১১
হলুদ আমের মত রাত নেই, চাঁদ নিয়ে এই পৃথিবীতে
কাচের চাঁদের গায়ে লেগে আছে পৃথিবীর কাদা
মৃত্তিকাবর্ণের মাটি হয়ে গেছে দ্বিচারী আলাদা,
হলুদ আমের মত রাত নেই, খড়ের বসুধা
মৃত্যুধান খুঁটে খায় আদিম কুক্কুট হিমসুধা।
—দেবাঞ্জলী মুখোপাধ্যায়
.
অমিতাভর উপন্যাস
তালতলা থানায় প্রণবেশ আর শুদ্ধসত্ত্ব ঢুকে দেখল, সাজো সাজো রব। সাব ইন্সপেক্টর বিনোদ মুহুরি ফোর্স সাজাচ্ছেন, কোথায় নাকি অভিযানে যাবেন। বিমল সমাদ্দার বকাবকি করছেন কোনো কনস্টেবলকে। বকতে বকতেই তাঁর চোখ পড়ল দুজনের উপর। একগাল হেসে বললেন, ‘আরে আসুন আসুন। এই খোঁয়াড়ে পায়ের ধুলো পড়ল আপনাদের, কী সৌভাগ্য আমার।’
‘ব্যস্ত বুঝি?’
‘আরে পলিটিক্যাল প্রিজনারেরা নাকি বিহার থেকে পালিয়ে এসে জানবাজারের কাছে আস্তানা গেড়েছে। কী ঝামেলা ভাবুন তো! হোম সেক্রেটারি ফোন করে গালাগালি দিচ্ছেন। কমিশনার হুমকি দিচ্ছেন। ঘেন্না ধরে গেল মশায় এই চাকরিতে। গিন্নি তো বারবার বলে ছেড়ে দাও। সদাগরি আপিসের কেরানি হলেও এর থেকে বেশি সম্মানের জীবন ছিল। তা যাক। বলুন, চা চলবে তো?’
চায়ের অর্ডার দিয়ে বিমলবাবু তাঁর ঘরে দুজনকে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি বসলেন। বলুন। এরকম অসময়ে, কী মনে করে?
‘ব্যালিস্টিক রিপোর্ট আজ আসার কথা ছিল। তদবির করতে এলাম। এ ছাড়া আরও টুকটাক প্ৰশ্ন আছে।’
‘ব্যালিস্টিক এসে গেছে। খুন করা হয়েছে রাইফেল দিয়ে।’
‘রাইফেল?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল শুদ্ধসত্ত্ব।
‘হ্যাঁ। অবাক হচ্ছেন কেন?’
‘সব ঘেঁটে গেল মশায়। ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন অন্যজনকে রাইফেল দিয়ে গুলি করবে কেন? পিস্তল ব্যবহার করবে তো! সেটাই স্বাভাবিক না?’
‘আর রাইফেলের মতো বড়ো জিনিস নিয়ে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠল, কারোর নজরে পড়ল না?’ প্রশ্ন ছুঁড়ল প্রণবেশ।
‘বোধ করি সেই কারণেই লোডশেডিং-এর ব্যবহার। যাতে অন্ধকারে কারোর চোখে না পড়ে,’ উত্তর দিলেন বিমল সমাদ্দার।
‘আচ্ছা বুলেটের ফাঁকা খোলটা মেলেনি, না?’
‘নাহ, আমরাও খুঁজেছি। ও আর মিলবে না। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে বোধ করি।’
‘আপনারা কাকে সন্দেহ করছেন?’
‘আশপাশের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু মাধব রক্ষিত ছাড়া তো কারোর ওপরেই চার্জ আনা যাচ্ছে না।
‘তাহলে মুশকিল হবে আপনার। কারণ আপনাকে মাধববাবুর অ্যালিবাই ভাঙতে হবে। সেটা না পারলে চার্জশিট বানাতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা মাধব তো আপনার মক্কেল। তাহলে আপনি ওকে বাঁচাবার চেষ্টা না করে এভাবে কথা বলছেন কেন মশায়?’
‘যদি দেখি যে আমার মক্কেল অপরাধী, তাকে কী করে বাঁচাব? আমি তো গোয়েন্দা। উকিল নই।’
‘তার মানে আপনিও দেখতে পাচ্ছেন মাধবই অপরাধী?’
‘না। এখনও পাচ্ছি না। আমার মাথা এখনও ফাঁকা স্লেট। সকলকেই সন্দেহ করছি, আবার কাউকেই করছি না।’
‘যেমন? আর কাকে সন্দেহ করছেন?’
‘মাধব আর আনিসুর বাদে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি। সে সাড়ে এগারোটার সময়ে মেইন সুইচ অফ করে ওপরে উঠে আনিসুরকে খুন করেছে।’
‘কিন্তু তাহলে তো ঘরের মধ্যে তার পায়ের ছাপ পাবার কথা।’
‘হোটেলের ছেলেটি, যে সেদিন সন্ধেবেলায় আনিসুরকে জল দিতে গিয়েছিল, সে খুন করেনি সেটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?’
