন্তু জলের এদিকে ওদিকে তাকায় বারে বারে। সেই খিলখিল অন্তিম হাসি শোনে নাকি বউয়ের? ছায়া দ্যাখে নাকি সেই সোহাগীর, পেতনির জলে। মন বুঝি কাঁদে।
না। ঈশান খোঁজে জলের সেই অদৃশ্য শমনকে। যাকে কখনও দেখা যায় না, কিন্তু যে আছে তারই কাছে কাছে, ছায়ায় ছায়ায়। শ্যাওলা-রং সেই ভয়াল চতুর হিংস্র যম, বিশাল দেহ আর কুতকুতে চোখ। সে চোখ মিটমিট করে হাসে আর দ্যাখে ঈশানকে। তাই ভাবে ঈশান। একবার কি ভাসে না ওপর জলে? ভীরু ঢ্যামনা। লুকিয়ে ফিরিস গহিন জলের অন্ধকারে।
কালো পাথুরে চোয়ালের ওপরে কুতকুতে চোখ জ্বলে দিবানিশি ঈশানের। যেন হিংস্র কামটেরই মতো।
মনটা আজকে এসে ঠেকেছে এইখানে। শোধ চায় ঈশান, জীবনের একটা প্রতিশোধ। একটা কামটকে চায় সে হাতের কাছে, যে এক গরাসে খেয়ে নিয়েছে সেই শেষ খিলখিল হাসি, সেই শেষ ডাক, শেষবার আসার বায়না।
ঘরে গেলে থাকতে পারে না। বউ যেন হেসে ছুটে আসে। বক্ষলগ্ন হতে। আর সতর্ক সন্ধানী হিংস্র শমন তাকে কোথায় টেনে নিয়ে অদৃশ্য হয়। আখড়াতলা থেকে আসবার পথে ফিরে যাবার অন্ধকারে ও জ্যোৎস্না রাত্রে, গেমোবনের তলায়, পেতনির জলে সেই হাসি শোনে ঈশান। ডাক শোনে, এইস, নে যাও। বুক ফাটে। জানে, সে আছে কাছে কাছে। মানুষের গন্ধ পায়, সেই গন্ধে গন্ধে ফেরে। বশাটার ফলায় হাত দ্যায় ঈশান। কোথায়! ওই যে জল ওখানে? নাকি, ওই যে স্রোতটা ল্যাজের ঝাপটা দিয়ে যায়, ওখানে! কোথায়।
শোধ চায় ঈশান। সেই নেশাই ভুলিয়ে রেখেছে সোহাগী বউয়ের সব শোক। এই নেশাটা কাটলে সে ঘরে গিয়ে মাথা কুটে দাপিয়ে মরে যাবে হয়তো। এখন শোক নয়, শোধ চায়। যদিও বউ বাঁধের উপরে উপরে ফেরে হাসে, খুনসুটি করে, চুল এলিয়ে পাগলি সাজে, তার আঁচল ওড়ে বাতাসে। যদিও চোখের কোণে ডাকে ইশারা করে। পেতনির জল কলকল করে, গেমোগাছে বাতাস শনশনিয়ে মরে। ওসব যে খেয়েছে, তাকে চায় ঈশান।
তাকে চায়, তাই মাছ মারার অছিলায় বিনজাল পাতে গহিন জলে। বিনজাল যায় সেই পাতালে। জোয়ারে বিন ভাটায় কচাড়। ওই দুই জালে কখনও সখনও ধরা পড়েছে কামট। গভীর জলের জানোয়ার। আড় মাছের আকৃতি, শ্যাওলা কালো রং, ওজনে পাঁচ থেকে দশ মন, কিন্তু বিন্দু বিন্দু চোখ। চামড়া শুয়োরের মতো মোটা। তাই দেশি কামারের গড়া দেশি লোহার বশা নেয়নি সে। কামটের গায়ে তা বিধবে না। গঞ্জের মহাজনকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়েছে ইস্পাতের বশা। তীক্ষ্ণ তার ধার। রোদও কাটে খান খান হয়ে।
ধরা পড়লে আদিবাসীরা তার মাংস খায় হাঁড়িয়ার সঙ্গে। ঈশানও খাবে কামটের মাংস। তারও মাংস মিষ্টি, কেন না সে মানুষ খায়।
