শেষ বংশধর – শ্যামল দত্তচৌধুরী

শেষ বংশধর – শ্যামল দত্তচৌধুরী

প্রথম রাতেই টের পেয়েছিল অনির্বাণ। টিমটিমে আলোয় সে তার সারাদিনের অভিজ্ঞতা মাকে লিখতে বসেছিল। অবনীকাকা নাতনির হোমটাস্কের খাতা থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে ওকে দিয়েছেন। এক-একটা পাতায় লিখছে আর পাশে সরিয়ে রাখছে অনির্বাণ। আজ সকালে এখানে পৌঁছোবার পর থেকে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।

বেশ গুমোট আবহাওয়া। জানলাগুলো খোলা থাকলেও বাইরের গাছপালাতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়া নেই। অথচ এই অবস্থায় হঠাৎ অনির্বাণের কাগজগুলো ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়াতে লাগল। ওর মাথার উপরে, এদিকে-ওদিকে কাগজ ভেসে বেড়াচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না পদার্থবিদ্যার ছাত্র অনির্বাণ।

গ্রামে অনির্বাণদের পিতৃপুরুষের ভিটে প্রায় ধবংস হতে বসেছে। সে মার কাছে শুনেছে যে, একসময় নাকি বিশ মাইলের মধ্যে ওদের মতো পাকাবাড়ি আর একটাও ছিল না।

নরোত্তম রায় ছিলেন এই অঞ্চলে সেকালের এক ডাকসাইটে প্রতাপশালী জমিদার। বারান্দার শেষপ্রান্তে নরোত্তম রায়ের এক অয়েল পেন্টিং আজ দেখেছে অরিন্দম। ধূলিমলিন, মাকড়সার জালে প্রায় অদৃশ্য। তবু বোঝা যায় তামাটে চওড়া মুখ, ঘাড়েগর্দানে দশাসই চেহারা কুস্তিগীরের মতো। ক্রোধী চোখদুটো ছবিতেও যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। পূর্বপুরুষের জমিজিরেত চাষবাস ছিল, কিন্তু নিন্দুকেরা বলত তাদের প্রকৃত উপার্জনের উপায় ছিল ডাকাতি।

সাধারণত তারা নিজেরা ডাকাতি করতে বেরোতেন না। একদল বিশ্বস্ত লেঠেলকে পাঠানো হত, যারা জান দেবে তবু মুখ ফুটে কর্তার বিরুদ্ধে রা কাড়বে না। লেঠেলরা ছিপ নৌকায় চড়ে কিংবা পায়ে রণ-পা বেঁধে দূরদূরান্তরের গ্রামে গিয়ে নৃশংস ডাকাতি করে আসত।

শোনা যায়, নরোত্তম রায় নাকি কখনও-সখনও স্বয়ং যেতেন ডাকাতি করতে এবং কোনো কোনো সময়ে তাঁর হিংস্র আচরণ লেঠেল ডাকাতদের বুকেও ভয় ধরিয়ে দিত। লোকে বলে কোনো এক বিধবা নারীর চার ছেলে-মেয়েকে হত্যা করার অভিশাপে নাকি নরোত্তম রায় নিজেও নির্বংশ হয়ে যাবেন।

নরোত্তম রায়ের ছিল সাত ছেলে, তারা সাবালক হয়ে ওঠার আগে একে একে মারা গিয়েছিল। তিনি কেবল ছোটো ছেলে সুরেশ্বরের বিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

মৃত্যুর আগে সুরেশ্বর দুটি সন্তানের জনক হয়েছিলেন। ছেলের নাম মনোহর, মেয়ের নাম ভাগীরথী। বালক বয়স থেকেই মনোহর শান্তশিষ্ট স্বভাবের। লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল তাঁর। প্রজাদের দুঃখদুর্দশার সময় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। কিন্তু ভাগীরথী একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। সে ছিল দুরন্ত, ডানপিটে, নিষ্ঠুর। ওই কিশোরী বয়সেই তার স্বভাবের হিংস্রতা প্রজাদের সন্ত্রস্ত করে তুলত। একবার একটা বিড়ালছানা রাত্রিবেলা কেঁদে কেঁদে বাড়ির কাউকে ঘুমোতে দেয়নি। কনকনে শীতের রাত। সকালের আলো ফুটতেই ভাগীরথী খিড়কির বাইরে ছাইয়ের গাদা থেকে বিড়ালছানাটাকে তুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল পুকুরের মাঝখানে। বাড়ির দাসী-চাকররা ওকে যমের মতো ডরাত।