‘মোটিভ কী? আমরা ছেলেটির ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখেছি। মামুলি। কিছু পাওয়া যায়নি।’
‘হুঁ।’ শুদ্ধসত্ত্ব চিন্তিত মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। ‘আচ্ছা বিমলবাবু, আপনি কি মিলিটারিতে ছিলেন?’ আচমকা জিজ্ঞাসা করল।
হকচকিয়ে গেছেন বিমলবাবু। আমতা আমতা করছেন, ‘কেন এমন প্রশ্ন করছেন?’
‘আপনার শোকেসের মধ্যে একটা ফলক দেখতে পাচ্ছি। সেকেন্ড ব্যাটালিয়ন, তারপর কিছু একটা লেখা।’
‘ওহ, তাই বলুন!’ এবার হাসলেন বিমল সমাদ্দার। ‘হ্যাঁ, সে স্বাধীনতার আগের ঘটনা। বছর তিনেক ছিলাম। তারপর মন উঠে গেল। পোস্ত- পাস্তা খাওয়া বাঙালির ছেলের কি ওই হাড়ভাঙা খাটনি সহ্য হয়? ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরে পুলিশের পরীক্ষায় বসলাম। আর্মির ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার জন্য চাকরিটা পেতে অসুবিধা হয়নি।’
‘আচ্ছা।’ শুদ্ধসত্ত্ব উদাসীনভাবে চায়ের কাপ সরিয়ে নস্যির কৌটো বার করল। ‘মিলিটারিতে পোস্টিং ছিল কোথায়?’
বিমলবাবু হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলেন। চট করে উত্তর দিচ্ছেন না। ধীরে ধীরে তাঁর মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে কঠিন একটা অবয়ব ফুটে উঠছে। প্রণবেশ দেখল, দপদপ করছে তাঁর মাথার একপাশের শিরা। চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ইতিহাস জানাটাও কি আপনার তদন্তের মধ্যে পড়ে?’
‘নাহ। কৌতূহল জেগেছে বলতে পারেন। কলকাতা পুলিশের মধ্যে আপনার নামডাক আছে, আগেও শুনেছিলাম। দক্ষ অফিসার, সৎ এবং কাউকে পরোয়া করেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কলকাতার বাইরে পোস্টিং নিলেন না কখনও। সেই কারণেই আপনার প্রোমোশন, যেগুলোর আপনি সত্যিই যোগ্য, তার অনেক ক-টাই হয়নি। আজ আপনার মুখে শুনে বুঝতে পারলাম, আপনি ঘরকুনো। তাই মিলিটারির চাকরি ছেড়ে ঘরের টানে চলে এসেছিলেন। তার মানে, আপনার পোস্টিং ছিল শহরের বাইরে কোথাও। সেজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় ছিল। অনেক দূরে বুঝি?’ শুদ্ধ সশব্দে নস্যি নিল।
বিমলবাবু শিকারি বেড়ালের মতো শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল লাফিয়ে পড়বেন সুযোগ পেলেই। তারপর ধীরে ধীরে নিজের শরীর শিথিল করলেন। স্বাভাবিক হয়ে এল তাঁর মুখ। মুখে একবার হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কিছু মনে করবেন না শুদ্ধবাবু। এই মিলিটারি জীবনের সঙ্গে এক বিশ্রী ইতিহাস জড়িয়ে আছে, যেটা আমি ভুলে যেতে চাই। এক নিরপরাধ মানুষের উপর ভুল করে গুলি চালিয়ে দেবার ইতিহাস। সেই অনুশোচনাতেই চাকরি ছাড়ি। ডিপার্টমেন্টের অনেকে জানে এই ঘটনা। ভেবেছিলাম, আপনি বুঝি সেই দিকে ইঙ্গিত করছেন।’
শুদ্ধ উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল। প্রণবেশ প্রশ্ন করল এবার, ‘আচ্ছা মাধববাবু যদি খুন করেই থাকেন, তাহলে সেটা কখন করেছেন বলে আপনার মনে হয়?’
বিমলবাবুর শিকারি বেড়ালের ভঙ্গিটা এখনও মুছে যাচ্ছে না। তার মধ্যেই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছেন। উত্তর দেবার আগে ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমার নিজের ধারণা, পার্টি শেষ হবার পর। বাড়ি ফেরার পথে।’
‘কেন?’
‘পার্টির মধ্যে বেরিয়ে খুন করে আসা কষ্টকল্পিত। অন্তত গ্রেট ইস্টার্নের দারোয়ানদের নজরে পড়তই যে মাধব গাড়িতে উঠছে। অথবা গাড়ি পার্ক করবার জায়গায় যারা থাকে। আমরা তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কারোর কিছু নজরে পড়েনি। দ্বিতীয়ত, যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে মাধব আনিসুরের হোটেলে গেল, সেখানেও কি কেউ তাকে দেখতে পেল না? তার গাড়িটাও না? তখন তো লোডশেডিং হয়নি যে মাধব সেই অন্ধকারের সুযোগ নেবে। সে যখন হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠল, তখন তো হোটেলের মালিকও সিঁড়ির নীচে নিজের টেবিলে বসে ছিল। তো, তার চোখে কেন পড়ল না? না, এই ব্যাখ্যা দাঁড়াচ্ছে না। আবার, মাধব বাসায় ফেরবার পর আর বেরোয়নি। দারোয়ান বলেছে। মাধবের চাকর নকুল বলেছে। মাধবের স্ত্রী-ও বলেছেন যে ভোর চারটের সময়ে তাঁর ঘুম ভেঙেছিল। তিনি দেখেছেন মাধব তাঁর পাশে ঘুমোচ্ছে। হ্যাঁ বারোটা থেকে চারটের মধ্যে বেরিয়ে বরানগর থেকে ধর্মতলা গিয়ে খুন করে আবার ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু…’
‘না, মাধবের পক্ষে সম্ভব নয়। এই ব্যাপারে আমরা আগেই আলোচনা করে নিয়েছি।’ এতক্ষণে শুদ্ধসত্ত্ব মুখ খুলল।
বিমল দারোগা কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন। কিন্তু শুদ্ধর মুখে আবার কুলুপ। বিমলবাবু একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘দারোয়ান, নকুল, নিজের স্ত্রী, এতগুলো মানুষের মুখ বন্ধ রাখা বড়ো সহজ কাজ নয়। তাহলে একটাই সময় পড়ে থাকে। বাড়ি আসার আগে খুন করে বাড়ি ফিরেছে।’
‘কিন্তু’ প্রণবেশ হাত তুলল, ‘পনেরো মিনিটে ধর্মতলা থেকে বরানগর আসতে গেলে এমনিতেই দ্রুত গাড়ি ছুটিয়ে আসতে হবে। তার মধ্যে যদি খুন করবার জন্য থামতে হয়, তাহলে এগারোটা চল্লিশে বরানগরে ফেরা যে প্রায় অসম্ভব মশায়।’
‘যদি এগারোটা চল্লিশে না ফেরে?’ বিমলবাবু মিচকি হাসলেন।
‘মানে? দারোয়ান বলেছে যে…’
‘দারোয়ান কী করে জানল? নিজের ঘরের ঘড়ি দেখেছে, তাই তো? সেই ঘড়ি মাধব আগে থেকেই স্লো করে রাখেনি সেই বিষয়ে আপনি নিশ্চিত? আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দিলেই তো কাজ চলে যায়। দারোয়ান যখন দেখেছে এগারোটা চল্লিশ, তখন যদি বারোটা দশ হয়?’
প্রণবেশ হাঁ করে চেয়ে থাকল। এই দিকটা সত্যিই তার মাথায় আসেনি।
বিমলবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন, ‘এই মাধব মহা ধুরন্ধর লোক মশায়। হুঁ হুঁ, যা বলছে, সব কথায় চোখ বুজে বিশ্বাস করলে নিজেই পরে হাত কামড়াবেন।’
‘কিন্তু তাতেও তো চেয়ার সরানো আর জানালার পর্দা কেন গুটিয়ে রাখা, এই দুটো সমস্যার সমাধান হয় না।’ শুদ্ধ বলল।
‘অবশ্যই হয়। ভেবে দেখুন। মাধব হোটেলের মেইন সুইচ অফ্ করল। তারপর চারতলায় উঠে টোকা দিল আনিসুরের ঘরে। আনিসুর দরজা
খুলল। অন্ধকারে ভালো দেখতে পাচ্ছে না। মাধব বলল, ‘তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’ চেনা গলা পেয়ে আনিসুর দরজা ছেড়ে দিল। মাধব ভেতরে ঢুকে বলল, ‘দরজা লাগিয়ে দাও। কথাটা গোপনীয়।’ আনিসুর সেই মতো কাজ করল। এবার মাধব বসবে। বসবে, যাতে আনিসুরের সন্দেহ না হয়, যাতে সত্যিই মনে হয় যে মাধব তার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছে। কোথায় বসবে? অন্ধকার
ঘরে সে ভালো দেখতে পাচ্ছে না। কোনো রকমে হাতড়ে হাতড়ে চেয়ার টানল। কিন্তু টেবিল এবং চেয়ার যেদিকে, সেটা ঘরের এক কোণায়। সেখান থেকে অন্ধকারে রাইফেল গুলি ভরা কঠিন। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন রাইফেলে কেন আগে থেকেই গুলি ভরে আনেনি। কার কারণ, অকস্মাৎ যদি আনিসুরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হতো, রাইফেল থেকে গুলি ছুটে যাবার সম্ভাবনা থাকত। তাতে আনিসুর ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে দিত। সেই ঝুঁকি মাধব নেয়নি। সে পকেটে করে বুলেট এনেছিল। তাহলে এবার তার আলো চাই, যাতে রাইফেলে তাড়াতাড়ি গুলি ভরতে পারে। তাড়াতাড়ি কেন? কারণ আনিসুরকে সময় দেওয়া যাবে না। তাই সে চেয়ার টেনে জানালার কাছে আনলো। মনে রাখতে হবে, ওই সময়ে অন্যান্য বাড়ি এবং রাস্তায় বাতি জ্বলছিল। অন্ধকার ছিল শুধুমাত্র আনিসুরের হোটেলে। জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল, সেটুকুই মাধবের কাছে যথেষ্ট ছিল। আনিসুর তখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করছে, ‘এত রাতে তুমি কেন এলে?’ মাধব চেয়ার টেনে জানালার কাছে এনে দেখল, জানালার পর্দা ফেলা। বেশি আলো আসছে না। এটা সন্ধেবেলা হলে এই সমস্যা হতো না, কারণ রাস্তায় ঝলমলে বাতি থাকত। কিন্তু তখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, তাই রাস্তার আলোও এমনিতেও কম। মাধবকে বাধ্য হয়ে পর্দা সরাতে হলো। যেটুকু আলো এল, তার মধ্যেই দ্রুত রাইফেলে গুলি পুরলো আনিসুর ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। মনে রাখবেন, অসুখের জন্য আনিসুর কড়া ডোজের ওষুধ খেত প্রতি রাতে। যে ট্যাবলেটের লিস্ট আমরা পেয়েছি, সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে খেলে এমনিতেই স্নায়ু শিথিল হয়ে যায়। দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নেয় মানুষ। তাই সে সামনে মাধবকে রাইফেলে গুলি ভরতে দেখেও হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাধব গুলি করল। সাইলেন্সার বোধ করি আগেই লাগানো ছিল। আনিসুর পড়ে গেল। মাধব দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে, কোনো একটা উপায়ে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। সেদিন আপনাদের যে পদ্ধতিগুলো বলেছি, সম্ভবত সেগুলোর মধ্যেই কোনো একটা উপায় অবলম্বন করেছিল সে। তারপর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নীচে নেমে গেল। ব্যাস। কাজ শেষ!’
‘কিন্তু রাইফেল কেন? ঘরের মধ্যে পিস্তল নয় কেন?’ আবার প্রশ্ন করল শুদ্ধসত্ত্ব।
‘মাধবের কাছে হয়তো পিস্তল ছিল না। জোগাড় করবার সময়ও ছিল না। হাতের কাছে যেটা পেয়েছে সেটা দিয়ে মেরেছে।’
‘তাহলে কোথায় গেল সেই মার্ডার ওয়েপন?’
‘সেটা আমরা খুঁজছি। আমার ধারণা, মাধবের বাড়িতেই পাওয়া যাবে।’
‘আর দুটো চিঠির রহস্য?’
‘আরে মশায় আপনি এখনও ওই ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? হতে পারে যে আনিসুর তার ক্যান্সারের যন্ত্রণার ধাক্কায় গণ্ডগোল করে ফেলেছিল। ভুল করে সাদা কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছে। অথবা হতেই পারে যে ওই সাদা কাগজে পেঁয়াজের রস দিয়ে হরিদাসের গুপ্তকথা লেখা আছে। যান গিয়ে আগুনের সামনে ধরুন। পেলেও পেতে পারেন অমুল্য রতন। আপনাদের ব্যোমকেশ বক্সী যেমন পেয়েছিল।’ নিজের রসিকতাতে নিজেই হ্যা হ্যা করে হাসছেন বিমল দারোগা।
শুদ্ধসত্ত্ব হাসল না। গম্ভীরভাবে বলল, ‘ওই দুটো চিঠির মধ্যেই আসল রহস্য লুকিয়ে আছে বিমলবাবু। ব্যাপারটা আপনি যতটা সহজ ভাবছেন, তত সহজ নাও হতে পারে।’
‘কেন? আমার ব্যাখা কি আপনার পছন্দ হলো না?’
‘পছন্দের প্রশ্ন নয়। একটা ঘটনা ঘটলে তার বহু রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। আমি সেই প্রশ্নেও যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাইছি, আপনার ব্যাখ্যাতে অনেক ফাঁক।
শিকারী বেড়ালের প্রত্যাবর্তন ঘটল। ‘শুদ্ধবাবু, প্রথমেই কিন্তু বলে রেখেছিলাম আমাদের তদন্তে আপনি বাধা দেবেন না।’
‘দিচ্ছি না। আপনি আপনার মতো করে তদন্ত চালিয়ে যান। শুধু বলছি, যদি বন্দুকটা খুঁজে না পান, অথবা যদি প্রমাণ করতে না পারেন যে দারোয়ানের ঘড়ি সত্যি সত্যিই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এই কেস আদালতে টিকবে না।’ শুদ্ধসত্ত্ব উঠে পড়ল। ‘আজ আসি। যদি কিছু পাই, আপনি জানবেন এটা কথা দিচ্ছি।’
এবার আর বিমল দারোগা তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানালেন না।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার তো বিমলবাবুর ব্যাখ্যা বেশ যুক্তিপূর্ণ মনে হলো। তুমি কেন বললে কাহিনীতে অনেক ফাঁক?’
শুদ্ধ একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সামান্য সময় পরে মুখ খুলল, রাইফেল ব্যবহারের ব্যাখ্যায় অনেক গলদ আছে।’
‘শুধু এটুকুই?’
