১৭
ফোন বন্ধ করে সিদ্ধার্থের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, ‘কী মনে হচ্ছে? মাথায় আসছে কিছু?’
বার্গারে কামড় বসাবার আগে সিদ্ধার্থ উত্তর দিল, ‘গল্পের জন্য প্রচুর উপাদান তো জোগাড় হয়েই গেছে। আর কত চাইছেন?’
রাত প্রায় নটা। আমরা ডিনার করছিলাম চৌরাস্তার কাছে একটা রেস্তোরাঁয়। আমিই সিদ্ধার্থকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম, এতটাই উত্তেজিত লাগছে যে সেটা ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছিল।
‘আনন্দ পাঠকের লিস্টের আর একজনকে কনট্যাক্ট করে পাইনি। বিনয়েন্দ্র মুস্তাফি, অরুণের স্কুলের বন্ধু। শুনলাম, কলকাতায় গেছেন। তবে তাঁকে আর দরকার নেই হয়তো। আপনার কাকা ঠিকই বলেছিলেন সিদ্ধার্থ। অমিতাভর উপন্যাসই হলো রহস্যের দরজা খোলার চাবি।’
‘হতে পারে। ফটোকপি করে রেখে দিয়েছি আমার কাছে, কিন্তু অর্ধেকের বেশি পড়তে পারিনি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, একেবারে সমাধানে পৌঁছে গিয়েছেন?’
কিছু ছোটোখাটো খটকা এখনও মেলেনি। কিন্তু হ্যাঁ, বড়ো প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গিয়েছি ধরতে পারেন।’
‘তাহলে বলুন আমাকে। বোঝান। তার আগে এটা বলুন, আমার কাকা কি হত্যাকারী? এটা জানা সবার আগে দরকার।
‘না। অরুণ চৌধুরী হত্যাকারী নন।’
সিদ্ধার্থ একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। জানালার দিকে চোখ মেলে বলল, ‘মুখে যতই বলি না কেন, কাকার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে এটা ভাবতেই আমার…’
‘কিন্তু আমার ধারণাগুলো প্রমাণ করতে পারব না। পারব না, তার কারণ মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। বহু সাক্ষ্যপ্রমাণই লুপ্ত। অন্তত সঞ্জয় অধিকারী বেঁচে থাকলেও কিছু সাক্ষ্য দিতে পারতেন, যেহেতু অমিতাভকে চিনতেন। তিনিও আর নেই।’
‘ধারণাগুলো বলুন।’
‘অরুণ চৌধুরী খুন করতে পারেন না, কিন্তু খুন এমনভাবে হয়েছিল যে তাঁর ওপর সন্দেহ পড়ে।
‘খুন করতে পারেন না কেন?’
‘পারেন না, কারণ এক তো অ্যালিবাই। দ্বিতীয়ত, আজ পুলিশ লাইব্রেরিতে গিয়ে পুরোনো রিপোর্ট ঘেঁটে একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য পেয়েছি। অমিতাভর মুখে এবং বুকে গুলি করা হয়েছিল ৭.৬২ × ২৫ মিলিমিটার টোকারেভ বুলেট দিয়ে। এই বুলেট মূলত ব্যবহার করা হতো সোভিয়েত পুলিশে। সত্তরের দশকে ভারতের স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রক সোভিয়েত থেকে এই বুলেট আমদানি করে। রাজ্য পুলিশের হেডকোয়ার্টারে নির্দেশ আসে এবার থেকে এটা ব্যবহারে। ইন্দিরা গান্ধির আমলে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রীর ফলে যে বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো হয়েছিল, টোকারেভের আমদানি সম্ভবত তারই অংশ ছিল। সত্তরের দশকে নকশাল দমনে এবং আশির শুরুতে খালিস্তানি সমস্যা দমনে এই বুলেটের ব্যবহার প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। আজকাল এই বুলেট আর বিশেষ জনপ্রিয় নয়। মজার ব্যাপার যেটা, টোকারেভের ব্যবহার পুলিশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক ছাড়া নিষিদ্ধ ছিল।’
‘তো?’
‘তো এটাই, অরুণের যদি কোনো সহকারীও থাকে, সে কীভাবে টোকারেভের সন্ধান পাবে? যদি না…’
‘যদি না সে নিজে পুলিশ হয়।’
‘ঠিক। আর পুলিশের মধ্যে অরুণের সহকারী লুকিয়ে থাকলে অরুণ গ্রেপ্তার হতেন না। সব সন্দেহ তাঁর ওপর পড়তো না, পুলিশ তাঁকে হ্যারাসও করতো না। বরং সেই সহকারী তদন্তের অভিমুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিত।’
‘কিন্তু যদি এমন হয় যে ধনরাজ গম্ব কাকার সহকারী? মনে রাখবেন, কেস ধনরাজের হাতে আসার পরেই কিন্তু কাকা ছাড়া পেয়েছিল।’
‘ধনরাজের হওয়া অসম্ভব। কারণ সেদিন রাত দশটা থেকে তিনি তদন্তে ঢুকে গেছেন। অরুণ চৌধুরীর বাড়িতে গেছেন, সেখান থেকে থানায় এসে সারারাত ছিলেন। তাঁর অ্যালিবাই অরুণের মতোই পোক্ত। এবার বলতে পারেন, ধনরাজের নির্দেশে তাঁর অধস্তন কোনো পুলিশ গিয়ে খুনটা করেছে। তা সেই পুলিশকে ধনরাজ জানালেন কখন? দুজন কনস্টেবল তাঁর সঙ্গে রাত দশটা থেকে বারোটা, মানে অরুণের বাড়ি থেকে থানায় আসা অবধি পুরো সময়টা ছিলেন, এবং তার পরেও ভোর অবধি ডিউটি করেছেন। তাহলে ধনরাজকে যদি নির্দেশ দিতেই হয়, থানায় ফিরে এসে দিতে হয়েছে, মানে রাত বারোটার পর। কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট বলছে, সেদিন থানায় যাদের ডিউটি ছিল, সকলেই পুরো সময়টা কভার করেছে, এবং থানাতে থেকেছে, কারণ সেই রাতে মিসেস বাসুর ফোন ছাড়া আর কোনো অভিযোগ আসেনি। তাহলে যদি নির্দেশ দিতেই হয়, একমাত্র সেই সব পুলিশের কাছেই নির্দেশ যেতে হয় সেই রাত্রে যাঁদের ডিউটি ছিল না। ঠিক? ধনরাজ কীভাবে এই নির্দেশ দিতে পারতেন? ফোন করে। কিন্তু থানা থেকে রাত বারোটার পর একটাই ফোন গিয়েছিল। সেটা অরুণ চৌধুরীর আইনজীবী মিস্টার প্যাটেলের বাড়ির নম্বরে। সম্ভবত অরুণ থানা থেকে ফোন করেছিলেন। কীভাবে জানলাম এটা? ধনরাজ গম্ব টেলিফোন অফিস থেকে কল লিস্ট আনিয়েছিলেন। সেটাও পুলিশ ফাইলে আছে। সম্ভবত এটা চেক করবার জন্য যে ড্যানিয়েলকে সেই রাত্রে কেউ ফোন করেছিল কিনা। আরেকটা সম্ভাবনা আছে, ধনরাজ আগে থেকেই কোনো অধস্তনকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। বাকিটা নাটক। কিন্তু সেই নাটক করবার দরকার পড়ল কেন? পুলিশ সেই সময়ে অনেককে মারছে, অমিতাভকে চুপচাপ এনকাউন্টার করে দিলেই পারতো, কেউ জিজ্ঞাসাও করত না। এমনভাবে সাজাবার দরকার পড়ল কেন যে অরুণের উপর সন্দেহ হয়? না, পুলিশের সঙ্গে অরুণের যোগসাজশ যৌক্তিক নয়। আজকের স্মার্টফোনের যুগ হলে ধনরাজকে এত সহজে ক্লিশ- চিট দেওয়া যেত না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ধনরাজ এই খুনে জড়িত নন।
‘কিন্তু আপনার সূত্র মানলে, অমিতাভকে তো খুন করেছে পুলিশেরই কেউ।’ ‘ধনরাজও সেই সিদ্ধান্তেই এসেছিলেন সম্ভবত। আর তাঁর অনুমানকে সিলমোহর দিয়েছিল অমিতাভর উপন্যাস।’
‘উপন্যাসের কথায় পরে আসব। ওটা পুরোটা না পড়লে আলোচনা করা যাবে না। আমি এখন ডেভিলস অ্যাডভোকেট সাজতে চাই। যতক্ষণ না কাকার নির্দোষ থাকাকে নিজের কাছে নিশ্চিত করতে পারছি, প্রশ্ন করেই যাব।’
‘বলুন।’
‘এমন কি হতে পারে না যে কাকার সেই তথাকথিত সহকারী টোকারেভ বুলেট চুরি করেছিল?’
‘মানে পুলিশের কাছ থেকে? এটা অসম্ভব, যদি না ডাকাতি হয়। সেরকম ডাকাতির কোনো খবর চকবাজার পুলিশ স্টেশন বা সদর পুলিশের ইতিহাসে নেই।
উঁহু, ভুলে যাচ্ছেন কেন যে নকশাল জমানায় পুলিশের মালখানা থেকে অস্ত্র লুঠ হতো প্রচুর।
‘ঠিক। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নকশাল জমানা বলে আর কিছু ছিল না। ১৯৭২ সালের পর থেকেই সব প্রায় শেষ। দার্জিলিং জেলাতে শেষ অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে। চার-পাঁচ বছর আগে লুঠ হওয়া বুলেট ব্যবহার না করে রেখে দেওয়া হলো, এবং ১৯৭৫ সালে এসে সেটার ব্যবহার করা হলো, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়? যারা বুলেট লুঠ করেছিল, তারা তো রাজনৈতিক কর্মী। নিজেদের ব্যবহারের জন্য লুঠ করেছিল। অস্ত্র ব্যবসায়ী নয় যে খোলা বাজারে বিক্রি করবে।’
হুঁ, তাহলে কাকা খুন করতে পারে না। তাই তো?’
‘না। কিন্তু খুন এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে তাঁর ওপর সব দোষ এসে পড়ে।’
‘কে খুন করেছিল তাহলে?’
‘এখনও বুঝছেন না? ড্যানিয়েল লামা। একমাত্র ওটাই সলিউশন।’
‘কিন্তু এত কিছু সাজাল কীভাবে?’
উত্তর দিতে যাব, হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম। একটা জিপের উপর বসে গিরিরাজ একদৃষ্টে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার কী যে হলো, রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সটান গিরিরাজের দিকে চলে গেলাম। সিদ্ধার্থ ব্যাবাচ্যাকা খেয়ে অনুসরণ করবে কিনা বুঝতে পারল না। রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল। গিরিরাজও চমকে উঠেছে। ভাবেনি যে আমি ওর সামনে এসে দাঁড়াব।
গিরিরাজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আমাকে অনুসরণ করবার নির্দেশ কি ড্যানিয়েল দিয়েছেন?’
গিরিরাজের মুখ কঠিন হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি এখান থেকে চলে যান ম্যাডাম! এতে আপনার এবং আমাদের সবার মঙ্গল, এখন ভালোভাবে বলছি, কিন্তু এর পরে আর এত ভদ্র ভাষা ব্যবহার নাও করতে পারি।’
‘সেদিন রাত্রিবেলা জিপ করে আপনিই তাহলে আমাদের অনুসরণ করছিলেন?’
গিরিরাজ শক্তহাতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরল। হাতের মোটা মোটা গাঁটগুলো ফেটে পড়ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘আমি কারোর হুকুমে কাজ করি না।’
‘আর আমি আসার দিন জলাপাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা? হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আমার ওপর নজরদারি চালানো? সেগুলোও কি কারোর নির্দেশে না? আপনি চানটা কী? আপনার মালিকই বা কী চান? আমাকে ভয় দেখাতে?’
লাল হয়ে উঠল গিরিরাজের মুখ। আমার দিকে শরীরটা এগিয়ে দিল, নাকে ধক করে এসে লাগল সস্তা মদের উগ্র গন্ধ, ‘আমার মালিক বলে কেউ নেই। গিরিরাজ কারোর পোষা কুকুর নয় যে চাবুকের ভয়ে কাজ করবে। আপনাকে ওয়ার্নিং দেবার ছিল, দিয়ে দিয়েছি। তার পরেও যদি শহর ছেড়ে না যান, তার ফল ভালো হবে না।’
‘কার জন্যে ভালো হবে না? ড্যানিয়েলের জন্য?’ গিরিরাজ উত্তর দিল না।
‘আমি এখনই ড্যানিয়েলের বাড়ি যাব। ভয় নেই, আপনাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমার গাড়ি আছে। কেন যাব বলুন তো? গিয়ে বলে আসব যে ওঁকে ভয় পাই না। আরও কিছু কথা বলব, কিন্তু সেগুলো আপনার না জানলেও চলবে।’ মাথায় আগুন জ্বলছিল। চিবিয়ে চিবিয়ে গিরিরাজকে আরও আহত করবার জন্য বললাম, ‘মালিকদের মধ্যেকার সব কথা চাকরবাকরদের জানতে নেই।’
গিরিরাজ দাঁতে দাঁত চিপল। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছিল। ততক্ষণে সিদ্ধার্থ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার দিকে ঘুরলাম। ‘চলুন আমার সঙ্গে।’
‘কোথায়?’
‘ড্যানিয়েল লামার বাড়ি।’
এবার ড্যানিয়েলের বাড়িতে ঢুকতে বেগ পেতে হলো না। নিজের নাম বলবার দু-মিনিটের মধ্যে গেট খুলে গেল। একটা ছিমছাম আধুনিক কেতায় সাজানো ড্রইং রুম। এলইডি স্ক্রিনের বিশাল টিভি, তার সামনে তিন দিক ঘিরে সাজানো ধবধবে সাদা সোফা। একদিকের দেয়ালের কাচবন্ধ তাকে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রাখা। নানারকম মডেল তাদের, অদ্ভুত সমস্ত শেপ। টেবিলের ওপর একটা ক্যাটালগ দেখতে পেলাম। ২০১০-এর পর তৈরি হওয়া বিভিন্ন ধরনের বন্দুকের ক্যাটালগ। ড্যানিয়েলের শখ কিছুটা বুঝতে পারছি। দেয়ালের অন্যপাশে একটা ছোটো বুকশেল্ফ। অবাক হয়ে দেখলাম, সারি সারি বিদেশি নাটকের বই সাজানো। লোকটা কি তাহলে গল্প উপন্যাস পড়ে না? নাকি শুধুই নাটকীয়তা নিয়ে অবসেসড?
স্লিপিং গাউন পরা ড্যানিয়েল সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। চোখ রক্তাভ। বোঝা গেল, ড্রিংক করেছেন। ভুরু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালেন, ‘আমি এত রাত্রে কোনো অতিথিকে ঢুকতে দিই না বাড়িতে। আপনাকে দিয়েছি, কারণ মনে হয়েছে আপনি হয়তো কোনো নতুন উপায়ে আমার সময় নষ্ট করতে পারেন। তিন মিনিট দিতে পারি। আর ইনি কে? আপনার ওয়াটসন?’
সংক্ষেপে সিদ্ধার্থর পরিচয় দিলাম। ড্যানিয়েল গ্রাহ্যও করলেন না। একটা সোফায় বসলেন, কিন্তু আমাদের বসতে বললেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললাম, ‘মিস্টার লামা, এটাই বলতে এলাম যে আপনার হুমকিতে ভয় পাই না। গিরিরাজকে বলে দেবেন, দরকার পড়লে পুলিশের সুরক্ষা নিয়ে এই শহরে আমি থেকে যাব।’
‘শুধু এটুকু বলতেই এত দূর এলেন? আমার ফোন নাম্বার সম্ভবত কাল রাত থেকেই আপনার কাছে আছে।’
‘শুধু এটুকুই নয়।’আমি থামলাম, এবং তারপর বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে গুছিয়ে নিলাম নিজেকে। ‘এটাও বলতে এলাম যে অমিতাভ মিত্রর হত্যারহস্য আমি সমাধান করেছি।’
‘যে রহস্য নিয়ে গত চল্লিশ বছর ধরে লোকজন মাথা কুটে মরেছে তার সমাধান সাতদিনেই করে ফেললেন? আপনি কি নিছকই শার্লক হোমস, না নিজেকে অত্যন্ত বেশি পরিমাণে ওভারে এস্টিমেট করা শার্লক হোমস?’
‘সমাধান আপনার জন্য সুখকর হবে না।’
‘মানে?’
‘মানেটা আপনিও জানেন। এই কারণেই পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাই না? না কি একরকম সরিয়েই দেওয়া হয়েছিল? এক্সট্রা- জুডিশিয়াল কিলিং-এর কারণে সত্তরের দশকে অবশ্য অনেক পুলিশ অফিসারেরই কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল। আবার অনেকের শাস্তিও হয়নি। অমিতাভ মিত্রকে এনকাউন্টার করবার কারণেই আপনাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাকি পেছনে আরও বড়ো গল্প আছে?’
প্রস্তুত ছিলাম, ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটবে। হয়তো শারীরিক আক্রমণও করতে পারেন। কিন্তু ড্যানিয়েল দুম করে কেমন নিভে গেলেন। কাঁধ ঝুলে গেল মনে হলো। নিজের মনেই দু-বার মাথা নাড়লেন। তারপর চোখ নামিয়ে বলেন, ‘এই তাহলে আপনার সমাধান?’
‘আপনি কি শুনতে চান?’
‘না। শুনতে চাই না।’ ক্লান্তভাবে নিজের শরীরটা এলিয়ে দিলেন সোফাতে। ‘আমি আর কিছুই শুনতে চাই না। এই শহর, এই ডিপার্টমেন্ট, এরা কেউ আমাকে ডিজার্ভ করে না। এই ভয়টাই পেয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম, যে…’
‘যে, আমি সত্যিটা খুঁজে বার করব।’
ড্যানিয়েল আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘ভয় পেয়েছিলাম যে, আপনি কিছুই বুঝবেন না। আর সেই না বোঝাটা আপনার কলমের মধ্যে দিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ ইডিয়ট অর্ধশিক্ষিত পাঠক গিলবে।’
‘আর সেই জন্য হাতকে নিষ্কলঙ্ক রাখবার জন্য নিজে থেকেই আজ সকালবেলা বারবার বলে যাচ্ছিলেন যে অরুণ চৌধুরী খুনি? আমি জিজ্ঞাসা না করা সত্ত্বেও?’ ‘আমার হাত নিষ্কলঙ্ক নয়।’ গর্জে উঠলেন ড্যানিয়েল, কিন্তু আমার কানে সেটা হাহাকারের মতো শোনাল। ‘আমি নিজে কোনোদিন এই অহংকারে মরতে পারবো না যে আমার হাতে রক্ত লেগে নেই। এই অহংকারের মুখে আমি লাথি মারি! আই অ্যাম প্রাউড অফ মাইসেল্ফ! আর যা বলেছি, আবার বলব। অরুণই খুনি।’
‘ঠিক যেটা বলে বলে মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছেন এতদিন? জানেন তো, বারবার একটা মিথ্যেকে বলে যেতে যেতে সেটাই সত্যি বলে মানুষ ধরে নেয়?’
‘আপনার কি মনে হয় মানুষ কী ধরে নিল তা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে? মানুষকে আমি ঘৃণা করি। যা খুশি লিখুন। আর কিস্যু এসে যায় না। অনেকটা সময় চলে গেছে।’ আবার সেই পুরোনো ড্যানিয়েল ফিরে আসছেন। খোঁচা খাওয়া আহত বাঘের মতো অপেক্ষা করছেন, কখন লাফিয়ে উঠে টুটি টিপে ধরবেন।
‘আপনার দেওয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে যে নির্ধারিত তিন মিনিট শেষ। কাজেই, আমরা এবার বেরিয়ে যাব। ভয় নেই, পুলিশকে কিছু জানাবার দায় আমার নেই। নিজের লেখাতে সিদ্ধান্তগুলো শুধু দেখিয়ে দেব। তার ওপর ভিত্তি করে পুলিশ কিছু ব্যবস্থা নেবে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার।’
বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। সিদ্ধার্থও আমার পেছনে। ড্যানিয়েল তখন ডাকলেন, ‘মিস ভট্টাচার্য!’ গম্ভীর এবং অন্যরকম সেই ডাক। কোণঠাসা মানুষটা আর নেই। ফিরে দেখলাম, আবার সম্রাট বসে আছেন নিজের সিংহাসনে।
‘বলুন।’
‘রহস্যকাহিনীর প্রতি আপনার আকর্ষণ কেন? এটা সবার খেলাধুলো করবার জায়গা নয়, জানেন না? আগুনে হাত দিলে হাত পোড়ে। সেটা যে হাত দিচ্ছে, তার দোষ। আগুনের নয়।
‘কী করব বলুন! আমার বাবা ছোটোবেলা থেকেই আগুন সম্বন্ধে আমাকে সাবধান করে দেননি যে! নিজে হাতে করে রহস্য আর থ্রিলার কিনে আনতেন। সৌভাগ্যক্রমে বাবা আপনার মতো কেউ ছিলেন না যিনি জোনাকির আলোকে আগুন বলে সাবধান করে দেবেন।
‘ওয়ার্থলেস!’ গর্জে উঠলেন ড্যানিয়েল। জীবনটা কোনান ডয়েলের উপন্যাস নয়। একবারও ভেবে দেখলেন না অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগ কীভাবে এল! পুলিশ রিপোর্টে ছিল। হয়তো পড়েওছেন। কিন্তু খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেননি। এটাও নজরে পড়ল না যে আমি যদি ওই ১১ জুনের খুনটা করতাম তাহলে সোজাসুজি গুলি চালাতাম, যেটা আমার মোডাস অপারেন্ডি। গুলি চালাবার আগে তার কবজি কাটতে যেতাম না। কোনো পুলিশ অফিসার সেটা করবে না, কারণ সেটা তার চরিত্রের বিরুদ্ধে যায়। আরও একটা কথা। স্পষ্ট ভাবে শুনে নিন। আপনাকে কে কী বুঝিয়েছে জানি না, কিন্তু আমার নার্ভের সমস্যা। জোরে আওয়াজ সহ্য করতে পারি না। না বোঝেন সাইকোলজি, না বোঝেন লজিক। কী সাংঘাতিক ডিজঅ্যাপয়েন্টিং আপনি।
কোথা থেকে কী প্রসঙ্গ! অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগ থেকে নিজের নার্ভের সমস্যা! চাপে পড়ে এবার দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন ড্যানিয়েল। উলটোপালটা বকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। হালকা গলায় উত্তর দিলাম, ‘সব সমাধান কি এখানেই শুনতে চান? সময় তো দিয়েছিলেন তিন মিনিট মাত্র! স্টোরিটা বেরোলে পাঠিয়ে দেব না হয় আপনাকে! কিস্তিতে কিস্তিতে।’
‘দরকার নেই! জানি কী লিখবেন। আপনি নতুন করে কিছুই আবিষ্কার করেননি। ঠিক এই অভিযোগেই কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আপনারা কেউ কিচ্ছু বোঝেন না, বোকা অশিক্ষিত সমাজকে দাবিয়ে রাখার জন্যে যেমন আমার মতো পুলিশ অফিসারের দরকার পড়ে, তাদের ভুল তথ্য গেলাবার জন্যে দরকার পড়ে আপনাদের।’
‘একটা জিনিসই বুঝিনি। আপনার অপরাধ পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি কেন?’
‘বেরিয়ে যান।’চিৎকার করে উঠলেন ড্যানিয়েল। ‘দূর হয়ে যান আমার চোখের সামনে থেকে। আপনারা সবাই!’
মায়া লাগল। নখদন্তহীন বৃদ্ধ বাঘকে দেখে যেমন লাগে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়া উচিত হবে না আর। চলে যাচ্ছি। গিরিরাজকে বলে দেবেন, আমাকে ফলো করে বা ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না।’
বেরোতে যাচ্ছি, ড্যানিয়েল ডাকলেন আবার, ‘মিস ভট্টাচার্য।’
পিছু ফিরলাম।
ক্লান্ত ভাবে চোখ বুজলেন ড্যানিয়েল। অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগ ছিল। ওটাই একমাত্র ব্লু। একমাত্র।
***
২৩/০৩/১৯৭৪
শম্ভু
মেদিনীপুরের কবি সম্মেলনে যাওয়া হবে না ভাই। লিভারের সমস্যাটা ভোগাচ্ছে খুব। অরুণ বলছে, না কমলে কলকাতায় নিয়ে যাবে। এখন কিছু দিন বাড়িতেই থাকতে হবে। তবে কবিতা পাঠিয়ে দেব যথাসময়ে। তুই পড়ে নিস।
এবার যেটা বলার, আসল সে-কথায় আসি। একটা ভুল স্বীকার করবার আছে শম্ভু। কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই আমি তোর কবিতাকে গুরুত্ব দিইনি এতদিন। ভাবতাম তুই মূলত সংগঠক আর সম্পাদক হিসেবে বেশি দক্ষ। তুইও নিজে থেকে কখনো নিজের ব্যাপারে একটাও কথা বলিসনি। কিন্তু প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না পড়ে আমার ভুল ভেঙেছে। দার্জিলিং-এ তো সব বই ঠিক সময়ে মেলে না, তোর বইও আসতে দেরি হলো অনেকটা। এবং পড়ে তড়িদাহত হয়েছি। মনে হয়েছে, আমার এ যাবৎকালের সমস্ত প্রস্তুতি এক লহমায় মিথ্যে হয়ে গেল, কারণ এ কবিতা আমি কখনো লিখতে পারবো না। সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ কোনো এক উন্নাসিকতা থেকে আক্রান্ত হয়েই পড়িনি। প্রিয় ধ্বনি পড়বার পরে ফিরে গিয়ে পড়লাম তোর প্রথম বই। আমার এ যাবৎ সমস্ত পাঠের অভিজ্ঞতা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। স্থিতিশীল মুদ্রা ও পালক ও পশুপাখির রূপায়ণ— প্রীতিময়ী সরস্বতী তুমি, নানারকম ধারণা মতামত প্রকাশ করে যাও/ রঙে ও সবুজে বরফস্তূপে, বিস্ময়কর অভিকর্ষের সম্ভারে/ যেমন নিয়মের কোনখানে পদার্থের বা ভূমিকম্পের পূর্বাভাষ দেওয়ার সার্থকতা— এতবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে গেছে, স্মৃতি থেকে লিখলাম। শব্দের পুনরাবৃত্তি সিনট্যাকসের বিপর্যয়, আকস্মিক বিপরীতধর্মী শব্দের ব্যবহার, এগুলো এতটাই অভিনব লাগছে যে ফিরে ফিরে পড়তে হচ্ছে। এতদিন কেন আমি ভেবেছিলাম শম্ভু ভিড়ের মধ্যে নিছক একটা মুখ? জানি না। কিন্তু ভুল ভেঙেছে শম্ভু। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। সম্ভবত আমাদের দশককে চিহ্নিত করবার সময়ে যে চার-পাঁচটা নাম বলতে হবে, তার মধ্যে তুই থাকবি। এখনই বলছি, তুই বীতশোক, পার্থ, তুষার, অনন্য (একে না চিনলে চিনে নে, মণীন্দ্র রায়ের ছেলে, বাচ্চা বয়েস থেকে লিখছে, এখনও গাল টিপলে দুধ বেরোবে, কিন্তু অন্য গ্রহের কবিতা লিখছে)— আর কে কে জানি না, হয়তো আরও আসবে আগামী দিনে, কিন্তু আমার আজকের কথাগুলো মিলিয়ে নিস।
আর কিছু লেখার নেই। সেই তোর সঙ্গে দেখা পাঁচ বছর আগে। কতদিন কেটে গেল তারপর! নির্জন কোণায় পড়ে আছি, কারোর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। উত্তরবঙ্গকে কেউই মনে হয় ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তবু তোদের আমন্ত্রণপত্র পেয়ে ভালো লাগলো। যাওয়া হবে না। আজকাল কোথাও যাওয়া হয় না। নির্জনে চলে গেছি অনেক। তবে কবিতা লিখব অনেক। গল্পও। গদ্য লিখতে ভালো লাগছে আজকাল, মনে হচ্ছে অনেক অনেক গল্প ভাঁড়ারে, কবিতার গণ্ডীতে যাদের ধরা যাবে না।
ভালো থাকিস
অমিতাভ
***
আগামী কিছুদিন গল্পই লিখবো ভাবছি। কবিতা থেকে একটা ব্রেক দরকার। আর তোরা চলে আসার পর আমি এমন কিছু লিখবো না, যা খুব নতুন হবে। চারপাশের অবস্থা দেখে মাথা একটু গরমও আছে। এই মেজাজে কবিতা লেখা কঠিন। ভালো থাক।
***
মিলন আজ চলে গেল। অসহনীয় দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে আর পারলো না। মিলন কবি ছিল না। গল্পকারও না। হয়তো একটা-দুটো কবিতা লিখেছে কখনো, কিন্তু সেটা ওর আসল পরিচয় নয়। ও আসলে লিটল ম্যাগাজিনের সংগঠক, দিনহাটায় যে চার-পাঁচটা সিরিয়াস কাগজ এখন বেরোচ্ছে, তার দুটোর সঙ্গে ও শুরু থেকে জড়িয়ে। প্রেসের কাজ, কাঁধে করে বই নিয়ে আসা, ডিস্ট্রিবিউট করা, যে যে কাজগুলো থ্যাংকলেস, সেগুলোর জন্য মিলন ছিল। একটা টাকাও এসব থেকে ও কোনোদিন পায়নি। টাকা কোথায় যে পাবে! এমনকি ওর নামও বেরোতো না কাগজগুলোতে। তা সত্ত্বেও কোথায় ওর ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল, আমরা বুঝিনি কেউ। মিলন কোনো চাকরি পায়নি। গ্র্যাজুয়েট হয়ে বসেছিল অনেকদিন, তারপর ‘৬৬ সালে একটা চায়ের দোকান দিল ধারদেনা করে। অনেকদিন ধরেই সেই দোকানে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো। অশ্বমেধের ঘোড়ার প্ল্যান ওখানেই। দোকানের সময় বাদে বাকি সময়টা মিলন লিটল ম্যাগাজিনে দিত। সিপিআই-এমএলদের সঙ্গে ওর কিছু ঘনিষ্ঠতা ছিল, যে কারণে পুলিশের খাতায় নাম উঠে যায়। ‘৭১-এ পুলিশ ওর দোকান ভেঙে দেয়। তুলে নিয়ে যায় ওকে, মারধর করে। মালপত্র সব সিজ করে। ফিরে এসে আর নতুন করে দোকান করবার সামর্থ্য মিলনের ছিল না। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতো। দাদাদের সংসারে দুমুঠো ভাত জুটে যেত ঠিকই, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সেটাও দিনে দুবার। বাকি সময়টা প্রচণ্ড খিদে পেলেও চেপে রাখতে হতো ওকে। অনেক সময় দেখেছি বাসি মোমো খেয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিচ্ছে। যাতে অম্বলের জ্বালায় সারাদিন খিদে না পায়। চায়ের দোকানটা টিকে থাকলে মিলনও টিকে যেত। ওর নিউমোনিয়ার চিকিৎসা হলো না ঠিক করে। মিলনকে খুন করা হয়েছে। খুন করেছে পুলিশ।
***
মিলনকে নিয়ে কবিতা লেখার ন্যাকামি আমি অন্তত করব না। আমি প্রতিশোধ চাই। মিলনের খুনের প্রতিশোধ। কবিতা লিখে কারোর কিচ্ছু ছেঁড়া যায় না।
আমিই বা কেন নাকে কাঁদছি? মিলনের এলিজি লিখে কার কী লাভ! কত মিলন মরে গেল হাজারে হাজারে!