ঠাকুরদা নরোত্তমের স্নেহ বাপ-মা মরা নাতনি ভাগীরথীর উপর গভীরভাবে নেমে এসেছিল। নিরীহ মনোহরকে তিনি খুব একটা আমল দিতেন না। হয়তো ভাগীরথীর স্বভাবে নরোত্তম নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বৃদ্ধ নরোত্তম মৃত্যুর কিছুকাল আগে আইনের মাধ্যমে প্রিয় নাতনি ভাগীরথীকে ত্যাগ করেছিলেন। বিশেষ আদেশ দিয়ে তাঁর জমিদারির ত্রিসীমানায় ভাগীরথীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, এর কারণ কেউ জানে না।

লোকমুখে শোনা যায়, শ্মশানের ভবানী মন্দিরে তখন ভাগীরথী তন্ত্রসাধনা করত। কে যেন দেখেছিল, ঘোর নিশিরাতে জটাধারিণী এক ভৈরবী একলা হেঁটে হেঁটে প্রান্তর পার হয়ে চলে যাচ্ছে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ নরোত্তম রায়ের মৃত্যু হয়েছিল।

মনোহর রায়ের পুত্র সুদর্শন এই এলাকায় প্রথম প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রায়বংশের পুরুষ স্বল্পায়ু। সুদর্শন রায়ও বেশিদিন বাঁচেননি। ইনি অনির্বাণের পিতা। দু-বছরের ছেলে অনির্বাণকে নিয়ে তার মা চলে আসেন মামাদের কাছে মথুরাপুরে। আদি গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। অনির্বাণ মেধাবী ছাত্র। আগাগোড়া পরীক্ষায় ভালো ফল দেখিয়ে সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স করেছিল। এখন রিসার্চ করছে।

ওদিকে সুদর্শন রায়ের মৃত্যুর পরে দেশের বাড়ি দেখাশোনার অভাবে অবহেলায় ভেঙে পড়ছিল। রায়বাড়ির নায়েব অবনীকাকা চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন অনির্বাণের মায়ের সঙ্গে। অবনীকাকার সনির্বন্ধ অনুরোধে এত বছর পরে মা অনির্বাণকে পাঠিয়েছেন ওই বসতবাড়ির আর জমিজমার একটা আইনসম্মত বিলিব্যবস্থা করার জন্য।

সকালে নদীর ঘাটে নামতেই কাদায় পা ডুবে গিয়েছিল অনির্বাণের। ধানখেতের আলে-আলে আধ ঘন্টাটাক হেঁটে শেষে পৌঁছেছে পিতৃপুরুষের গ্রামে। অবনীকাকাকে আগে থেকেই জানানো ছিল। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, একজন মুনিষ গিয়েছিল অনির্বাণকে পথ চিনিয়ে আনতে। ওদের বাড়ির দরজা খুলিয়ে, একটা ঘর বাসের উপযোগী করে রাখা ছিল। এল মুড়ি আর গুড়। দুপুরের খাওয়া হবে অবনীকাকার বাসায়।

অনির্বাণের মার প্রশংসায় বৃদ্ধ পঞ্চমুখ। বললেন, তিনি রায়পরিবারের সঙ্গে ষাট বছর জড়িয়ে আছেন কিন্তু কখনও এমন লক্ষ্মীমন্ত ও বুদ্ধিমতী বউ দেখেননি। শুনে অনির্বাণের খুব ভালো লাগল।

বেলার দিকে বৈষয়িক আলোচনা হল অবনীকাকার সঙ্গে। তারপর রোদ একটু পড়লে ঘুরে দেখা। সন্ধে হওয়ার আগেই কয়েকজন মাতব্বর মতন লোক এল শলাপরামর্শ দিতে। পরদিন পঞ্চায়েত অফিসে যাবে অনির্বাণ। অন্ধকার নামার আগে তারা চলে গেল তড়বড় করে।