‘না। আরও আছে। চেয়ার সরাবার যে ব্যাখ্যা বিমলবাবু দিলেন, সেটাও ভুল। মাধব তখনই চেয়ার সরাবেন, যদি তিনি বসতে চান। মানে, কিছুটা সময় কাটাতে চান। কিন্তু মাধবের হাতে ছিল রাইফেল। চেয়ার সরিয়ে নিয়ে এসে কিছুক্ষণ বসবার মতো সময় তাঁর হাতে ছিল না। কারণ সেই সময়টুকুর মধ্যে জানালার বাইরে থেকে আসা আলোতে রাইফেল দেখে আনিসুর প্রতিক্রিয়া জানাবেন। হয় চিৎকার করবেন আর নাহলে ছুটে পালাবেন। পিস্তল হলে এই সমস্যা ছিল না, সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখা যেত। রাইফেল লুকানো সম্ভব নয়। কাজেই, বসবার সময় মাধববাবুর ছিল না। দ্বিতীয়ত, ঘরের মধ্যে ঢুকবার প্রয়োজন মাধববাবুর হলো কেন? আর ঘরেই যদি ঢুকলেন, হেঁটে হেঁটে গোটা ঘর পেরিয়ে দরজা থেকে জানালার কাছে এলেন কেন? মাধব তো আনিসুরকে দরজার বাইরে থেকেই গুলি করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যেতে পারতেন। অন্ধকারে কেউ তাঁকে দেখতেও পেত না। তৃতীয়ত, সুতো টেনে ঘরের বাইরে থেকে ছিটকিনি ওপরে তোলার যে থিওরি বিমলবাবু দিয়েছিলেন, সেটা
আলোতে যত সহজ, অন্ধকারে তত নয়। পায়ের অবস্থার জন্য জানালার বাইরে দিয়েও মাধব বেরোতে পারবেন না। তবে সবথেকে দুর্বল হলো দারোয়ানের ঘড়ি পিছিয়ে দেওয়ার যুক্তি। এই ব্যাখ্যা আদালতে দিলে জজ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে।’
‘কেন? সমস্যাটা কোথায়?’
‘সেটা তুমি নিজেই দেখতে পাবে। আপাতত আমাদের গন্তব্য বরানগর। মাধববাবুর বাড়ি আর একবার যেতে হবে।’ মুচকি হেসে উত্তর দিল শুদ্ধসত্ত্ব।
***
‘আপনি এই বাড়িতে কতদিন আছেন, শিউচরণজি?’
‘বিশ সালের বেশি হয়ে গেল হুজুর।’
‘আচ্ছা, মালিক কি সবসময়েই রাত করে বাড়ি ফেরেন? আর আপনিই গেট খুলে দেন?’
না হুজুর। মালিক ঘড়ি ধরে চলেন। বেশিরভাগ দিনেই রাত ন-টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসেন। দশটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে নেন। এ বাড়ির আলো নিভে যায় তারপর। তবে মালিকের ছেলেরা অনেক দিনই ফিরতে রাত করে। এই নিয়ে মালিক বকাবকিও করেছেন অনেক!
‘আপনি কখন ঘুমোতে যান?’
‘রাত এগারোটা হয়ে যায়। তবে তারপরেও কি টানা ঘুমোতে পারি? মালিকের ছেলেদের জন্য উঠতে হয়।’
‘সেই রাতে মালিকের ছেলেরা কখন ফিরেছিল?’
‘একজন ফিরেছিল সকাল সকাল। সাড়ে সাতটার মধ্যে। ছোটো ছেলের
ফিরতে দশটা বেজে গিয়েছিল।’
‘তার মানে মালিকই শেষ জন, যিনি বাড়ি ঢুকেছিলেন?’
‘হ্যাঁ হুজুর।’
‘আচ্ছা শিউচরণজি, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত্রে ঘুমানো অবধি আপনি কী কী কাজ করেন?’
‘আমি? বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গাছে জল দিই। তারপর বাড়ি আর বাগানের টুকটাক অনেক কাজ থাকে। সন্ধেবেলা গিন্নিমার ঠাকুরঘরে মাঝে মাঝে গানবাজনা হয়। আশেপাশে গিন্নিমার আরও বন্ধুবান্ধব যারা থাকে, তারা আসে। সেই সময়ে আমিও পুজোর ঘরে গিয়ে বসি। বড়ো সুন্দর ভজন হয়, ভক্তি চলে আসে। মাঝে মাঝে ভোগ চড়ান গিন্নিমা। তার কাজকর্ম থাকে। আর এসব যদি কিছুই না থাকে, নিজের ঘরে চলে আসি। সন্ধে সাড়ে আটটা থেকে রেডিওতে ভোজপুরি গান দেয়। সেটা শুনি। সাড়ে নটা নাগাদ ডাল-রুটি পাকাতে বসি। খেয়ে দেয়ে রাত্রিবেলা সারা বাগান চক্কর মারি একবার। মালিক বার বার বলে দিয়েছেন, রাত করে একবার টহল দিতে, যাতে চোরছ্যাঁচড় জানতে পারে যে এই বাড়িতে পাহারা আছে। সেসবের পর ঘরে এসে আবার রেডিয়ো চালিয়ে শুয়ে পড়ি। গান বা খবর, শুনতে শুনতে চোখে ঘুম চলে আসে।’
‘সেদিনও কি সেটাই করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। সেদিন গিন্নিমার বাতের ব্যথাটা বেড়েছিল বলে ঘরে শুয়েছিলেন। আমি সন্ধেবেলা মালিক বেরিয়ে যাবার পর একবার বেরোই গিন্নিমার জন্য পান জর্দা কিনে আনতে। ফিরে আসবার পর থেকে সারাদিন ঘরের ভেতরেই ছিলাম। গান শুনেছি, রুটি পাকিয়েছি, টহল মেরেছি। মাঝে নকুল একবার বেরিয়েছিল সন্ধে আটটায়। ন’টার সময়ে ফিরে আসে। সাড়ে দশটা নাগাদ আমিও শুয়ে পড়ি।’
‘আপনি কি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ঘুমোন?’