পেতনির এই জলে কতদিন ঘুরেছে ঈশান বউ নিয়ে। সোহাগী বউয়ের লোকলজ্জা কম ছিল। কত দিন রাত্রি সে হেসে শিউরে তুলেছে পেতনির বুক। তার কত প্রেমকুহর একেবারে নির্বাক করেছে পেতনির কলকলানি। আর পেতনির রং-এ রং মেশানো সেই হিংস্র কামট হয়তো তখন ভেসে উঠে দেখেছে তার সতর্ক চোখে।
সেই একটি শোধ চায় ঈশান। এই নেশাটা গেলে, এদেশে কেমন করে বাঁচা যায়, এই পেতনির ধারে, বাঁধের পাড়ে, গেমোবনের বাতাসে, সেটা জানে না ঈশান।
গঞ্জের বাঁধে এসে নোঙর করল নৌকো। ওই দেখা যায় কানী বিমলী বসেছে, আনাজ হাটের সামনে। আপন মনে হাসছে। হোট হাতখানি বের করে ভিক্ষে চায়। আসল হাতটি দিয়ে শরীর। আর কাপড় সামলায়। ডাঙার কামটেরা বড় বেশি চেতন এনে দিয়েছে ওর দেহ ও মনে। ওর অন্ধ। জীবনের একটা নিরালা কোণ আছে। একটু নিরালা ঠাঁই নেই তার যৌবনের। সে-ই না বিমলীর দুঃখ। গেমো গাছে বাতাস আসে, পেতনির জল কলকল করে। বাঁচার জন্যে ভিক্ষে করে বিমলী। তবু বাঁচায় কেন সুখ নেই?
বিমলীর বুক উজিয়ে নিশ্বাস পড়ে, অন্ধ, এক হাত ছোট বিমলী। ওর জোয়ারঢেউ শরীরের মায়াবিনী রূপ দেখে সবাই।
তার দিকে অমন অপলক সতর্ক সন্ধানী হিংস্র চোখে কী দ্যাখে ঈশান।
শোধের নেশায় দ্যাখে। পাপ ঢুকেছে এখন শোধের নেশায়।
ও নেশায় মধ্যরাত্রে, পেতনির জোয়ারে নৌকোয় নিয়ে গিয়েছিল দশ মাসের ছাগল। দূর দক্ষিণে গিয়ে তাকে ফেলেছিল কামটের টোপ করে। নৌকোয় বাঁধা ছাগলের শরীর ডুবেছিল। ছাগলটা ডাকতে পারেনি। খাবি খেয়ে মরেছিল। ঈশান বল্লম হাতে সারা রাত কাটিয়েছে পেতনির বুকে। আর যেন দেখেছে, চতুর জানোয়ার কেবলই পাক খাচ্ছে আশেপাশে টোপ গিলছে না।
শেষ রাত্রে শুধু দপ দপ করেছে ঈশানের কামট-হিংস্র চোখ। গালাগাল দিয়েছে অশ্লীল ভাষায়। তারপর মরা ছাগল ছেড়ে দিয়েছে জলে। পেতনি তখন ভাটা-মুখে গেছে নেমে।
দুপুরে দেখেছিল, দুটি শিং সুদ্ধ সেই ছাগলের আধ-খাওয়া মুণ্ডুটা ভেসে এসেছে জোয়ারে। যার টোপ সে খেয়েছে ঠিক।
জলের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল ঈশান। মনে হয়েছিল, নৌকোর পাশে পাশে আছে সে। হাসছে মিটমিট করে। শুধু দেখা যায় না।
কিন্তু আখড়াতলার শূন্য ঘরে কার সোহগের আগুন যেন পুড়িয়ে মারে অষ্টপ্রহর। পেতনির বুক থেকে কেবলই ডাক ভেসে আসে, এইসো, নে যাও।
তারপর কিছুদিন পরে, প্রথম রাত্রের ঝোঁকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নৌকোয় গঞ্জের একটা কেঁদো কুকুরকে। ফেলে দিয়েছিল নিয়ে দূর দক্ষিণের বাঁকে। কুকুরটা যতবারই সাঁতার কেটে পাড়ে। উঠতে গেছে, নৌকো বেয়ে আড়াল করেছে ঈশান। অসহায় কুকুরটা জলে ঘেউ-ঘেউ করতে পারেনি। কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে নির্বোধের মতো তাকিয়েছে ঈশানের দপদপ চোখের দিকে।
ঈশান আতিপাতি করে খুঁজেছে পেতনির প্রতিটি তরঙ্গে, প্রতি স্রোতের বাঁকে। কোথায় সেই পলাতক শমন।
মাঝ রাত্রে মরতে মরতে গঞ্জের কুকুরটা ভিন্ন পাড়ে গিয়ে ঠেকেছিল। আর কোনওদিন গঞ্জে আসেনি। ঈশানের মনে হয়েছিল, ধূর্ত কামট ঘুরেছে তারই নৌকোর পাশে পাশে। আর মিটমিট করে হেসেছে তার কুতকুতে চোখে।
আজ দ্যাখে ঈশান বিমলীকে। ভাবে, খেয়া পার করতে নিয়ে যাবে আজ কানীকে। কী সুখে বাঁচে ও এই সংসারে। ওকে দিয়ে শোধ নেবে ঈশান আজ রাত্রে। তাই দ্যাখে সাপের মতো চোখে।
নেংটিপরা ঈশান। নেংটির ট্যাক থেকে বার করে একটি আনি। এগিয়ে গিয়ে হাতে দেয় বিমলীর। বিমলী আনিটা আঙুলে অনুভব করে খুশি হয়ে বলে, কে গা, কে তুমি?
সবাইকেই বলে। যদি চেনা মানুষের হয় তার। হাটের ভিড়, কে-ই বা দেখে ফিরে। যদি দ্যাখে তবে ভাবে, ফোঁসলাচ্ছে কানীটাকে। যেন গোঙা স্বরে জবাব দেয় ঈশান, আমি ঈশেন।
খুশি আর ধরে না বিমলীর, ওমা, তুমি পয়সা দিলে। আ আমার কী কপাল গো। সেই ছমাস আগে দিছিলে।
শুনতে চায় না ঈশান। সরে যেতে চায়। ভাবতে চায়, কীভাবে কাজ হাসিল করবে।
বিমলী ডাকে, ও ঈশেনদাদা, শোনো, শুইনে যাও একবারটি।
বল—
কাছখানে এইস। এইয়েছ?
হাঁটুতে হাত দেয় ঈশানের। বলে ফিস ফিস করে, সক্কাল বেলা আইসতে না আইসতে পোড়ারমুখো বেন্দা আড়তদারটা কী বলছে জান? বলে, অ বিমলী, কী কী সুখে তুই ভিখ মাগিস। আমার আড়তে এইসে থাক, সব পাবি। আমি বইলোম, দূর হও, দূর হও খচ্চর মিনসে। তা ঈশেনদাদা, হাটে-গঞ্জে মানুষ নেই গো। এত লোকের সামনে খপ কইরে আমার গায়ে হাত দিল, শরীলে আমার ব্যথা করে।
বলে কাঁদে বিমলী। ফিসফিস করে অভিশাপ দেয়। কিন্তু কার কাছে দুঃখ করে বিমলী? তার অদৃশ্য শমনের কাছে?
ঈশান কী বলবে ভেবে পায় না। দ্যাখে বিমলীর দিকে। বলে, হুঁ!
বিমলী কেমন একটু আশ্বস্ত সুখের সুরে বলে, তোমার রাগ হচ্ছে ওদের ওপরে, না? থাক, রাগারাগি কইরোনা য্যান!
সরে আসে ঈশান।
এটা আবাদের গঞ্জ। আশেপাশে গ্রাম নেই, গৃহস্থ নেই। পেতনি নদীর ধার যেন খা-খা করে। কাছে কাছে আছে কিছু আদিবাসীদের ভাঙাচোরা ঘর। চাষের মরসুম গেলে বেকার হয়ে যায়। তখন পেটে-খাবার ভাত পচিয়ে নেশা করে মেয়ে-পুরুষ। কতগুলি কালো কালো মেয়ে পুরুষ, কতগুলি শুয়োর আর গঞ্জের বিদেশি কারবারি ব্যাপারি–তাদের জন্যে কয়েক ঘর দেহজীবিনীর বাস।
জলে আছে সর্বনেশে নোনা আর হিংস্র কামট। পাড়ে আছে বেশ্যা, ব্যাপারি, আদিবাসী। এখানে গা বাঁচিয়ে বাঁচতে চায়, গায়ে-জল-লাগা বিমলী। তাও চোখ থাকলে কথা ছিল। বিমলী কানী, কেঁদে কেঁদে বলে, হেই ভগমান, আমি মরিনে কেন?
কোঁচড় ভরে মুড়ি নিয়ে বাঁধের উপরে এসে দাঁড়ায় ঈশান। মুড়ি চিবুতে চিবুতে তাকায় দূর জলে। পেতনির জল অকূল হচ্ছে। ফুলছে আরও। হাটের দিন আজ। লোকজন আসছে। ঈশান যেন দ্যাখে, শ্যাওলা কালো জানোয়ারগুলি আজ বড় বেশি ঘোরাফেরা করছে এখানকার জলে। সতর্ক সন্ধানে ওত পেতে আছে, যদি একটা কেউ জলে পড়ে। যত মানুষ, তত খাবার তো। করাত-হিংস্র দাঁত কড়মড় করে পেতনির অতলে।
ছাগলের টোপ ফসকে গেছে। বৃথা গেছে কুকুর টোপের হয়রানি। সেরা টোপ দেবে এবার ঈশান। মানুষের অঙ্গ, মেয়েমানুষের শরীর। ঝাপাঝাপি করবে অথৈ জলে। নোলা ছোঁকছোঁকান যম না এসে যাবে কোথায়, একবার দেখবে।
দপদপ করে জ্বলে ঈশানের চোখ। আবার দ্যাখে বিমলীর দিকে। হ্যাঁ, গায়ে-গতরে মাংস আছে। কানীটার। পুষ্ট, নিটোল মাংস।
নিরালায় যায় ঈশান বাঁধের উপর দিয়ে। নৌকোগুলি এত দোলে কেন কিনারায়? জল ফোলে, তাই। পেতনি বাড়ে, অতল হয়, সে আসে তলে তলে।
গেমো বন ঘন হয়, পুবে বাতাস তার ঘেটি মোচড়ায়। গঞ্জের দেহস্তূপসারিণীরা ছুটে আসে বাঁধে। কামটের মতো। দেখতে আসে, লোকের যাওয়া আসা কেমন হচ্ছে। এখন যেন তারা আবাদের গঞ্জে নিবাসিতা। মরসুমে কারবার জমে।
বাঁধের উপর এসে হাসে খিলখিল করে। কেন? কোন মাঝিকে দেখল পেতনির জলে। নামবে নাকি কোমরের জলে? বলবে, এইসো নে যাও?
আবাদের মাঠ ভেঙে বাতাস আসে পুব-সাগরের। পেতনির কোমর জলে কেউ হাসে নাকি খিল-খিল করে। কোনও সোহাগী?
না। শুনলে পরে, বাঁচে কেমন করে ঈশান। সে শোধ চায়।
কী দ্যাখো গো ঈশেনদাদা।
জিজ্ঞেস করে একটা মেয়ে। সকলেই চেনাশোনা। বউ মরার পর মানুষটা মেয়ে পাড়ায় যায় না। সেইটা এক বিস্ময়। বড় বিস্ময়, লোকটা পাগল হয়ে গেছে।
ঈশান বলে, জাল দেখি।
জাল দ্যাখে ঈশান। ওই দেখা যায়, বিনজালের ছোল ভাসে। আটকা পড়বে নাকি একটি আজ। বিনজালের বাঁধনে দাঁত খুলতে পারবে না। বেরিয়ে যাওয়ার উপায় কম।
কিন্তু আটকা পড়ে না একটাও। টোপ চায়।
হাটের মধ্যে ফিরে আসে ঈশান। বিমলীকে দ্যাখে। একটু বেলায়, ময়রার দোকান থেকে গরম জিলিপি নিয়ে আসে কিনে। ঠোঙা দেয় বিমলীর হাতে। বলে, খা, তোর জন্যে আনছি। বিমলীর চোখের অন্ধকারে বিস্মিত খুশি উপচে পড়ে। বলে, কেন গো ঈশেনদাদা। ঈশান মাথা তুলে নদীর দিকে তাকায়। চোখ যে বড় দপদপায়। দিলাম, খা।
টোপ মজায় ঈশান। বিমলী যেন কী ভেবে মিটিমিটি হাসে। আঁচলখানি টেনে দেয় বুকে ভাল করে। বলে, তুমি খাবা না ঈশেনদাদা।
ঈশান জবাব দেয়, খেইয়েছি। তোর জন্যে আনছি ওগুলোন।
কানী বিমলী সলজ্জ হেসে জিলিপি খায়।
ঈশান গোঙাস্বরে আস্তে আস্তে বলে, অ-বিমলী।
–অ্যাঁ?
–তোরে আজ আমি পার কইরে দিয়ে আসবেনে, আঁ?
একটু অবাক হয়ে হাসে বিমলী। বলে, দেবা, সত্যি? তবে বড় নিশ্চিন্ত হই ঈশেনদাদা।
ঈশানের দাঁতে দাঁত বসে। বলে, দ্যাব। বিকেলে, রহমানের আড়তের কাছে বইসে ভিক্ষে করিস, ওখেন থেইকে নে যাব।
বিমলী ভাবে, কেন, অত নিরালায় কেন? আবার হাসে মিটিমিটি। বলে, আচ্ছা। যা বল।
ঈশান বাঁধের উপর যায়। রোদ বড় চড়া। পেতনি ঝিকিমিকি করে। বাতাসটি বড় আরামের।
দুপুরে জাল তুলতে গিয়ে, জাল বড় ভারী লাগে ঈশানের। ওকোড় কাছি টানে, জাল উঠতে চায় , এত ভারী। ঈশানের দু চোখ হিংস্র উল্লাসে জ্বলজ্বল করে। পড়ল নাকি, পড়ল একটা জালে? কানী বিমলীর ভাগ্য নিয়ে?
আরও জোরে টানে ঈশান। জাল ওঠে। গরান গাছের গুঁড়ি একটা প্রকাণ্ড। জালের কোলে আটকেছে।
হতাশ ক্রুদ্ধ চোখে যেন দ্যাখে ঈশান, ধূর্ত কামট পাক খায় তারই নৌকোর আশেপাশে।
বিনজাল তুলে, কচাড় জাল পেতে, আবার গঞ্জে ফেরে ঈশান।
মরসুমের হাট নয়। সন্ধ্যা হতে না হতেই ভাঙন ধরে।
রহমানের ধানের আড়ত বন্ধ। এখন ধান নেই! লোকজন কম এদিকে। বিমলী বসে আছে এক কোণে।
এদিক-ওদিক দ্যাখে ঈশান। কারুর নজর নেই এদিকে। কে-ই বা দ্যাখে। ঈশান ডাক দেয়, চল বিমলী।
বিমলী যেন হুতাশে ছিল। মিঠে ব্যাকুল গলায় বলে, এইসেছ! বড় ভয় পেয়েছিলাম, কী জানি, ভুইলে গেলে কিনা!
নেংটি পরা ঈশান, কোমরে বাঁধা গামছা। নিকষ কালো মূর্তি, এখন যেন আরও শক্ত দেখায়। বিমলীর হাত ধরে নিয়ে যায় বাঁধের উপর। গেমো গাছের গোড়ায় বাঁধা ছিল নৌকো। বিমলীকে তুলে, বাঁধন খুলে ঈশান নৌকোয় ওঠে।
এখনও ভাটা চলেছে। পেতনি হাসছে খিলখিল করে। যাবার বেলায় হাসে, আসার সময় চুপি চুপি আসে। অদৃশ্যে জিভ বাড়িয়ে বাঁধের ফাটল খোঁজে। আর খোঁজে মানুষ।
গেমো গাছ বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ে যেন। বাঁধের মাথায় চাঁদ উঠেছে পঞ্চমীর। অস্পষ্ট আলো-ছায়ায়, গাছ, বাঁধ, জল, সবই যেন কেমন আড়িপাতা লুকিয়ে থাকার মতো রহস্যে ভরা।
ঈশানের পাথুরে কপালের ছায়ায় কোন গর্তে ঢোকা অপলক দুটি ছোট ছোট চোখ। নৌকোয় উঠে বিমলীর হাত ধরে আবার বলে, হালের কাছে গলুয়ে গে বসবি চল।
হালের কাছে? কেন? ঈশানের কাছে কাছে বসতে হবে? পেতনির জলের মতো হাসি চিকচিক করে বিমলীর ঠোঁটে। বলে, চল।
ঈশানের নজর পড়ে না বিকেলে কোন ফাঁকে কানী বিমলী আজ চুল বেঁধেছে তেল জল লাগিয়ে। দেখেনি, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে কখন। এখন ডুরে শাড়িটি বড় বেশি ছোট লাগছে তার। কেন? শরীর কি আরও ফাঁপল।
বিমলীকে গলুয়ে বসিয়ে, নিজে তার পিছনে বসে হাল ধরে ঈশান। কোমর থেকে গামছাখানি খোলে নিঃসাড়ে। মুখ না বাঁধলে চেঁচাবে মাগি। মুখ বেঁধে, কোমরে দড়ি বেঁধে, গলুয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখবে। তাই কাছে কাছে রাখতে চায়।
গামছাটা কোলের উপর রেখে, নৌকোর মুখ দক্ষিণে ঘোরায় ঈশান।
এখনও দু-চারটি নৌকো এদিক-ওদিকে যাতায়াত করে। গয়ারমারির শেষ মোটরের ভেঁপু আসে ভেসে।
ঈশান জলের দিকে তাকায়। ঘাড়ে কপালে দপদপ করে শিরা উপশিরা। উঁচু ভূর তলায় জ্বলে এখন সাপ-খপিস চোখ। দ্যাখে, ভীরু যম এসেছে আজ তার নৌকোর ছায়ায়। মরণের ভয় ডিঙিয়ে এসেছে আজ আসল টোপের লোভে। ওই যেন পাক খায় শ্যাওলা কালো বিশাল শরীরের ঝাপটায়। দ্যাখে কুতকুতে চোখে, করাত-দাঁতে দাঁত ঘষে।
মনে মনে বলে ঈশান, আয়, একটু দূরে আয়। জীবনের এই একটা শোধ চাই আজ। আর কিছু না।
দূরে যায় ঈশান। নামে পেতনির টানে। পাটাতনের পাশ থেকে টেনে বের করে সুদীর্ঘ বশা। কুহকী জ্যোৎস্নায়, বড় বেশি হিংস্র দেখায় ইস্পাতের বশা-ফলা।
যেন ভুলেই গেছল, হঠাৎ চমকে ওঠে বিমলীর গলার স্বরে, কী কর ঈশেনদাদা?
কী করে ঈশান? বলে, লৌকো বাই।
নৌকো বায়? বৈঠার শব্দ নেই, নৌকো দোলে না কেন? বড় যে এক বগা যায়। বিমলী মিটিমিটি হাসে কুহকী জ্যোৎস্নার মতো। বলে, ওপারে যাবা না ঈশেনদাদা?
চমকায় ঈশান। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় বিমলীর দিকে। কেন, চোখে কি ঠাহর পায় নাকি কানী? বলে, তাই তো যাই। কেন?
বিমলী সলজ্জ হেসে বলে, পুবে বাতাসটা মুখে লাগে, মনে নেয়, দক্ষিণে চইলছি।
ঈশান বলে, জাল পেইতেছি একটু দূরে। একবার দেইখে যাব।
অ!
বিমলীর চোখের কোলের অন্ধকারে চাঁদের কণা চিকচিক করে।
ঈশানের হিংস্র চোখ চমকায়। কী আসে পাক খেয়ে ওই দক্ষিণের বড় বাঁকে। কী যেন চলকে ওঠে নৌকোর তলায়।
এসেছে তারা। দলে দলে এসেছে মানুষের গন্ধ পেয়ে। সেই শেষ খিলখিল হাসিটা খেয়ে এসেছে, গিলে এসেছে শেষ ডাকটা, এইস, নে যাও।…এইস, নে যাও।…
সেটা ভাবতে চায় না ঈশান। তা হলে বাঁচা যায় না। শোধ চায়। জীবনের এই একটা শোধ। এই জন্যে সে বেঁচে আছে। আদিবাসীরা তার মাংস খায়। ঈশানও খাবে।
বাঁধ নির্জন, পেতনির বুক নিরালা, গেমোবনে বাতাস ডাকে।
মাথায় রক্ত ওঠে ঈশানের। গামছাটা তুলে নেয় হাতে।
বিমলী ডাকে, ঈশেনদাদা?
গলাখানি যেন বড় মিষ্টি বিমলীর, মায়াবিনীর কুহক মাখা। ঈশান শব্দ করে।
হুঁ।
–চাঁদ উইঠেছে, না।
বড় চমকায় ঈশান। কানী না বিমলী? বলে, টের পাস কেমনে?
বিমলী বলে, আইজকে যে পঞ্চমী শোনলাম?
হ্যাঁ, চাঁদ উইঠেছে।
পেতনি নাচে, হাসে কলকল করে। সমুদ্রের অন্ধকারে যায় কিনা, তাই। বাঁধের কোল থেকে। জল নেমেছে। সেখানে মাটি চকচক করে।
কিন্তু দেরি হয়ে যায় যে! জোয়ার পড়লে, আবার উত্তরে টেনে নিয়ে যাবে। চারদিকে সুপ্তি। ডাঙায় ডাকে ঝিঁঝি। আর, এই তো ঘিরে ধরেছে তারা ঈশানের নৌকোর চারদিক। যেন ল্যাজের ঝাপটা মারে তারা ক্ষুধা ও লোভের তাড়নায়!
দুটো টোপ গেছে, এ টোপ ফসকাতে দেবে না ঈশান।
ঈশান, প্রায়-উলঙ্গ সেই সমুদ্রের আদিম অধিবাসী, চোখে যার ক্রুদ্ধ জিঘাংসা ধকধক জ্বলে। দু হাতে গামছা তুলে বিমলীর মুখ বাঁধতে যায়।
–ঈশেনদাদা।
থমকে যায় ঈশান। -হ্যাঁ।
বিমলীর সারা মুখে কৌতূহল। বলে, পিঠে কী ফেইললে আমার?
টনক বড় খাড়া কানীর। ঈশান বলে কিছু না, গামছাখানা পইড়ে গেছে।
কিন্তু জোয়ার যে অনেকক্ষণ রাইমঙ্গলের মোহনা পার হয়ে এসেছে। সময় যায়।
বিমলীর মুখে জ্যোৎস্না যেন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। বলে, ঈশেনদাদা তোমার পরাণটায় বড় দুঃখু, না?
-কেন?
–আমি জানি। তাই তুমি রা কাড়ো না।
কে যেন ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে ঈশানের বুকে, ওরে মুখ বাঁধ, শিগগির বাঁধ। দেখিসনে, তোর সোহাগী বউয়ের শেষ হাসি, শেষ ডাক-খাওয়া শমনেরা ধরা দিতে এসেছে। ঘুরছে আশেপাশে, মানুষের গলার স্বরে, জীবন্ত মাংসের গন্ধে।
চকিতে বশটা তুলে নেয় ঈশান। কীসের ছায়া ওটা জলে?
কিছু না, পেতনির বুকে জ্যোৎস্নার খেলা।
বিমলী বলে, কী করো ঈশেনদাদা।
–বৈঠাটা সরাইয়ে রাখি।
হাল ছেড়ে দিয়ে, আর একটু এগিয়ে আসে ঈশান বিমলীর দিকে। মজা টোপ, পচে না যায়। আর দেরি করা যায় না।
বিমলী বলে, দূর বনের বাতাসের মতো, তাই তো বলি ঈশেনদাদা, সনসারে ভাল মানুষের মরণ হয়। আমাকে কেন খায় না কামটে?
ঈশানের চমকানিতে নৌকোটা সুদ্ধ যেন কেঁপে ওঠে। তার গোঙা স্বর বড় তীক্ষ্ণ শোনায় ; কেন!
পেতনির মায়া জল গড়ায় বিমলীর চোখের গর্তে। বলে, আমি লুলা কানী।
অস্থির হয়ে গামছাটা পাকায় ঈশান। দ্যাখে, কানী বিমলীর বাঁধা চুল বড় চকচক করে। ঠোঁট লাল।
আর পেতনির জলে লোভী কামট লোভার্ত হয়ে ফেরে। ঈশানের হাতে তারা আজ প্রাণ দিতে এসেছে।
পেতনি থম খায়। জোয়ারের ধাক্কা লেগেছে অদূরে। সময় যায়। টোপ বুঝি ফসকায়।
ঈশান গামছা তুলে নিয়ে যায় বিমলীর মাথার উপর দিয়ে।
বিমলী সরে আসে ঈশানের কোলের কাছে। কুহকী জ্যোত্সার বিষণ্ণতা যায়, মিটমিট হাসে। বিমলী বলে, ঈশেনদাদা, আমার গলায় বড় লাগে।
–আঁ?
–হ্যাঁ, গামছার পাকে বেন্ধে ফেইলছ আমারে। এটটুখানি আস্তে বান্ধো, না হলি যে বড় লাগে?
–আঁ?
বিমলী হাসে খিলখিল করে। ঈশানের পায়ে হাত দেয়। তারপর হঠাৎ গুনগুন করে ওঠে,
মন যদি দিলে
তবে মনের মানুষ নাই কেন।
এতই কাঁদালে যদি,
আজ ভালবাসা কেন।
এ পরাণে কী আছে আর,
কী বা দেখ আর বার,
আগুনের আঁচ নেই।
ফুঁ দিয়ে ছাই ওড়াও কেন।
পেতনি নদীর বুকে জোয়ার আসে চুপি চুপি। গেমোবনে বাতাস বড় শনশন করে। নদীর সর্বাঙ্গ শিউরোয়। বাঁধের ঢালুতে চাঁদ যায় গড়িয়ে। আর মানুষের গন্ধে গন্ধে ফেরে, ভয়াল করাল। মাংস লোলুপ কামট। চোখে তার রক্তের তৃষ্ণা। সোহাগী বউয়ের শেষ হাসি খেয়ে এসেছে। তারা।
আর শেষ ডাক, এইস, নে যাও!
কিন্তু ঈশান কী করে। সময় যায় না?
কানী বিমলী বলে মায়াবিনী সুরে, ঈশেনদাদা তোমার হাতের বাঁধন এটটুস আলগা কর গো, বড় শক্ত।
বলে বিমলী মাথাটি এলিয়ে দেয় ঈশানের শক্ত বুকে, বাঁধন আলগা হয় ঈশানের।
বাতাসে যেন বড় সোহাগ উথলায়। বিমলী বলে, দম বন্ধ নাকি তোমার ঈশেনদাদা।
-হ্যাঁ।
-কেন?
–জলে আমি কামট দেখি।
কামট!
হ্যাঁ।
চমকে উঠে, মুখ ফেরাল বিমলী ঈশানের দিকে। বলে, কপালে আমার গরম জল পইড়ল। তোমার শরীল বড় কাঁপে। ঈশেনদাদা তুমি কাঁদছ?
হ্যাঁ, কালো পাথরটা যেন কীসের দমকে কাঁপে। জলে ল্যাজ আছড়ায় কামট। কিন্তু বাতাসে যেন সোহাগের ডাক! ঈশান ফিসফিস করে বলে, কাঁদি না লো বিমলী, এ পেতনির মায়া।
কী বোঝে বিমলী, কে জানে। তার চোখে জল আসে।
তারপর জোয়ারের ধাক্কা টের পেয়ে বলে, চল, তোরে রেখে আসি।
বিমলী মিষ্টি করুণ সুরে বলে, রাত হইয়েছে অনেক। কে নে যাবে বাড়িতে! গঞ্জে রেইখে যাবা?
ঈশান একটু চুপ করে থাকে। দূর জলে তাকায়। নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে বলে, গঞ্জে যদি রেইখে যাব, তবে তোরে পেতনির জলে ফেইলোম না কেন? আখড়াতলা যাবি বিমলী?
আখড়তলায়? ও, সেখানে ঈশেনদাদার বাড়ি। বিমলীর বড় অকুলান লাগে ডুরে শাড়ি। শরীর তার এত বাড়ল কখন ; কবে? নিরুত্তর চোখের গর্তে কুহকী জ্যোৎস্না চিকচিক করে।
ঈশান বৈঠা টানে। পাটাতনের ওপর ইস্পাতের বশটা একটু ম্লান দেখায়। ফলাটা যেন বড় টানা চোখের ফাঁদের মতো চকচক করে। কিন্তু পলাতক কামটরা যেন আজ সত্যি বড় হতাশক্রোধে দাঁত কড়মড় করে পেতনির অতলে।
ঈশান ভাবে, বড় খিলখিল করে হেসেছে আজ বিমলী। আরও না জানি কত হাসবে।