একটা বিদ্যুতের পোল থেকে কারেন্ট টেনেছে ক্লাবঘরে। অনির্বাণ আসছে খবর পেয়ে অবনীকাকা ছেলেদের ধরেকরে রায়বাড়ির একটা ঘরে টিমটিমে বালবের আলোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অবনীকাকার লোক বারান্দায় একটা হারিকেনও জ্বালিয়ে গেছে। বাইরে যেতে দরকার হবে অনির্বাণের।

আজ সারাদিনে যত তথ্য জোগাড় করেছে অণির্বাণ, তার বিশদ বিবরণ লিখে সে মার কাছে পাঠাবে তাঁর মতামতের জন্য। অবনীকাকার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা আছে। তিনি কাল সকালেই একটা লোককে পাঠাবেন ওই চিঠি সমেত মথুরাপুরে।

কিন্তু লিখতে বসে এই বিপত্তি। কাগজগুলো হাওয়ায় ভেসে ভেসে উড়ছে, যদিও বিন্দুমাত্র হাওয়া চলাচল করছে না ঘরটায়।

একটু থমকে গেল অনির্বাণ। এমন অদ্ভুত ঘটনার মানে কী? ভূতুড়ে কাণ্ড! ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি?

হঠাৎ কে যেন সজোরে ধাক্কা মারল তাকে। তার হাত ধরে টানছে। চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরল অনির্বাণ, কিছুতেই সে চেয়ার ছেড়ে উঠবে না। কিন্তু কোনোও প্রবল অদৃশ্য শক্তি ওকে টেনেহিঁচড়ে তুলে দিল। তারপর পিঠে ধাক্কা মারতে মারতে বের করে দিল ঘর থেকে। হতভম্ব অনির্বাণ অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়। তার চোখের সামনে ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। অনির্বাণ ঠেলে দেখল ভিতর থেকে বন্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তার গা শিরশির করে উঠল।

বারান্দার কোণ থেকে হারিকেনটা তুলে নিভু নিভু শিখা বাড়িয়ে দিল অনির্বাণ। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসল এই ঘটনার বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা কী হতে পারে।

সে আজ গ্রামে ঘুরে বুঝতে পেরেছে অনেকেই তার আবির্ভাব ভালো চোখে দেখছে না। বিষয়সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা কোনো কালেই সরল-সোজা ছিল না। এখনও নেই। তবে কি কোনো কায়েমি স্বার্থ কাজ করছে? অনির্বাণকে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে? অবনীকাকা পাকাপোক্ত বিষয়ী মানুষ। তাঁর স্বার্থে কী আঘাত লাগল?

পরদিন দেখা হলে অবনীকাকাই কথাটা তুললেন—রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

অনির্বাণ তাঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, বলল,—আপনি কি ভাবলেন একলা পোড়োবাড়িতে আমি ভূতের ভয় পাব? ও বাড়িতে ভূতটুত আছে নাকি!

অবনীকাকা চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন,—তুমি বড়ো হয়ে প্রথম এখানে আসছ, ভেবেছিলাম আমার ভিটেতেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। কিন্তু তোমরা শহরে লেখাপড়া শেখা ছেলে, আমার বাসায় হয়েতো কষ্ট হত তোমার। তাই শেষে তোমাদের বসতবাটিতেই থাকার বন্দোবস্ত করলাম। রাতের দিকে ওদিকে কেউ সেঁধোয় না তো, তাই এখনও চোর-গুন্ডাদের আস্তানা হয়ে ওঠেনি।

—ব্যাপারটা আমাকেও খুব অবাক করেছে অবনীকাকা। ওরকম একটা বিশাল বাড়ি শূন্য পড়ে আছে অথচ কেউ জবর দখল করেনি। অ্যান্টিসোশ্যালদের আড্ডা হয়ে ওঠেনি-এর কারণ কী?