‘হ্যাঁ হুজুর! মালিক বলে দিয়েছেন। বাইরে অনেক চোর ডাকাত। যেন সাবধানে থাকি।’
‘আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ শিউচরণজি।’
নকুল দূরে টুলের উপর দাঁড়িয়ে গাড়িবারান্দার ঝুল সাফ করছিল। মাথা ঘুরিয়ে হেসে বলল, ‘কথা হয়ে গেল বাবু? শরবত খেয়ে যান।’
‘না নকুল। আজ সময় নেই।’
‘সময় নেই বললে হবে? বাবু বলে দিয়েছেন, আপনাদের চা-জলের যেন অবহেলা না হয়। যদি দেখেন আতিথেয়তায় ঢিলে দিয়েছি, ধড়ের ওপর মাথাটা আস্ত রাখবেন না।’
‘আমি বলে দেব তোমার বাবুকে, তুমি যথেষ্ট করেছ। আজ আসি।’ শুদ্ধ পেছন ফিরেছিল। আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘গাড়িবান্দারায় তাহলে বাতি লাগানো হয়েছে?’
‘হ্যাঁ বাবু। আপনারা যেদিন গেলেন, তার পরেই গিয়ে আলো কিনে আনলাম।’
গাড়িতে উঠে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, ‘এবার বুঝলে, দারোয়ানের ঘড়ি কেন পিছোনো সম্ভব নয়?’
‘না, বুঝলাম না কেন?’ প্রণবেশ দেখল, শুদ্ধ নিজের মনে হাসছে।
‘আরে বাবা সেদিন মাধব রক্ষিত বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সন্ধে ছটা বাজবার কিছু পরে। তাহলে ঘড়িতে কারিকুরি করতে হলে তার আগেই করতে হবে। এদিকে শিউচরণ রোজ সাড়ে আটটার সময়ে রেডিয়োতে গান শোনে। যদি ঘড়ি পিছিয়ে থাকে, রেডিয়ো চালিয়েই তো বুঝতে পারবে।’
‘যদি ঘড়ি তার পরে পিছোয়?’
‘কখন? পিছোলে একমাত্র নকুল পিছোতে পারবে। কারণ সেদিন বাড়িতে ওই সময়ে একমাত্র সে-ই ছিল। কিন্তু নকুল আটটা থেকে ন-টা বাড়িতে ছিল না। আর ন-টার পর থেকে একটা বড়ো সময় শিউচরণ নিজের ঘরে বসে রান্না করেছে, রেডিয়ো শুনেছে। যখন টহল মারছিল বাগানে, তখন কেউ এসে ঘড়ি পিছিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ফিরে এসে শিউচরণ আবার রেডিয়ো শুনেছে। রেডিয়োতে ঘন ঘন সময় ঘোষণা হয়ে থাকে। শিউচরণ দেখেছে যে সে সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়েছে। যদি তার আগে রেডিয়ো চালিয়ে থাকে, তাহলে রেডিয়োতে ঘোষণা করা সময় আর নিজের ঘড়ির সময়ের তারতম্য তার চোখে পড়ল না কেন? আর শিউচরণ ঘুমিয়ে পড়বার পরে সময় বদলানো সম্ভব নয়। কারণ সে ঘরের দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ করে ঘুমোয়।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আর কী! মাধব খুন করেননি সে কথা বলছি না। কিন্তু বিমল দারোগার সিদ্ধান্ত ভুল।’
তুমি কি শিউচরণের ব্যাপার আগে থেকে জানতে? আমাকে তখন কেন বললে যে নিজেই কথা বলে বুঝতে পারব?’
‘অনুমান করেছিলাম। দেখো, শহরে যে মানুষ থাকে, বিশেষত যে মানুষ কাজের মধ্যে থাকে, তাকে এটা ওটা দরকারে ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে হয়। আর একবার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেলে অপ্রয়োজনেও সে ঘড়ি দেখে। কাজেই ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে-পিছিয়ে সামান্য সময়ের জন্য সম্ভব হলেও, কয়েক ঘণ্টার জন্য এই ফাঁকিবাজি বড়ো সহজ ব্যাপার নয় হে, যদি না পুরো সময়টুকু সে ঘুমিয়ে থাকে!
‘তাহলে, এবার কোথায়? বাড়ি?’
‘আমার একটা খটকা হচ্ছে প্রণবেশ। আর একবার থানায় চলো তো! যাবার আগে কোথাও খেয়ে নিতে হবে। খিদে পাচ্ছে।’
রাত প্রায় সাড়ে নটা হয়ে এসেছে। থানায় বিমলবাবু ছিলেন না। একজন কনস্টেবল বসে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। শুদ্ধকে দেখে তটস্থ হয়ে উঠে সেলাম ঠুকলেন। কলকাতার বিভিন্ন বিখ্যাত কেসের সূত্রে শুদ্ধ এঁদের অনেকেরই মুখ চেনা হয়ে গিয়েছে।
‘আপনার নাম ভবানীবাবু না?
‘হ্যাঁ, স্যার।’ভবানীবাবু কৃতার্থ ভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছেন। ‘কিন্তু বড়োবাবু তো নেই। বাড়ি চলে গেছেন। ফোন করব?’
না। আপনাকে হলেও হবে। কোথাও বসা যায়?’ একটা ফাঁকা ঘরে দুজনকে বসালেন ভবানীবাবু। জানালা দিয়ে বাইরের ঘন অন্ধকার চোখে পড়ছে। মাথার ওপর ক্যাঁচক্যাঁচ করে ঘুরছে পুরোনো পাখা। হলুদ মরা বাল্বের আলো অস্পষ্ট। থানা এখন নির্জন। বাইরে কয়েকজন পুলিশ বসে গজল্লা করছে। সেকেন্ড অফিসারের ঘর থেকে গান ভেসে আসছে হালকা। ঝিমোচ্ছে চারপাশ।
‘খাবার বলি স্যার?’
‘না না, কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি। পেট ভর্তি। আচ্ছা ভবানীবাবু, আনিসুর সাহেবের লাশ যখন বেরোয়, আপনিও কি সেখানে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, স্যার। বড়োবাবু আমাকে আর শান্তি মল্লিককে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘সেটা তো খুনের দুইদিন পর, তাই না? খুনের দিন আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘মানে পয়লা জুন? সেদিন থানাতেই ছিলাম স্যার। নাইট ডিউটি ছিল। সপ্তাহে তিনদিন করে নাইট করতে হয়।’
‘সেদিন কি অদ্ভুত কিছু ঘটেছিল? খেয়াল করতে পারবেন?
‘অদ্ভুত মানে?’ বিভ্রান্ত চোখে তাকাচ্ছেন ভবানীবাবু।
‘মানে এমন কিছু, যেটা হয়তো স্বাভাবিক রুটিনের মধ্যে পড়ে না।
‘নাহ, তেমন তো…’ বিড়বিড় করে থেমে গেলেন ভবানীবাবু। তারপর বললেন, ‘না স্যার, কিছুই মনে আসছ না।’
‘বড়োবাবু কোথায় ছিলেন?’
‘বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তবে গভীর রাত্রে একবার থানায় এসেছিলেন।’
‘কেন?’
‘বড়োবাবু মাঝে-মাঝেই রাত্রে আসেন। কাজপাগল মানুষ হলে যা হয় আর কী! সেদিনও সন্ধে আটটায় বাড়ি চলে গেছিলেন। আবার রাত দেড়টার সময়ে এলেন। ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাটি করলেন। ব্যাগে কিছু ফাইল পুরে বললেন, আজকের রাতটাও গেল ভবানী! কমিশনার সাহেব বলে দিয়েছেন কাল ভোরের মধ্যে সব ফাইল ক্লিয়ার করতে হবে।’
‘আচ্ছা!’ শুদ্ধসত্ত্ব চিন্তা করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘বড়োবাবুর বাড়ি কোথায়?’
‘পার্ক সার্কাসের কাছে স্যার।’
‘যাতায়াত করেন কী করে?’
‘গাড়ি পান তো!’
‘আচ্ছা আপনি তো মাধববাবুর বাড়িতেও তদন্তের জন্য গেছেন। সেখানে কিছু অদ্ভুত লক্ষ করেছিলেন?’
‘না স্যার। তবে আমার নিজের মাধববাবুকে দেখেই মনে হয়েছিল, এই লোকটা খুনি। কেন মনে হয়েছিল, বলতে পারব না। কিন্তু চোখের দৃষ্টি কেমন যেন! খুনির মতো ঠাণ্ডা। কম দিন তো এই লাইনে হলো না স্যার! আমরা লোক চিনি।
‘আর কিছু?’
‘নাহ! শুধু বাগানটা দেখার সময়ে এক জায়গাতে দেখলাম, পাঁচিলের কাছে ঝোপটা দলা-মোচড়ানো। অন্য সব জায়গায় ঝোপ সমান ভাবে মসৃণ কাটা। শুধু ওই জায়গার ঝোপ বিধ্বস্ত। যেন পাঁচিল থেকে কেউ ঝোপের ওপর লাফিয়ে পড়েছে।’
‘চোরছ্যাঁচড়? বা পাড়ার বখাটে ছেলে?’
‘হতেও পারে। এত ছুটকো ব্যাপার ছিল যে আমিও ভুলে গেছিলাম। আজ আপনি বলাতে মনে পড়ল।’
‘থানার পয়লা জুন রাত্রে আপনি ছাড়া আর কে ছিল?’
‘সেকেন্ড অফিসার মল্লিক। এএসআই সুরেন সামন্ত। আমি ছাড়া আর দুজন কনস্টেবল।’
‘বিমলবাবু মানে আপনার বড়োবাবু, থানাতে এলেন দেড়টায়। বেরোলেন কখন?’
‘দুটোর আগেই। আমাকে বললেন একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে। সঙ্গে একটা বড়ো ব্যাগ ছিল। ফাইলপত্র ঢেকানো ছিল তাতে। ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন।’
‘বড়োবাবু তখন কেমন ছিলেন? উত্তেজিত? শান্ত?’
‘নাহ। তেমন কিছু না। অন্যান্য দিনের মতোই। চোখ লাল ছিল। তবে সেটা প্রেশার বাড়লে হয় ওঁর। আগেও দেখেছি।’
‘থানার পোশাকেই ছিলেন?’
‘না, না। অত রাতে আর ফর্মাল ড্রেস কী! প্যান্ট শার্ট চটি।’
‘কিছু বলেছিলেন? হয়তো সামান্য কিছু। তাহলেও চলবে।’
‘খেয়াল পড়ছে না স্যার। তবে দুইবার বাথরুমে গেলেন। বারবার হাত পা ধুচ্ছিলেন, কারণ বড়োবাবুর বেরোবার সময়েও হাত পায়ে জল দেখেছি।’
‘ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা যেদিন বডি বার করা হয়, মানে তেসরা জুন, সেদিন আপনি হোটেলের ঘরে কী দেখলেন? দরজা ভাঙা হয়ে গিয়েছিল তো তখনই!’
‘হ্যাঁ, স্যার। ওই হোটেলে আগেও গেছি। একবার নেপালের এক খদ্দেরের সাথে মালিকের ঝামেলা থেকে মারামারি হয়। সেটা সামলাবার জন্য থানা থেকে যেতে হয়েছিল। যাই হোক, গিয়ে দেখলাম অনেক লোক থিকথিক করছে। ভাঙা দরজার ওপারে বড়ি পড়ে আছে। আর সে কী গন্ধ স্যার! বমি উলটে আসে।’
‘বড়োবাবু কী করলেন?
‘রুটিন কাজ, যা করার। ডাক্তারকে খবর দেওয়া। মর্গে লোক পাঠানো। পুলিশের ফোটোগ্রাফারকে আনানো। পুরো জায়গাটা সিল করে দেওয়া। এসবই।’
‘জানালা খোলেননি কেন? এত গন্ধ যখন?’
‘বলতে পারব না স্যার। আমারও মনে হচ্ছিল জানালা খুলি। কিন্তু বড়োবাবু বারণ করলেন, যেন ক্রাইম সিন নষ্ট না করে দিই। আর দরকারের বেশি পায়ের ছাপ যেন না পড়ে।’
‘আচ্ছা ভবানীবাবু, আপনার প্রথম কী মনে হয়েছিল লাশ দেখার পর? একদম প্রথমে মনে যেটা এসেছিল সেটাই শুনতে চাইছি।’
‘বোকা বোকা ভাবনা স্যার। শুনলে হাসবেন।’ লাজুক হাসছেন ভবানীবাবু।
‘তবু বলুন না!’
‘আলিবাবার চিচিংফাঁক জানেন তো স্যার? মনে হয়েছিল, কেউ যেন বাইরে থেকে চিচিংফাঁক বলেছিল, দেয়াল দুই দিকে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে গুলি চালিয়েছিল। তারপর চিচিং বনধ বলেছে। দেয়াল আবার জুড়ে গেছে।’
শুদ্ধসত্ত্ব ভবানীবাবুর কাঁধে চাপড় মেরে সপ্রশংস স্বরে বলল, ‘শাবাস ভবানীবাবু। এই অদ্ভুত অন্যরকম ভাবনাগুলোই আপাতত কাজে লাগবে। উপকার হলো আপনার সঙ্গে কথা বলে। আজ উঠি।’
‘স্যার একটা কথা।’ ভবানীবাবু হাত কচলালেন আবার।
‘হ্যাঁ, বলুন না!’
‘মানে, বলছিলাম কী, বড়োবাবুকে বলবেন না স্যার, যে আপনাকে এসব বলেছি। তিনি হয়তো জানলে রাগ করবেন। আমাদের তো নিয়ম নেই এভাবে মুখ খোলার!’
‘আপনার ভাবনা নেই ভবানীবাবু। আমি কাউকে কিছু বলব না! আত্মগতভাবে বলল শুদ্ধসত্ত্ব, আপাতত সামনের কয়েকটা দিন হয়তো মুখই খুলব না। শুধু ভাববো।’