১৯
কারা প্ররোচিত করে কঙ্কালের রণলিপ্সা, নারকীয় আত্মহত্যা,
বারাসাত-বরাহনগর
বোবা ভ্রূণ, ঠ্যাংবিম্ব : ভাঙা সাম্রাজ্যের কামজ্বরে মুগ্ধ হীরের সুন্নত!
—অনন্য রায়
.
‘এই গল্পের শুরু ১৯৬৭ সালে। দার্জিলিং সহ গোটা বাংলা তখন নকশাল আন্দোলনে অশান্ত। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুলিশের নির্মমতা। ড্যানিয়েল লামার উত্থান সেই সময়কালে। দক্ষ এবং নিষ্ঠুর অফিসার হিসেবে সদর পুলিশ থেকে তাকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। গোটা জেলায় সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে যে বিশেষ পুলিশি বিভাগ তৈরি হয়েছিল, ড্যানিয়েল ছিল তার শীর্ষের দিকে, অপারেটিং কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম। মূলত নোংরা কাজগুলোই করতো, যেগুলো আইপিএস র্যাঙ্কের বড়ো অফিসাররা নিজের হাতে না করে ওর মতো কয়েকজনের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল, দার্জিলিং জেলাকে শান্ত রাখতে হবে। যদি সাফল্য আসে, পুরস্কার হিসেবে ডিএসপি-র পদ। মানে, জেলার শাসনভার চলে আসবে নিজের নিয়ন্ত্রণে।
‘সাফল্য এসেছিল, যদি সেটাকে সাফল্য হিসেবে ভাবতে পারা যায়। ড্যানিয়েলের নির্মমতায় কেঁপে উঠেছিল দার্জিলিং। শহরে আন্দোলনের তীব্রতা সেভাবে ছিল না, তাই আমাদের অনেকের গায়েই আঁচ লাগেনি। কিন্তু আশেপাশের গ্রাম মহকুমাতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল। ইনফ্যাক্ট, শুরুই তো হয়েছিল এখান থেকে। চা-বাগানগুলো তখন জ্বলছে। প্রতিদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর। বিগল কিষাণ, সোনম ওয়াংদি, জংগল সাঁওতাল, খোকন মজুমদারের নাম রোজ খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। পরিস্থিতি শান্ত করতে ড্যানিয়েল লামার মতো বেশ কিছু পুলিশ অফিসারের দরকার পড়েছিল। সেই ইতিহাস অনেকেই জানে। সরকারি হিসেবের বাইরেও ডাকাত বা ছেলেধরা নাম দিয়ে এনকাউন্টার করে দেবার ঘটনা ভুরিভুরি ঘটছিল। একটা সময়ের পর পুলিশ ফোর্সের ভেতর থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল, এতটা নৃশংসতার দরকার পড়ছে কেন! জেলার বিভিন্ন গ্রাম বা টাউনে কত ছেলে নিখোঁজ হয়েছিল, তার আসল সংখ্যা এখনো কেউ জানে না। অথবা কতজনকে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আটক করে রাখা হয়েছিল। পুলিশ তো হুকুমের চাকর, সরকার থেকে যা নির্দেশ আসবে, তা মানতে বাধ্য। কিন্তু নির্দেশের অতিরিক্ত যেটুকু, তার দায়ভাগ অন্য কারোর ওপর বর্তায় না। কিন্তু ড্যানিয়েল তখন দার্জিলিং-এর মুকুটহীন সম্রাট। তার বিরুদ্ধে সামনাসামনি কথা বলতে পারে এমন কেউ ছিল না। পুলিশের কর্তারাও প্রমাদ গুণতে আরম্ভ করেছেন ততদিনে। কারণ ড্যানিয়েল ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের দানব হয়ে উঠছে। একদিন গোটা ফোর্সকে সে গিলে খাবে। দরকার হয়ে পড়ছিল ড্যানিয়েলের বিপরীতে একটা র্যাশনাল মুখকে তুলে আমার। কিন্তু গোটা কাজটাই করতে হবে গোপনে ফোর্সের মধ্যেও সকলকে জানানো চলবে না। ড্যানিয়েল যেহেতু পুলিশের ওপর মহলেরই সৃষ্টি, সে বেঁকে বসলে বহু ভেতরের কথা বাইরে বেরিয়ে যাবে। তাই অপেক্ষা করতে হবে। ড্যানিয়েলের কোনো একটা ভুলের অপেক্ষা, যার সুযোগ নিয়ে তাকে বৈধ উপায়েই সাইডলাইন করে দেওয়া যায়। দরকার ছিল একটা বিকল্প গ্রহণযোগ্য মুখ। এখানেই ধনরাজ গম্বর আগমন। সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং যুক্তিবাদী এক আদর্শ পুলিশ অফিসার। উন্মাদ ড্যানিয়েলের বিপরীতে ঈশ্বরসম। পুলিশের উপরমহলের একটা অংশ ধনরাজকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে লালন করতে শুরু করে দিলেন। অপর অংশ অবশ্য তখনও নানা কারণে, মূলত ক্ষমতালাভের সমীকরণেই, ড্যানিয়েলের পাশে থাকলেন।
‘এই লড়াইতে নিজের অজান্তেই দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে গেল অমিতাভ। আমি বা অমিতাভ, কেউই রাজনীতিতে অংশ নিইনি। কিন্তু অমিতাভ ছিল সংবেদনশীল। চোখের সামনে এত ছেলেকে মরতে দেখে ওর মাথা বিগড়ে যাচ্ছিল আরও বেশি করে। অমিতাভর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যেকার কবিতাগুলো পড়লে দেখবেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লিখে গিয়েছে। আরও অনেকের মতোই। কিন্তু সে সবই লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা। বিশেষ কেউ পড়ত না। অমিতাভ চাইতো আমিও যেন এগুলো নিয়ে লিখি। আমি পুলিশের বাড়াবাড়ি কখনও পছন্দ করিনি। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কোনোকালে উৎসাহ বোধ করিনি। আমার প্রিয় বিষয় ছিল নিখাদ সাহিত্য। তার মধ্যে সমাজ রাজনীতি বিপ্লব এসবের কোনো ছিটোফোঁটাও ছিল না, যতক্ষণ না লেখার উপাদান হিসেবে আসে। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে একজন অরাজনৈতিক মানুষ হিসেবে মনে করি এখনও। তাই ওর চাওয়াতে কর্ণপাত করিনি। আমাদের বিচ্ছেদের একটা বড়ো কারণ ছিল সেটা। অমিতাভর মনে হয়েছিল, আমি প্রতিষ্ঠানের হাতে লালিত-পালিত হতে হতে নিজের স্বতন্ত্র স্বর হারিয়ে ফেলেছি। বড়োলোকের ছেলে, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড়ো হয়েছি। নিজেও স্বপ্ন দেখি সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে বাণিজ্যিক সাহিত্য করে খ্যাতি লাভ করবার। অমিতাভর কাছে অসহ্য ছিল সেসব। আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছিল আমার থেকে। আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু কী করতাম আমি? নিজের স্বাভাবিক প্রবণতার বিপরীতে গিয়ে মেকি প্রগতিশীল সাজতাম? সেটা সম্ভব? নাকি সততা?’
অরুণ মাথা নাড়লেন নিজের মনে। আমি একজন সাহিত্যিক। রাজনীতি দিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকের কী এসে যায়?’
হঠাৎ চোখে পড়ল, অনন্যা বাগানের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভাব দেখে বুঝলাম, এইদিকেই আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে দেখে থমকে গিয়েছেন। দোনোমনো করছিলেন। ফোনের রেকর্ডার বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। অনন্যা তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছিলেন। বললাম, ‘আমার সমাধানে কেউ আঘাত পাবে না, মিস চৌধুরী। আপনার ভয় নেই।’
অনন্যা প্রথমে উত্তর দিচ্ছিলেন না। হয়তো বুঝতে পারছিলেন না কী বলবেন। তারপর নীচু গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘সমাধান করে ফেলেছেন?’
‘সম্ভবত।’ হেসে উত্তর দিলাম।
অরুণ বসে ছিলেন বারান্দায়। অনন্যা সেদিকে তাকালেন। ‘অরুণের সমস্ত খেয়াল আমাকেই রাখতে হয়, তনয়া। অসুস্থ শরীরেও। কারণ ও আমার থেকে দশগুণ ভালনারেবল। ভেতরে ভেতরে। বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব না।’
‘আপনার স্বামী নির্দোষ! ‘
অনন্যা নির্নিমেষে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হয়তো দেখতে চাইছিলেন, সত্যি বলছি কিনা। কী দেখলেন জানি না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছু ফিরলেন। শরীরটা আবার মিলিয়ে গেল বাড়ির পথে।
আমি ফিরে এসে অরুণের সামনে বসলাম। অরুণ অনন্যার চলে যাবার দিকে তাকিয়েছিলেন। একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না, কী কথা হলো। শুধু প্রশ্ন করলেন, ‘সিদ্ধার্থ জানে?’
‘আপনার অনুমতি না নিয়ে আপাতত কাউকে কিছু জানাবো না। তবে লেখাটা তো লিখতেই হবে। তখন সকলেই জানবে।
‘ওকে বলতে পারেন।’ অরুণ সম্মতিসূচক মাথা ঝোঁকালেন।
‘আপনি বলুন, যা বলছিলেন।’ আবার ফোনের রেকর্ডার অন করে দিলাম।
‘আমার বইগুলো ফ্লপ করছিল। নিজের মতো করে জায়গা বানিয়ে নেবার জন্য লড়ছি তখন। এর মধ্যে অমিতাভর নাম উঠে এল প্রতিশ্রুতিমান কবি-লেখকদের তালিকায়। মিথ্যে বলব না, সঞ্জয় অধিকারীর রিপোর্ট দেখে তীব্র হিংসে হয়েছিল। কিন্তু নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, আমার আর ওর রাস্তা আলাদা। ও নিরীক্ষামূলক লেখা লিখতে চায়। লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আদর্শ। আমি লিখতে চাই সাহিত্যের মিশেলে রহস্য গল্প। সিরিয়াস সাহিত্যের ভিড়ে কল্কে পেতে গেলে অনেকটা রাস্তাই চলা বাকি আছে আমার।
‘কিন্তু অমিতাভ ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল। দেখতে পাচ্ছিল যে কবিতা লিখে কিছু হয় না। রাষ্ট্রীয় দমনের বিপরীতে প্রতিবাদী শিল্পসাহিত্য কার্যক্ষেত্রে অসাড়। গোটা রাজ্য জুড়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে তখন আগুন-ঝরানো কবিতা লেখা হচ্ছে, আর একটা পর একটা ছেলে খুন হয়ে যাচ্ছে। অমিতাভ বুঝছিল, কলমের একক প্রতিরোধ যথেষ্ট নয়। তাহলে সে আর কী করতে পারে? দলীয় রাজনীতি ওর মতো ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। অমিতাভ ঠিক করল, সে প্রোভোক করবে। তাতে যদি নিজের মৃত্যুও হয়, হোক। সেটাকেই সে ইন্সটলেশন আর্ট হিসেবে ব্যবহার করবে। নিজের কবিতা দিয়ে স্টেটমেন্ট রাখতে পারছে না যখন, জীবন দিয়ে রেখে যাবে। অবিশ্বাস্য লাগছে, না? আজ ফিরে দেখলে আমারও মনে হয় ওই সময়টা অবাস্তব ছিল। কিন্তু সত্তরের অনেক কবি বাস্তবতার গণ্ডিতে আটকে থাকতে কোনোদিনই চায়নি। তার কিছুদিন পরেই আমার বিরুদ্ধে অমিতাভর সেই অভিযোগ। আমার কেরিয়ারের অনেকটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল তখন। সঞ্জয় সেই সময়ে অমিতাভর যে সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন, সেটা কি আপনি পড়েছিলেন? পড়লে দেখতেন, হাবিজাবি অনেক কথার পাশাপাশি অমিতাভ আরও একটা বিস্ফোরক অভিযোগ করেছিল। দার্জিলিং শহরে কিছুকাল আগেও নকশাল দমনের নাম করে যে বর্বর পুলিশি সন্ত্রাস হয়েছিল, তার ভেতরকার খবর এবং সেই সন্ত্রাসের মাথা জনৈক পুলিশ অফিসারের বিষয়ে তথ্য অমিতাভর কাছে আছে। একদিন সে সমস্ত কিছুই প্রকাশ করবে।
‘কলকাতায় বসে এই খবর পড়লে আপনি এর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন না। কারণ কলকাতার বরানগরে, কাশীপুর থেকে শুরু করে সিদ্ধার্থ রায়ের কংগ্রেসি জমানার সন্ত্রাস ততদিনে যে পর্যায়ে গিয়েছে, সেখানে অমিতাভর এরকম অভিযোগ নেহাতই জলভাত। দার্জিলিঙের মতো অবস্থা তখন কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যাপারটা অন্যরকম। এই শহর বরাবরই শান্তিপূর্ণ ছিল। যেটুকু অস্থিরতা, নকশাল আমলেই। গোর্খাল্যান্ড তখনও বহু দূরের ব্যাপার। সেই কিলিং, হানাহানি আর সন্ত্রাসের ক্ষত সারিয়ে ছোট্ট জেলাটা আবার আস্তে আস্তে সেরে উঠছে। অতীতকে মাটিচাপা দিয়ে দিচ্ছে পুলিশও। ড্যানিয়েলের পতনের অপেক্ষায় একটা অংশ, ঠিকই। কিন্তু তাদেরও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। এরই মধ্যে অমিতাভর অভিযোগ বাংলার প্রথম সারির দৈনিকের পাতায়। নাম না করলেও ড্যানিয়েলের দিকেই যে অভিযোগের তির, সেটা বুঝতে কারোর বাকি থাকেনি। পুলিশের বাঙালি অংশের হাত ঘুরে কথা উঠল ড্যানিয়েলের কানে। ড্যানিয়েল ভুরু কুঁচকেছিল কিনা জানি না। হয়তো অমিতাভকে পাত্তাই দেয়নি। তবু একবার ঘুরে এল অমিতাভর আস্তানা। রুটিন খানাতল্লাশি চালালো। অমিতাভকে তুলেও নিয়ে গিয়েছিল মনে হয়। যেহেতু অভিযোগই করেছে, আর কিছু না, ড্যানিয়েলও আর ঘাঁটায়নি। তা ছাড়া বেশ কিছুটা বাড়াবাড়ির পর সে নিজেও সাবধান হয়ে গিয়েছিল। ওপরতলা থেকে নির্দেশ এসেছিল, আইন নিজের হাতে নেওয়া চলবে না। আগে হলে এরকম রুটিন নির্দেশকে ড্যানিয়েল থোড়াই কেয়ার করতো। কিন্তু সেই সময়ে জেলা পুলিশের মধ্যে বেশ কিছু ট্রান্সফার হয়। শাস্তিমূলক ছুটিতে পাঠানো হয় কিছু অফিসারকে। ড্যানিয়েল তাই নিজেকে কিছুটা বাঁচিয়ে চলছিল। এটাও বুঝতে পেরেছিল যে ধনরাজ গম্বু তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে।
‘পরের বোমাটা ছিল অমিতাভর উপন্যাস, যেটা ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের এক পাহাড়ি শহরের নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা। উপন্যাসটা যদি পড়েন, দেখবেন পাতায় পাতায় রাস্তাঘাট ঘরবাড়ির প্রায় নাম ধরে ধরে বিবরণ দেওয়া আছে, কোন জায়গা থেকে কতজন ছেলেকে তুলে এনে পুলিশ গায়েব করে দিয়েছে। ভুয়ো কেস সাজানো, হত্যাপদ্ধতি এবং লাশ গায়েব করে দেবার নিখুঁত বর্ণনা। শীর্ষে যে পুলিশ অফিসার, পড়লেই এই শহরের যে কোনো মানুষ বুঝতে পারবেন কার আদলে তৈরি। কলকাতায় আলোড়ন ওঠেনি, কিন্তু দার্জিলিঙের বাঙালি মহলে নড়াচড়া শুরু হয়ে গেল। যারা এত বিশদে জানতো না, তারাও জানলো। একটা মানবাধিকার সংগঠন অমিতাভর সঙ্গে যোগাযোগ করলো। একমাস বাদে তাদের রিপোর্ট বেরোলো সংবাদপত্রের পাতায়। তার ওপর ভিত্তি করে একটা জনস্বার্থ মামলার আবেদন পেশ করা হলো দার্জিলিং কোর্টে, পুলিশের খাতায় নিখোঁজ বলে বর্ণিত তরুণতরুণীদের সন্ধানের ইস্যুতে। অন্যান্য বহু জনস্বার্থ মামলার মতোই এই মামলাও ঝুলে রইল। কিন্তু ড্যানিয়েল প্রমাদ গুনলো এবার। কারণ সে বুঝতে পারছিল, এগুলোকে ব্যবহার করেই তার বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজানো শুরু হয়ে যাবে। দরকার অমিতাভকে থামানো। অমিতাভকে হুমকি দিল ড্যানিয়েল। বলল, ভুয়ো কেসে ফাঁসিয়ে দেবে। কিন্তু যেহেতু অমিতাভ তখন একটা ছোটখাটো নাম, আর শান্ত পুকুরে ঢিল ছুঁড়েছে, তাই তার গায়ে সরাসরি হাত দেবার সাহস ড্যানিয়েলের ছিল না। যদি অমিতাভকে তুলে নিয়ে এসে এনকাউন্টার করে দিত, ড্যানিয়েলকে ছিঁড়ে খেত মিডিয়া, এনজিও, এবং পুলিশের একাংশ। তাই ড্যানিয়েল অমিতাভর উপর চাপ দেওয়া শুরু করলো। ওকে অনুসরণ করা, রাতবিরেতে ওর ঘরে পুলিশ পাঠানো এইসব। এগুলোই অন্যের মুখে পরে শুনেছি। কিন্তু অমিতাভ দমে তো গেলই না, উলটে ড্যানিয়েলকে জানাল যে সে এরপর একটা নন-ফিকশন লিখছে। দাজিলিং অঞ্চলে পুলিশের সন্ত্রাস নিয়ে এবার নাম করে করে বিবরণ দেবে। সেই মানবাধিকার সংগঠনটি তাকে সহায়তা দেবে সমস্তরকম, আর কলকাতার এক প্রকাশক এর মধ্যেই বই করবার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আবার সেই প্রোভোক করা। মৃত্যুকে ডেকে আনা হাত ধরে, কারণ ওটাই তখন ওর কাছে আল্টিমেট শিল্প।
‘আজ ২০১৯ সালে এসে সত্তরের সন্ত্রাস নিয়ে আমরা যতই গলা ফাটাই না কেন, খোদ সত্তর দশকের মধ্যে বসে সেগুলো নিয়ে লেখালেখি করা একটা বড়ো সাহসের ব্যাপার ছিল। সেই সময়কার সংবাদপত্রগুলো দেখবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন অথবা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যত লেখা হয়েছে, তার এক শতাংশও লেখা হয়নি পুলিশের গুলিতে নিহত রাজনৈতিক কর্মীদের বিষয়ে। না, কেউ লেখেননি। কোনো প্রতিষ্ঠিত কবি বা লেখক, কেউ না। লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে বহু কবিতা বেরোতো ঠিকই, সেখানে ধারাবাহিকভাবে এগুলো নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত রুদ্র, সব্যসাচী দেব বা সমীর রায়ের মতো কবি, কিন্তু সেসব ম্যাগাজিনের আর কতই বা পাঠক! মূলধারার সংবাদ এবং সাহিত্য গোটা সময়টা জুড়ে হিরন্ময় নীরবতা পালন করে গিয়েছিল। এগুলো লেখার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। দ্রোণাচার্য ঘোষ, যাকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘সম্ভাবনাময় কবি’, পুলিশ লকআপে তার হত্যা নিয়ে কোনো মূলধারার কবি বা লেখক একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। অথবা তিমিরবরণ সিংহ। একমাত্র শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন ‘নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই তোমার ছিন্ন শির, তিমির’। তিনি হয়তো ব্যতিক্রম ছিলেন। কিন্তু অন্যেরা? যুবকের স্নানে মুগ্ধ একটা প্রজন্ম দেখেও দেখেনি যে সেই যুবকেরাই একে একে নর্দমার ধারে লাশ হয়ে পড়ে থাকছে। আর নৈঃশব্দের মধ্যেই অমিতাভ সংবাদপত্রের পাতায় ঘোষণা করে দিল, সে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত এক প্রকাশকের ঘর থেকে বই বার করবে উত্তরবঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিষয়ে!
‘আবারও বলছি, কলকাতার কাগজের রিপোর্ট পড়লে এগুলো কিছুই জানতে পারবেন না। কারণ কলকাতায় বসে এখানকার বাস্তবতা বোঝা সম্ভব নয়। অমিতাভর উপন্যাস নিয়ে যতখানি অভিঘাত উত্তরবঙ্গে উঠেছিল, কলকাতায় তার সিকির সিকিও ওঠেনি। কারণ ওখানে রাষ্ট্রীয় হত্যা ততদিনে জলভাত, আর সেগুলো নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন না। কিন্তু ছোটো শহরের ক্ষেত্রে হিসেব অন্যরকম হয়। আরও বেশি অন্যরকম হয়, যদি সেই ছোটো শহরের পুলিশ অফিসার হয় ড্যানিয়েল লামার মতো কেউ। ক্রোধে, ঘৃণায় পাগল হয়ে গেল ড্যানিয়েল। সে জানত, এই ধরনের রিপোর্ট বা বই প্রকাশ করবার ফল কী হতে পারে। কমিশন বসবেই তার বিরুদ্ধে। ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে তার এতদিনকার সযত্নলালিত কেরিয়ার। কিন্তু অমিতাভকে সে ছুঁতেও পারছে না। ড্যানিয়েলের একটা ব্যাপার ছিল। ও যাকে শত্রু বলে একবার ধরে নিত, সে সারাজীবনের মতো ড্যানিয়েলের ব্ল্যাকলিস্টে ঢুকে যেত। সে যদি অপরাধীও হয়, বা রাজনৈতিক কর্মী, ড্যানিয়েলের তার ওপর ক্রোধটা হয়ে দাঁড়াতো ব্যক্তিগত। সে মনে করতো, এরা তার ব্যক্তিগত শত্রু। একে উন্মাদনাও বলতে পারেন। কিন্তু অমিতাভকে ড্যানিয়েল তার ব্যক্তিগত শত্রুদের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। আর এসব ক্ষেত্রে যা হয়, ড্যানিয়েল স্থির করল অমিতাভকে শেষ করতে হবে। এমনভাবে, যাতে তার ওপর সন্দেহ না পড়ে।
ড্যানিয়েল আমার সঙ্গে দেখা করল। বোঝালো যে অমিতাভর এই ধরনের লেখালেখিতে পুলিশের একাংশ তার উপর ক্ষুব্ধ। কারণ গোটা ফোর্সের নাম খারাপ হচ্ছে। তাই, ড্যানিয়েল কিছু না করলেও, অন্য যে কেউ অমিতাভকে গুম করে দিতেই পারে। দোষ ড্যানিয়েলের ঘাড়ে পড়বে, কিন্তু তাতে অমিতাভর তো লাভ কিছু হবে না! সে ততদিনে পুলিশের খাতায় নিখোঁজ। ড্যানিয়েল চাপ দিল অমিতাভর সঙ্গে তার কথা বলিয়ে দিতে। কোনো নিউট্রাল জায়গাতে। আমার বাড়ির প্রস্তাবটাও ও-ই দিয়েছিল। আমি ড্যানিয়েলকে চিনতাম। ও যে কীরকম মানুষ, সেই সম্বন্ধেও ধারণা ছিল। মনে হয়েছিল, ড্যানিয়েল এবার চরম কোনো রাস্তা বেছে নেবে। সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানাতে এসেছে। যখন বলছে যে ফোর্স থেকে অমিতাভকে গুম করে দেওয়া হবে, বাস্তবে সেটা ড্যানিয়েল নিজেই করবে বলে মনে হয়েছিল। এটা থামাতেই হবে। ভয় পেয়ে অমিতাভর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওর আস্তানায় গিয়ে পেলাম না। শেষে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে স্থানীয় শুঁড়িখানা থেকে ধরে আনলাম।’
এবার কফি ঢেলে অরুণের দিকে এগিয়ে দিলাম। কথাগুলো বলছিলেন যখন, একটা ভেঙে পড়া মানুষের মতো লাগছিল তাঁকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। বার বার মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছিল কেমো হয়ে যাবার পর বাবার কেশহীন মাথা আর কঙ্কালের মতো মুখটা।
‘অমিতাভ প্রথমে আমাকে বিশ্রী অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনদিন ধরে গিয়ে বোঝানোর পর রাজি হলো। শর্ত দিল, ড্যানিয়েল বাড়ির ভেতর পা রাখতে পারবে না। ওর নাকি নিজেকে কলুষিত লাগবে ওরকম লোকের সঙ্গে এক ছাদের তলায় দাঁড়াতে। পাগলের কতরকম অদ্ভুত খেয়াল! কিন্তু পরে বুঝেছি, ও তখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল মৃত্যুর। নিজের মৃতদেহকে শিল্পের চরমতম রূপ হিসেবে ব্যবহার করবে, ঠিক যেমন সায়গনে নিজেদের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, ভিয়েতনামে আমেরিকান আগ্রাসনের প্রতিবাদে। অমিতাভও আত্মহননের রাস্তাতেই গিয়েছিল বলে মনে করি।
‘এর পরের ঘটনা আপনি যেরকম বললেন, তেমনই। অমিতাভ আগে এসেছিল। পরে ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েল বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কিন্তু দেখলাম, অমিতাভকে বোঝানোর বদলে আরও বেশি করে ওকে উত্তেজিত করে দিচ্ছে। রাগিয়ে দিচ্ছে। অথবা, অমিতাভ ভেবেই এসেছিল যে সে উত্তেজিত হবে। একটা সময়ে দেখা গেল দুজনেই দুজনকে প্রোভোক করে যাচ্ছে সমানতালে। ড্যানিয়েল বলল, এই বাড়িতে একটা রাইফেল আছে। চাইলে সেটা দিয়ে গুলি করে কুকুরের মতো তোমাকে মারতে পারি এখানেই। লাশ পুঁতে চুন চাপা দিয়ে দেব পুলিশের কুকুর টের পাবে না। আগুনে ঘি পড়ল। অমিতাভ ছুটে বাড়ির ভেতরে গেল। রাইফেল নিয়ে এসে ড্যানিয়েলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘জল্লাদ’, ওকে থামাতে গেলাম। তারপর তো গুলি চলল। অমিতাভ ছুটে বেরিয়ে গেল। জানি না মিসেস বাসু কেন বলেছিলেন যে আমি নীচু হয়ে কিছু খুঁজছি। এতদিন পরে এসে আর সত্যিই মনে নেই। যাই হোক, অমিতাভ বেরিয়ে যাবার পর ড্যানিয়েল আমার দিকে ফিরে ঠাণ্ডা গলায় বলল, অমিতাভ এসেছিল এটা যদি জানাজানি হয়ে যায়, তাহলে তোমাকেও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাবে না। অমিতাভকে সবাই চেনে, তোমাকে কেউ চেনে না। কারোর কিছু আসবে যাবে না। বেঘোরে মারা পড়তে না চাইলে যা যা বলছি, সেগুলো করো। সত্তর দশকের কুখ্যাত পুলিশ অফিসারের মুখে এই হুমকি শোনার তাৎপর্য কী, সেটা আজ দাঁড়িয়ে বোঝা সম্ভব নয়। আমি জমে গেলাম। ড্যানিয়েলের চোখ দেখে বুঝলাম, ও ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে না।’
অরুণ থামলেন। সেই সুযোগে আলতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, ‘সত্যিই কি এতটাই ভয় পেয়েছিলেন? একবারও কি চাননি যে আসল সত্যিটা বাইরে আসুক? তাহলে অমিতাভর পায়ের ছাপ বা বন্দুকে আঙুলের দাগ মুছলেন না কেন? কেন আপনার হাতে অমিতাভর আঁচড়ের দাগ নিয়ে অন্য কোনো ব্যাখা দিলেন না পুলিশকে? কেন বললেন যে ভুলে গেছেন, যাতে পুলিশের সন্দেহ হয়?’
হাসলেন অরুণ। আমি ব্যগ্রস্বরে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘বলুন মিস্টার চৌধুরী। আজ এতদিন পরে এসে অন্তত স্বীকার করুন যে আপনি ড্যানিয়েলের হাতের পুতুলে পরিণত হতে সেদিন অস্বীকার করেছিলেন।’
‘সেই স্বীকারোক্তিতে কি আপনার স্টোরিতে কোনো উন্নতি হবে?
‘জানি না, অথবা কেয়ার করি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি শুনতে চাই। আপনার মুখ থেকে। বলুন, আপনি ভয় পাননি।’ ঝুঁকে পড়ে অরুণের হাতের ওপর হাত রাখলাম। অরুণ হাত সরালেন না।
মৃদুস্বরে, নিজেকেই শোনাচ্ছেন এমনভাবে বললেন, ‘তবুও গ্লানির মতো মানুষের মনের ভিতরে এই সব জেগে থাকে বলে/শতকের আয়ু—আধো— আয়ু— আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতাব্দীতে তারা/ কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচনা করে/আশায় উজ্জ্বল রাখে।’
একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে সরে এলাম। অরুণ অস্ফুটে বললেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।’ তারপর দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমি ধীরস্বরে বললাম, ‘গল্পটা এবার শেষ করুন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘আমাকে হয়তো অপরাধীই সাব্যস্ত করা হতো, যদি না ড্যানিয়েল অনেকগুলো ভুল করতো। বাগানের মাটিতে বুটের ছাপ দেখে প্রথম সন্দেহ হয়েছিল ধনরাজ গম্বুর। সে অমিতাভর অভিযোগ, সাক্ষাৎকার, প্রকাশিত উপন্যাস এবং ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে অঙ্গুলিনির্দেশ, সবটাই জানত। সেই রাত্রে ড্যানিয়েলের থানায় চটি পরে আসাটা ছিল মারাত্বক ভুল। এবং মিথ্যে কথা বলা যে তার কাছে থানা থেকে ফোন এসেছিল। ধনরাজ শুনেছি পরে ফোন লিস্ট বার করিয়েছিল সরকারি নির্দেশের সাহায্য নিয়ে। ড্যানিয়েলের কাছে স্বাভাবিকভাবেই কোনো ফোন আসেনি। ড্যানিয়েলের অন্য ভুল যেটা ছিল, খুনের জায়গাতে বুটের ছাপ। যে ছাপ বাগানের বুটের সঙ্গে হুবহু এক। আর সবথেকে বড়ো ভুল তো টোকারেভ বুলেটের ব্যবহার, যেটা এখন জানছি। ধনরাজ এগুলোকে এক জায়গায় আনতে শুরু করেছিল আস্তে আস্তে। ড্যানিয়েলের অ্যালিবাইকেও ভাঙা গিয়েছিল বীরবিক্রম তামাঙের সাক্ষ্য দিয়ে। আর ধনরাজকে এই কাজে সহায়তা করেছিল অমিতাভর অসমাপ্ত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। অমিতাভ বুঝেছিল যে ড্যানিয়েল তাকে ছাড়বে না। অথবা, চায়নি ড্যানিয়েল তাকে ছাডুক। তাই উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছিল, অনেকটা প্রতীকী ঢঙে। যাতে তার মৃত্যু বিফলে না যায়। এই কাহিনী মানুষ পড়বার পর যেন বুঝতে পারে, কে অপরাধী। মৃত্যু যদি তার শিল্পের মূল প্লট হয়, উপন্যাসটা হোক সহযোগী সাবপ্লট। দুটি ইনস্টলেশন আর্ট, দুটো আলাদা অর্থ, কিন্তু ও বুঝতে পারেনি, এত তাড়াতাড়ি খুন হবে। বুঝলে, আরও দ্রুত লিখে হয়তো শেষ করবার চেষ্টা করত।
‘বডি শনাক্ত হবার পর অমিতাভর ঘর ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল পুলিশ। কাগজপত্র সিজ করেছিল সব। তার মধ্যেই পাণ্ডুলিপিটা ছিল। ড্যানিয়েল বাংলা পড়তে পারতো না, তাই সে উৎসাহ দেখায়নি। কিন্তু ধনরাজ পারতো। পাণ্ডুলিপির উপর বাংলায় লেখা ছিল, ‘অপরাধ ও শাস্তি’। মনে আছে, প্রথমদিন আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘ক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট’ পড়েছেন কিনা? এরকম অদ্ভুত নাম দেবার কী মানে আমি জানি না। কারণ লেখার বিষয়ের সঙ্গে নামটা যায় না। যখন পরে কপিটা পুলিশের হেফাজতে থেকে নিয়ে আসি, নামের কভার খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই নামটাই সম্ভবত ধনরাজকে আকৃষ্ট করেছিল। অপরাধ বিষয়ে অমিতাভ কী লিখেছে সেটা পড়বার জন্যে হয়তো ধনরাজ পাণ্ডুলিপিটা পড়তে শুরু করেছিল। যখন শেষ করল, আপনার মতোই পুরো ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার সামনে। বাস্তবের সঙ্গে মিলগুলো দেখে, অপরাধ ও তার সমাধান, উভয়ের মিলকে সাযুজ্যপূর্ণ করে ধনরাজ তার সিদ্ধান্তে পৌঁছোল। আমার সঙ্গে যখন কথা বলতে এল, আপনার মতোই সে-ও পুরো গল্পটা সামনে রাখল। এবার মুখ খুললাম। প্রথম থেকে বলে গেলাম যা যা ঘটেছে। এর আগে ড্যানিয়েলের ভয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না কারণ সে নিজেই ছিল তদন্তকারী অফিসার। কিন্তু ধনরাজ আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল যে তার কাছে সব স্বীকার করলে সে আমার পাশে দাঁড়াবে। ধনরাজের মতো মানুষ ফাঁকা কথা বলবার লোক নয়। তাই ওকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। ধনরাজ পুলিশের উপরমহলেও পুরোটা জানাল। অমিতাভ রাজনৈতিক কর্মী নয়। সাধারণ মানুষ। কোনো কেস ছাড়া ড্যানিয়েল আবার বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। সেটাও এক অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে। শুধু সেটাই নয়। সেই খুনের দায়ে আর একজন অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষকে ফাঁসাতে চাইছে। এই শেষটুকু ধনরাজের কাছে ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। এই খবর বাইরে ছড়ালে গোটা ফোর্সের বদনাম, এবং অনেককেই হয়তো দায় মাথায় নিয়ে সরে যেতে হবে। ড্যানিয়েলকে তাই সরতেই হবে এবার। ঘুঁটি প্রস্তুত হলো। তার প্রথম ধাপ হিসেবে ড্যানিয়েলকে সরিয়ে কেস তুলে দেওয়া হলো ধনরাজের হাতে। সমস্যা হলো, যা যা সাক্ষ্য পাওয়া গিয়েছে, সবটাই সারকামস্টানশিয়াল। সেখান থেকে ড্যানিয়েলকে সরাসরি অভিযুক্ত করা কঠিন। আদালতে যদি বলা হয় যে মৃত লেখকের অসমাপ্ত উপন্যাস থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গিয়েছে, কেস সেখানেই খারিজ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়। ড্যানিয়েলের অপরাধ বাইরে জানাজানি হোক, ধনরাজ তীব্র বিপক্ষে ছিল এমন মতামতের। তার কাছে সবার আগে ডিপার্টমেন্টের সম্মান। সে চেয়েছিল, ড্যানিয়েল পদত্যাগ করুক। এমনকি আসল খবর পুলিশের নীচতলাতেও যাওয়া চলবে না। সাফাই অভিযান হোক, কিন্তু ঢাক পিটিয়ে নয়। কিন্তু এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটবে, আর পুলিশের কেউ জানবে না, তা হয় না। কয়েকজনকে জানাতেই হতো, তাদের মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেওয়ানো হলো। যে কনস্টেবল, কুলবির থাপা, যাঁর কাছে গিয়ে আপনি কোনো সাহায্যই পাননি তিনি বোধহয় সেই কয়েকজনের একজন ছিলেন। সেই কারণেই পাথরের মতো মুখ করে বলে গিয়েছিলেন যে কিছুই জানেন না, মনে নেই। আর যারা জানতো কেউ সম্ভবত বেঁচে নেই। শেষদিন অবধি তারা মুখ খোলেনি।
‘কিন্তু ড্যানিয়েলকে যে সরানো হবে, এই কাজে মূল বাধা কে? অরুণ চৌধুরী এবং তার উকিল। তারা মুখ খুলতে শুরু করলে অনেক কিছুই বাইরে চলে আসবে। তার সূত্র ধরে ড্যানিয়েলের অতীত কাজ, হত্যা, অত্যাচার, অমিতাভর বিবৃতি, জনস্বার্থ মামলা, সমস্ত কিছু। ক্ষতিটা একা ড্যানিয়েলের হবে না, হবে সমগ্র পুলিশ ফোর্সের। এবং যে ভয়ংকর ডামাডোল শুরু হবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, তার সুযোগ পুরোটাই নেবে ড্যানিয়েল। সে এক এক করে সবার নাম করতে শুরু করবে। কোন হত্যায় কে জড়িয়ে ছিল, কোন ভুয়ো কেস কার মস্তিষ্কপ্রসূত। পুরো পরিস্থিতিটা তখন হয়ে পড়বে কুৎসিত। এটাকে এড়ানো যায় একমাত্র যদি গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। ধনরাজ এবং তৎকালীন ডিএসপি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সমস্তটা জানিয়ে অনুরোধ করলেন, আমরা যদি মুখ বন্ধ রাখি, তাহলে এবং একমাত্র তাহলেই সাফাই অভিযান সম্ভব। ড্যানিয়েলকে সরানোও সম্ভব। না, তার শাস্তি হবে না। কারণ তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাকে পাকাপাকিভবে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। এর পরিবর্তে আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে হবে আজীবনের জন্য। আর আমরা যদি মুখ খুলি, মিডিয়া, মানবাধিকার, আইন আদালত সবাই চলে আসবে ঠিকই, কিন্তু সেই হট্টগোলে ড্যানিয়েল বেরিয়ে যাবে। হ্যাঁ, তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা উঠবে, সেটা সত্যি। কিন্তু পুলিশ তখন নিজেদের জঞ্জাল এবং কুকর্মের ইতিহাস পরিষ্কার করতে এতই ব্যস্ত থাকবে, যে আমাদেরই বিরুদ্ধে চলে যাবে। নিজেদের পিঠ বাঁচাবার জন্য ড্যানিয়েলকে না চাইলেও তারা সমর্থন করে দেবে তখন। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে না। ফল যেটা হবে, মামলা ঝুলে থাকবে বছরের পর বছর। হ্যাঁ, সেটা সামাজিক ন্যায় হয়তো হবে। পুলিশের নির্মমতাকে সামনে আনা অবশ্যই ন্যায়। কিন্তু ড্যানিয়েল বেঁচে যাবে। ধনরাজ আমাদের কাছে দুটো রাস্তা দিলেন। প্রথম রাস্তায়, আমরা মুখ খুলব না। আমি নিঃশর্ত মুক্তি পাব। ড্যানিয়েলকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দেওয়া হবে। দ্বিতীয় রাস্তায়, আমরা আমাদের পছন্দমতো যা করবার করবো। কিন্তু সেক্ষেত্রে পুলিশ নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই ড্যানিয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে যাবে, হয়তো আমাকে ফাঁসিয়েও দেবে অমিতাভর হত্যায়। এবং ড্যানিয়েল শাস্তি নাও পেতে পারে।
‘আপনি হলে কোন রাস্তা বেছে নিতেন, জানি না। আমার কাছে প্রথম রাস্তা বেশি গ্রহণীয় ছিল। আমি সামাজিক ন্যায় নিয়ে ভাবিত নই। আমার দরকার ছিল বন্ধুর হত্যার বিচার। ধনরাজের সঙ্গে আমার মৌখিক চুক্তি হলো। জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট। আমরা দুজনেই এ ব্যাপারে নিজের জীবদ্দশায় বাইরে কিছু বলব না। আমি একটা বাড়তি শর্ত রেখেছিলাম। অন্য কেউ যদি নিজে থেকে এই সত্য আবিষ্কার করে, তাহলে তার কাছে পুরোটা স্বীকার করব। এটার কারণ, আমি চেয়েছিলাম মৃত্যুর আগে অমিতাভর উপন্যাসটা অসমাপ্ত অবস্থাতেই প্রকাশ করে যেতে। সেটা পড়ে যদি কেউ সত্যিটা বার করে, তাহলে লুকোবো না। ধনরাজ কী ভেবেছিল জানি না। শর্তে রাজি হলো।
‘ড্যানিয়েল চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাকে প্রথমে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হলো। তারপর সমস্ত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। সে প্রতিদিন থানাতে আসতো। হাতে কোনো কাজ নেই। বসে বসে মাইনে পেত। কারণ হিসেবে ওর বিরুদ্ধে একটা মানবাধিকার সংগঠনের দায়ের করা মামলার কিছু আইনি মারপ্যাঁচ তুলে আনা হলো। সেই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নাকি অভিযুক্ত অফিসারকে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া চলবে না, এরকম একটা আইন ধুলো ঝেড়ে সামনে হাজির করা হলো। ড্যানিয়েল সমস্তটা বুঝলো। কিন্তু অমিতাভ মিত্র-র হত্যা বিষয়ে যেহেতু কেউ তাকে অভিযুক্ত করেনি, একটা কথাও বলেনি সেই বিষয়ে, ড্যানিয়েল প্রত্যাঘাত করতে পারলো না। তার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ, জনস্বার্থ মামলা, সেটা আপাতভাবে সত্যি। সেই মামলাতে অভিযুক্ত হবার ফলে যদি তাকে কিছুদিন বসিয়ে রাখা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে টেকনিকালি কিছুই বলার নেই। এটা তো আর শাস্তি নয়! ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে এমনকি কমিশনও বসেনি। শুধু বসিয়ে রাখা হলো দিনের পর দিন। এই অবস্থা কোনো আত্মসম্মানওয়ালা মানুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কয়েক মাস পর ড্যানিয়েল পদত্যাগ করলো। দীর্ঘ চেষ্টার অবসান হলো। ঘুঁটি নড়ে গেল ড্যানিয়েল লামার। রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল নতুন নায়ক, ধনরাজ গম্বু।
‘এই যে কথাগুলো আপনাকে বলছি এখন, এতকিছু আমি একদিনে জানিনি বহুদিন ধরে খুঁজে খুঁজে, একে ওকে জিজ্ঞাসা করে, পুলিশের মধ্যে খোঁজ লাগিয়ে আস্তে আস্তে পুরো গল্পটা জেনেছি। শেষে গিয়ে সবাই সব কিছু পেল, যা তারা চেয়েছিল। আমি পেলাম ড্যানিয়েলের শাস্তি। ধনরাজ পেল ক্ষমতা। পুলিশ পেল দুর্নামের ভয় থেকে মুক্তি। শুধু আমার বন্ধুটাই আর বেঁচে থাকলো না।’
অরুণ থামলেন। দেখলাম, তাঁর চোখে জল টলটল করছে। টোকা মারলেই ভেঙে পড়বে। নিজেকে প্রবল চেষ্টায় সামলে চোখে হাত চাপা দিলেন অরুণ। কিছুটা সময় পর হাত সরিয়ে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। ‘সরি।’
‘শেষ একটাই কথা জানার। ঋষি রোডের বাড়ির ঠিকানা আর ছবি, আপনিই মেসেজ করেছিলেন। তাই তো?’
অরুণ চমকালেন। ‘আপনি বুঝলেন কী করে?
‘কবিতাটি। আপনিও তো আমার মতোই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। কিন্তু নিজের মুখে বললেন না কেন?’
‘বাড়িটার কথা আমাকে অমিতাভ বলেছিল। তখনও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। ও ড্যানিয়েলের পিছু নিয়ে ওই বাড়ির সন্ধান পেয়েছিল। ড্যানিয়েলের টর্চার সেল। মুক্তি পেয়ে আমি বাড়িটাকে খুঁজে বার করি। দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছবিটা দেখি। রামবীরকে ড্যানিয়েলের ছবি দেখাই। রামবীর শনাক্ত করে, এই লোকটাকে সে বাড়ির ভেতর দেখেছে। তারপর থেকে আর ওই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারিনি। জানতাম, ঢুকলেই অমিতাভর স্মৃতি তাড়া করবে। কিন্তু ছবি তুলে রেখেছিলাম। খবর রাখতাম, বিক্রি হয়ে গেল কিনা, বেহাত হলো কিনা। বাড়িটা ইম্পর্ট্যান্ট ছিল, কারণ ওটা ছিল ড্যানিয়েলের কুকীর্তির একটা সাক্ষ্য। কিন্তু ধনরাজের সঙ্গে চুক্তির ফলে বাইরে সে কথা প্রকাশ করিনি। আর ড্যানিয়েলও ততদিনে নিজের যা প্রাপ্য সেটুকু পেয়ে গিয়েছে। আপনাকে সরাসরিই বলতে পারতাম। কিন্তু তখন আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন। হয়তো ভাবতেন, বাড়ির ব্যাপারটা বানানো। আপনার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেবার জন্য আমার চাল। তাই নিজের মুখে বলতে চাইনি।
‘আপনি কি এই কারণেই বারবার অমিতাভর সময়কার কবিতা পড়তে বলছিলেন? রাজনীতি, প্রতিশোধের থিমগুলোকে দেখাতে চাইছিলেন? অমিতাভর কবিতায়, পরে গল্প বা গদ্যেও, এত রাগ, বিস্ফোরণ সেটার পেছনে যে নকশালবাড়ির সময়, সত্তর দশকের কবিতা, আর সেটা এই রহস্যের মূল পটভূমি, এগুলো কানেক্ট করা সত্যিই সম্ভব নয়, যদি না সেই সময়কার সাহিত্য অন্তত কিছুটা না জানা থাকে।’
অরুণ উত্তর দিলেন না।
‘আপনাকে সন্দেহ করবার কারণ একটাই। প্রথম দিন বলেছিলেন, অমিতাভকে আপনি হত্যা করেছেন।’
‘সেটা এখনও আমি মনে করি। ওকে হত্যার দায় যতটা ড্যানিয়েলের, ততটাই আমার। যদি ওকে সেদিন বাড়িতে না ডাকতাম, ও বেঁচে থাকতো। চুয়াল্লিশ বছর ধরে প্রতিটা দিন ভেবে গিয়েছি, কেন ওকে সেদিন ডাকলাম! কেন ড্যানিয়েলের কথায় ভুললাম, রেগে গিয়েছি, ঘৃণা করেছি নিজেকে। হয়তো অনেকটা সেই কারণেই আমিও আর জনসমক্ষে তেড়েফুঁড়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতাম না। ভেতরে ভেতরে জানতাম, রক্ত আমার হাতেও লেগে আছে।’ কুয়াশাটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাচ্ছে। কাঁপা ছবির মতো ভেসে উঠছে দূরের পাহাড়, জঙ্গল। বহু, বহুক্ষণ আমরা মুখোমুখি বসে ছিলাম নীরব। হয়তো দুজনেই মনে মনে এক অকালমৃত তরুণ কবির কথা ভেবে চলেছিলাম। অথবা ড্যানিয়েলের কথা। অথবা হয়তো না। আমি শুধুই দেখে যাচ্ছিলাম অরুণের কপালের ওপর ঝামরে পড়া চুলকে।
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। অরুণও উঠলেন। সম্ভবত আমার কিছুই বলবার ছিল না। বিদায় নেবারও ছিল না। তবুও আমি চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ফিরে দেখলাম, অরুণ আমার চোখে চোখ মেলে দিয়েছেন। সেই দৃষ্টির ভাষা বোঝবার ক্ষমতা ছিল না। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম তাঁর হাত। কিন্তু ছুঁতে পারলাম না। সরিয়ে নিলাম নিজেকে। তারপর ফিসফিস করে বললাম, ‘আপনার কোনো দায় ছিল না। হাতে রক্তের দাগ ছিল না। আমি বিশ্বাস করি, ছিল না।
গেট দিয়ে বেরোবার সময়ে পেছন ফিরে দেখলাম, অস্বচ্ছ কুয়াশার মধ্যে অরুণ নিশ্চল হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।