—তোমার বাবা সুদর্শন রায় খুব বিদ্বান মানুষ ছিলেন। এলাকার সকল মানুষ তাঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কিন্তু প্রয়োজনে শাসন করতে পারার ক্ষমতাও ছিল তাঁর। তোমার ঠাকুরদা মনোহর রায় আবার সেই তুলনায় একেবারে নরম-সরম মাটির মানুষ। তিনি জেলেপাড়ায় এক প্রজার ঘরে পড়ে থাকতেন। যেজন্য তাঁর অপযশ রটেছিল। তাঁর আমলেই প্রথম টের পাওয়া যায়, কোনো অশরীরী দুষ্ট আত্মা রায়বাড়িতে বাসা বেঁধেছে। মনোহরের পিতামহ নরোত্তম রায় তখনও বেঁচে। বুড়ো হয়ে ধুঁকছে রোগব্যাধিতে। দু-পা পঙ্গু, শরীরে ঘা। বিছানা ছেড়ে নড়তে পারে না। একদিন দেখা গেল পশ্চিমে বাঁশঝাড়ের ভিতরে তার লাশ পড়ে আছে। তাকে যেন কেউ টেনেহিঁচড়ে বাড়ির বার করে দিয়েছে।

একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে অবনীকাকা বলতে লাগলেন,—তোমাকে আজ বলি বাবা আমার ধারণা মনোহর রায় বাইরে বাইরে রাত কাটাতেন কিছু একটা ভয়ানক ভয়ে। তোমার বাবার আমলেও একই দৌরাত্ম্য চলেছিল। সেই জন্য সুদর্শন রায় বাড়ির পশ্চিম অংশটায় তালা মেরে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে চলে আসেন পুবের দিকটায়। অনেক ওঝাবদ্যি এসেছিল কেউ কিছু সুরাহা করতে পারেনি। তারপর তোমার বাবা মারা গেলেন অপঘাতে, তোমার মা শিশুকোলে চলে গেলেন মথুরাপুরে। রায়বাড়ি বন্ধ হয়েই পড়েছিল। মাঝে অবশ্য বদমাশদের আড্ডা হয়ে উঠেছিল। একরাতে তাদের চারটে লাশ পাওয়া যায় মজাপুকুরের কাদায়। মুখেচোখে নিদারুণ ভয়ের চিহ্ন ছিল তাদের।

অনির্বাণ সেই রাতেও থেকে গেল পিতৃপুরুষের বসতভিটেয়। অবনীকাকার গেঁয়ো গল্প বিশ্বাস হয়নি তার। বাড়িটা ঘিরে কিছু একটা রহস্য নিশ্চয় আছে, কিন্তু তা যে বুদ্ধির অগম্য, অনির্বাণের বিজ্ঞানী মন যে কথা মানতে পারছে না। তবু, পরিবেশের জন্যই হয়তো, একটা গা-ছমছমে ভাব মাঝেমাঝেই চেপে ধরছে।

ঘরে টিমটিমে বালব জ্বলছে। তবু হারিকেনের আলোটা উসকে দিয়ে টেবিলের উপর রাখল। মাকে লেখা অসমাপ্ত চিঠিটা শেষ করতে হবে। টেবিলে পাতাগুলো পরপর সাজানো, ছোটো একটা পাথর চাপা। অবনীকাকার মুখে শোনা গল্পটাও লিখবে মাকে। কাল সকালে চিঠিটা খামে ভরে পাঠাবে মথুরাপুরে।

শুতে-শুতে রাত হয়ে গেল। লন্ঠনের আলো একটু কমিয়ে শুয়ে পড়ল অনির্বাণ। হঠাৎ তার মাথার বালিশটা কেউ সড়াৎ করে টেনে নিল। অনির্বাণ অবাক হয়ে দেখল বালিশ তছনছ হয়ে তুষারপাতের মতন তুলো ঝরছে তার গায়ে-মাথায়।

তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল সে। যথাসাধ্য শান্তকণ্ঠে বলল,—তুমি কে? কেন ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ? এটা আমার বাড়ি, আমি রায়বাড়ির বংশধর। এখান থেকে আমাকে তাড়াবার অধিকার কারও নেই।

সাহস করে বলল বটে অনির্বাণ, কিন্তু অনুভব করল তার হৃৎপিণ্ড দ্রুততালে চলছে। সহসা ওর চোখের সামনে টেবিলের পাথরটা সরে গিয়ে একটা করে মাকে লেখা চিঠির পাতা ভাসতে ভাসতে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। ভয়ের সঙ্গে এবার বেদম রাগ হল তার।

অনির্বাণ চিৎকার করে বলে উঠল,—তবে রে ! আয় দেখি তোর কত ক্ষমতা, আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা? এই আমি প্রতিজ্ঞা করছি, বাড়িঘর সাফ করিয়ে আমি এবার নিজে এখানে বাস করব। দেখি তুই আমার কী করতে পারিস!

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। কেবল লন্ঠনের শিখা বেয়ে গেল নিজে থেকে। তারপর টেবিলের উপরে কলমটা চলতে শুরু করল। সাদা কাগজে খসখস শব্দে কিছু লিখছে। অনির্বাণ সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে পড়ল আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা আছে,—আমি ভাগীরথী।

চমকে উঠল অনির্বাণ। ভাগীরথী? তার ঠাকুরদা মনোহর রায়ের সেই ডানপিটে, নিষ্ঠুর বোন? সে নাকি ত্যাজ্য হওয়ার পরে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল!

আজই বিকেলে গ্রামের একজন বৃদ্ধ লোকের কাছে অনির্বাণ শুনেছে, ভাগীরথী গোপনে তন্ত্রসাধনা করত। রায়বাড়ির পশ্চিমদুয়ার পেরিয়ে মজাপুকুরের ধারে বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে নদীতীরের শ্মশানে ছিল তাঁর পঞ্চমুণ্ডির আসন। অমাবস্যার রাত্রে সিদ্ধিলাভের আশায় ভবানী মন্দিরে সে শিশু বলি দিত। গাঁয়ের লোকে সন্দেহ করত, কিন্তু নরোত্তম রায়ের ভয়ে ঘটনা থানা-আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারেনি।

ক্রমে নরোত্তম রায়ের কানে গেল কথাটা। তিনি তখন ঘোরতর রোগশয্যায়। খুব রেগে গিয়ে তিনি আদরের নাতনি ভাগীরথীকে উইল বানিয়ে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিলেন। মনোহরকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন গোপনে। তারপর ভাগীরথীকে কেউ আর চোখে দেখেনি। অবনীকাকা কী আর এসব ঘটনা জানেন না? ইচ্ছে করেই বোধহয় পরিবারের কলঙ্কের কথা অনির্বাণের কাছে চেপে গেছেন।

আবার কলমটা আঁকাবাঁকা অক্ষরে চলতে শুরু করেছে।

…এই বাড়ি আমার …দাদু ত্যাগ করেছে…কোথায় যাব… দাদা মনোহর আমাকে পশ্চিমের উঠোনে কুপিয়ে মেরে… পুঁতে রেখেছে গোয়ালঘরে… প্রতিশোধ চাই… রক্ত …রক্ত এ বাড়ি আমার… দাদুর—দাদার… সুদর্শনের রক্তপান করেছি… এবার তোর…

হঠাৎ অনির্বাণ দেখল লন্ঠনটা তীব্র বেগে তার দিকে ছুটে আসছে। যেন কেউ ছুড়ে মেরেছে জোরে। সে কোনোমতে মাথা বাঁচিয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে পালায়। শুনতে পেল পিছনে লন্ঠনটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেছে। মশারি তোশক মুহূর্তে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে।

ঊর্ধ্বশ্বাসে অনির্বাণ ছুটতে লাগল গ্রামের লোকবসতির দিকে। ওদিকে ধীরে ধীরে আগুন বাড়তে বাড়তে সম্পূর্ণ বাড়িটাকে গ্রাস করে ফেলল। ছুটতে-ছুটতে অনির্বাণ অনুভব করল একটা মিশকালো ঝোড়ো হাওয়ার স্তম্ভ দ্রুত এসে তাকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা অনির্বাণকে প্রান্তরের উপর দিয়ে সবলে টানতে-টানতে নিয়ে চলল শ্মশানের দিকে।

পরদিন ওকে ভবানী মন্দিরের গর্ভগৃহে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। অনির্বাণ তখন বদ্ধ উন্মাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *